Thursday, May 13, 2021

মুখাগ্নি (শেষ পর্ব) ✍️ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী


 

মুখাগ্নি (শেষ পর্ব)

✍️ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

এ. সি. পি চক্রবর্তী , রঞ্জিত ব্যানার্জীকে সঙ্গে নিয়ে মর্গে পৌঁছন l ইন্সপেক্টার শশাঙ্ক সঙ্গে দুজন কনস্টেবল কে নিয়ে মর্গে জান পুলিশের জিপে l
এরমধ্যে খবর পেয়ে ভগবান পান্ডে এবং রিপোর্টার প্রতিভা টি. ভি. ইউনিট নিয়ে মর্গে পৌঁছন l প্রতিভা লাইভ টেলিক্সষ্টের আয়োজন করে এবং বুম নিয়ে সমস্ত খবর এইরকম ভাবে পরিবেশন করে..... আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমরা এখন মর্গে আছি যেখানে রোহিতের লাশ রাখা হয়েছে l কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা আশা করছি রোহিতের বাবা মা এবং এ. সি. পি. চক্রবর্তী ও ইন্সপেক্টার শশাঙ্ক যারা জান লড়িয়ে সার্প সুটারদের এনকাউন্টার করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা সকলে এসে পৌঁছোবেন l
এ. সি. পি. চক্রবর্তী বুম এবং ক্যামেরা সরাতে বলেন l এখন এই দুঃখের পরিস্থিতিতে লাইভ টেলিকাস্ট করতে দেওয়া অমানবিকতা হবে l
প্রতিভাকে বলেন দেখুন আপনি একটু মানবিক দিক থেকে ভাবুন একজন বাবা মা'র ওপর কি মানসিক চাপ থাকে সেটা নিশ্চই সহজে বুঝতে পারছেন l আমাদের একটু একা থাকতে দিন.. প্লিজ l
রঞ্জিৎ বাবুকে রোহিতের লাশ দেখানো হয় l উনি বলেন না না এ আমার ছেলে রোহিত নয় l এ অন্য কেউ l রোহিত তো সিলিকন সিটি তে l যাকে তাকে রোহিত বলে বললেই আমি মেনে নেবে l আমারতো কোন যমজ ছেলে ছিলোনা হিন্দী সিনেমার মতন বলে পেছনে ঘুরতেই ভগবান পান্ডের মুখো মুখি হন l
রঞ্জিৎ বাবু ভগবানের কলার ধরে বলেন তুই আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই ফাঁদ পেতেছিস l এ. সি. পি. কে আমাদের বিরুধ্যে বলে আমার সম্মান ক্ষুন্ন করতে চেষ্টা করছিস l তোর আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার এই কি সময়!
ঠিক এই সময় সুনয়না দেবী এসে পৌঁছোন ওনার মেয়ে রিঙ্কিকে নিয়ে l রিঙ্কি দৌড়ে যায় মর্গে তার দাদাকে দেখতে l ওর মা ডাকেন মেয়েকে l কিন্তু মেয়ে ওনার ডাক না শুনেই টেবিলে শোয়ানো লাশ দেখে l ওনার মেয়ে মেডিকেলের স্টুডেন্ট লাশের মুখ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ে l
ভগবান বলে একটা কুকুর ও রাস্তায় মরে গেলে তার মা তাকে ঘিরে থাকে l কাউকে কাছে ঘেঁসতে দেয়না l আজ নিজের ছেলেকে মা বাবা চিনছে না শুধু সমাজের ভয়ে l এ. সি. পি স্যার আপনি দিন আমি ওর শব সৎকার করবো l ও আমার ছেলের মতন l ওর পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম আমি করবো l রঞ্জিৎ সাহেব তুমি থাকো তোমার ঝুটা সমাজ নিয়ে আমিতো মদ বিক্রি করি নিজে মাতাল আমি সমাজকে ভয় পাইনা কারণ আমার ইজ্জত আমার বৌ আত্মহত্যা করার পর চলে গিয়েছে l কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে আমার মেয়েকে ওর শ্বশুর বাড়ির লোক এক লক্ষ টাকা পণ দিতে পারিনি বলে পুড়িয়ে মারে l আমার স্ত্রী সেই দুঃখে মেয়ের শোক ভুলতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন l পুলিশ আমাকেই সন্দেহ করে কারণ এই রঞ্জিৎ ব্যানার্জী আমাকে আমার কোম্পনি থেকে বার করার সুব্যবস্থা করে বসকে ভুলিয়ে l রঞ্জিৎ বাবু তুমি কত লক্ষ টাকা খেয়েছো পারচেস ডিপার্টমেন্ট থেকে l আমি সব ফাঁশ করে দিতাম কারণ আমি কোম্পানির একাউন্টস টা ভালো করে দেখতাম l তুমি টাকাই রোজগার করতে কিন্তু মনুষত্য হারিয়েছিলে l আমার মেয়ে বৌ সব তোমার জন্য আমাকে একা রেখে চলেগেলো l আজ আমি মাতাল হয়েছি তোমার জন্য l কিন্তু আমি মানুষ, কুকুর নই তাই আমি তোমার রোহিতের শ্রাদ্ধ করবো l এ. সি. পি স্যার আমাকে বডি দিন...
না কখনো না.. চিৎকার করে ওঠেন সুনয়না দেবী l ও আমার ছেলে... ও আমার ছেলে... আমার গর্ভের সন্তান l আজ ওর এই পরিণতির জন্য আমি দায়ি.... হ্যাঁ আমি দায়ি l কেউ ওর বডি টাচ করবেনা l ওকে কেউ ছোঁবেনা l
