###এঞ্জেল###
##চতুর্দশ পর্ব##
© ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী


খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে ধ্রুব l আজ ওর অনেক কাজ ফ্যাক্টরিতে l বসের নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত ইউনিটের প্রোডাকশন ডিটেল এবং তার কোয়ালিটি কন্ট্রোল রিপোর্ট সংগ্রহ করে জমা দিতে হবে l এই আর্থিক বর্ষের লক্ষ পূর্ণ হয়েছে কিনা সেটাও সমীক্ষা করতে হবে l সমুদায় রিপোর্ট প্রথম কোয়ার্টারের Q1 তাকে জমা দিতে হবে l তারপর সেটা অডিট সেকশনে যাবে l সে জানে তার কাজ অনেক এগিয়ে আছে এবং একটাও লট কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে নন স্ট্যান্ডার্ড হয়নি l কাজেই তার চিন্তার কোন কারণ নেই l শুধু কিছু পেপার ওয়ার্ক বাকি l
এদিকে মনিকার ধ্রুবর সঙ্গে দেখা হচ্ছেনা l সে হসপিটালে আর বাড়ি করে সময় কাটছে l ধ্রুবর এখন অত্যন্ত কাজের চাপ আছে তা সে জানে l অহেতুক ওকে বিরক্ত না করাই ভালো l মায়ের পিড়া পিড়ি দিন দিন বাড়ছে l ও নিজের শরীরের যত্ন তা ছাড়া পুষ্টিকর খাদ্য ভিটামিন ইত্যাদি নিচ্ছে l দুধ, ডিম, কলা, মাছ, মাংস সব ই খাচ্ছে l রেগুলার ব্যায়াম নিজে করছে এবং প্রেশার চেক আপ করাচ্ছে মা কে দিয়ে l
কোয়ার্টারলি রিপোর্ট জমা দিয়ে ধ্রুব সাত দিনের ছুটির জন্য দরখাস্ত করে জেনারেল ম্যানেজার এর কাছে l অফিসে ছুটির জন্য এই সময় বলা মানে বিপদ ডাকা l নতুন পদোন্নতি তার অপর অতো দায়িত্ব এড়িয়ে বাড়ি যেতে মন চায়না l কিন্তু মাকে অনেকদিন দেখেনি তাই সেই ব্যাপারটা ফেলে দিতে পারেনা l বিপাশার বিয়েটা উপলক্ষ মাত্র l কিন্তু কিন্তু করে ছুটি দরখাস্ত দেয় l
ডাক পড়ে বসের কাছে l বস রেকোমেণ্ড না করলে ছুটি অসম্ভব l বস বলেন কলকাতায় কোম্পানির কাজে সে যেতে পারে l পশ্চিম বঙ্গের চার জেলা বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদীয়া এবং হুগলী তে তাদের প্রোডাক্ট মার্কেটিং এর জন্য তাকে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ দের সঙ্গে মিটিং করে সেলস প্রোমোশন কতটা এগুচ্ছে এবং ডিমান্ড সাপ্লাই রেক পয়েন্ট অনুযায়ী সমীক্ষা করে কি কি অসুবিধে সুবিধে আছে তা কলকাতা রিজিওনাল অফিসে রিপোর্ট দিতে হবে l ওখানে মিঃ সান্যাল, কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার সব বুঝিয়ে দেবেন ওকে l ও হেড অফিস থেকে কদিনের জন্য ডেপুটেশনে যাচ্ছে মনে থাকে যেন সেই অনুযায়ী সমস্ত কাজ করতে হবে l সেটাই বাঞ্ছনীয় l আসা যাওয়ার প্লেনের টিকিট কোম্পানি থেকে কাল পেয়ে যাবে পরশু রওনা দেবে কলকাতা l যতটা সোজা ভাবছিল ততটা নয় l কোম্পানি ওকে দিয়ে মার্কেটিং এর কাজ ও করিয়ে নিচ্ছে ছুটি না দিয়ে l বলার কিছু উপায় নেই l ওখানে গিয়ে আবার চারটে জেলা গস্ত করতে হবে l সব রেক পয়েন্ট যেখানে ফার্টিলাইজার আসে কম্পানি থেকে মাল গাড়িতে সেগুলো তদারকি করতে হবে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভের সঙ্গে l ডিমান্ড সাপ্লাই এবং আরও কতো প্রয়োজন তার তথ্য দিতে হবে l সব রিপোর্ট ফ্যাক্স করে জানাতে হবে রিজিওনাল অফিস থেকে কোম্পানির হেড অফিসে l এক গাদা কাজ নিয়ে এসেছে l বিয়ে বাড়ি মাথায় উঠবে l
আজ মনিকার সঙ্গে তাদের বাড়িতে দেখা করবে l ও কলকাতা যাচ্ছে বলে তাকে জানিয়ে দিতে হবে নাহলে সে আবার চিন্তা করবে l মনিকার সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি l ওর বড়ই অভিমান l ধ্রুব কি করবে ওকে কম্পানিতে অনেক কাজ করতে হয় l সময় পায়না l
মনিকা বলে আজ সময় হল দেখা করার l মনে পড়লো আমাকে?
