আছে কি?
ষোড়শ শতাব্দী তে ইউরোপে অ্যানাব্যাপ্টিস্ট মুভমেন্ট এর ফলে অ্যামিশ,মেননাইটস আর ব্রেথেনদের মত গ্রুপ গুলির জন্ম হয়। এইসব খ্রিস্টান ধর্মান্ধ গ্রুপ গুলির মধ্যে মিল থাকলেও এদের মধ্যে অ্যামিশরা সবচেয়ে গোঁড়া; সেটা বাড়তে বাড়তে এমন পর্য্যায়ে যে আজকের এই অত্যাধুনিক যুগেও তারা সেই প্রাচীন শতাব্দীতেই পড়ে আছে। আজও তারা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে, বিদ্যুত ব্যবহার করেনা, নিজেদের কাপড় জামা নিজেরাই চরখা কেটে তৈরী করে। অ্যামিশ মেয়েরা এক রংয়া পোশাক পরে; তাদের ছিটের পোশাক পরা মানা। পোশাকও সেই আদ্যিকালের পা অবধি ঝুলের ম্যাক্সি ধরণের লম্বা হাতার জামা, তার ওপর অ্যাপ্রন। ছেলেদের, মেয়েদের পোশাকে চেন বা সেই জাতীয় কিছু ব্যবহার হয়না; বোতাম দিয়ে দিয়ে আটকানো। ছেলেদের পোশাকে সাদা, কালো, ব্রাউন এই তিনটি মাত্র রংই থাকে। তারা কোনো একার ফটো রাখতে পারেনা; গ্রুপ ফটো ছাড়া।
এই হেনো অ্যামিশরা ১৭২০ সাল নাগাদ পূর্ব্ব আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া রাজ্যের পেনসিলভেনিয়া শহরের ল্যান্কেস্টার কাউন্টি তে চলে আসে এবং বসতি গড়ে তোলে। সেখানকার প্রায় সব চাষের জমিই এদের অধীনে; ফলতঃ এদের টাকা পয়সার বিন্দুমাত্র অভাবনেই। অভাব কি, এরা দারুন পয়সাওয়ালা তবে ওই প্রাচীন যুগকে আঁকড়ে পরে আছে এখনো। একটা মাত্র ঘরওয়ালা স্কুলে যায়, যেখানে ক্লাস এইটের ওপরে পরানো হয়না।
এখন ল্যান্কেস্টার হলো অ্যামিষদের সবচেয়ে পুরনো আর জনবহুল এলাকা। আধুনিক জগতের মানুষজন অ্যামিশদের দেখতে যায়; কি করে এমন ইন্টারনেটের যুগেও ওরা সেই প্রাচীন শতাব্দী তে বেঁচে রয়েছে। সেখানে অ্যামিশদের ওয়ান রুম স্কুল, তাদের তৈরী জ্যাম, জেলি, পাই এর দোকান, তাদের হস্তশিল্প, কামারের দোকান, তাদের ফার্ম এনিম্যাল সহ ফার্ম এই সব দেখে সাথে তাদের পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বাড়ি ঘর মানুষজন কেও দেখে।
তারা আজও সেই মোমের বা তেলের বাতি জ্বালায় রাত্রে, শীতের সময় শুধু মাত্র কাঠের চুল্লি দিয়ে ঘর গরম করে; কালো কালো ঘোড়ায়টানা গাড়িতে করে ঘোরে, একটা বিশেষ মরসুমে বিয়ে করে বলা বাহুল্য নিজেদের মধ্যেই। বিয়ের পর পুরুষেরা দাড়ি রাখে 'বিবাহিত পুরুষ' বোঝানোর জন্য। একেকটা পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক কারণ আজকের যুগেও সাত আটটি করে সন্তান জন্মায়। জন্মনেয় তারা বাড়িতেই, ধাইমা আসে, তার হাতেই।
ল্যান্কেস্টার বা তার আসেপাসে অ্যামিশ ভিলেজ ঘুরতে যাওয়া লোকজনদের থাকার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে; কিছু কিছু অবিকল অ্যামিশরা যেভাবে থাকেন সেই ভাবেই করা; অত্যাধুনিক ব্যবস্থাও আছে অবশ্য। মানুষজনের ঘুরতে বেড়াতে যাতে সুবিধা হয়। দিনের বেলা যেমন তেমন, রাতের বেলায় অমন ধু ধু করে চাষের জমি, সাথে সেই পুরনো ধাঁচের বাড়ি গুলোতে নিভু নিভু আলো, আলোর চেয়ে বুঝি অন্ধকার সৃষ্টি করে বেশি।
আর এমন পরিবেশে ভূত যে থাকতেই পারে সেটা বহু মানুষই বিশ্বাস করে। এমনিতেই আমেরিকানরা যথেষ্ট ভূত বিশ্বাস করে; তারা এমনও মানে কোনো কোনো জায়গায় ভূতেদের ঘনত্ব বেশিও আছে। যা কিনা 'কোল্ড স্পট' বলে পরিচিত।
গতবারের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই এবারের প্ল্যানটা সামারে করেছে সুতপা। অনিমেষের সামার ভ্যাকেশন শুরু হলেই তারা আবার যাবে অ্যামিশ ভিলেজ। তারা বলতে শুধু সুতপা অনিমেষই নয়; তাদের অসম বয়সী বন্ধুদের গ্রুপ কেভিন, অ্যালেন, লিসা, শেরিল, রজিত আর পূজা। সুতপা এক্কেবারেই ভূত মানেনা; যদিও অনেকেই তাকে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছে, যে, যেমন হাওয়া বা ঈশ্বরকেও তো চোখে দেখা যায়না তবু তা' আছে। ঠিক তেমনি ভূতও থাকতেই পারে। সেসবে অবশ্য সুতপার নিজের অবস্থান থেকে নড়ার ইচ্ছে হয়েছে তেমন নয়।
