Saturday, March 21, 2015

পথে প্রান্তরেঃ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / পারাদ্বীপ , উড়িষ্যা / ২১.০৩.২০১৫ /বেলা ১২.৫৫



                               নেহেরু গেষ্ট হাউস , পারাদ্বীপ , উড়িষ্যা ।

                                    সুর্য্য উদয় , পারাদ্বীপ সমুদ্র সৈকত
                                    নেহেরু গেষ্ট হাউস , পারাদ্বীপ
                               শ্রী জগন্নাথ মন্দীর , পারাদ্বীপ , উড়িষ্যা ।
     

পথে প্রান্তরেঃ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

Posted in 


পথে প্রান্তরে

পারাদ্বীপ বন্দর শহর
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী 



পারাদ্বীপ বন্দর শহর উড়িষ্যার এক গর্ব বললে অত্যুক্তি হবেনা । উড়িষ্যার জগতসিংপুর জেলার পারদ্বীপ, এর বিশেষত্ব পর্যটনের চেয়ে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বেশি। কারণ এই পারাদ্বীপ উড়িষ্যার প্রধান বন্দর শহর। কটক শহর থেকে ৯৪ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এবং ভুবনেশ্বর থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কূলে এই শহরটা ছোট্ট, অথচ এর ঐতিহ্য অতি পুরাতন।

পারাদ্বীপ যাওয়ার সোজা রাস্তা কটকের ও.এম.পি ছক থেকে ডানদিক বেঁকে তির্তোল হয়ে সোজা পারাদ্বীপ । এ ছাড়া কেন্দ্রাপড়া হয়ে দুহুরিয়া ছক থেকে এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরে পারাদ্বীপ যাওয়া যায়। যারা কেন্দ্রাপড়া শহর বলদেব জীউ মন্দির দর্শন করতে চান তারা এই রাস্তায় যান । আরেকটা রাস্তা এক্সপ্রেস হাই ওয়ে(NH-5A) র চন্ডিখোল ছক থেকে ডানদিকে বেঁকে অনতিদূরে বালিচন্দ্রপুর থেকে ললিতগিরি, রত্নগিরি, উদয়গিরি এই তিনটে বৌদ্ধ কীর্তি দেখে আবার এক্সপ্রেস হাই ওয়েতে ফিরে বাঁ দিকে পারাদ্বীপ যাওয়ার সোজা পাকা রাস্তা আছে । এই দুর্লভ বৌদ্ধ কীর্তি দেখার জন্য জাপান থেকে অনেক বৌদ্ধ ধর্মালম্বী ছাড়াও অন্য বৌদ্ধ পর্যটক আসেন এই পর্যটন শৈলীর ঐতিহাসিক মূল্যের জন্য । এখানে ভারত সরকারের পর্যটন বিভাগ এবং প্রত্নতত্ব বিভাগের আনুকূল্যে পর্যটকদের বিশেষ সুবিধে আছে । 

পারাদ্বীপ তিন দিক দিয়েই যাওয়া যায় ১.) কটকের ও.এম.পি.ছক ধরে তির্তোল দিয়ে ,২.) মহানদীর ব্রিজ পেরিয়ে জগৎপুর থেকে ডান দিকে ঘুরে সালেপুর, কেন্দ্রাপড়া হয়ে, ৩.) N.H.5 ধরে চন্ডিখোল হয়ে আবার N.H.5Aধরে ললিতগিরি, রত্নগিরি, উদয়গিরি এই তিনটে বৌদ্ধ কীর্তি দেখে আবার এক্সপ্রেস হাইওয়েতে ফিরে বাঁ দিকে পারাদ্বীপ যাওয়ার সোজা পাকা রাস্তা । তিনটে রাস্তাই সুন্দর । তবে প্রথমটা বেশি সুবিধের, কারণ পুরোটাই কংক্রিটের রাস্তা (জয়পুর ছক থেকে তৈরি হয়েছে )। 

উড়িষ্যার পূর্বতন মুখ্য মন্ত্রী বিজু পট্টনায়ক দৈত্যারি মাইনস থেকে পারাদ্বীপ অবধি এক্সপ্রেস হাই ওয়ে NH5-Aকেন্দ্র সরকারের সাহায্যে ১৯৬২ সালে তৈরি করান, যা সোজা মাইনস থেকে পারাদ্বীপে লৌহ প্রস্তর বহনের কাজে আসে । হাজার হাজার ট্রাকে প্রতিদিন এই পথে ক্রোমাইট পরিবহন হয়।

