অনুগল্প লং বেঞ্চ
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১৯.০৩.২০১৫ / বেলা ১.১৫
।
পার্কের এই কংক্রিটের লং বেঞ্চটা বরিষ্ঠ
নাগরিকদের জন্য উদ্দিষ্ট । একটু নিরিবিলি পরিবেশ । সামনেই ছোট্ট একটা ফুলের বাগান
আছে তাতে নানান রঙের গোলাপ , রজনীগন্ধা , ডালিয়া , জারবেরা
ইত্যাদি ফুলের শোভায় এক মনোরম পরিবেশ ।
বেঞ্চের ওপর ছায়ার জন্য বেশ পেছনে একটা কদম গাছ । বলে
কদম গাছে নাকি কেষ্ট নাচে গোপীদের জন্য , তাই এই - বরিষ্ঠ নাগরিকের বসার জায়গায় কদম গাছটাই বেশ
বেমানান। এই অঞ্চলের কাউন্সিলার ঠিক যায়গাতেই বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বসার যায়গাটা
ঠিক করেছেন পার্কের মধ্যে । সামনেই মাঠের মধ্যে আরেকটা গোলাকার ঘর যার চালাটা
এসবেস্টস এর তৈরি । চূড়াটা কোনিকাল আকৃতির এবং গোলাকার বেঞ্চ , বসার জন্য । মধ্যেখানে
সুন্দর অর্কিড। পাসের দেওয়ালটা খোলা তাই আলো
বাতাস আসার অসুবিধা নেই। মোটামুটি বলতে গেলে এরকম একটা পার্ক সাধারণত সল্ট লেকেই
দেখতে পাওয়াযায় ।
প্রসঙ্গে আসি । এই বেঞ্চটাতে আমরা ৫ জন
অবসরপ্রাপ্ত বরিষ্ঠ নাগরিক এসে বিকেল বেলায় আড্ডা দি। আমরা বলতে ১. পঞ্চুদা , ২. নিহারদা , ৩. রণজিৎ-দা , ৪. সমরেশ দা এবং আমি । এনাদের মধ্যে
আমি সর্ব কনিষ্ঠ । পঞ্চুদা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ তাই সকলে ওনাকে সম্মান
করেন। আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক
রাজনীতি , খেলা , কিছু ধর্মালোচনা আবার
তার মধ্যে কখন কার্ল মার্ক্স ত কখন শ্যামা প্রসাদ মুখুজ্জে র আবির্ভাব হয়। নিহারদা
এর আগে পার্টি করতেন । ‘৭১ এ জেলে ছিলেন শুনি। রণজিৎ দা একটু
গেরুয়ার ভক্ত। পঞ্চুদা , আমাকে নিজের দলে টানেন । উনি কোন
পার্টির আলোচনায় থাকেন না । আমার তাই ওনাকেই পছন্দ। সমরেশ দা কে বোঝা মুশকিল । উনি
সব শোনেন কোন মন্তব্য দেন না। বলতে-গেলে আমরা তিনজন রাজনীতির প্রসঙ্গে আসীনা।
নিহারদা আর রণজিৎ দার মধ্যে কথা কাটা কাটি হলে পঞ্চুদা সামাল দেন। আমি ওই সময় চট
করে দুটো রাউন্ড মেরে আসি পার্কের চারিদিকে। আজকে পঞ্চুদা আসেন নি । নিহারদা খবর
দিলেন উনি এপোলোতে আই.সি.ইউ.তে । কাল নাকি স্ট্রোক হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বড়
দেখতে যাওয়ার সাধ হল । এইতো গতকাল বিকেলে
কি সুন্দর ছিলেন । রাতে কি এমন হল ?
সকলকে বললাম চলুন না দেখে আসি ‘পঞ্চুদাকে’ ।
পরের দিন
সকালে সবাই এপোলোতে হাজির হলাম । ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতে আরও বেশ কিছু সময় বাকি ।
পাস নিয়ে ওপরে গিয়ে দেখি আই.সি.ইউ. থেকে ডেড বডি বেরুচ্ছে । সামনেই পঞ্চুদার ছেলে
মেয়ে ! সকলে হতভম্ব । কারুর মুখ থেকে কিচ্ছু কথা বেরুলো-না । মেয়েটি কান্নায়
ভেঙ্গে পড়েছে । পঞ্চুদার ছেলে নিথর । রণজিৎ দা , নিহার
দা , সমরেশ দা সকলেই চোখ পুঁছছে । আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো । নিজেকে সামলাতে
পারলাম না । রণজিৎ দাকে জড়িয়ে বললাম একি হোল ? রণজিৎ দা শুধু
মাথায় হাত রাখলেন। উনিও চোখ পুঁছছেন রুমাল দিয়ে । নিহারদা সমরেশ দা নিথর । সব শেষ
! এইতো মানুষের জীবন !! এই নিয়ে এতো গর্ব ।
No comments:
Post a Comment