শৈশবের কলকাতা – কলকাতার শৈশব
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
‘কলকাতা’ - আমাদের প্রাণের শহরের নামটা শুনলেই আমাদের আবেগ যেন বাঁধন হারা হয়ে যায় । বয়সের দিক দিয়ে কলকাতা প্রাচীন শহর নয় মোটেই, বিশ্বের অনেক বড় শহরের মত চকচকে বিত্তশালীও নয়, তবু প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এই শহরটাকে নিয়ে কত গল্প-কবিতা- কাহিনী, কত বিচিত্র কথা একে নিয়ে । বিদেশী সান্রাজ্যবাদী শক্তির দম্ভের নিশান বুকে ধরেছিল এই শহর আবার সেই দানব শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল গর্জন প্রথম শুনিয়েছিল এই শহরই ।
কলকাতা শহরের জন্ম ও শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেকালীন আদর্শহীন বাঙালির লোভ, চাটুকারিতা ও অনৈতিকতার হাজারো মলিন কাহিনী, তেমনই জড়িয়ে আছে দুশ’ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুক্তির উজ্বল গাথা । এই নিবন্ধে আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে কলকাতার শৈশবের সেই মলিন দিনগুলো ফিরে দেখতে চেয়েছি । বছর পঁচিশ আগে ১৬৯০ খৃষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট দিনটিকে মনে রেখে কলকাতা শহরের ৩০০তম জন্মদিন পালিত হয়েছিল মহা সমারোহে ।
একটা শহর বেড়ে ওঠে, বিকশিত হয় ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়মে তার কোন জন্মদিন হতে পারে না, থাকতে পারেনা তার কোন জনকও । তাছাড়া, যে তিনটি গ্রাম নিয়ে নগর কলকাতা পত্তন, সেই তিনটি গ্রামের বিক্রয় দলিল সই হয়েছিল ১৬৯৮এর ১0ই নভেম্বর । তাহলে ১৬৯০ কলকাতার জন্মদিন হয়ই বা কি করে ? ইতিহাসের দলিল ও নথি বিচার করে আধুনিক কলকাতার মহামান্য উচ্চ আদালতও একই মত জানিয়েছিল ২০০৩এর ১৭ই মে যে কলকাতার কোন জন্মদিন নেই, নেই এর কোন জনকও ।
আজ থেকে ঠিক ৩২৪ বছর আগে, ১৬৯০ খৃষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট, দিনটা ছিল রবিবার । জোব চার্ণক নামে একজন এবং আরো ৩৭জন ইংরেজের এক বাণিজ্য তরী ভাগীরথী নদীর তীরে সুতানুটি নামে এক গ্রামে নোঙ্গর ফেলল । বানিজ্যতরীটি মাদ্রাজ থেকে এসেছিল । জোব চার্ণক এই দলটির প্রধান । ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ থেকেই ইউরোপীয় বণিকরা এদেশে বাণিজ্য ঘাটি গাড়তে শুরু করেছিল । ১৬০০ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা হয় । বাংলায় বাণিজ্যকুঠি করার ইছে তাদের ছিল,কিন্তু পর্তুগীজ ও ওলন্দাজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছিল না। ১৬৭৯তে ইংরেজরা প্রথম এসেছিল হুগলী নদীর তীরে এখনকার গার্ডেনরিচে, কিন্তু সুবিধা করতে পারে নি ।
জোব চার্ণক ছিলেন কোম্পানীর একজন সাধারণ নিম্নপদস্থ কর্মচারী । আগেও আরো দুবার এই অঞ্চলটা ঘুরে গিয়েছিলেন । এই অঞ্চলের নদীপথে যাতায়াতের সূত্রে তার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল । চার্ণক মাদ্রাজ কুঠির ইংরাজদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে সুতানুটি তাদের বানিজ্যকুঠি স্থাপনের উপযুক্ত স্থান হতে পারে । ১৬৯০এর জুলাই মাসে মাদ্রাজ থেকে আরো ৩৭জনকে নিয়ে জোব চার্ণকের বানিজ্যতরী সুতানুটিতে নোঙ্গর ফেলে ২৪শে অগস্ট । চার্ণক অতি ধুরন্ধর ও চতুর লোক ছিল । ন্যায়নীতির ধার ধারতেন না বলেই জানা যায় । কোম্পানীর কর্মচারী হয়েও নানান নীতিহীন ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের বানিজ্য করতেন, নানান কুকাজের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকতেন । কোম্পানীর অনেকের সুনজরেও ছিলেন না । ১৬৯৩তে চার্ণকের মৃত্যু হয় । এহেন জোব চার্ণককে ‘কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা’ বলে মিথ্যা ইতিহাস লিখে গেছে ইংরেজরা । চার্ণক বাংলায়, সুতানুটিতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একটা স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করেছিলেন মাত্র কিন্তু কোন হিসাবেই তাকে ‘কলকাতা নগরী’র প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না ।
চার্ণকের মৃত্যুর পর কোম্পানীর এজেন্ট হয়ে আসেন তাঁর জামাতা চার্লস আয়ার । তাকে কোম্পানী পরামর্শ দেয় যে করেই হোক – কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েও সুতানুটি এবং লাগোয়া দুটি গ্রাম ‘ডিহি কলকাতা’ ও ‘গোবিন্দপুর’এর জমিদারি স্বত্ব আদায় করতে হবে মুঘল বাদশার কাছ থেকে । গ্রাম তিনটি ছিল বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির অন্তর্গত । তাঁরা গ্রাম তিনটির জমিদারি স্বত্ব ইংরেজ বণিকদের বিক্রি করতে সম্মত ছিল না। অন্য পথ ধরল ধূর্ত ইংরাজ বণিকরা । বৃদ্ধ মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের শাসন তখন শিখ, মারাঠা বিদ্রোহ দমনে জর্জরিত, দুর্বল । ঔরঙ্গজেবের নাতি আজিমুদ্দিনকে প্রচুর নজরানার বিনিময়ে তারা এই তিনটি গ্রামের দখলদারির সম্মতি আদায় করে নিল । ১৩০০ টাকা ক্ষতিপুরণের বিনিময়ে সাবর্ণ চৌধুরীদের থেকে ‘ডিহি কলকাতা’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘সুতানুটি’র জমিদারি স্বত্ব কিনে নিল ইংরাজ বণিকরা । বৃটিশ মিউজিয়মে রাখা সেই বিক্রয় দলিলের তারিখ ১৬৯৮এর ১০ই নভেম্বর, আর জোব চার্ণকের মৃত্যু হয় এর পাঁচবছর আগে ।
নগর কলকাতার পথচলা শুরু হল, আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হয়ে গেলো এ দেশে ইংরাজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের কেন্দ্রস্থল, বাংলার কালো দিনেরও সূচনা । কেমন ছিল সেইসব দিন তা জানার উপায় সামন্যই । লন্ডনের মহাফেজ খানার দলিলের স্তুপ থেকে সংগৃহিত তথ্য নিয়ে এদেশের নানান ঐতিহাসিকদের রচনায় সেসব তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে । ইংরেজরা নতুন কলকাতার ঝোপ জঙ্গল পরিস্কার করে তাদের বসবাসের জন্য নানান ব্যবস্থা করল, বাইরের নানান উপদ্রবের ভয়ে দুর্গ বানাল, নানা প্রান্তের বণিক ব্যসায়ীরা ইংরাজের জমিদারি এলাকায় বাসা বাধলেন । বাংলার তদানীন্তন নবাব আলিবর্দির শাসন কালে বারংবার বর্গী হানা থেকে বাচতে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয় নিলেন কলকাতায় । কলকাতার লোকসংখ্যা বাড়লো ।
১৭০৭সালের জরীপ অনুযায়ী তখনকার কলকাতার সীমানা ছিল এইরকম – ‘বাজার কলকাতা’ ও ‘টাউন কলকাতা’র সীমানা ছিল মোটামুটি বউবাজার থেকে পশ্চিমে লালদীঘি বড়বাজার পর্যন্ত । মোট জমির আট ভাগের একভাগ ছিল বসতি। টাউন কলকাতার চারভাগের একভাগ জমিতে ধান চাষ হত...এখনকার চৌরঙ্গি অঞ্চলটা ছিল গোবিন্দপুর গ্রামের মধ্যে আর চিৎপুর সহ উত্তর কলকাতা ছিল সুতানুটি গ্রাম । সুতানুটির ১৭০০ বিঘা জমির মধ্যে ১৫০ বিঘারও কম জমিতে ছিল লোকবসতি । বেশির ভাগ জমিতেই ধান চাষ হত” বিনয় ঘোষ / ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’। এই ছিল আদি কলকাতার চেহারা । ১৭৫০-৫৫ সালে সুতানুটিতে এককাঠা জমির দাম ছিল ১১টাকা ।
