Tuesday, April 22, 2014

যেতে কৈলাস দম হাঁস ফাঁস / অভিজিৎ দত্ত

যেতে কৈলাস 
দম হাঁস ফাঁস

অভিজিৎ দত্ত

অনেক দিন ধরেই কৈলাসে যাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু “যাবো” বললেই তো আর যাওয়া যায় না!!! এই বেড়াতে বা ধর্ম করতে গেলেও অনেক প্রস্তুতি লাগে।
শেষ মেষ, আমরা তিন বন্ধু, ঠিক করেই ফেললাম, “কৈলাসে কেলেঙ্কারীর” জন্য। এই কৈলাসে লাশ নেই-এই কৈলাস, শিবের আবাস।
অন্য দুই বন্ধু চলল- পুণ্যি করতে আর আমি ছবি তুলতে।
তবে, কৈলাসে যাওয়াটা কিন্তু চাট্টি ভাত খাওয়ার মত সোজা নয়। পাঁচ থেকে, ছয় পা হাঁটলেই আর পা চলতে চায় না।
আমাদের পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছিল - যখন দেখবে আর হাঁটতে পারছ না, তখন দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেবে, তারপর আবার হাঁটা শুরু।
এগোতে লাগলাম কৈলাসের দিকে। যত কাছে আসছি, ততই থাকবার আর খাওয়া দাওয়ার মান কমেই যাচ্ছে।

মানস সরোবরে গিয়ে, সব কষ্ট ভুলে গেলাম। ওপারে কৈলাস দেখে যা মনে হলো - সেটা প্রকাশ করার ভাষা বা লেখন শৈলী আমার নেই।

একটাই ইংরেজী কথা মনে হল- ম্যাজেষ্টিক্।



পাহাড় চূড়ায় বৌদ্ধ গুম্ফা




মানস সরোবরে সোনালি হাঁস




মানস সরোবর থেকে কৈলাস




পুরোনো তিব্বত


  
অভিজিৎ দত্তের পরিচয়:
পেশায় লেদার টেকনোলজিষ্ট, এই ভদ্রলোক চারটে মহাদেশ ঘুরেছেন, গত ত্রিশ বছরে।
আগে অ্যানালগে ছবি তুলতেন, বর্তমানে ডিজিটালে তোলেন।
ছবি কে ভালো বললে – স্বাভাবিক ভাবেই খুশী হন, না বললে, তিনি তুলেই যাবেন ছবি।
এটাই তাঁর বেঁচে থাকার রসদ।

শৈশবের কলকাতা – কলকাতার শৈশব ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



শৈশবের কলকাতা – কলকাতার শৈশব

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

‘কলকাতা’ - আমাদের প্রাণের শহরের নামটা শুনলেই আমাদের আবেগ যেন বাঁধন হারা হয়ে যায় । বয়সের দিক দিয়ে কলকাতা প্রাচীন শহর নয় মোটেই, বিশ্বের অনেক বড় শহরের মত চকচকে বিত্তশালীও নয়, তবু প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এই শহরটাকে নিয়ে কত গল্প-কবিতা- কাহিনী, কত বিচিত্র কথা একে নিয়ে । বিদেশী সান্রাজ্যবাদী শক্তির দম্ভের নিশান বুকে ধরেছিল এই শহর আবার সেই দানব শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল গর্জন প্রথম শুনিয়েছিল এই শহরই । 
কলকাতা শহরের জন্ম ও শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেকালীন আদর্শহীন বাঙালির লোভ, চাটুকারিতা ও অনৈতিকতার হাজারো মলিন কাহিনী, তেমনই জড়িয়ে আছে দুশ’ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুক্তির উজ্বল গাথা । এই নিবন্ধে আমি ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে কলকাতার শৈশবের সেই মলিন দিনগুলো ফিরে দেখতে চেয়েছি । বছর পঁচিশ আগে ১৬৯০ খৃষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট দিনটিকে মনে রেখে কলকাতা শহরের ৩০০তম জন্মদিন পালিত হয়েছিল মহা সমারোহে ।
একটা শহর বেড়ে ওঠে, বিকশিত হয় ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক নিয়মে তার কোন জন্মদিন হতে পারে না, থাকতে পারেনা তার কোন জনকও । তাছাড়া, যে তিনটি গ্রাম নিয়ে নগর কলকাতা পত্তন, সেই তিনটি গ্রামের বিক্রয় দলিল সই হয়েছিল ১৬৯৮এর ১0ই নভেম্বর । তাহলে ১৬৯০ কলকাতার জন্মদিন হয়ই বা কি করে ? ইতিহাসের দলিল ও নথি বিচার করে আধুনিক কলকাতার মহামান্য উচ্চ আদালতও একই মত জানিয়েছিল ২০০৩এর ১৭ই মে যে কলকাতার কোন জন্মদিন নেই, নেই এর কোন জনকও ।

