Sunday, January 11, 2015

অন্তঃপুরের তারা / সর্বাণী মুখোপাধ্যায়।/







       অন্তঃপুরের তারা
তাঁরা পাশে না থাকলে একজন বিভূতিভূষণ, একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, একজন তারাশঙ্কর এ ভাবেই জন্ম নিতেন? সন্ধানে বেরিয়ে ঘরণীদের কঠিন ব্রতর আঁচ পেলেন সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সর্বাণী মুখোপাধ্যায়।
১০ জানুয়ারি, ২০১৫, ০১:০০:১৮
• নিজের লেখালেখি, কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে স্বামীর লেখা শুধরে দিতেন বিভূতিভূষণের ঘরণী।
• এক দিকে সংসারের অর্থকষ্ট। অন্য দিকে অপরিমিত মদ্যপায়ী স্বামীকে সামলানো। তাঁর বন্ধু-আড্ডার ঝক্কি মেটানো। ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নেওয়া। এই ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর রোজনামচা।
• রেগে গেলে ভাঙচুর চালাতেন বনফুল। শান্ত করতেন স্ত্রী। তাঁর লেখালেখি তো বটেই, ডাক্তারি গবেষণার কঠিন পর্বগুলোয় স্ত্রীই হতেন সঙ্গী। তার মধ্যেই চলত ভোজনরসিক স্বামী ও তাঁর সন্তানের যথাযথ প্রতিপালন।
• একটি উপন্যাস লেখার কারণে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী এক বার ঠিক করলেন বস্তিতে গিয়ে থাকবেন। এক কথায় শিশুকন্যাকে নিয়ে স্বামীর অনুগামী হন নন্দী-জায়া।
অলংকরণ: শেখর রায়।
কোনও দিন সামনে আসেননি তাঁরা। কিন্তু ওঁদের দিকপাল সাহিত্যিক-স্বামীরা যদি সাহিত্য জগতের এক একটি মহাগ্রহ হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁদের অন্দরমহলের ঘরণীরা ছিলেন অমিত শক্তিধর মহাতারকা। যাঁদের অদৃশ্য রশ্মির বিচ্ছুরণে স্বামীরা উদ্ভাসিত।
আজ তাঁদের কথা।
বিভূতিভূষণের কল্যাণী
প্রথম স্ত্রী গৌরীর অকালমৃত্যুতে অতি অল্প সময়ের দাম্পত্যে যতি পড়ল।
তার পর কুড়ি বছর পার। বিভূতিভূষণ তখন প্রৌঢ়। সেই সময়ই অন্তত তিরিশ বছরের ছোট, তাঁর সাহিত্য-অনুরাগী রমা চট্টোপাধ্যায় সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব পাড়লেন বিভূতিভূষণের কাছে।
ঘটনাটি না শুনলে বোঝা যাবে না, বিয়ের আগে থেকেই রমা কতটা অনুরক্ত ছিলেন ওঁর প্রতি।
প্রস্তাব শুনে বিভূতিভূষণ গায়ের জামা খুলে বুকের কাঁচাপাকা রোম দেখিয়ে বললেন, “দ্যাখো, আমার অনেক বয়স হয়েছে, আর ক’দিনই বা বাঁচব?”
জবাবে সদ্য যুবতী রমা অবলীলায় বলেছিলেন, “আপনি যদি আর মাত্র একটা বছরও বাঁচেন, তাহলেও আমি আপনাকেই বিয়ে করব।”
রমার সঙ্গে বিভূতিভূষণ
১৯৪০, ৩ ডিসেম্বরে বিয়ে। ১৯৫০, ১ নভেম্বর বিভূতিভূষণের প্রয়াণ। দশ বছরের বিবাহিত জীবন।
মাত্র সাতাশ বছরের ভরা যৌবনে শিশুপুত্র নিয়ে বিধবা। কিন্তু নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অসমবয়সী প্রেমিক-স্বামীর ভালবাসায় বুঁদ হয়ে কাটিয়ে গেলেন রমাদেবী।
অথচ তাঁর নিজেরও ছিল সাহিত্য-প্রতিভা। ছোট থেকেই লিখতেন। হাতে লেখা পত্রিকা বার করতেন।
‘দেশ’ সাহিত্য পত্রিকার কোনও এক সংখ্যায় একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল রমা চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘স্বপ্ন’ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বপ্ন বাসুদেব’।
সারাটা জীবন স্বামীকে ‘আপনি’, অথচ আদর করে নিজের দেওয়া ‘মঙ্কু’ নাম ধরে ডাকতেন। আর বিভূতিভূষণ? ‘কল্যাণী, তুই’।
সব জায়গায় স্বামীর কায়ার সঙ্গে ছায়া হয়ে থাকতেন। যুগলে প্রচুর বেড়াতেন দেশ জুড়ে, এবং অবশ্যই জঙ্গলে। স্বামীকে আরাধ্য দেবতা মানতেন। ছাপা হয়ে বেরোনোর আগে ধরে ধরে পড়তেন সাহিত্যিক স্বামীর সমস্ত লেখা। প্রয়োজনে পরামর্শ দিতেন, আলোচনা করতেন। এমনকী সেই মতো তাঁর লেখায় অদল-বদলও করতেন অত বড় সাহিত্যিক।
কখনও নিজের সাহিত্য প্রতিভাকে ‘কেরিয়ার’ করেননি। আর তার জন্য আপশোস? তিলমাত্র না।
তারাশঙ্করের বড়বৌ
উমাশশী বন্দ্যোপাধ্যায়। চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের চার ছেলে, এক মেয়ের বড় আদরের ‘ফন্টি’। মাত্র ন’ বছর বয়সে লাভপুরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সতেরো-আঠেরো বছরের কিশোর তারাশঙ্করের বালিকাবধূ হয়ে এলেন। সে ১৯১৫ কী ১৬-র ২৬ জানুয়ারি।
অতি ধনী ঘরের মেয়ে। প্রচুর গয়না আর প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিলেন তখনকার দিনে। এবং শ্বশুরবাড়ির অনেক অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে এক সময় হয়ে উঠলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক স্বামী তারাশঙ্করের ‘বড়বৌ’।