১৭০৭এ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুখল শাসনের পতনের দিন গোনা শুরু হয় । বাংলাতে কোন কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না । বাংলার স্বাধীন নবাব নিঃসন্তান আলিবর্দি খান তার নবাবী, পারিবারিক কলহ আর মুর্শিদাবাদ নিয়ে ব্যস্ত । ইংরাজ ব্যবসা করার অনুমতি পেয়ে কলকাতাকে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য করে তুলতে বাংলার নবাবীটাও দখলের ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল । ইতিমধ্যেই তারা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ বানিয়ে সেনা মোতায়েন করেছে । আলিবর্দির দৌহিত্র তরুণ সিরাজ ইংরাজদের ঔদ্ধত্যের কিঞ্ছু আঁচ পেয়েছিলেন । ১৭৫৬র ৯ই এপ্রিল আলিবর্দির মৃত্যুর পর নবাবের আসনে বসার তিনমাস পরেই ইংরাজদের শিক্ষা দিতে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন, ইংরাজরা পরাস্ত হয়, কলকাতার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘আলিনগর’ হয় । কলকাতায় জাঁকিয়ে বসা ইংরেজরা ঠিক একবছর পরেই শিরাজের প্রমুখ মন্ত্রী মীরজাফর’এর বিশ্বাসঘাতকতা ও তাদের বিশ্বস্ত বাঙালি বেনিয়াদের সহযোগিতার বলে বলীয়ান ইংরাজ প্রতিশোধ নেয় পলাশীতে ১৭৫৭’র ২৩শে জুন । মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ পরাজিত হন, আত্মগোপন অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয় ।
আমাদের সেই জানা ইতিহাসের ধারা বর্ণনা দেওয়া এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয় । আমি বুঝতে চেয়েছি সেদিনের কলকাতার শৈশব ও বেড়ে ওঠার দিনগুলো কি ক্লেদাক্ত ছিলস,বাঙালি বেনিয়া, মুৎসুদ্দি, ইংরাজের চাটুকারদের লোভ ও অনৈতিকতার কি কুৎসিত চেহারা শৈশবের কলকাতা সাক্ষী থেকেছিল তা জানলে আমাদের অবাক হতে হয় ! কলকাতা শহরের বিকাশ ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারায় হয়নি, ঢাকা বা মুর্শিদাবাদের মত প্রাচীনত্বের বা ঐতিহ্যের অহংকারও কলকাতার ছিল না । দেওয়ানী পাওয়ার পর ইংরাজ কোম্পানী কি দানবীয় শক্তি অর্জন করেছিল তা বিস্ময়কর । সেই সময়ের চরম দুর্নীতি পরায়ন, উৎকোচ বিলাসী ওয়ারেন হেষ্টিংসের এক অনুচর নালিশ করেছিল মহারাজ নন্দকুমারের নামে । হিন্দু ব্রাহ্মণ নন্দকুমারকে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় ধরে এনে বিচারের প্রহসন করে ফাঁসিকাঠে লটোকে দিয়েছিল হেষ্টিংস (১৭৭৫)। আর “এই হত্যাকান্ডের অন্তরালে ছিলেন এই মহানগরীর এক বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিক”(রামমোহন ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’/প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়)। গবেষক বিনয় ঘোষ ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার কলকাতার অধিবাসী এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন গঙ্গাতীরে ভিড় করেছিল, এবং ব্রাহ্মণ হত্যার দৃশ্য পাপ মনে করে গঙ্গা স্নানান্তে পবিত্র হয়েছিল । শোনা যায় এই সময় কলকাতার ব্রাহ্মণরা অপবিত্র শহর ত্যাগ করে গঙ্গার পশ্চিম তীরে বালি-উত্তরপাড়া অঞ্চলে দলে দলে যাত্রা করেছিলেন” ।
