Wednesday, May 3, 2017

কেয়া চক্রবর্তী মৃত্যু - হত্যা ? দুর্ঘটনা ? আত্মহত্যা ?


  কেয়া চক্রবর্তী মৃত্যু - হত্যা ? দুর্ঘটনা ? আত্মহত্যা ? 
   


অঞ্জন দত্ত 
১৩ মার্চ রবিবার সকাল দশটায় পোর্ট পুলিশের লঞ্চ সাঁকরাইল থেকে এক ঘণ্টার উজানে হীরাপুরের কাছে কেয়া চক্রবর্তীর মৃতদেহ উদ্ধার করে, জানাচ্ছে পরদিন ১৪ মার্চের ‘আনন্দবাজার’। ‘কেয়ার মৃতদেহে তিন চারটি ক্ষত দেখা দেয়। তাঁর হাত দুটি ভাঙ্গা। মুখে আঘাতের চিহ্ন। তাঁর হাত ভাঙলোই বা কি করে?… গঙ্গার জলের তোড়ে, স্টিমারের প্রপেলারের ঘায়ে? না ধস্তাধস্তির চোটে…?’ লিখছে এক হপ্তা পর ২০ মার্চের ‘যুগান্তর’।
আসল কেয়া নিজের জীবনখানায় ছিলেন কেমন?
নীললোহিতের একটা উপন্যাস আছে ‘তোমার তুলনা তুমি’। উপন্যাসের ওই নামখানা কেয়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু কেয়ার তুলনা বোধ হয় কেয়া কেবল নিজেই। একদিকে স্কটিশ চার্চ কলেজের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে নিরন্ন গ্রুপ থিয়েটারে হোল-টাইমার হতে চাইছেন। অন্যদিকে সশস্ত্র নকশালদের হাত থেকে অসহায় তরুণকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন নির্দ্বিধায়, ধস্তাধস্তিতে খুলে যাচ্ছে পরনের শাড়ি। একদিকে নিজের বিয়ের গয়না আর মায়ের জমানো গয়না বেচে দাঁড় করাতে চাইছেন অজিতেশ-রুদ্রপ্রসাদের ‘নান্দীকার’। অন্যদিকে নিজের খরচ চালাতে জুতোর কোম্পানিতে (‘বাটা’) বসে বিজ্ঞাপনের কপি লিখছেন নীরবে।আর দুর্দম সাহসে মা’কে নিয়ে একাই বেড়াতে যাচ্ছেন নাগাল্যান্ড-মণিপুর। এবং মায়ের বুকে পেস-মেকার বসানোর খরচ টানতে শেষটা সিনেমায় নামছেন।
কার্যত দেশের শেষ প্রান্ত নাগাল্যান্ড-মণিপুরে বেড়াতে যাওয়ার নামে আজও অ্যাভারেজ বাঙালি চারবার ভাবে, কোন নামী ভ্রমণ সংস্থা ওসব রাজ্যে বেড়ানোর ট্যুর অ্যারেঞ্জ করে না। আর কেয়া ব্যাপারটা সেরে ফেলছেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেই !
আইএ পাশ করার পর হঠাৎ ঠিক করলেন রাতের কলকাতা দেখতে বেরোবেন। তাই-ই করলেন। দেওয়াল পত্রিকায় বন্ধুরা যখন কাঁচা হাতে মকশো করে, তখন তিনি লেখেন নিখুঁত সনেট। হইহই পড়ে যায় তা নিয়ে।যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, তখন কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর নিবন্ধের বিষয় হয় ‘রবীন্দ্রমানসে মৃত্যু’। তিনি লেখেন, ‘অন্ধকারের ঝরনা থেকে আমাদের জীবন শুরু। অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মধ্যেই মৃত্যুর আক্রমণ। মানুষ কিন্তু কোনও দিনই মেনে নিতে পারেননি মৃত্যুর এই আক্রমণ।’’
অধ্যাপনার চাকরি পেলেন। নিজেরই কলেজে। কৃতজ্ঞতা জানাবেন মাস্টারমশাইকে। সটান চলে গেলেন স্টাফ রুমে। ‘গুরু’ তরুণ সান্যালের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এলো চুল তাঁর পায়ে বিছিয়ে দু’পায়ে চিমটি কেটে বললেন, ‘‘গুরুদক্ষিণা।’’