উড়িষ্যার ইতিহাস বলে পারাদ্বীপ থেকে জাভা, সুমাত্রা, বর্ণীও, মালয়েশিয়া, প্রভৃতি জায়গায় উড়িষ্যার পণ্য যেমন, তসর এবং সিল্কের শাড়ী, রূপোর তারকষি গহনা, ইত্যাদি এখানকার ব্যবসায়ীরা পাল তোলা নৌকায় পরিবহন করে নিয়ে যেতেন । এই ব্যবসায়ীদের “সাধব পুও” এবং তাদের বৌদের “সাধব বহু” বলা হতো । কার্তিক পূর্ণিমার দিন এই সাধব পুওরা যাত্রা শুরুর আগে, সাধব বৌ' রা বিশেষ পূজার্চনা করে সধব পুওদের বিদায় দিতেন । তাই কার্তিক পূর্ণিমার ওই বিশেষ দিনটিকে “বৈত বন্দাণ” উৎসব বলা হয়। 

১৯৫০ সালে কেন্দ্র সরকারের জল এবং শক্তি কমিশন (Central water and power commission)মহানদীর মোহানায় অবস্থিত প্রাকৃতিক বন্দর উপযোগী সমুদ্র তটে পারাদ্বীপ বন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন । তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধান মন্ত্রী পণ্ডিত জবাহারলাল নেহেরু এবং উড়িষ্যার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ানন্দ পট্টনায়ক ( আদরের ডাকঃ বিজু পট্টনায়ক) ৩রা জানুয়ারি, ১৯৬২ সালে পারাদ্বীপ বন্দরের ভূমি পূজা করে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। একে শুভ দেওয়া বলে। এই বন্দর প্রতিষ্ঠার সময় একটি কালো গ্রানাইট পাথরের ফলকের ওপর পণ্ডিত নেহেরুর স্বাক্ষরে ইংরাজিতে লেখা আছে “Willed by the people, I commend you, to this another National Adventure” যার বাংলা অর্থ কিছুটা এই রকম “ইহাই মহাজাতির নির্দেশে আবার এক বিরাট অভিযানের পথে আমার আহ্বান” । পণ্ডিত নেহেরু থাকার জন্য যে গেস্ট হাউস তৈরি হয়, তার নাম “নেহেরু গেস্ট হাউস” ।


ওই গেস্ট হাউসে আমি সপরিবারে দু রাত তিন দিন থাকি পুরো পারাদ্বীপ শহর, বন্দর এবং সমুদ্র সৈকত দেখার জন্য । খুব বিচিত্র এই অনন্ত গভীর সমুদ্র সৈকত । একে গোল্ডেন সি বিচ ও বলে এবং সামুদ্রিক জীবে ভরপুর, যেমন কাঁকড়া, চিংড়ী, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি। সুন্দর ঝাউ এর বন, বড় বড় পাথরের বোল্ডর দিয়ে সমুদ্র তট সুরক্ষিত । সুন্দর একুরিয়াম, জগন্নাথ মন্দির, হনুমান মন্দির, তট রক্ষা বাহিনী, সুরক্ষিত পারাদ্বীপ বন্দর, যা না দেখলে বোঝান যায়না । 

২রা  মার্চ, ১৯৬৬ সালে পিটার স্টেম্বোলিক পারাদ্বীপ বন্দর উদ্বোধন করেন আনুষ্ঠানিক ভাবে । একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশন্ধি থেকে প্রায় ৫০ মিলিওন টন লৌহ প্রস্তর রপ্তানি করা আরম্ভ হয়।

