Wednesday, December 25, 2019

পিঞ্জরে অচিন পাখি
___________________
অন্তরা ঘোষ। পর্ব -- ৩

চার পাঁচ দিন হয়ে গেল দীপ্তদের এখানে আসা। এই চার পাঁচ দিনে সেই মেয়েটিকে দীপ্ত আর দেখেনি। হয়তো বাড়ির কাজে ব্যস্ত আছে। কিন্তু সব সময় তার ওই গভীর বেদনাবিধুর চোখদুটো দীপ্ত'র মনে পড়ে।‌ মনে হয় কোথায় যেন একটা ব্যথা লুকিয়ে আছে ওই দুটো চোখের মধ্যে।
দীপ্তরা যখন ঘর অগোছালো করে গ্রামে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে , ফিরে এসে দেখেছে পরিপাটি করে তাদের ঘর , বিছানা গোছানো। সায়নরা বলাবলি করছে যে চাচীজি অর্থাৎ সন্তুর মা ওদের কত খেয়াল রাখছে ..ঘরটাও গুছিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু দীপ্ত অনুভব করতে পারে প্রতিটি জিনিসেই যেন অন্য কোন একজনের একটা পরম যত্নের হাতের ছোঁয়া রয়েছে।
দীপ্ত ভাবে আর এক আশ্চর্য মহিলার কথা -- হ্যাঁ , সন্তুর মা। মুখে খুব কম কথা বলেন।
হয়তো ভাষার সমস্যা , এমনও হতে পারে।
ঘোমটা টেনে ভদ্রমহিলা সারাদিন রান্না ঘরের মাটিতে পাতা উনুনে কাঠে ,‌ নলের মধ্যে ফুঁ দিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে ওদের জন্য রান্না করে চলেছে। তারপর আবার আছে সন্তুর বাবার আধঘন্টা অন্তর চায়ের ফরমাশ ! এতোটুকু বিরক্তি নেই ভদ্রমহিলার ! হাসিমুখে আপ্যায়ন করে চলেছেন সবার !
আজ সন্তু দীপ্তদের নিয়ে ক্ষেত দেখাতে নিয়ে বের হল। গ্রামে প্রচুর জমিজমা সন্তুদের। কোনো জমিতে শুধুই আখ লাগানো , কোনটায় শুধুই মকাই অথবা ধান কিংবা সরষে , আবার কোনো কোনোটায় মুলো , আলু‌ ওলকপি , শালগম , কোনটায় সবুজ টমেটো কোনটায় বেগুন অথবা কপি । সন্তুর মা এই ক্ষেতের সবজিগুলো দিয়ে অতি সাধারন ভাবে যা রান্না করেন তাই যেন অমৃত মনে হয় ! কাঁচা টমেটো মেথির শাক আর শালগম দিয়ে একটা সবজি রান্না করেন চাচীজি যেটা দীপ্তদের দারুণ লেগেছে।
ধানের ক্ষেত আর সরষে‌‌ ক্ষেত‌ ছড়িয়ে রয়েছে বিঘার পর বিঘা ! যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ, কোথাও কোথাও সবুজের মাঝে হলুদ চাদর বিছানো সরষে ক্ষেত। দীপ্ত ভাবে ক্ষেতে এত মানুষ কাজ করছে সন্তুর বাবার তদারকিতে..অথচ ঘরে সন্তুর মা সারাদিন পরিশ্রম করছেন, ওনাকে সাহায্যের জন্য কিন্তু কোন কাজের লোক রাখেনি সন্তুর বাবা ! কি আশ্চর্য রে বাবা !
ওরা চার বন্ধু আনমনে ক্ষেত দেখতে দেখতে চলছিল। হঠাৎ একটা ইয়া লম্বা চওড়া মুসকো মতন গোঁফওলা লোক -- গা দিয়ে তার যেন তেল গড়াচ্ছে, কানের লতি বেয়েও তেল পড়ছে, তেল চুকচুকে ন্যাড়া মাথা, পিছনে ইয়া বড় টিকি.. সন্তুর সামনে এসে বলল ,
"পায়ে লাগু ঠাকুর"
সন্তু হাসতে হাসতে দীপ্তদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল.. "এ হচ্ছে তান্তীয়া .. পেশায় ডাকাত..
