ঘটগাঁ মা তারিণী পিঠ
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১১.০৩.২০১৫ বুধবার /
তারিণীর ইতিহাস ঃ- ১৪৮০ খৃস্টাব্দে পুরীর গজপতি রাজা শ্রী পুরুষোত্তম দেব , ‘কাঞ্চী যুধ্যের’ সময় তৎকালীন কেঞ্জোর রাজ্যের রাজা শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেও মহাশয়কে তাঁর সেনাপতি রূপে আহ্বান করেন । শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেব যুধ্যে পারদর্শী ছিলেন তাই শ্রী পুরুষোত্তম দেবের আহ্বানে তাঁর সঙ্গে কাঞ্চি অভিযানে যাত্রা করেন। গজপতি রাজা পুরুষোত্তম দেব কাঞ্চী জয় করে কাঞ্চী রাজার রাজ কন্যা ‘পদ্মাবতী দেবীকে’ সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং পাট রানি করেন । এই ইতিহাস অতি প্রাচীন ।
ছোট করে বলতে হলে ঃ পুরীর জগন্নাথের রথ দেখতে কাঞ্চীর রাজা এসেছিলেন । রথের প্রারম্ভে পুরীর গজপতি মহারাজা , শ্রী জগন্নাথ ,বলভদ্র এবং মা সুভদ্রার রথে ‘ছেরা পঁহরা’ করে থাকেন। এটাই রীতি । ছেরা পঁহরা অর্থাৎ সোনার ঝাঁটা দিয়ে চন্দন এবং বেল ফুল দিয়ে সারা রথ পরিক্রমা করে নিজে রাজা ঝঁট দেন । সেই ঝাঁটা হাতে রাজাকে দেখে কাঞ্চীর রাজা পুরীর গজপতি রাজাকে ম্যাথোর ভাবেন এবং উপহাস করেন । এতে গজপতি রাজা অপমানিত হন এবং শপথ করেন কাঞ্চী রাজ্য জয় করে রাজকন্যা পদ্মাবতী দেবীকে মহারানী করবেন । যা ভাবা তাই হল । সেই যুধ্যে শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেব সেনাপতির ভূমিকা পালন করে কাঞ্চী যুধ্যে জয়ী হয়ে ফেরেন ।
কাঞ্চী যুধ্যের জয়ের খুশীতে গজপতি রাজা পুরুষোত্তম দেব শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেবেকে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর কি অভিলাষ ! শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেব মা তারিণীকে তাঁর রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পূজো করতে চান এবং কেঞ্জোরে মায়ের মন্দির বানানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু গজপতি রাজা বলেন এই আশা পূরণের উদ্দেশ্যে ‘মা তারিণীকে’ নিয়ে যাওয়ার অনুমতির জন্য মাকে প্রার্থনা করতে ; কারন মায়ের অনুমতি বিনা তাঁকে নেওয়া সম্ভব নয় । এর পর গোবিন্দ দেব মায়ের পূজোয় বসেন । মা তারিণী তাঁর পূজোয় সন্তুষ্ট হন বটে কিন্তু একটা সর্ত রাখেন। মা বলেন মা’কে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজা গোবিন্দ দেব যেন পেছন ঘুরে না তাকান মা আসছেন কিনা দেখতে । রাজা রাজি হন মা’য়ের ওই সর্তে । রাজার সঙ্গে মা তারিণী ঘোড়ায় চড়ে রাজার পেছন পেছন যাচ্ছিলেন । কিন্তু ঘটগাঁর কাছে গভীর জঙ্গলে মায়ের ঘোড়ার আওয়াজ রাজা শুনতে পেলেন না । এতে রাজা বিব্রত হয়ে পেছনে তাকান । সেই সময় মা তারিণী প্রস্তরে পরিণত হয়ে এক বট গাছের তলায় অধিষ্ঠান করেন। রাজা যত মনঃ কষ্ট করে পূজার্চনা করলেও আর মা তাঁর রূপ ধারণ করেন না। সেই থেকে ‘মা তারিণী’ ঘটগাঁতে পূজো পেয়ে আসছেন ।
তারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা:-
