Wednesday, January 3, 2024


সীতাহার চতুর্থ পর্ব
©ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী✍️
খুকুদির বিয়ের বাসর শেষ। কন্যা বিদায়ের পর আমাদের সকলের মন খারাপ। কনকাঞ্জলি দেওয়ার সময় খুকুদি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মিনু মাসিও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আমি ভাবি এ কেমন প্রথা, মা বাবার ঋন কি এক মুঠো চাল দিয়ে শোধ করা যায়? আমার মনে এই প্রশ্ন বারে বারে উঁকি দেয়। আমি এর বিরোধ করি। এর উচ্ছেদ হওয়া উচিৎ। কোন শাস্ত্রে কি এর উল্লেখ আছে? না নেই। খুকুদির সঙ্গে আমার বোন পুতুল যায় বরের বাড়িতে।
বিয়ে বাড়ির ধুম ধামেতে আমাদের বাড়ির আসল ঘটনা চাপা পড়ে গিয়েছে। তন্ময়দা আমাদের বাড়িতে এক লেডি অফসার পাঠান প্লেন ড্রেসে। উনি আমাদের বাড়ি এসে তদন্ত আরম্ভ করলেন।
***সীতাহার চুরির তদন্ত আরম্ভ**
মা জানতেন উনি আসবেন তাই ওনাকে আদোর যত্ন করেন।
মহিলা অফিসার লক্ষ্মীকে জিজ্ঞাসা করেন, কতোদিন কাজ করছ ?
লক্ষ্মী বলে,কুড়ি বছরের ওপর।
- তুমিতো এ. সি. মেকানিককে দেখেছো?
- হ্যাঁ।
- দেখলে চিনতে পারবে?
- হ্যাঁ কেন পারবোনা।
- ও কাজ করার সময় তুমি কোথায় ছিলে?
- মায়ের শোবার ঘরে।
- কতক্ষন?
- ও কাজ করছিল। আমায় বললো জল আনতে। আমি একটা প্লাস্টিকের বড় বালতিতে জল আনতে যাই বাথরুমে।
- এই সময় জগা ননা ডাকে মাছ কুটতে। আমি বলি এখন যেতে পারবোনা। এরমধ্যে একটু সময় যায়।তারপর জলের বালতি নিয়ে মায়ের শোবার ঘরে যাই। মেকানিক, এ. সি. ঢাকাদিয়ে দেয় এক কালো পলিথিনের কাপড়ে তারপর ভ্যাকুম মেশিন দিয়ে জলের বালতি থেকে জল পাম্প করে উঠিয়ে এ. সি. পরিষ্কার করে। ঐ মেকানিক কাজে ব্যস্ত দেখে জগা ননার ডাকে আবার রান্না ঘরে যাই। ফিরে দেখি
এ. সি চলছে কিন্তু মেকানিক নেই।
- ও কাউকে বলে যায়নি?
- না আমি একাই ছিলাম। আমিতো রান্নাঘরে গিয়েছিলাম তাই বোধহয় কাউকে না বলে চলে গিয়েছে।
- হুঁ। বুঝলাম। তুমি মাকে বললেনা মেকানিক চলে গিয়েছে বলে।
- পিসির রান্নার যায়গায় আমার যাওয়া মানা।
- কেন?
- সে মা বলবেন। বলে লক্ষ্মী রান্না ঘরে চলে যায়।
এইসময় মা বলেন, ঠাকুরঝি বড় ছুঁচিবাই মহিলা। লক্ষ্মী জাতের নয় তাই ওর ঠাকুরঝির রান্নার যায়গায় যাওয়া মানা। ও তাই ওখানে যায়না। কি করা যায় বলুন! বাল্যবিধবা। শুনতেই হয় ওনার কথা। উনি মানে আমার স্বামী আবার বোনকে ভীষণ ভালো বাসেন। তাই আমাকে সব দিক সামলে চলতে হয়। ভূলটা আমারি। আমার ঐ সময় থাকা উচিৎ ছিল।
- কি ছিল কি না সেটা ভেবে লাভ নেই। অতো দামি একটা হার চুরি গেল না হারিয়েছে সেটাই দেখতে হবে। আপনার আলমারির চাবি কোথায় ছিল ?
- বালিশের নিচে।
- কি বালিশের নিচে! আশ্চর্য কি বলছেন আপনি!
- লক্ষ্মী জানতো। হ্যাঁ ও সব জানে। ও খুব বিশ্বস্ত। ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে আছে মেয়ের মতন। ওকে অবিশ্বাস কেউ করেনা।
- হুঁ। আচ্ছা আপনাদের বাড়িতে একটি ছেলে কাজ করে শুনেছি। সে কোথায় থাকে?
- গেস্ট রুমের পাসের ঘরে WBCS দেখতে পারি ঘরটা।
- হ্যাঁ কেন পারবেননা। চলুন।
- চিন্ময়ের ঘরে ও একাই থাকে। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ঘর। ঘরের দেওয়ালে মা ভবতারিণীর বড় ফটো। ধুপ জ্বলছে ফটোর পাশে। একটা ছোট টেবিল সামনে একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর কিছু পড়ার বই এবং একটা ল্যাপটপ। দেওয়ালে একটা ডিজিটাল ক্লক আর একটা ছোট স্মার্ট টি ভি।
- চিন্ময় এদের দেখে অবাক হয়ে যায়। বলে, মা কি হল আপনি!