হেস্টিংসের দুর্নীতির কথা জেনেছিলেন নন্দকুমার । নন্দকুমারের ফাঁসির সময় ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন হুগলীর খানাকুল গ্রামে তিন বছরের শিশু । রামমোহন কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করেন ১৮১৫ থেকে, তাঁর ৪৩ বছর বয়সে । বলা যায়, শহর কলকাতা তখন থেকেই দেখতে পেয়েছিল আলোর রেখা । তার আগে, সেই শৈশবের কলকাতা ছিল ক্লেদাক্ত অন্ধকারের সাক্ষী ।
১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধের পরই কলিকাতার নগরায়ন শুরু হয় । পলাশীর যুদ্ধের আগে কলকাতায় পাকা বাড়ির সংখ্যা এক কুড়িও ছিল না । সেই কলকাতা গড়ে উঠলো লুঠের টাকায় । ইতিহাস অনেক লুঠ দেখেছে – সুলতান মাহমুদের লুঠ, , সোমনাথ মন্দিরের লুঠ, নাদির শাহের দিল্লী লুঠ কিংবা বর্গীদের লুঠ । কিন্তু পলাশীর লুঠ ছিল তুলনা হীন। পাঠ্য ইতিহাসে ‘পলাশীর লুন্ঠন’ কথাটা পড়েছি কিন্তু কত কুৎসিত ছিল সেই লুন্ঠন তা পাঠ্য ইতিহাসে লেখা নেই । সিরাজকে পরাস্ত ও গুপ্ত হত্যার পর ক্লাইভরা মীরজাফর ও অন্যান্য এদেশীয় চাটুকারদের নিয়ে ‘নবাবের কোষাগারের দরজা ভেঙ্গে তা লুঠ করে । লুঠের সময় উপস্থিত ছিলেন নবকৃষ্ণ দেবও’ (‘কলকাতা তিন শতক’/কৃষ্ণ ধর) । একশ নৌকা বোঝাই হয়ে সেই লুঠের টাকা মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় আসে, ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছিল ক্লাইভ ও তার সহকর্মী আর তার সহযোগী দেশীয় বাঙালি বেনিয়ারা । ইতিহাসের সে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় । এই কলঙ্কের ভিত্তিমূলেই কলকাতার সমৃদ্ধির সূত্রপাত । লুঠের বখরার টাকায় কোম্পানীর দালালি,চাটুকারি করে শৈশবের কলকাতার বাঙালি নাগরিক সমাজ । ক্লাইভের দূর্নীতির কথা বিলেতেও গিয়ে পৌছেছিল । বিচার সভায় ক্লাইভ বলেছিল “পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর আমি যে কি সুযোগ পেয়েছিলাম তা একবার বিবেচনা করুন । ধনৈশ্বর্যে ভরা এক বিরাট মহানগর(মুর্শিদাবাদ) আমার হাতের মুঠোয় ছিল; বড় বড় ধনিক স্বদেশীয় মহাজনেরা আমার মুখে একটু হাসি ফোটাবার জন্য টাকা ছোঁড়াছুড়ি করতেন...মিঃ চেয়ারম্যান, এই মুহুর্তে আমি যখন এই সব কথা আপনাকে বলছি, তখন আমার নিজের সংযম বোধের কথা ভেবে আমি সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছি” ।
এই নাগরিক সমাজকেই পেয়েছিল শৈশবের কলকাতা । তাই ১৭৭০- ৭৩এর ভয়াবহ মন্বন্তরে সুবেবাংলার একতৃতীয়াংশ মানুষের অনাহার মৃত্যুতে এই নাগরিক সমাজের কোন হেলদোল ছিল না । বরং তাদের বৈভব বাড়তেই থাকলো । নবাবের কোষাগার লুন্ঠনে ক্লাইভের সহযোগী ক্লাইভের সামান্য মুন্সী নবকৃষ্ণ দেবকে হেস্টিংস সুতানুটির (সমগ্র উত্তর কলকাতা)তালুকদার বানিয়ে দিলেন ১৭৭৬এ আর তার আগে হেস্টিংসের দুর্নীতির প্রতিবাদকারী নন্দকুমারকে ফাঁসিতে লটকে দিয়েছিলেন ১৭৭৫এ । শৈশবের কলকাতায় ইংরাজ কোম্পানীর বিশ্বস্ত সহযোগীএই দালা্ বেনিয়া, বেলেল্লাপনায় ডুবে থাকা নাগরিক সমাজ পরিপোষন করতো এক চরম অবক্ষয়ী সংস্কৃতি, সাধারণ শ্রমজীবি ও কৃষিজীবি মানুষের বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে যার কোন মিল ছিলনা ।
অন্য গোলার্ধে তখন ঘটে চলেছে নানান যুগান্তকারি ঘটনা । ১৭৭৬এ আমেরিকার বৃটিশ উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা ঘোষণা,১৭৮৯এ ফরাসি বিপ্লবের সংবাদ কলকাতা পেয়েছিল । ততদিনে কলকাতায় ছাপাখানা চলে এসেছে । ১৮৮তে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘হিন্দু কলেজ’এর । ১৭৯৬এ টমাস পেইনের ‘দি এজ অফ রিসন’ কলকাতায় পৌছে গেলো, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন ২৭ বছরের যুবক । কলকাতা আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে । সে অন্য কাহিনী । আমি শুধু কিছু জানা অজানা তথ্য সংগ্রহ করে শিকড়হীন, আলোহীন শৈশবের কলকাতার একটা ছবি লিখতে চেয়েছি মাত্র ।
