Tuesday, June 9, 2015

যার শেষ ভালো তার সব ভাল ( সত্য কথন , পাত্র কাল্পনিক) ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী / ০৯.০৫.২০১৫ / ২৫শে বৈশাখ ১৪২২ / শনিবার /



যার শেষ ভালো তার সব ভাল 
( সত্য কথন , পাত্র কাল্পনিক)
ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী / ০৯.০৫.২০১৫ / ২৫শে বৈশাখ ১৪২২ / শনিবার /
আমি তখন উড়িষ্যা , সম্বলপুর জেলার ‘বেলপাহাড়’ এ পোষ্টে-ড ।সালটা যা মনে পড়ে ১৯৭৭ সাল। বেলপাহাড় জায়গাটা খুব ভাল ছিল। সম্বলপুর থেকে বেলপাহাড় প্রায় ৯০ কি।মি। ট্রেন বাস দুটোতেই যাওয়া যায় । ঝারসুগুড়া হয়ে যেতে হয় । আমি রেঞ্জ অফিসার ছিলাম বেশ কিছুদিন বেলপাহাড়ে । নতুন চাকরি , সদ্য কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছিলাম । অনেক কৌতূহল মনে নতুন যায়গাতে পৌঁছে দেখি আমার জন্য সব ব্যবস্থা হয়ে আছে । কোয়ার্টারটা খুব সুন্দর বাংলো টাইপের । বাস স্ট্যান্ড থেকেই রিসিভ করল আমার এক আর্দালি ‘নীলমণি সা’ আর পাণ্ডা বাবু ডেপুটি রেঞ্জার । হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ ছিল আমাকে নিয়ে ঠিক যায়গায় পৌঁছে দেওয়ার। তাই আমার কোন অসুবিধে হয়নি। সদা হাস্যময় নীলমণি কে দেখে একটু মনে জোর পেলাম।
নীলমণি কোয়ার্টারে এসে জিজ্ঞাসা করল, “কাণা খাবাকে আনবি বাবু ?”সম্বলপুরি ভাষাতে । তার মানে , কি খাবার আনবো বাবু ?
আমি বলি যা পাবে তাই নিয়ে এসো । ওকে ১০ টাকা দিলাম রাতের খাবার আনার জন্য । তখন ১০ টাকা অনেক । তাই ওই টাকাতেই সব কেনা কাটা হয়ে গেল ।
নীলমণি কিছুক্ষণ বাদে দুখানা তন্দুর রুটি , ডাল-ফ্রাই এক প্লেট , ডিমের অমলেট নিয়ে এলো কাছের ঢ়াবা থেকে। সঙ্গে একটা কাটা পেয়াজ আর আচার । খুব তৃপ্তি করে খেলাম মনেই হলনা বাড়ি ছেড়ে আছি বলে। রাতের ডিনারের পর আমার এক গ্লাস দুধ লাগে তবে ওটা কোথায় পাবো ?
