Wednesday, December 25, 2019

পিঞ্জরে অচিন পাখি
___________________
 অন্তরা ঘোষ ।
পর্ব - ১
আমার এই গল্পের ইমারত পুরোটাই কল্পনার ইট কাঠ পাথর দিয়ে তৈরি হয়নি। আমার এক প্রিয় মানুষের কাছে শোনা তার জীবনের একটা অধ্যায় নিয়ে এই গল্প। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারন গল্প.. তবুও যেন কোথাও অন্তর্নিহিত চাপা অনুভূতি গল্পটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
আমার গল্পের সময়কাল ১৯৭০ /৭১ সাল হবে।
চার বন্ধু দীপ্ত অনিরুদ্ধ সায়ন আর সন্তু আশুতোষ কলেজের ছাত্র। দীপ্ত অভিজাত পরিবারের ছেলে। লম্বা ফর্সা দোহারা চেহারা.. এক মাথা চুল.. মুখের মধ্যে চোখ দুটো খুব ইম্প্রেসিভ.. যেন কারো দিকে তাকালেই তার মনের ডাইরি পড়ে নিতে পারে। চেহারার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব আছে। কলেজের অনেক মেয়েই দীপ্ত বলতে পাগল.. কিন্তু দীপ্তর ব্যক্তিত্বকে টপকে তার কাছে পৌছাবার সাহস করে না। দীপ্তরও যেন ওসব ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্ট নেই ।
মোটামুটি ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে দীপ্ত ।‌ বক্তৃতাটা‌ও বেশ ভালই দেয়‌ । কলেজে‌ তাই দীপ্তকে প্রায় সবাই এক ডাকে চেনে । ছাত্র-ছাত্রী থেকে প্রফেসর সবাই।
সাদামাটা চেহারার অনিরুদ্ধ খুব মিশুকে ছেলে। ইন্টার কলেজ ক্রিকেট কম্পিটিশনে অনিরুদ্ধ একেবারে অপরিহার্য খেলোয়াড় । বন্ধুমহলেও‌ খুব জনপ্রিয়। সায়ন সাংস্কৃতিক জগতের সাথে যুক্ত। খুব ভালো গান করে। বিভিন্ন গানের প্রোগ্রামে যায়। এছাড়াও কলেজ সোশ্যালেও অনিরুদ্ধের গান শোনার জন্য বন্ধুবান্ধবদের ভিড় লেগেই থাকে।‌
প্রায় ৬ ফুট হাইটের সন্তুর‌ ভালো নাম সন্তোষ আওয়াস্থি । সন্তু কিন্তু অবাঙালি। ছোট থেকেই কলকাতা মামার বাড়িতে থাকার জন্য বাংলাটা ভালোই জানে। সন্তু উত্তরপ্রদেশের গোঁড়া‌‌ ব্রাহ্মণ‌ পরিবারের ছেলে। উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে সন্তু । গ্রামের নামটিও বেশ মিষ্টি -- 'আশাখেরা' ।
সন্তু কলেজে পড়াশোনা করা ছাড়াও মামার ডাবরের শোরুমে নিয়মিত বসে কলেজ থেকে ফিরে এসে। ডাবরের বিশাল শোরুমে বসার জন্য মামার কাছ থেকে বেশ মোটা অংকের একটা হাত খরচও পায়।‌ দীপ্তরাও মাঝে মাঝে কলেজ ফেরত অনেক রাত অবধি সেখানে গিয়ে আড্ডা মারে ‌।
সামনে গরমের ছুটি আসছে। চার বন্ধুর মধ্যে একটা কমন ভালো লাগার বিষয় ছিল চারজনেই খুব ঘুরতে ভালোবাসে। সায়ন বলল , অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি, চল , কোথাও ঘুরে আসি কয়েকটা দিন।
অনিরুদ্ধ ও সন্তু ঘোরার নামে উৎসাহিত হয়ে দিল্লি আগ্রা সিমলা মুসৌরি উটি ইত্যাদি অনেক জায়গার নাম বলে ফেলল‌ এক নিঃশ্বাসে।
সায়ন বলল, দীপ্ত তুই কোনো একটা জায়গার সাজেশন দে না ‌গুরু যেখানে কটা দিন ঘুরে আসা যায়।
দীপ্ত বলল, আমার মাথায় একটা জায়গায় যাওয়ার নাম ঘুরছে। তবে তোরা রাজি হবি কিনা জানিনা। কেননা তোরা দিল্লী বোম্বে গোয়া এসব অনেক বড় বড় জায়গার নাম বলছিস। এটা একটা অখ্যাত জায়গা। তবে আমার ধারণা আমরা খুব আনন্দ পাব সেখানে গেলে।
তিনজনই উদগ্রীব হয়ে দীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল , কোন জায়গায় যাওয়ার কথা বলছিস রে।
দীপ্ত বলল, সন্তুদের গ্রাম আশাখেরা।
আমি এমনিতেই গ্রাম দেখতে ভালোবাসি। তোরা না গেলে আমি হয়তো একাই চলে যেতাম কোন একদিন সন্তুর সাথে। আর সন্তুর মুখে মাঝেমাঝেই ওদের গ্রামের যা কথা শুনি তাতে আমি নিশ্চিত ওই গ্রামে গেলে খুব আনন্দে কাটাবো কয়েকটা দিন। এবার বল তোদের মতামত।
সায়ন নিরস কন্ঠে বলল ,শেষে কিনা গ্রামে.. !
সায়নকে থামিয়ে দিয়ে সন্তু আনন্দে বলে উঠল, তোরা যাবি আমাদের গ্রামে ?
খুব মজা হবে। আমি বাবুজিকে আজকেই খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করব তাহলে। দীপ্ত হচ্ছে ওদের মধ্যে একটু বেশি ম্যাচিওর্ড । বন্ধুরাও‌ তাই মাঝেমধ্যে ওকে গুরু বলে।‌ গুরুর‌ ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাই কেউ আর বিশেষ কিছু কথা বলল না।বাকি দুজনও রাজি হয়ে গেল।
কয়েকদিনের মধ্যে সন্তুর বাড়িতে খবর পাঠানো ও ট্রেনের টিকিটও কাটা হয়ে গেল। মোটামুটি এক মাসের জন্য মানে পুরো গরমের ছুটিটা কাটাতে যাচ্ছে ওরা সন্তুর গ্রামের বাড়িতে।
নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যেবেলায় চারজন একটা করে সাইড ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাওড়া থেকে উঠে‌ পড়ল কালকা মেলে ।
দীপ্তর ফটো তোলার শখ খুব। তাই তার আগফা ক্যামেরাটা নিতে ভোলেনি। পরের গোটা দিন রাতটাও কাটল ট্রেনে।‌ পারপরের দিন সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ ওরা পৌঁছালো কানপুরে‌‌ । কানপুরে নেমে ওরা বাস ধরল সন্তুদের গ্রামে যাবার জন্য। হাইওয়ে ধরে ‌বাস চলল বেশ কিছুক্ষণ । তা প্রায় ঘন্টা দেড়েক এর পথ ।
গ্রামের বাসস্টপগুলো থেকে যত লোক নামে তার চেয়ে বেশি লোক ওঠে। বাসের মাথায়ও তিল ধারণের জায়গা নেই ! শুধু মানুষ নয় তাদের সঙ্গে রয়েছে মুরগির ঝুড়ি , সবজির বস্তা , বান্ডিল বান্ডিল খৈনির পাতা, এমনকি ছোট ছোট ছাগলছানা নিয়েও উঠে পড়েছে কয়েকজন।
শেষ পর্যন্ত বাস এসে দাঁড়ালো আশাখেরা গ্রামের স্টপেজে‌ । এবার কিছুটা রাস্তা হেটে গ্রামে ঢুকতে হবে। ছোট্ট বাস স্টপেজ। সামনে একটা টালি দর্মা দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। চার বন্ধু ঠিক করল চা খাবে। সামনে খাটিয়া পাতা। চারজনে গিয়ে বসে চায়ের অর্ডার দিল। হঠাৎ সামনের খাটিয়াতে চোখ পড়তেই সন্তু ছাড়া বাকি তিনজনের চোখ গোল গোল হয়ে গেল। খাটিয়াতে একটা ইয়া মোটা বিশাল ভুঁড়িওয়ালা ধুতি ফতুয়া পরা লোক শুয়ে রীতিমত নাক ডাকছে। মুখ হাঁ করে নাক ডাকছে আবার মুখ বন্ধ করে ফুউউউস্ শব্দ করছে। লোকটার মুখে মাছি ভর্তি। নাক ডাকার সাথে সাথে ভুড়িটাও একবার চুপসে যাচ্ছে একবার ফুলে উঠছে। বেশ কিছু মাছি নিশ্বাস নেওয়ার সময় নাক মুখের ভেতরে ঢুকে‌‌ যাচ্ছে .. আবার প্রশ্বাসের সাথে সাথে বেরিয়ে আসছে। লোকটার কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সন্তু এসব দেখতে অভ্যস্ত। বাকি তিনজন হা করে খানিকক্ষণ দেখে হেসে উঠল। দীপ্ত ক্যামেরা বার করে ফটো তুলতে‌ তুলতে বলল , ব্যাটা একেবারে কুম্ভকর্ণের বাচ্চা !