বড় জাহাজের জন্য এই বন্দর উৎকৃষ্ট । বিভিন্ন বিদেশী জাহাজ পারাদ্বীপ বন্দরে এসে মাল বোঝাই করে। এখান-থেকে বিদেশে যথা জাপান, চায়না, ইটালি, সাউথ কোরিয়া ইত্যাদি দেশে প্রধানত এখানকার দুর্লভ ক্রোমাইট রপ্তানি করা হয় । অস্ট্রেলিয়া থেকে উৎকৃষ্ট আন্থ্রাসাইট কয়লা উড়িষ্যার তালচের থার্মাল প্ল্যান্টের জন্য আমদানি করা হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার “পোস্ক কোম্পানি” ১২০০ মেট্রিক টনের ষ্টীল প্ল্যান্ট এর প্রকল্প করে পারাদ্বীপ এর কাছে । এর জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ এখন সম্পূর্ণ হয়নি । আমি কোন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেতে চাইনা সেটা আমার কাজ নয়। মনে হল তাই লিখে দিলাম। এই স্টিল প্ল্যান্টের কাজ এখন কেন্দ্র সরকারের দ্বারা ত্বরান্বিত হতে চলেছে । কল কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ আইনে পরিনত হলে হয়ত হতে পারে। বলা বাহুল্য, এর জন্য অনেক কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হবে । সময় বলবে কি হবে। 

পারাদ্বীপ থেকে কেবল ক্রোমাইট নয় বক্সাইট, ডোলোমাইট লাইম স্টোন, ক্যালসাইট ইত্যাদিও রপ্তানি করা হয়। উড়িষ্যার ক্রোমাইট খনি দৈত্যারি, সুকিন্দা, কেনঝোর, বড়বিল ইত্যাদি থেকে দুর্লভ ক্রোমাইট রপ্তানির জন্য পারাদ্বীপ বন্দরের প্রতিষ্ঠার বিশেষ আবশ্যকতা উপলব্ধি করা হয় । এখানে যা খনিজ পদার্থ গচ্ছিত ছিল এবং আছে তা অন্তত ৫টা ষ্টীল প্ল্যান্ট অনায়াসে চালাতে পারতো । উড়িষ্যার খনিজ পদার্থ উচ্চ কোটির, কিন্তু কেন যে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার এই দুর্মূল্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দিলেন তার কোন রাজনৈতিক যুক্তি পাইনা । এদিকে বেশ কিছু যুগ রাউরকেল্লা ছাড়া অন্য ইস্পাত কারখানা হয় নি । এখন সুকিন্দার কাছে ডুবুরিতে তিনটে ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং উৎপাদন ও হচ্ছে। যেমন নীলাচল ইস্পাত কারখানা, টাটা স্টিল প্ল্যান্ট, ভূষণ স্টিল প্ল্যান্ট, এ ছাড়া অনুগুল ও ঝারসুগূড়ার ভূষণ স্টিল প্ল্যান্ট । 

পারাদ্বীপ লিখতে গেলেই উড়িষ্যার খনিজ পদার্থ, স্টিল প্ল্যান্ট ইত্যাদির প্রেক্ষাপট লেখা প্রয়োজন, তাই এ সব লেখা লিখতে বাধ্য হলাম।

পারাদ্বীপ যেহেতু বন্দর শহর এখানে অনেক কল কারখানা আছে ১) পারাদ্বীপ ফসফেট রাসায়নিক সার কারখানা, ২) ইফকো রাসায়নিক সার কারখানা, ৩) এশার ষ্টীল পেলেট প্লান্ট, ৪) ভারত পেট্রোলিয়াম এর মার্কেটিং টার্মিনাল, ৫) হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের এর মার্কেটিং টার্মিনাল, ৬) কার্গিল এডিবিল অয়েল প্ল্যান্ট, ৭) ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, ৮) স্কল ব্রেওরিস লিমিটেড ।

Thursday, March 19, 2015

ঘটগাঁ মা তারিণী পিঠ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১১.০৩.২০১৫ বুধবার /



