মঞ্জু
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ০৪.০৩.২০১৫ /
আমার বাড়ীর কাজের মহিলা ‘মঞ্জু’ বয়েস বেশি না ৩০-৩২ হবে , কিন্তু তিন মেয়ের মা ।
বর অটো চালায় । মেয়েগুলোকে স্কুলে পড়ায় । আজকাল রোজ দেরি করে আসে নয় তাড়া
তাড়ি কাজ সেরে পালায় অন্য বাড়ীর কাজ করতে । মহা মুস্কিল এরকম ত ছিলনা ।
মঞ্জু আমাদের দুজনের রান্না , আমার জন্য সকালে তরিবাতের জলখাবার এই সব
রান্না করতে করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় নিত। আগে আসত সকাল ৭ টায় যেত
প্রায় সকাল ৮.৩০ । এখন আসে ৮ টায় এক ঘণ্টায় সব কাজ সেরে চলে যায় । কিছু
বললে হেঁসে বলে,“মেসো খাওয়াটা কমাও । ওত খেলে শরীর খারাপ করবে ।” আমি এক
ঘণ্টায় তোমাদের রান্না বান্না সব করে দিচ্ছি । আরেকজন দাদার বাড়ীর বৌদি ,
তারাও আমাকে রেখেছে রান্না করার জন্য আধ ঘণ্টায় সব করে দি । সকালের
জলখাবার ওট আর দুধ । ডিম সিদ্ধ ডাল ভাত একটা ভাজা , নয় সবজি , নয় মাছের
ঝাল আর ভাত খেয়ে দুজনে অফিস চলে জায় , ফিরে রাতে দুখানি রুটি আর সকালের
তরকারি, এক কাপ দুধ খেয়ে ঘুমোয় ।
আমি বলি - তুই কি করে জানলি ওরা কি খায় আর না খায় ! ওরা হয়ত বাইরে কিছু
খেয়ে আসে । তোর যা রান্না, নেহাত তোর মাসির অসুখ বলে আমি তোর হাতের
রান্না খাচ্ছি নাহলে কে খাবে তোর হাতের রান্না ! নুনের মাপ জানলিনা , তুই
কি রান্না করিস রে । সর্বদা আমার খাওয়ার দিকে তোর নজর । আমরা খান দানি
ঘরের ছেলে । বাপ দাদার আমলে খাওয়াটা পরিপাটি ছিল ...আছে... থাকবে ।
দাদা আমেরিকা থেকে আমার জন্য নেল কাটার , আমার মেয়ের জন্য টকিং ডল ,
গায়ে মাখার সাবান , পারফিউম সব এনে দিয়েছে । তোমরা মাস মাহিনা ছাড়া কি
দাও আমাকে ।
আমি বলি , আমি কি তোর জন্য আমেরিকা যাব । যত সব , চা’ দে ! শারদায় যে
টাকা রেখেছিলি পেলি ?
না পাবনা আর । ও সুদীপ্ত হারামজাদা সব গিলেছে লোকেদের টাকা । গরীবের
টাকাগুলো কেমন করে সহ্য হয় কে যানে । ও মরার সময় দেখবে কি অবস্থা হবে ?
ওকি একা খেয়েছেরে । একে একে সব বেরুচ্ছে বেরুবে । দাঁড়া কি হয় দেখ ।
কি আর হবে ? কিচ্ছু হবে না । যে যেমন আছে সেইরকম ই থাকবে । কি লাভ
আমাদের টাকা ত পাবনা আর ... হতাশ হয়ে বলে !
তা তোদের মতন লোকেরা আবার আরেকটা সুদীপ্তর মত লোকের পাল্লায় পড়বে।
আহ্লাদে আটখানা দেখিস ? সেটা আবার কি গো মেসো ?
মিরাক্কেল= মির+আক্কেল ! আক্কেল দাঁত না ওঠা অবধি ভাল লাগবে তার পর ওই
মীর(মীর অফসর আলী)র ছ্যাবলামি , শ্রী-লেখা দত্তর ন্যাকামি , রজতাভের
“আপনি থাকছেন সার” , বুড়ো ভাম , পরানের এক ঘেয়ে কমেন্ট, “ভালো ! আরও ভালো
করতে হবে পরেরটায়”। তারচেয়ে সা রে গা মা দেখ ভালো লাগবে । আমরা ওটাই দেখি
। কি সুন্দর গান গায় ছেলে মেয়েগুলো । এক কমলিকা ছাড়া । ও গর্বে ফেটে পড়ে
। বলে কিনা , “আমার গান লোকে বড় স্ক্রিন লাগিয়ে ভিডিওতে দ্যাখে।” খুব
গর্ব মেয়েটার । দেখবি ও থাকবেনা শেষ অবধি ।
তুমি এতসব দ্যাখ মেসো ?