কলকাতা শহরের জন্ম ও শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেকালীন আদর্শহীন বাঙালির লোভ, চাটুকারিতা ও অনৈতিকতার হাজারো মলিন কাহিনী, তেমনই জড়িয়ে আছে দুশ’ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুক্তির উজ্বল গাথা । এই নিবন্ধে আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে কলকাতার শৈশবের সেই মলিন দিনগুলো ফিরে দেখতে চেয়েছি । বছর পঁচিশ আগে ১৬৯০ খৃষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট দিনটিকে মনে রেখে কলকাতা শহরের ৩০০তম জন্মদিন পালিত হয়েছিল মহা সমারোহে ।
একটা শহর বেড়ে ওঠে, বিকশিত হয় ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়মে তার কোন জন্মদিন হতে পারে না, থাকতে পারেনা তার কোন জনকও । তাছাড়া, যে তিনটি গ্রাম নিয়ে নগর কলকাতা পত্তন, সেই তিনটি গ্রামের বিক্রয় দলিল সই হয়েছিল ১৬৯৮এর ১0ই নভেম্বর । তাহলে ১৬৯০ কলকাতার জন্মদিন হয়ই বা কি করে ? ইতিহাসের দলিল ও নথি বিচার করে আধুনিক কলকাতার মহামান্য উচ্চ আদালতও একই মত জানিয়েছিল ২০০৩এর ১৭ই মে যে কলকাতার কোন জন্মদিন নেই, নেই এর কোন জনকও ।
আজ থেকে ঠিক ৩২৪ বছর আগে, ১৬৯০ খৃষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট, দিনটা ছিল রবিবার । জোব চার্ণক নামে একজন এবং আরো ৩৭জন ইংরেজের এক বাণিজ্য তরী ভাগীরথী নদীর তীরে সুতানুটি নামে এক গ্রামে নোঙ্গর ফেলল । বানিজ্যতরীটি মাদ্রাজ থেকে এসেছিল । জোব চার্ণক এই দলটির প্রধান । ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ থেকেই ইউরোপীয় বণিকরা এদেশে বাণিজ্য ঘাটি গাড়তে শুরু করেছিল । ১৬০০ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা হয় । বাংলায় বাণিজ্যকুঠি করার ইছে তাদের ছিল,কিন্তু পর্তুগীজ ও ওলন্দাজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছিল না। ১৬৭৯তে ইংরেজরা প্রথম এসেছিল হুগলী নদীর তীরে এখনকার গার্ডেনরিচে, কিন্তু সুবিধা করতে পারে নি ।
জোব চার্ণক ছিলেন কোম্পানীর একজন সাধারণ নিম্নপদস্থ কর্মচারী । আগেও আরো দুবার এই অঞ্চলটা ঘুরে গিয়েছিলেন । এই অঞ্চলের নদীপথে যাতায়াতের সূত্রে তার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল । চার্ণক মাদ্রাজ কুঠির ইংরাজদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে সুতানুটি তাদের বানিজ্যকুঠি স্থাপনের উপযুক্ত স্থান হতে পারে । ১৬৯০এর জুলাই মাসে মাদ্রাজ থেকে আরো ৩৭জনকে নিয়ে জোব চার্ণকের বানিজ্যতরী সুতানুটিতে নোঙ্গর ফেলে ২৪শে অগস্ট । চার্ণক অতি ধুরন্ধর ও চতুর লোক ছিল । ন্যায়নীতির ধার ধারতেন না বলেই জানা যায় । কোম্পানীর কর্মচারী হয়েও নানান নীতিহীন ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের বানিজ্য করতেন, নানান কুকাজের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকতেন । কোম্পানীর অনেকের সুনজরেও ছিলেন না । ১৬৯৩তে চার্ণকের মৃত্যু হয় । এহেন জোব চার্ণককে ‘কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা’ বলে মিথ্যা ইতিহাস লিখে গেছে ইংরেজরা । চার্ণক বাংলায়, সুতানুটিতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একটা স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করেছিলেন মাত্র কিন্তু কোন হিসাবেই তাকে ‘কলকাতা নগরী’র প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না ।