 ঘটগাঁ মা তারিণী পিঠ
  ত্রিভুবন জিৎ  মুখার্জী / ১১.০৩.২০১৫ বুধবার /
  তারিণীর ইতিহাস ঃ- ১৪৮০ খৃস্টাব্দে পুরীর গজপতি রাজা শ্রী পুরুষোত্তম দেব , ‘কাঞ্চী যুধ্যের’ সময় তৎকালীন কেঞ্জোর রাজ্যের রাজা শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেও মহাশয়কে তাঁর সেনাপতি রূপে আহ্বান করেন । শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেব যুধ্যে পারদর্শী ছিলেন তাই শ্রী পুরুষোত্তম দেবের আহ্বানে তাঁর  সঙ্গে  কাঞ্চি অভিযানে যাত্রা করেন। গজপতি রাজা পুরুষোত্তম দেব  কাঞ্চী জয় করে কাঞ্চী রাজার রাজ কন্যা ‘পদ্মাবতী দেবীকে’ সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং পাট রানি করেন । এই ইতিহাস অতি প্রাচীন ।   
ছোট করে বলতে হলে ঃ পুরীর জগন্নাথের রথ দেখতে কাঞ্চীর রাজা এসেছিলেন । রথের প্রারম্ভে পুরীর গজপতি মহারাজা , শ্রী জগন্নাথ ,বলভদ্র এবং মা সুভদ্রার রথে ‘ছেরা পঁহরা’ করে থাকেন। এটাই রীতি । ছেরা পঁহরা অর্থাৎ সোনার ঝাঁটা দিয়ে চন্দন এবং বেল ফুল দিয়ে সারা রথ পরিক্রমা করে নিজে রাজা ঝঁট দেন । সেই ঝাঁটা হাতে রাজাকে দেখে কাঞ্চীর রাজা পুরীর গজপতি রাজাকে ম্যাথোর ভাবেন এবং উপহাস করেন । এতে গজপতি রাজা অপমানিত হন এবং শপথ করেন কাঞ্চী রাজ্য জয় করে রাজকন্যা পদ্মাবতী দেবীকে মহারানী করবেন । যা ভাবা তাই হল । সেই যুধ্যে শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেব সেনাপতির ভূমিকা পালন করে কাঞ্চী যুধ্যে জয়ী হয়ে ফেরেন ।  
 
কাঞ্চী যুধ্যের জয়ের খুশীতে গজপতি রাজা পুরুষোত্তম দেব শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেবেকে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর কি অভিলাষ ! শ্রী গোবিন্দ ভঞ্জ দেব মা তারিণীকে তাঁর রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পূজো করতে চান এবং কেঞ্জোরে মায়ের মন্দির বানানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু গজপতি রাজা বলেন এই আশা পূরণের উদ্দেশ্যে ‘মা তারিণীকে’ নিয়ে যাওয়ার অনুমতির জন্য মাকে প্রার্থনা করতে ; কারন মায়ের অনুমতি বিনা তাঁকে নেওয়া সম্ভব নয় । এর পর গোবিন্দ দেব মায়ের পূজোয় বসেন । মা তারিণী তাঁর পূজোয় সন্তুষ্ট হন বটে কিন্তু একটা সর্ত রাখেন। মা  বলেন মা’কে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজা গোবিন্দ দেব যেন পেছন ঘুরে না তাকান মা আসছেন কিনা দেখতে । রাজা রাজি হন মা’য়ের ওই সর্তে । রাজার সঙ্গে  মা তারিণী ঘোড়ায় চড়ে রাজার পেছন পেছন যাচ্ছিলেন । কিন্তু ঘটগাঁর কাছে গভীর জঙ্গলে মায়ের ঘোড়ার আওয়াজ রাজা শুনতে পেলেন না । এতে রাজা বিব্রত হয়ে পেছনে তাকান । সেই সময় মা তারিণী প্রস্তরে পরিণত হয়ে এক বট গাছের তলায় অধিষ্ঠান করেন। রাজা যত মনঃ কষ্ট করে পূজার্চনা করলেও আর মা তাঁর রূপ ধারণ করেন না।  