কালে কালে অভিনয়ের নেশা ওঁকে বুঁদ করে ফেলল। পড়ুয়া থাকার সময়ই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে উনিশ বছর বয়েসে নান্দীকার-এর ‘চার অধ্যায়’-এর এলা হলেন। শুধু যে অভিনয় তা নয়, দলের প্রত্যেকের সুখদুঃখ, টাকাপয়সা, সেটসেটিং, পোশাকআশাক, বিজ্ঞাপন লেখা, টিকিট ছাপানো, এর পরে কী নাটক হবে, কেমন করে হবে, সবেতেই তিনি। এমনকী আলাপ-আলোচনায় তর্কযুদ্ধেও। সে’ও ভারী সিরিয়াস ঢঙে। একবারের কথা যেমন। নান্দীকার-এর ঘরে তমুল তর্ক সে দিন। অজিতেশ বনাম কেয়া। সন্ধে পেরিয়ে রাত....পরদিন দেখা গেল কেয়া আসছেন রিকশা চেপে। সঙ্গে অসংখ্য বই। তার পাতায় পাতায় কাগজের ‘ফ্ল্যাপ’ লাগানো। এ দিনও তর্ক শুরু হতে একের পর এক বই খুলে নমুনা, উদ্ধৃতি দিতে থাকলেন। একটা সময়ের পর হার মেনে নেন কেয়ার ‘অজিতদা’।
অভিনয়টা যখন করতেন তাতে যে কতটা সম্পৃক্ত হতেন, দেখা যেতে পারে সাহিত্যিক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষের বয়ান থেকে।— ‘‘আন্তিগোনে দেখবার স্মৃতিটা আমার সাঙ্ঘাতিক। সাধারণত কেয়া-রুদ্র (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) যখন আমাকে নেমন্তন্ন করত তখন একটু আগেই আমি যেতাম। ব্যাপারটা হত অদ্ভুত। কেয়া তখন শিশু হয়ে যেত। অপেক্ষা করত যে ও স্টেজে ঢোকবার আগেই যাতে আমার সঙ্গে দেখা হয়। ... ওই দিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ... ঢোকার মুখেই রুদ্রর সঙ্গে দেখা। রুদ্র আমাকে একেবারে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল সাজঘরে। আমি কেয়াকে খুঁজে পাইনি। এ রকম আমার একদম হয় না। তারপর আমি দেখলাম, কেয়া আর নেই। আন্তিগোনে বসে আছে। পুরোপুরি। কেয়া আমার হাতটা চেপে ধরল।’’
তাঁর ‘তিন পয়সার পালা’ দেখে গৌরকিশোর সোজাসুজি বলে দেন, "কেয়ার মতো অভিনেত্রী বাংলায় আসেনি।’’
মায়ের ‘পেসমেকার’ বসানোর দিন শো করতে পারেন কেউ? তা’ও আবার একটা নয়, দু-দুটো! পৌনে তিনটে নাগাদ হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকলেন। দুটো শো করে কাউন্টারের সামনের সিঁড়িতে বসে পরের দিনের বিজ্ঞাপনের ‘ম্যাটার’ তৈরি করলেন। তার পর আবার ছুটলেন হাসপাতাল।
বিয়েতে শুভদৃষ্টি হচ্ছে। তখনও নাটক। এমনিতে পুরোহিত ইত্যাদি ছিল না। বোধ হয় লঘুচ্ছলে ওই আচারটুকুই হচ্ছিল। ‘‘সেই সময় অজিতেশবাবু এলেন। সম্ভবত তখন ‘তিন পয়সার পালা’ চলছে। ...কেয়া চেঁচাতে লাগল... ‘পরের শো কবে? কী? কোথায়?’ কোনও ক্রমে দু’জনকে থামানো গিয়েছিল,’’ স্মরণ বন্ধু ইন্দিরা দে-র।
বেতারে তখন একটা পরীক্ষামূলক সাহিত্য-অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। রিডিং ড্রামা। একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী একটি নাটক একাই পড়ে যাবেন। সংলাপের মাঝে দৃশ্য-নির্দেশও পড়তে হবে নির্লিপ্ত গলায়। নাটক ঠিক হল কবি কৃষ্ণ ধরের ‘বনজ্যোৎস্না’। চারটি চরিত্র। দু’জন পুরুষ। দু’জন নারী। কেয়াকে ধরলেন প্রযোজক। উনি তখন ঘোরতর শয্যাশায়ী। তাতে কী, শুনেই বললেন, ‘‘বাহ্, বেশ নতুন রকমের তো। আমি করব।’’তাঁর অসুখের কথা ভেবে স্ক্রিপ্ট পাঠানোর কথা উঠল বাড়িতে। তারও দরকার পড়ল না। আধ ঘণ্টার মধ্যে ট্যাক্সি করে হাজির হয়ে গেলেন ‘আকাশবাণী’। সে দিনের মতো আলোচনা সেরে পরদিন দিব্যি রেকর্ডও করলেন।
একটি সাক্ষাৎকারে কেয়াকে বলতে দেখা যায়, ‘‘যদি মহিলা প্রকৃত অর্থেই সাধিকা হন, তা হলেই কিন্তু তাঁকে সামাজিকভাবে নিন্দিত হতে হবে। তাঁর স্বামী হয়তো, যে গান শুনে এক কালে তাঁকে ভালবেসেছিলেন, সেই গানের চর্চায় বেশি মন দেবার অপরাধে, পাশের বাড়ির বৌটিকে দেখে আহ্লাদিত হবেন— ভাববেন— আহা বৌটি কেমন সুন্দর, সংসার করে, রাঁধাবাড়া করে, সেজেগুজে থাকে। আর যে-মা অসুস্থ ছেলেকে ছেড়ে শো করতে গেল, তাকে তো ডাইনি মনে করা হবে।’’ স্পষ্ট ভাষায় কেয়া বলে দেন, বিছানা, রান্নাঘর, আঁতুড়ঘরের বাইরের জীবনে যেতে স্ত্রীদের ভূমিকা স্বামীরা কতটা মানতে রাজি, তার ওপরেই নির্ভর করে ঘরনির চৌকাঠ পেরনো !