দূর-দূরান্তের শহরে গিয়ে মাঝে মাঝে ডাকাতি করে গ্রামে ফিরে আসে। একটা ছোটখাটো ডাকাতের দলও আছে ওর।
বাংলাটা একেবারেই বোঝেনা তান্তীয়া। শুধু দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।
দীপ্তরা এই প্রথম চাক্ষুষ কোনো ডাকাত দেখল। সকলেই বেশ উত্তেজিত। সন্তু বলল, কিরে যাবি নাকি তান্তীয়ার ঘরে ?এইতো‌ কাছেই -
সকলেই এক পায়ে যেতে রাজি।
সন্তু বলল , " তানতীয়া মেরা দোস্ত লোক তুমহারা ঘর দেখনা চাহতে হ্যায়।"
তান্তীয়া বলল , ক্যয়া দেখোগে ঠাকুর.. গরিবখানা'মে হ্যায় হি ক্যায়া ?
"আচ্ছা চলো ফির"।
তান্তীয়া এগিয়ে চলল‌।
দীপ্তরা পাঁচমিনিটে তান্তীয়ার ঘরে পৌঁছে গেল। মাটির বাড়ি। একেবারেই সাদাসিধে। ‌ কিন্তু ঘরের দেওয়ালে চারটে ছোট বড় বন্দুক ঝুলছে।
দীপ্ত জিজ্ঞেস করল, ইয়ে সব বন্দুক সে লোগো কো মারতে হো ক্যায়া?
তান্তীয়া বলল ,হা হুজুর মারনা তো পড়তাই হ্যায় কভি ক‌ভি ।
অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, মানুষ খুন করেছো ?
তান্তীয়ার অকপট স্বীকারোক্তি ,
."হা হুজুর ওতো থোড়া বহুত কিয়াহি হ্যায়..
দীপ্ত জিজ্ঞেস করল, কব সে ডাকাইতি করতে হো.. ? "
তান্তীয়ার বেশ গর্বের সাথে ঝটপট উত্তর, ":বহত ছোটা সে ঠাকুর ..ইয়ে তো হামারা খানদানি বিজনেস হ্যায়.. মেরা দাদা পরদাদা ভি এইহি কাম করতে থে।"
দীপ্ত ক্যামেরা বার করে তান্তীয়ার কয়েকটা ছবি তুলতে চাইল । তান্তীয়া হৈ হৈ করে ক্যামেরা চেপে ধরল --
" নেহি হুজুর , তসবির না উঠাইয়ে "
তান্তীয়ার গলায় করুন মিনতি‌।
সন্তুও চোখের ইশারায় দীপ্তকে মানা করল‌।
এটা বোধহয় ডাকাতদের একটা সিক্রেসীর ব্যাপার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দীপ্ত ক্যামেরা নামিয়ে রাখলো।
এরপর আর কদিন ওরা তান্তীয়াকে দেখতে পায়নি।
সন্তু বলল, বোধ হয় ওর দলের সাথে অন্য কোন জায়গায় ডাকাতি করতে গেছে। কারণ নিজের গ্রামে কখনো ডাকাতি করে না তান্তীয়া ।
নিজের গ্রামের কারো কোন ক্ষতি করা তো দূরের কথা ‌-- বরং দরকারে অদরকারে ‌তান্তীয়া গ্রামের প্রচুর মানুষের উপকার করে থাকে। বিয়ে থা করেনি -- একা মানুষ এই তান্তীয়া।
ডাকাত হলেও ওর ভেতরে যেন আর একটা সহজ সরল মানুষ লুকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আলাপ হওয়ার পরই এটা বেশ বুঝতে পারল দীপ্তরা।
দীপ্তরা কলকাতায় ফিরে যাবার কিছুদিন পর সন্তুর কাছে শুনেছিল যে তান্তীয়াকে নাকি ওর বিরুদ্ধ পার্টির ডাকাতরা খুন করে ধড় মুন্ডু আলাদা করে কেটে‌ গ্রামের ঝিলের জলে ভাসিয়ে দিয়ে‌ গিয়েছিল।