চার্ণকের মৃত্যুর পর কোম্পানীর এজেন্ট হয়ে আসেন তাঁর জামাতা চার্লস আয়ার । তাকে কোম্পানী পরামর্শ দেয় যে করেই হোক – কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েও সুতানুটি এবং লাগোয়া দুটি গ্রাম ‘ডিহি কলকাতা’ ও ‘গোবিন্দপুর’এর জমিদারি স্বত্ব আদায় করতে হবে মুঘল বাদশার কাছ থেকে । গ্রাম তিনটি ছিল বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির অন্তর্গত । তাঁরা গ্রাম তিনটির জমিদারি স্বত্ব ইংরেজ বণিকদের বিক্রি করতে সম্মত ছিল না। অন্য পথ ধরল ধূর্ত ইংরাজ বণিকরা । বৃদ্ধ মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের শাসন তখন শিখ, মারাঠা বিদ্রোহ দমনে জর্জরিত, দুর্বল । ঔরঙ্গজেবের নাতি আজিমুদ্দিনকে প্রচুর নজরানার বিনিময়ে তারা এই তিনটি গ্রামের দখলদারির সম্মতি আদায় করে নিল । ১৩০০ টাকা ক্ষতিপুরণের বিনিময়ে সাবর্ণ চৌধুরীদের থেকে ‘ডিহি কলকাতা’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘সুতানুটি’র জমিদারি স্বত্ব কিনে নিল ইংরাজ বণিকরা । বৃটিশ মিউজিয়মে রাখা সেই বিক্রয় দলিলের তারিখ ১৬৯৮এর ১০ই নভেম্বর, আর জোব চার্ণকের মৃত্যু হয় এর পাঁচবছর আগে ।
নগর কলকাতার পথচলা শুরু হল, আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হয়ে গেলো এ দেশে ইংরাজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের কেন্দ্রস্থল, বাংলার কালো দিনেরও সূচনা । কেমন ছিল সেইসব দিন তা জানার উপায় সামন্যই । লন্ডনের মহাফেজ খানার দলিলের স্তুপ থেকে সংগৃহিত তথ্য নিয়ে এদেশের নানান ঐতিহাসিকদের রচনায় সেসব তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে । ইংরেজরা নতুন কলকাতার ঝোপ জঙ্গল পরিস্কার করে তাদের বসবাসের জন্য নানান ব্যবস্থা করল, বাইরের নানান উপদ্রবের ভয়ে দুর্গ বানাল, নানা প্রান্তের বণিক ব্যসায়ীরা ইংরাজের জমিদারি এলাকায় বাসা বাধলেন । বাংলার তদানীন্তন নবাব আলিবর্দির শাসন কালে বারংবার বর্গী হানা থেকে বাচতে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয় নিলেন কলকাতায় । কলকাতার লোকসংখ্যা বাড়লো ।
১৭০৭সালের জরীপ অনুযায়ী তখনকার কলকাতার সীমানা ছিল এইরকম – ‘বাজার কলকাতা’ ও ‘টাউন কলকাতা’র সীমানা ছিল মোটামুটি বউবাজার থেকে পশ্চিমে লালদীঘি বড়বাজার পর্যন্ত । মোট জমির আট ভাগের একভাগ ছিল বসতি। টাউন কলকাতার চারভাগের একভাগ জমিতে ধান চাষ হত...এখনকার চৌরঙ্গি অঞ্চলটা ছিল গোবিন্দপুর গ্রামের মধ্যে আর চিৎপুর সহ উত্তর কলকাতা ছিল সুতানুটি গ্রাম । সুতানুটির ১৭০০ বিঘা জমির মধ্যে ১৫০ বিঘারও কম জমিতে ছিল লোকবসতি । বেশির ভাগ জমিতেই ধান চাষ হত” বিনয় ঘোষ / ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’। এই ছিল আদি কলকাতার চেহারা । ১৭৫০-৫৫ সালে সুতানুটিতে এককাঠা জমির দাম ছিল ১১টাকা ।
