Sunday, August 18, 2013

ঝুম্পা লাহিডি / অনুবাদঃ- ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১৭।০৮।২০১৩

বিশ্বে যে হাতে গুনতি ভারতীয় বংশোদ্ভব লেখক লেখিকা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে ১) ভি এস নৈপল ২) সল্মন রুসদি , ৩)অমিতাভ ঘোষ , ৪) উপমন্যু চ্যাটার্জী , ৫)সুধা মূর্তি , ৬) রোহিন্টন মিস্ত্রী , ৭) পি কে আয়ার , ৮) অমিত চৌধুরী এবং ৯) ঝুম্পা লাহিডি অন্যতম। এনারা প্রত্যেকেই ইংরাজি সাহিত্যে নিজের দেশের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত করেছেন তাঁদের লেখার মাধ্যমে ।
ভারতিয়-আমেরিকিয় লেখিকা ঝুম্পা লাহিডি তাঁর প্রথম রচিত খুদ্র গল্প সঙ্কলন ‘দ     ইন্টরপ্রিটার অফ্ মালাডিজ’ ২০০২ সালে সম্মানজনক ‘পুলিজর পুরস্কার’ পেয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় সৃষ্টি করে । এটা বাঙ্গালির কম গর্বের কথা নয় । এর পর তাঁর লোকপ্রিয় উপন্যাস ‘দ নেমসেক্’ , মীরা নাইয়ার চলচিত্র নির্মান করে খ্যাতি অর্জন করেন । ২০১৩ সালে ঝুম্পার ‘দি লোল্যান্ড’ উপন্যাস ‘মেন বুকার পুরস্কারের’ জন্য মনোনীত হয়েছে ।
আত্মজীবনীভিত্তিক কথাসাহিত্যে ঝুম্পা তাঁর গল্প ও উপন্যাসের চরিত্রগুলো সুন্দর ভাবে চিত্রণ করেন । ঝুম্পার সাহিত্যের উল্লেখনীয় দিগ হল বিশ্বদর্শন । সারা জীবন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে কাটানোর জন্য তাঁর লেখায় দেশান্তরী হওয়ার দুঃখ এবং নিজেকে খোঁজার এক অভিনব সংগ্রাম পরিলক্ষিত হয় যা এক নতুনত্বের স্বাদ পরিবেশন করে । কলমের আঁচোড়ে সেই ভৌগলিক পরিসীমা ভাঙতে সখ্যম হন। এটাই পাঠককে বেশি আকৃষ্ট করে । দেশান্তর পাখীর মতন উডে উডে নীডের সন্ধানে কোন এক আস্তানা তে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি। পরিবর্তিত সময়ের সফেদ্ ডালে ফুটতে না পারা স্বপ্নের ফুল দৃশ্যমান করানোতে ঝুম্পার মনস্তত্ব সর্বদা ঈপ্সিত পরিধির অস্থির বিন্দুকে ভেদকরে । সামাজিক ও রাজনৈতিক অব্যাবস্থার জন্য সৃষ্ট অজায়গার ঘা’ দেখাতে না পেরে এক টুকরো মাংস কেটে প্রশ্ন করার সৎ সাহস রাখেন যা সামাজিক বিপল্বের এক আগ্নেয়াস্ত্র রূপে পরিগণিত ।
ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি ঝুম্পার দুর্বলতা তাঁর লেখার মাধ্যমে পাওয়া জায়। প্রত্যেক বছর পৈত্রিক ভিটে কোলকাতাতে আসতে ভোলেন না । এখানে এসে মাসাধিক থেকে বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণে যান কিন্তু কোন গাইড সঙ্গে নেন না। তাঁর মতে কোন অচেনা জায়গা বা মানুষের সঙ্গে মিশতে হলে অপরের সাহায্য নিলে চরম সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়না। নিজে সোজা সেই জায়গা বা ব্যক্তি বিশেষকে দেখা করলে চরম সত্যিকে উপলব্ধ করতে পারবেন । আসল রহস্যকে উন্মোচিত করা সম্ভব নিজের চোখে দেখে জেনে , যা অন্যের দ্বারা সম্ভব নয় কারন সে তার মতন বলবে বোঝাবে হয়ত তাতে খামতি থাকতে পারে ।

জীবনে একবার:ঝুম্পা লাহিড়ী ( ইংরাজী থেকে ভাষান্তর)

জীবনে একবার:ঝুম্পা লাহিড়ী ( ইংরাজী থেকে ভাষান্তর)