মঞ্চটা তাঁর মন্দির হলেও কলেজে পড়াতে যে কোনও খামতি ছিল, তা কিন্তু নয়। বরং তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা ‘ইনোভেশন’ কাজ করত। ভাবনার ঋজুতা, জিতে নেওয়ার জেদ, আগলে রাখার মন চোখে পড়ত।বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রী, যারা ইংরিজি বলতে গিয়ে থমকায়, কলেজ বসার আগে তাদের লাইব্রেরিতে আলাদা ক্লাস নিতেন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে ‘ওথেলো’, ‘হ্যামলেট’-এর রেকর্ড আনিয়ে শোনাতেন। উচ্চারণ শুধরে দিতেন।
‘‘(কেয়াদি) ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ পড়াতেন জেনারেল ইংলিশ ক্লাসে। অনার্সে ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’। ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অভিনয় করাতেন। তাদের তর্কবিতর্কে টানতেন। এটাই ওঁর পড়ানো,’’ একটি লেখায় বলেছেন তাঁর ছাত্রী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়। কেউ কেউ আবার বলেন, এক-এক সময় মনে হত, ক্লাসের ডায়াসটা হয়ে উঠেছে নাটমঞ্চ।পড়ানোর আগে-পরে চলত নানা ধরনের গল্প। ঠিক গল্প নয়, শিল্পীর আত্মদানের কাহিনি। ‘‘লরেন্স অলিভিয়ার যখন ওথেলো অভিনয় করেন, তখন কী ভাবে হরমোন ইনজেকশন নিয়ে চেহারার বদল এনেছিলেন... ওঁর বলাতে গায়ে কাঁটা দিত,’’ স্মৃতি বোলানের।
১৯৭৭। ১৪ মার্চ। শহর জুড়ে সবার গন্তব্য সে দিন উত্তর কলকাতার ২০এ, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট। সন্ধে নামার একটু আগে শববাহী কাচের গাড়িতে ওই বাড়ির সামনে আনা হল অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীকে। শ্যাওলা রঙা মুখটুকু তখন জেগে শুধু। সারা শরীর ফুলে মোড়া।
দু’দিন আগে ‘জীবন যে রকম’ ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে মাঝগঙ্গায় তলিয়ে যান তিনি। আগের দিনই সকালে সাঁকরাইলের ঘাটে ভেসে ওঠে তাঁর দেহ। রাস্তায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভিড় ঠেলে কোনওক্রমে আনা হল ওঁর মা লাবণ্যকে।
চরিত্রটি এক অন্ধ মায়ের। লঞ্চে করে মা-ছেলে যেতে যেতে জলে পড়ে যায় ছেলে। তাকে বাঁচাতে মা’ও ঝাঁপ দেয় মাঝদরিয়ায়। এই দৃশ্যেরই শ্যুটিং করতে গিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান বছর পঁয়ত্রিশের কেয়া।
মাত্র চৌত্রিশ বছরে জীবন নাট্যের ইতিরেখা টেনে যবনিকার অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী। ১৯৭৭ সালের ১২ মার্চ ৷
জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছিল কেয়া চক্রবর্তীর,মাত্র ৩৫ বছরে৷ সাঁকরাইল থেকে পাঁচ মাইল দূরে হীরাপুরে ভেসে এসেছিল তাঁর কাদামাখা, কচুরিপানা জড়ানো দেহ ৷