সুতপা অনিমেষ দুজনেই গ্রাম বাংলার ছেলে মেয়ে। অনেকটা কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে শহরে এসে বাকিটুকু করেছে। সৌভাগ্য ক্রমে দুজনের দেখা, বিয়ে, এবং আমেরিকায় পাড়ি। অনিমেষ পোস্ট ডক্টরেট করে আর পড়ায়; সুতপা প্রথমদিকে টুকটাক ভল্যান্টিয়ার করে এখন একটা নামী হোলসেল সেন্টারে কাজ করে। বছর চারেক হয় ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর পরই আমেরিকায় এসে হনিমুনে গেছিল অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডা; ডিজনি ওয়ার্ল্ড। ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভের বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলে উঠেছিল; তাদের হোটেলের মিনিবাসের বন্দোবস্ত ছিল ডিজনির পার্ক গুলোতে যাওয়ার, কাজেই সুবিধে হয়েছিল ওদের। সেবারে ওই ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভের রেড রুফ ইন হোটেলটা খুব বাজে ভাবে আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেখানকার মানুষজনকে অন্য অন্য হোটেলে সরিয়ে নেওয়া হয়। কেভিন, অ্যালেন, লিসা, শেরিল, রজিত, পূজা রা ছিল রেড রুফ ইনে। ওদেরকে বেস্ট ওয়েস্টার্ন-এ স্থানান্তরিত করে কর্তৃপক্ষ। ওরা সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রী। অনিমেষ, সুতপার সাথে ওদের প্রাথমিক পরিচয় ডিজনি যাওয়ার মিনিবাসে। পরে জানা যায় অনিমেষের সাথে ওদের সাবজেক্টের মিল আছে; কাজেই আরওই ঘনিষ্ঠ হয়ে পরে ওরা। খুবই প্রানবন্ত ছেলেমেয়ে গুলো। পড়াশোনায় তুখোর, ঘুরতে বেড়াতে ভালবাসে, প্রচুর গল্প করে, গান গায় গিটার বাজায়। শুধু ওদের একটাই ব্যাপার সুতপার অপছন্দ, ওরা ভুতে বিশ্বাস করে। ওরা নাকি সুতপাকে প্রমান দিয়েই ছাড়বে ভূত আছে। অনিমেষ নিজে ভুতে বিশ্বাস করেনা তবে কেউ ভুতে বিশ্বাস করে শুনলে ওর সুতপার মত রাগও হয়না।
সুতপাকে ভূত দেখানোর পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা সবাই গত শীতে গেছিল অ্যামিশ ভিলেজ। সেখানে ঠিক অ্যামিশরা যেভাবে থাকে তেমন থাকার ব্যবস্থাওয়ালা হোটেল খুঁজে বের করেছিল ওরা। ওই প্রবল ঠান্ডায় শুধু মাত্র কাঠের আগুনে গরম করা ঘর, বিকেল হওয়ার আগেই যেন রাত্রি নামবে, আর অত লম্বা রাত্রি কাটানো। জেগে থাকার সময়টা মোম কিম্বা তেলের বাতি জ্বালিয়ে কাজ কর্ম সারা। পুরনো আমলের কাঠের বাড়ি, ঘরের ভেতর দেওয়ালে হলদে হয়ে যাওয়া অ্যামিশ পরিবারের ফটো, বিশেষ আর কোনো সজ্জা নেই, অ্যামিশ দের তৈরী লেপ কম্বল পাতা বিছানায়।
সন্ধ্যের সময় কিছু হয়েলের কর্মচারী অ্যামিশদের মত সাজপোশাকে এসে ঘরে আলো জ্বালালো; টেবিলে ট্রেডিশনাল অ্যামিষ ক্রিস্টমাস মেন্যু গরম গরম পরিবেশন করলো। আর অনেক খানি কাঠ দিয়ে গেল যাতে সারারাত অসুবিধা না হয়।
ওরা মিট্লোফ, অ্যামিশ হ্যাম এন্ড চীজ, ডাম্পলিংস, অ্যামিশ সসেজ বলস, পেনসিলভেনিয়া ডাচ গ্রিন বীনস, অ্যামিশ বানানা ব্রেড, পিচ এন্ড প্লাম জ্যাম, অ্যামিশ ব্রেড পুডিং, গুয়ী অ্যামিশ ক্যারামেল পাই এই সবের মত নতুন ধরনের সুস্বাদু সব খাবার খেল আনন্দ করেই। সারা ঘরে পাইন, ফার, চেরি, রেডওক, এমন বিভিন্ন কাঠের গন্ধ ঘুরছে। সাধারনতঃ এই সব কাঠই ফায়ার প্লেসে ব্যবহার করা হয় ফায়ার উড হিসাবে।
খেয়ে উঠে ওরা ফায়ার প্লেসের আশেপাশে বসেছিল; বাইরে বেস স্নো হতে শুরু করেছে। ঘরের ভেতরে আলো আঁধারী; প্রত্যেকের ছায়া গুলোই যেন দেওয়ালের অন্ধকার বাড়াচ্ছে। অনিমেষ তার বহু চর্চ্চিত ছোটবেলার অভিজ্ঞতা শোনাতে লাগলো; এগুলো শুনে শুনে কান পচে গেছে সুতপার।
"ছোটবেলায় গ্রামে থাকতাম; গ্রাম মানে এক্কেবারে অজ পাড়াগা। কাঁচা মাটির রাস্তা, বেশির ভাগ মাটির বাড়ি টালির বা খড়ের চাল। আমরা সব কিছুর জন্যই দূর দূর হাঁটতাম।
কি স্কুল যাওয়া, কি শ্মশান যাওয়া; গ্রামের সে-ই-এ-ক কোনায় শ্মশান তিনচারটে গ্রামের জন্য ওই একটাই ব্যবস্থা। মোটামুটি সাত আট মাইল হাঁটা পথ; সে পথও তেমনি ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে নয় বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে। বর্ষাকালে তো আরওই ভালো কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যেতনা রাস্তাঘাট। তারওপর বহু মানুষই এত গরিব ছিল যে পুরো দাহ করতে যে পরিমান কাঠ লাগে সেটা কেনার মত পয়সাও থাকত না ফলে অর্দ্ধেক দাহ করে মাটি চাপা দিয়ে চলে যেত; একটা আধা মজে যাওয়া খাল ছিল বর্ষায় বেশ জল হত অনেক সময় সাপে কাটা দেহ ওই খালে ভাসিয়ে দিয়ে যেত লোকে। ফলতঃ শ্মশানের পরিবেশ ভয়ঙ্করই ছিল।
মাঝে মাঝেই বন্ধুদের কাছে সাহসিকতার পরিচয় দিতে ওই শ্মশানে অমাবস্যার রাত্রে গিয়ে বড় নিম গাছে নিজের নাম খোদাই করে আসতে হত। আমিও বার দুয়েক করেছি; পরে আর কেউ আমায় চ্যালেঞ্জ দিতনা। একবার শীতের রাত্রেও গেছিলাম। অন্ধকার চারিদিক, গাছের মধ্যে দিয়ে হাওয়া পাস করে হু হু শব্দ, শিয়ালের বুক কাঁপানো ডাক, বাঁশঝাড়ে শিয়ালের চোখ জোনাকি জ্বলতে থাকত, ঝাড়ের মরমর আওয়াজ, সাথে ওই নোংরা পরিবেশ, দুর্গন্ধ। আমাদের এক বন্ধু তো মারাই গেল; কাঁটা গাছে চাদর আটকে গেছিল ওর, নাম খোদাই করে পিছন ফেরার পর, আর তাতেই..."