১৭০৭এ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুখল শাসনের পতনের দিন গোনা শুরু হয় । বাংলাতে কোন কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না । বাংলার স্বাধীন নবাব নিঃসন্তান আলিবর্দি খান তার নবাবী, পারিবারিক কলহ আর মুর্শিদাবাদ নিয়ে ব্যস্ত । ইংরাজ ব্যবসা করার অনুমতি পেয়ে কলকাতাকে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য করে তুলতে বাংলার নবাবীটাও দখলের ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল । ইতিমধ্যেই তারা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ বানিয়ে সেনা মোতায়েন করেছে । আলিবর্দির দৌহিত্র তরুণ সিরাজ ইংরাজদের ঔদ্ধত্যের কিঞ্ছু আঁচ পেয়েছিলেন । ১৭৫৬র ৯ই এপ্রিল আলিবর্দির মৃত্যুর পর নবাবের আসনে বসার তিনমাস পরেই ইংরাজদের শিক্ষা দিতে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন, ইংরাজরা পরাস্ত হয়, কলকাতার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘আলিনগর’ হয় । কলকাতায় জাঁকিয়ে বসা ইংরেজরা ঠিক একবছর পরেই শিরাজের প্রমুখ মন্ত্রী মীরজাফর’এর বিশ্বাসঘাতকতা ও তাদের বিশ্বস্ত বাঙালি বেনিয়াদের সহযোগিতার বলে বলীয়ান ইংরাজ প্রতিশোধ নেয় পলাশীতে ১৭৫৭’র ২৩শে জুন । মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ পরাজিত হন, আত্মগোপন অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয় ।
আমাদের সেই জানা ইতিহাসের ধারা বর্ণনা দেওয়া এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয় । আমি বুঝতে চেয়েছি সেদিনের কলকাতার শৈশব ও বেড়ে ওঠার দিনগুলো কি ক্লেদাক্ত ছিলস,বাঙালি বেনিয়া, মুৎসুদ্দি, ইংরাজের চাটুকারদের লোভ ও অনৈতিকতার কি কুৎসিত চেহারা শৈশবের কলকাতা সাক্ষী থেকেছিল তা জানলে আমাদের অবাক হতে হয় ! কলকাতা শহরের বিকাশ ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারায় হয়নি, ঢাকা বা মুর্শিদাবাদের মত প্রাচীনত্বের বা ঐতিহ্যের অহংকারও কলকাতার ছিল না । দেওয়ানী পাওয়ার পর ইংরাজ কোম্পানী কি দানবীয় শক্তি অর্জন করেছিল তা বিস্ময়কর । সেই সময়ের চরম দুর্নীতি পরায়ন, উৎকোচ বিলাসী ওয়ারেন হেষ্টিংসের এক অনুচর নালিশ করেছিল মহারাজ নন্দকুমারের নামে । হিন্দু ব্রাহ্মণ নন্দকুমারকে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় ধরে এনে বিচারের প্রহসন করে ফাঁসিকাঠে লটোকে দিয়েছিল হেষ্টিংস (১৭৭৫)। আর “এই হত্যাকান্ডের অন্তরালে ছিলেন এই মহানগরীর এক বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিক”(রামমোহন ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’/প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়)। গবেষক বিনয় ঘোষ ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার কলকাতার অধিবাসী এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন গঙ্গাতীরে ভিড় করেছিল, এবং ব্রাহ্মণ হত্যার দৃশ্য পাপ মনে করে গঙ্গা স্নানান্তে পবিত্র হয়েছিল । শোনা যায় এই সময় কলকাতার ব্রাহ্মণরা অপবিত্র শহর ত্যাগ করে গঙ্গার পশ্চিম তীরে বালি-উত্তরপাড়া অঞ্চলে দলে দলে যাত্রা করেছিলেন” ।
হেস্টিংসের দুর্নীতির কথা জেনেছিলেন নন্দকুমার । নন্দকুমারের ফাঁসির সময় ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন হুগলীর খানাকুল গ্রামে তিন বছরের শিশু । রামমোহন কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করেন ১৮১৫ থেকে, তাঁর ৪৩ বছর বয়সে । বলা যায়, শহর কলকাতা তখন থেকেই দেখতে পেয়েছিল আলোর রেখা । তার আগে, সেই শৈশবের কলকাতা ছিল ক্লেদাক্ত অন্ধকারের সাক্ষী ।