টকটকে ফরসা। নীল নয়নতারা। মাঝারি গড়ন। মানুষটি ছিলেন একেবারে সাদামাঠা। চার ছেলেমেয়ের মা। রাশভারী সাহিত্যিক স্বামী ও সংসার এই নিয়েই তুষ্ট ছিলেন তিনি। তা বলে শুধুই যশস্বী স্বামীর লতানে পরগাছা হয়ে নয়।
স্বামী-সন্তান-সংসারের নিজস্ব পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন তাঁর সাধ্বী স্ত্রী-ধর্মে অটল থেকেই। একবারের কথা শোনা গেল।
রাতের বেলা দাঁতের প্রবল যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন উমাশশী। এ দিকে তারাশঙ্কর পাশেই বসে ‘কবি’ উপন্যাস লেখায় মগ্ন। বহুক্ষণ চেষ্টাকরে শেষে যন্ত্রণা সইতে না পেরে উমাশশী বললেন, “তুমি কী রকম মানুষ গো? এত কাতরাচ্ছি, ফিরেও দেখছ না, কেবল লিখেই চলেছ?” এত ক্ষণে হুঁশ ফিরল তারাশঙ্করের। হন্তদন্ত হয়ে উঠে ডাক্তার ডাকতে বেরোলেন।
স্ত্রী ও নাতনিকে নিয়ে তারাশঙ্কর
সাহিত্যজীবনের একেবারে গোড়ার দিকে তারাশঙ্করের লেখালেখির জায়গাটি ছিল দক্ষিণ কলকাতার মনোহরপুকুর রোডের টিনের বাড়ি। অথবা কলেজ স্ট্রিটের ‘শান্তিভবন’ মেসবাড়ি। তখন অর্থাভাব তাঁর প্রচণ্ড। দিন চালাতে প্রায়ই হাতের সোনার আংটি বিক্রি করে দিতে হত। লাভপুরে ফিরলেই তা নজর এড়াতো না তাঁর ‘বড়বউয়ের’।
চুপচাপ নিজের গয়না ভেঙে স্বামীর জন্য গড়িয়ে আনতেন ঠিক ওই রকম আংটি। এ রকম অজস্র বার। কখনও সাহত্যিক স্বামীর পাণ্ডুলিপি তাঁর মুখে শুনতেন না। আগেভাগে পড়তেও পেতেন না। লেখা পড়তেন বই বেরোলে, তবেই। বিপুল রচনা সম্ভারের কোনওটি তাঁকে উত্‌সর্গ করা হয়েছে কিনা, তাও জানা নেই। কিন্তু এ নিয়ে কোনও অনুযোগ ছিল না উমাশশীর।
তাঁদের ছোট মেয়ে বাণী রায় শুনিয়েছেন এই আশ্চর্য মানবীর কথা।
পরিবারেরই অতি আপন কেউ উমাশশীকে বিখ্যাত সাহিত্যিকের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ‘জীবন-অরসিক’ স্ত্রী বলেছিলেন। প্রতিবাদে তারাশঙ্কর-কন্যা বাণী রায় তার ‘তারাশঙ্কর স্মৃতিচারণ’ বইটিতে লিখেছেন, ‘অতিরিক্ত ধর্মপরায়ণা জীবন-অরসিকা এই স্ত্রীই ছিলেন তারাশঙ্করের জীবনের মূল ভিত্তি...প্রথম দিকে তাঁর বড়বৌ অনিপুণ ভাষায় এই সত্যই হয়তো বার বার প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাহিত্যব্রতী স্বামীকে ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারেননি। জীবনের শেষের দিকে ঈষত্‌ অনুযোগের সুরেই তারাশঙ্কর এই সত্য প্রকাশ করেছেন।’ তাঁর কাছ থেকেই আরও শোনা ‘স্ত্রীর অতিরিক্ত ভগবান প্রীতি তাঁকে পদে পদে তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছে’ এই অভিমান ও অনুযোগ তারাশঙ্করের ছিল। কিন্তু পরে, প্রৌঢ়ত্বের কিনারায় পৌঁছে স্ত্রী সম্পর্কে যথার্থ উপলব্ধিতে এর ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন...।’
১৯৭১, ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর চলে যান। এর সাত বছর পর বড় ছেলে সনত্‌কুমারের মৃত্যু। মর্মান্তিক পুত্রশোক বহন করে তার তেরো বছরের মাথায় ১৯৮৪, ২১ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন তারাশঙ্করের ‘বড়বৌ’ উমাশশী।
মানিকের ডলি
তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয়া কমলা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডলি’।
ঢাকা বিক্রমপুরের পঞ্চসার গ্রামের গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রধানশিক্ষক বাবা সুরেন্দ্রচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মা নগেন্দ্রনন্দিনী দেবীর তৃতীয়া কন্যা তিনি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চতুর্থ কী পঞ্চম পূর্বপুরুষ। সরোজিনী নাইডু পিসি। পদ্মজা নাইডু পিসতুতো বোন।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কলকাতার টালায় কাকার বাড়িতে উঠেছিলেন কমলা। সেখানেই এক বন্ধুকে নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁকে ‘দেখতে’ আসা। যার পরিণতি, ১৯৩৮-এর ১১ মে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিণয়।
কমলা সুন্দরী ছিলেন। সে কথা অন্য, নির্মম সত্যিটা হল, ‘অসাধারণ প্রতিভার অন্যরকম’ মানুষের স্ত্রী হওয়া যে কঠিন, আজীবন বুঝে গেছেন তিনি।
তাঁদের চার ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ছোট সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শুনেছি, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামলানোটাই তো বিশাল ব্যাপার!’ সেইসঙ্গে সামলানো তাঁর বিশাল আড্ডার আসর। সংসারের অর্থকরী দিক। কাল কী করে চলবে তার কোনও ঠিক নেই। এ দিকে বাড়িতে কিছু না জানিয়ে লোকজনকে নেমন্তন্ন করা প্রায় নিয়মে এনে ফেলেছিলেন মানিক। প্রায়ই সমস্ত রান্নাবান্না হয়ে যাবার পর ফের বাজার করে নতুন করে আবার রান্না করার মতো বহু উপদ্রবই দু’হাতে সামলে গেছেন কমলাদেবী।
