
২২শে শ্রাবণ ... ৭ই আগস্ট
তথ্য সংগ্রহ ও রচনা - অনীক ত্রিবেদী
আজ সন্ধ্যে টা একটু অন্যরকম। বাড়িতে অনেক লোক। উৎসবের সময় যেমন হয় অনেকটা সেরম। একটা বিরাট কিছু বোধয় ঘটবে। কিছু মানুষ গুরুদেবের চারিধারে ফিসফাস স্বরে কথা বলাবলি করছে। বাড়ির কিছু মেয়ে মাথার কাছটায় বসে। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন গুরুদেব। ওরা সেই দিকেই তাকিয়ে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বিকেল থেকে। রাতের সাথে সাথে টানও বাড়তে লাগল। যমে-ডাক্তারে টানাটানি। কারো ঘুম হল না । আতঙ্কের সে রাত কি দীর্ঘ কি দুঃসহ। খান খান করা স্তব্ধতার মধ্যে বেশ দূর থেকে শ্বাসটানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অতন্দ্র নিশিযাপন চলল জোড়াসাঁকোয়।
আতঙ্কের দীর্ঘরজনীর যারা সাক্ষী ছিল, ভোরের দিকটায় তাদের অনেকেই ক্লান্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন। আকাশ একটু আলো হতেই ঘুম ভাঙল, এক অনাহুত আতঙ্ক সবার মনে। এই বুঝি দুঃসংবাদ আসে। দুঃসংবাদ প্রকাশিত হল ২২ শে শ্রাবণ সকালের দৈনিক গুলোতে ‘কবির অন্তিমকাল আসন্ন’। দূর দূরান্তে খবর পৌঁছে গেলো, ফোন এলো অসংখ্যবার। কাল রাত থেকে ব্রহ্মসঙ্গীত শুরু হয়েছে। কবির রচিত গান এক এক করে গেয়ে চলেছেন এক এক জন ।তার একটা মৃদু আবহ এসে পৌঁছাচ্ছে দোতালার ঘরে। গুরুদেব হয়তো শুনতে পাচ্ছেন কিন্তু কথা বলার কোনো শক্তি নেই।
আচার্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ঘরে এলেন। মাথার কাছটায় খানিক্ষন দাঁড়ালেন। শুরু হল মন্ত্রোচ্চারণ। ব্রহ্মসঙ্গীতের আবহে আর মন্ত্রচ্চারনের শুদ্ধতায় মন্দিরের পরিবেশ তৈরি হল ঘরটায়।
দূর দূরান্তের মানুষ খবরের কাগজ দেখে উদ্বিগ্ন। এর মধ্যেই আসতে শুরু করেছে অনেকে। শ্রাবণ মাসের থমথমে আকাশ। একটুও হাওয়া নেই। বিধুশেখর শাস্ত্রী গুরুদেবের পায়ের কাছটায় এসে বসলেন। পিতা নোহসি – মন্ত্র পাঠ করছেন। সেই মন্ত্র যা রবীন্দ্রনাথ আজীবন স্মরণ করে এসেছেন।
আকাশ জুড়ে খুব আলো আজ। ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে মধ্যাহ্নসূর্য যখন প্রমূর্ত। ঘড়িতে তখন ঢং ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে মহাপ্রয়াণের প্রসাঙ্ঘাতিক মুহূর্ত। ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে আসছে জিভ। তাহলে কি থেমে যাবে স্পন্দন ?? বন্ধ হয়ে যাবে শ্বাস প্রশ্বাস ? সাঙ্গ হবে ভবলীলা ? যে হৃদয় একদিন ময়ূরের মত নেচে উঠেছিল সে হৃদয় কি তবে সবারে প্রনাম জানিয়ে বিদায় নেবে ? আত্মীয়েরা যখন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গুরুদেব তখন মগ্ন অন্তরাত্মার সাথে অন্তিম আলাপচারিতায় । মিনিটের কাঁটা সবে দশ ছাড়িয়েছে। কবির বাঁ হাত কাঁপছে। ওপরে ওঠানোর চেষ্টা করছেন। কাউকে কি ডাকছেন ? ক একজন এগিয়ে এলো। বহুসম্মানে সে কম্পমান বাহু ললাট স্পর্শ করল। তার পরেই স্থির হয়ে গেল দেহ। উত্তরণ ঘটল মরণোত্তর অন্য কোনো এক স্তরে।
No comments:
Post a Comment