আমি এর আগে তোমাকে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি মনে করতে মনে পড়ে ইনমান স্ক্যোয়ারে আমার বাড়িতে দেওয়া তোমাদের বিদায় সম্বর্ধনারই কথা৷ তোমার পরিবার কেম্ব্রিজ ছেড়ে অন্য বাঙালী পরিবারগুলোর মত আটলান্টা বা অ্যারিজোনায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল না; আমার পরিবার-আত্মীয়রা যে সংগ্রাম আরম্ভ করেছিল তার পথে না হেঁটে তারা চলল ভারতে৷ সেটা ছিল ১৯৭৪ সালের কথা৷ আমার তখন ছ' বছর বয়স৷ তোমার বোধহয় নয়৷ আমার পরিষ্কার যেটা মনে পড়ে তা হ'ল সেই দিনের অনুষ্ঠানের আগের কয়েক ঘন্টা, পার্টির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন আমার মা৷ পালিশ করা আসবাবপত্র, টেবিলে প্লেট, ন্যাপকিন পরিপাটি করে সাজানো, ঘরময় ভেড়ার মাংস আর পোলাওয়ের গন্ধ ও বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য মা'র শখের ফরাসী সুবাস, মা প্রথমে নিজের গায়ে স্প্রে করলেন তারপরে আমার জামায়, আমি যা পরেছিলাম স্প্রে তা সাময়িকভাবে কালো করে দিল৷ সে সন্ধ্যায় আমি কলকাতা থেকে ঠাকুমার পাঠানো জামা পরেছিলাম৷ সাদা ছোট ঝুলের পাজামা, সবজে নীল কুর্তা আর প্লাস্টিকের মুক্তো লাগানো কালো ভেলভেটের জ্যাকেট৷ স্নানের সময় জামা তিনটে আমার খাটেই রাখা ছিল, আমি দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম, আঙুলের ডগাগুলো পর্যন্ত সাদা হয়ে গেছিল আর কুঁচকে ছিল৷ মা পাজামার বড় ঘেরের মধ্যে সেফটি পিন দিয়ে দড়ি পরাচ্ছিলেন, তারপরে দড়ির মধ্যে একটু একটু করে কোমরের কাপড় ভাঁজ করে আমার পেটের কাছে বেঁধে দিলেন৷ পাজামার ভেতরের সেলাইয়ে গোলের মধ্যে বেগুনি হরফে প্রস্তুতকর্তার স্টিকার৷ স্টিকারের জন্যই আমি পাজামাটি পরতে আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু মা' অভয় দিয়েছিলেন একবার ধোওয়ার পরে সিলটি আর থাকবে না আর কুর্তা দিয়ে ঢাকা থাকায় কেউ দেখতেও পাবে না৷
মা'র কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকলো৷ খাবার যথেষ্ট কিনা, সকলের জন্য হবে কিনা সাথে আবহাওয়া নিয়েও চিন্তা ছিল মা'র৷ তুষারপাতের সম্ভাবনা ছিল৷ সে সময়ে বাবা-মা বা তাদের বন্ধুদের নিজস্ব গাড়িও ছিল না৷ তোমরা সহ সকল অতিথিরাই মিনিট পনেরোর হাঁটা পথের দূরত্বে থাকতে৷ হয় হার্ভার্ড বা এমআইটির আশেপাশে বা মাস অ্যাভেনিউ ব্রিজটি পেরিয়ে৷ কেউ কিছু দূরেও থাকতো, ম্যালডেন, মেডফোর্ড বা ওয়ালথাম থেকে বাসে বা ট্যাক্সিতে আসত৷ আমার চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে মা তোমার বাবার প্রসঙ্গ তুলে বলতে লাগলেন, "আমার মনে হয় ডক্টর চৌধুরি বাড়ির লোকদের নিয়ে গাড়িতে আসতে পারেন"৷ তোমার মা-বাবা সামান্য বয়স্ক আর আমাদের তুলনায় এদেশে বেশ পুরানোও বটে৷ ওঁনারা দেশ ছেড়েছিলেন ১৯৬২ তে৷ তখনও বিদেশী ছাত্রদের এদেশে আসার ছাড়পত্রের আইন বদলায় নি৷ আমার বাবা ও তাঁদের বন্ধুরা তখনও পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ তোমার বাবার তখন পি.এইচডি হয়ে গেছে৷ আন্ডোভারের এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে তিনি সিলভার রঙের একটি গাড়ি চালিয়ে কাজে যেতেন৷ আমি বেশ কয়েকবার অনেক রাতে পার্টি শেষের পরে বা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে ঐ গাড়িটি আমাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে৷
আমার মা গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের মা'দের প্রথম দেখা৷ মা তখনও কিছু জানতেন না৷ ওঁনার মাথাটা ঘোরাচ্ছিল এবং একটি ছোট পার্কের বেঞ্চে বসেছিলেন৷ তোমার মা একটি দোলনায় বসে আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছিলেন সাথে তুমিও তাঁর উপরে ঝুঁকছিলে, মাথায় সিঁদুর আর শাড়ি পরা একজন অল্পবয়স্ক বাঙালী ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন তিনি৷ নিচু স্বরে মা’কে জিজ্ঞাসা করলেন, শরীর ঠিক লাগছে তো? তোমাকে দোলনা থেকে নেমে যেতে বললেন তারপরে তুমি আর তোমার মা মিলে মা’কে বাড়ি পৌঁছে দিলে৷ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়েই তোমার মা বলেছিলেন যে বোধহয় আপনি সন্তান-সম্ভবা৷ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা বন্ধু হয়ে গেলেন, আমাদের বাবারা যখন কাজে থাকত সেসময়টা তাঁরা একসাথে কাটাতেন৷ তাঁরা কলকাতায় ফেলে আসা জীবনের কথা বলতেন৷ যোধপুর পার্কে তোমার মা'র সুসজ্জিত বাড়ির কথা, ছাদের উপরে গোলাপ, জবাগাছের কথা আর আমার মায়ের মানিকতলায় পঞ্জাবি রেস্টুরেন্টের উপরের ছোট্ট ফ্ল্যাটের কথা যেখানে তিনটি ছোট্ট ঘরে সাতজন লোক থাকতেন৷ কলকাতায় তাদের দেখা হওয়ার সুযোগ ছিল খুবই কম৷ তোমার মায়ের বাবা ছিলেন সেসময়ের কলকাতার বিখ্যাত আইনজীবিদের মধ্যে একজন৷ পাইপ খেতে অভ্যস্ত, ইংরাজপ্রেমী, স্যাটারডে ক্লাবের মেম্বার৷ তোমার মা পড়তেন কনভেন্ট স্কুলে৷ ওদিকে আমার মায়ের বাবা ছিলেন জিপিও-র ক্লার্ক৷ এদেশে আসার আগে মা কখনও টেবিলে বসে খান নি, কমোডও ব্যবহার করেন নি৷ কিন্তু কেম্ব্রিজে গিয়ে দুজনের মধ্যে কোনও পার্থক্যই ছিলনা৷ দুজনেই ছিলেন সমান একা৷ বাজারে যেতেন একসাথে, উভয়ই স্বামীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতেন, রান্নাও হত তোমাদের বা আমাদের স্টোভে৷ রান্না হয়ে গেলে নিজেদের মত ভাগ করে নিতেন৷ উল বুনতেন দুজনে মিলে৷ বুনতে বুনতে একঘেয়েমি এলে পাল্টাপাল্টি করে নিতেন৷ আমি যখন জন্মালাম, বন্ধু হিসাবে তোমার বাবা-মা ই হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন৷ তোমার ব্যবহার করা পুরনো উচুঁ চেয়ারে বসে আমাকে খাওয়ানো হত, তোমার ব্যবহার করা প্যারামবুলেটারে চড়ে আমাকে রাস্তায় ঘোরানো হত৷

ক্রমশঃ- 

ইংরাজী থেকে ভাষান্তর

[ঝুম্পা লাহিড়ীর শেষ প্রকাশিত ছোট গল্প সংকলন "আন অ্যাকাস্টামড আর্থ" থেকে নেওয়া একটি ছোট গল্প৷ গল্পটি প্রথম নিউইয়র্কার ডট কমে ২০০৬ এর মে মাসে প্রকাশিত হয়৷]




Friday, August 16, 2013

ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী. 5:43 PM | ওরাও বাঁচতে চায়

