শিকড়ের সন্ধানে---(৪)
পঞ্চকোট রাজ ও পঞ্চকোট রাজপরিবারের ইতিহাস লিখতে আমি আগ্রহী নই, আমি আমার পারিবারিক ইতিহাস রচনাতেই আগ্রহী। কিন্তু আমার পরিবারটি এই রাজ পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকার জন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা।
পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজধানী বারে বারেই পরিবর্তিত। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, যুদ্ধে বিপর্য্যয়ের জন্য, প্রাকৃতিক বিপর্য্যয়ের জন্য, কিংবা রাজা-মহারাজাদের খেয়াল খুশি--যে কোন কারণেই হোক কখনও পঞ্চকোট গড়, কখনও পাড়া (বর্তমানে পুরুলিয়া জেলায় একটি স্থান), কখনো কাশীপুর (এটিও পুরুলিয়া জেলায় আদ্রা নামক রেল স্টেশনের নিকটবর্তী একটি স্থান) এভাবে স্থান বদল হয়েছে। আবার একই জায়গায় পুরাতন রাজবাড়ি ভেঙ্গে নতুন রাজবাড়ি গড়ে উঠেছে। পঞ্চকোট শিখরভূমের অন্তর্গত বলে তৈলকম্প বা তেলকূপীকেও পুরাতন রাজধানী বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে গোপভূমি বা গোপরাজাদের কারো দ্বারা এই রাজ্য প্রতিষ্ঠিত। নানান মতের ভারে পঞ্চকোটের রহস্য ক্রমে বেড়েই চলেছে।
‘সম্বন্ধ নির্ণয়’ নামে ছোট্ট পুস্তিকাটিতে পঞ্চকোট রাজপরিবারের যে দীর্ঘ তালিকা পাই, হয়ত এই গ্রন্থের লেখক পঞ্চকোট রাজাদের প্রশস্তি রচনা থেকে তা গ্রহণ করেছেন। রাখালচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘পঞ্চকোটের ইতিহাস’ নামক বইটিতে বলা হয়েছে এই রাজারা ক্ষত্রিয় বংশদ্ভূত। রাজাদের প্রশস্তি রচনায় অনেক সময় যা সত্যি নয় তাও লেখা হয়ে থাকে। রাজপরিবার ও রাজাদের গুণাবলী জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য, প্রজাদের মধ্যে রাজপরিবার সম্বন্ধে মানসম্ভ্রম জাগিয়ে তোলার জন্য এমন করা সম্ভব। যারা ইতিহাস চর্চা করেন তাদের অনেকের মতে, এই রাজারা স্থানীয় অধিবাসী, ভূমিজ বা সর্দার স্থানীয় লোক। ক্রমেই, বিষয়, ভূসম্পত্তির মালিক ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজেদের রাজা বলে ঘোষিত করেছেন। এই মতটিও অস্বীকার করা যায় না। বিনয় ঘোষের ‘পশ্চিমবঙ্গের সংষ্কৃতি’ তে এই ধরণের উল্লেখ দেখতে পাই।
তরুণদেব ভট্টাচার্য্যের পুরুলিয়ার উপর একখানি গ্রন্থে দেখেছি, তিনিও এদের স্থানীয় অধিবাসী বলেই চিহ্নিত করেছেন। এমন কি রাজাদের টোটেম ছিল গরুর লেজ, যাকে তাঁরা বলতেন ’ ছাঁওয়ার বান্ধা’ এমন উল্লেখও আছে। অনেক আগে পুরাতন রাজারা নাকি তা ব্যবহার করতেন। এইরকম কোন কিছুর সংবাদ কিন্তু অন্যত্র বা আমার পরিবারের কারুর কাছ থেকে পাইনি বা শুনিনি। অন্যান্য গ্রন্থেও এর কোন উল্লেখ পাইনি, যদিও রাজারা স্থানীয় ভূমিজ অধিবাসী, একথা অনেকেই মনে করেছেন।
পুরুলিয়া পুলিশ লাইনের কাছে ‘তারাভবনে’ রাজপরিবারভুক্ত একটি পরিবার বাস করেন। ‘তারাভবনের’ শ্রী সোমেশ্বর মিশ্র লালসিংহদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আরও কিছু তথ্য জানা গেছে। পঞ্চকোট রাজপরিবারের যাঁরা রাজকুমার তাঁরা সকলেই লালসিংহদেব নামে উল্লেখিত। যুবরাজ, যিনি পরে রাজ সিংহাসনের পদপ্রার্থী তিনি ছাড়া বাকি কুমাররা সকলেই লালসিংহ। সোমেশ্বর লালসিংহের কথাতেও পঞ্চকোট রাজপরিবার যে ক্ষত্রিয় বংশজাত, এই গরিমা ছিল। কিন্তু এছাড়াও তিনি যে কথাগুলি জানান, তার থেকে এই রাজপরিবার সম্বন্ধে আরও কিছু অনুমানও করে নেওয়া যায়। তাঁর কাহিনি এইরকম----