গলা নীচু করে এমন গল্পের মত করে অনিমেষ বলে ঘটনাগুলো, তাতে আরও গা ছম্ছম পরিবেশ। ফায়ার প্লেসের আগুনটা দপ্দপ করছে, সুতপা উঠে কটা কাঠ গুঁজে দিল। কি কাঠ কেজানে, যেমন ধোঁয়া হয়ে গেল, তেমনি বিশ্রী পচা গন্ধ ভরে গেল ঘরে। কাঁচা কাঠ তো বটেই ফালতু কোনো গাছের কাঠ নিশ্চয়ই।
গল্প শেষ হলে পর ওরা সুন্দর করে গান ধরল গিটার বাজিয়ে; বেশ কটা গাইলো। সুতপাও যথেষ্ট ভালো গায়; যদিও বাংলা গান, মানে না বুঝলেও শ্রুতিমধুর লাগে ওদের। ফ্লোরিডাতে শুনিয়েছিল, কাজেই এবারে অনুরোধ এলো সুতপার কাছে। ঠান্ডা লাগা না কিসের জন্য কেজানে, সুতপার গলা এমন আটকে যেতে লাগলো কিছুতেই ঝেড়ে কেশেও গান গাওয়ার উপযুক্ত পরিষ্কার হলোনা। অনেক সময় ধরেই ফায়ার প্লেসের আগুনটা দপ্দপ করছিল সুতপা কাঠ দেওয়াতেও উন্নতি হয়নি; এখন হঠাৎ যেন চিমনি দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে নিভিয়ে দিল আগুনটা, শুধু কাঠ গুলো লাল হয়ে ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগলো। অ্যালেন উঠে নতুন করে কাঠ দিয়ে জ্বালিয়ে দিল ফায়ার প্লেস; আগের বার সুতপা কাঠ দেওয়াতে বিশ্রী গন্ধ ভরে গেছিল এখন আবার সেই ধুনো ধুনো মতো কাঠের সুন্দর গন্ধ বেরোতে লাগলো।
এভাবে আর জেগে থাকার মানেহয়না; কাল সকালে আবার অনেকটা ড্রাইভ করতে হবে। তায় এত হেভি স্নো হচ্ছে, রাস্তাঘাট আদৌ পরিস্কার থাকবে কিনা, কত সময় লেগে যাবে কেজানে। তারচেয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। নিজেদের নিজেদের ঘরে গেল সবাই গুড নাইট করে দিয়ে।
শুতে এসে সুতপা দেখে অনিমেষ শুয়ে পড়েছে, আর সুতপার শোবার জায়গায় অ্যামিষ মহিলাদের তৈরী একটা ন্যাকড়ার পুতুল রাখা। এইধরনের চোখমুখ হীন ট্রেডিশনাল অ্যামিশ মহিলাদের পোশাক পরানো ন্যাকড়ার পুতুল নিয়েই আজও খেলে অ্যামিশ মেয়েরা। ওদের হস্তশিল্পের দোকান থেকে সকালে কিনেছিল সুতপা; প্রায় সারাটা দিন কলে করে ঘুরেছে, মাঝেমধ্যে কথাও বলছিল পুতুলটার সাথে। এখন সেটাকে অনিমেষ শুইয়ে রেখেছে দেখে সুতপা বলল
"ওকি ও এখানে কেন?"
"আমি কিজানি তোমার মেয়ে" দুষ্টুমিটা বুঝলো সুতপা; পুতুলটাকে উঠিয়ে ব্যাগে রেখে এলো। ব্যাগটা ঘরের কোনায় রাখা। পুতুল রেখে আসতেই টেনে নিল অনিমেষ
"আর কতদিন এইসব পুতুল নিয়ে খেলা হবে? এবার আমার জ্যান্ত পুতুল চাই"
"ধ্যাৎ! তুমি পুতুল দিয়ে কি করবে শুনি? আর পুতুল এলে মনেরেখো মধ্যিখানে থাকবে কিন্তু, তখন আর বৌকে এভাবে পাবেনা"
"সেটাও একটা কথা" বলতে বলতে ঘনিষ্ঠ হলো দুজনেই। এত ঠান্ডার রাত নিমেষে যেন বদলে গেল, শরীরী উষ্ণতায়।
ষোড়শ শতাব্দী তে ইউরোপে অ্যানাব্যাপ্টিস্ট মুভমেন্ট এর ফলে অ্যামিশ,মেননাইটস আর ব্রেথেনদের মত গ্রুপ গুলির জন্ম হয়। এইসব খ্রিস্টান ধর্মান্ধ গ্রুপ গুলির মধ্যে মিল থাকলেও এদের মধ্যে অ্যামিশরা সবচেয়ে গোঁড়া; সেটা বাড়তে বাড়তে এমন পর্য্যায়ে যে আজকের এই অত্যাধুনিক যুগেও তারা সেই প্রাচীন শতাব্দীতেই পড়ে আছে। আজও তারা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে, বিদ্যুত ব্যবহার করেনা, নিজেদের কাপড় জামা নিজেরাই চরখা কেটে তৈরী করে। অ্যামিশ মেয়েরা এক রংয়া পোশাক পরে; তাদের ছিটের পোশাক পরা মানা। পোশাকও সেই আদ্যিকালের পা অবধি ঝুলের ম্যাক্সি ধরণের লম্বা হাতার জামা, তার ওপর অ্যাপ্রন। ছেলেদের, মেয়েদের পোশাকে চেন বা সেই জাতীয় কিছু ব্যবহার হয়না; বোতাম দিয়ে দিয়ে আটকানো। ছেলেদের পোশাকে সাদা, কালো, ব্রাউন এই তিনটি মাত্র রংই থাকে। তারা কোনো একার ফটো রাখতে পারেনা; গ্রুপ ফটো ছাড়া।
এই হেনো অ্যামিশরা ১৭২০ সাল নাগাদ পূর্ব্ব আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া রাজ্যের পেনসিলভেনিয়া শহরের ল্যান্কেস্টার কাউন্টি তে চলে আসে এবং বসতি গড়ে তোলে। সেখানকার প্রায় সব চাষের জমিই এদের অধীনে; ফলতঃ এদের টাকা পয়সার বিন্দুমাত্র অভাবনেই। অভাব কি, এরা দারুন পয়সাওয়ালা তবে ওই প্রাচীন যুগকে আঁকড়ে পরে আছে এখনো। একটা মাত্র ঘরওয়ালা স্কুলে যায়, যেখানে ক্লাস এইটের ওপরে পরানো হয়না।