পাশাপাশি স্বামীর মৃগী রোগের সেবার ধকল। দিনে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট, ফ্লাক্সে করে অনবরত চা। আর সেই সঙ্গে অপরিমিত মদ্যপান।
দুশ্চিন্তা হত। সামলাবার প্রচুর চেষ্টা করেছেন কমলা। লুকিয়ে জল মিশিয়ে দিতেন মদের বোতলে। পরিণাম? সংঘাত আর কষ্ট।
সেকেন্ড ডিভিশনে ভালভাবে ম্যাট্রিক পাশ। কিন্তু প্রবল ইচ্ছে থাকলেও শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারের সংসারের চাপে আর লেখাপড়া করা হয়নি। হল না আরও অনেক কিছুই। তা’ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রতিভাধর সাহিত্যিকের স্ত্রী হয়েও। শাড়ি-গয়না, টাকাপয়সা, ঘোরা-বেড়ানো দূরে থাক, দু-দণ্ড জিরোনোর জীবনও পাননি। তাতে কিচ্ছু যায় আসেনি তাঁর ‘ডলি’র।
আগাগোড়া লড়াই। তার মধ্যেই চার সন্তানের মা হলেন। এর মধ্যে টালিগঞ্জের পৈতৃক বাড়ি বিক্রির প্রাপ্য আট হাজার টাকা এল।
আজীবন কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বার স্বামী তাঁকে কোনও কিছু না বলে সে-টাকা পার্টি ফান্ডে দিয়ে দিলেন।
চিন্তা হত। কষ্ট হত। যখন দেখতেন লেখা আসছে না, লিখতে পারছেন না মানিক। অন্যমনস্ক। শূন্য দৃষ্টিতে চুপচাপ বসে আছেন বারান্দায় একা। জ্যোত্‌স্নারাতে আড়-বাঁশি বাজাচ্ছেন না। দুঃসহ যন্ত্রণা ফুটে উঠছে চোখেমুখে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কষ্টই তাঁর ডলির আসল কষ্ট ছিল। অন্য কিছু নয়।
বরানগরে ভাড়া করা বাড়ির দু’কামরার ঘর। একটিতে ক্যানভাসের পার্টিশন করে এক দিকে বৃদ্ধ অশক্ত অসুস্থ শ্বশুরের আমরণ সেবা। অন্য দিকে লেখার যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে সাহিত্য-সৃষ্টিতে মগ্ন স্বামী। অন্য ঘরে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে অসীম দারিদ্র দু’হাতে মোকাবিলা করা কমলা।
খড়মের শব্দের জন্য উত্‌সুক হয়ে থাকতেন ডলি। বুঝতেন, ‘উনি আসছেন।’...১৯৫৬-র ৩ ডিসেম্বর বরাবরের মতো থেমে গেল সেই আওয়াজ। মাত্র আটচল্লিশ বছরে চলে গেলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও দশ বছর যুদ্ধ করার পর ছোট ছেলে সুকান্তের চাকরি হওয়ায় এক টুকরো ‘আলোর মুখ’ দেখে এবং বড়মেয়ের মৃত্যুশোক সয়ে ২০০৫-এর ২৭ অক্টোবর সমস্ত সন্তাপের ওপারে চিরশান্তির ঘুম ঘুমোলেন মানিক-ঘরণী।
বনফুলের লীলা
‘বুঝলে?’ বলে বয়সে আট বছরের বড় স্বামীকে যিনি ডাকতেন, তিনি লীলাবতী মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যিক ও ডাক্তার স্বামী ‘বনফুল’, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। যাঁর কাছে তিনি বরাবরের ‘লীলা’।
তত্‌কালীন বর্মার নামজাদা অ্যাডভোকেট গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও কিরণবালা দেবীর তিন ছেলে আট মেয়ের সব চেয়ে বড় লীলাবতী।
কুড়ি বছর বয়সে ১৯২৭-এর ৭ জুন, বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। পাকা গমের মতো ঝকঝকে উজ্জ্বল ত্বক। কাটাকাটা চোখমুখ। ঠিক যেন দেবী। আই-এ পড়ার ফার্স্ট ইয়ারেই হয়ে গেলেন বনফুলের ঘরণী।
সাহিত্যিক ডাক্তার স্বামীর সংসার করতে করতে আই-এ পাশ করলেন ফার্স্ট ডিভিশনে। তারপর পড়ায় ছেদ পড়ল। দুই ছেলে দুই মেয়ের মা হলেন। মাঝে তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর ফের পড়া শুরু করলেন। প্রাইভেটে বি.এ পাশও করেন ভালভাবেই। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে।
এর পর? ছেলেমেয়ে বড় করা, সংসার এবং স্বামীর দেখাশোনা। এই ছিল তখনকার দিনের গ্র্যাজুয়েট লীলাবতীর সারাদিনের কাজ। শেষের কাজটি ছিল মারাত্মক কঠিন।
তাঁদের ছোট মেয়ে করবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, বনফুল ছিলেন মেজাজি। অসম্ভব খাদ্যরসিক। তার তালে তাল দেওয়া কম কথা নয়। এত কিছুর মধ্যেও স্বামীর সমস্ত লেখা সবথেকে আগে পড়তে হত লীলাবতীকে। সেইসঙ্গে ছিল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের যাবতীয় ডাক্তারি এক্সপেরিমেন্টে সমানতালে ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে সহযোগিতাও।
ভাগলপুরের বাড়িতে সপরিবার বনফুল (বাঁ দিকে তাঁর লীলা)
বনফুলের ছিল এক দিকে সাহিত্যচর্চা। অন্য দিকে ভাগলপুরের বাড়িতে গরু-ভেড়া-খরগোশ-গিনিপিগ ইত্যাদি নানা রকম পশু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সিফিলিস-এর অ্যান্টিডোট আবিষ্কারে লেগে ছিলেন তিনি। তাতে স্বামীকে সমানতালে ল্যাবরেটরিতে সহযোগিতা করতেন তাঁর লীলা।
