Monday, April 14, 2014

স্কুল পরিদর্শন / ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী / ১৫.০৪.২০১৪ / ১লা বৈশাখ ১৪২১ / সকাল ৮ টা ।

স্কুল পরিদর্শন 


ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী / ১৫.০৪.২০১৪ / ১লা  বৈশাখ  ১৪২১ /  সকাল ৮ টা ।

 মাষ্টার মশাই কলার টেনে দু গালে দুটো শক্ত চাঁটি মারলেন ছেলেটির গালে । গাল লাল হয়ে গেল । তারপর বেত্রাঘাত সপাং সপাং । ছেলেটি ছট পট করতে করতে বলে,“সার মারবেন না আমি পরের বারে ভালো করে উত্তর দেব। আমার মা নেই আমাকে ঘরের কাজ করতে হয় । তার মধ্যে পডার সময় পাই না ।” 
মাষ্টার মশাই বলেন মাতৃভাষায় ফেল । ছি ছি মাতৃভাষার অপমান । ওরে তোদের চোদ্দ পুরুষে কেউ পডাশুন করেছে যে তুই করবি? যা রিক্সা টান ! কাজে দেবে । এই বলে আবার বেত্রাঘত ।  সঙ্গে চাঁটি লাথি .. মানে রাগের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন মহাশয় । ক্লাসের অন্য ছেলে মেয়েদের মুখে রা নেই । নীরবে সহ্য করে তারা এই অকথ্য অত্যাচার । প্রতিবাদ করার শক্তি কারুর মধ্যে আছে বলে মনে হয় না । সাহিত্যের মাষ্টার খুব কড়া মেজাজের এবং রাগি । রাগলে ওনার জ্ঞান থাকেনা । মেরে মেরে ছেলেটির ফর্শা চেহারা লাল হয়ে জায় । কান গাল লাল টক টক করছে ।
ছেলেটি আর পারছেনা এই অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে । সাহিত্যে সে , তার মতন লিখেছে তবে সার কেন তাকে পশুর মত মারছেন ? সে ত বলছে সারকে পরের বারে পরীক্ষায় ভালো লিখে দেখাবে ।
শিক্ষকের নির্দেশ -  বাইরে হাঁটু গেড়ে কান ধরে বসতে । তখন ছেলেটি প্রায় আধমরা  হয়ে গিয়েছে মার খেয়ে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।দু চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত অশ্রু ধারা মুখে লালা আর মারের চোটে শার্ট ছিঁড়ে কুটি কুটি । কলারটাও ছিঁড়ে গিয়েছে বেচারার । কান্নাও থামছেনা । শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জ্বালা যন্ত্রণায় বিবশ করে ফেলেছে । হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কেঁদে ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট ছেলেটির । তবুও সারের দয়া হলনা ! 
ঠিক সেই সময় বাইরে জীপের শব্দ । পেছনে একটা সাদা রং এর  এম্বাস্যাডার কার তাতে লেখা স্কুল এন্ড মাস এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট   
স্কুলে কমিশনার , স্কুল এন্ড মাস এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট , স্বয়ং ।   মহাশয়ার বিনা প্রোগ্রামে সারপ্রাইজ ভিজিট সঙ্গে জেলা শিক্ষা অধিকারী   এবং স্কুল এস আই ।