সেদিন রাতে দীপ্তরা গোবি আলুর তরকারি, গরম গরম উনুনে সেঁকা মকাইয়ের রুটি আর ঘন‌ অড়হ‌র ডাল পরম তৃপ্তির সাথে খাচ্ছিল ডিনারে। দীপ্তর খাওয়া হয়ে গেছিল। সিগারেট ধরিয়ে ছাদে সুখটান দিতে গেল দীপ্ত। সেদিন ছিল জ্যোৎস্না রাত। ছাদে এসেই কার্নিশের এক কোনায় দীপ্তর চোখ আটকে গেল। সেই সাদা শাড়ি পরা রহস্যময়ী নারী ! মাথায় ঘোমটা নেই। জোছনার আলো স্নান করিয়ে দিচ্ছি মেয়েটার সর্বাঙ্গে। নিশ্চল চিত্রাপিতের মত দাঁড়িয়ে মেয়েটা দূরে অন্ধকার ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দীপ্ত একটু দূরে অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে‌ , তাই মেয়েটা ওকে দেখতে পায়নি। ভালো করে মেয়েটাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল দীপ্তর মত ছেলেও। গমের মতো গায়ের রং, ছিপছিপে তন্বী,এত চিকন ত্বক যে মাছিও বসতে গেলে বোধহয় পিছলে পড়ে যাবে‌! বছর কুড়ি বাইশ বছর বয়স হবে বোধহয় মেয়েটার। এক ঢাল কালো মিশমিশে মেঘের মতো চুল পিঠের উপর, বাঁশির মতো টিকালো নাক, ছোট্ট কপাল, টানা টানা ভুরু যেন তুলি দিয়ে আঁকা, বড় বড় গভীর কালো চোখ, গোলাপি অধরের কোনে যেন এক চিলতে অভিমান আর বিষাদ লুকিয়ে আছে। এত সুন্দর মুখ অথচ কি করুন। দীপ্ত ভাবল, সত্যি ভগবান কি যত্ন করে সময় নিয়ে মেয়েটাকে বানিয়েছে।
এমন সময় অনেকগুলো পায়ের আওয়াজে মেয়েটা হতচকিত হয়ে উঠল। ঘুরে দাঁড়াতেই দীপ্তর চোখে চোখ পড়ল। কয়েকটা মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল দীপ্তর দিকে। তারপর হঠাৎ মাথায় ঘোমটা টেনে ছুটে চলে গেল ছাদের অন্য দিকের দরজা দিয়ে ঘরের ভিতরে।
সায়ন অনিরুদ্ধ সন্তু ততক্ষণে ছাদে এসে গেছে। সায়ন এসেই ট্রানজিস্টারে রেডিও লক্ষ্নৌ ধরল।
বিনাকা গীতমালা শুধুই বুধবার হয় তাই আজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্য গান ধরার চেষ্টা করতে লাগল সায়ন।
দীপ্তর খুব প্রিয় একটা গান রেডিওতে বাজছে "ইয়ে দিল তুম বিন কাহি লাগতা নেহি হয় হম কেয়া করে"
দীপ্ত তখনো অন্যমনস্কভাবে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে ঠিক যেখানে মেয়েটা দাড়িয়ে ছিল। সায়ন অনিরুদ্ধ ডাকছে , কিন্তু দীপ্তর ভ্রুক্ষেপ নেই।
সন্তু এসে দীপ্তর পিঠ চাপড়ে বলল,
"কা হুয়া রে , ইতনা খোয়ি খোয়ি কিঁউ হো " ?
দীপ্ত ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্তুর চোখে চোখ রেখে বলল, ওই সাদা শাড়ি পরা মেয়েটা 'কে 'রে সন্তু " ?
সন্তু গম্ভীর হয়ে গেল। সায়নদের দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা রেডিওতে গান শুনতে ব্যস্ত ছদের অন্য কোণে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে সন্তু বলল,
"শুনতে চাস ? বেশ তাহলে শোন.. তবে না শুনলেই ভালো করতিস.. কষ্ট পাবি শুনলে "
দীপ্ত অবিচল দৃষ্টিতে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললো, তুই বল .. কষ্ট হলেও আমি শুনতে চাই..!
অন্তরা ঘোষ।
২৩.১২.১১
চিত্রঋণ : ইন্টারনেট
( চলবে)
আগের পর্বগুলির লিংক

No comments:

Post a Comment