চা পর্ব শেষ । এবার আলপথ ধরে গ্রামে ঢোকার পালা।
আলপথ ধরে ওরা হাঁটতে লাগল। দু'ধারে ধানের ক্ষেত, কোথাও মাঠের পর মাঠ হলুদ শর্ষের ক্ষেত। কোথাও বা আখের ক্ষেত । ইট কাঠ কংক্রিটের শহরের মানুষ দীপ্তদের এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। শহরের নাগরিক সভ্যতা আজ বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে যেন ওরা।আধুনিক প্রযুক্তির সমস্ত সংযোগগুলি হঠাৎ করেই কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে !
হঠাৎ সায়ন চেঁচিয়ে উঠল, ওই দেখ ময়ূর। সকলে দেখল দূরের মাঠে বেশ কয়েকটা ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে । কী যেন খুঁটে খুঁটে ‌খাচ্ছে ক্ষেতের ধার থেকে । সন্তু বলল এখানে অনেক ময়ূর আছে। এখন প্রায়ই ওরা ময়ূর দেখতে পাবে। অনিরুদ্ধ বলল, না দীপ্ত তোর এখানে আসার আইডিয়াটা দেখছি ভালই ছিল। মনে হচ্ছে ছুটিটা জমে যাবে। কথা বলতে বলতে দশমিনিটের মধ্যেই ওরা সন্তুদের বাড়ি পৌঁছে গেল। সামনেটা মাটির বাড়ি, টালির চাল ,‌ সামনে বেশ বড় একটা উঠোন। উঠোন পেরিয়ে মাটির বাড়ি । ঠিক লাগোয়া পেছনেই কিন্তু দোতলা পাকা বাড়ি।
সন্তুর বাবা , ছোট ভাই মন্নো এসে ওদের ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। মন্নোর বয়স বড়জোর বারো কি তেরো হবে ।সন্তুর মা এক গলা ঘোমটা দিয়ে , থালাতে বেশ কিছু বাড়িতে তৈরি ক্ষীরের মিষ্টি , নিমকি আর গজা ‌নিয়ে মন্নোর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিল। জম্পেশ খিদে পেয়েছিল দীপ্তদের। মিষ্টিগুলো সাঁটিয়ে দিতে চারজনের বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। দীপ্তরা জল খেতে চাইলে সন্তু ওদের নিয়ে উঠোনের মাঝখানে কুয়ো তলাতে এল। সন্তুর ছোট ভাই মন্নো ঝপাং করে বালতি ডুবিয়ে পাতকুয়ো থেকে জল তুলল। দীপ্তরা দেখল বালতিতে দুটো ব্যাঙ লাফাচ্ছে !
সন্তুর ভাই ব্যাঙ দুটোকে ধরে আবার পাতকুয়োতে ফেলে দিল। তারপর কাঁসার গ্লাস ওই বালতিতে ডুবিয়ে ওদের জল দিল।
ইসস্ , এই জল কি খেতে হবে নাকি! সন্তুর দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে দীপ্ত বলল।‌‌ সায়নেরও গা শির শির করে উঠল। সন্তু বলল, আবে শালা এ গন্দা পানি নেহি রে‌ ! মেহডকে্র (ব্যাঙ) এর ইউরিন নাকি জলকে সাংঘাতিক পরিশুদ্ধ করে।
দীপ্তরা এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।‌ শেষে অনিরুদ্ধ বলল ,নাক চোখ বুজে খেয়ে নে দীপ্ত। এক মাস আমাদের এই জল খেয়েই কাটাতে হবে ! গা ঘিন ঘিন করা সত্বেও নাক চোখ বুজে ওরা ওই জলই খেলো।
দীপ্তর হঠাৎ চোখ পড়ল দোতলার একটা জানলার দিকে। দুটো বড় বড় গভীর কাজল কালো চোখ যেন ওদেরই দেখছে। সাদা শাড়ি পরা অল্প বয়সী একটা মেয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে। দীপ্তর চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটা জানালা থেকে সড়াৎ করে সরে গেল।
দীপ্ত সন্তুকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সন্তুর বাবা এসে দীপ্তদের স্নান করার জন্য তাড়া দিলেন। পাতকুয়োর সামনেই একটা দর্মার বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গা। সন্তু জানালো কুয়ো তলাতেই স্নান করতে হবে। দীপ্তদের বাথরুমে চান করা অভ্যেস। কিন্তু এখানে ওইরকম বাথরুমের কোন ব্যবস্থাই নেই । অবশ্য মন্দ লাগছিল না ওদের এই পরিবেশে। রোজকার জীবন থেকে সবকিছুই একটু আলাদা । নাগরিক সভ্যতা থেকে যেন অনেক দূরের একটা নতুন জগৎ ! ‌এখানে সব হিসাব হয়তো মিলবে না ।
দীপ্তরা দোতলার একটা ঘরে গিয়ে নিজেদের ব্যাগপত্র রেখে গামছা নিয়ে পাতকুয়োতে এল স্নান করতে।‌‌ সায়ন যেই এক বালতি জল গায়ে ঢেলেছে অমনি লাফিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো... 'বালতির মধ্যে ব্যাঙ' !
সন্তুর ভাইয়ের বেশ মজা লাগছিল দীপ্তদের ব্যাঙকে ভয় পেতে দেখে।
ফোকলা দাঁতে ফিক ফিক করে হাসতে লাগলো মন্নো‌।
স্নান করে জামা কাপড় পরে ওরা নীচর‌ ঘরে এলো। নিকোনো মাটির মেঝের উপর আসন পাতা। প্রত্যেকের আসনের সামনে একটা করে ডেস্ক এর মত রাখা। সন্তুর বাবা আর ভাইও এক সঙ্গেই খেতে বসেছে। সন্তুর মা এক গলা ঘোমটা দিয়ে পরিবেশন করছেন। আয়োজন খুব সামান্য। আন্তরিকতা কিন্তু অনেকটাই বেশি।
সন্তুরা নিরামিষাশী। ঝকঝকে পিতলের থালায় ভাত ডাল আলু ভাজা , একটা তেতোর তরকারি, একটা আলু বেগুন ওলকপির তরকারি আর আচার । সব শেষে টক দই ‌
সন্তুর বাবা মানুষটা কিন্তু বেশ মিশুকে। ছোটখাটো হাট্টাকাট্টা চেহারা। কাঁচাপাকা কদম ছাট চুল। পরনে ধুতি ফতুয়া , মাথার শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট টিকি। দীপ্তদের বললেন, গরীবখানা মে থোড়াসা তকলিফ তো জরুর হোগা বেটা ‌। আচ্ছে সে খাও তুম লোগ। শরমাও নেহি‌ । ইয়ে আপনাই ঘর সামঝো বেটা ।
"আরে ইয়ে‌ সন্তু কি মা ,। মেহমান লোগো কো আচ্ছে সে খাতিদারি করো। পুছো আউর‌ কেয়া‌ লাগেগা ‌‌ --- ইয়া নেহি --
বিরাট এক ডাক ছেড়ে সন্তুর মাকে কাছে ডেকে নিল চাচাজি।
বেচারী যেন কলের পুতুল !
