*নয়নতারা*
*ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী*

১০.১১.২০২৩ শুক্রবার
বেলা ১১. ৫২
পুজোর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ছোট্ট মেয়েটি ঘুরে বেড়াচ্ছিল আপন মনে । সংগে একটা বড় বেলুন । সংগে কেউ বলে মনে হলনা ।পরিচিত কেউ ওকে খুঁজছে এমন ও নয় । তবে কি মেয়েটা একা !
কাছে গিয়ে বলি তোমার নাম কি?
কোন উত্তর নেই !
একটু কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ রেখে একই প্রশ্ন করি । তবুও কোন উত্তর নেই ।
কি আশ্চর্য মেয়েটা কি তবে বোবা কালা ?
কৌতুহল হল মেয়েটির বিষয় ।
আমাকে কিছু বলতে দেখে মেয়েটি মুখে হাত দিয়ে তার ডান বৃদ্ধাংগুষ্ঠি নাড়ায় পরে আবার কানের কাছে নিয়ে ওই একই ইশারা করে। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকায় ।
আমি বুঝি মেয়েটি বোবা কালা ।
ভারি মুশকিল আমি কি করে ওকে বোঝাই আমার মনের কথা?
মেয়েটি আমার কাছে কি মনে করে আসে তারপর ইশারায় বোঝায় তার বাড়ি ওই দিকে ।
আমি দু হাতে চালা _/\_ করে বোঝাই তোমার বাড়ি?
- মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় । মানে হ্যাঁ ।
- আহারে কত কষ্ট এই নিষ্পাপ শিশুটির মনে । কিন্তু কে তার বাবা মা?
- মেয়েটি আমাকে কিছু বলতে চায় যা দেখে আমি বুঝি ও ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে চায় ।
- একেই বলে শিশু যে আপন পর বোঝেনা। বলি চল... হাত দেখিয়ে বলি চল ।
- গুটি গুটি পায়ে এগোই ওর পিছু পিছু ।
- এক পরিত্যক্ত মোটর গ্যারেজের মধ্যে এক বৃদ্ধাকে দেখি সেলাই করতে । একটা ছোট্ট আলো জ্বলছে । বৃদ্ধা ছুঁচ সুতো নিয়ে আপন মনে কি সেলাই করছেন ।
- আমাদের দেখে চকিত আমার মুখপানে তাকিয়ে বলেন, কে তুমি বাবা ? এখানে কেন এয়েছ?
- যাক ইনি কথা বলতে পারেন তাহলে। আমি বলি, মাসি আমি তোমার নাতনী কে একা একা ঘুরতে দেখে নিয়ে এলাম তোমার কাছে । ওকে এখানে ছেড়ে দিয়ে আমি ফিরে যাব আমার ঘরে ।
- ও আমার নাতনী নয়।ওকে আমি এক মেলায় পেয়েছিলাম। সেইথেকেই ও আমার কাছে আছে। ওর কেউ নেই আমারো কেউ নেই। আমি যা রোজগার করি আমাদের দুজনের পেট চলে যায়।
ও ঠিক এই রকমই একা একা ঘুরছিল। অনেক জিজ্ঞ্যেশ করেও ওর বাড়ির ঠিকানা পাইনি। যতটুকু ঠারে ঠোরে বুঝি ওর বাবা মা কেউ নেই ও প্রায় অনাথ। কার সংগে এসেছিল তাও বুঝিনি। দিনকাল যা খারাপ ওই মেয়েকে কেউ বদ উদ্দেশ্যে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে তাই আমার কাছে নিয়ে এলাম। প্রায় তিন মাস হয়ে গেল কেউ খোঁজ খবর করে নি। ভাবলাম থানায় দিয়ে আসি কিন্তু থানায় নিয়ে যাচ্ছি বুঝতে পেরে ও ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার মনে হয় ওর থানা পুলিশে ভয় আছে।
- মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে কি বলতে চায়।
-আমি বলি কিছু খাবি?
-মাথা নাড়িয়ে বৃদ্ধার দিকে হাত দেখিয়ে বলে ও দেবে খেতে।
- মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছিল নিশ্চই বড় ঘরের মেয়ে । অবহেলায় আছে জামা কাপড় খুব ই সাধারন.... মাথার চুল উস্কো খুস্কো কিন্তু মুখের হাঁসি আর চোখ দুটোই বলছে নিশ্চই কোন সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে । হয় হারিয়ে গিয়েছে নয় অন্য কোন কিছু রহস্য আছ ।
- আমি ত ফেলুদা নই কি ব্যোমকেশ বক্সি নই যে রহস্যের উৎস জেনে তার পেছনে ঘুরে কিছু সুরহা করব !