এখন ল্যান্কেস্টার হলো অ্যামিষদের সবচেয়ে পুরনো আর জনবহুল এলাকা। আধুনিক জগতের মানুষজন অ্যামিশদের দেখতে যায়; কি করে এমন ইন্টারনেটের যুগেও ওরা সেই প্রাচীন শতাব্দী তে বেঁচে রয়েছে। সেখানে অ্যামিশদের ওয়ান রুম স্কুল, তাদের তৈরী জ্যাম, জেলি, পাই এর দোকান, তাদের হস্তশিল্প, কামারের দোকান, তাদের ফার্ম এনিম্যাল সহ ফার্ম এই সব দেখে সাথে তাদের পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বাড়ি ঘর মানুষজন কেও দেখে।
তারা আজও সেই মোমের বা তেলের বাতি জ্বালায় রাত্রে, শীতের সময় শুধু মাত্র কাঠের চুল্লি দিয়ে ঘর গরম করে; কালো কালো ঘোড়ায়টানা গাড়িতে করে ঘোরে, একটা বিশেষ মরসুমে বিয়ে করে বলা বাহুল্য নিজেদের মধ্যেই। বিয়ের পর পুরুষেরা দাড়ি রাখে 'বিবাহিত পুরুষ' বোঝানোর জন্য। একেকটা পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক কারণ আজকের যুগেও সাত আটটি করে সন্তান জন্মায়। জন্মনেয় তারা বাড়িতেই, ধাইমা আসে, তার হাতেই।
ল্যান্কেস্টার বা তার আসেপাসে অ্যামিশ ভিলেজ ঘুরতে যাওয়া লোকজনদের থাকার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে; কিছু কিছু অবিকল অ্যামিশরা যেভাবে থাকেন সেই ভাবেই করা; অত্যাধুনিক ব্যবস্থাও আছে অবশ্য। মানুষজনের ঘুরতে বেড়াতে যাতে সুবিধা হয়। দিনের বেলা যেমন তেমন, রাতের বেলায় অমন ধু ধু করে চাষের জমি, সাথে সেই পুরনো ধাঁচের বাড়ি গুলোতে নিভু নিভু আলো, আলোর চেয়ে বুঝি অন্ধকার সৃষ্টি করে বেশি।
আর এমন পরিবেশে ভূত যে থাকতেই পারে সেটা বহু মানুষই বিশ্বাস করে। এমনিতেই আমেরিকানরা যথেষ্ট ভূত বিশ্বাস করে; তারা এমনও মানে কোনো কোনো জায়গায় ভূতেদের ঘনত্ব বেশিও আছে। যা কিনা 'কোল্ড স্পট' বলে পরিচিত।
গতবারের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই এবারের প্ল্যানটা সামারে করেছে সুতপা। অনিমেষের সামার ভ্যাকেশন শুরু হলেই তারা আবার যাবে অ্যামিশ ভিলেজ। তারা বলতে শুধু সুতপা অনিমেষই নয়; তাদের অসম বয়সী বন্ধুদের গ্রুপ কেভিন, অ্যালেন, লিসা, শেরিল, রজিত আর পূজা। সুতপা এক্কেবারেই ভূত মানেনা; যদিও অনেকেই তাকে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছে, যে, যেমন হাওয়া বা ঈশ্বরকেও তো চোখে দেখা যায়না তবু তা' আছে। ঠিক তেমনি ভূতও থাকতেই পারে। সেসবে অবশ্য সুতপার নিজের অবস্থান থেকে নড়ার ইচ্ছে হয়েছে তেমন নয়।
সুতপা অনিমেষ দুজনেই গ্রাম বাংলার ছেলে মেয়ে। অনেকটা কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে শহরে এসে বাকিটুকু করেছে। সৌভাগ্য ক্রমে দুজনের দেখা, বিয়ে, এবং আমেরিকায় পাড়ি। অনিমেষ পোস্ট ডক্টরেট করে আর পড়ায়; সুতপা প্রথমদিকে টুকটাক ভল্যান্টিয়ার করে এখন একটা নামী হোলসেল সেন্টারে কাজ করে। বছর চারেক হয় ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর পরই আমেরিকায় এসে হনিমুনে গেছিল অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডা; ডিজনি ওয়ার্ল্ড। ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভের বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলে উঠেছিল; তাদের হোটেলের মিনিবাসের বন্দোবস্ত ছিল ডিজনির পার্ক গুলোতে যাওয়ার, কাজেই সুবিধে হয়েছিল ওদের। সেবারে ওই ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভের রেড রুফ ইন হোটেলটা খুব বাজে ভাবে আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেখানকার মানুষজনকে অন্য অন্য হোটেলে সরিয়ে নেওয়া হয়। কেভিন, অ্যালেন, লিসা, শেরিল, রজিত, পূজা রা ছিল রেড রুফ ইনে। ওদেরকে বেস্ট ওয়েস্টার্ন-এ স্থানান্তরিত করে কর্তৃপক্ষ। ওরা সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রী। অনিমেষ, সুতপার সাথে ওদের প্রাথমিক পরিচয় ডিজনি যাওয়ার মিনিবাসে। পরে জানা যায় অনিমেষের সাথে ওদের সাবজেক্টের মিল আছে; কাজেই আরওই ঘনিষ্ঠ হয়ে পরে ওরা। খুবই প্রানবন্ত ছেলেমেয়ে গুলো। পড়াশোনায় তুখোর, ঘুরতে বেড়াতে ভালবাসে, প্রচুর গল্প করে, গান গায় গিটার বাজায়। শুধু ওদের একটাই ব্যাপার সুতপার অপছন্দ, ওরা ভুতে বিশ্বাস করে। ওরা নাকি সুতপাকে প্রমান দিয়েই ছাড়বে ভূত আছে। অনিমেষ নিজে ভুতে বিশ্বাস করেনা তবে কেউ ভুতে বিশ্বাস করে শুনলে ওর সুতপার মত রাগও হয়না।
সুতপাকে ভূত দেখানোর পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা সবাই গত শীতে গেছিল অ্যামিশ ভিলেজ। সেখানে ঠিক অ্যামিশরা যেভাবে থাকে তেমন থাকার ব্যবস্থাওয়ালা হোটেল খুঁজে বের করেছিল ওরা। ওই প্রবল ঠান্ডায় শুধু মাত্র কাঠের আগুনে গরম করা ঘর, বিকেল হওয়ার আগেই যেন রাত্রি নামবে, আর অত লম্বা রাত্রি কাটানো। জেগে থাকার সময়টা মোম কিম্বা তেলের বাতি জ্বালিয়ে কাজ কর্ম সারা। পুরনো আমলের কাঠের বাড়ি, ঘরের ভেতর দেওয়ালে হলদে হয়ে যাওয়া অ্যামিশ পরিবারের ফটো, বিশেষ আর কোনো সজ্জা নেই, অ্যামিশ দের তৈরী লেপ কম্বল পাতা বিছানায়।
সন্ধ্যের সময় কিছু হয়েলের কর্মচারী অ্যামিশদের মত সাজপোশাকে এসে ঘরে আলো জ্বালালো; টেবিলে ট্রেডিশনাল অ্যামিষ ক্রিস্টমাস মেন্যু গরম গরম পরিবেশন করলো। আর অনেক খানি কাঠ দিয়ে গেল যাতে সারারাত অসুবিধা না হয়।
ওরা মিট্লোফ, অ্যামিশ হ্যাম এন্ড চীজ, ডাম্পলিংস, অ্যামিশ সসেজ বলস, পেনসিলভেনিয়া ডাচ গ্রিন বীনস, অ্যামিশ বানানা ব্রেড, পিচ এন্ড প্লাম জ্যাম, অ্যামিশ ব্রেড পুডিং, গুয়ী অ্যামিশ ক্যারামেল পাই এই সবের মত নতুন ধরনের সুস্বাদু সব খাবার খেল আনন্দ করেই। সারা ঘরে পাইন, ফার, চেরি, রেডওক, এমন বিভিন্ন কাঠের গন্ধ ঘুরছে। সাধারনতঃ এই সব কাঠই ফায়ার প্লেসে ব্যবহার করা হয় ফায়ার উড হিসাবে।
খেয়ে উঠে ওরা ফায়ার প্লেসের আশেপাশে বসেছিল; বাইরে বেস স্নো হতে শুরু করেছে। ঘরের ভেতরে আলো আঁধারী; প্রত্যেকের ছায়া গুলোই যেন দেওয়ালের অন্ধকার বাড়াচ্ছে। অনিমেষ তার বহু চর্চ্চিত ছোটবেলার অভিজ্ঞতা শোনাতে লাগলো; এগুলো শুনে শুনে কান পচে গেছে সুতপার।
"ছোটবেলায় গ্রামে থাকতাম; গ্রাম মানে এক্কেবারে অজ পাড়াগা। কাঁচা মাটির রাস্তা, বেশির ভাগ মাটির বাড়ি টালির বা খড়ের চাল। আমরা সব কিছুর জন্যই দূর দূর হাঁটতাম।
কি স্কুল যাওয়া, কি শ্মশান যাওয়া; গ্রামের সে-ই-এ-ক কোনায় শ্মশান তিনচারটে গ্রামের জন্য ওই একটাই ব্যবস্থা। মোটামুটি সাত আট মাইল হাঁটা পথ; সে পথও তেমনি ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে নয় বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে। বর্ষাকালে তো আরওই ভালো কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া যেতনা রাস্তাঘাট। তারওপর বহু মানুষই এত গরিব ছিল যে পুরো দাহ করতে যে পরিমান কাঠ লাগে সেটা কেনার মত পয়সাও থাকত না ফলে অর্দ্ধেক দাহ করে মাটি চাপা দিয়ে চলে যেত; একটা আধা মজে যাওয়া খাল ছিল বর্ষায় বেশ জল হত অনেক সময় সাপে কাটা দেহ ওই খালে ভাসিয়ে দিয়ে যেত লোকে। ফলতঃ শ্মশানের পরিবেশ ভয়ঙ্করই ছিল।
মাঝে মাঝেই বন্ধুদের কাছে সাহসিকতার পরিচয় দিতে ওই শ্মশানে অমাবস্যার রাত্রে গিয়ে বড় নিম গাছে নিজের নাম খোদাই করে আসতে হত। আমিও বার দুয়েক করেছি; পরে আর কেউ আমায় চ্যালেঞ্জ দিতনা। একবার শীতের রাত্রেও গেছিলাম। অন্ধকার চারিদিক, গাছের মধ্যে দিয়ে হাওয়া পাস করে হু হু শব্দ, শিয়ালের বুক কাঁপানো ডাক, বাঁশঝাড়ে শিয়ালের চোখ জোনাকি জ্বলতে থাকত, ঝাড়ের মরমর আওয়াজ, সাথে ওই নোংরা পরিবেশ, দুর্গন্ধ। আমাদের এক বন্ধু তো মারাই গেল; কাঁটা গাছে চাদর আটকে গেছিল ওর, নাম খোদাই করে পিছন ফেরার পর, আর তাতেই..."