বলা বাহুল্য সেই অবগুণ্ঠিত নারী কলের পুতুলের মত মাথা নাড়তে নাড়তে ইশারায় আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা করছিল ।
হয়তো বা বলতে চাইছিল আমাদের আর কিছু লাগবে কিনা !
কিন্তু মুখে টু শব্দটি নেই ! সবকিছুই ইশারায় !
সুদূর উত্তরপ্রদেশের এই প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলাটি জীবনে হয়তো চাক্ষুষ কোনদিন এতগুলো শহরের ছেলেকে একসাথে কোনদিন ‌দেখেইনি !
রান্নাঘর থেকে সন্তুর মা কিছু আনতে গেলেন।
হঠাৎ দীপ্তর শ্বাসনালীতে কিভাবে যেন খাবার আটকে কাশি শুরু হল। সন্তুর বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকতে লাগলেন সন্তুর মাকে। কাশির দমকে যখন দীপ্ত জেরবার হঠাৎ দেখল ওর সামনে জলের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে একটা ফর্সা ধবধবে নিরাবরণ হাত। দীপ্ত মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল -- সেই সাদা শাড়ি পরা কাজল নয়না রহস্যময়ী নারী !
অন্তরা ঘোষ ।
২১.১২.১৯.
( চলবে)
পর্ব ২ এর লিঙ্ক

পিঞ্জরে অচিন পাখি
___________________
অন্তরা ঘোষ। পর্ব- ২
দীপ্ত গ্লাসটা হাতে নিয়ে বোধহয় ধন্যবাদ দিতে গিয়েছিল ...
কিন্তু কিছু বলার আগেই সেই রহস্যময়ী নারী ত্রস্ত হরিনীর মতো উঠোন পেরিয়ে ঘরের দিকে চলে গেল। মাথায় ঘোমটা থাকায় তার মুখটাও দেখতে পেল না দীপ্ত। হঠাৎ সন্তুর বাবার দিকে চোখ পড়ায় দীপ্ত লক্ষ্য করল সহজ সরল অমায়িক মানুষটার চোখের চাউনি কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে সন্তুর মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আরে এ সন্তু কি মা ...
ইধার আও তো জারা --
দেখো মেহমান লোগো কো কেয়া চাহিয়ে.. মুঝে ভি থোড়া সবজি দো‌"
সন্তুর মা সবজি নিয়ে যখন ওর বাবাকে দিচ্ছে তখন ওর বাবা ফিস ফিস গলায় বলল, বিটিয়া কো সামালকে রাখো.. মেহেমান কা সামনে না আয়ে তো আচ্ছা .."
সন্তুর মা কলের পুতুলের মত মাথা নাড়লো।
দীপ্ত'র চোখ খেতে খেতে বারবার অজান্তেই চলে যাচ্ছে উঠোন পেরিয়ে ঘর গুলোর দিকে।
খেয়ে উঠে ওরা চারজনেই ওদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা ঘরে এল। সায়ন, অনিরুদ্ধ, সন্তু খাটিয়ায় বডি ফেলে দিল। দীপ্ত আনমনে সিগারেট খেতে খেতে ভাবতে লাগল কিছুক্ষন আগের দেখা মেয়েটির কথা।
বিকেলে চারজনে গ্রামে ঘুরতে বেরলো। গ্রামের মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে দেখল , এখানেপাকা বাড়ি কদাচিৎ। বেশিরভাগই মাটির বাড়ি। টালি বা খড়ের চাল‌।প্রত্যেকের বাড়ির সামনেই গরু বাঁধা আছে। সন্তুদের ঘরেও দীপ্তরা দেখেছে চারটে হৃষ্টপুষ্ট গরু গোয়ালে রাখা।
কিছুটা যেতেই দীপ্তরা টের পেল গ্রামে সন্তুদের বেশ সম্মান আছে। উচ্চ বংশীয় ব্রাহ্মণ বলে আলাদা কদর। কেননা গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবার খুব একটা বেশি নেই। রাস্তা দিয়ে ছোট-বড় যেই যাচ্ছে পিঠটাকে ধনুকের মতো বেঁকিয়ে একটু ঝুঁকে সন্তুকে বলছে "পায়ে লাগু ঠাকুর"। সন্তুও গম্ভীর মুখে জবাব দিচ্ছে, "জিতে রহো"।
সন্তুর সাথে সাথে দীপ্তদেরও সকলে বলছে 'পায়ে লাগু'। কত সহজ সরল মানুষ এরা।ব্যাপারটা দীপ্তরা বেশ উপভোগ করছে। অনিরুদ্ধ বলে উঠলো, এখানে তো তোদের দারুন সম্মান 'রে সন্তু ! "
সন্তু বলল, হ্যাঁরে গ্রামের লোকেরা বাবাকে খুব সম্মান করে।
কথা বলতে বলতে ওরা গ্রামের শেষে -- মাঠের দিকে চলে এসেছিল। কত ময়ূর মাঠে ঘুরছে খেলছে , পেখম তুলে নাচছে, মাঝে মাঝে কি যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। এতদিন দীপ্তরা চিড়িয়াখানায় ময়ূর দেখেছিল। দীপ্তর মনে হত খাঁচায় বন্দি প্রাণীরা কেমন যেন উদাস.. ভিতর ভিতর ছটফট করে মুক্তির জন্য। এখানে ময়ূর গুলোকে দেখে মনে হল কত অনাবিল আনন্দে আছে ওরা.. স্বাধীনতার আনন্দ , শৃংখল মুক্তির আনন্দ.. সত্যিই বন্যেরা প্রকৃতিতেই সুন্দর।
সন্ধ্যে নামতেই দীপ্তরা লক্ষ্য করল গোটা গ্রামটা যেন অন্ধকারে ডুবে গেল। সন্তুদের ঘরেও কোনো আলো জ্বলছে না। সন্তুকে জিজ্ঞেস করে ওরা জানতে পারল যে এই গ্রামে এখনও ইলেকট্রিসিটি পৌঁছয়নি। অবাক হল ওরা !
সত্যি গ্রামের লোকেরা কত দিক থেকেই বঞ্চিত !