ওরাও বাঁচতে চায়


আমাবস্যার রাত । চারিদিকে অন্ধকার । সামনে একটা কালো রঙের স্করপিও খ্যাঁচ্ করে ব্রেক কসলো ।  গাড়ি থেকে চারজন নামলো । পরনে জিন্স আর কালো টি শার্ট । চোখে কালো চশমা । হাতে গ্লাভস্ আর পিস্তল মনে হচ্ছে । মুখটা ঢাকা সাদা মাস্কে। মাথায় সাদা ফেল্ট্ ক্যাপ্। চারজন চার দিকে গেলো । এ টি এম্ কাউন্টারের ভেতর আমি একা বসে। রাতের ডিউটি । একটু চোখটা ধরে এসেছিল ঘুমের আমেজে । সামনের দৃশ্য দেখে ঘুমের বারোটা বেজে গেল । কিছু একটা অঘটন ঘটবে বলে মনে হচ্ছিল । তন্দ্রাচ্ছন্ন  চোখটা খুলতেই,.. “এই শালা ঘুমচ্ছিস কি ওঠ শালা রাত জাগা প্যাঁচা ঘুমচ্ছিস কিরে ?”  
কথাটা শুনে মেজাজ টা চটে গেল । নিজেকে সামলে নিলাম । আমার হাতে একটা লাঠি ছাডা আর কিছু নেই । পরনে শুধু সিকিউরিটি গার্ডের ড্রেস্ । হাতে দুমডোন একটা গত কালের আনন্দ বাজার পত্রিকা কালই খবরটা চোখে পডেছিল,“কলকাতার এ টি এম লুটেরারা গডি নিয়ে ডাকাতি করছে, সিসি টিভি ফুটেজে ধরা পডছেনা, ওরা দলে বলে আসছে সঙ্গে মারণাস্ত্র । ভয় লাগলো  আবার রাগ ও হল! তোরা গরীবের পেটে লাথি মেরে চিট্ ফান্ড এর টাকা লুটলি এখন ব্যাঙ্কের এ টি এম লুটছিস!! আলু পিঁয়াজের দাম ও বাডালি । দুমুঠো যে নুন ভাত খাবো তাও তোরা শান্তিতে খেতে দিবি না। কি চাস তোরা ? আমরা গরীবরা না খেয়ে মরি আর তোরা দেশ লুটে মস্তি করবি । কথাটা মনে মনে ভাবছিলাম .......
..হঠাৎ “এই শালা আমার সামনে দাঁড়া নইলে মাথার খুলি উডিয়ে দেব! টুঁ শব্দ করবিনা”  সামনের ছেলেটা বলল ।
আমি কেন সামনে দাঁড়াবো ?
ন্যাকা জানিস না ! দাঁডা বে জান প্যারি হ্যায় তো !!একটু ইতস্তত বোধ করে পকেট হাতডে কি বার কোরতে চেষ্টা করছিল (নিশ্চই এ লাইনে নতুন মানে প্রফেসনাল নয়)   
... ঠিক সেই সময় আমি ওর মাথায় আমার ডান্ডা দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিলাম। দিয়ে দৌড়ে ওখান থেকে পালালাম । ওই ছেলেটা আচমকা এটা হবে আশা করেনি । ও চিৎকার করে তলায় পডে গেল। আমি প্রাণপনে ছুটলাম মোবাইলে মেসেজ্ দিতে । মেসেজ বক্স থেকে সেভ করা মেসেজ টা আমার ব্যাঙ্কের বি এম কে পাঠিয়ে দিলাম । সেন্ট হল দেখলাম...ঠিক সেই সময় গুলির শব্দ হল। হঠাৎ আমার বাঁ হাতে  কি একটা অগ্নিস্ফুলিংগ র মতন ঢুকে গেল । আমি যন্ত্রণায় পডেগেলাম। জ্ঞান ছিলোনা কারণ জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি হস্পিটালে। কাছে আমার স্ত্রী পুত্র বসে।
ডাক্তার বাবু জিঙ্গাসা করলেন “কেমন লাগছে? যন্ত্রণা হচ্ছে ? আপনার অপারেশন হয়েছে , ভয় নেই গুলি বার করে দিয়েছি। আপনার ছেলেই আপনাকে রক্ত দিয়েছে। ব্লাড গ্রুপ এক; ও পসিটিভ্ । ওসুধ ইঞ্জেক্সন সব ব্যাঙ্কের ম্যানেজার দিয়েছেন। ভয়ের কিছু নেই। আপনি সুস্থ বোধ করলে পুলিস আসবে আপনার স্টেটমেন্ট নিতে । আপনি যা যা ঘটেছে মনে করে বলতে পারবেন তো?”মাথা নাডিয়ে বললাম , হ্যাঁ স্যার পারবো।  পুলিস অফিসার এলেন সেই সময় ।
-      কি ব্যাপার কেমন আছেন ?
-      ভালো ।
-      কে কে ছিল কেমন দেখতে একটু আন্দাজ করতে পারবেন।
-      হ্যাঁ স্যার । আমি একা কাউন্টারের ভেতর ছিলাম । এমনিতেই জায়গাটা ফাঁকা তাতে রাতে কেউ আসে পাসে থাকে না । তখন পুলিসের মোবাইল পেট্রলিং এ কাউকে কাছে দেখি নি স্যার।
-      আমি সে কথা আপনাকে জিঙ্গাসা করি নি ; কে ছিল কে না ছিল ! যা জিঙ্গাসা করছি তার উত্তর দিন। একটু গম্ভীর ভাবে বললেন।
-      আমি একা কাউন্টারের ভেতর ছিলাম একটা কালো রঙের স্করপিও ....
-      স্করপিও বলে কি করে জানলেন ? তখন ত অন্ধকার ছিল বলছেন !
-      হ্যাঁ স্যার্ , কিন্তু এ টী এম এর আলো ছিল সেই আলোতে গাডিটা দেখে বুঝতে পারি । তা ছাডা আমি গাডি চিনি সার । আমি আগে গাডি চালাতাম 
-      ও আচ্ছা ! নাম্বার দেখেছিলেন ?
-      না স্যার ওটা দেখতে পারিনি কারণ গাড়িটা সাইড করা ছিল একটু দূরে
-      হুঁ আর কিছু ?
ওই গাডিথেকে চারটে লোক কালো পোসাকে বেরুলো।
-      কালো বলে কি করে জানলেন?
-      আমি রাত কানা নই স্যার। একটু আলো পডেছিল ওতেই দেখেছি ওরা কি পরেছিল।
-      হুঁ তা বটে ।
-      কথা বলতে একটু কষ্ট হচ্ছে সার । ডাক্তার বললেন,“পেসেন্ট কে একটু রেস্ট দিন” ।
-      ঠিক আছে পরে আসবো । ঠিক ঠিক বলবেন  মাথা নাডিয়ে সম্মতি দিলাম।
বৌ কাছেই ছিল । বলল আমরা না খেয়ে থাকবো তাও আচ্ছা তোমাকে এ চাকরি আর করতে হবে না।
-      সংসার কি করে চলবে ?
-      সে আমি বুঝবো এখন ।
এখানে বলে রাখি ,আমার বৌ যমুনা একটি বাচ্চা মেয়েকে সারা দিন রাখে। ঘরের রান্না বান্না যাবতীয় কাজ ওই করে । মেয়েটির বাবা মা দুজনেই সকাল থেকে অফিসে যায়। জমুনা মেয়েটিকে ছোট থেকে বড করেছে। ওরা মাস গেলে ৫০০০ টাকা মাইনে দেয় । আমার ছেলে মন্টু কলেজের খরচ নিজেই চালায় টিউসনি করে। পার্ট টাইমে ডিটিপি করে শ্যাম বাজারে । বেচারা সাইকেলে যায় । বাস ভাডা বেডে যাওয়াতে সাইকেল ই ওর এক মাত্র ভরসা । টিউসনি থেকে হাজার দুএক পায় বাকি ডিটিপি করে কিছু পায়। আমি ৬০০০ টাকা পাই । রাত দিন এক করে খাটতে হয়। এই কটা সামান্য টাকায় আমাদের কষ্টেমষ্টে চলে যায়। তবে এই দুর্দিনে আর সংসার টান্তে পারছিনা । দেশে মা বোন আছে তাদের টাকা পাঠাতে হয়। তারা না হলে না খেয়ে মরবে। মা, বি পি এল এর চাল পায়। বোন ক্ষেতখামারে কাজ করে। বিয়ে করেছিল স্বামি ছেডে দিয়েছে ।
হঠাৎ যমুনা বলে উঠলো “কি ভাবছো ? আমি ত আছি”  কি করে যে কি করি বুঝে উঠতে পারছিনা । আমি কবে হাসপাতাল থেকে যাবো । পুলিসের চক্কর আমার খুব বাজে লাগে । জল তেষ্টা পাচ্ছে । যমুনা একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনেছে দেখলাম। সত্যি ও আমার অনেক খেয়াল রাখে। ছেলেটাও মন মরা হয়ে গিয়েছে । যমুনা বলল “তুমি চিন্তা করনা । আমার মালকিন বলেছেন উনি ৫০০০ টাকা আগাম দেবেন বলে । পূজোতে যে বোনাস পাই সেটা আগে থেকে দেবেন উনি”
-      তোকে আমি অনেক দুঃখ দিলাম যমুনা” বলতে বলতে চোখে জল এলো ।
-      ও মা এই সময় আমি থাকবোনা ত কে থাকবে শুনি ? তোমার বোন ? ও ত স্বামীর ঘর করতে পারলনিকো , তোমাকে কি দেখবে শুনি!
-      আমি এখানে আছি , খেটে খাচ্ছি ও কাজ করতে পারে না ? সোহাগ্ । বলি কোথা থেকে আসবে শুনি ? গা জ্বলে যায় আদিখ্যেতা দেখলে ! মরন !! 
-      আমি ঘরে ফিরে আমার আগের মালিকের ট্যাক্সি চালাবো । দেখিস ঠিক চলে যাবে ।
-      রক্ষে কর ।
ডাক্তার এসে বললেন ওনাকে রেস্ট দিন। পরের দিন সকাল বেলাতে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার এলেন পুলিস অফিসার এলেন ।
-     আজ কেমন আছেন ?
-     ভালো ।
-     কথা বলতে কষ্ট হবেনা ?
-     না ।
-     আচ্ছা আপনি কালো রঙের স্করপিও বলছিলেন না !
-     হ্যাঁ স্যার । লোকটাকে কেমন দেখতে বলতে পারবেন ?
-     ও লোক নয় সার একটা কম বয়েসের ছেলে ।
-     কি করে জানলেন ?
-     ও আমাকে থ্রেট করছিল । যানে মেরে ফেলবে বলছিল যদি আমি ওকে এ টি এম ভাঙ্গা তে সাহায্য না করি ত 
-     ও আচ্ছা । কেমন দেখতে ওকে?
-     রোগা লম্বা আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। নন বেঙ্গলি মনে হল সার । গলার স্বর চিনতে পারবো । সি সি টি ভি ফুটেজে সব কভার করে থাকবে সার ।
-     কি হয়েছে না হয়েছে সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই । যা জিঙ্গাসা করছি তাই বলুন
-     মুখ কেন দেখেন নি?
-     মুখে মাস্ক ছিল সার ।
-     হুঁ। নন বেঙ্গলি কেন বললেন ?
-     কথা শুনে তাই মনে হল স্যার।
-     ও । আপনি গাডি চালাতেন না ?
-     হ্যাঁ সার।
-     আপনি কি করলেন ও আসাতে ?
-     ও এসেই আমাকে বাজে গালা গালি দিয়ে উঠতে বলে । আমাকে সামনে দাঁড়াতে বললো। আমি মানা করাতে পকেট খোঁজে । আমি বুঝলাম মেশিন খুঁজছে । সঙ্গে সঙ্গে মাথায় লাঠি মেরে ওখান থেকে দৌড়ে পালালাম জান বাঁচাতে ।
-     ও যদি মরে যেত ?
-     ব্যাংঙ্কের এ টি এম ভাঙ্গবে , আমি ছেডে দেব স্যার ! আমি কি করতে আছি তাহলে ?
-     কিন্তু ও যদি মরে যায় ! এমনত হতে পারে !!
একটু ভেবে বললাম, আমার আত্মরক্ষার জন্য এবং ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ টাকা যা  এ টি এম এ আছে  তার সুরক্ষার জন্য আমি ওটা করতে বাধ্য হয়েছি স্যার ।   যদি এই কারনে আমাকে দোষি সাব্যস্ত করা হয় তবে আমার কিছু বলার নেই ।
পুলিস অফিসার সমস্ত বয়ান নথিভুক্ত করেন ।
আমি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এলাম। ব্যাঙ্ক , আমার সাহসিকতাতে  খুশি হয়ে আমাকে মেন ব্রেঞ্চের  সিকিউরিটি গার্ড করে । মাইনে বেডে 9০০০ টাকা হয় । বৌ বললো গুলি খাওয়ার পর মাইনে বাডলো । সবকটা ছেলে ধরাপড়েছে ।    
আমি বলি, “সততা নিয়ে কাজ করলে ভগবান সহায় হন । ”  আমাদের সংসার এখন স্বচ্ছল ।