আজ থেকে ঠিক ৩২৪ বছর আগে, ১৬৯০ খৃষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট, দিনটা ছিল রবিবার । জোব চার্ণক নামে একজন এবং আরো ৩৭জন ইংরেজের এক বাণিজ্য তরী ভাগীরথী নদীর তীরে সুতানুটি নামে এক গ্রামে নোঙ্গর ফেলল । বানিজ্যতরীটি মাদ্রাজ থেকে এসেছিল । জোব চার্ণক এই দলটির প্রধান । ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ থেকেই ইউরোপীয় বণিকরা এদেশে বাণিজ্য ঘাটি গাড়তে শুরু করেছিল । ১৬০০ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা হয় । বাংলায় বাণিজ্যকুঠি করার ইছে তাদের ছিল,কিন্তু পর্তুগীজ ও ওলন্দাজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছিল না। ১৬৭৯তে ইংরেজরা প্রথম এসেছিল হুগলী নদীর তীরে এখনকার গার্ডেনরিচে, কিন্তু সুবিধা করতে পারে নি । 
জোব চার্ণক ছিলেন কোম্পানীর একজন সাধারণ নিম্নপদস্থ কর্মচারী । আগেও আরো দুবার এই অঞ্চলটা ঘুরে গিয়েছিলেন । এই অঞ্চলের নদীপথে যাতায়াতের সূত্রে তার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল । চার্ণক মাদ্রাজ কুঠির ইংরাজদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে সুতানুটি তাদের বানিজ্যকুঠি স্থাপনের উপযুক্ত স্থান হতে পারে । ১৬৯০এর জুলাই মাসে মাদ্রাজ থেকে আরো ৩৭জনকে নিয়ে জোব চার্ণকের বানিজ্যতরী সুতানুটিতে নোঙ্গর ফেলে ২৪শে অগস্ট । চার্ণক অতি ধুরন্ধর ও চতুর লোক ছিল । ন্যায়নীতির ধার ধারতেন না বলেই জানা যায় । কোম্পানীর কর্মচারী হয়েও নানান নীতিহীন ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের বানিজ্য করতেন, নানান কুকাজের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকতেন । কোম্পানীর অনেকের সুনজরেও ছিলেন না । ১৬৯৩তে চার্ণকের মৃত্যু হয় । এহেন জোব চার্ণককে ‘কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা’ বলে মিথ্যা ইতিহাস লিখে গেছে ইংরেজরা । চার্ণক বাংলায়, সুতানুটিতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একটা স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করেছিলেন মাত্র কিন্তু কোন হিসাবেই তাকে ‘কলকাতা নগরী’র প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না ।
চার্ণকের মৃত্যুর পর কোম্পানীর এজেন্ট হয়ে আসেন তাঁর জামাতা চার্লস আয়ার । তাকে কোম্পানী পরামর্শ দেয় যে করেই হোক – কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েও সুতানুটি এবং লাগোয়া দুটি গ্রাম ‘ডিহি কলকাতা’ ও ‘গোবিন্দপুর’এর জমিদারি স্বত্ব আদায় করতে হবে মুঘল বাদশার কাছ থেকে । গ্রাম তিনটি ছিল বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির অন্তর্গত । তাঁরা গ্রাম তিনটির জমিদারি স্বত্ব ইংরেজ বণিকদের বিক্রি করতে সম্মত ছিল না। অন্য পথ ধরল ধূর্ত ইংরাজ বণিকরা । বৃদ্ধ মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের শাসন তখন শিখ, মারাঠা বিদ্রোহ দমনে জর্জরিত, দুর্বল । ঔরঙ্গজেবের নাতি আজিমুদ্দিনকে প্রচুর নজরানার বিনিময়ে তারা এই তিনটি গ্রামের দখলদারির সম্মতি আদায় করে নিল । ১৩০০ টাকা ক্ষতিপুরণের বিনিময়ে সাবর্ণ চৌধুরীদের থেকে ‘ডিহি কলকাতা’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘সুতানুটি’র জমিদারি স্বত্ব কিনে নিল ইংরাজ বণিকরা । বৃটিশ মিউজিয়মে রাখা সেই বিক্রয় দলিলের তারিখ ১৬৯৮এর ১০ই নভেম্বর, আর জোব চার্ণকের মৃত্যু হয় এর পাঁচবছর আগে ।