আমি সঙ্গে লাগেজ বলতে কিছুই আনিনি। নতুন চাকরিতে জয়েন করতে এসেছি । তিন পেয়ার সার্ট প্যান্ট , লুঙ্গী , তোয়ালে গামছা, টুত ব্রাশ , পেস্ট,একটা লাক্স সাবান ইত্যাদি । একটা বেড হোল্ডার । এখানে কোয়ার্টারে খাট,টেবিল চেয়ার ইত্যাদি আসবাব পত্র আছে । দুটো ঘরে সিলিং ফ্যান আছে ।আমি শুনেছি যে ,পশ্চিম উড়িষ্যায় গ্রীষ্ম কালে রৌদ্র তাপ অসহনীয় । ৪৩-৪৪ ডিগ্রী ছাড়িয়ে যায়।  আমি ব্যাচেলার মানুষ , এখন যা সঙ্গে এনেছি এবং যা আছে মোটা মুটি  চলার জন্য যথেষ্ট । 
সকালে দেখি নীলমণি বেড টি নিয়ে এলো । ও সকালে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেল রান্না বান্না করবে বোধ হয় । দেখি বেশ গুছিয়ে সব কিনে এনেছে । আমার চিন্তা গেল। নীলমণি কে এখানকার আগের রেঞ্জার বাবুর্চি র ট্রেনিং দিয়েছেন । ও রান্না তে এক্সপার্ট দেখলাম।
দন্ত মঞ্জন করে বেড টি খেয়ে প্ল্যান্টে-সন সাইটে বেরিয়ে পড়লাম পাণ্ডা বাবুর সঙ্গে ওনার সাইকেলে ।তখন মোটর সাইকেল বিলাসিতা ছিল । প্রায় সকলে সাইকেলে যাতায়াত করতো। তবে অফিস থেকে আমার জন্য মোটর সাইকেল আনা হচ্ছে , কারন রেঞ্জ অফিসারদের যাতায়াতের সুবিধের জন্য সরকার থেকে মোটর সাইকেল সাপ্লাই করা হয় । কিন্তু তখন ও আমি মোটর বাইক চালাতে জানতাম-না।   আমি সব কাজু প্ল্যান্টে-সন সাইকেলে ঘুরে দেখতে সুরু করলাম।
টিঙ্গিস্মাল প্ল্যান্টে-সন এ গেলাম। ওরা কি সব কাজ করে দেখলাম। সেদিন ফার্টিলাইজার এপ্লিকেশন চলছিল। ৫০ জন লেবারার কাজ করছিল। মাস্টার রোল দেখলাম । কাজু গাছের চারিদিকে প্রায় পাঁচ   ফুট ব্যাসের গোলাকৃতি একটা রিঙের মতন করা হয়েছে তাতে তিন রকমের সার মিশ্রণ করে প্রয়োগ করা হচ্ছে । তারপর মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে । কোন বছর কাজু বাদাম লাগান হয়েছে , কত আয়তনের (
একারে) সব বৃত্তান্ত  লেখা একটা বোর্ডে । এই প্ল্যান্টে-সনের সার্ভেয়ারের এর নাম সুধীর রঞ্জন দাস । ভদ্রলোক খাঁকি পোষাকে ছিলেন । আমাকে দেখে স্যালুট করলেন। পাণ্ডা বাবু ডেপুটি রেঞ্জার  আমাকে এখানকার কাজ সব বোঝাচ্ছিলেন। আজ ঝারসুগুড়া থেকে অফিসার আসবেন বিকেলে । এর পর আরোদুটো প্ল্যান্টে-সন দেখতে গেলাম। সবকটা সাইকেলে ।
বিকেলে যিনি এলেন তাঁর নাম , শশিকান্ত মিশ্র । ইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর । আমার অফিসার । উনি ঠিক বিকেল ৫ টার সময় এলেন একটা জিপে । পেছনে কিছু চেলা চামুণ্ডা । সঙ্গে স্টেনো ।
আমাকে দেখে বললেন, “হাও আর ইউ ফিলিং ইয়ং ম্যান ?”
ফাইন সার । নো প্রব্লেম।
হেভ ইউ চেকড দি মাষ্টার রোল ?