সেই থেকে ‘মা তারিণী’ ঘটগাঁতে পূজো পেয়ে আসছেন ।
তারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা:-
১৯৭০ সালে উড়িষ্যা  সরকার এর মন্দির প্রতিষ্ঠান তারিণীর মন্দির তৈরি করে মাকে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে ওখানে যাত্রী দের সুবিধের জন্য হোটেল , লজ , গেস্ট হাউস ইত্যাদি আছে । যারা থাকতে চান স্বচ্ছন্দে ওখানে কম খর্চায় থাকতে পারেন। ওখান থেকে অনেক দর্শনিয় স্থান যেমন জলপ্রপাত ১. সান ঘাগরা , ২. বড় ঘাগরা , ৩. ভীম কুন্ড ইত্যাদি ঘুরে  দেখে যেতে পারেন। কিছু বিদেশী পর্যটক এইসব দর্শনিয় স্থান এসে ঘুরে ভিডিও করে তাঁদের দেশে নিয়ে যান ।    
কি করে যাবেন:-
ভুবনেশ্বর থেকে ঘটগাঁতে যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে । প্রথম রাস্তা ভুবনেশ্বর থেকে NH 5 ধরে কটক , চন্ডিখোল  হয়ে NH5A(Express High way) ধরে বাঁ দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে “ব্রাহ্মণী নদীর ব্রিজ”  পার হয়ে  ‘ডুবুরী’ ।  এই ডুবুরী তে টাটা স্টিল প্ল্যান্ট , নীলাচল ইস্পাত স্টিল প্ল্যান্ট ইত্যাদি আছে তাই এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব । ডুবুরি থেকে দৈত্যারি মাইনসের রাস্তায় ‘ব্রাহ্মনিপাল’ অবধি গিয়ে ওখান থেকে ডানদিকে ঘটগাঁ (রাস্তার ওপর এক্সপ্রেস হাই ওয়ের ওপর ফিকে সবুজ বোর্ডে সুস্পষ্ট লেখা) । ভুবনেশ্বর থেকে রাস্তায় চন্ডিখোল ৭০ কিলোমিটার , চন্ডিখোল থেকে ডুবুরী ৩৮ কিলোমিটার , ডুবুরী থেকে ব্রাহ্মণীপাল ১২ কিলোমিটার , ব্রাহ্মণীপাল থেকে ঘটগাঁ ৫৮ কিলোমিটার । সমুদায় ১৭৮ কিলোমিটার  এই রাস্তার একটা বিশেষত্ব আছে। এই রাস্তা দিয়ে গেলে অনেক ছোট ছোট  পাহাড় পর্বত  এবং জঙ্গল আছে যার সিনিক ভ্যালু অনেক। আমি সারা রাস্তা ক্যামেরা ধরে ফটো তুলেছি। দ্বিতীয় রাস্তা সোজা NH5 ধরে ‘চন্ডিখোল ছক’ পেরিয়ে সোজা ‘পাণিকোইলি’ অবধি গিয়ে ওখান থেকে আবার বাঁ দিকে ‘যাজপুর রোড’ । যারা হাওড়া থেকে আসবেন তারা যাজপুর রোড়ে নেমে ট্যাক্সি কিম্বা কেঞ্জোরের বাসে ঘটগাঁ নেবে মা তারিণী র দর্শন করতে পারেন। যা বলছিলাম.. ওই যাজপুর থেকে আবার আনন্দপুর হয়ে সোজা ঘটগাঁ মা তারিণী পীঠ । 
     