'জীবন যে রকম' ছবির শ্যুটিংকালে লঞ্চ থেকে কেয়ার পতন এবং মৃত্যু, কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যু নিয়ে চাপানউতোর চলে বহু দিন। মাঝগঙ্গায় শ্যুটিং করার অনুমতি ছিল তো? ডামি নয়, অভিনেত্রী স্বয়ং কেন ঝাঁপ দিলেন জলে? জাল পাতা ছিল? লাইফবোট? সাঁতার না-জানা কেয়া এই ঝুঁকি নিলেন কেন? তাঁকে কি জোর করা হয়? না কি তিনিই জোর করেন পরিচালককে? নিছক দুর্ঘটনা? না কি আত্মহত্যা? হত্যা নয় তো? কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল কি? নাকি পরিবার ,কেরিয়ার , দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে তিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন জলে? আর তারপর শাড়ি জড়িয়ে যায় লঞ্চের প্রপেলারে৷ লঞ্চ এগিয়ে যায়, যাওয়ার পথে মারণ আঘাত করে যায় তাঁর মুখে ,মাথায় ! ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতা পুলিশের তদন্তও চলে দীর্ঘদিন৷ একটা সময়ের পর ফাইল বন্ধ হয়ে যায়৷ প্রশ্নের উত্তর থেকে যায় অজানাই ৷
অরুণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন , 'কেয়ার অভ্যাস ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমানো৷ এমনকি রিহার্সালের মধ্যে দশ মিনিটের
ব্রেক থাকলেও ও ঘুমিয়ে পড়ত৷ গঙ্গা থেকে যখন ওকে পাওয়া গেল , তখন ওর মুখ সামান্য ফোলা ৷ আমার মনে হয়েছিল, ও ঘুমিয়ে আছে ৷ '
কিংবা কবিতা সিংহ যেভাবে দেখেছেন :'কেয়ার দেহ পচতে আরম্ভ করেছে৷ অনেকক্ষণ জলে ছিল , এখন রোদে ৷
আমি তার ঈষত্ নীলবর্ণ মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম৷ মুখের বাঁ পাশ সুন্দর৷
ডান পাশ ফুলে ঝুলে পড়েছে৷ সেখানে একটি গভীর দাগ ৷'
নান্দীকারে কেয়ার বন্ধু রাধারমণ তপাদারের মনে পড়েছিল : ' কেয়ার খুব খৈনির নেশা ছিল৷ আমি ছিলাম ওর সাপ্লায়ার৷ শ্যুটিং থাকলেই বলতো , 'রাধুদা , আজ শ্যুটিং আছে৷ বেশ অনেকটা বানিয়ে দিন৷'. . যখন কেয়ার বডি পাওয়া যায়, তার মুখের ভেতর তখনো ছিল অনেকটা না খাওয়া খৈনি ৷'
'মিসেস আর পি সেনগুপ্ত ' ৷ এই শিরোনামেই এক নাট্যপত্রিকায়
রম্যরচনা লিখেছিলেন কেয়া ৷ তাতে সংসারে তাঁর ফ্রাসটেশনের
দিকটা কিন্ত্ত খানিক ধরা পড়ে ৷ তিনি লিখেছেন , 'এই নিয়ে ৬ বার
উঠলাম- - মানে এই লিখতে বসে আধ ঘণ্টাটাকের মধ্যে৷ একবার গয়লা এল, সদর দরজা খুললাম ৷ স্বামী গেঞ্জি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, খুঁজে দিলাম .. . টেলিফোন এল দুটো' ৷ কিংবা , 'আজ সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা ছবি দেখতে যাব ভেবেছিলাম ৷ অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস- এ ৷ উনি মানা করেছেন. .৷' একসময়ে শুধুমাত্র নাচ নিয়ে থাকতেন যিনি, সেই ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়কে পাকাপাকি নাটকের
দিকে নিয়ে আসায় উত্সাহ দিয়েছিলেন কেয়াই ৷ ঊষা -র কথা থেকে জানা যাচ্ছে , 'আমি ওর যন্ত্রণাকে জানি .. . ছোটবেলাতে একটা পারিবারিক যন্ত্রণা , কলেজ জীবন এবং তার পরেও এক যন্ত্রণা , কি সে যন্ত্রণা , কেন ? কি? জানাতে পারবো না৷ লেখা যাবে না, একান্তই পার্সোনাল. ..৷ ' কেয়ার স্কটিশ চার্চ কলেজের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিবেকানন্দ রায়ের কথাতেও রয়েছে একই রকমের আভাষ৷ তাঁর কথায়: ' তিন বছর কেয়ার মনোজগতে যে আলোড়ন চলছিল. .. ছিল
দুই পুরুষের মাঝখানে তার দ্বিধা ৷ তাঁদের নামোল্লেখ থেকে বিরত থাকলাম ৷ সম্ভবত দু 'জনেই তার পাণিগ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন ৷ কোনও এক জনকে না বলা কেয়ার সাহসে কুলোত না. ..'
"সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন একটি পত্রিকায় লিখেছেন - অজিতেশের কথা ভাবলে আমার চোখে ভেসে ওঠে অন্য এক ছবি। কেয়ার শেষ যাত্রায় , আমাদের আগে আগে চলন্ত সব চেয়ে উঁচু , এলোমেলো চুলের মাথাটা।"
কেয়া শুধু বড় অভিনেত্রীই ছিলেন না ,দলের সবার প্রতি তাঁর একটা অদ্ভুত ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ ছিল ,দল বাঁচাতে নান্দীকার-এর দুঃসময়ে গয়না বন্ধক রেখেছিলেন , চাকরী ছেড়ে নিজেকে পুরোপুরি থিয়েটারে সমর্পন করেছিলেন , তাঁর নীতিবোধ এতই দৃঢ় ছিল যে, তিনি 'স্কটিশ চার্চ কলেজে'র শিক্ষকতা থেকে ১৯৭৪ সালে ইস্তফা দিলেন , কেননা তাঁর মনে হয়েছিলো নাটকের জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় তাঁর পক্ষে শিক্ষকতার কাজে যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না , চাকরী থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে উনি নান্দীকার-এর প্রচারের দায়িত্ব নিযেছিলেন।
অজিতেশকে গুরু বলে মেনে জীবনটাকে থিয়েটারে নিমজ্জিত করে দিয়েছিলেন , শো-এর আগে অজিতেশের পা ছুঁয়ে প্রনাম করে স্টেজে নামতেন , সব নাটকেই অজিতেশ কিংবা কেয়ার জুটির টানটান লড়াই ছিল উপভোগ করার মতো , শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের পর বাংলা নাটক পেয়েছিল এই দুরন্ত জুটিকে , নান্দীকারের ভেতরকার দ্বন্দ্ব যখন বেসামাল অবস্থায় এসে পৌঁছতো সেই অবস্থাকে সামাল দিতে 'কেয়া চক্রবর্তী'র অনন্য ভূমিকা ছিল , দলের মধ্যে ব্যক্তিগত সংঘাত যতই প্রকট হোক না কেন 'কেয়া চক্রবর্তী'র হস্তক্ষেপে সেই দ্বন্দ্বের নিরসন হতো।
‘চলচ্চিত্রের কিছু ক্রিমিনালের গাফিলতিতে বাংলা নাটকের কতবড় ক্ষতি হয়ে গেল সেটা কি চলচ্চিত্রের অভিনেতৃবৃন্দ কোনোদিন বুঝবেন? এ যেন নাট্যকর্মীদের বৃহত্তর আত্মহত্যার প্রতীক।’ – কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যুতে এভাবেই ঝলসে উঠেছিলেন উৎপল দত্ত।

2 comments:

  1. Facebook e Keya Chakraborty r ekta page khola hoyechhe. To archive her achievements and memories that have strangely been pushed away by the media. Hardly anything can be found on the net or on Nandikar website. If you can help contribute to her memory, pls visit the page and get in touch with the admin.

    ReplyDelete
    Replies
    1. https://www.facebook.com/keya.chakraborty.1675275

      Delete