- সব দিন ই মনে পড়ে l আজ কি নতুন? উল্টে প্রশ্ন করে l
ধ্রুব আসবে বলে মনিকা রান্না করে রেখেছে l চল হাত পা ধুয়ে বসে পড় ডাইনিং টেবিলে l
- মা কোথায়?
- মায়ের আজ নাইট ডিউটি l
- ও তাহলে তুমি একা l
- হ্যাঁ
দুজনে খেতে শুরু করে l বাটার চিকেন টা মনিকা ভালোই রান্না করে l খেতে খেতে বলে তোমার বাড়ির নাম্বারটা দিয়ে যাও l
- নিশ্চই l এই নাও একটা কোম্পানির কার্ড তাতে ওর নাম কোম্পানির টেলিফোন নাম্বার আছে ঐ কার্ডে কলকাতার মানে মধ্যম গ্রামের বাড়ির নাম্বারটা হাতে লেখা সেটাই দিয়ে দেয় l এ ছাড়া ওদের মধ্যম গ্রামের বাড়ির ঠিকানা লিখে দেয় কার্ডের পেছনে ।
- মনিকা কার্কড টা ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় । ওদের বাড়ির ঠিকানা এবং টেলিফোন নাম্বার দেখে কার্ড টা নিজের কাছে রাখে । তারপর জিজ্ঞাসা করে কবে যাচ্ছ বাড়িতে ?
- আগামী কাল মর্নিং ফ্লাইটে যাবো l
- টিকিট হয়ে গিয়েছে l ওটা ওদের দায়িত্ব l
-ঠিক আছে আমায় ফোন করবে কিন্তু l আমি চিন্তায় থাকবো l
-জানি, চিন্তা আমার ও থাকবে l
- আমি কি এয়ার পোর্টে কাল যাবো তোমাকে সি অফ করতে l
-না না তোমাকে কষ্ট করতে হবে না l
- তোমার কি ডিউটি নেই l
- আছে, তবে তোমার ডিউটি টা আমার কাছে বেশি দরকারি l তাই আমি থাকবো এয়ারপোর্টে l
- ঠিক আছে তুমি যা ভালো বোঝ l
বাড়ি যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে রেখেছে l মায়ের জন্য এখানকার কিছু মসলা আনিয়েছিল এক কোম্পানির লোক কে দিয়ে l দারুচিনি, গোল মরিচ, লবঙ্গ ইত্যাদি l তা ছাড়া এখানকার কাজু খুব বিখ্যাত l সব নিয়ে সক্কাল বেলায় ট্যাক্সি নিয়ে এয়ার পোর্টে পৌঁছয় l ওখানে মনিকার সঙ্গে দেখা l
- মনিকা বারে বারে ধ্রুবকে বলে ফোন করবে কিন্তু l আমি চিন্তায় থাকবো l
- আমি ওখানে প্রচুর কাজ নিয়ে যাচ্ছি l ফোন করার সময় পেলে নিশ্চই করবো l চিন্তার কিছু নেই l তোমার স্মৃতি সব সময় আমার মনে জড়িয়ে আছে l তাকে কি ভুলতে পারি l
-আদিখ্যেতা কোর না l যা বলছি তাই করবে l রোজ রাতে ফোন করবে একবার l
- অতো টাকা কোথায় পাবো?