রঞ্জিৎ ভগবানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে l ভগবান আমায় ক্ষমা কর ভাই l আজ তোর বৌ আর মেয়ের অভিশাপে আমার পরিবার ছারখার হয়ে গেলো l আমার একমাত্র ছেলে এনকাউন্টারে মারা গেলো l আমি পাপি....আমি পাপি.... আমায় ক্ষমা কর l প্রতিভা কিন্তু সমস্ত ঘটনা রেকর্ডিং করে চলেছিল l কিন্তু কোন রিপোর্টিং করেনি l পরে এডিট করে সাউন্ড জুড়ে দেবে l
এ. সি. পি. চক্রবর্তী, ভগবানকে ধন্যবাদ দেন l উনি স্বীকার করেন আজ সমস্ত অপারেশন এর পেছনে ভগবানের হাত আছে l ও নাথাকলে আমরা কিছুতেই সফল হতে পারতামনা l
কেওড়াতলা শ্মশান :-
রঞ্জিৎ ব্যানার্জী কলসপূর্ন জল নিয়ে কাষ্ঠ খণ্ডিগুলির উপর রাখা নিজের একমাত্র পুত্রের শবের চারিদিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করেন l তারপর কলসির জল ফেলেদিয়ে মৃতের মুখে অগ্নি সংযোগ করে মুখাগ্নি করেন l এরপর ব্রাহ্মণ মন্ত্র উচ্চারণ করেন
আমরা সনাতন ধর্মালম্বীরা বিশ্বাস করি যে মানুষ মৃত্যুর পর দেবলোকে যায়।কিন্তু তিনি দেবালোকে যাবেন কি করে?
কৃত্বাতু দূস্কৃতং কর্মং জানতা।
মৃত্যুকাল বশং প্রাপ্য নরং পঞ্চতমাগতম্ ধর্মাধর্ম মমাযুক্তং লোভ মোহ সমবৃত্তম দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যাং লোকান স গুচ্ছতু।
অনুবাদঃ- তিনি জেনে বা না জেনে অনেক দুষ্কর্ম করে থাকতে পারেন।কাল বশে মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকেন।এ দেহ ধর্ম-অধর্ম, লোভ -মোহ প্রভৃতি দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল।হে অগ্নিদেব!আপনি তার সকল দেহ দগ্ধ করে দিব্যিলোকে নিয়ে যান।
অন্যেষ্টি ক্রিয়া :-
প্রতিভা বুম হাতে শুরু করেন ; আমি প্রতিভা জনমত টি. ভি. থেকে সঙ্গে ক্যামেরায় প্রদীপ্ত আর সুখেন্দু, রোহিতের অন্তেষ্টি ক্রিয়ার লাইভ কভারেজ টেলিকাষ্ট করছি l শেষ পর্যন্ত রোহিতের বাবা মা'র খোঁজ পাওয়াজায় তাঁরা মর্গ থেকে রোহিতের শব কেওড়াতলা শ্মশানে নিয়ে যান l পুলিশ সঙ্গে ছিলো l রোহিতের বাবা রঞ্জিৎ ব্যানার্জী এক মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির জেনেরাল ম্যানেজার এবং মা সুনয়না দেবী কলকাতার এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রিন্সিপাল l বোন রিঙ্কি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী l সকলে উপস্থিত থেকে শব সৎকার হয় l
সমাজে যারা শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব বলে নিজেদের মনে করেন তাঁরা নিজের সন্তানের প্রতি বেশি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন l অহেতুক পুত্র সন্তানের প্রতি অধিক স্নেহ দেখিয়ে তার হাতে প্রয়োজনের অধিক টাকা দিলে তারা বিপথগামী হবেই l এতে কোন সন্দেহ নেই l রোহিতের হাতে তার মা প্রচুর টাকা দিতেন l সেই টাকায় সে ড্রাগের নেশা ধরে l মাদক চক্রের সঙ্গে মিশে সুপারী কিলারে পরিণত হয় l নিজের জীবন ছারখার হয়ে যায় এবং এমন ই অবস্থার সৃষ্টি হয় যে তাকে পুত্র বলে পরিচয় দিতে তার আপন পিতা মাতা অস্বীকার করেন l কিন্তু ভগবান পান্ডে মদের ব্যবসা করে মাতাল হয়েও প্রতি পদে পদে পুলিশকে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে শেষ মেস রঞ্জিৎ বাবুকে বলে যে সে রোহিতকে বেওয়ারিশ লাশ হতে দেবেনা সে তার সৎকার নিজে করবে l এখানেই বোঝাযায় যে শুধু পড়াশুনো করে সমাজে উচ্চপদে কেউ থাকলেই সে মানুষ পদবাচ্য হতে পারেনা যদি না সামান্য মনুষত্য তার মধ্যে থাকে l ভগবানকে বিনা কারণে রঞ্জিৎ ব্যানার্জী চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করেন কারণ সে রঞ্জিৎ এর কালো টাকা রোজগার ধরে ফেলেছিলো l তার মেয়ের বিয়েতে পণ না দিতে পারার জন্য মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারে তার শ্বশুর বাড়ির লোক l সেই দুখঃ কষ্ট তার স্ত্রী সহ্য না করে আত্মহত্যা করে l ভগবানকে জেল খাটতে হয় স্ত্রীর মৃত্যুর দায় নিয়ে পরে সে জামিনে ছাড়া পায় l তারপর মদের ব্যবসা করে l রোহিত তার দোকানে ড্র্যাগ সেবন করতে আসতো সেই খবর সে রঞ্জিৎ বাবুকে দেয় l তখন যদি রঞ্জিৎ বাবু ছেলেকে নিয়ে যেতেন তাহলে হয়তো সে অকাল মৃত্যু বরণ করতোনা l এটা সমাজের এক কলংকিত অধ্যায় হয়ে থেকেগেলো l

---------সমাপ্ত---------


No comments:

Post a Comment