Sunday, August 18, 2013

জীবনে একবার:ঝুম্পা লাহিড়ী ( ইংরাজী থেকে ভাষান্তর)

জীবনে একবার:ঝুম্পা লাহিড়ী ( ইংরাজী থেকে ভাষান্তর)


আমি এর আগে তোমাকে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি মনে করতে মনে পড়ে ইনমান স্ক্যোয়ারে আমার বাড়িতে দেওয়া তোমাদের বিদায় সম্বর্ধনারই কথা৷ তোমার পরিবার কেম্ব্রিজ ছেড়ে অন্য বাঙালী পরিবারগুলোর মত আটলান্টা বা অ্যারিজোনায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল না; আমার পরিবার-আত্মীয়রা যে সংগ্রাম আরম্ভ করেছিল তার পথে না হেঁটে তারা চলল ভারতে৷ সেটা ছিল ১৯৭৪ সালের কথা৷ আমার তখন ছ' বছর বয়স৷ তোমার বোধহয় নয়৷ আমার পরিষ্কার যেটা মনে পড়ে তা হ'ল সেই দিনের অনুষ্ঠানের আগের কয়েক ঘন্টা, পার্টির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন আমার মা৷ পালিশ করা আসবাবপত্র, টেবিলে প্লেট, ন্যাপকিন পরিপাটি করে সাজানো, ঘরময় ভেড়ার মাংস আর পোলাওয়ের গন্ধ ও বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য মা'র শখের ফরাসী সুবাস, মা প্রথমে নিজের গায়ে স্প্রে করলেন তারপরে আমার জামায়, আমি যা পরেছিলাম স্প্রে তা সাময়িকভাবে কালো করে দিল৷ সে সন্ধ্যায় আমি কলকাতা থেকে ঠাকুমার পাঠানো জামা পরেছিলাম৷ সাদা ছোট ঝুলের পাজামা, সবজে নীল কুর্তা আর প্লাস্টিকের মুক্তো লাগানো কালো ভেলভেটের জ্যাকেট৷ স্নানের সময় জামা তিনটে আমার খাটেই রাখা ছিল, আমি দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম, আঙুলের ডগাগুলো পর্যন্ত সাদা হয়ে গেছিল আর কুঁচকে ছিল৷ মা পাজামার বড় ঘেরের মধ্যে সেফটি পিন দিয়ে দড়ি পরাচ্ছিলেন, তারপরে দড়ির মধ্যে একটু একটু করে কোমরের কাপড় ভাঁজ করে আমার পেটের কাছে বেঁধে দিলেন৷ পাজামার ভেতরের সেলাইয়ে গোলের মধ্যে বেগুনি হরফে প্রস্তুতকর্তার স্টিকার৷ স্টিকারের জন্যই আমি পাজামাটি পরতে আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু মা' অভয় দিয়েছিলেন একবার ধোওয়ার পরে সিলটি আর থাকবে না আর কুর্তা দিয়ে ঢাকা থাকায় কেউ দেখতেও পাবে না৷
মা'র কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকলো৷ খাবার যথেষ্ট কিনা, সকলের জন্য হবে কিনা সাথে আবহাওয়া নিয়েও চিন্তা ছিল মা'র৷ তুষারপাতের সম্ভাবনা ছিল৷ সে সময়ে বাবা-মা বা তাদের বন্ধুদের নিজস্ব গাড়িও ছিল না৷ তোমরা সহ সকল অতিথিরাই মিনিট পনেরোর হাঁটা পথের দূরত্বে থাকতে৷ হয় হার্ভার্ড বা এমআইটির আশেপাশে বা মাস অ্যাভেনিউ ব্রিজটি পেরিয়ে৷ কেউ কিছু দূরেও থাকতো, ম্যালডেন, মেডফোর্ড বা ওয়ালথাম থেকে বাসে বা ট্যাক্সিতে আসত৷ আমার চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে মা তোমার বাবার প্রসঙ্গ তুলে বলতে লাগলেন, "আমার মনে হয় ডক্টর চৌধুরি বাড়ির লোকদের নিয়ে গাড়িতে আসতে পারেন"৷ তোমার মা-বাবা সামান্য বয়স্ক আর আমাদের তুলনায় এদেশে বেশ পুরানোও বটে৷ ওঁনারা দেশ ছেড়েছিলেন ১৯৬২ তে৷ তখনও বিদেশী ছাত্রদের এদেশে আসার ছাড়পত্রের আইন বদলায় নি৷ আমার বাবা ও তাঁদের বন্ধুরা তখনও পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ তোমার বাবার তখন পি.