Saturday, August 10, 2013

আমার রবীন্দ্রনাথ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা প্রথম পড়েছিলাম মনে নেই, মনে রাখাও কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি স্বচ্ছন্দে, প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারো লেখা পড়তাম না। আমার কৈশোর কাটে রাবীন্দ্রিক পরিমণ্ডলে। তখনকার কবিতা-পিপাসু কিশোর ও তরুণরা পাগলের মতন রবীন্দ্রনাথের কবিতাই পড়ত। রাত্তিরবেলা উঠে রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা পড়ে নিতুম। সেসব কবিতা ছিল আমার নির্জনতার সঙ্গী। বিশেষ ভালো লাগা কোনো কোনো লাইন অপরকে জানানোর জন্য আমি বিনা কারণেই একে ওকে তাকে চিঠি লিখতুম। তখন, এমনকি রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের গদ্য কবিতাগুলোও ছিল আমার মুখস্থ।

পঞ্চাশের দশকে আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, তখনো কিন্তু সাহিত্যের আবহাওয়া রবীন্দ্রনাথের কিরণ ছটাতেই অনেকখানি আচ্ছন্ন। পত্রপত্রিকায় অধিকাংশ প্রবন্ধই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে; অধ্যাপকরা রবীন্দ্রনাথে আপ্লুত। রাজনৈতিক নেতারাও তাঁদের ভাষণে যখন তখন, অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দেন। এমনই তাঁর সর্বব্যাপ্ত প্রভাব, বাংলার প্রায় সব লেখাই রবীন্দ্র-অনুসারী। ‘দেশ’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘শনিবারের চিঠি’ প্রভৃতি প্রভাবশালী পত্রিকায় রবীন্দ্র-অনুসারী কাঁচা কবিতারই প্রাবল্য, নিছক ছন্দ-মিল দেওয়া সেসব অদ্ভুত জিনিস!
‘আধুনিক কবিতা’ তখন শিক্ষিত মহলেও হাসি-ঠাট্টার বিষয়। যেকোনো ভাষায় রবীন্দ্রনাথের মতন এমন বিশাল মাপের প্রতিভাধর লেখকের আবির্ভাব হলে তার খানিকটা বিপদও আছে। তাঁর প্রভাব ও ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা খুবই শক্ত, সাহিত্যের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়। তাহলে আর সাহিত্যবহতা থাকবে কী করে?

আমি অল্প বয়সে রবীন্দ্র-বিরোধী ভূমিকা নিলেও তাঁর লেখা পড়েছি তন্ন তন্ন করে। কখনো কখনো কেঁদেছি। কোনো কোনো গদ্য রচনাও কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। এরপর অনেক কাল তাঁর গান ছাড়া অন্য কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। কয়েক বছর আগে তাঁকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে একটি উপন্যাস লেখার সময় তাঁর প্রায় সব রচনা আবার পড়ে নিতে হয়। হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন, কিছুই অপাঙ্ক্তেয় নয়। যুগ অতিক্রম করে সাহিত্যের একটা চিরকালীন বিচারও তো আছে। সেই বিচারে রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ লেখক। বিশ শতকে সারা পৃথিবীতেই বা তাঁর তুল্য আর কে আছে?

