পারাদ্বীপ
বন্দর সহর
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ০৬.০৩.২০১৫ /বেলা
১.০৩
পারাদ্বীপ বন্দর সহর উড়িষ্যার এক গর্ব বললে
অত্যুক্তি হবেনা । উড়িষ্যার জগৎসিংপুর
জেলার পারাদ্বীপ এর বিশেষত্ব পর্যটনের
চেয়ে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বেশি কারন এই পারাদ্বীপ উড়িষ্যার প্রধান বন্দর সহর । কটক সহর থেকে ৯৪ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এবং
ভুবনেশ্বর থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কূলে এই সহরটা ছোট্ট অথচ এর
ঐতিহ্য অতি পুরাতন।
পারাদ্বীপ যাওয়ার সোজা রাস্তা কটকের ও.এম.পি ছক
থেকে ডানদিক বেঁকে তির্তোল হয়ে সোজা পারাদ্বীপ । এ ছাড়া কেন্দ্রাপড়া হয়ে দুহুরিয়া
ছক থেকে এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরে পারাদ্বীপ যাওয়া যায়। যারা কেন্দ্রাপড়া সহর বলদেব
জীউ মন্দির দর্শন করতে চান তারা এই
রাস্তায় যান । আরেকটা রাস্তা এক্সপ্রেস হাই ওয়ে(NH-5A)
র চন্ডিখোল ছকথেকে ডানদিকে বেঁকে
অনতিদূরে বালি-চন্দ্রপুর থেকে
ললিত-গিরি , রত্নগিরি , উদয়গিরি এই
তিনটে বৌদ্ধ কীর্তি দেখে আবার এক্সপ্রেস হাই ওয়েতে ফিরে বাঁ দিকে পারাদ্বীপ যাওয়ার
সোজা পাকা রাস্তা আছে । এই দুর্লভ বৌদ্ধ
কীর্তি দেখার জন্য জাপান থেকে অনেক বৌদ্ধ
ধর্মালম্বী আসেন তা ছাড়াও অন্য বৌদ্ধ
পর্যটক আসেন এই পর্যটন শৈলীর ঐতিহাসিক মূল্যবোধের জন্য । এখানে ভারত সরকারের
পর্যটন বিভাগ এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের
আনুকূল্যে পর্যটকদের বিশেষ সুবিধে আছে ।
পারাদ্বীপ তিন দিক দিয়েই যাওয়া
যায় ১.) কটকের ও.এম.পি.ছক ধরে তির্ত্তোল
দিয়ে ,২.) মহানদীর ব্রিজ পেরিয়ে জগৎপুর থেকে ডান দিকে
ঘুরে সালেপুর , কেন্দ্রাপড়া
হয়ে , ৩.) N.H.5 ধরে চন্ডিখোল হয়ে
আবার N.H.5A ধরে ললিতগিরি , রত্নগিরি , উদয়গিরি
এই তিনটে বৌদ্ধ কীর্তি দেখে আবার এক্সপ্রেস হাই ওয়েতে ফিরে বাঁ দিকে পারাদীপ
যাওয়ার সোজা পাকা রাস্তা । তিনটে
রাস্তাই সুন্দর । তবে প্রথমটা বেশি সুবিধের কারন পুরোটাই কংক্রিটের রাস্তা
(জয়পুর ছক থেকে তৈরি হয়েছে )।
উড়িষ্যার পূর্বতন মুখ্য মন্ত্রী বিজু পট্টনায়ক দৈত্যারি মাইনস থেকে
পারাদ্বীপ অব্ধি এক্সপ্রেস হাই ওয়ে NH5-Aকেন্দ্র সরকারের সাহায্যে ১৯৬২ সালে
তৈরি করান । এই রাস্তা সোজা দৈত্যারি মাইনস থেকে পারাদ্বীপে লৌহ প্রস্তর বহনের কাজে আসে । হাজার হাজার ট্রাকে
প্রতিদিন এই পথে দুর্মূল্য ক্রোমাইট পরিবহন হয়।
উড়িষ্যার
ইতিহাস বলে পারাদ্বীপ থেকে বালি দ্বীপ,জাভা,সুমাত্রা,বর্ণীও,মালয়েশিয়া
প্রভৃতি জায়গায় উড়িষ্যার পণ্য যেমন তসর