গলা নীচু করে এমন গল্পের মত করে অনিমেষ বলে ঘটনাগুলো, তাতে আরও গা ছম্ছম পরিবেশ। ফায়ার প্লেসের আগুনটা দপ্দপ করছে, সুতপা উঠে কটা কাঠ গুঁজে দিল। কি কাঠ কেজানে, যেমন ধোঁয়া হয়ে গেল, তেমনি বিশ্রী পচা গন্ধ ভরে গেল ঘরে। কাঁচা কাঠ তো বটেই ফালতু কোনো গাছের কাঠ নিশ্চয়ই।
গল্প শেষ হলে পর ওরা সুন্দর করে গান ধরল গিটার বাজিয়ে; বেশ কটা গাইলো। সুতপাও যথেষ্ট ভালো গায়; যদিও বাংলা গান, মানে না বুঝলেও শ্রুতিমধুর লাগে ওদের। ফ্লোরিডাতে শুনিয়েছিল, কাজেই এবারে অনুরোধ এলো সুতপার কাছে। ঠান্ডা লাগা না কিসের জন্য কেজানে, সুতপার গলা এমন আটকে যেতে লাগলো কিছুতেই ঝেড়ে কেশেও গান গাওয়ার উপযুক্ত পরিষ্কার হলোনা। অনেক সময় ধরেই ফায়ার প্লেসের আগুনটা দপ্দপ করছিল সুতপা কাঠ দেওয়াতেও উন্নতি হয়নি; এখন হঠাৎ যেন চিমনি দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে নিভিয়ে দিল আগুনটা, শুধু কাঠ গুলো লাল হয়ে ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগলো। অ্যালেন উঠে নতুন করে কাঠ দিয়ে জ্বালিয়ে দিল ফায়ার প্লেস; আগের বার সুতপা কাঠ দেওয়াতে বিশ্রী গন্ধ ভরে গেছিল এখন আবার সেই ধুনো ধুনো মতো কাঠের সুন্দর গন্ধ বেরোতে লাগলো।
এভাবে আর জেগে থাকার মানেহয়না; কাল সকালে আবার অনেকটা ড্রাইভ করতে হবে। তায় এত হেভি স্নো হচ্ছে, রাস্তাঘাট আদৌ পরিস্কার থাকবে কিনা, কত সময় লেগে যাবে কেজানে। তারচেয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। নিজেদের নিজেদের ঘরে গেল সবাই গুড নাইট করে দিয়ে।
শুতে এসে সুতপা দেখে অনিমেষ শুয়ে পড়েছে, আর সুতপার শোবার জায়গায় অ্যামিষ মহিলাদের তৈরী একটা ন্যাকড়ার পুতুল রাখা। এইধরনের চোখমুখ হীন ট্রেডিশনাল অ্যামিশ মহিলাদের পোশাক পরানো ন্যাকড়ার পুতুল নিয়েই আজও খেলে অ্যামিশ মেয়েরা। ওদের হস্তশিল্পের দোকান থেকে সকালে কিনেছিল সুতপা; প্রায় সারাটা দিন কলে করে ঘুরেছে, মাঝেমধ্যে কথাও বলছিল পুতুলটার সাথে। এখন সেটাকে অনিমেষ শুইয়ে রেখেছে দেখে সুতপা বলল
"ওকি ও এখানে কেন?"
"আমি কিজানি তোমার মেয়ে" দুষ্টুমিটা বুঝলো সুতপা; পুতুলটাকে উঠিয়ে ব্যাগে রেখে এলো। ব্যাগটা ঘরের কোনায় রাখা। পুতুল রেখে আসতেই টেনে নিল অনিমেষ
"আর কতদিন এইসব পুতুল নিয়ে খেলা হবে? এবার আমার জ্যান্ত পুতুল চাই"
"ধ্যাৎ! তুমি পুতুল দিয়ে কি করবে শুনি? আর পুতুল এলে মনেরেখো মধ্যিখানে থাকবে কিন্তু, তখন আর বৌকে এভাবে পাবেনা"
"সেটাও একটা কথা" বলতে বলতে ঘনিষ্ঠ হলো দুজনেই। এত ঠান্ডার রাত নিমেষে যেন বদলে গেল, শরীরী উষ্ণতায়।
মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙ্গে সুতপার, বিকট ঠান্ডা লাগছে; উঠে দেখে ফায়ার প্লেসের আগুন নিভে রয়েছে। সুন্দর করে ছাই সরিয়ে, কাঠ সাজিয়ে জ্বালাতে গেল; কত চেষ্টা তেও জ্বললো না। ডাকতেই হলো ঘুমন্ত অনিমেষকে। অনিমেষ আসতেই মুহুর্তে জ্বলে উঠলো আগুন।
সকালে উঠে ওরা বেশ অবাক; সারাটা রাত এত স্নো হলো, সকালে তার প্রায় কোনো চিহ্নই নেই। ভোররাত্রে বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে গেছে নাকি?! বাইরের ঘরে এসে দেখে আরেক কান্ড; সুতপার ওই পুতুলটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পরে আছে ফায়ার প্লেসের পাশে, নিশ্চয়ই ইঁদুরের উৎপাত। সুতপা যদিও একটু মনক্ষুন্ন হলো। ব্রেক ফাস্ট খেয়ে ওরা চেক আউট করলো; বাজে কাঠ আর পুতুলটা ইঁদুরে কাটা এদুটো বলি বলি করেও কমপ্লেন করলনা।
এই ছিল গতবারের অভিজ্ঞতা। এবারে সামারে যাবে, আর ক্যাম্পে থাকাই সাবস্ত হয়েছে। অ্যালেন লিসা দের গ্রুপটাও আসছে; সুতপার বেশ মজা লাগে ওদের এই যে কোনো সাধারণ ঘটনাকে ভৌতিক বলে আখ্যা দেওয়া। গতবার অ্যামিশ ভিলেজে ঘটা ঘটনা গুলোর একটাতেও সুতপা কিন্তু ভয় পায়নি। এবারও ওদের সেই একই চ্যালেঞ্জ, ভূত আছে প্রমান দেখাবেই ওরা সুতপাকে; বেশ।