রাজা দামোদর সিংহের(২ শকাব্দ--৬২ শকাব্দ) পিতা জগৎ সিংহ জগন্নাথ দর্শনে যাবার পথে অধুনা পুরুলিয়া জেলার ঝালদার নিকট তাঁর অন্তঃসত্ত্বা মহীষী অসুস্থ হয়ে পড়েন, রাজা তাঁকে রেখে একাই তীর্থযাত্রা করেন। ফিরে এসে মহীষীর মৃত্যু সংবাদ পান এবং পুত্রকে স্থানীয় আদিবাসীদের দ্বারা পালিত হতে দেখেন। রাজা জগৎ সিংহ কুমারকে নিয়ে নিজ রাজত্বে (রাজস্থানের ধার রাজ্য) গমন করেন, কুমারের বয়ঃপ্রাপ্তির পর ফিরে এসে স্থানীয় অধিবাসীদের একত্রিত করে পুত্র দামোদর সিংহকে রাজা করেন। কিন্তু ততদিনে সেই বয়স্ক স্থানীয় আদিবাসীরা সকলেই মৃত। সেই মানুষগুলির উপকার এবং সততার পুরস্কার স্বরূপ রাজা ওই সাতজন স্থানীয় অধিবাসীকে ‘রাণা’ নামে ভূষিত করেন। শ্রী সোমেশ্বর সিংহদেবের মতে, ভারতের ইতিহাসে পঞ্চকোট রাজপরিবারই প্রথম এইভাবে মরনোত্তর পুরস্কার প্রচলিত করেন। এখনো পর্য্যন্ত রাজপরিবারের কোন অনুষ্ঠানে ওই সাতজন রাণার নামে একটি নতুন মাটির হাঁড়িতে কলাই এর ডাল ও চালের খিচুড়ি রান্না করে স্থানীয় কোন পুকুরের পাড়ে নিবেদন করা হয়। ওই সাতজন স্থানীয় আদিবাসীদের প্রতি এভাবেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়।
এই কাহিনি থেকে একটা কথা কিন্তু পরিষ্কার যে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ বহু আগে থেকেই ছিল। হয়ত বা তাঁরা নিজেরাই তা ছিলেন। আদতে, পঞ্চকোটকে বলা হয় বাইশ কাহানের রাজ্য। ঝালদা, জয়পুর, কাতরাস(ধানবাদের কাছে) প্রভৃতি এক একটি কাহান। এইগুলি শাসন করতেন স্থানীয় অধিবাসীরাই। সেই সেই অঞ্চলের দায়িত্ব অর্পণ করা থাকত সেই অঞ্চলের ভূস্বামী বা সর্দারের উপরে। তারা ছিলেন ভূমিজ, যাদের পদবী ছিল সিং বা সর্দার, পরে তারা নিজেদের উপাধি ’সিংহদেব’ ধারণ করেন। হয়ত এভাবেই বিভিন্ন ছোটখাটো রাজপরিবারের মানুষের সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়তাও গড়ে উঠেছিল। কাহিনির সত্যতা কতটা আজ আর জানা যায় না।
কিন্তু ঘটনা যাই হোক না কেন, স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে একটা যে মিশ্রণ ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। একটি কথা স্বীকার করতেই হয়, দীর্ঘ কয়েকশ বছর শুধু নয়, প্রায় দু হাজার বছরের উপর এই রাজ পরিবারের রাজাদের যে দীর্ঘ তালিকা পাওয়া গেছে (সম্বন্ধ নির্ণয় বই অনুসারে) তার কিছুটাও যদি সত্য হয় তাহলে মানভূম, জঙ্গলমহল ও বাংলার রাজ্য-রাজনীতিতে এই রাজ্য ও রাজাদের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও অবদানের কথা অবশ্যস্বীকার্য্য।
স্থানীয় অধিবাসী হলেও বর্গী হাংগামারও অনেক আগে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট প্রদেশের রাজাদের আক্রমণের ফলে পঞ্চকোটে রাজ্য এবং রাজ পরিবারে তাদের সংমিশ্রণ ঘটে। পরে বিষয়-ধনসম্পত্তির মালিক ও রাজা হবার ফলে বিবাহ ইত্যাদি কারণে অন্যান্য রাজ পরিবারের সঙ্গেও সংমিশ্রণ ঘটেছিল। পরবর্তী কালে পঞ্চকোট প্রভূত শক্তিধর একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যার রাজত্বকাল চলেছিল বহু বছর ধরে এবং পঞ্চকোট রাজাদের রাজত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বে কৃষক বিদ্রোহে মহারাজ নীলমণি সিংহদেবের(মৃত্যু বাংলা ১৩০৫) নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ পর্য্যন্ত বই, পুঁথিপত্র, চিঠি, দলিল-দস্তাবেজ, বংশলতিকা ইত্যাদি দেখে এবং অনুমান করে যা মনে হয়েছে তা এইরকম-----ফুলিয়া থেকে