এইচডি হয়ে গেছে৷ আন্ডোভারের এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে তিনি সিলভার রঙের একটি গাড়ি চালিয়ে কাজে যেতেন৷ আমি বেশ কয়েকবার অনেক রাতে পার্টি শেষের পরে বা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে ঐ গাড়িটি আমাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে৷
আমার মা গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের মা'দের প্রথম দেখা৷ মা তখনও কিছু জানতেন না৷ ওঁনার মাথাটা ঘোরাচ্ছিল এবং একটি ছোট পার্কের বেঞ্চে বসেছিলেন৷ তোমার মা একটি দোলনায় বসে আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছিলেন সাথে তুমিও তাঁর উপরে ঝুঁকছিলে, মাথায় সিঁদুর আর শাড়ি পরা একজন অল্পবয়স্ক বাঙালী ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন তিনি৷ নিচু স্বরে মা’কে জিজ্ঞাসা করলেন, শরীর ঠিক লাগছে তো? তোমাকে দোলনা থেকে নেমে যেতে বললেন তারপরে তুমি আর তোমার মা মিলে মা’কে বাড়ি পৌঁছে দিলে৷ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়েই তোমার মা বলেছিলেন যে বোধহয় আপনি সন্তান-সম্ভবা৷ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা বন্ধু হয়ে গেলেন, আমাদের বাবারা যখন কাজে থাকত সেসময়টা তাঁরা একসাথে কাটাতেন৷ তাঁরা কলকাতায় ফেলে আসা জীবনের কথা বলতেন৷ যোধপুর পার্কে তোমার মা'র সুসজ্জিত বাড়ির কথা, ছাদের উপরে গোলাপ, জবাগাছের কথা আর আমার মায়ের মানিকতলায় পঞ্জাবি রেস্টুরেন্টের উপরের ছোট্ট ফ্ল্যাটের কথা যেখানে তিনটি ছোট্ট ঘরে সাতজন লোক থাকতেন৷ কলকাতায় তাদের দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল খুবই কম৷ তোমার মায়ের বাবা ছিলেন সেসময়ের কলকাতার বিখ্যাত আইনজীবিদের মধ্যে একজন৷ পাইপ খেতে অভ্যস্ত, ইংরাজপ্রেমী, স্যাটারডে ক্লাবের মেম্বার৷ তোমার মা পড়তেন কনভেন্ট স্কুলে৷ ওদিকে আমার মায়ের বাবা ছিলেন জিপিও-র ক্লার্ক৷ এদেশে আসার আগে মা কখনও টেবিলে বসে খান নি, কমোডও ব্যবহার করেন নি৷ কিন্তু কেম্ব্রিজে গিয়ে দুজনের মধ্যে কোনও পার্থক্যই ছিলনা৷ দুজনেই ছিলেন সমান একা৷ বাজারে যেতেন একসাথে, উভয়ই স্বামীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতেন, রান্নাও হত তোমাদের বা আমাদের স্টোভে৷ রান্না হয়ে গেলে নিজেদের মত ভাগ করে নিতেন৷ উল বুনতেন দুজনে মিলে৷ বুনতে বুনতে একঘেয়েমি এলে পাল্টাপাল্টি করে নিতেন৷ আমি যখন জন্মালাম, বন্ধু হিসাবে তোমার বাবা-মা ই হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন৷ তোমার ব্যবহার করা পুরনো উচুঁ চেয়ারে বসে আমাকে খাওয়ানো হত, তোমার ব্যবহার করা প্যারামবুলেটারে চড়ে আমাকে রাস্তায় ঘোরানো হত৷

ক্রমশঃ- 

ইংরাজী থেকে ভাষান্তর

[ঝুম্পা লাহিড়ীর শেষ প্রকাশিত ছোট গল্প সংকলন "আন অ্যাকাস্টামড আর্থ" থেকে নেওয়া একটি ছোট গল্প৷ গল্পটি প্রথম নিউইয়র্কার ডট কমে ২০০৬ এর মে মাসে প্রকাশিত হয়৷]




No comments:

Post a Comment