হ্যাঁ দেখি। আর কি করব বল ? তোদের বয়েসে খাওয়ার সময় পেতাম না । এখন বসে
শুয়ে দিন কাটে না । সকাল বিকেল হাঁটি , বাজার করি , মাঝে মধ্যে ব্যাঙ্কে
যাই , বিকেলে কারে ঘুরি কখন সখন তাও ড্রাইভার থাকলে । ড্রাইভার না এলে
নিজের গাড়ী নিজেই পুঁছি ।
মেসো দাদা কবে আসবে ? অনেক দিন আসে না ।
ও আমেরিকা গিয়েছে আসবে কি করে ? ওকে আরও বছর খানেক থাকতে হবে । বৌমা
নাতনী সব ওখানে । ফিরবে কিনা কে জানে ?
তা তুমি কি আমার হাতের রান্না খেয়ে দিন কাটাবে ? তোমার বৌমা এলে তোমায়
রান্না করে দেবে না ?
আকাশ থেকে পড়লি নাকি ! তোর এতো প্রশ্নের কি দরকার । যা মাসির ঘরে যা ।
বৌমা রান্না করবে ? কি সব বলে ! খুব আস্পর্ধা হয়েছে তোর । আমার ঘরে আর
আসবিনা । তুই জানিস ওর বিষয় ?
যাইগো বেলা হল । ও মাসী যাই ।
হ্যাঁ আয় । কি ফুটুর ফুটুর করছিলি শুনি ?
নাগো মেসোক বৌদির রান্না করার কথা বলাতে রেগে গিয়ে আমাকে যেতে বলছে ।
ও হরি । ও রান্না করবে কিরে ? ওরা কি আমাদের আমলের মেয়ে ? ওখানে ছেলেটা
কি খায় কি করে কে জানে ? তুই আয় এবার । কেন ফটর ফটর করিস মেসোর সঙ্গে ?
জানিস তো ও বৌমার নিন্দে একদম শুনতে ভালো বাসেনা । আমাকেই হাটিয়ে দেয় ।
নিজে দেখে এনেছে না ! খুব ভালো বাসে তাই । আমাদের মেয়ে নেইত । ওকেই মেয়ের
স্নেহ দেয় । বৌমাও তোর মেসোকে খুব যত্ন করে এলে । চা নিজের হাতে বানিয়ে
দেয় । ও থাকলে আমার হাতের চা খায়না । বৌমাকে বলে লেমন টি বানাতে , নয়
হার্বাল টি ।
সেত দেখেছি আমি । মেসোর মন রাখতে খুব জানে তোমার বৌমা ।
এই মঞ্জু তুই গেলি ............. । আমার গলার আওয়াজ শুনে মঞ্জু পালায় ।
মঞ্জু জাওয়ার পর আমি গিন্নীকে বলি ... ওকে ছাড়িয়ে অন্য লোক রাখবো । খুব
বাড় বেড়েছে ওর।
অন্য লোক ওই মাইনেতে আর এখন পাবে না ।
দু হাজার টাকা কি কম ? মাস-গেলে আমার নতুন চাকরীতে ওই মাইনে পেতাম না ।
তখন দিন কাল আলাদা ছিল। লোকে শান্তিতে ছিল। এখনকার কালে দু হাজার টাকার কি দাম বল।
তা অবশ্য ছিল ।
তবে ?
মঞ্জুর মতন কাজের লোক আর পাবে না । তোমার অনেক ফাই ফরমাজ খাটে । তোমার
গেঞ্জি , জামা প্যান্ট সব মুখ বুজে কাচে । ও নিজেই বলে ওয়াশিং মেশিনের
দরকার নেই মাসি , ওইটুকু আমি নিজেই পারবো। ওকে তাড়ান চলবেনা ।
মঞ্জু আমাদের বিশ্বাসী মেয়ে ওর ওপর ভরসা করে সব ছেড়ে যাওয়া যায় । এখনকার
কাজের লোক কে কোথায় চুরি করে নিয়ে যাবে ! না বাবা মঞ্জুই ভালো । আমরা
দুজন থাকি এত বড় ঘরে । ঘর ভর্তি জিনিস । কিছু হাত সাফাই করলে কিছুই বোঝার
উপায় নেই । ও তাও চেয়ে নেয় । এইতো সেদিন দুটো সিলিং ফ্যান দিলাম । বলে
গরমে মেয়েরা পড়া শুন করতে পারে না মাসি । তোমাদের ত এসি আছে , আমরা গরমে
সিদ্ধ হয়ে জাই । নতুন ফ্যান গুল তাও দিয়ে দিলাম । মেয়েটার ওপর মায়া হয়
। ওর বরটা কিছুই করেনা । তার ওপর শাশুড়ি আছে । সব শুষে খাবার লোক কেউ কোন
উপকারে আসেনা । ওর বাড়িতে ওই একমাত্র রোজগার করে বাকি সবাই ওর ওপর
নির্ভরশীল ।
এই ভারতবর্ষে এরকম অনেক মঞ্জু নিজের গতর খাটিয়ে পয়সা রোজগার করে স্বামী
,পুত্র, কন্যার ভরন পোষণের দায়িত্ব নিয়েছে । নিজেকে নিংড়ে টাকা রোজগার
করে মুখে কোন প্রতিবাদ থাকে না থাকে শুধু ফেকাশে হাঁসি ।
No comments:
Post a Comment