ভাগলপুরের বাড়ির খোলা জায়গায় টালির ছাদ দেওয়া কুঁড়েঘরের মতো দুটি কামরা। তার একটিতে চলত সাহিত্যিক বনফুলের সাহিত্যচর্চা। অন্যটিতে তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট। দুটিই সামাল দিতেন তাঁর লীলা। ফলে সব মিলিয়ে ব্যাপারটি যে কী আকার নিত, বলাই বাহুল্য।
মানুষের হৃদ্‌যন্ত্র নিয়ে ‘অ্যান্টিজেন’ তৈরির পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হত। হৃত্‌পিণ্ড থেকে ফাইবার বের করে কেমিক্যাল ওষুধ দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার দরকার পড়ত। অসম্ভব কঠিন সে কাজ। মাঝে মাঝে গা-গুলিয়ে যেত। তবু ছোট মেয়ে করবীকে সঙ্গে নিয়ে সে-কাজে এতটুকু খামতি দিতেন না লীলাবতী।
এত কিছুর পরে প্রচণ্ড খাদ্যরসিক এবং মেজাজি স্বামীর পছন্দের যাবতীয় রান্না যত্ন করে নিজের হাতে করতেন।
তা সত্ত্বেও বনফুল মাঝেমাঝেই নাকি গোঁসা করে ‘স্বপাক খাওয়ার’ সিদ্ধান্ত নিয়ে কিনে আনতেন আলাদা রান্না করার সরঞ্জাম। কিন্তু তার মেয়াদ হত মাত্র একদিনের। এ কর্ম তাঁর সাধ্যে কুলোবে না বুঝে পরের দিনই আবার স্ত্রীর হেঁশেলে আত্মসমর্পণ।
স্ত্রীর সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল স্বামীর রাগ সামলানো। রাগলে জ্ঞান থাকত না বনফুলের। হাতের কাছে যা পেতেন ভেঙে চুরমার করতেন। আটকানোর দুঃসাধ্য কাজটি করতে হত সেই লীলাবতীকেই।
একদিন ইচ্ছে করেই এক কাণ্ড করে বসলেন তিনি। তখনকার দিনে ‘হোয়াট নট’ নামে রান্নাঘরের যাবতীয় জিনিস রাখার এক ধরনের ক্যাবিনেট থাকত অনেকেরই বাড়িতে। তেমনই এক ক্যাবিনেট থেকে একসঙ্গে ছ’খানা কাচের প্লেট ভেঙে ঠান্ডা স্বরে স্বামীকে বললেন, ‘কালকে যাবে। আবার নিয়ে আসবে।’ স্ত্রীর এই রূপ কোনও দিন দেখেননি বনফুল। এ ব্যক্তিত্ব কোথায় চাপা ছিল এত দিন! বাক্রোধ হয়ে গিয়েছিল বনফুলের।
লীলাবতীর এই ব্যক্তিত্বের খোঁজ করতে গিয়ে শোনা গেল এক অপূর্ব কাহিনি।
লীলাবতী তখন খুবই ছোট। নারায়ণগঞ্জ থেকে কাকা ডা. সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতায় আসেন। ওঠেন বাগবাজারের বলরাম বসু স্ট্রিটে। সারদা মায়ের কাছে। দুটি বছর তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন তিনি। তাঁর ব্যক্তিত্বের ভিতটা তখনই পোক্ত হয়।
১৯৭৬-এর ২৭ জুলাই। স্বামী ও চার ছেলেমেয়েকে রেখে চোখ বুজলেন লীলাবতী। বিয়ের ঊনপঞ্চাশতম বছরে যুগল জীবনে ছেদ টেনে দিলেন ‘বনফুলের’ প্রাণভ্রমর। তাঁর লীলা-হারা বুকে পাথরচাপা ডাক্তার স্বামী বললেন, ‘এই ভালো।’ ব্রেইন-ফ্যাকাল্টি নষ্ট হয়ে দীর্ঘমেয়াদি এই রোগের ধাক্কায় প্যারালিটিক, কথাবন্ধ লীলাবতী বেঁচেছিলেন মাত্র এক বছর। এর পরই তাঁর সাহিত্যিক স্বামী বনফুল বুক উজাড় করে ‘লীলা’-কে সম্বোধন করে লিখেছিলেন ডায়েরি ‘মর্জিমহল’ এবং উপন্যাস ‘লী’। যে ‘লী’-র অর্থ মিলন।
বিমল মিত্রের আভা
স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে চাকরি ছেড়েছিলেন বিমল মিত্র! তার আগে তাঁকে বলেছিলেন, ‘ভেবে দেখো, মাস গেলে নিয়মিত থোক টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, রেলওয়ে পাস, আমি না থাকলে উইডো পেনশন, এ রকম আরও অনেক সুযোগ-সুবিধে থেকে বঞ্চিত হবে...।’
এর পরও এক কথায় স্বামীকে ‘স্বাধীনভাবে লেখার’ জন্য চাকরি ছাড়ার সায় দিয়েছিলেন আভা মিত্র।
আভা বুঝেছিলেন, লেখার জন্য স্বামীকে চাকরির বাধ্য-বাধকতার দায় থেকে রেহাই দিতে হবে। এ দিকে দুই ছেলেমেয়ের মা তখন। সাংসারিক দায় প্রচুর। তবু সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।
১৯৪৩-এর ২৭ জুলাই বি এ পড়তে থাকা আভা সিংহের বিয়ে হয় রেলের চাকুরে বিমল মিত্রের সঙ্গে। প্রচণ্ড ইচ্ছে সত্ত্বেও লেখাপড়াটা আর হল না শ্বশুরবাড়ির অমতে।
সেই খেদের থেকেও তাঁর বুকে অনেক বেশি বাজত কৃতী পরিবারে তাঁর অকৃতী অপ্রতিষ্ঠিত স্বামীর প্রতি আত্মীয়স্বজনের অবহেলা, উপেক্ষা, অনাদর। এর ফসল ফলল অন্য ভাবে। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠল প্রবল টান, একাত্মতা।
সারা দিন ছেলেমেয়ে-সংসার করে আভাদেবী সন্ধেয় বেরিয়ে পড়তেন গাড়ি নিয়ে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে সমস্ত দিন লেখালেখি করা স্বামীকে তুলে নিতেন। ভিক্টোরিয়া, গঙ্গার পারে ম্যান অব ওয়্যার জেটি বা লেকের ধারে বসে গল্প করতেন সাহিত্য নিয়ে। বালজাক-দস্তয়ভস্কি। কোনও সাংসারিক আলোচনা নয়!