১৯৭০ সালে উড়িষ্যা সরকার এর মন্দির প্রতিষ্ঠান তারিণীর মন্দির তৈরি করে মাকে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে ওখানে যাত্রী দের সুবিধের জন্য হোটেল , লজ , গেস্ট হাউস ইত্যাদি আছে । যারা থাকতে চান স্বচ্ছন্দে ওখানে কম খর্চায় থাকতে পারেন। ওখান থেকে অনেক দর্শনিয় স্থান যেমন জলপ্রপাত ১. সান ঘাগরা , ২. বড় ঘাগরা , ৩. ভীম কুন্ড ইত্যাদি ঘুরে দেখে যেতে পারেন। কিছু বিদেশী পর্যটক এইসব দর্শনিয় স্থান এসে ঘুরে ভিডিও করে তাঁদের দেশে নিয়ে যান ।
কি করে যাবেন:-
ভুবনেশ্বর থেকে ঘটগাঁতে যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে । প্রথম রাস্তা ভুবনেশ্বর থেকে NH 5 ধরে কটক , চন্ডিখোল হয়ে NH5A(Express High way) ধরে বাঁ দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে “ব্রাহ্মণী নদীর ব্রিজ” পার হয়ে ‘ডুবুরী’ । এই ডুবুরী তে টাটা স্টিল প্ল্যান্ট , নীলাচল ইস্পাত স্টিল প্ল্যান্ট ইত্যাদি আছে তাই এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব । ডুবুরি থেকে দৈত্যারি মাইনসের রাস্তায় ‘ব্রাহ্মনিপাল’ অবধি গিয়ে ওখান থেকে ডানদিকে ঘটগাঁ (রাস্তার ওপর এক্সপ্রেস হাই ওয়ের ওপর ফিকে সবুজ বোর্ডে সুস্পষ্ট লেখা) । ভুবনেশ্বর থেকে রাস্তায় চন্ডিখোল ৭০ কিলোমিটার , চন্ডিখোল থেকে ডুবুরী ৩৮ কিলোমিটার , ডুবুরী থেকে ব্রাহ্মণীপাল ১২ কিলোমিটার , ব্রাহ্মণীপাল থেকে ঘটগাঁ ৫৮ কিলোমিটার । সমুদায় ১৭৮ কিলোমিটার এই রাস্তার একটা বিশেষত্ব আছে। এই রাস্তা দিয়ে গেলে অনেক ছোট ছোট পাহাড় পর্বত এবং জঙ্গল আছে যার সিনিক ভ্যালু অনেক। আমি সারা রাস্তা ক্যামেরা ধরে ফটো তুলেছি। দ্বিতীয় রাস্তা সোজা NH5 ধরে ‘চন্ডিখোল ছক’ পেরিয়ে সোজা ‘পাণিকোইলি’ অবধি গিয়ে ওখান থেকে আবার বাঁ দিকে ‘যাজপুর রোড’ । যারা হাওড়া থেকে আসবেন তারা যাজপুর রোড়ে নেমে ট্যাক্সি কিম্বা কেঞ্জোরের বাসে ঘটগাঁ নেবে মা তারিণী র দর্শন করতে পারেন। যা বলছিলাম.. ওই যাজপুর থেকে আবার আনন্দপুর হয়ে সোজা ঘটগাঁ মা তারিণী পীঠ ।
এখন এটি উড়িষ্যার একটি পর্যটন এবং শক্তি পীঠের স্থান যেখানে মা পূজো পান। মা তারিণী খুব জাগ্রত দেবী তাঁর কাছথেকে কেউ খালি হাতে ফেরেনা । ভক্তিভরে ডাকলে মা সাড়া দেন ভক্তকে ।
তারিণীর পর্ব পর্বানিঃ-
তিনটে বড় সংক্রান্তি তে তারিণীর বিশেষ পূজার্চনা হয় এবং ওই সময় এখানে উৎসব মুখরিত পরিবেশ জা এখানকার আদিবাসীদের পর্ব বলে ধরা হয়। ১. মকর সংক্রান্তি (জানুয়ারি ১৪-১৬) , ২. মহা বিষুব সংক্রান্তি (এপ্রিল ১৪-১৬) , ৩. রজ সংক্রান্তি ( জুন ১৪-১৬) । এই সময় যাত্রীদের খুব ভীড় হয় । ছত্রিশ গড় , ঝাড়খণ্ড থেকে এখানে অনেকে আসেন মায়ের যাত্রা দেখতে । এ ছাড়া দুর্গা পূজো ও কালি পূজোতে মায়ের বিশেষ পূজার্চনা হয় । এখানকার মুগের ডালের খিচুড়ি মায়ের প্রসাদ । আমিষ ভোগ হয় না। উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মায়ের পূজোর জন্য লোকে মানসিক করেন নারকোল ভোগ দিয়ে। তাই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারকোল আসে মায়ের কাছে ভোগের জন্য। এখানকার পুরোহিত কে দেহুরী বলে। এরা ব্রাহ্মণ নয় ।
ভোগের সময় নির্ঘন্টঃ-
ক্র.সংখ্যা
পূজার নাম
সময়
১.
বাল্যভোগ
সকাল ৬ টা
২.
খিচুড়ি
সকাল ১০.৩০
৩.
পহড় (মন্দিরের দ্বার বন্দ করা হয়)
বেলা ১.০০
৪.
বাল্যভোগ
বেলা ৩.৩০
৫.
সন্ধ্যা ভোগ (সরু চকুলি পিঠে ভোগ)
বিকেল ০৫.০০
6.
সন্ধ্যা আরতি
সন্ধ্যা ০৭.৪৫
7.
পহড় (মন্দিরের দ্বার বন্দ করা হয়)
সন্ধ্যা ০৮.০০
8 Attachments
No comments:
Post a Comment