“ভালবাসা” নামক অনুভুতি, উপলব্ধি বা বোধের যে শিক্ষক বা রাজা, সেই রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ভালবাসা পেতে, বা ভালবাসা আদায় করতে এত একচোখা ও স্বার্থপর হতে পেরেছিলেন তা ভাবা যায় না । শোনা যায় এই ব্যাপারে তাঁর ঠিক অগ্রজ ‘নতুন দাদা’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এঁর মনে যে উদারতা ও ত্যাগ দেখা গিয়েছিল, তা মনকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় ।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এক সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গানবাজনা কবিতা সাহিত্য নাটক প্রভৃতির চর্চা নিয়ে যে বিরাট সাংস্কৃতিক আখড়া বানিয়েছিলেন, সেখানে একদিন তাঁর প্রিয় বন্ধু ও তখনকার সময়ের প্রখ্যাত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী মহাশয়কে নিয়ে এসেছিলেন । বিহারীলাল চক্রবর্তীর লেখা কবিতা গুলি তার স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর খুব পছন্দ হয়েছিল । তা বুঝতে পেরে বিহারীলাল বাবু নুতন নুতন কবিতা লিখে প্রায় কাদম্বরী দেবীকেই আগে দেখাতেন । এই ভাবে ক্রমশ কাদম্বরী দেবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, ঠাকুরবাড়িতে আসা যাওয়া ঘন ঘন বেরে যেতে লাগল তাঁর । কাদম্বরী দেবীর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ ও তাঁর অনুরাগ আদায় করতে প্রায় প্রতিদিন একটি করে প্রেমের কবিতা লিখে নিবেদন করতে লাগলেন । যা সকলের গোচরেই ঘটতে লাগলো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এতে ক্ষুণ্ণ হওয়া তো দূরের কথা বরং কাদম্বরীদেবীকে, বিহারীলাল বাবুর প্রতিভার সমাদর করতে প্রায় দিন ভাল মন্দ রেঁধে খাওয়ানর পরামর্শ দিতেন । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, তাঁর প্রিয় নুতনবৌঠানের প্রতি বিহারীলাল এর প্রেমজ আকর্ষণ একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি । সেই কথা একদিন নিজের স্ত্রী মৃণালিণী দেবীকে অকপটে স্বীকার করে বলেছিলেন, “জান তো ছোট বউ, আমি নুতনবউঠানকে এতটাই ভালবাসতাম যে বিহারীলাল বাবুর থেকেও ভাল কবিতা লেখার তারনায় দিন রাত লিখতে শুরু করেছিলাম । যখন তখন নুতন বৌঠানের ঘরে গিয়ে, তাকে জোর করে পাসে বসিয়ে রেখে বা বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার কবিতা শোনাতাম । তখন নুতনবউঠান বলতেন, ‘যাই বল বাপু, বিহারীলাল বাবুর মত লিখতে তোমার অনেক দেরি আছে’ ... শুনে আমার ভীষণ রাগ হত, একবার ম্যাকবেথ নাটকের “হেকটি” নামক ডাইনি চরিত্রটির মত বউঠানের নামে কবিতা লিখি । পরে বুঝেছিলাম নুতনবউঠান আমাকে এতটাই ভালবাসত যে, আমাকে খেপিয়ে দিয়ে আমার থেকে অতুলনীয় কিছু লেখা বার করে নিতে সাহায্য করাই ওঁর উদ্দেশ্য ছিল” । নিজের স্ত্রীর মনে, কাদম্বরী দেবীর প্রতি তাঁর দুর্নিবার প্রেম ও ভালবাসা, কটটা আঘাত করতে পারে তা না ভেবেই এমন অনেক স্বীকারুক্তি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ।
অথচ পরবর্তি কালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্ত্রী কাদম্বরী দেবী, তার প্রিয় দেওরটির প্রেমে পরেছে, তখন ওঁদের দুজনের জন্য ‘অলিকবাবু’ নামে একটি নাটক লিখে...নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নায়ক নায়িকা হিসাবে ওঁদের অভিনয় করালেন । নিজের স্ত্রীর মুখ দিয়ে সংলাপ বলালেন... “ আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্র সূর্য কে সাক্ষী করে মুক্ত কণ্ঠে বলব তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলব সহস্র বার বলব, আমিই তোমার স্ত্রী” । এই গল্পও নির্দ্বিধায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে অকপটে বলেছিলেন... !!!!
No comments:
Post a Comment