কবি কৃত্তিবাস ওঝার পরিবারভুক্ত মুখো বংশীয় একটি শাখা (খুব সম্ভবতঃ সুসেন পন্ডিতের শাখা, কারণ সুসেনের ভাই গঙ্গানন্দ প্রথম দেবীবর ঘটক দ্বারা ফুলিয়া মেলের অধিকারী হন) অন্যত্র বসবাসের জন্য ফুলিয়া গ্রাম থেকে উঠে আসেন। সরাসরি ফুলিয়া থেকে নবদ্বীপেও বিদ্যাশিক্ষা লাভের জন্য আসা বিচিত্র নয়। আবার কৃত্তিবাস পরিবারের অন্য একটি শাখাও এই বংশের পূর্বপুরুষ হতে পারেন, এখনো সেই সম্বন্ধে পুরোপুরি জানা যায়নি। যে শাখাটি অন্যত্র গমন করেন অথবা পরে নবদ্বীপে আসেন কর্মসূত্রে কিংবা বিদ্যাশিক্ষা লাভের জন্য, সেই ধারায় জন্মগ্রহণ করেন জানকীনাথ তর্কচূড়ামণি, রামভদ্র সার্বভৌম, শ্রীরাম তর্কালঙ্কার, মথুরানাথ এবং তস্য ভ্রাতা গোপীকান্ত চক্রবর্তী সার্বভৌম। মথুরানাথ সম্বন্ধে আগেই বিশদভাবে জানা গেছে(‘বঙ্গে নব্যন্যায়চর্চা’ গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য)। মথুরানাথের অপর ভ্রাতা গোপীকান্তও বড় পন্ডিত ছিলেন। গোপীকান্ত কাশীতে অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনার জন্য চলে যান। বাংলায় তাঁর রচনা তেমন প্রসার লাভ করেনি কিন্তু এক তাঞ্জোরেই তাঁর রচিত আঠারোটি অনুলিপি পাওয়া গেছে। গোপীকান্ত তাঁর রচনায় প্রতি পদে পদে রামভদ্র সার্বভৌমের পাদবন্দনা করেছেন। অনুমানে মনে হয় রামভদ্র মথুরানাথ এবং গোপীকান্ত উভয়ের পিতামহ এবং শিক্ষাগুরুও ছিলেন।
গোপীকান্ত কাশীতে বসবাস করলে মথুরানাথের বংশটি সম্ভবতঃ নবদ্বীপে থাকার পর অন্যত্র গমন করেছিলেন কিংবা মানকরে আসেন। মানকরও একসময় বিখ্যাত ছিল পন্ডিতদের জন্য (বিনয় ঘোষের ‘পশ্চিমবঙ্গের সংষ্কৃতি’ তেই জানা যায়), এবং মানকরে ভট্টাচার্য্য পাড়ায়( পিতামহের মুখে শুনেছি সেখানে আমাদের পরিবারের টোল ছিল)ছিল মহা মহা পন্ডিতদের বাসস্থান। মথুরানাথের রচনাকাল ছিল আনুমানিক ১৫৪০-১৫৯০। রমানন্দ তর্কবেদান্তবাগীশের জন্মকাল ছিল আনুমানিক ১৭১৫-১৭২০ নাগাদ। এই কয়েকপুরুষের সম্বন্ধে এখনও কিছু জানা যায়নি, অনুসন্ধান চলছে। অনুমান করে নিতে হয়, এইসময় হয় তাঁরা মানকরেই ছিলেন অথবা অন্যত্র কোন জায়গা থেকে এসে মানকরে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং বর্গি হাংগামার কারণে প্রায় দুইশত বৎসর পরে আবার বসতবাটী ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পুরুলিয়া থেকে শ্রী অমিতাভ সিংহ মহাপাত্র জানিয়েছেন যে সেই সময় ম্যালেরিয়ার জন্য মানকর থেকে বহু পরিবার অন্যত্র চলে যান। এটিও একটি কারণ হতেই পারে। হয়ত অনেক পরিবার ম্যালেরিয়ার জন্য মানকর ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু আমাদের পরিবারে পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে যতদুর জানা গেছে, তাঁরা বর্গী হাংগামার কারণেই মানকর থেকে পালিয়ে পঞ্চকোটে আসেন ও আশ্রয় লাভ করেন।আবার দুটি কারণেই বসতবাটী ত্যাগ, তাও হতে পারে। মানকরে বহুবার গিয়েছি, ভট্টাচার্য্য পাড়ায় যে একটি প্রাচীন টোল ছিল, সে সন্ধানও পেয়েছি প্রাচীন/প্রাচীনা বাসিন্দাদের গল্প-কাহিনি থেকে ।
(চলবে)
শিখরভূমের প্রাচীন রাজধানী ছিল তৈলকম্প বা তেলকূপী। অনেকগুলি মন্দির ছিল, যা জলমগ্ন হয়ে নষ্ট হয়েছে। এই মন্দিরটিও অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে বিনষ্ট হওয়ার পথে...। ছবিটি পাঠিয়েছেন পুরুলিয়ার পল্লব মন্ডল। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ...
No comments:
Post a Comment