- আমি জানিনা l দ্যাট ইস নন অফ মাই কনসার্ন l
- ও কে l সিকিউরিটি চেকের জন্য এগিয়ে যায় l সময় হয়ে যাচ্ছে l পাসপোর্ট দেখিয়ে ঢুকে পড়ে l
মনিকাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল l হঠাৎ ধ্রুবর বাড়ি যাওয়াটা শুধু মাকে দেখতে না বিপাশাকে দেখতে ! মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন আসে l এই বিপাশা মেয়েটা কে? বিপাশার বিয়ের জন্য ওকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতে হচ্ছে কেন? না না ও কাজেই যাচ্ছে বলল l এতো সন্দেহ কেন মনিকার মনে l ও কি ধ্রুব কে অবিশ্বাস করে? ছিঃ ছিঃ ধ্রুবকে সন্দেহ করা পাপ l ওর মতন নিষ্পাপ সরল ছেলে এই যুগে পাওয়া মুস্কিলে l মনিকার ভাগ্য ভালো ও ধ্রুবর মতন জীবনসঙ্গী পাচ্ছে l দেখতে, পড়া শুনোয়, কাজে কম্মে সব দিক দিয়ে ওর মতন ছেলে হয়না l তবে এই সময়টা ওদের তাড়া তাড়ি বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ l তবে কি মনিকার মায়ের কথা সত্যি হতে পারে !
কি এইসব উল্টো পাল্টা তার মনে আসছে !
মনিকা এই সব ভাবতে ভাবতে হসপিটালে যায় l আজ তার মাথা ঘোরাচ্ছে কেন জানেনা l প্রেশার চেক করলো একটু হাই আছে l টেনশনে হচ্ছে l তবে এই সময় ওরকম একটু হয় l ও অন্যকে নানান ভাবে বোঝায় আর নিজের বেলায় এতো নার্ভাস কেন ! সব ই ধ্রুবর বাড়ি যাওয়া নিয়ে l ছেলেটা দু বছর পর বাড়ি যাচ্ছে l ওর বাড়ির প্রতিও তো একটা কর্তব্য আছে l কিন্তু ওর বাবা খুব অন্যরকম শুনেছি l দেখি কি হয়... মনে মনে ভাবে l
মনিকা ডিউটি সেরে সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফেরে । বাড়িতে ফিরে মায়ের প্রশ্ন বান.. মা সন্ধ্যের সময় থাকার কথা না l ওনার নাইট ডিউটি ছিল জানি l জানিনা উনি কেন ফিরে এলেন ! নিশ্চই আমার খোঁজে....
- কিরে ধ্রুব চলে গেল? তোকে ওদের বাড়ির ফোন নাম্বার দিয়েছে?
- গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয়.. হ্যাঁ দিয়েছে l
- কবে আসবে বলেছে !
- ও কে কোম্পানি কাজে পাঠিয়েছে কলকাতায় l তাই ফ্লাইটে গিয়েছে l
- ও ! তা তুই আর কি বললি?
- বললাম রোজ ফোন করতে l আমি রাতে অপেক্ষা করবো ওর ফোনের জন্য
- ও বলল সময় পেলে ফোন করবে l
- মানে সময় পাবে না কেন?
- বললাম তো ওকে কোম্পানি অনেক কাজ দিয়ে পাঠিয়েছে l. সেগুলো করতে ওকে নানা জায়গায় টুরে যেতে হবে l
- ও ! তা ভালো l ছেলেটা দায়িত্ব বান সুপুরুষ, সৎ চরিত্রের, মিষ্ট ভাসি, ভালো রোজগেরে l এই বয়েসেই দায়িত্বের চাকরি করছে, ভালো মাইনে পায় l সব দিক দিয়ে জামাই হিসেবে এক নম্বর l আমি এরকম ছেলে পেতাম না l দেখি কি হয় শেষ পর্যন্ত?
- কেন কি হবে আবার?
- তা আমি কি করে বলবো l ঈশ্বর জানেন l তাঁর ইচ্ছা l কি করে জানবো বল, !