সারাটা দিন ওরা অ্যামিশ ভিলেজের এদিক ওদিক ঘুরল; সুতপা আবার একটা পুতুল কিনলো অনিমেষকে দেখিয়ে দেখিয়ে। একটা নদীর ধরে ক্যাম্প, আরো অনেক ক্যাম্পার্স রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ব্যবস্থা পত্র এদের বেশ ভালই; ওদের টেন্টটা একটা কোনায়, অন্য টেন্ট গুলোর থেকে একটু আলগা। এমন মনোরম পরিবেশে মজা করে বার-বে-কিউ করে আনন্দে কাটলো সারাটা দিন। সন্ধ্যায় ক্যাম্প ফায়ারের পাশে বসে অনিমেষের সেই শ্মশানের গল্প; কোন একবার নাকি গাছে নাম লিখতে গিয়ে পায়ের নীচে কিছু একটা পড়েছিল। অনিমেষ আলো জ্বালিয়ে দেখার সুযোগ পায়নি তবে তার অনুমান ওটা কোনো শবদেহের অংশ বিশেষ। অনিমেষ এই ঘটনা গুলো এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে বর্ণনা করে, যেটা শুনলে শিউরে ওঠা স্বাভাবিক। তার এই অভিজ্ঞতার কথা কেন জানি এই গ্রুপটা শুনতে চায় প্রতিবারই। গল্প চলাকালীন ক্যাম্প ফায়ারের আগুনটা দপ্দপ করতে শুরু করলো, সুতপা কাঠ দেওয়াতে ধোঁয়া উঠলো খুব, সাথে বিশ্রী পচা গন্ধ। নদীর ধারে তাই, হাওয়ায় গন্ধটা উড়েও গেল একটু সময়ের মধ্যেই। অনিমেষের গল্পের পর ওরা গিটার বাজিয়ে গান ধরল, এবারে নাচও। ওদের নাচ গানের পর সুতপাকে অনুরোধ গান গাইতে। রাত বেড়েছে এখন সুতপার শ্রুতিমধুর গান মানানসই হবে। এত সময় হৈ হুল্লোর, নাচ ইত্যাদি করার ফলেই মনেহয় সুতপার গলা আটকে গেল, অনেক ঝেড়ে কেশেও গান করার উপযুক্ত পরিস্কার হলোনা। ক্যাম্প ফায়ারটাও হঠাৎই একটা দমকা হাওয়া এসে যেন ফু দিয়ে নিভিয়ে দিল। উঠে পড়ল সবাই, ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। এবারে ওরা ক্রস কান্ট্রি ড্রাইভিংএর প্ল্যান করেছে; পেনসিলভেনিয়ার থেকে ওরা ড্রাইভ করবে ফ্লোরিডার ট্যাম্পায়। অনিমেষের বেশ সিনিয়র একজন কুমারেশদা, সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতেই পড়ায় সম্প্রতি খোঁজ পেয়েছে অনিমেষ; অতএব কেভিনদের নিয়ে ওদেরকে পৌঁছেও দেবে আর কুমারেশদার সাথে দেখাও করে আসবে। মোটামুটি ১৫/১৬ ঘন্টার ড্রাইভ; পালা করে করে চালাবে তাতে রাত্রে কোথাও না থাকলেও চলবে। এদেশে তো বেশ লম্বা সামার ভ্যাকেশন পাওয়া যায়; এবারের ভ্যাকেশন এই ভাবেই কাটাবে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সুতপা দেখে ওর পুতুলটা ক্যাম্প ফায়ারের ফায়ার প্লেসের পাশে ছিন্নভিন্ন হয়ে পরে আছে। এখানেও ইঁদুর? হতেই পারে; নাঃ আর একবারও কিনবেনা ওই পুতুল।
***********
টানা এতটা সময় গাড়িতে থেকে, ড্রাইভ করে, ক্লান্ত লাগছিল সুতপা অনিমেষের। কুমারেশদার বাড়ি যখন পৌঁছল তখন বেশ রাত। যদিও এত বছর পর দেখা আর সুতপার সাথে তো প্রথমবার কিন্তু বেশি সময় আলাপ জমলনা। সকালে উঠে কথা বলাই শ্রেয়।
স্বান্তনা বৌদি বেশ আর্লি রাইজার; সকাল সকাল রান্নার আর কফির সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। ঘুম ভেঙ্গে সুতপা দেকে ওঠাল অনিমেষকে; দুজনে ফ্রেশ হয়ে নীচের তলায় এসে কফি সহযোগে বসলো ওদের লিভিংরুমে। অনেক ছবি টাঙানো লিভিংরুমের দেওয়ালে; সুতপা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। কুমারেশদা স্বান্তনা বৌদির অল্প বয়সের ছবি, বিয়ের ছবি, আমেরিকায় আসার পরের ছবি, ছেলেমেয়েদের ছবি, নিজেদের ডিপার্টমেন্টএর ছবি। পরবর্তী ছবিটা একটু বড়, একটা গ্রুপ ফটো, সেখানে নীচে বড় বড় হরফে লেখা আছে R.I.P. আর আরও কিছু লেখা; কাছে এগিয়ে দেখল সুতপা, কুমারেশদার ডিপার্টমেন্টএর কিছু প্রানবন্ত, অত্যন্ত্য মেধাবী ছাত্র ছাত্রী যারা বছর চারেক আগে অরল্যান্ডো ঘুরতে গিয়ে রেড রুফ ইনের বিদ্ধ্বংসী আগুনে প্রাণ হারায়।
ছবিতে কেভিন, অ্যালেন, লিসা, শেরিল, রজিত আর পূজা।
সকালে উঠে ওরা বেশ অবাক; সারাটা রাত এত স্নো হলো, সকালে তার প্রায় কোনো চিহ্নই নেই। ভোররাত্রে বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে গেছে নাকি?! বাইরের ঘরে এসে দেখে আরেক কান্ড; সুতপার ওই পুতুলটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পরে আছে ফায়ার প্লেসের পাশে, নিশ্চয়ই ইঁদুরের উৎপাত। সুতপা যদিও একটু মনক্ষুন্ন হলো। ব্রেক ফাস্ট খেয়ে ওরা চেক আউট করলো; বাজে কাঠ আর পুতুলটা ইঁদুরে কাটা এদুটো বলি বলি করেও কমপ্লেন করলনা।