নগর কলকাতার পথচলা শুরু হল, আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হয়ে গেলো এ দেশে ইংরাজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের কেন্দ্রস্থল, বাংলার কালো দিনেরও সূচনা । কেমন ছিল সেইসব দিন তা জানার উপায় সামন্যই । লন্ডনের মহাফেজ খানার দলিলের স্তুপ থেকে সংগৃহিত তথ্য নিয়ে এদেশের নানান ঐতিহাসিকদের রচনায় সেসব তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে । ইংরেজরা নতুন কলকাতার ঝোপ জঙ্গল পরিস্কার করে তাদের বসবাসের জন্য নানান ব্যবস্থা করল, বাইরের নানান উপদ্রবের ভয়ে দুর্গ বানাল, নানা প্রান্তের বণিক ব্যসায়ীরা ইংরাজের জমিদারি এলাকায় বাসা বাধলেন । বাংলার তদানীন্তন নবাব আলিবর্দির শাসন কালে বারংবার বর্গী হানা থেকে বাচতে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয় নিলেন কলকাতায় । কলকাতার লোকসংখ্যা বাড়লো । 
১৭০৭সালের জরীপ অনুযায়ী তখনকার কলকাতার সীমানা ছিল এইরকম – ‘বাজার কলকাতা’ ও ‘টাউন কলকাতা’র সীমানা ছিল মোটামুটি বউবাজার থেকে পশ্চিমে লালদীঘি বড়বাজার পর্যন্ত । মোট জমির আট ভাগের একভাগ ছিল বসতি। টাউন কলকাতার চারভাগের একভাগ জমিতে ধান চাষ হত...এখনকার চৌরঙ্গি অঞ্চলটা ছিল গোবিন্দপুর গ্রামের মধ্যে আর চিৎপুর সহ উত্তর কলকাতা ছিল সুতানুটি গ্রাম । সুতানুটির ১৭০০ বিঘা জমির মধ্যে ১৫০ বিঘারও কম জমিতে ছিল লোকবসতি । বেশির ভাগ জমিতেই ধান চাষ হত” বিনয় ঘোষ / ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’। এই ছিল আদি কলকাতার চেহারা । ১৭৫০-৫৫ সালে সুতানুটিতে এককাঠা জমির দাম ছিল ১১টাকা ।
১৭০৭এ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুখল শাসনের পতনের দিন গোনা শুরু হয় । বাংলাতে কোন কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না । বাংলার স্বাধীন নবাব নিঃসন্তান আলিবর্দি খান তার নবাবী, পারিবারিক কলহ আর মুর্শিদাবাদ নিয়ে ব্যস্ত । ইংরাজ ব্যবসা করার অনুমতি পেয়ে কলকাতাকে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য করে তুলতে বাংলার নবাবীটাও দখলের ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল । ইতিমধ্যেই তারা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ বানিয়ে সেনা মোতায়েন করেছে । আলিবর্দির দৌহিত্র তরুণ সিরাজ ইংরাজদের ঔদ্ধত্যের কিঞ্ছু আঁচ পেয়েছিলেন । ১৭৫৬র ৯ই এপ্রিল আলিবর্দির মৃত্যুর পর নবাবের আসনে বসার তিনমাস পরেই ইংরাজদের শিক্ষা দিতে সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন, ইংরাজরা পরাস্ত হয়, কলকাতার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘আলিনগর’ হয় । কলকাতায় জাঁকিয়ে বসা ইংরেজরা ঠিক একবছর পরেই শিরাজের প্রমুখ মন্ত্রী মীরজাফর’এর বিশ্বাসঘাতকতা ও তাদের বিশ্বস্ত বাঙালি বেনিয়াদের সহযোগিতার বলে বলীয়ান ইংরাজ প্রতিশোধ নেয় পলাশীতে ১৭৫৭’র ২৩শে জুন । মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ পরাজিত হন, আত্মগোপন অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা হয় ।