সব ঘরে সন্তুর বাবা লন্ঠন ও বড় বড় হ্যাজাক জ্বালিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যেবেলা সন্তুর মা বড় কাসার খালাতে পাঁচ কাপ গরম দুধের চা আর পিয়াজি নিয়ে এল সন্তুর বাবা ও সন্তুদের জন্য। সন্তুর বাবা মানুষটা খুব চা খেতে খুব ভালোবাসেন। আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর চা চাই।
এক কথায় বলতে গেলে বলা যায়
'চা খোর'
যেহেতু ঘরে গরু আছে তাই খাঁটি দুধের চা খায় ওরা। এতোটুকু জল থাকে না চা'তে। দশ মিনিটের মধ্যে একথালা পিয়াজি খেয়ে ফেলল ওরা। এখানে এসে থেকে দীপ্তদের সকলেরই খুব খিদে পাচ্ছে। হয়তো জলের জন্য হতে পারে। কিংবা হয়তো ব্যাঙ মুত্র যুক্ত জলের সুফল।
রাত্রে ওরা ছাদে শুতে গেল।এক একজনের জন্য এক একটা খাটিয়া পাতা। খাটিয়াতে তোষক ও চাদর বিছানো আর একটা বালিশ। গায়ে ঢাকা দেওয়ার জন্য একটা করে চাদর আছে। সন্তু ওর বাবার ট্রানজিস্টর রেডিওটা ছাদে নিয়ে এসেছে। রেডিও সিলোনে বিনাকা গীতমালা হচ্ছে। আমিন সাহানি হোস্ট। অনেকটা বাংলা অনুরোধের আসরের মতন প্রোগ্রাম।খুব ভালো ভালো হিন্দি ছায়াছবির গান শুনতে পাওয়া যায় এই প্রোগ্রামে। সায়নরা‌ টুকটাক গল্প হাসিঠাট্টা করছে নিজেদের মধ্যে।
দীপ্ত ছাদে পায়চারি করছিল। ঘুম আসছে না। বারবার অবচেতন মনে সেই সাদা শাড়ী পরিহিত মেয়েটার চোখ দুটোকে যেন সে দেখতে পাচ্ছিল। ‌সন্তুকে জিজ্ঞেস করব করব করেও করতে পারছে না। দীপ্ত জানত যে সন্তুরা দু ভাই। বোনের কথা কখনো সন্তুর মুখ থেকে শোনেনি। ছাদে ঠান্ডা হওয়া দিচ্ছে। চারিদিকে খোলামেলা জায়গা। গরম কালের রাতের হাওয়াটাও তাই এখানে একটু ঠান্ডাই। সায়নরা গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত প্রায় বারোটা হবে। চারিদিকে জোনাকির আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে -- 'কোয়াক' 'কোয়াক' করে। খোলা আকাশের নিচে রাতের এই অদ্ভুত সুন্দর রূপ দীপ্ত দেখেনি কোনদিনও।
সায়ন ,অনিরুদ্ধ অঘোরে ঘুমাচ্ছে।দীপ্তর চোখে শুধু ঘুম নেই। হঠাৎ যেন একটা দরজা খোলার মতো আওয়াজ হল। দীপ্ত ছাদের কার্নিশ থেকে বাড়ির নিচের উঠোনে তাকিয়ে দেখে একটা মানুষের অবয়ব ..হাতে একটা হ্যাজাক। মানুষটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না দীপ্ত। দীপ্তর মনে হল বাড়িতে বোধহয় চোর ঢুকেছে! সন্তুকে জানানোটা দরকার।
সন্তুর গায়ে ধাক্কা দিল দীপ্ত , "এই সন্তু ওঠ ওঠ.. বাড়িতে বোধহয় চোর ঢুকেছে! "
চোর কথাটা কানে ঢুকতেই সন্তু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল,
"কোথায় ? কোথায় চোর ? "
দীপ্ত ছাদের কার্নিশের কাছে এসে আঙ্গুল দিয়ে নিচে দরজার দিকে দেখিয়ে বলল, "চোর পালিয়ে যাচ্ছে ওই দেখ। "
দুজনেই দেখল মানুষটা একহাতে হ্যাজাক আর এক হাতে কমণ্ডুল নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে। সন্তু বলে উঠল , "আবে দূর শালা ‌উয়ো তো বাবুজি হ্যায়। "
দীপ্ত অবাক হয়ে বলল , "তোর বাবা ! এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন ? "
সন্তু স্বাভাবিক গলায় বলল nature's call ইয়ার..
দীপ্ত আতকে উঠে বলল, মানে ! এই এত রাতে !
তোদের বাড়িতে টয়লেট নেই ?"
সন্তু মুচকি হেসে বলল, আমাদের বাড়ি কেন ..গোটা গ্রামেই নেই.. তোদেরকে আগের থেকে বলিনি যদি তোরা শুনে না আসতে চাস তাই.. বাবুজি দিনের বেলা যেতে লজ্জা পায়.. গ্রামের সকলে বাবুজিকে চেনে সম্মান করে.. তাই রাতের অন্ধকারে পাশের গ্রামে যায়। ওই যে দূরে টেলিগ্রাফের পোস্ট দেখছিস তার পরে আছে আর একটা গ্রাম। ওখানে যায় বাবুজি।
দীপ্ত বলে উঠল, "মাই গড.. তারমানে কাল সকালে আমাদেরও... " !
সন্তু দুষ্টু দুষ্টু হেসে বলে উঠল, " হ্যাঁ মাঠে যেতে হবে , একেবারে ধানক্ষেতে ..একসাথে..
খুব মজা হবে দেখবি ,,, "
" তেরি তো" বলে দীপ্ত বালিশ নিয়ে সন্তুর দিকে ছুড়লো।
সন্তু বালিশটা ক্যাচ করে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে বলল , "পাশের গ্রামে যেতে হবে না বাবুজির মত --
এই গ্রামেই ব্যবস্থা আছে "।
তখন প্রায় মাঝরাতই বলা চলে। দীপ্তর চোখেও তখন গভীর ঘুম।
হঠাৎ কানে কতগুলো শব্দ প্রবেশ করল --
"এ দীপ চায়ে পিয়োগে ?"
দীপ্ত চোখ কচলে উঠে দেখল সন্তুর বাবা। মাঝরাতে ডাকছে চা খাবার জন্য !
দীপ্ত হাত ঘড়িতে দেখল রাত‌ দেড়টা।
আড়মোড়া ভেঙে দীপ্ত বলল ," নেহি চাচাজি সুবহ মে পিয়েঙ্গে.. "
"আরে পিও ভাই , চায়ে খানে মে কেয়া হার্জ হ্যায় " ---
অগত্যা সন্তুর মাকে ডাকতে ডাকতে চলে গেল বুড়ো নিচে --
"এ সন্তু কি মা উঠো , জারা চায়ে পিলাও‌ ভাই --
দীপ ভি পিয়েগা--
জারা বড়িয়া সে বানানা "।
দীপ্ত মনে মনে ভাবল বুড়ো নিজেও ঘুমাবেনা ,‌ বেচারী সারাদিন খাটাখাটনি করা সন্তুর মাকেও ঘুমাতে দেবে না।
অগত্যা রাত দুটোর পর অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত চা খেতেই হল দীপ্তকে।
সকালের আলো ফুটতেই সায়ন অনিরুদ্ধ আর সন্তু উঠে পড়ল। দীপ্ত আগেই উঠে পড়েছিল। দেখল ছাদে চারটে কমন্ডুল বা গাড়ু রাখা.. অনেকটা কেটলির মত দেখতে কিন্তু সাইজে বড়। পিতলের ।
সায়নকে উঠেই বাথরুমে যেতে হয় প্রাতঃকৃত্য সারতে। বেচারা নিচে ঘুরে চলে এলো। কোথাও টয়লেট দেখতে পেল না। অনিরুদ্ধ বলল ,হ্যাঁরে দীপ্ত এই কেটলিগুলো দিয়ে কি হবে?
দীপ্ত বলল ,সবাই একটা করে হাতে উঠিয়ে নে.. মাঠে যেতে হবে.
সায়ন, অনিরুদ্ধ সমস্বরে বলে উঠল ..মানে
দীপ্ত গম্ভীর গলায় বলল ..মানে গ্রামে টয়লেট নেই.. তাই বন্ধুগণ মাঠে যাবার জন্য তৈরি হয়ে যাও!