কখনও বালিগঞ্জ বিজন সেতুতে মাটিতে বাজার নিয়ে বসা ব্যাপারিদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে দুজনে জেনে নিতেন সাধারণ মানুষের জীবনকথা। যার থেকে সাহিত্যিক বিমল মিত্রের কলমে ‘কাহিনি’র ফসল ফলত।
১৯৯১-এর ২ ডিসেম্বর। ঊনআশি বছরে সাহিত্যিক বিমল মিত্র চিরকালের মতো বন্ধ করলেন তাঁর কলম। ওই দিন সকালেই কোমায় আক্রান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। বুঝতে পারেননি তাঁর সব কিছু বুঝতে-পারা স্ত্রী আভা। ভেবেছিলেন রাতের ঘুমের ওষুধের জের।
পরে এই আক্ষেপের মর্মান্তিক যন্ত্রণায় যে কথা বলেছিলেন, কতখানি ভালবাসলে এমন সাঙ্ঘাতিক বলা সম্ভব! — ‘আমার আনাড়িপনায় আমার স্বামী যে ভাবে কষ্ট পেয়ে চলে গেল, আমি যেন সেই কষ্টটা পাই।’
ঠিক আট বছর পর একই মাসে ১৯৯৯-এর ১৮ ডিসেম্বর যা বলেছিলেন, তার থেকেও অনেকগুণ বেশি কষ্ট পেয়ে ওভারি ক্যানসারের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে, তাঁর আত্মগ্লানির চরম ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করে চোখ বুজলেন আভা মিত্র।
জ্যোতিরিন্দ্রর পারুল
পারুল নন্দী। সাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর স্ত্রী। যিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে ‘বঙ্গবাসী’ কলেজে নাইট-ক্লাস করে গ্র্যাজুয়েশন পূর্ণ করেছিলেন।
এনসিসি করেছেন। এস্রাজ, বেহালা, সেতার বাজাতে জানতেন। গান ছিল প্রাণ। সঙ্গীতজগতের সমস্ত খঁুটিনাটি খবর ছিল নখের ডগায়। পাড়ার মেয়েদের নিয়ে পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠান নিজে পরিচালনা করতেন। ছিলেন প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা-সংগ্রামীও। এমন এক নারী পরবর্তী জীবনটা সঁপে দিলেন তাঁর স্বামীর যশ, খ্যাতি, সম্মানের কাছে।
ময়মনসিংহ থেকে কলকাতার হ্যারিসন রোডের বাড়িতে চলে আসা তরুণী পারুল ধর চৌধুরী। হঠাত্‌ একদিন তাঁর হাতে পড়ে একখানা বাঁধানো সাহিত্যপত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’। সেখানে তাঁর চোখ আটকে যায় এক অদ্ভুত নামের গল্পে, ‘শশাঙ্ক মল্লিকের নতুন বাড়ি’। লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী।
ওই গল্পের নাম তাঁকে টানে, একই সঙ্গে টানে তার ভবিতব্যও। বৌদির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বন্ধু জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। সেই সূত্রেই বিয়ের সম্বন্ধ এবং পরিণয়।
পারুল নন্দী পরে নিজেই বলেছেন, প্রথম দর্শনে কৃশ চেহারা, আধময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি এ সব দেখে দোটানায় পড়ে যান। কিন্তু এই দ্বিধা চলে যায় ‘লেখক’ শব্দটির আকর্ষণে।
১৯৪৬-এর ১৭ ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের দিনও বরের পোশাক-আশাকে কোনও হেলদোল নেই। একরাশ কালো ঝাঁকড়া উসখুসে চুল। লন্ড্রি থেকে কাচানো ধুতি-পাঞ্জাবি। চেহারার মলিন ছাপটিও ঘষা-মাজা করা হয়নি। দেখে কেউ বলবে না বিয়ে করতে এসেছেন!
‘বারো ঘর এক উঠোন’ লিখবেন জ্যোতিরিন্দ্র। লেখার প্রয়োজনেই এক দিন স্ত্রীকে বলেছিলেন, “বস্তিতে থাকতে হবে। পারবে?”