গোঁড়া রবীন্দ্র-ভক্তরা একসময় রবীন্দ্রনাথের খুব ক্ষতি করতেন। তাঁরা, যেমন সুকুমার সেন ও নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলতেন, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতা আর পাঠযোগ্য নয়! এতে অন্য পক্ষে রবীন্দ্র-বিমুখতা বেড়ে যেত। ষাটের দশক পর্যন্ত রবীন্দ্র-ভক্তদের বাড়াবাড়ি এবং তাঁকে গুরুঠাকুর বানিয়ে পূজা করার চেষ্টা অত্যন্ত প্রবল ছিল। আমাদের মতন তরুণ লেখকদের কাছে এটা অসহ্য মনে হতো।

রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছিলেন, আর কিছু না থাকুক, তাঁর গানগুলো থেকে যাবে। সত্যিই তাঁর গান পেরিয়েছে কালের সীমানা, আজও তাঁর গান মাতিয়ে রেখেছে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের, এমনকি অবাঙালিদেরকেও। সংগীত-স্রষ্টা হিসেবে সদ্য যৌবন বয়স থেকেই তিনি বিপ্লবী। সুর আহরণ করেছেন নানান সীমানা থেকে, ইচ্ছে মতন মিশিয়েছেন কোনো প্রথা না মেনে। নানান মার্গ-সংগীতের রাগ-রাগিণীর নির্দিষ্ট রূপ ভেঙে মিলিয়ে মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন সুর। প্রখ্যাত ওস্তাদদের কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন উচ্চাঙ্গ-সংগীতের, সেই সঙ্গে পিয়ানো বাজিয়ে দীক্ষা হয়েছে ইউরোপীয় সুরে। যখন ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামবাংলায়, তখন সংগ্রহ করেছেন বাউল, ফকির, মাঝি-মাল্লা, এমনকি ডাক-হরকরাদের নিজস্ব গান, সেসব সুরে নিজস্ব কথা বসিয়ে রচিত হলো যেসব সংগীত, তা বাংলায় অশ্রুতপূর্ব। পাঞ্জাব ও দক্ষিণ ভারতের নানান গানের সুরও মিশিয়েছেন বাংলা গানে, যা তাঁর আগে আর কেউ করেননি।
রবীন্দ্রনাথের প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই বিভিন্ন মানসিক স্তরের রেখাভেদ অত্যন্ত স্পষ্ট। নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘কড়ি ও কোমল’ রচনার আগে কাব্যের ভাষা তাঁর কাছে ধরা দেয়নি। ‘মানসী’ পর্বের কবিতা রচনার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ২৭। যৌবন থেকে মধ্যযৌবনই তাঁর কাব্য রচনার শ্রেষ্ঠ সময়। একাই তিনি বাংলা কাব্যকে তুলে নিয়েছেন বিশ্বস্তরে।

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে বারবার প্রাণের মধ্যে মিশিয়ে নিতে চেয়েছেন। তাঁর মধ্যে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের মতো সেনসুয়াস আবেদন হয়তো ছিল, কিন্তু ইংরেজ কবিদের চেয়ে তাঁর আন্তরিকতা ও ব্যাকুলতা যে আরো তীব্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধ্বনি-মাধুর্যে ও চরিত্র-নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের কাহিনীমূলক কবিতাগুলোর গভীর আবেদন রয়েছে। ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদে’র মতন সংলাপ-কাব্য বিশ্বসাহিত্যেই দুর্লভ।
রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, শেকসপিয়ার বা ভিক্টর য়্যুগোর মতো প্রতিভাদের সৃষ্টি-ক্ষমতা অনেক ব্যাপক হয়। তাঁরা নিছক কবির মতন লাজুক, নিভৃতচারী হন না, হন দারুণ বাস্তবতা জ্ঞানসম্পন্ন, পরিশ্রমী, ভোগী, অণু থেকে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে কেতূহলী। সাহিত্য ছাড়াও আরো অন্য অনেক দিকে ছড়িয়ে থাকে তাঁদের আগ্রহ। গ্যেটে যেমন বহু রমণীচর্চা করেছেন, তেমনই গবেষণা করেছেন গাছপালা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথেরও বান্ধবী ও অনুরাগিণী-ভাগ্য ঈর্ষণীয়। তিনি ছবি এঁকেছেন, ব্যবসা করেছেন, সারা দেশের বিবেক-প্রতিভু হয়েছেন, একটি সাধারণ ছোট্ট বিদ্যালয়কে পরিণত করেছেন মহীরুহে। যেকোনো ভাষায় এ রকম একজন লেখকের আবির্ভাব প্রায় অলৌকিক ঘটনা।

[আমার রবীন্দ্রনাথ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়]

Wednesday, August 7, 2013

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা / শ্রী শুভ্র লিখেছেন

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা / শ্রী শুভ্র লিখেছেন
"আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, বিরহবেদন লাগে! তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে!!"

               বাইশে শ্রাবণ! শুধু একটা দিন নয়! নয় অঝর শ্রাবণের বর্ষণ মুখরিত হৃদয় মন্থন শুধু! বাইশে শ্রাবণ পঁচিশে বৈশাখের পূর্ণ বৃত্তায়ন! এক ইন্দ্রপতনের স্মৃতিবিজরিত মহাকাব্য! বাংলার ইতিহাসের এক স্থিরবিন্দু সম ঐতিহাসিক সমাপতন! চলে গেলেন বিশ্ববন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথ! চলেই কি গেলেন? নাকি শাশ্বত মহাসত্যের মত চিরন্তন হলেন! জল বাতাস সবুজ মাটি আর নীল আকাশের মত দিগন্ত বিস্তৃত সত্য হয়ে উঠলেন! "তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি!" ঠিক তাই, বঙ্গজীবনের পরতে পরতে তিনি রবীন্দ্রনাথ, আনন্দ অনন্ত জাগ্রত পূর্ণ সত্ত্বা! "তমসো মা জ্যোতির্গমোঃময়!"
"জীবন আর মরণ তো একই সত্ত্বার দুই দিক- চৈতন্যে ঘুম আর জাগরণ যেমন!" বলেছিলেন কবি বাসন্তী দেবীকে; ১৫ই কার্ত্তিক ১৩৩৮-এ লেখা একটি পত্রে! কবির প্রজ্ঞায় ধরা পড়েছিল মৃত্যু কিন্তু বিলুপ্তি নয়! নয় মহাশূন্য! কবি অনুভব করেছিলেন, মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের পরিপূর্ণ মুক্তি! সম্পূর্ণ প্রকাশ! পুরানো যা কিছু, তাকে নূতনের জন্য জায়গা করে দিয়ে যেতে হবে! মৃত্যুর সেই দূয়ারেই জীবনের মহাযজ্ঞ! আর মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই পরিণতির মাত্রায় প্রকাশিত হয় জীবন, তার পূর্ণতায়! সেই পরিপূর্ণতারই এক মহাকাব্যিক ক্ষণ বাইশে শ্রাবণ! রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ! বঙ্গ সংস্কৃতির ধ্রুপদী লগ্ন! বাংলার  ইতিহাসে এক যুগান্তরের সূচনা!

বাইশে শ্রাবণ তাই, শুধু মাত্র কবির মৃত্যুর দিন নয়! বাইশে শ্রাবণ ব্যক্তিত্বের সীমানা ছাড়িয়ে অসীম নৈর্ব্যক্তিক অনন্তে কবির সত্য হয়ে ওঠার দিনও বটে! রবীন্দ্রনাথকে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে তাঁর এই সত্যমূল্যেই করতে হবে তাঁকে অনুভব! মৃত্যুকে বিলুপ্তির হাহাকারের সীমানায় যে দেখা, যে দেখার মধ্যে দিয়ে আপামর মানুষ কালের পথরেখা ধরে শোকে কাতর হয়ে বিলাপ করে চলে; রবীন্দ্রনাথেই বলে গেছেন, সে দেখা খণ্ডিত দেখা! তা অসম্পূর্ণ! তাই তা পূর্ণ সত্য নয়! শোক আমাদের গতি রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে! মুছে যেতে থাকে সামনের পথরেখা! জীবনের প্রবাহমানতা বিঘ্নিত হয়, শোকের আতিশয্যে বিহ্বল হয়ে আমরা মৃত্যুকে তার সত্যমূল্যে অনুভব করি না!

জীবনকে তার সত্যমূল্যে অনুভব করতে হলে মৃত্যুর প্রেক্ষিতে তাকে অনুধাবন করা প্রয়োজন! আত্মজীবনীর পরতে পরতে সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন কবি তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায়! তিরিশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি সদ্য তরুণ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখলেন, "....আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম জীবনকে মৃত্যুর জানলার ভিতর দিয়ে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না! মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায় প্রথমে তা বড় দুঃসহ! কিন্তু তার পরে তার ঔদার্য্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে! তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখদুঃখ অনন্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হাল্কা হয়ে দেখা দেয়!" (৮ই আষার ১৩২৪) এখানেই রবীন্দ্র চেতনার অনন্যতা!

               রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যুর সাথে প্রথম দেখা হয় জননী সারদা দেবীর মৃত্যুতে! কবির বয়স তখন তেরো! সারদা দেবীর মৃত্যু হয় ২৭শে ফাল্গুন ১২৮১ (১০ই মার্চ ১৮৭৫)! কবির বৌদি প্রফুল্লময়ী দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, হাতের উপর লোহার সিন্দুকের ডালা পড়ায় আহত আঙ্গুল পরে বিষিয়ে যায়! এর থেকেই মৃত্যু হয় সারদা দেবীর! কবির শৈশব কালের এই মৃত্যু তাকে বিশেষ ভাবে অভিভুত করতে পারে নি! কারণ ঠাকুর পরিবারের সাংসারিক আবহাওয়ায় কবির শৈশবের অধিকাংশ সময়ই কেটেছিল গৃহভৃত্যদের পরিমণ্ডলে! তার উপর অষ্টমগর্ভের সন্তান হিসেবে মাতৃ সাহচর্য্য পাননি সেরকম! ফলে মাকে হঠাৎ হারানোর অভাবটা সেই শৈশবে অনুভব করেননি কবি!
 এই প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতিতে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, "মার যখন মৃত্যু হয়, আমার বয়স তখন অল্প! অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই! এতদিন পর্যন্ত যে ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন! কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়- তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতলার ঘরে থাকিতেন! যে রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, "ওরে তোদের কি সর্বনাশ হল রে!"
 "তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাহার ছিল! স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল, কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না! প্রভাতে উঠিয়া যখন মার মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে কথাটার অর্থ ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না! বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান! কিন্তু, মৃত্যু যে ভয়ংকর সে দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না; সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর!"

               "জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না!"কবির মাতৃস্মৃতির এই বয়ানে একটা বিষয় পরিস্কার! তাঁহার মনস্তত্বের পরিসরে, বালক বয়সে মৃত্যুর সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎকারের অনুভবটুকু বরাবরই ক্রিয়াশীল ছিল! প্রথম দেখা মৃত্যুর এই শান্ত সমাহিত রূপটিই তাঁর চেতনায় মৃত্যুর একটা স্থায়ী ছবি গড়ে তুলেছিল!

তবুও জীবনস্মৃতির এই পর্বেই বললেন কবি, শোককে ভুলবার শক্তি শৈশবেই প্রবল থাকে! শৈশব কোনো আঘাতকেই গভীরভাবে গ্রহণ করে না! "এইজন্য জীবনে প্রথম যে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দপদে চলিয়া গেল!"
"কিন্তু আমার চব্বিশবছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়!" কবি বলছিলেন তাঁর প্রিয় বৌঠাকুরানী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কথা ! কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন! তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি সহ রবীন্দ্রনাথকে! জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলেন মৃত্যশোকের সুতীব্র যন্ত্রণা! প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা!

               কবির জীবনে মৃত্যুর এই প্রথম সুতীব্র অভিঘাত তাঁর সমগ্র সত্ত্বায় গভীর অনুরণন তুলে দিল! আকাশভরা সূর্য তারার এই যে পার্থিব জীবন, সেখানে বাকি সবকিছুই যেখানে আপন ছন্দে গতিশীল, সেখানে, জীবনের প্রিয় মানুষটিকে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকস্মিক যে ছন্দপতন- সেই আঘাত; জীবনের একটা দিক যখন পুরো শূন্য করে দিয়ে যায়, সেই শোকের হাহাকারের সাথে পরিপার্শ্বের ছন্দময় চলমান জীবনের মাধুর্য্যকে মেলানো যে কি কঠিন সাধনা, সে কথা কাদম্বরীর আত্মহত্যায় প্রথম উপলব্ধি করলেন কবি শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ! প্রিয়জন বিয়োগের এই শূন্যতাকে মনের গভীরে মেনে নিয়ে জীবনের চলমান ছন্দে সামঞ্জস্য বিধান করা তো সহজ কথা নয়!

               শোকের এই নিবিড় অন্ধকারে মন যেমন ডুবে যায়, ঠিক তেমনই জীবাত্মার অন্তর স্বরূপ এই হাহাকারের বেড়া কেটে আলোকিত জীবন প্রবাহের মধ্যে মুক্তি পেতে চায়! কিন্তু সেই মুক্তি পাবার পথ সাধারণ ভাবে জানা থাকে না বলেই আমরা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ি! আর তার ফলেই জীবন মৃত্যুর যুগল ছন্দের সঙ্গতের তালটুকু নিজেদের শোকগ্রস্ত পরিসরে ধরতে ব্যর্থ হই! কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ! কাদম্বরীর মৃত্যুই তাঁকে পথ দেখিয়ে দিল! অনুভব করলেন মানুষ "নিশ্চল সত্যের পাথরে গাঁথা দেওয়ালের মধ্যে চিরদিনের কয়েদি" নয়! উপলব্ধি করলেন "শোকের এই শূন্যতাকে মানুষ কোনোমতেই অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করিতে পারে না! যাহা নাই তাহাই মিথ্যা, যাহা মিথ্যা তাহা নাই!"

               তাই, "যাহাকে ধরিয়াছিলাম তাহাকে ছাড়িতেই হইল, এইটিকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা পাইলাম তেমনি সেইক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটি উদার শান্তি বোধ করিলাম! সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণপুরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারি দিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনোখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না, একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না, এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মতো আমি সেদিন যেন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম!" লিখেছিলেন কবি জীবনস্মৃতির পাতায়! এই ভাবে প্রিয়জনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই ঐকান্তিক জীবনের রহস্য উপলব্ধি করলেন রবীন্দ্রনাথ!

               অতি প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যাথায় আমরা এতটাই বিহ্বল হয়ে থাকি বলেই নিজেদের জীবনের সীমানায় মৃত্যুর সৌন্দর্যটুকৄ অনুভব করতে পারি না! মৃত্যুর অন্ধকারই যে জীবনকে নিরন্তর আলোকিত করে রাখে, অনুধাবন করতে পারি না সেই সত্যও! টের পাই না, মৃত্যু এসেই প্রিয়জনকে আরও নিবিড়ভাবে অনুভবের-  মূল্যবান পরিসরটুকু প্রস্তুত করে দিয়ে যায়! কিন্তু সময়ের সাথে শোকের তীব্র দাহ প্রশমিত হয়ে এলে, পিছন ফিরে যতই স্মৃতিচারণ করি, ততই কিন্তু মৃত্যুর সেই অনিবার্য যন্ত্রণার মুহূর্ত্ত ছাপিয়ে জীবনের স্মৃতিবিজরিত অম্লান মুহূর্ত্তগুলির সুখস্মৃতিতেই সবাই মগ্ন হই, সুখানুভূতির স্পর্শে! এখানেই তো মৃত্যুর সৌন্দর্য! মৃত্যু তাই কেবলই জীবনের রঙ ফোটায়!
 রবীন্দ্রনাথের প্রিয়, "ছুটি"র মৃত্যু হল ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯ (২৩শে নভেম্বর, ১৯০২)! মৃত্যুকালে মৃণালিনী দেবীর বয়স হয়েছিল ঊনত্রিশ বছর! কবির তখন চল্লিশ! সমাপ্তি ঘটল মাত্র ১৯ বছরের দাম্পত্যপর্বের! সম্ভবত এপেণ্ডিসাইটিস হয়েছিল তাঁর! ঘটেছিল চিকিৎসাবিভ্রাট! এলোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথির যুগপৎ প্রয়োগে কোনটিই ফলপ্রসু হয়নি! পুত্র রথীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণ করেছেন, "মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন! তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে! আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল!" শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার প্রথম পর্বেই কবি হারালেন তাঁর অন্যতম সহযোগীকে! শুরু হল আবার তার একলা চলা!