ওদের ব্যাপারটা বুঝতে একটু টাইম লাগল। তারপর দুজনেই সন্তুর পিছনে ছুটল, শালা হারামি -- "
সন্তু দীপ্তর পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগল।
অগত্যা সবাই একটা করে গাড়ু হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করল।
ওরা লক্ষ্য করল এখানে কারোর এ বিষয়ে লজ্জা নেই। ছেলেরা এক দিকের রাস্তায় যাচ্ছে মেয়েরা আরেক দিকে।বেশ খোশ মেজাজে গল্প করতে করতে যাচ্ছে সবাই। যেন প্রাতঃকৃত্য নয় সব পিকনিক করতে যাচ্ছে।বেশ কিছুটা হেঁটে এসে দেখল আলপথের দুই ধারে দুটো ধানক্ষেত। দুদিকেই সাইনবোর্ড লাগানো। একটাতে লেখা "মহিলাও'কে লিয়ে "অন্যটাতে লেখা "পুরুষো'কে লিয়ে"
লজ্জা বিসর্জন দিয়ে সবাই ধান ক্ষেতে ঢুকে গেল। তবে বাঁচোয়া এটাই যে লম্বা লম্বা উলুগাছগুলো একে অপরকে বেশ আড়াল করে রেখেছে। দেখতে পাচ্ছে না কেউ কাউকে।
দীপ্ত ভাবল তার ডায়েরিতে আরেকটা নতুন অভিজ্ঞতা সংযোজন হল।
অন্তরা ঘোষ।
২২.১২.১৯.
চিত্রঋণ : ইন্টারনেট
( চলবে)
পিঞ্জরে অচিন পাখি
___________________
অন্তরা ঘোষ। পর্ব -- ৩

চার পাঁচ দিন হয়ে গেল দীপ্তদের এখানে আসা। এই চার পাঁচ দিনে সেই মেয়েটিকে দীপ্ত আর দেখেনি। হয়তো বাড়ির কাজে ব্যস্ত আছে। কিন্তু সব সময় তার ওই গভীর বেদনাবিধুর চোখদুটো দীপ্ত'র মনে পড়ে।‌ মনে হয় কোথায় যেন একটা ব্যথা লুকিয়ে আছে ওই দুটো চোখের মধ্যে।
দীপ্তরা যখন ঘর অগোছালো করে গ্রামে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে , ফিরে এসে দেখেছে পরিপাটি করে তাদের ঘর , বিছানা গোছানো। সায়নরা বলাবলি করছে যে চাচীজি অর্থাৎ সন্তুর মা ওদের কত খেয়াল রাখছে ..ঘরটাও গুছিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু দীপ্ত অনুভব করতে পারে প্রতিটি জিনিসেই যেন অন্য কোন একজনের একটা পরম যত্নের হাতের ছোঁয়া রয়েছে।
দীপ্ত ভাবে আর এক আশ্চর্য মহিলার কথা -- হ্যাঁ , সন্তুর মা। মুখে খুব কম কথা বলেন।
হয়তো ভাষার সমস্যা , এমনও হতে পারে।
ঘোমটা টেনে ভদ্রমহিলা সারাদিন রান্না ঘরের মাটিতে পাতা উনুনে কাঠে ,‌ নলের মধ্যে ফুঁ দিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে ওদের জন্য রান্না করে চলেছে। তারপর আবার আছে সন্তুর বাবার আধঘন্টা অন্তর চায়ের ফরমাশ ! এতোটুকু বিরক্তি নেই ভদ্রমহিলার ! হাসিমুখে আপ্যায়ন করে চলেছেন সবার !
আজ সন্তু দীপ্তদের নিয়ে ক্ষেত দেখাতে নিয়ে বের হল। গ্রামে প্রচুর জমিজমা সন্তুদের। কোনো জমিতে শুধুই আখ লাগানো , কোনটায় শুধুই মকাই অথবা ধান কিংবা সরষে , আবার কোনো কোনোটায় মুলো , আলু‌ ওলকপি , শালগম , কোনটায় সবুজ টমেটো কোনটায় বেগুন অথবা কপি । সন্তুর মা এই ক্ষেতের সবজিগুলো দিয়ে অতি সাধারন ভাবে যা রান্না করেন তাই যেন অমৃত মনে হয় ! কাঁচা টমেটো মেথির শাক আর শালগম দিয়ে একটা সবজি রান্না করেন চাচীজি যেটা দীপ্তদের দারুণ লেগেছে।
ধানের ক্ষেত আর সরষে‌‌ ক্ষেত‌ ছড়িয়ে রয়েছে বিঘার পর বিঘা ! যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ, কোথাও কোথাও সবুজের মাঝে হলুদ চাদর বিছানো সরষে ক্ষেত। দীপ্ত ভাবে ক্ষেতে এত মানুষ কাজ করছে সন্তুর বাবার তদারকিতে..অথচ ঘরে সন্তুর মা সারাদিন পরিশ্রম করছেন, ওনাকে সাহায্যের জন্য কিন্তু কোন কাজের লোক রাখেনি সন্তুর বাবা ! কি আশ্চর্য রে বাবা !
ওরা চার বন্ধু আনমনে ক্ষেত দেখতে দেখতে চলছিল। হঠাৎ একটা ইয়া লম্বা চওড়া মুসকো মতন গোঁফওলা লোক -- গা দিয়ে তার যেন তেল গড়াচ্ছে, কানের লতি বেয়েও তেল পড়ছে, তেল চুকচুকে ন্যাড়া মাথা, পিছনে ইয়া বড় টিকি.. সন্তুর সামনে এসে বলল ,
"পায়ে লাগু ঠাকুর"
সন্তু হাসতে হাসতে দীপ্তদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল.. "এ হচ্ছে তান্তীয়া .. পেশায় ডাকাত..
দূর-দূরান্তের শহরে গিয়ে মাঝে মাঝে ডাকাতি করে গ্রামে ফিরে আসে। একটা ছোটখাটো ডাকাতের দলও আছে ওর।
বাংলাটা একেবারেই বোঝেনা তান্তীয়া। শুধু দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।
দীপ্তরা এই প্রথম চাক্ষুষ কোনো ডাকাত দেখল। সকলেই বেশ উত্তেজিত। সন্তু বলল, কিরে যাবি নাকি তান্তীয়ার ঘরে ?এইতো‌ কাছেই -
সকলেই এক পায়ে যেতে রাজি।
সন্তু বলল , " তানতীয়া মেরা দোস্ত লোক তুমহারা ঘর দেখনা চাহতে হ্যায়।"
তান্তীয়া বলল , ক্যয়া দেখোগে ঠাকুর.. গরিবখানা'মে হ্যায় হি ক্যায়া ?
"আচ্ছা চলো ফির"।
তান্তীয়া এগিয়ে চলল‌।
দীপ্তরা পাঁচমিনিটে তান্তীয়ার ঘরে পৌঁছে গেল। মাটির বাড়ি। একেবারেই সাদাসিধে। ‌ কিন্তু ঘরের দেওয়ালে চারটে ছোট বড় বন্দুক ঝুলছে।
দীপ্ত জিজ্ঞেস করল, ইয়ে সব বন্দুক সে লোগো কো মারতে হো ক্যায়া?
তান্তীয়া বলল ,হা হুজুর মারনা তো পড়তাই হ্যায় কভি ক‌ভি ।
অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, মানুষ খুন করেছো ?
তান্তীয়ার অকপট স্বীকারোক্তি ,
."হা হুজুর ওতো থোড়া বহুত কিয়াহি হ্যায়..
