হাম-সফর এক্সপ্রেস
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
কাল ‘হাম-সফর’ এক্সপ্রেসে হাওড়া অবধি এলাম । প্রায় তিন ঘণ্টা বিলম্বে ট্রেন এসে পৌঁছল হাওড়ায় । আমার স্ত্রী এবং আমি বেঙ্গালুরু থেকে ওই ট্রেনে এলাম। যদিও ট্রেন তিন ঘণ্টা বিলম্বে এসে পৌঁছল কিন্তু সত্যি আমাদের রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি। আমাদের সঙ্গে ইণ্ডিয়ান অয়েলের এক পদস্থ অবসরপ্রাপ্ত অধিকারী সহযাত্রী ছিলেন । উনি আমাদের নানা কথায় ভুলিয়ে রেখেছিলেন যার জন্য ওই যাত্রার কষ্ট লাঘব হয় আপনা হতে । একে একে উনি তাঁর জীবনের নানা ঘটনাবলীর বর্ণনা দিয়ে আমাদের দুজনাকে মুগ্ধ করে রাখেন। ভদ্রলোকের যেমন অমায়িক ব্যাবহার ঠিক সেইরকম অত্যন্ত সাদা মাটা পোশাক পরিচ্ছদ। আমার খুব ভালো লাগছিল ওনার সঙ্গে কথা বলে ।
প্রসঙ্গে আসি। খুব কম বয়েসেই ওনার বাবা ইহ-ধাম ত্যাগ করেন। তখন তিনি যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে সবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতক। ওনার মা দুই বোন এবং এক ভাই এর সংসার । ওনার বাবার অবর্তমানে উনি টিউশনি করে অতি অল্প বয়েসেই সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। এরপর আরও জোয়াল টানার জন্য ভদ্রলোক ইণ্ডিয়ান অয়েলের প্রবেশনারি ইঞ্জিনিয়ার ভাবে চাকরি সুরু করেন । পরে ধাপে ধাপে উচ্চ পদবিতে নিজের কর্ম নিপুণতা এবং সচ্চোট অধিকারী হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রমুখ সহরে কাজ করার সুযোগ পান। তাঁর সমস্ত বাসনা আকাঙ্ক্ষা কে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর মা , তাঁর কাছ থেকে কর্তব্য হিসেবে তার ছোট ভাই বোনেদের মানুষ করিয়ে নেন। কথাটা হয়ত খুব কটু কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তব আমার যা ধারনা ।
প্রসঙ্গে আসি। খুব কম বয়েসেই ওনার বাবা ইহ-ধাম ত্যাগ করেন। তখন তিনি যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে সবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতক। ওনার মা দুই বোন এবং এক ভাই এর সংসার । ওনার বাবার অবর্তমানে উনি টিউশনি করে অতি অল্প বয়েসেই সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। এরপর আরও জোয়াল টানার জন্য ভদ্রলোক ইণ্ডিয়ান অয়েলের প্রবেশনারি ইঞ্জিনিয়ার ভাবে চাকরি সুরু করেন । পরে ধাপে ধাপে উচ্চ পদবিতে নিজের কর্ম নিপুণতা এবং সচ্চোট অধিকারী হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রমুখ সহরে কাজ করার সুযোগ পান। তাঁর সমস্ত বাসনা আকাঙ্ক্ষা কে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর মা , তাঁর কাছ থেকে কর্তব্য হিসেবে তার ছোট ভাই বোনেদের মানুষ করিয়ে নেন। কথাটা হয়ত খুব কটু কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তব আমার যা ধারনা ।
আমি ভাবি যেহেতু তিনি বড় ছেলে এবং সংসারের এক মাত্র রোজগারক্ষম পুত্র সন্তান তাই সেটাই তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। অবশ্য এটা আমার বক্তব্য।
ভদ্রলোক সারা জীবন অবিবাহিত থাকেন । দুই বোনকে পাত্রস্থ করেন এবং তাদের সমস্ত আবদার রক্ষা করেন । ছোট ভাইকে ওনার মা বিয়ে দেন । এরপর ছোট ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের মানুষ করার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে পড়ে । ছোট ভাই কোন চাকরি এক দু মাসের বেশি করেন না। মায়ের মতে ওনার ছোট ছেলে ওই কষ্টের চাকরি করতে পারবে না। ভদ্রলোক মৃদু হাসেন । আমায় বলেন জমিদারের ছেলে কিনা ! ও কি করে কষ্টের চাকরি করবে ?