এখন এটি উড়িষ্যার একটি পর্যটন এবং শক্তি পীঠের স্থান যেখানে মা পূজো পান। মা তারিণী খুব জাগ্রত দেবী তাঁর কাছথেকে কেউ খালি হাতে ফেরেনা । ভক্তিভরে ডাকলে মা সাড়া দেন ভক্তকে ।
 
তারিণীর পর্ব পর্বানিঃ-
তিনটে বড় সংক্রান্তি তে তারিণীর বিশেষ পূজার্চনা হয় এবং ওই সময় এখানে উৎসব মুখরিত পরিবেশ জা এখানকার আদিবাসীদের পর্ব বলে ধরা হয়।  ১. মকর সংক্রান্তি (জানুয়ারি ১৪-১৬) , ২. মহা বিষুব সংক্রান্তি (এপ্রিল ১৪-১৬) , ৩. রজ সংক্রান্তি ( জুন ১৪-১৬) । এই সময় যাত্রীদের খুব ভীড় হয় । ছত্রিশ গড় , ঝাড়খণ্ড থেকে এখানে অনেকে আসেন মায়ের যাত্রা দেখতে । এ ছাড়া দুর্গা পূজো ও কালি পূজোতে মায়ের বিশেষ পূজার্চনা হয় । এখানকার মুগের ডালের খিচুড়ি মায়ের প্রসাদ । আমিষ ভোগ হয় না। উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মায়ের পূজোর জন্য লোকে মানসিক করেন নারকোল ভোগ দিয়ে। তাই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারকোল আসে মায়ের কাছে ভোগের জন্য। এখানকার পুরোহিত কে দেহুরী বলে। এরা ব্রাহ্মণ নয় । 
ভোগের সময় নির্ঘন্টঃ-
ক্র.সংখ্যা
 পূজার নাম
                                    সময়
 ১.
 বাল্যভোগ
সকাল ৬ টা
 ২.
 খিচুড়ি
সকাল ১০.৩০
৩.
পহড় (মন্দিরের দ্বার বন্দ করা হয়)
                                         বেলা ১.০০
 ৪.
 বাল্যভোগ
বেলা ৩.৩০
 ৫.
 সন্ধ্যা ভোগ (সরু চকুলি পিঠে ভোগ)
বিকেল ০৫.০০
6.
  সন্ধ্যা আরতি
সন্ধ্যা ০৭.৪৫
7.
 পহড় (মন্দিরের দ্বার বন্দ করা হয়)
সন্ধ্যা ০৮.০০