হঠাৎ পরিবেশটা এমন হবে কেউ আশা করেন নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় দৌড়ে গেলেন স্বাদরে আমন্ত্রণ জানাতে । কিন্তু কমিশনার মহোদয়ার চোখ সেই ছাত্রটির ওপর পড়লো । ওই ছেলেটি তখন ও কাৎরাচ্ছে যন্ত্রণায় ।  উনি  কোন কিছু না বলেই ছেলেটিকে  উঠতে বললেন  । তারপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পরম স্নেহ ভরা নয়নে বললেন, “কি হয়েছে বাবা ? তোমার নাম কি ? তুমি কেন কাঁদছ ? তোমায় কে মেরেছে ? ...ইত্যাদি ইত্যাদি ।
ছেলেটি থর থর করে কাঁপতে লাগলো তারপর বলল আমার নাম পদ্মলোচন দাস ।  আমি  সাহিত্যতে ২৪ নম্বর পেয়েছি তাই সার আমায় মেরেছেন । আমি ভালো লিখেছিলাম । আমার মা নেই তাই বাবা ঘরের কাজ করতে বলেন । আমি গরীব । আমদের দু বেলা খাওয়ার জোটে না । স্কুলে মিড ডে মিল খেতে আসি । তা নাহলে তাও জুটতোনা । কথাগুলো হাঁপাতে হাঁপাতে এক নাগাড়ে বলে গেল ছেলেটি । 
এটা ত মারা নয় এটা রীতিমত বধ করা ! তা কে সেই ব্যক্তি তোমায় বধ করেছে ? এই বলে ছেলেটিকে নিজের কোলে তুলে পিঠে হাত বুলতে লাগলেন । সারা গায়ে চোট দেখে শিউরে ওঠেনমুখে ,“আহারে কে সেই পাষণ্ড !  এরকম ভাবে কেউ ছাত্রদের মারে? ” আর  তোমরা  ছেলে মেয়েরা তোমরা কেন মানা করনি সারকে?
ক্লাসের সব ছেলে মেয়ে এক সঙ্গে বলল আমাদের সাহিত্য সার ওকে মেরেছেন আমরা মানা করলে আমাদেরও মারতেন সার ।
তাই-বুঝি ! কমিশনার মহোদয়া , প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে সেই সাহিত্যের শিক্ষক কে হাজির করতে বলেন ।
প্রধান শিক্ষক বলে মাদাম আজ এক বছরের ওপর এই স্কুলে সাহিত্যর শিক্ষক নেই । আমাদের স্কুলের ক্লার্ক শ্যামল বাবুকে ওই বিষয় পড়াতে বলি ।
ডি. আই মহাশয় সাফাই দেন , উনি বারে বারে এই বিষয় চিঠি লিখেছেন কিন্তু সুফল হয় নি।
কমিশনার আড় চোখে দুজনের উত্তর শোনেন তার পর ছেলেটির পরীক্ষার খাতা আনতে বলেন । 
ছেলেটি ভয়ে কেঁদে ফেলে । সে ভাবে আবার বোধ হয় মার দেবেন ।
কমিশনার ছেলেটিকে পরম স্নেহে বলেন ,“কাঁদিস না বাবা আমি তোর মা । কাঁদে কেউ বোকা ছেলে আমি মারবনা ভয় পাচ্ছিস কেন ? ” আচ্ছা বাবা তোর নাম পদ্মলোচন তাই না ?
হ্যাঁ ।
বলতো বাবা তোর নামের মানে কি ?
পদ্ম মানে পদ্ম ফুল .. লোচন মানে চোখ , যার চোখ পদ্মের মতন তিনি শ্রী রাম
বাঃ ।  কে বলেছে তুই সাহিত্যে কাঁচা ! এই বলে মাথায় হাত দেন ।
ছেলেটির লেখা খাতা এল । এই সময় সাহিত্যের শিক্ষক হাত জোড় করে বলেন আমরা নিজেদের ভাষা ভুল লিখছি । আমাদের মাতৃভাষাকে অপমান করছি । এটা কি বরদাস্ত করা জায় ?
প্রধান শিক্ষক মহাশয় চুপ করতে বলেন ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে ।
কমিশনার মহাশয়া খাতা দেখে বলেন বাঃ ছেলেটি-ত বেশ লিখেছে । ওকে এই প্রশ্নের উত্তরে  ১০ এ ৭ দেওয়া উচিৎ । আপনি কি আপনার মাইনের টাকা থেকে নম্বর দিচ্ছিলেন না জীবনে ৩০ এর বেশি নম্বর পান নি পরীক্ষায় কি শ্যামল বাবু ? কোনটা ঠিক ? ছেলেটি যা  লিখেছে আমি হলে ওকে ৫০ দিতাম ১০০ থেকে । আপনি মাধ্যমিক টুকে পাস করেছিলেন না লিখে আপনি ১০ এ ২ , ১০ এ ৩ এরকম করে ২৪ নম্বর দিয়েছেন । আচ্ছা বলুন তো এক+এক সন্ধি হলে কি হয় ? সন্তানের স্ত্রী লিঙ্গ কি ?