ভদ্রলোক সারা জীবন অবিবাহিত থাকেন । দুই বোনকে পাত্রস্থ করেন এবং তাদের সমস্ত আবদার রক্ষা করেন । ছোট ভাইকে ওনার মা বিয়ে দেন । এরপর ছোট ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের মানুষ করার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে পড়ে । ছোট ভাই কোন চাকরি এক দু মাসের বেশি করেন না। মায়ের মতে ওনার ছোট ছেলে ওই কষ্টের চাকরি করতে পারবে না। ভদ্রলোক মৃদু হাসেন । আমায় বলেন জমিদারের ছেলে কিনা ! ও কি করে কষ্টের চাকরি করবে ?
আমি বলি , জমিদারের ছেলে মানে ? সে কি ? আশ্চর্য ! তা বলে চাকরি করবেনা ?
ভদ্রলোক হেঁসে বলেন আমার বাবাও জমিদারের ছেলে ছিলেন কিনা তাই ! উনি খুব সুপুরুষ ছিলেন,বলে মোবাইলে একটা ফটো দেখালেন। আমার ছোট ভাইটি ঠিক আমার বাবার মতন দেখতে। দেখুন । ছোট ভাই কিন্তু পরের কম্পার্টমেন্টে । ভেস্টিবিল বলে যাতায়াত অনায়াসে করা যায়। ছোট ভাইয়ের কাছে তার ছেলে আছে।
আমি দেখলাম সত্যি ওনার বাবার সুন্দর চেহারা । যাকে বলে কন্দর্প কান্তি। আমি বলি সত্যি খুব সুপুরুষ ছিলেন ।
পিতৃ নিন্দা করবোনা ওটাই ওনার প্লাস পএন্ট । ভদ্রলোক হেঁসে বলেন।
আমি মনে মনে ভাবি উত্তর কোলকাতায় আমার শ্বশুর বাড়ীর কাছে অনেক ঘরেই এই এক সমস্যা আমার চোখে পড়ে । মা এক ছেলের কাঁধে জোয়াল রেখে অন্য ছেলে মেয়েকে মানুষ করিয়ে নেওয়া বিরল নয়। এটাকে কি বোলব “ইমোশনাল ব্ল্যাক মেলিং” ছাড়া । কথাটা হয়ত কটু শোনাচ্ছে কিন্তু এটাই বাস্তব।ভদ্রলোকের বাবার অবর্তমানে সংসারের সব দায় দায়িত্ব বড় ছেলের কাঁধে দিয়ে অন্যদের আবদার দেওয়া এটা কিরকম কথা ! এটা হয়ত সৎ মা করতে পারেন কিন্তু নিজের মা ! তিনি কি করে এরকম পক্ষ পাতিত্য করতে পারেন বড় ছেলের সঙ্গে ! ভেবে অবাক হই ।
ওপরের ব্যাঙ্কে ভদ্রলোকের ছোট ভাইয়ের বৌ মানে বৌমা ছিলেন । ওনাকে ইনি নাম ধরেই ডাকেন । নিচের লোয়ার ব্যাঙ্কটা আমার স্ত্রী র । ঐখানে ওনার ছোট ভাইয়ের মেয়ে শুয়ে ছিল। আমি বলি , ও ত বাচ্চা মেয়ে ওকে মিডল বার্থে দিয়ে তলার বার্থটা আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে কারন ও ট্রেনের ধকল সামলাতে পারে না । তাই হল।
এরপর আমি চা আনালাম । সকলে খেলাম । আমি টাকা পেমেন্ট করাতে ভদ্রলোক একটু মন ক্ষুণ্ণ হলেন । আমি কথাটা ঘুরিয়ে দিলাম অন্য কথায়।....