সে সময় এক সন্তানের মা পারুল। চার বছরের মেয়েকে নিয়ে এক কথায় উঠে এসেছিলেন বেলেঘাটার ‘বারোয়ারি তলার’ বস্তিতে। তার পরেই জন্ম নিয়েছিল সেই বিখ্যাত উপন্যাস।
তিন ছেলেমেয়ের মা হলেন পারুল। তাদের লেখাপড়া, মানুষ করার সব দায়িত্ব নিলেন। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কখনও চাকরি করেননি সংসারের জন্যে। আর অর্থাভাবের আজীবন টানাটানিতেও কখনও এতটুকু চিড় ধরেনি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে।
সব কাজের মাঝেই খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়তেন। স্বামী সম্পর্কিত যাবতীয় রিপোর্ট সযত্নে কাটিং করে রাখতেন। ১৯৮২ সালের ১ অগস্ট চলে যান জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। আর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮, আশি বছর পার করে তিলজলা পিকনিক গার্ডেনে স্বামীর সরকারি আবাসনে দেহ রাখলেন তাঁর জীবন-সঙ্গিনী পারুল।
সন্তোষকুমারের নীহারিকা
বিয়েটা হঠাত্‌ই হয়ে গিয়েছিল। কালীঘাটে মামাবাড়িতে বেড়াতে আসা মেয়ে ‘ফুনু’ বুঝতেও পারেনি তাঁর আসলে ‘মেয়ে দেখা’ চলছে।
দেখতে আসা সুদর্শন অথচ বেঁটেখাটো ছেলেটির নাম বাদল। জিজ্ঞেস করল‘আমরা খুব গরিব, আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবে?’ তখন বুঝতে পেরে ফুনু সটান বলে দিয়েছিল, ‘মনের মিল হলে গাছতলাতেও থাকতে পারি।’
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬। সরস্বতী পুজোর দিন বিয়ে হয়ে গেল মুকুন্দলাল গুহ-র বড় মেয়ে আঠেরো বছরের ফুনুর সঙ্গে ছাব্বিশ বছরের বাদলের। এই বাদল, সন্তোষকুমার ঘোষ। পরবর্তী কালে দুঁদে সাংবাদিক। খ্যাতনামা সাহিত্যিক। আর ফুনু, গুহবাড়ির বড় মেয়ে, তাঁর আজীবন ছায়াসঙ্গী স্ত্রী, নীহারিকা ঘোষ।
আপাতদৃষ্টিতে নরম, কোমল, অতি শান্ত, সবসময় হাসিমুখের নীহারিকাকে সন্তোষকুমার ঘোষের মতো তুখোড় স্বামীর ছায়াতে থাকা মনে হলেও, তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ছিল। ছিল কঠিন সময়ে একেবারে একা ডিসিশন নেবার শক্তি। এক বারের কথা, মেজমেয়ের মেরুদণ্ডের জরুরি অপারেশন। নিজে বন্ড সই করে একেবারে সার্জারি করিয়ে আনলেন একা। বিন্দুমাত্র জানতে দিলেন না স্বামীকে। দূরে আছেন, শুনে পাছে টেনশনে পড়েন! সংসার-ছেলেমেয়ের ব্যাপারে সন্তোষকুমার ছিলেন পুরোপুরি স্ত্রীনির্ভর। তাঁর মতো ব্যস্ত সাংবাদিক-সাহিত্যিকের এ সব বিষয়ে ফিরে দেখার ফুরসত তেমন ছিল না। তবু দুরন্ত স্বভাবের প্রচণ্ড রোম্যান্টিক স্বামীটিকে একেবারে ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ করার রাশ ছিল তাঁর হাতেই। যে রাশ আলগা হয়ে মুঠি থেকে পড়ে গেল ১৯৮৫-র ২৬ ফেব্রুয়ারি। গলার ক্যানসারে নির্বাক সন্তোষকুমার ঘোষ চলে গেলেন। ২০০১, ১৮ জানুয়ারি, জীবন থেকে ছুটি নিলেন নীহারিকা ঘোষ।
গৌরকিশোরের তুলু
হুগলির অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী পরিবারের কেউই স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি তাঁদের ‘তুলু’ এমন একটা কাজ করে বসবে!
কড়া শাসনের যৌথ সংসারে ধনী ঘোষবাড়ির ধীরেন্দ্রনাথ ও সুধীরবালার ছয় সন্তানের তৃতীয় সন্তান তুলু। ভাল নাম শীলা। নবদ্বীপে মাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে প্রেমে পড়ল মাসতুতো দাদার বন্ধু, চালচুলোহীন দরিদ্র পরিবারের উড়নচণ্ডী ছেলে গৌরকিশোর ঘোষের। একদম চিঠির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রেম। বাড়ির সকলের সঙ্গে একলা একবগ্গা লড়াই করে শীলা এক দিন বাধ্য করালো এই অসম বিয়েতে মত দিতে।
১৯৫৬, ৮ কী ৯ মে। বাংলার পঁচিশে বৈশাখ, রেজিস্ট্রি বিয়ে হল। তেত্রিশ বছরের গৌরকিশোর একবস্ত্রে সাতাশ বছরের শীলাকে নিয়ে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে তুমুল আলোড়ন ফেলে।
এর পর থেকে সবটাই শীলা ঘোষের নিপুণ হাতের জীবনশিল্প। আনন্দবাজারের গৌরকিশোরের স্থায়ী চাকরির আগে পর্যন্ত অসম্ভব অনটনের সঙ্গে ভয়ংকর লড়াই। তার মাঝেই গড়ে তোলা একটি গোছানো সংসার। তৈরি করা তিন ছেলেমেয়েকে। দু’হাতে সামলানো সংসারের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন, বাঁধাগতের বাইরের মানুষ গৌরকিশোরকে।
অন্য দিকে শীলা ঘোষ সেই বিরল স্ত্রীদের একজন, যিনি তাঁর সাংবাদিক-সাহিত্যিক স্বামীর সমস্ত লেখা, ছবি, কাটিং করে সন-তারিখ দিয়ে সংরক্ষণ করে গেছেন। লেখক গৌরকিশোর ঘোষের সমস্ত ম্যানস্ক্রিপ্টের প্রথম অনিবার্য পাঠক ছিলেন তাঁর ‘তুলু’! গল্প-উপন্যাসের দু’প্যারা লিখে তুলুকে পড়িয়ে নিতেন গৌরকিশোর। জীবনের সমস্ত কাজে পরম নিশ্চিন্তি —‘তুলু আছে’।
শ্যামলা। লম্বা। দীর্ঘ চুল। লাবণ্যময়ী মুখশ্রী। বড় বড় পাতা-ছাওয়া আকর্ষণীয় চোখ। বরাবরের সাজ সিঁদুরের টিপ। তাঁতের শাড়ি। আর একমাত্র অলঙ্কার দু’হাতে দুটি মোটা শাখা। ম্যানিলায় ‘ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার নিতে স্বামীর সফরসঙ্গিনী ছিলেন ওই সাজেই।
১৯৭৫-এর এমার্জেন্সিতে ‘মিসা’য় বাড়ি থেকে গ্রেফতার হলেন গৌরকিশোর ঘোষ। তখন সে এক অন্য লড়াই! দুই নাবালিকা মেয়ে আর বৃদ্ধা শাশুড়ি নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। একমাত্র ছেলে তখন হস্টেলে। তা’ও সামাল দিলেন শীলা!
কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করে মামলা লড়ে আদায় করলেন স্বামীর সঙ্গে জেলে দেখা করার অর্ডার। প্রচুর ছোটাছুটি করলেন স্বামীকে ‘রাজবন্দি’ স্টেটাস পাওয়ানোর।
বাসে করে দিনের পর দিন আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করা কম কষ্টের ছিল না। প্রায় এক বছর জেলে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি বন্দি মানুষটির সঙ্গে যে ভাবে প্রচণ্ড লড়াই করে আর বুদ্ধি খাটিয়ে যোগাযোগ করতেন, তা রোমাঞ্চকর রহস্য কাহিনিকেও হার মানায়। ছ’ছটা বছর প্যারালিসিসে ভুগে, কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গৌরকিশোরের। তার মধ্যেই তাঁকে তুলে কম্পিউটারে বসিয়ে ফের লেখা ধরানোর দুঃসাধ্য কাজটি করেন এই শীলা ঘোষ, অক্লান্ত সেবাযত্ন আর পরিশ্রমে।
১৫ ডিসেম্বর, ২০০০। সকালে স্ত্রীর মুখে একখানা আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে শেষ আদর করে বিকেলের দিকে চিরবিদায় নিলেন গৌরকিশোর। আরও বারোটা বছর তাঁর তুলু তাঁকে ‘বাঁচিয়ে’ রাখলেন একেকটা বিষয়ে সেমিনার অর্গানাইজ করে, তাঁর জন্মদিন পালন করে, নানা ভাবে তাঁকে প্রোজেক্ট করে, যাতে লোকের মনে তিনি ‘থাকেন’। শেষমেশ নিজে চলে গেলেন ঠিক বারো বছর পর ২০১২, ৪ সেপ্টেম্বর।
আশুতোষের মমতা
এই পর্বের শেষ ঘরণী, কথাশিল্পী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন-নায়িকা মমতা মুখোপাধ্যায়।
লখনউ-এর প্রবাসী বাঙালি ব্রজেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃণালিনী দেবীর নয় সন্তানের চতুর্থ মমতা। সবার রেণু।
বাড়ির আপত্তি অগ্রাহ্য করে কলকাতায় এসেছিলেন কোনও এক স্কুলে হিন্দি পড়াতে। যাতে তাঁদের আর্থিক অনটনের কিছুটা সুরাহা হয়। কিন্তু... কাঁচা-হলুদ রঙের ছিপছিপে দোহারা, সুশ্রী মুখশ্রীর, আর দেখার মতো সুন্দর আঙুলের মেয়েটির ভাগ্যচক্রে সম্বন্ধ হল নি-রোজগেরে, বেকার, ‘সাহিত্যিক’ হওয়ার আকাশকুসুম স্বপ্ন-দেখা সুদর্শন পুরুষ আশুতোষের সঙ্গে। যাঁকে সেদিন একঘর লোকের মধ্য থেকে বাইরে আলাদা ডেকে তাঁর শর্ত রেখেছিলেন মমতাআরও পড়তে এবং চাকরি করতে দিতে হবে। জবাবে পাত্রের সাফ কথা “সে তো করতে হবেই। চাকরি না করলে চলবে কী করে? আমি তো ধরাবাঁধা রোজগার করি না।”
বেকার, জীবিকায় ব্যর্থ, বিশাল একান্নবর্তী কৃতী পরিবারের একমাত্র অ-কৃতী সেজ ছেলে আশুতোষের সঙ্গে ১৯৫৩-র ৪ অগস্ট বিয়ে হয়ে গেল মমতার।
আরও লেখাপড়া, চাকরি করে বাইরের দুনিয়ায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়া মমতা মুখোপাধ্যায়, নিয়তির নির্মম বিধানে চিরকালের মতো বন্দি হলেন ঘরের চার দেওয়ালের কারাগারে।
দুটি সন্তানের মধ্যে প্রথম মেয়ের জন্ম হল উল্টো পা নিয়ে। অক্লান্ত শ্রম আর সেবায় মেয়ের উল্টো পা সোজা করার অসাধ্য কাজটি সাধন করলেন তিনি।
তত দিনে আশুতোষের ‘সাহিত্যিক’ হওয়ার একাগ্র সাধনা বাস্তবে ফলতে শুরু করেছে। নাম-যশ, অর্থ-খ্যাতি, জীবনের সমস্ত না-পাওয়া যেচে আসছে হাতের মুঠোয়, তাঁর কলমের প্রসাদে। ঠিক এই সুখের সময়ে চরম অভিশাপ। বহু দিন পর মুখোপাধ্যায় বংশে পর পর মেয়ে হওয়া বাড়িতে মমতার দ্বিতীয় সন্তান হল ছেলে। যে ছেলের জন্মসঙ্গী মারাত্মক রোগ ‘মাসকুলার ডিসট্রফি’যার কোনও চিকিত্‌সা নেই, নিরাময় নেই, অব্যর্থ পরিণাম, তিলে তিলে মৃত্যু।
রোগ ধরা পড়ল ছেলের মাত্র তিন বছর বয়সে। শোকে স্তব্ধ সারা বাড়ি। পাথর স্বামী-স্ত্রী। তবু নিজের সঙ্গে লড়াই করে উঠে দাঁড়ালেন মমতা। টেনে তুললেন স্বামীকে। তাঁর অনড় আঙুলে জোর করে ধরালেন কলম। বললেন, “তোমার কাজ তুমি করো, লেখো। আর কিচ্ছু তোমাকে করতে হবে না। আর আমার কাজটা করব আমি। ছেলের দিকটা আমি সামলাব।”