- কি করাযায় এই নিষ্পাপ শিশুটির জন্য। চাইল্ড হেল্প লাইনে ফোন করলে হয়। নেট সার্চ করে নাম্বার পেলাম। ওর ফটো মোবাইলে তুলে হোয়াটস এপ এ পাঠালাম। রিপ্লাই এলো। আমরা পৌঁছচ্ছি।
বৃদ্ধাকে বলাতে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তোমাকে কে বলেছে ওই সব করতে । ও আমার কাছে আছে আমার কাছেই থাকবে।
- আমি বলি মাসি ও ওখানে অন্য ছেলে মেয়েদের সংগে ভালো থাকবে। তুমি কি চাওনা মেয়েটি ভালো থাকুক ?
- আমি একা একা এই গ্যারেজে থাকি। আমার কেউ নেই। ও থাকলে আমার ভালো লাগে। যা রোজগার হয় তাতে ওর আমার চলে যায়।
- কিন্তু এরকম ক দিন চলবে? তুমি কি সবদিন ওর কাছে থাকবে?
- তা কেন বালাই সাঠ।
- এর মধ্যে পুলিস এবং চাইল্ড লাইনের কিছু সমাজ সেবিকা এসে হাজির।
- পুলিশ বৃদ্ধাকে নানা প্রশ্ন করেন। বেগতিক দেখে মেয়েটি বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে বোঝায় যে ও ভালো।
মেয়েটিকে চাইল্ড হেল্প লাইনের ম্যাডাম রা মুক বধিরদের বোঝার মত ঠারে ঠুরে কি সব জিজ্ঞাসা করলেন। মেয়েটি যা বুঝলো তার উত্তরে বলে ওর মা বাবা কেউ বেঁচে নেই এক রোড একসিডেন্টে ওর বাবা মা মারা যান। ও কিরকম করে বেঁচে যায় ঈশ্বরের কৃপায়। ওকে পুলিস ধরে নিয়ে গিয়েছিল চাইল্ড হেল্প লাইনে দিতে কিন্তু ও সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। পুলিসকে কেন মেয়েটি ভয় পায় বোঝা যাচ্ছেনা। বৃদ্ধাকে আঁকড়ে ধরে বলে ও ওই মাসির কাছেই থাকবে।
আমি বোঝাই দেখ মা তুমি ওখানে বাচ্চাদের সাথে খেলা করবে, পড়াশুনো করবে, ছবি আঁকবে আরো কত কিছু করবে। এখানে বুড়ি মাসি না থাকলে তুমি কি করবে তখন কোথায় যাবে?
মেয়েটি বুড়িকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ও হাত নাড়িয়ে বললো ও যাবেনা। ও বুড়ি মাসির কাছে থাকবে। ও বড় হয়ে বুড়ি মাসিকে খাওয়াবো।
মহা মুস্কিল ! আমি বলি তুমি আদ্যামার আশ্রমে ভালো থাকবে। ওখানে তোমার মতন অনেক বাচ্চা আছে। তারা ওখানে ভালো আছে। পড়াশুনো করছে, খেলাধুলো করছে, গান গাইছে, ছবি আঁকছে আবার হাতের কাজ করছে। তুমিও তাই করবে। তুমি ওখানে ভালো থাকবে। তুমি যাবেনা?
বুড়ির চোখে জল। ওর মেয়েটির প্রতি খুব মায়া পড়ে গিয়েছে। মেয়েটিও ওকে জড়িয়ে কাঁদছে।
আমি বলি পুলিশ কে আপনারা না গেলে ও ভয় পাবে কিছুতেই যাবে না। আমি মেয়েটির জন্য ক্যাডবেরি এনেছিলাম। সেটা বুড়ির হাতে দি। বলি মাসি তুমি বললে ও যাবে। তুমি ওকে বোঝাও যে তুমি ওকে দেখতে যাবে।
বহু কষ্টে মেয়েটি রাজি হয় যেতে। চাইল্ড হেল্প লাইনের মহিলারা মেয়েটিকে বুড়ির সঙ্গে নিয়ে সোজা আদ্যা মায়ের আশ্রমে নিয়ে যায়। আমি ভাবি যাক মেয়েটির একটা হিল্লে আদ্যা মা নিজেই করেছেন। আমি ওর নাম নয়নতারা দি। ও আমার নয়ণ তারা। প্রতি সপ্তাহে আমি যাই মেয়েটিকে দেখে আসি। আমার কেমন যেন মেয়েটির প্রতি মায়া পড়ে গিয়েছে। বোধহয় আমার মেয়ে নেই তাই। ও যে আমার নয়ণ তারা। আমার মা দুর্গা। ঈশ্বর ওকে ভালো রাখুন।
© ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

No comments:
Post a Comment