ভদ্রলোক সুরু করেন আমাদের আদি বাড়ি যশোর অধুনা বাংলা দেশে। বাবাকে আমার দাদু রেলের চাকরি দিয়ে ছিলেন। আমরা মোগল সরাই তে অনেক দিন কাটিয়েছি। দাদু কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা ছিলেন তাই বিনা পণে আমার বাবাকে জামাই বানিয়ে ফেলেন। বাবা রেলের চাকরি পেয়ে ভারি খুশি কিন্তু ওই যে বললাম, জমিদারের ছেলে ! সে কি মন দিয়ে চাকরি করে ? প্রায় দিন অফিস কামাই । দাদু সামলাতেন । ক্রমে সংসার বাড়ে । আমার নিচে দুই বোন , এক ভাই । দুই ভাই , দুই বোন , বাবা , মা সর্বমোট ছয় জনের সংসার । দাদু পুরোটা সামাল দিতেন। উনি রেলের বড় পদাধিকারী ছিলেন তাই বাড়িতে কোন জিনিষের খামতি ছিলনা । তা ছাড়া আর্দালি এসে ঘরের অনেক কাজ করত । আমার ভাই তাই বাবার মতন আয়েসি হতে সুরু করে। ওকে কি দোষ দি বলুন । আমার ত জোয়াল টানার আছে কপালে।
দাদু বিচক্ষণ লোক ছিলেন। তিনি কিছুটা আন্দাজ করেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাই আমাকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায় বড় মামার বাড়ি। সেখানে থেকেই আমার পড়াশোনা। ভাগ্যিস মামা আমাকে পড়িয়ে ছিলেন নাহলে মূর্খ হয়ে বসে থাকতাম। কথাটা বলে হাঁফ ছাড়লেন। আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম । ক্রমে টিউশনি সুরু করে নিজের পড়ার খরচ কিছুটা যোগাড় করতাম। কাউকে কিছু বলতাম না। এরপর যাদবপুরে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতক হওয়ার পর বাবার মৃত্যু সম্বাদ আসে । মা সব ভাই বোন কে নিয়ে মামার বাড়ি ওঠেন। ব্যাস সুরু হয় দুর্দিনের সংসার । মামা ক্রমে থাকার ঘর দিয়ে গা ঢাকা দেন কারন তখন দাদু ও বিগত। আমার ওপর সমস্ত সংসারের দায়িত্ব । এরপর ভগবানের দয়ায় ইণ্ডিয়ান অয়েলের প্রবেশনারি ইঞ্জিনিয়ার ভাবে চাকরি সুরু করি। কোনদিকে চোখ রাখিনি । চাকরি ছাড়া আমার কোন দিকেই নজর ছিলোনা । মাইনের টাকার এনভেলাপ টা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছি। কত আছে কোন দিন গুনে দেখিনি। আমার পকেটে বাস ভাড়া ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকতো-না । বন্ধুরা অনেক টিটকিরি মেরে কথা বলত কিন্তু আমার এক লক্ষ্য ভাই বোন কে মানুষ করা । এর মধ্যে ছোট ভাই টয়লেট সেরে তাঁর বার্থে যাচ্ছিলেন । আমাদের এড়িয়ে চলে গেলেন দেখলাম। ছোট ভাইয়ের ছেলে এসে বলে জ্যাঠা চায়ের পয়সা দাও নয়ত বাবা চা ফেলে দেবে। খুব রেগে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন তোরা কিছু খেয়েছিস?