১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধের পরই কলিকাতার নগরায়ন শুরু হয় । পলাশীর যুদ্ধের আগে কলকাতায় পাকা বাড়ির সংখ্যা এক কুড়িও ছিল না । সেই কলকাতা গড়ে উঠলো লুঠের টাকায় । ইতিহাস অনেক লুঠ দেখেছে – সুলতান মাহমুদের লুঠ, , সোমনাথ মন্দিরের লুঠ, নাদির শাহের দিল্লী লুঠ কিংবা বর্গীদের লুঠ । কিন্তু পলাশীর লুঠ ছিল তুলনা হীন। পাঠ্য ইতিহাসে ‘পলাশীর লুন্ঠন’ কথাটা পড়েছি কিন্তু কত কুৎসিত ছিল সেই লুন্ঠন তা পাঠ্য ইতিহাসে লেখা নেই । সিরাজকে পরাস্ত ও গুপ্ত হত্যার পর ক্লাইভরা মীরজাফর ও অন্যান্য এদেশীয় চাটুকারদের নিয়ে ‘নবাবের কোষাগারের দরজা ভেঙ্গে তা লুঠ করে । লুঠের সময় উপস্থিত ছিলেন নবকৃষ্ণ দেবও’ (‘কলকাতা তিন শতক’/কৃষ্ণ ধর) । একশ নৌকা বোঝাই হয়ে সেই লুঠের টাকা মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় আসে, ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছিল ক্লাইভ ও তার সহকর্মী আর তার সহযোগী দেশীয় বাঙালি বেনিয়ারা । ইতিহাসের সে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় । এই কলঙ্কের ভিত্তিমূলেই কলকাতার সমৃদ্ধির সূত্রপাত । লুঠের বখরার টাকায় কোম্পানীর দালালি,চাটুকারি করে শৈশবের কলকাতার বাঙালি নাগরিক সমাজ । ক্লাইভের দূর্নীতির কথা বিলেতেও গিয়ে পৌছেছিল । বিচার সভায় ক্লাইভ বলেছিল “পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর আমি যে কি সুযোগ পেয়েছিলাম তা একবার বিবেচনা করুন । ধনৈশ্বর্যে ভরা এক বিরাট মহানগর(মুর্শিদাবাদ) আমার হাতের মুঠোয় ছিল; বড় বড় ধনিক স্বদেশীয় মহাজনেরা আমার মুখে একটু হাসি ফোটাবার জন্য টাকা ছোঁড়াছুড়ি করতেন...মিঃ চেয়ারম্যান, এই মুহুর্তে আমি যখন এই সব কথা আপনাকে বলছি, তখন আমার নিজের সংযম বোধের কথা ভেবে আমি সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছি” ।
এই নাগরিক সমাজকেই পেয়েছিল শৈশবের কলকাতা । তাই ১৭৭০- ৭৩এর ভয়াবহ মন্বন্তরে সুবেবাংলার একতৃতীয়াংশ মানুষের অনাহার মৃত্যুতে এই নাগরিক সমাজের কোন হেলদোল ছিল না । বরং তাদের বৈভব বাড়তেই থাকলো । নবাবের কোষাগার লুন্ঠনে ক্লাইভের সহযোগী ক্লাইভের সামান্য মুন্সী নবকৃষ্ণ দেবকে হেস্টিংস সুতানুটির (সমগ্র উত্তর কলকাতা)তালুকদার বানিয়ে দিলেন ১৭৭৬এ আর তার আগে হেস্টিংসের দুর্নীতির প্রতিবাদকারী নন্দকুমারকে ফাঁসিতে লটকে দিয়েছিলেন ১৭৭৫এ । শৈশবের কলকাতায় ইংরাজ কোম্পানীর বিশ্বস্ত সহযোগীএই দালা্ বেনিয়া, বেলেল্লাপনায় ডুবে থাকা নাগরিক সমাজ পরিপোষন করতো এক চরম অবক্ষয়ী সংস্কৃতি, সাধারণ শ্রমজীবি ও কৃষিজীবি মানুষের বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে যার কোন মিল ছিলনা ।
অন্য গোলার্ধে তখন ঘটে চলেছে নানান যুগান্তকারি ঘটনা । ১৭৭৬এ আমেরিকার বৃটিশ উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা ঘোষণা,১৭৮৯এ ফরাসি বিপ্লবের সংবাদ কলকাতা পেয়েছিল । ততদিনে কলকাতায় ছাপাখানা চলে এসেছে । ১৮৮তে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘হিন্দু কলেজ’এর । ১৭৯৬এ টমাস পেইনের ‘দি এজ অফ রিসন’ কলকাতায় পৌছে গেলো, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন ২৭ বছরের যুবক । কলকাতা আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে । সে অন্য কাহিনী । আমি শুধু কিছু জানা অজানা তথ্য সংগ্রহ করে শিকড়হীন, আলোহীন শৈশবের কলকাতার একটা ছবি লিখতে চেয়েছি মাত্র ।
No comments:
Post a Comment