সহিষ্ণু, ধৈর্যময়ী, শান্ত, নরম অথচ অতি দৃঢ় এবং সাহসী এই ‘সাধারণ’ মহিলার নিঃশব্দ সহযোগিতা, প্রেরণা, অপরিসীম ত্যাগ এবং শক্তি ছাড়া আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সর্বজনপ্রিয় সফল সাহিত্যিক হতে পারতেন না।
পাণ্ডুলিপি দূরে থাক, স্বামীর অনেক বই-ই পড়া হয়নি তাঁর স্ত্রীর। ছেলে ফেলে স্বামীর সঙ্গে যাওয়া হয়নি তাঁর সুপারহিট সব সিনেমার প্রিমিয়ারে। স্বামীর সমস্ত লেখা মমতা পড়েছিলেন একমাত্র ছেলে চলে যাওয়ার পর, তাঁর মর্মান্তিক যন্ত্রণার সময়-না-কাটা অঢেল সময়ে। তার আগে তাঁর ভাগ্যবিধাতার কাছে যা তিনি চেয়েছিলেন, তা শুনে গায়ে কাঁটা দেয়। জেনেশুনে বুক পেতে তিনি পুত্রশোক নিতে চেয়েছিলেন‘আমি না থাকলে ছেলের এই যত্ন কে করবে? মা ছাড়া ওর যে বড় কষ্ট হবে। আমি যেন ওর আগে না যাই।’
অন্য দিকে বুক নিংড়ে তিনি নিজের বৈধব্যই চেয়েছিলেন। ‘খিদে পেলেও যে নিজে বুঝতে পারে না, আমাকে বলে দিতে হয়, চানের গরম জলটুকু পর্যন্ত নিজে ঠিক করে মেশাতে পারে না, আমাকে মিশিয়ে দিতে হয়, আমি আগে গেলে তাকে কে দেখবে? তাকে রওনা করিয়ে দিয়ে তবে যেন আমি যাই।’ এই প্রার্থনা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করেছিলেন মমতা মুখোপাধ্যায়ের ভাগ্যবিধাতা। একফোঁটা চোখের জল না ফেলে একমাত্র ছেলেকে ‘আগে’ পাঠিয়ে, তার ১২ বছর পর ১৯৮৯-এর ৪ মে স্বামীকে অতি শান্তভাবে ‘রওনা’ করিয়ে দিলেন।
যতক্ষণ ঠান্ডা শরীর নিয়ে নিষ্প্রাণ দেহটি কাছে ছিল, নির্নিমেষ দেখার পর শূন্য বিছানায় স্বামীর মাথার বালিশখানা বুকে আঁকড়ে আর্ত হাহাকারে চাইলেন তার শেষ চাওয়া— ‘ভগবান বলে যদি কেউ কোথাও থেকে থাকো, তাহলে আরও যা যা দুর্ভোগ আছে, সব এই জন্মে মিটিয়ে দাও। একচুলও ছেড়ো না। এ জীবনেই যেন সব চুকিয়ে যেতে পারি।’ ১৯৯৭-এর ১১ সেপ্টেম্বর, সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনের ঠিক তিন দিন পরে স্বামীর শেষ জন্মোত্‌সব পালন করে, বড় আশ্চর্য ভাবে আচমকা সব হিসেব চুকিয়ে বোধহয় স্বামী-পুত্রের কাছেই চলে গেলেন মমতা মুখোপাধ্যায়।
ওঁরা চলে গেছেন। ওঁরা চলে যান নিঃশব্দে। সকলের আড়ালে। অলক্ষ্যে। যত দিন থাকেন, বাঁচেন মহাগ্রহের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান তারা হয়ে। কখনও সে তারার নাম রমা, কখনওবা উমা, লীলা, কমলা, পারুল...
মহাকালও কি তার খবর রাখে না!
ওঁদের কথা
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
স্ত্রী ভবানী। বিয়ে ১৯৬৮-র ২০ জুন। স্বামীর দেওয়া আদরের নাম ‘সোনামন’। বললেন, “ওই নামটিই বেশি পছন্দের এবং পরিচিতির। আমি মনে করি সংসারটা আমার স্ত্রীর। আমি সেখানে আশ্রিত। অতিথির মতো থাকি।”
প্রফুল্ল রায়
স্ত্রী বাসবী। স্বামীর ডাকনামে ডাকে ‘বাদল’। পঞ্চান্ন বছরের বিবাহিত জীবন। বললেন, “কোনও দিন জানতে চায়নি আমি কত টাকা রোজকগার করি। কোনও দিন কিছু চায়নি। শখ শুধু বেড়াবার। আমার ভয়ংকর আর্থিক দুঃসময়ে বাপের বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে কখনও এক রাতের জন্যও বাবা-মায়ের কাছে থাকতে চায়নি। আমার সমস্ত বিপর্যয়ে শী স্টুড্ ফার্ম।”
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
স্ত্রী গীতা চলে গেছেন ১৪ অগস্ট, ১৯৯৩। বললেন, “আমি বিয়ে করিনি। আসলে গীতাই আমাকে বিয়ে করেছে।... হঠাত্‌ একদিন রাস্তায় সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়ে আমার হাতে পোখরাজের আংটি পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি যদি আমায় বিয়ে না করো, আমি আত্মহত্যা করব।’ বিয়ে হল।... চলে গেল ব্রেন টি

No comments:

Post a Comment