ছেলেটি বলে না । এই নে ২০০ টাকা তোদের পছন্দ মতন খাবার খা । সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাইয়ের বৌ দেখলাম উঠে চলে গেলেন তাঁর পুত্র কন্যা কে নিয়ে পতির বার্থের উদ্দেশ্যে ।
ভদ্রলোক আমাদের চা খাওয়ালেন । চা খেতে খেতে সুরু করেন ওই ছেলে মেয়ে দুজনের স্কুলের খরচ কত জানেন ?
কত ?
জোকা র , দিল্লী পাবলিক স্কুলে পড়ে দুজনে । বছরে এডমিসন খরচ ২ লক্ষ টাকা তা ছাড়া ড্রেস বই খাতা , জুতো ইত্যাদি। এছাড়া প্রত্যেক বছর ডোনেশন চায় সে প্রায় ৪০-৫০ হাজারের কম নয়। আমি যতদিন আছি সব খরচ দেব কিন্তু আমার অবর্তমানে কি হবে। মা গত হয়েছেন ২০১৫ তে । আমার শরীর খুব একটা ভালো নেই । সুগার,ব্লাড প্রেশার সব ই আছে। কখন কি হয় বলা যায় না। নিজের দিকে কোনদিন তাকানোর ইচ্ছে করেন।
আমি বলি দেখুন আমাকে এইসব আপনার বলা কি ঠিক হল ? আপনার ভাই , বৌমা , ছেলে মেয়ে কি ভাবলো বলুন ত আমাকে? আমার ত এসব শোনার কথা নয়।
ভদ্রলোক কে খুব অসহায় মনে হল এই কথা শোনার পর । উনি বলেন আপনাদের দুজনকে আমি কথাগুলো বলে হাল্কা হলাম। আমার জীবনে এরা ছাড়া আর কেউ নেই। দুশ্চিন্তা হয় মাঝে মাঝে । অনেক বোঝাই । কিন্তু কোন কিছু হবে বলে মনে হয়না।
আমি ওনাকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে বলি যদি কোন দিন আমায় মনে পড়ে তবে ফোন করবেন। আমি আপনার পাসে থাকতে চেষ্টা করব ।
উনি বলেন আরে না না । আপনি কি করবেন ? আমার যা জমান টাকা আছে তার সিংহ ভাগ আমার ছোট ভাই আর তার বৌয়ের নামে ফিক্স করা। এরা যদি আমার বার্ধক্য বয়েসে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয় আমি কোথায় যাবো? বলে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন !
এটা ত খুব অন্যায় । আপনি নিজের ব্যবস্থা না করে সমস্ত টাকা ........
জ্যাঠা হাওড়া ষ্টেশনে ট্রেন ইন করছে ।
হ্যাঁ বাবা চল এবার উঠি । নমস্কার । আবার যদি বেঁচে থাকি তবে দ্যখা হবে হয়ত !
প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলি , ও মা সে কি ? বেঁচে থাকবেন না কোন দুঃখে শুনি ! আমি ওনাকে অবাক নয়নে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম সত্যি এই রকম মানুষ ও আছে এই দুনিয়াতে । সত্যি উনি মহান ।
আমি আমার ছেলেকে ট্রেনের অবস্থিতি সম্পর্কে রাস্তায় ফোনে সূচনা দিতে দিতে কখন ট্রেন এসে পৌঁছে গেল হাওড়া ষ্টেশনে । অফিস থেকে আমার ছেলে সোজা নিতে এলো।
তোমাদের রাস্তায় কোন অসুবিধে হয়নিত বাবা !
না না এবারে রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি , আমি বলি ।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ছেলের পরিচয় করিয়ে দিলাম । উনি আমাদের ওনার গড়িয়ার নতুন ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়ে আস্তে আস্তে এগুলেন একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে প্ল্যাট ফর্মের ওপর । আমি তাকিয়ে ছিলাম ওনার চলার পথের দিকে অবাক নয়নে ..................
১৩০৭ শব্দ
No comments:
Post a Comment