রাত দশটা নাগাদ মনিকা ফোন করে ধ্রুবর বাড়িতে । এতক্ষণে ও নিশ্চই বাড়ি পৌঁছে মায়ের আদর খাচ্ছে । ছেলে আমার নন্দ দুলাল । ফোন বেজেই যাচ্ছে বেজেই যাচ্ছে কিন্তু কেউ তুলছেনা । সবাই শুয়ে পড়লো নাকি এতো তাড়া তাড়ি । হতেও পারে । তাই ফোন রেখে দেয় ।
এদিকে ধ্রুব মনিকাদের বাড়ি ফোন করতে চেষ্টা করে ওই সময় কিন্তু ফোন ডেড বলে মনে হয় । কোন শব্দ হয়না । আশ্চর্য লাগে । বাবাকে জিজ্ঞাসা করে ফোন ডেড কেন । উনি বলেন এখানে ওইরকম দিনের পর দিন ফোন ডেড থাকে কলকাতা টেলিফোনের কোন টেকনিশিয়ান আসেন না ফোন ঠিক করতে । তাই ফোন ডেড অবস্থায় কিছু করার থাকে না । ধ্রুবর এদিকে দিনের বেলায় মনিকাকে ফোন করার সময় হয় না । তবুও ভাবে কাল পি.সি.ও. থেকে মনিকাকে ফোন করবে । কিন্তু ও দিনের বেলায় ফোন করবে কি করে মনিকা তখন হস্পিটালে থাকে । ওখানকার নাম্বার ওর নেই ।
পরের দিন আবার মনিকা ফোন করতে চেষ্টা করে । একই সমস্যা । ফোন কিছুতেই ধরে না ।
এদিকে ধ্রুব একদম সময় পায়না মনিকা কে ফোন করতে । নানান কাজে ও ভুলে যায় ফোন করতে ।
রাতে ওই এক কাণ্ড । ফোন এখন ও ঠিক হয়নি । ধ্রুব ব্যস্ত হয় এই নাম্বার অফিসে দেওয়া আছে । যদি বস ওকে না পায় কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে । তখন ওকে বারো কৈফিয়ত দিতে হবে ।
মনিকা কিছুতেই ধ্রুবকে ফোনে না পেয়ে উদাস হয়ে পড়ে ।
মায়ের সর্বদা এক কথা ওকে ফোনে পেলি ?
কিন্তু মনিকা ভেঙ্গে পড়ার মেয়ে নয় । ও মনে মনে কোলকাতা যাওয়ার কথা চিন্তা করে । মা কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে তুমি একটু চুপ করবে আমাকে একটু একা থাকতে দেবে..... বলে ওর ঘরে চলে যায় l আজ পূর্ণিমা l আকাশে রুপোর থালার মতন চাঁদ উঠেছে l আজ ধ্রুবর কথা খুব মনে পড়ছে । ওদের মেলা মেশা হাঁসি ঠাট্টার কথা মনে করে চোখে জল আসছে । তবে কি মায়ের কথা ঠিক হবে
…… আবার ভাবে না তার ধ্রুবর কোন অসুবিধে হয়েছে নিশ্চই । হয়তো কাজে খুব আটকে গিয়েছে বাড়িতে ফেরে নি ।
মনটা বিষণ্ণ লাগছে অথচ এই সময় মন ভালো রাখা উচিৎ l
হঠাৎ কিছু গানের কলি মাথায় এলো.. মনিকা গুন গুণ করে গাইতে থাকলো সেই পুরনো সুরে......
কথা ও সুর :-
© অভীক চক্রবর্তীর
ফেলে আসা স্মৃতি আমায়
শুধুই যে কাঁদায়
ফেলে আসা স্মৃতি আমায়
শুধুই যে কাঁদায়
ফেলে আসা স্মৃতি আমায়
আনমনা এ মনে
শুধুই তোমার আসা যাওয়া 2
আমি আজ দিশেহারা
আজ ও সে রাত আছে
আজ ও সে চাঁদ ও আছে
শুধু তুমি নেই আজ কাছে
ফেলে আসা স্মৃতি আমায়
শুধুই যে কাঁদায়
বেঁধে ছিলাম ঘর আমি
চোরা বালির চরে
তাই বেদনার বালুচরে
কেন তুমি ঝড়ের রাতে
একা ফেলে দিয়ে গেলে আমাকে
ডুবে যাবো আমি আজ সাগরে
ফেলে আসা স্মৃতি আমায়
শুধুই যে কাঁদায়।
কথা ও সুর...
© অভীক চক্রবর্তী
8th may 2020
@avik chokroborty
No comments:
Post a Comment