এর চাদর , শাড়ী এবং সিল্কের শাড়ী, রুপোর
তারকষি গহনা ইত্যাদি এখানকার ব্যবসায়ীরা পাল তোলা নৌকায় পরিবহন করে নিয়ে যেতেন ।
এই ব্যবসায়ীদের এনারা “সাধব পুও” বলেন
এবং তাদের বৌ’ দের “সাধব বহু” বলে । কার্তিক পূর্ণিমার দিন সাধব বৌ’রা বিশেষ
পূজার্চনা করে “সাধব পুওদের” বিদেশে
বাণিজ্য করার জন্য বিদায় দিত ; তাই ওই বিশেষ দিনটিকে কার্তিক পূর্ণিমার “বৈত বন্ধান”
উৎসব বলাহয় এবং এই উৎসব
প্রত্যেক বছর মহা ধুম ধাম করে পালন করা হয়। কটকের মহানদীর ধারে বালি যাত্রা
মাঠে “বালি যাত্রা”
সুরু হয় ঐ বিশেষ দিন থেকে। কটকের বালি যাত্রায় নানা জিনিষ বিক্রি
হয়। ইতিহাস বলে বালি দ্বীপে উড়িষ্যার পণ্য
রপ্তানি সুরু হত কার্ত্তিক পূর্ণিমার দিন থেকে তাই নাম “বালি
যাত্রা” ।
১৯৫০ সালে কেন্দ্র সরকারের জল এবং শক্তি কমিশন (Central
water and power commission)মহানদীর মোহানায় অবস্থিত প্রাকৃতিক
বন্দর উপযোগী সমুদ্র তটে পারাদ্বীপ বন্দর স্থাপনের সিধ্যান্ত নেন । তৎকালীন
ভারতবর্ষের প্রধান মন্ত্রী পণ্ডিত জবাহারলাল নেহেরু এবং উড়িষ্যার তৎকালীন
মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ানন্দ পট্টনায়ক (বিজু
পট্টনায়ক) ৩ রা জানুয়ারি ১৯৬২ সালে
পারাদ্বীপ বন্দরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন ভূমি পূজা করে । এই বন্দর
প্রতিষ্ঠার সময় একটি কালো গ্রানাইট পাথরের ফলকের ওপর পণ্ডিত নেহেরুর স্বাক্ষরে
ইংরাজিতে লেখা আছে “Willed by the people, I commend you, to this another
National Adventure” যার বাংলা অর্থ কিছুটা এই রকম “ইহাই মহাজাতির নির্দেশে আবার এক বিরাট অভিযানের পথে আমার আহ্বান” । পণ্ডিত
নেহেরু থাকার জন্য যে গেস্ট হাউস তৈরি হয় তার নাম “নেহেরু
গেস্ট হাউস” । এখানে
বলা বাহুল্য আমি সপরিবারে ওই গেস্ট হাউসে দু রাত তিন দিন থাকি পুরো পারাদ্বীপ সহর,বন্দর এবং সমুদ্র সৈকত দেখার জন্য । খুব বিচিত্র এই অনন্ত গভীর সমুদ্র
সৈকত । একে গোল্ডেন সি বিচ ও বলে এবং সামুদ্রিক জীবে ভরপুর যথা কাঁকড়া , চিংড়ী , সামুদ্রিক মৎস্য ইত্যাদি। সুন্দর ঝাউ এর
জঙ্গল , বড় বড় পাথরের বোল্ডর দিয়ে সমুদ্র তট সুরক্ষিত । সুন্দর একুরিয়াম , জগন্নাথ
মন্দির , হনুমান মন্দির , তট রক্ষ্যা
বাহিনী , সুরক্ষিত পারাদ্বীপ বন্দর যা না দেখলে বোঝান যায়না
।
পারাদ্বীপ বন্দর
২ রা মার্চ ১৯৬৬ সালে পিটার স্টেম্বোলিক উদ্বোধন করেন আনুষ্ঠানিক ভাবে ।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশন্ধী থেকে প্রায় ৫০ মিলিওন টন লৌহ প্রস্তর রপ্তানি করা
আরম্ভ হয়। এর পর থেকে এটা Paradip Port Trust নামে নামিত হয়
।