এই ছিল গতবারের অভিজ্ঞতা। এবারে সামারে যাবে, আর ক্যাম্পে থাকাই সাবস্ত হয়েছে। অ্যালেন লিসা দের গ্রুপটাও আসছে; সুতপার বেশ মজা লাগে ওদের এই যে কোনো সাধারণ ঘটনাকে ভৌতিক বলে আখ্যা দেওয়া। গতবার অ্যামিশ ভিলেজে ঘটা ঘটনা গুলোর একটাতেও সুতপা কিন্তু ভয় পায়নি। এবারও ওদের সেই একই চ্যালেঞ্জ, ভূত আছে প্রমান দেখাবেই ওরা সুতপাকে; বেশ।
সারাটা দিন ওরা অ্যামিশ ভিলেজের এদিক ওদিক ঘুরল; সুতপা আবার একটা পুতুল কিনলো অনিমেষকে দেখিয়ে দেখিয়ে। একটা নদীর ধরে ক্যাম্প, আরো অনেক ক্যাম্পার্স রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ব্যবস্থা পত্র এদের বেশ ভালই; ওদের টেন্টটা একটা কোনায়, অন্য টেন্ট গুলোর থেকে একটু আলগা। এমন মনোরম পরিবেশে মজা করে বার-বে-কিউ করে আনন্দে কাটলো সারাটা দিন। সন্ধ্যায় ক্যাম্প ফায়ারের পাশে বসে অনিমেষের সেই শ্মশানের গল্প; কোন একবার নাকি গাছে নাম লিখতে গিয়ে পায়ের নীচে কিছু একটা পড়েছিল। অনিমেষ আলো জ্বালিয়ে দেখার সুযোগ পায়নি তবে তার অনুমান ওটা কোনো শবদেহের অংশ বিশেষ। অনিমেষ এই ঘটনা গুলো এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে বর্ণনা করে, যেটা শুনলে শিউরে ওঠা স্বাভাবিক। তার এই অভিজ্ঞতার কথা কেন জানি এই গ্রুপটা শুনতে চায় প্রতিবারই। গল্প চলাকালীন ক্যাম্প ফায়ারের আগুনটা দপ্দপ করতে শুরু করলো, সুতপা কাঠ দেওয়াতে ধোঁয়া উঠলো খুব, সাথে বিশ্রী পচা গন্ধ। নদীর ধারে তাই, হাওয়ায় গন্ধটা উড়েও গেল একটু সময়ের মধ্যেই। অনিমেষের গল্পের পর ওরা গিটার বাজিয়ে গান ধরল, এবারে নাচও। ওদের নাচ গানের পর সুতপাকে অনুরোধ গান গাইতে। রাত বেড়েছে এখন সুতপার শ্রুতিমধুর গান মানানসই হবে। এত সময় হৈ হুল্লোর, নাচ ইত্যাদি করার ফলেই মনেহয় সুতপার গলা আটকে গেল, অনেক ঝেড়ে কেশেও গান করার উপযুক্ত পরিস্কার হলোনা। ক্যাম্প ফায়ারটাও হঠাৎই একটা দমকা হাওয়া এসে যেন ফু দিয়ে নিভিয়ে দিল। উঠে পড়ল সবাই, ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। এবারে ওরা ক্রস কান্ট্রি ড্রাইভিংএর প্ল্যান করেছে; পেনসিলভেনিয়ার থেকে ওরা ড্রাইভ করবে ফ্লোরিডার ট্যাম্পায়। অনিমেষের বেশ সিনিয়র একজন কুমারেশদা, সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতেই পড়ায় সম্প্রতি খোঁজ পেয়েছে অনিমেষ; অতএব কেভিনদের নিয়ে ওদেরকে পৌঁছেও দেবে আর কুমারেশদার সাথে দেখাও করে আসবে। মোটামুটি ১৫/১৬ ঘন্টার ড্রাইভ; পালা করে করে চালাবে তাতে রাত্রে কোথাও না থাকলেও চলবে। এদেশে তো বেশ লম্বা সামার ভ্যাকেশন পাওয়া যায়; এবারের ভ্যাকেশন এই ভাবেই কাটাবে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সুতপা দেখে ওর পুতুলটা ক্যাম্প ফায়ারের ফায়ার প্লেসের পাশে ছিন্নভিন্ন হয়ে পরে আছে। এখানেও ইঁদুর? হতেই পারে; নাঃ আর একবারও কিনবেনা ওই পুতুল।
***********
টানা এতটা সময় গাড়িতে থেকে, ড্রাইভ করে, ক্লান্ত লাগছিল সুতপা অনিমেষের। কুমারেশদার বাড়ি যখন পৌঁছল তখন বেশ রাত। যদিও এত বছর পর দেখা আর সুতপার সাথে তো প্রথমবার কিন্তু বেশি সময় আলাপ জমলনা। সকালে উঠে কথা বলাই শ্রেয়।
স্বান্তনা বৌদি বেশ আর্লি রাইজার; সকাল সকাল রান্নার আর কফির সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। ঘুম ভেঙ্গে সুতপা দেকে ওঠাল অনিমেষকে; দুজনে ফ্রেশ হয়ে নীচের তলায় এসে কফি সহযোগে বসলো ওদের লিভিংরুমে। অনেক ছবি টাঙানো লিভিংরুমের দেওয়ালে; সুতপা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। কুমারেশদা স্বান্তনা বৌদির অল্প বয়সের ছবি, বিয়ের ছবি, আমেরিকায় আসার পরের ছবি, ছেলেমেয়েদের ছবি, নিজেদের ডিপার্টমেন্টএর ছবি। পরবর্তী ছবিটা একটু বড়, একটা গ্রুপ ফটো, সেখানে নীচে বড় বড় হরফে লেখা আছে R.I.P. আর আরও কিছু লেখা; কাছে এগিয়ে দেখল সুতপা, কুমারেশদার ডিপার্টমেন্টএর কিছু প্রানবন্ত, অত্যন্ত্য মেধাবী ছাত্র ছাত্রী যারা বছর চারেক আগে অরল্যান্ডো ঘুরতে গিয়ে রেড রুফ ইনের বিদ্ধ্বংসী আগুনে প্রাণ হারায়।
ছবিতে কেভিন, অ্যালেন, লিসা, শেরিল, রজিত আর পূজা।
No comments:
Post a Comment