আমাদের সেই জানা ইতিহাসের ধারা বর্ণনা দেওয়া এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয় । আমি বুঝতে চেয়েছি সেদিনের কলকাতার শৈশব ও বেড়ে ওঠার দিনগুলো কি ক্লেদাক্ত ছিলস,বাঙালি বেনিয়া, মুৎসুদ্দি, ইংরাজের চাটুকারদের লোভ ও অনৈতিকতার কি কুৎসিত চেহারা শৈশবের কলকাতা সাক্ষী থেকেছিল তা জানলে আমাদের অবাক হতে হয় ! কলকাতা শহরের বিকাশ ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারায় হয়নি, ঢাকা বা মুর্শিদাবাদের মত প্রাচীনত্বের বা ঐতিহ্যের অহংকারও কলকাতার ছিল না । দেওয়ানী পাওয়ার পর ইংরাজ কোম্পানী কি দানবীয় শক্তি অর্জন করেছিল তা বিস্ময়কর । সেই সময়ের চরম দুর্নীতি পরায়ন, উৎকোচ বিলাসী ওয়ারেন হেষ্টিংসের এক অনুচর নালিশ করেছিল মহারাজ নন্দকুমারের নামে । হিন্দু ব্রাহ্মণ নন্দকুমারকে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় ধরে এনে বিচারের প্রহসন করে ফাঁসিকাঠে লটোকে দিয়েছিল হেষ্টিংস (১৭৭৫)। আর “এই হত্যাকান্ডের অন্তরালে ছিলেন এই মহানগরীর এক বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিক”(রামমোহন ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’/প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়)। গবেষক বিনয় ঘোষ ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার কলকাতার অধিবাসী এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন গঙ্গাতীরে ভিড় করেছিল, এবং ব্রাহ্মণ হত্যার দৃশ্য পাপ মনে করে গঙ্গা স্নানান্তে পবিত্র হয়েছিল । শোনা যায় এই সময় কলকাতার ব্রাহ্মণরা অপবিত্র শহর ত্যাগ করে গঙ্গার পশ্চিম তীরে বালি-উত্তরপাড়া অঞ্চলে দলে দলে যাত্রা করেছিলেন” । 
হেস্টিংসের দুর্নীতির কথা জেনেছিলেন নন্দকুমার । নন্দকুমারের ফাঁসির সময় ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন হুগলীর খানাকুল গ্রামে তিন বছরের শিশু । রামমোহন কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করেন ১৮১৫ থেকে, তাঁর ৪৩ বছর বয়সে । বলা যায়, শহর কলকাতা তখন থেকেই দেখতে পেয়েছিল আলোর রেখা । তার আগে, সেই শৈশবের কলকাতা ছিল ক্লেদাক্ত অন্ধকারের সাক্ষী ।
১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধের পরই কলিকাতার নগরায়ন শুরু হয় । পলাশীর যুদ্ধের আগে কলকাতায় পাকা বাড়ির সংখ্যা এক কুড়িও ছিল না । সেই কলকাতা গড়ে উঠলো লুঠের টাকায় । ইতিহাস অনেক লুঠ দেখেছে – সুলতান মাহমুদের লুঠ, , সোমনাথ মন্দিরের লুঠ, নাদির শাহের দিল্লী লুঠ কিংবা বর্গীদের লুঠ । কিন্তু পলাশীর লুঠ ছিল তুলনা হীন। পাঠ্য ইতিহাসে ‘পলাশীর লুন্ঠন’ কথাটা পড়েছি কিন্তু কত কুৎসিত ছিল সেই লুন্ঠন তা পাঠ্য ইতিহাসে লেখা নেই । সিরাজকে পরাস্ত ও গুপ্ত হত্যার পর ক্লাইভরা মীরজাফর ও অন্যান্য