বড় জাহাজের জন্য এই বন্দর উৎকৃষ্ট । বিভিন্ন
বিদেশী জাহাজ পারাদ্বীপ বন্দরে এসে মাল বোঝাই করে। এখান-থেকে বিদেশে যথা জাপান, চায়না,ইটালি, সাউথ কোরিয়া
ইত্যাদি দেশে প্রধানত এখানকার দুর্লভ
ক্রোমাইট রপ্তানি করা হয় । অস্ট্রেলিয়া থেকে উৎকৃষ্ট আন্থ্রাসাইট কয়লা
উড়িষ্যার তালচের থার্মাল প্ল্যান্টের জন্য আমদানি করা হয়।
দক্ষিণ
কোরিয়ার “পোস্ক কোম্পানি” ১২০০ মেট্রিক
টনের ষ্টীল প্ল্যান্ট এর প্রকল্প করে
পারাদ্বীপ এর কাছে । এর জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ এখন সম্পূর্ণ হয়নি । এই স্টিল প্ল্যান্ট এখন কেন্দ্র সরকারের
দ্বারা ত্বরান্বিত হতে চলেছে । কল কারখানার জন্য
জমি অধিগ্রহণ আইনে পরিণত হলে হয়ত
হতে পারে। বলা বাহুল্য এর জন্য অনেক কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হবে । সময় বলবে কি
হবে।
পারাদ্বীপ থেকে কেবল ক্রোমাইট নয় বক্সাইট , ডোলোমাইট লাইম
স্টোন , ক্যালসাইট
ইত্যাদিও রপ্তানি করা হয়। উড়িষ্যার
ক্রোমাইট খনি দৈত্যারি ,সুকিন্দা , কেনঝোর
, বড়বিল ইত্যাদি থেকে দুর্লভ ক্রোমাইট রপ্তানির জন্য
পারাদ্বীপ বন্দরের প্রতিষ্ঠার বিশেষ আবশ্যকতা উপলব্ধি করা হয় । এখানে যা খনিজ পদার্থ গচ্ছিত ছিল এবং আছে তা অন্তত
৫টা ষ্টীল প্ল্যান্ট অনায়াসে চালাতে পারতো
। উড়িষ্যার খনিজ পদার্থ উচ্চ কোটির কিন্তু
কেন যে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার এই দুর্মূল্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দিলেন তার
কোন রাজনৈতিক যুক্তি পাইনা । কিন্তু বেশ
কিছু যুগ রাউরকেল্লা ছাড়া অন্য ইস্পাত
কারখানা হয় নি । এখন সুকিন্দার কাছে ডুবুরিতে তিনটে ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠা
হয়েছে এবং উৎপাদন ও হচ্ছে যেমন নীলাচল ইস্পাত কারখানা , টাটা
স্টিল প্ল্যান্ট , ভূষণ স্টিল প্ল্যান্ট , এ ছাড়া অনুগুল ও ঝারসুগূড়ার ভূষণ স্টিল প্ল্যান্ট ।
পারাদ্বীপ লিখতে গেলেই উড়িষ্যার খনিজ পদার্থ , স্টিল প্ল্যান্ট ইত্যাদির প্রেক্ষাপট লেখা প্রয়োজন তাই এ সব লেখা লিখতে
বাধ্য হলাম।
পারাদ্বীপ যেহেতু বন্দর সহর এখানে অনেক কল
কারখানা আছে ১.) পারাদ্বীপ ফসফেট রাসায়নিক সার কারখানা , ২.) ইফকো রাসায়নিক সার কারখানা, ৩.) এশার ষ্টীল
পেলেট প্লান্ট , ৪.) ভারত পেট্রোলিয়াম এর মার্কেটিং
টার্মিনাল , ৫.) হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের এর মার্কেটিং
টার্মিনাল , ৬.) কার্গিল এডিবিল অয়েল প্ল্যান্ট , ৭.) ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন , ৮.) স্কল ব্রেওরিস
লিমিটেড ।
No comments:
Post a Comment