দীপ্ত জিজ্ঞেস করল, কব সে ডাকাইতি করতে হো.. ? "
তান্তীয়ার বেশ গর্বের সাথে ঝটপট উত্তর, ":বহত ছোটা সে ঠাকুর ..ইয়ে তো হামারা খানদানি বিজনেস হ্যায়.. মেরা দাদা পরদাদা ভি এইহি কাম করতে থে।"
দীপ্ত ক্যামেরা বার করে তান্তীয়ার কয়েকটা ছবি তুলতে চাইল । তান্তীয়া হৈ হৈ করে ক্যামেরা চেপে ধরল --
" নেহি হুজুর , তসবির না উঠাইয়ে "
তান্তীয়ার গলায় করুন মিনতি‌।
সন্তুও চোখের ইশারায় দীপ্তকে মানা করল‌।
এটা বোধহয় ডাকাতদের একটা সিক্রেসীর ব্যাপার। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দীপ্ত ক্যামেরা নামিয়ে রাখলো।
এরপর আর কদিন ওরা তান্তীয়াকে দেখতে পায়নি।
সন্তু বলল, বোধ হয় ওর দলের সাথে অন্য কোন জায়গায় ডাকাতি করতে গেছে। কারণ নিজের গ্রামে কখনো ডাকাতি করে না তান্তীয়া ।
নিজের গ্রামের কারো কোন ক্ষতি করা তো দূরের কথা ‌-- বরং দরকারে অদরকারে ‌তান্তীয়া গ্রামের প্রচুর মানুষের উপকার করে থাকে। বিয়ে থা করেনি -- একা মানুষ এই তান্তীয়া।
ডাকাত হলেও ওর ভেতরে যেন আর একটা সহজ সরল মানুষ লুকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আলাপ হওয়ার পরই এটা বেশ বুঝতে পারল দীপ্তরা।
দীপ্তরা কলকাতায় ফিরে যাবার কিছুদিন পর সন্তুর কাছে শুনেছিল যে তান্তীয়াকে নাকি ওর বিরুদ্ধ পার্টির ডাকাতরা খুন করে ধড় মুন্ডু আলাদা করে কেটে‌ গ্রামের ঝিলের জলে ভাসিয়ে দিয়ে‌ গিয়েছিল।
সেদিন রাতে দীপ্তরা গোবি আলুর তরকারি, গরম গরম উনুনে সেঁকা মকাইয়ের রুটি আর ঘন‌ অড়হ‌র ডাল পরম তৃপ্তির সাথে খাচ্ছিল ডিনারে। দীপ্তর খাওয়া হয়ে গেছিল। সিগারেট ধরিয়ে ছাদে সুখটান দিতে গেল দীপ্ত। সেদিন ছিল জ্যোৎস্না রাত। ছাদে এসেই কার্নিশের এক কোনায় দীপ্তর চোখ আটকে গেল। সেই সাদা শাড়ি পরা রহস্যময়ী নারী ! মাথায় ঘোমটা নেই। জোছনার আলো স্নান করিয়ে দিচ্ছি মেয়েটার সর্বাঙ্গে। নিশ্চল চিত্রাপিতের মত দাঁড়িয়ে মেয়েটা দূরে অন্ধকার ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দীপ্ত একটু দূরে অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে‌ , তাই মেয়েটা ওকে দেখতে পায়নি। ভালো করে মেয়েটাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল দীপ্তর মত ছেলেও। গমের মতো গায়ের রং, ছিপছিপে তন্বী,এত চিকন ত্বক যে মাছিও বসতে গেলে বোধহয় পিছলে পড়ে যাবে‌! বছর কুড়ি বাইশ বছর বয়স হবে বোধহয় মেয়েটার। এক ঢাল কালো মিশমিশে মেঘের মতো চুল পিঠের উপর, বাঁশির মতো টিকালো নাক, ছোট্ট কপাল, টানা টানা ভুরু যেন তুলি দিয়ে আঁকা, বড় বড় গভীর কালো চোখ, গোলাপি অধরের কোনে যেন এক চিলতে অভিমান আর বিষাদ লুকিয়ে আছে। এত সুন্দর মুখ অথচ কি করুন। দীপ্ত ভাবল, সত্যি ভগবান কি যত্ন করে সময় নিয়ে মেয়েটাকে বানিয়েছে।
এমন সময় অনেকগুলো পায়ের আওয়াজে মেয়েটা হতচকিত হয়ে উঠল। ঘুরে দাঁড়াতেই দীপ্তর চোখে চোখ পড়ল। কয়েকটা মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল দীপ্তর দিকে। তারপর হঠাৎ মাথায় ঘোমটা টেনে ছুটে চলে গেল ছাদের অন্য দিকের দরজা দিয়ে ঘরের ভিতরে।
সায়ন অনিরুদ্ধ সন্তু ততক্ষণে ছাদে এসে গেছে। সায়ন এসেই ট্রানজিস্টারে রেডিও লক্ষ্নৌ ধরল।
বিনাকা গীতমালা শুধুই বুধবার হয় তাই আজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্য গান ধরার চেষ্টা করতে লাগল সায়ন।
দীপ্তর খুব প্রিয় একটা গান রেডিওতে বাজছে "ইয়ে দিল তুম বিন কাহি লাগতা নেহি হয় হম কেয়া করে"
দীপ্ত তখনো অন্যমনস্কভাবে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে ঠিক যেখানে মেয়েটা দাড়িয়ে ছিল। সায়ন অনিরুদ্ধ ডাকছে , কিন্তু দীপ্তর ভ্রুক্ষেপ নেই।
সন্তু এসে দীপ্তর পিঠ চাপড়ে বলল,
"কা হুয়া রে , ইতনা খোয়ি খোয়ি কিঁউ হো " ?
দীপ্ত ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্তুর চোখে চোখ রেখে বলল, ওই সাদা শাড়ি পরা মেয়েটা 'কে 'রে সন্তু " ?
সন্তু গম্ভীর হয়ে গেল। সায়নদের দিকে তাকিয়ে দেখল ওরা রেডিওতে গান শুনতে ব্যস্ত ছদের অন্য কোণে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে সন্তু বলল,
"শুনতে চাস ? বেশ তাহলে শোন.. তবে না শুনলেই ভালো করতিস.. কষ্ট পাবি শুনলে "
দীপ্ত অবিচল দৃষ্টিতে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললো, তুই বল .. কষ্ট হলেও আমি শুনতে চাই..!
অন্তরা ঘোষ।
২৩.১২.১১
চিত্রঋণ : ইন্টারনেট
( চলবে)
আগের পর্বগুলির লিংক

পিঞ্জরে অচিন পাখি
__________________
 অন্তরা ঘোষ । পর্ব - ৪

সন্তু একটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে শুরু করল "বিন্দা আমার চচেরা ( খুড়তুতো) বোন। এখন ওকে যেমন দেখছিস -- একদম চুপচাপ , গুমসুম ... ও কিন্তু একেবারেই এইরকম ছিল না , বরং খুব হাসিখুশি ছটফটে মেয়ে ছিল। মুখে খই ফুটতো সবসময়। আমি যখন কলকাতা থেকে আসতাম ওর কত যে কথা জমে থাকতো আমার জন্য !