- অফিসার বলেন,হ্যাঁ আমরা এসেছি কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতে।
- বলুন।
- আপনি কি এখানে কাজ করেন?
- হ্যাঁ।
- মাস মাহিনা কতো পান?
- ঠিক নেই। বাবা যখন যেমন কাজ সেইরকম মাস মাহিনা দেন। কোন ঠিক নেই। ওটা আমার হাত খরচ বলতে পারেন। আমি একাউন্টসের কাজ দেখি।
- ও আচ্ছা। তবুও কতো?
- কখনো ১০ কখনো ১৫ হাজার আবার কখনো কিছুইনা। কোন ঠিক নেই।
- আপনার আপত্তি থাকেনা।
- আমাকে উনি ছেলের মতন দেখেন। আমাকে ছোট বেলাথেকে মানুষ করেছেন। পড়াশুনো করিয়েছেন। ওটা আমার চরম প্রাপ্তি। বাড়িতে আছি খাচ্ছি, থাকছি। বাবা নতুন জামা প্যান্ট পুজোর সময় কিনে দেন। আর কি চাই!
- আপনি সন্তুষ্ট।
- না হওয়ার কি আছে!
অফিসারের জানালার ওপর একটা চাবি মার্কা সাবানের দিকে চোখ পড়লো। ওটা দেখে সন্দেহ হয় তাই সঙ্গে নিলেন তদন্তে সহায়ক হতে পারে। এই সাবানের ওপর চাবির ছাপ সহজে নেওয়া যায়।
- অফিসার শোবার ঘরে ফিরে এলেন। মাকে বলেন আপনার আলমারির চাবিটা দেখি।
- মা বালিশের নিচ থেকে চাবির গোছা দিলেন।
- গোদরেজর আলমারির চাবিটা দেখে আশ্চর্য হন অফিসার। বলেন এই দেখুন এখনো একটু সাবান লেগে আছে। একটু মগে করে জল আনুন আমি দেখাচ্ছি। চাবি মার্কা সাবানের পেছনে আরেকটা চাবির স্পষ্ট দাগ। ওটা আলমারির চাবির ঠিক খাপে মিশে যায়।
- মা মগে জল নিয়ে আসেন। মা নিজেই অনুভব করেন একটু সাবানের জলের মতন চ্যাট চ্যাট করছে চাবিতে সামান্য জল দিয়ে ঘোষলে।
- অফিসার চিন্ময়কে ডাকেন।
- চিন্ময় এসে বলে ডেকেছিলেন ম্যাডাম।
- হ্যাঁ। আপনি আপনার জামা কাপড় কিসে কাচেন?
- কেন? সাবানে। আমি নিজেই কাচি। ডিটার্জেন্ট দিয়ে পরে ডুবিয়ে রাখি। কিছু দাগ ডিটার্জেন্ট এ ওঠেনা।
- যেমন?
- যেমন চায়ের দাগ, অন্যকিছু রঙের দাগ। তাই সাবান কিম্বা লেবু ব্যবহার করি। তারপর ব্রাশ করি। আমার জামা প্যান্ট ওয়াসিং মেশিনে কাচা হয়না। আমি নিজেই কাচি।
- হুঁ। বুঝলাম। তা কি সাবান ব্যবহার করেন?
সস্তার সাবান। দামি সাবান কেনার প্য়সা থাকেনা। বই খাতা কিনতেই সব টাকা খরচ হয়েযায়।
- বই খাতা! কেন?
- পড়াশুনো করি ম্যাডাম। WBCS পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। বাইরেতো কোচিং নেওয়ার টাকা নেই। তাই।
- WBCS!! বাহ্ খুব ভালো। তবে বুদ্ধিটা খুব প্রখর নিশ্চই আপনার। প্ল্যানটা কে করেছিলো?
- প্ল্যান কিসের প্ল্যান!! আমি গরিব মানুষ। আমাকে এই ভাবে অপবাদ দেবেন না। আমি যথেষ্ট খাটি এই পরিবারের জন্য। সেই আন্দাজে আমি পারিশ্রমিক পাইনা। আমার উচ্চাসা আছে কিন্তু টাকা নেই। বাবাকে বললে উনি সেরকম আমল দেন না আমার কথার।
- তা বলে চুরি !!! ছি ছি আপনি না শিক্ষিত। আশ্রিত। আপনার এতটুকু মনে হোলোনা এটা মায়ের সঙ্গে বেইমানি করা।
- আমি চুরি কিরিনি ম্যাডাম। কোন বেইমানি করিনি। আমি মায়ের ঘরেই যাইনা।
- কিন্তু সাবানে চাবির ছাপ নেওয়ার জন্য এ. সি. মেকানিককে সাবান দিয়ে কার্য সিদ্ধি করি। তাইনা!
- ওটা ও আমাকে চেয়েছিলো হাত ধোয়ার জন্য। আমি তাড়া তাড়ি ঐ সবনটা এগিয়ে দি। কিন্তু ওটাতে ও ঐ কাজ করবে বলে ঘুনেক্ষরেও বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস করুন। যদি তাই হত তবে আমি কি সবনটা রেখে দিতাম? ঐ লোকটি আমায় ফাঁসানোর জন্য ঔ কাজ করেছে। আপনি ওকে ডেকে বুঝুন।
- আপনি তাহলে করেন নি।
- আমি মায়ের শোবার ঘরে কোনোদিন যাইনা। আমার খাবার লক্ষ্মী আমার ঘরে এনেদেয়। জিজ্ঞাসা করুন।
- মা বলেন ও ঠিক বলছে। ও আমাদের কোন ঘরে যায়না। শোবার ঘর ঠাকুর ঘর কোনো ঘরে যায়না বৈঠকখানা ছাড়া।
- এ. সি. মেকানিকের ফোন নাম্বার আছে?
- বাবার কাছে নিশ্চই আছে।

No comments:

Post a Comment