               কবির জীবনে স্ত্রীর মৃত্যুও বিশেষ অভিঘাত ফেলে যায়! তার পরিচয় রয়ে গেছে স্মরণ কাব্যগ্রন্থের ছত্রে ছত্রে! রয়ে গিয়েছে সমকালীন অনেক গানের কলিতে! স্মরণ গ্রন্থে লিখছেন-
"
আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে- রাখিব জ্বালি আলো!
তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে বাসিতে হবে ভালো!"

               মৃত্যুর মধ্যে যে শোক, সেই শোকের শত যন্ত্রণা ছাপিয়েও এই যে ঐকান্তিক প্রেম; এই প্রেমের শক্তিই আমাদের সংলগ্ন রাখে জীবনের প্রবাহমানতার সাথে! কবি তাই মৃত্যুর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে স্বীকার করেননি! মৃত্যুও প্রবাহমান জীবনের প্রধানতম অনুষঙ্গ! এই বোধ জাগ্রত থাকলে, শোক আমাদের পরাজিত করতে পারে না, বরং উত্তীর্ণ করে জীবনের পূর্ণতায়!

               এক বছরের মধ্যে হারালেন মেজ মেয়ে রেণুকাকে! ২৮শে ভাদ্র, ১৩১০ (১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৩) বেশ কিছুদিন যক্ষায় ভুগতে থাকা কন্যাকে আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করছিলেন! স্মৃতিচারণে লিখছেন কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী, "বাবা রোজ সকালবেলায় ওঁকে বারান্দার এককোণে বসে উপনিষদ থেকে মন্ত্র পাঠ করে তার মানে বুঝিয়ে দিতেন! এমনি করে তাঁর মনকে সংসারের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করবার পথে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ছেড়ে যেতে বেশি কষ্ট না পান! এই সময় বাবা যেন রাণীদিকে বেশি কাছে টেনে নিয়েছিলেন!" মৃত্যুশয্যায় রেণুকা কবির হাত ধরে আব্দার করেছিলেন, "বাবা ওঁ পিতা নোহাসি বলো!" অথচ কন্যার জীবন রক্ষার জন্যে কি না করেছিলেন কবি!

 কিন্তু মৃত্যু যখন অনিবার্য তখন তাকে শান্ত চিত্তে বরণ করে নিতে হয়! প্রাণের কষ্ট যখন মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পরিত্রাণের পথ খোঁজে, তখন তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে জীবনকে অসম্মান করতে নেই! শোকের হাহাকারকে কোলাহলে মুখর না করে, মৃত্যুর আবহে জীবনের অপরিমেয় মূল্যকে অনুভব করা দরকার! এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জীবনের দুরন্ত শোকাবহ সুতীব্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই অর্জন করেন! প্রিয়জনের মৃত্যুশোক তাঁকে থামিয়ে দেয়নি! এগিয়ে দিয়েছে সৃজনশীলতার নতুন নতুন পল্লবিত শাখা প্রশাখার শাশ্বত পরিমণ্ডলে! এখানেই রবীন্দ্রনাথের অনন্যতা! মৃত্যুকে তিনি জীবনের চিরন্তন ছন্দের শাশ্বত তাল বলে উপলব্ধি করলেন শোকোত্তীর্ণ শান্তির মধ্যেই!

               রেনুকার মৃত্যুর দেড় বছরের মধ্যে কবি হারালেন তাঁর জীবনের দীক্ষাগুরু, পিতা দেবেন্দ্রনাথকে! মহর্ষির মৃত্যু হয় ৬ই মাঘ,১৩১১ (১৯শে জানুয়ারী ১৯০৫)! বয়সের ভারে দেহ রাখলেন তিনি ৮৯তম বছরে! কবির জীবনে এইপ্রথম মৃত্যুশোক এল সময়ের স্বাভাবিক গতিতে! অকাস্মাৎ অনাহূতর মতো নয়! মহর্ষির মৃত্যুর সাথে শেষ হল একটা শতাব্দী! কবি সাঁকো হয়ে রইলেন দুই শতাব্দীকে ধারণ করে! পিতার হাত ধরেই সংস্পর্শে এসেছিলেন উপনিষদের! বেদান্ত দর্শনের অন্তরেই ব্যক্তি জীবনের সাথে বিশ্বছন্দের সম্পর্ক সূত্রটিকে প্রথম অনুধাবন করেন কবি! আর এই বিষয়ে মহর্ষিই ছিলেন তাঁর প্রথম সহায়ক! ফলে পিতার মৃত্যুকে শোকের হাহাকারে নয়, জীবনের বড়ো ক্ষেত্রেই বরণ করলেন!

 "যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক! আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে, ......শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় (রাস পূর্ণিমা) আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই! মন বললে কম পড়েনি - সমস্তর মধ্যেই সবই রয়ে গেছে, আমিও আছি তার মধ্যে! সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল! যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে...যা ঘটেচে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে!"
 সদ্য সন্তান হারা কন্যা মীরাদেবীকে লেখা পত্রে (১২ই ভাদ্র, ১৩১৪) সান্ত্বনা দিয়ে কথাগুলি বলছিলেন কবি! কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ মারা যান ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩১৪ (২৩শে নভেম্বর ১৯০৭) সম্পূর্ণ আকস্মিক ভাবে; মুঙ্গেরে বন্ধুর মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে কলেরায় অকাল প্রয়াণ হয় শমীন্দ্রনাথের, মাত্র বারো বছর বয়সে! আদর করে কবি যাকে শমী ঠাকুর বলে ডাকতেন! কবি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই সন্তানটি তাঁর মতোই প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে! তাই শমীকে হারানোর ব্যাথা গভীর ভাবেই বেজে ছিল তাঁর প্রাণে! কিন্তু ব্যক্তিগত সেই শোককেও বিশ্বসত্যের ছন্দের সাথে এই ভাবে মেলাতে পেরেছিলেন বলেই তিনি রবীন্দ্রনাথ! দুঃখ শোকের মধ্যেও যিনি বিশ্বপথিক !