বিন্দা যখন দু'বছরের তখন একটা অ্যাক্সিডেন্টে আমার চাচা চাচি দুজনেরই স্বর্গবাস হয়ে যায়। আমার বাবুজি বিন্দাকে আমার মায়ের কোলে দিয়ে বলে আজ থেকে এই তোমার মেয়ে। বিন্দা সেই থেকে আমার বাবুজি আর মায়ের স্নেহ যত্নে আদরে বড় হয়.. মা বাবুজিকেই ও নিজের বাবা-মা বলে জানে। আমারও খুব আদরের বোন ও। ছোট থেকে সব কিছু আবদার ও আমার কাছেই করত।
আমাদের পাশের গ্রামে আমাদেরই পালটি ঘর ঠাকুর নরেন্দ্র প্রতাপ সিং ছিল বাবুজির দোস্ত। যখন বিন্দা চার বছরের আর চাচাজি'র ছেলে রমেশ তখন বছর দশেকের হবে । তখন দুই বাবুজি মিলে ওদের বিয়ের পাকা কথা বলে রাখে।
ছোট থেকেই বিন্দা আর রমেশ একসাথে স্কুলে গেছে , খেলা করেছে , বড় হয়েছে.. ছোটবেলা থেকেই দুজনের খুব ভাব। বড় হয়ে যখন ওরা জানল যে ওরা একে অপরের বাগদত্তা তখন ওদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হল.. প্রেমে পরিণত হল।
রমেশের বাবার অনেক ক্ষেত খামার আছে। রমেশ চাকরির চেষ্টার‌ সাথে সাথে ক্ষেত-খামারেরও দেখাশোনা করত। বিন্দা যখন ষোলো বছরের , তখন ধুমধাম করে ওদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। শ্বশুরবাড়িতে খুব সুখেই কাটছিল বিন্দার জীবন। বিয়ের পর বছর খানেক বিন্দা আমাদের বাড়িতেই ছিল। পরের বছর রমেশ বি. এসে .এফে চাকরি পেয়ে যায়। বছর দুয়েকের মধ্যে ওর পোস্টিং হয় গুজরাটের কচ্ছে। এখনো মনে আছে যেদিন রমেশ চলে যাবে বিন্দার সেকি কান্না !
রমেশ যাওয়ার পর কয়েকদিন খুব মন খারাপ ছিল বিন্দার। রমেশ কিন্তু ওকে নিয়মিত চিঠি লিখত।
মাঝে শুধু দশ‌ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল একবার।
পরের বার মাস খানেক ছুটি নিয়ে আসবে বলে কথা দিয়ে গেল।
সেই থেকে বিন্দা নতুন করে দিন গোনা শুরু করে।
মাস পাঁচ ছয় কেটে যাওয়ার পর রমেশ চিঠিতে জানায় সামনের সপ্তাহে সে আসছে।
খুশিতে বিন্দা আত্মহারা তখন।
রোজ ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখর ওপর পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে দেয়।
একটা একটা করে দিনও কেটে যায়।
শেষপর্যন্ত প্রতিক্ষার দিন শেষ হয়।
সকাল থেকেই বিন্দা রাস্তার মোড়ে বারবার গিয়ে দেখতে থাকত প্রতিটা বাস। এই বুঝি রমেশ‌ এলো‌!
সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল!
রমেশের দেখা নেই।
উদাস হয়ে‌ আশাই ছেড়ে দিল বিন্দা।মনে মনে ভাবল রমেশ নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। ঘরে গুমসুম মেরে চুপচাপ শুয়ে থাকে বিন্দা। এরপর আরও চার দিন কেটে গেল। রমেশের কোনো খবরই নেই। বাড়ির লোকেরাও এবার চিন্তায় পড়ে গেল। কী হল ছেলেটার !
একটা খবর পর্যন্ত নেই ! পাঁচ দিনের মাথায় গ্রামের একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়তে দৌড়তে আমাদের বাড়ি এসে বিন্দাকে খবর দেয় যে রমেশের‌ জীপ
দেখেছে সে। সঙ্গে আরো অনেক মেহমান আসছে। মুহূর্তে খুশির ঝলক বিন্দার চোখে। খুব ইচ্ছে হল ওর সেজেগুজে রমেশের সামনে আসার।
আগত সন্তানের কথা ইচ্ছে করেই চিঠিতে জানায়নি সে ‌। একেবারেই সামনাসামনি বলে রমেশকে চমকে দিতে চায় ।
রমেশের দেওয়া চুমকি বসানোর লাল শাড়ীটা পরল। দুই হাতে ভর্তি কাচের চুড়ি, গলায় মঙ্গলসূত্র, টানা টানা চোখে কাজল,সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে বড় করে টিপ।
রমেশ চুলের বেনুনীতে ফুল লাগানো পছন্দ করত। তাই বাড়ির পিছনের বাগান থেকে সাদা কাঠচাঁপা আর গেঁদুয়া ফুল এনে মাথার চুলে আটকে নিল। আয়নায় নিজেকে দেখে একবার হেসে নিল।
হঠাৎ নিচে অনেক লোকের আওয়াজ ! রমেশ এসে গেছে ! বিন্দা এক ছুটে ওপর থেকে নেমে এসে দেখে উঠোনের মাঝখানে একটা কফিন। বেশ কয়েকজন মিলিটারি পুলিশ চারদিকে দাঁড়িয়ে। বিন্দার চোখ ওদের মধ্যে রমেশকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ বিন্দা দেখল বাবুজি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মায়ের কান্নার আওয়াজ আসছে ঘরের ভেতর থেকে। কি হল তখনো কিছুই বুঝতে পারছে না বিন্দা। পুলিশরা এবার আস্তে আস্তে কফিনের ঢাকাটা খুলে দিল। ভারতের তেরঙ্গায় ঢাকা রমেশের শরীর ফুলে ফুলে ঢাকা‌! মিলিটারি পুলিশ অফিসার জানালো ইমারজেন্সি সিচুয়েশন হওয়ায়
ওর ছুটিও নামঞ্জুর হয়ে যায়। পরশু কচ্ছ সীমান্তে হারামী নালাতে নজরদারি করার সময় পাকিস্তানিদের সাথে গোলাগুলিতে একটা গুলি এসে লাগে রমেশের পাজরে। সেই অবস্থাতেও রমেশ গুলি চালিয়ে যায় শত্রুপক্ষের উপর। হঠাৎ শত্রুপক্ষের মেশিনগান থেকে একঝাঁক গুলি এসে রমেশকে ঝাঁঝরা করে দেয়। বিন্দার নাম নিতে নিতেই রমেশ মারা যায়।
শুনে বিন্দা যেন পাথর হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
যখনই জ্ঞান আসছিল বারবার রমেশকে খুঁজছিল। শহরের হসপিটালে নিয়ে যেতে হয় বিন্দাকে। বাচ্চাটাও মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
আমি একদম চাইনি আমার আদরের বোনটা এইভাবে সাদা শাড়ি পরে নিরাভরণ হয়ে থাকুক। কিন্তু গ্রামের সমাজ খুব নিষ্ঠুর রে দীপ্ত । ওর হাতের চুড়ি গুলো ভেঙ্গে দিল, এত ভালোবাসতো বোনটা চুড়ি পরতে ..সিঁদুর মুছে দিল.. সাদা শাড়ি পরিয়ে জিন্দা লাশ বানিয়ে দিল আমার বোনটাকে।
রমেশের মৃত্যুটা বিন্দা মেনে নিতে পারেনি। তারপর থেকেই ও একদম নির্বাক গুমসুম হয়ে থাকে । কতদিন যে ওর হাসি দেখিনি, ওর চবড় চবড় কথা শুনিনি, ওর আবদার
শুনিনি ! পাথর হয়ে গেছে রে আমার বোনটা।
রুমাল বের করে চোখ মুছতে লাগল সন্তু।
এসব শুনে দীপ্তর মুখটাও কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠল। সন্তুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
সন্তু দীপ্ত'র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে।
দীপ্ত জিজ্ঞেস করে-"আচ্ছা ওর তো ওইটুকু বয়স ..তোরা ওর আরেকবার বিয়ে দিলি না কেন " ?
"আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম‌ বিশ্বাস কর ,বাবুজিকে বুঝিয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম 'রে বোনটা আবার হাসুক, কথা বলুক। বাবুজিও আমার কথা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু গ্রামেরই পঞ্চায়েত বলল বিধবার বিয়ে দেওয়া অশাস্ত্রীয়। সেই চেষ্টা করলে আমাদের একঘরে করে দেবে "।
এখানে সবাই ভীষণ গোঁড়া রে ... "
দীপ্ত বলে উঠল, "উফফ সত্যি কি সমাজ ব্যবস্থা আমাদের।মানুষের জীবনের থেকে সমাজের নিয়ম কানুন বড় " !