পুরীর সাহিযাত্রা উৎসব ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ০৭.০২.২০১৫ /


 পুরীর  সাহিযাত্রা উৎসব  
ত্রিভুবন জিৎ  মুখার্জী / ০৭.০২.২০১৫ / 
পুরী , উড়িষ্যার এক তীর্থস্থানই শুধু নয় এই সহরের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে জগন্নাথ সংস্কৃতি অঙ্গে  অঙ্গে জড়িত ।  বিভিন্ন  পর্ব পর্বানির মধ্যে পুরী সদা সর্বদা উৎসব  মুখরিত তীর্থস্থান  । তাই কথায় আছে  এখানে বারো মাসে তের পার্বণ বা যাত্রা । বসন্তর আগমনে এখানে এক অদ্ভুত যাত্রা শুরু হয় নাম সাহি যাত্রা’ বাপথ প্রান্ত যাত্রা উৎসব’  । প্রায় ১২৩০ খৃষ্টাব্দ থেকে তখনকার গজপতি রাজা  চোড়্গঙ্গদেব’  বিভিন্ন আখড়া ঘরে মল্ল যোদ্ধাদের  নিয়ে জাগাঘর (ব্যায়াম ঘর) তৈরি  করেন । তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর রাজধানী পুরী যাতে সুরক্ষিত থাকে  । কোন বাহ্যিক শত্রুদ্বারা  আক্রমণকে  প্রতিরোধ করার শক্তি থাকে এই  মল্ল যোদ্ধাদের ।  তখন জগন্নাথ মন্দিরের চতুঃপার্শ্বে সুউচ্চ  মেঘনাদ প্রাচীর ছিলনা ।  এই মল্ল যোদ্ধাদের,   রাজা জগন্নাথ মন্দির সুরক্ষ্যার দায়িত্ব দেন।  তারা মন্দিরকে বাহ্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষ্যা করার জন্য বিভিন্ন অস্ত্র চালনা যথা তরওয়াল লাঠি চালনা প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র  চালনাতে রপ্ত ছিল। জাগাঘর ছিল এইসব মল্ল যোদ্ধাদের  তালিম এবং শিক্ষা কেন্দ্র। 
সাহি’  মানে পাড়া’ । জাগা ঘর” মানে ব্যাম কেন্দ্র। পুরী মন্দির চতুঃপার্শ্বে সুউচ্চ প্রস্তর নির্মিত  মেঘনাদ প্রাচীর তৈরি হয় মন্দির সুরক্ষার জন্য ।
পুরীতে ৭ টা পুরন সাহি আছে যথাঃ- ১)হরচন্ডী সাহি ২)মার্কন্ডেস্বর সাহি ,৩) দোল মণ্ডপ সাহি ৪)বাসেলি সাহি ৫)মাটিমন্ডপ সাহি ৬)বালি সাহি ও ৭)গৌড় বাট সাহি  জগন্নাথ মন্দির এর চতুঃপার্শ্বে এদের অবস্থিতি  ।  এই সাহির অধিবাসীদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মন্দিরকে বাহ্য শত্রু থেকে রক্ষা করা এবং তার জন্য তারা প্রত্যেক দিন জাগা ঘরে ব্যাম কুস্তি মল্ল যুদ্ধ  এবং লাঠি ও তরবারি  চালনা ইত্যাদি  অভ্যাস করত । সাধারণ জনতা এইখানে তালিম-প্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছথেকে বিভিন্ন কলা কুশলী শিক্ষা প্রাপ্তি করার সুযোগ পেত ।  প্রত্যেক সাহির একটা জাগা ঘর আছে  । উধাহরনতঃ ১। সুন্দরা জাগা ২। মল্লিগড় জাগা ইত্যাদি । 
এই জাগা ঘরের যোদ্ধারাই বাহ্য শত্রু থেকে একসময় জগন্নাথ মন্দির রক্ষা করেছিলতাই পুরীর গজপতি  রাজা জাগা-ঘরের মল্ল  যোদ্ধাদের  বিশেষ তালিম এর আয়োজন করেন তাঁর রাজধানী এবং মন্দির সুরক্ষ্যার জন্য । 
রাম নবমীর দিন থেকে প্রত্যেক জাগা ঘরের মল্ল যোদ্ধারা  তাদের যুদ্ধ কলা কুশলী পুরীর পথ প্রান্তে প্রদর্শন করে । ১৫ দিন ধরে এই যাত্রা চলে এই সময় এক বিশেষ সাজে নাগা নাচ’ হয় এবং  মল্ল যুদ্ধ কুস্তি ইত্যাদি প্রদর্শিত হয় । সাহি যাত্রার সময় ছোট ছোট পথ প্রান্ত নাটক প্রদর্শিত হয় । পুরীর সাধারণ জনতা এই পথ প্রান্ত নাটকের মাধ্যমে বিভিন্ন জাগা ঘরের কলা কুশলীদের রণ কৌশল নাগা নাচের মাধ্যমে উপভোগ করেন।
ওই সময় মল্ল যুদ্ধ ছাড়াও ছোট ছোট পৌরাণিক কাহিনী প্রদর্শিত হয় । সব সাহিথেকে এই যাত্রা আরম্ভ হয়ে পুরীর বাড় দান্ড তে এক হয় । হরচন্ডী সাহি মার্কন্ডেস্বর সাহি দোল মণ্ডপ সাহি ,বাসেলি সাহি মাটিমন্ডপ সাহি বালি সাহিগৌড় বাট সাহি এই সাতটি সাহিথেকে সাহি যাত্রা বেরয় । প্রত্যেক সাহির একটি স্বতন্ত্র চিহ্ন স্বরূপ পতাকা থাকে ।  প্রত্যেক সাহির আলাদা আলাদা ছোট নাটকের বিষয় বস্তু থাকে যেমন রাম জন্মদুর্গা ঠাকুরের দ্বারা মহিষাসুর নিধন রাবণের দ্বারা  সিতা হরণ রাম রাবণের যুদ্ধপঞ্চ মুখি গণেশ ,নৃসিংহ অবতার ইত্যাদি ।
 ব্যাঘ্র চর্ম  পরি-ধারিত এক বিরল সাজে নাগা নর্তক সুসজ্জিত হয়ে দর্শক কে তার রণ নৃত্য কৌশল প্রদর্শন করে। সেটাই এই যাত্রার মুখ্য আকর্ষণ নাগা নর্তক অস্ত্র সুসজ্জিত কটিদেশ  কুঞ্চিত গুম্ফ জোড়া তীক্ষ্ণ নাসিকা অট্ট হাস্য পূর্ণ  রক্ত চক্ষু দ্বয়ের রণ হুঙ্কার দর্শকের মনোরঞ্জনের এক মাধ্যম। নাগা নাচ পুরী ছাড়া অন্য কোথাও প্রদর্শিত হয়না । উড়িষ্যার এই মার্সল আর্ট অনেক দর্শক কে আকৃষ্ট করে।   
এই সময় বিদেশি পর্যটকেরা অনেকেই  নাগা নাচ এবং সাহি যাত্রার আনন্দ নিতে পুরী আসেন।  তাই এই সময় পুরী উৎসব মুখরিত এক পর্যটন কেন্দ্রতে পরিণত হয় ।

অনুগল্প লং বেঞ্চ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১৯.০৩.২০১৫ / বেলা ১.১৫ ।



   অনুগল্প লং বেঞ্চ  
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১৯.০৩.২০১৫ / বেলা ১.১৫ ।