দুটোরই উত্তর ভুল হল। কোনটার ই উত্তর সঠিক পেলেন না । দেখলেন ত এবার বলুন সাহিত্য কার বেশি জানা জরুরি । নিজেকে আগে প্রস্তুত করুন তারপর বাচ্চা ছেলের গায়ে হাত দেবেন। এত আস্পর্ধা ! কচি ছেলে মেয়ের গায় হাত !! ঘরে বৌকে মারেন নিশ্চয় !!! কি শ্যামল বাবু ?  
কমিশনার মহোদয়া ওইখানেই ডিক্টেসন দিয়ে শ্যামল সারকে সাসপেন্ড করার জন্য ডি.আই কে নির্দেশ দিলেন। প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে ১০০ কিলোমিটার দুরে এক স্কুলে বদলির আদেশ দিলেন । শ্যামল সারকে ডি. আই অফিসে হেড কোয়ার্টার ফিক্স করলেন । সাহিত্যের শিক্ষক ওই স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন । সব শিক্ষক শিক্ষিকা র উদ্যশ্যে বলেন কোন ছেলে মেয়ের গায়ে হাত দেবেন না । ওদের ভালো করে বুঝিয়ে পড়াবেন । এমনিতেই স্কুলের উপস্থাপন কম হচ্ছে এর পর আরও কমে জাবে । গরীবের ছেলে মেয়ে এখানে বিদ্যার্জন করতে আসে মার খেতে নয় ।  আপনাদের সরকার মাইনে দিচ্ছে পড়ান জন্য ।  এটা সকলকে ওয়ার্নিং । মনে থাকে জেন।
যাওয়ার সময় ছেলেটির হাতে ১০০ টাকা দিয়ে বললেন একটা নতুন জামা কিনে পরবি বাবা । ছেলেটি এবার খুশিতে কমিশনার মহোদয়ার পা জড়িয়ে ধরল । চোখ থেকে তার অবিরাম অশ্রু  ধারা বয়ে কালো দাগ হয়ে গিয়েছে । কিন্তু তার সব কষ্ট এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। সে জেন তার মাকে পেয়ে-গেল । অনেকক্ষণ কাঁদছিল এবার মুখে হাঁসি দেখে কমিশনার খুশী হলেন। এক টিচার ভদ্রলোককে দায়িত্ব দিলেন ওই ছেলেটির নতুন জামা কেনার , কারন উনি জানেন ছেলেটি ঘরে টাকা নিলে ওর কাছথেকে হয়তো ওর বাবা ছাড়িয়ে মদ খেয়ে নেবে ওই টাকায় ।
সকলে আনন্দে  তালি দিয়ে মহাশয়াকে সম্বোধন করল , “আপনি আমাদের মা , সাক্ষাৎ মা।”  
কমিশনার মহোদয়া সকলকে  বসতে বলে শিক্ষক দের উদ্দেশ্যে বলেন ছাত্রদের মারলে তারা ভয়  পাবে আর তাতে স্কুলের উপস্থাপন কমে জাবে । সে-টাকি ভালো ! ওদের ভালোবেসে পড়াতে হবে ।  কেন পারছেনা সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে । সেই অনুযায়ী ওদের বারে বারে বোঝাতে হবে । শিক্ষকের ধৈর্য এবং স্নেহ দুটোর প্রয়োজন । মেরে কাউকে ভালো মানুষ করা যায়না । এটা মনে রাখবেন। শিক্ষক সর্বদা নমস্য কিন্তু সেই শিক্ষক কে তার কর্তব্য করতে হবে কারন তারা মানুষ তৈরির শিল্পী।
মা মরা ছেলে পদ্মলোচন দাস আজ প্রথম এক ভিন্ন মার স্নেহ পেল । তার আনন্দাশ্রু তে দুচোখ ভরে উঠলো । সে ঘরে ফিরে ভালো করে সাহিত্য পডে দেখিয়ে দেবে সকলকে সে কিছু কম নয় । কমিশনারের দেওয়া শার্ট পরে পরীক্ষা দেবে । এবারে সে ফার্স্ট হবে ।
ত্রিভুবনজিৎ  মুখার্জী / ১৩.০৪.২০১৪ / রবিবার রাত ১১.০৯ ।
   

No comments:

Post a Comment