সন্তু বলল, " আরেকটা কথা তোকে বলা হয়নি। তোর সাথে রমেশের একটা জিনসের অনেকটা মিল -- জানিস ? তোর চোখ দু'টোর সঙ্গে রমেশের চোখের অদ্ভুত মিল " !
তোর মনে আছে দীপ্ত কলেজে তোকে আমি একবার বলেছিলাম আমার এক আত্মীয়র সাথে তোর ভীষণ মিল ?
বিন্দা তার জীবনের ওই ‌অভিশপ্ত ঘটনার পর থেকে কখনো কারো সামনে আসে না।
কিন্তু বিন্দা যে তোকে যে দূর থেকে দেখছে সেটা আমি লক্ষ্য করেছি একদিন। সেটা ওই একটাই কারণে। ও তোর মধ্যে রমেশের চোখদুটো খুঁজতে চাইছে " ।
দীপ্ত শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল এইজন্যই এতো আকুল করা চাহনি ছিল ওই চোখে !
দীপ্ত বলল , "আমাকে রমেশের একটা ফটো দেখাস তো "--
সন্তু বলল , "খুঁজে দেখতে হবে রে , কেননা ওই ঘটনার পর থেকে বোনের সামনে রমেশের কোন স্মৃতি আমরা রাখিনি ।
ওরা কথা বলতে বলতে খেয়াল করেনি যে ভোরের আলো ফুটবো ফুটবো করছে।
সন্তুর বাবা কেটলি আর চায়ের কাপ নিয়ে উপরে এসে এসেছন‌।
" দীপ , চায়ে পিনা হ্যয় কী নেহি " ?
আজ আর দীপ্ত না করল না।
চায়ের কাপ হাতে নিল।
সন্তুর বাবা জিজ্ঞেস করল, মিঠ ( মিষ্টি) ঠিক হ্যায় ?
দীপ বলল, "হা চাচাজি বরাব্বর হ্যায়"
আবার একটা নতুন রোদ ঝলমলে সকালের শুরু।
গাড়ু হাতে সকলে মাঠে যেতে যেতে দেখল চারপাশে সবুজ আর সবুজ.. শয়ে শয়ে ময়ূর খেলে বেড়াচ্ছে... খেতের মধ্যে ইঁদুর ধরে খাচ্ছে.. সবুজের মধ্যে নীলকণ্ঠী রং.. মাঝে মাঝে হলুদের ছোঁয়া.. কি অপূর্ব দৃশ্য !
সন্তুর মা আজ জলখাবারে পুরী আর আলু মটর বানিয়েছিল , সঙ্গে আমের আচার। সন্তুর মা পুরী ভেজে কুল পাচ্ছে না। চারজন ইয়ং ছেলে.. গ্রামে এসে যাদের খিদে শতগুণ বেড়ে গেছে.. তার সাথে আছে সন্তুর বাবা ও ভাই। বেচারী সন্তুর মা হাসিমুখে আগুনের তাতে ভেজেই চলেছে পুরী ...
আজ সায়নরা গ্রাম ঘুরতে গেল। দীপ্ত গেল না। রাতে ঘুম হয়নি । ভাবল ছোট্ট করে এক রাউন্ড ঘুম মারবে। ওদের বলল তোরা যা আমি বিকেলে বেরোবো।
ছবি আঁকা দীপ্তর একটা নেশা। সন্তুর ভাই মন্নোকে বলল কাগজ পেন্সিল আনতে। সন্তুর ভাই মহা উৎসাহে খাতা পেন্সিল এনে দিল। পেন্সিল দিয়ে রাফ স্কেচ করে দুটো ছবি আঁকল দীপ্ত। প্রথমটা একটা মেয়ে ছাদের ধারে একটু আড়াআড়ি করে দাঁড়িয়ে.. মুখে চাঁদের আলো পড়েছে..
আরেকটা ছবি একটা মেয়ে চোখ বড় বড় করে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনের দিকে.. দৃষ্টিতে আছে বিস্ময় ব্যথা-বেদনা আকুলতা ..সবই।
পেন্সিল স্কেচ করে রাখল দীপ্ত। সঙ্গে করে নিয়ে যাবে ছবি দুটো। বাড়ি গিয়ে ক্যানভাসে ভালো করে অয়েল পেইন্টিং করবে।
শুয়ে পড়ল। একটু ঘুমানো দরকার। মাঝে মাঝে কাশি হচ্ছে দীপ্তর। খোলা ছাদে থাকার অভ্যাস নেই তো‌ , হয়তো হিম পড়ে ঠান্ডা লেগেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল দীপ্ত। ---- গভীর ঘুম।
ঘুম ভাঙলো সায়নদের ডাকে।
অনিরুদ্ধ বলল, কত ঘুমাবি রে শালা। কুম্ভকর্ণের নাতি তুই। কুয়ো তলায় চলে আয় চান করব ..খিদে পেয়েছে জব্বর ... "
দীপ্ত বলল , "তোরা যা আমি আসছি। ওরা চলে গেল। দীপ্ত দেখল পাশে টুলের ওপর কাসার গ্লাসে ঢাকা দেওয়া কিছু রাখা আছে।
সন্তুকে জিজ্ঞেস করল ,এটা কি রে।
সন্তু গ্লাসের ঢাকা খুলে দেখে বলল এটা কাড়া.. গ্রামের টোটকা ওষুধ , তুলসী পাতা আদা গোলমরিচ মধু দিয়ে বানানো হয়। তুইতো কাসছিস। তাই বোধহয় বিন্দা করে রেখে গেছে।
চমকে তাকিয়ে দীপ্ত বলল, " তুই কি করে জানলি বিন্দা করেছে " !
সন্তু হেসে বলল, এটা এই বাড়িতে বিন্দাই বানায়। যখনই যার সর্দি কাশি হয় বিন্দাই বানিয়ে দেয়।
হঠাৎ উদাস গলায় সন্তু বলে উঠল ,
" বস , তুই যদি আমাদের বাড়িতে থেকে যেতিস তাহলে হয়তো আমার বোনটা আবার একটু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেত "।
দীপ্ত বলল , " ধুর কি যে বলিস না .. চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে ।আমি বাবুজির সাথে কথা বলব যাতে ওর আবার বিয়ে দেওয়া হয়।
সন্তু বলল, " না না একদম বলবি না বাবুজি যদি জানতে পারে আমি তোকে সব বলেছি তাহলে খুব রাগ করবে " ।
চলে যেতে যেতে সন্তু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল , তুই আজ আর চান করিস না ..ঠান্ডা লেগেছে তোর। কাড়া'টা খেয়ে নিয়ে নিচে ভাত খেতে আয়।
দীপ্ত গ্লাসটা হাতে নিয়ে খাবে কি খাবে না ভাবছে। আবার ভাবছে হয়তো বিন্দা কোথাও থেকে ওকে দেখছে। না খেলে বেচারি মেয়েটা হয়তো দুঃখ পাবে।
নাক চোখ বুজে দীপ্ত গ্লাসের পানীয়টা শেষ করল।
দীপ্ত ভালো করেই জানে মেয়েটার প্রেমে ও পড়েনি। কিন্তু একটা ফুলের মত মেয়ে যার সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে তার জন্য কেমন যেন অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে। যদি মেয়েটার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটাতে পারতো দীপ্ত !
অন্তরা ঘোষ ।
২৫.১২.১৯.
চিত্রঋণ : ইন্টারনেট
( আগামী পর্বে সমাপ্ত )
আগের পর্বগুলোর লিঙ্ক