               শান্তিনিকেতন থেকে, ১৪ই শ্রাবণ ১৩২৫  শ্রীমতি রাণু অধিকারীকে লিখছেন কবি, "আমার খুব দুঃখের সময়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে; আমার যে মেয়েটি সংসার থেকে চলে গেছে সে আমার বড়ো মেয়ে, শিশুকালে তাকে নিজের হাতে মানুষ করেছি, তার মত সুন্দর দেখতে মেয়ে পৃথিবীতে খুব অল্প দেখা যায়! কিন্তু সে যে মুহূর্ত্তে আমার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল সেই মুহূর্ত্তেই তুমি আমার কাছে এলে- আমার মনে হল যেন এক স্নেহের আলো নেবার সময় আর এক স্নেহের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল! আমার কেবল নয়, সেদিন যে তোমাকে আমার ঘরে আমার কোলের কাছে দেখেছে তারই ঐ কথা মনে হয়েছে! তাকে আমরা বেলা বলে ডাকতুম!" বেলা অর্থাৎ মাধুরীলতার মৃত্যু হয় ২ জৈষ্ঠ ১৩২৫ (১৬-৫-১৯১৮)!
কিন্তু দুঃখ শোকে কাতর হয়ে বিহ্বল হলে তো চলবে না কবির! ঐ পত্রেই রাণুকে জানাচ্ছেন, "কেননা আমার উপরে যে কাজের ভার আছে; তাই আমাকে দুঃখ ভোগ করে দুঃখের উপরে উঠতেই হবে! নিজের শোকের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এক মুহূর্ত্ত বৃথা কাটাবার হুকুম নেই আমার!" এরও আগে  শমীর মৃত্যুর পরপরই ৮ই জানুয়ারী ১৯০৮ বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে লিখছেন,"আমাদের চারিদিকেই এত দুঃখ এত অভাব এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের শোক লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষরূপে দুর্ভাগা কল্পনা করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জা বোধ হয়!" এই ভাবে বৃহত্তর সমাজের দুর্দশার প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত শোকের উর্দ্ধে উঠে সামাজিক কর্মে ও তাঁর সৃজনশীলতায় নিজেকে সক্রিয় ও ফলবান রেখেছিলেন!

               দুঃখ শোকের খুঁটিতে বাঁধা না পড়ে, দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে থেকে জীবনের অনন্ত প্রবাহে নিজেদেরকে উৎসারিত করবার মন্ত্র দিয়ে গেলেন কবি- নিজের জীবনের দৃষ্টান্তের মধ্যে দিয়েই! শোককে দেখলেন বন্ধনমুক্তির উপায় হিসেবে! বিচ্ছেদকে করলেন বৃহৎ মিলনের পথের দিশারী! এই ভাবে ক্ষুদ্র আমির মোহ আবরণ কেটে বৃহৎ মানবিক আমিতে পৌঁছাতে মৃত্যুরও যে একটা সদর্থক ভূমিকা থাকতে পারে, সে সত্যই প্রমাণ করে গেলেন কবি, তাঁর ব্যক্তি জীবনের মৃত্যুশোকের বলয়ে! তাই মৃত্যু মানেই বিলুপ্তি নয়! নয় শূন্যতা! নয় রিক্ততা! মৃত্যুই জীবনকে পূর্ণতা প্রদান করে! তাই জন্ম মৃত্যুর মধ্যে জীবনের মূল অভিপ্রায়, তাঁর মতে- অনন্ত আনন্দরূপম!
আলোচনা শেষ করব একটি পত্র দিয়ে, শান্তিনিকেতন থেকে Mrs George Engel কে লিখছেন কবি, "I have some experience of death myself and I have come to realise that being inevitable it must have as great a meaning as life itself. The suffering which it causes is owing to a sudden interruption in our faith in life's reality; but we must know that every moment that passe carries the footstep of death which walks hand in hand with life as its ceaseless compenion. Life; only in its inseparable unity with death; is complete in its reality."

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,
বিরহদহন লাগে!
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে!!
তবু প্রাণ নিত্যধারা,
হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে
বিচিত্র রাগে!
তরঙ্গ মিলায় যায়
তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে
কুসুম ফুটে!
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ,
নাহি নাহি দৈন্যলেশ---
সেই পূর্ণতার পায়ে
মন স্থান মাগে!



২২শে শ্রাবণ ... ৭ই আগস্ট
তথ্য সংগ্রহ ও রচনা - অনীক ত্রিবেদী


আজ সন্ধ্যে টা একটু অন্যরকম। বাড়িতে অনেক লোক। উৎসবের সময় যেমন হয় অনেকটা সেরম। একটা বিরাট কিছু বোধয় ঘটবে। কিছু মানুষ গুরুদেবের চারিধারে ফিসফাস স্বরে কথা বলাবলি করছে। বাড়ির কিছু মেয়ে মাথার কাছটায় বসে। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন গুরুদেব। ওরা সেই দিকেই তাকিয়ে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বিকেল থেকে। রাতের সাথে সাথে টানও বাড়তে লাগল। যমে-ডাক্তারে টানাটানি। কারো ঘুম হল না । আতঙ্কের সে রাত কি দীর্ঘ কি দুঃসহ। খান খান করা স্তব্ধতার মধ্যে বেশ দূর থেকে শ্বাসটানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অতন্দ্র নিশিযাপন চলল জোড়াসাঁকোয়।

আতঙ্কের দীর্ঘরজনীর যারা সাক্ষী ছিল, ভোরের দিকটায় তাদের অনেকেই ক্লান্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন। আকাশ একটু আলো হতেই ঘুম ভাঙল, এক অনাহুত আতঙ্ক সবার মনে। এই বুঝি দুঃসংবাদ আসে। দুঃসংবাদ প্রকাশিত হল ২২ শে শ্রাবণ সকালের দৈনিক গুলোতে ‘কবির অন্তিমকাল আসন্ন’। দূর দূরান্তে খবর পৌঁছে গেলো, ফোন এলো অসংখ্যবার। কাল রাত থেকে ব্রহ্মসঙ্গীত শুরু হয়েছে। কবির রচিত গান এক এক করে গেয়ে চলেছেন এক এক জন ।তার একটা মৃদু আবহ এসে পৌঁছাচ্ছে দোতালার ঘরে। গুরুদেব হয়তো শুনতে পাচ্ছেন কিন্তু কথা বলার কোনো শক্তি নেই।

আচার্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ঘরে এলেন। মাথার কাছটায় খানিক্ষন দাঁড়ালেন। শুরু হল মন্ত্রোচ্চারণ। ব্রহ্মসঙ্গীতের আবহে আর মন্ত্রচ্চারনের শুদ্ধতায় মন্দিরের পরিবেশ তৈরি হল ঘরটায়।

দূর দূরান্তের মানুষ খবরের কাগজ দেখে উদ্বিগ্ন। এর মধ্যেই আসতে শুরু করেছে অনেকে। শ্রাবণ মাসের থমথমে আকাশ। একটুও হাওয়া নেই। বিধুশেখর শাস্ত্রী গুরুদেবের পায়ের কাছটায় এসে বসলেন। পিতা নোহসি – মন্ত্র পাঠ করছেন। সেই মন্ত্র যা রবীন্দ্রনাথ আজীবন স্মরণ করে এসেছেন।

আকাশ জুড়ে খুব আলো আজ। ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে মধ্যাহ্নসূর্য যখন প্রমূর্ত। ঘড়িতে তখন ঢং ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে মহাপ্রয়াণের প্রসাঙ্ঘাতিক মুহূর্ত। ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে আসছে জিভ। তাহলে কি থেমে যাবে স্পন্দন ?? বন্ধ হয়ে যাবে শ্বাস প্রশ্বাস ? সাঙ্গ হবে ভবলীলা ? যে হৃদয় একদিন ময়ূরের মত নেচে উঠেছিল সে হৃদয় কি তবে সবারে প্রনাম জানিয়ে বিদায় নেবে ? আত্মীয়েরা যখন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গুরুদেব তখন মগ্ন অন্তরাত্মার সাথে অন্তিম আলাপচারিতায় । মিনিটের কাঁটা সবে দশ ছাড়িয়েছে। কবির বাঁ হাত কাঁপছে। ওপরে ওঠানোর চেষ্টা করছেন। কাউকে কি ডাকছেন ? ক একজন এগিয়ে এলো। বহুসম্মানে সে কম্পমান বাহু ললাট স্পর্শ করল। তার পরেই স্থির হয়ে গেল দেহ। উত্তরণ ঘটল মরণোত্তর অন্য কোনো এক স্তরে।