ইয়েস সার , দ্যাট্ ইস পার্ট অফ মাই ড্যুটি  ।
দেটস্ ফাইন লেট মি সি ।
ইউ উইল বি গিভেন উইথ দ্যা ড্রেস ফর রেঞ্জ অফিসার , এন্ড দি মোটর সাইকেল সুন  আন্টিল দেন বিয়ার উইথ আস । 
কি করে বলি যে আমি মোটর সাইকেল চালাতে শিখিনি । তবে শিখে নিতে পারবো বলে মনে হয়। 
মিশ্র সার বলেন ,  প্লিজ চেক দি সাইড গ্রেফটিং প্ল্যান্টে-সান ফর কাজু । ইট ইজ এ নিউ স্কিম। সি দ্যাট্ দি সাইওন মেটে-রিয়াল ইজ কালেক্টেড ফ্রম ইলাইট প্লান্ট ওনলি । 
ওকে সার । 
উনি বিকেলের চা জলখাবার খেয়ে চলে গেলেন প্রায় সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ । আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট চক্রধর পাণ্ডা বাবু সব এরেঞ্জমেন্ট করেছিলেন । 
এখানে অফিসার এলে তাদের তদবির করতে হয় দেখছি । অবশ্য নীলমণি আছে কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু আমার কাছে তো অতো টাকা নেই । আমি যৎসামান্য টাকা নিয়ে এসেছি। 
পাণ্ডা বাবুকে বলাতে উনি বলেন অগুলোর জন্য আলাদা টাকা থাকে । আপনার কিছু চিন্তা নেই । 
মানে ?
মানে পরে জানবেন সার । 
ওনার কথার মধ্যে কিছু ইঙ্গিত আছে লক্ষ্য করলাম । এসবে উনি খুব পোক্ত মনে হল ।  
মনে মনে ভাবলাম ব্যাঙ্কের পরীক্ষাগুলো দিতে হবে। আমার পি জি টা সেরে নিতে হবে । এ চাকরি বোধ হয় আমার জন্যে নয়। আমি মিস ফিট । রিজাইন দিতে হবে । তবে রেসিগ্নেসন একসেপ্ট হয়না সাধারণত সরকারি চাকরীতে । পরে আসছি সেই কথায় । 
বাবাকে রাতে চিঠি লিখতে বসি। সব বৃত্তান্ত লিখে একটা ইনল্যান্ড লেটার পোষ্ট করি।
মাস না ঘুরতেই ডেপুটি ডাইরেক্টর শ্রী বিচিত্রানন্দ দাস আসেন ইন্সপেকশনে । সঙ্গে এসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর পাণ্ডা সার । 
আগে-থেকে পাণ্ডা সার এডভান্স পার্টি পাঠান । প্রায় দশ বারো জন স্টাফ । 
নীলমণি কে হন্ত দন্ত হয়ে বাজার করতে দেখি । মাছ , মাংস , মুর্গী , তরি তরকারি । বাবা ! এ তো বিয়ে বাড়ীর ভোজ । চক্রধর পাণ্ডা বাবু টাকা দিচ্ছেন আর নীলমণি সব পরিপাটি করে কিনে আনছে । বিরাট হাঁড়ি , ডেকচি সব বসিয়ে রীতিমত বিয়ে বাড়ীর রান্না । কে খাবে এতো সব ভাবি !! 
বেলা ১১ টা নাগাদ ডেপুটি ডাইরেক্টর সাহেব এলেন। পাণ্ডা সার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে আপাদ মস্তক দেখে বললেন ফ্রেশ গ্রাজুয়েট ? ট্রেনিং কমপ্লিটেড । 
ইয়েস  সার ।  
কাজগুলো বুঝেছ ? এখানে অনেক কাজ আছে তোমার ওপর সব নির্ভর করছে ।
আই উইল ডু মাই বেস্ট সার ।
দ্যাট্ ইস হোয়াট এক্সপেক্টেড ফ্রম ইউ ।
মিঃ পাণ্ডা তুমি কি ভাবছ এই ছোকরা পারবে ?