পার্কের এই কংক্রিটের লং বেঞ্চটা বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য উদ্দিষ্ট । একটু নিরিবিলি পরিবেশ । সামনেই ছোট্ট একটা ফুলের বাগান আছে তাতে নানান রঙের গোলাপ , রজনীগন্ধা , ডালিয়া জারবেরা ইত্যাদি  ফুলের শোভায় এক মনোরম পরিবেশ । বেঞ্চের ওপর ছায়ার জন্য বেশ পেছনে একটা কদম গাছ বলে কদম গাছে নাকি কেষ্ট নাচে গোপীদের জন্য , তাই এই -  বরিষ্ঠ নাগরিকের বসার জায়গায় কদম গাছটাই বেশ বেমানান। এই অঞ্চলের কাউন্সিলার ঠিক যায়গাতেই বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বসার যায়গাটা ঠিক করেছেন পার্কের মধ্যে । সামনেই মাঠের মধ্যে আরেকটা গোলাকার ঘর যার চালাটা এসবেস্টস এর তৈরি । চূড়াটা কোনিকাল আকৃতির এবং গোলাকার বেঞ্চ , বসার জন্য । মধ্যেখানে সুন্দর অর্কিডপাসের দেওয়ালটা খোলা তাই আলো বাতাস আসার অসুবিধা নেই। মোটামুটি বলতে গেলে এরকম একটা পার্ক সাধারণত সল্ট লেকেই দেখতে পাওয়াযায়  
প্রসঙ্গে আসি । এই বেঞ্চটাতে আমরা ৫ জন অবসরপ্রাপ্ত বরিষ্ঠ নাগরিক এসে বিকেল বেলায় আড্ডা দি। আমরা বলতে ১. পঞ্চুদা , ২.  নিহারদা , ৩. রণজিৎ-দা , ৪. সমরেশ দা এবং আমি । এনাদের মধ্যে আমি সর্ব কনিষ্ঠ । পঞ্চুদা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ তাই সকলে ওনাকে সম্মান করেন।  আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক রাজনীতি , খেলা , কিছু ধর্মালোচনা আবার তার মধ্যে কখন কার্ল মার্ক্স ত কখন শ্যামা প্রসাদ মুখুজ্জে র আবির্ভাব হয়। নিহারদা এর আগে পার্টি করতেন । ৭১ এ জেলে ছিলেন শুনি। রণজিৎ দা একটু গেরুয়ার ভক্ত। পঞ্চুদা , আমাকে নিজের দলে টানেন । উনি কোন পার্টির আলোচনায় থাকেন না । আমার তাই ওনাকেই পছন্দ। সমরেশ দা কে বোঝা মুশকিল । উনি সব শোনেন কোন মন্তব্য দেন না। বলতে-গেলে আমরা তিনজন রাজনীতির প্রসঙ্গে আসীনা। নিহারদা আর রণজিৎ দার মধ্যে কথা কাটা কাটি হলে পঞ্চুদা সামাল দেন। আমি ওই সময় চট করে দুটো রাউন্ড মেরে আসি পার্কের চারিদিকে। আজকে পঞ্চুদা আসেন নি । নিহারদা খবর দিলেন উনি এপোলোতে আই.সি.ইউ.তে । কাল নাকি স্ট্রোক হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বড় দেখতে যাওয়ার সাধ হল । এইতো গতকাল বিকেলে  কি সুন্দর ছিলেন । রাতে কি এমন হল ?  সকলকে বললাম চলুন না দেখে আসি ‘পঞ্চুদাকে’ । 
 পরের দিন সকালে সবাই এপোলোতে হাজির হলাম । ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতে আরও বেশ কিছু সময় বাকি । পাস নিয়ে ওপরে গিয়ে দেখি আই.সি.ইউ. থেকে ডেড বডি বেরুচ্ছে । সামনেই পঞ্চুদার ছেলে মেয়ে ! সকলে হতভম্ব । কারুর মুখ থেকে কিচ্ছু কথা বেরুলো-না । মেয়েটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে । পঞ্চুদার ছেলে নিথর । রণজিৎ দা , নিহার দা , সমরেশ দা সকলেই চোখ পুঁছছে ।  আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো । নিজেকে সামলাতে পারলাম না । রণজিৎ দাকে জড়িয়ে বললাম একি হোল ? রণজিৎ দা শুধু মাথায় হাত রাখলেন। উনিও চোখ পুঁছছেন রুমাল দিয়ে । নিহারদা সমরেশ দা নিথর । সব শেষ ! এইতো মানুষের জীবন !! এই নিয়ে এতো গর্ব ।