সবাই তো নতুন চাকরিতে ছোকরাই থাকে সার । আপনি , আমি সকলেই একদিন তাই ছিলাম। 
সকলে হেঁসে উঠলো এক সঙ্গে ।
"বিচিত্রা নন্দ দাস" ভদ্রলোকের কথা কেন যেন আজ বারে বারে মনে পড়ছে । এক কালে খুব প্রতিপত্তি ছিল তাঁর । ডেপুটি ডাইরেক্টর ছিলেন ।তখনকার ডেপুটি ডাইরেক্টর খুব বড় পোস্ট আর ক্ষমতাও খুব । তাই এই গল্প লিখতে গিয়ে কিছু কিছু স্মৃতি ভেসে উঠছে চোখের সামনে । ভদ্রলোকের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মানুষের কাছ থেকে কিছু না কিছু আদায় করা । এডমিনিস্ত্রেটিভ অফিসার ছিলেন তাই লোকে ভয় করত কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারতোনা সহজে । এমন হেন লোকের কাছে আমার পোস্টিং হওয়াতে আমি খুব বিব্রত ছিলাম। কিন্তু সরকারি চাকরি করতে গেলে এরকম অনেক সমস্যা হয় যা নিজেকেই সমাধান করতে হয়। অন্য কেউ কখন সাহায্যের হাত বাড়ায় নি । 
সেই বিচিত্রা-নন্দ দাসের খাওয়ার গল্প শুনেছিলাম , আজ চাক্ষুষ দেখলাম। প্রায় ১ কিলো র ওপর পাঁঠার মাংস , দু বাটি মুর্গীর মাংস ,১০-১২ টা মাছ ভাজা , এক জাম বাটি পায়েস । আমার চোখ ছানা বড়া তার সঙ্গে মেটের তরকারি চর্বি দিয়ে ! একিরে ভাই , একি ? রাক্ষস নাকি ? কি করে হজম করেন ভদ্রলোক ? এতো রাক্ষস । 
এই খাটুনির চাকরিতে না খেলে ফিল্ডে কাজ করবে কি করে ? বোধ হয় আমার উদ্দেশ্যে বলছিলেন কথাটা । পেট ভরে খাবে আর নিজের কাজ প্রাণ দিয়ে করবে । 
পরের কথাটা ঠিক কিন্তু প্রথমটা মানতে পারলাম না। 
বিকেল বেলায় যাওয়ার আগে দেখলাম জিপের পেছনে দু আডাই কিলো ওজনের একটা রুই মাছ । সঙ্গে সর্ষের তেলের টিন আর রকমারি তরি তরকারি । মনে মনে ভাব্লাম এও আছে ! 
গা ঘিন ঘিন করলো দেখে। বাবাকে সব বৃত্তান্ত লিখে জানালাম । আমি এই চাকরি ছেড়ে দেব স্থির করলাম। টপ টু বটম কারাপ্টেড । নো আই মাস্ট রিজাইন । তাই করলাম । অনেক কষ্টে একসেপ্ট হয় আমার রেসিগ্নেসন ।  পোষ্ট গ্রাজুয়েশন এর জন্য ভুবনেশ্বর ফিরে যাই। আসার সময় নীলমণিকে ১০০ টাকা বকশিস দিয়ে আসি । ও আমার অনেক যত্ন করেছে। ও কিন্তু একদম নিতে চাই-ছিলনা । 
পরে শুনেছি সেই বিচিত্রা-নন্দ দাস ভিজিল্যানসের জালে পড়ে সাসপেন্ড হন । ছেলেগুলো অমানুষ হয় । মেয়টা এক ক্লার্কের সঙ্গে ভাগে । বৌ পাগল হয়ে জান । এখন ভদ্রলোক আমাদের ই বাড়ির কাছা  কাছি থাকেন। দেখলে মায়া হয় । প্যারালিসিস এর পেসেন্ট । অতি দৈনন্দিন অবস্থা। কেউ দেখার নেই। কোথায় গেল ওই রাক্ষসের খাওয়া ? 
সততা নিয়ে চাকরি করলে ভগবান সহায় হন । চুরির টাকা বেশি দিন থাকে না। সাময়িক রসনা তৃপ্তির জন্য নিজেকে পরের কাছে ছোট করা মুর্খামির কাজ। আমার মানবিকতায় বাধে । তাই বলি
যার শেষ ভালো তার সব ভাল ।

No comments:

Post a Comment