এদেশীয় চাটুকারদের নিয়ে ‘নবাবের কোষাগারের দরজা ভেঙ্গে তা লুঠ করে । লুঠের সময় উপস্থিত ছিলেন নবকৃষ্ণ দেবও’ (‘কলকাতা তিন শতক’/কৃষ্ণ ধর) । একশ নৌকা বোঝাই হয়ে সেই লুঠের টাকা মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় আসে, ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছিল ক্লাইভ ও তার সহকর্মী আর তার সহযোগী দেশীয় বাঙালি বেনিয়ারা । ইতিহাসের সে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় । এই কলঙ্কের ভিত্তিমূলেই কলকাতার সমৃদ্ধির সূত্রপাত । লুঠের বখরার টাকায় কোম্পানীর দালালি,চাটুকারি করে শৈশবের কলকাতার বাঙালি নাগরিক সমাজ । ক্লাইভের দূর্নীতির কথা বিলেতেও গিয়ে পৌছেছিল । বিচার সভায় ক্লাইভ বলেছিল “পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর আমি যে কি সুযোগ পেয়েছিলাম তা একবার বিবেচনা করুন । ধনৈশ্বর্যে ভরা এক বিরাট মহানগর(মুর্শিদাবাদ) আমার হাতের মুঠোয় ছিল; বড় বড় ধনিক স্বদেশীয় মহাজনেরা আমার মুখে একটু হাসি ফোটাবার জন্য টাকা ছোঁড়াছুড়ি করতেন...মিঃ চেয়ারম্যান, এই মুহুর্তে আমি যখন এই সব কথা আপনাকে বলছি, তখন আমার নিজের সংযম বোধের কথা ভেবে আমি সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছি” । 
এই নাগরিক সমাজকেই পেয়েছিল শৈশবের কলকাতা । তাই ১৭৭০- ৭৩এর ভয়াবহ মন্বন্তরে সুবেবাংলার একতৃতীয়াংশ মানুষের অনাহার মৃত্যুতে এই নাগরিক সমাজের কোন হেলদোল ছিল না । বরং তাদের বৈভব বাড়তেই থাকলো । নবাবের কোষাগার লুন্ঠনে ক্লাইভের সহযোগী ক্লাইভের সামান্য মুন্সী নবকৃষ্ণ দেবকে হেস্টিংস সুতানুটির (সমগ্র উত্তর কলকাতা)তালুকদার বানিয়ে দিলেন ১৭৭৬এ আর তার আগে হেস্টিংসের দুর্নীতির প্রতিবাদকারী নন্দকুমারকে ফাঁসিতে লটকে দিয়েছিলেন ১৭৭৫এ । শৈশবের কলকাতায় ইংরাজ কোম্পানীর বিশ্বস্ত সহযোগীএই দালা্‌ বেনিয়া, বেলেল্লাপনায় ডুবে থাকা নাগরিক সমাজ পরিপোষন করতো এক চরম অবক্ষয়ী সংস্কৃতি, সাধারণ শ্রমজীবি ও কৃষিজীবি মানুষের বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে যার কোন মিল ছিলনা ।
অন্য গোলার্ধে তখন ঘটে চলেছে নানান যুগান্তকারি ঘটনা । ১৭৭৬এ আমেরিকার বৃটিশ উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা ঘোষণা,১৭৮৯এ ফরাসি বিপ্লবের সংবাদ কলকাতা পেয়েছিল । ততদিনে কলকাতায় ছাপাখানা চলে এসেছে । ১৮৮তে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘হিন্দু কলেজ’এর । ১৭৯৬এ টমাস পেইনের ‘দি এজ অফ রিসন’ কলকাতায় পৌছে গেলো, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন ২৭ বছরের যুবক । কলকাতা আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে । সে অন্য কাহিনী । আমি শুধু কিছু জানা অজানা তথ্য সংগ্রহ করে শিকড়হীন, আলোহীন শৈশবের কলকাতার একটা ছবি লিখতে চেয়েছি মাত্র ।

“ভালবাসা” / Ritwik Das Sharma





“ভালবাসা” নামক অনুভুতি, উপলব্ধি বা বোধের যে শিক্ষক বা রাজা, সেই রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ভালবাসা পেতে, বা ভালবাসা আদায় করতে এত একচোখা ও স্বার্থপর হতে পেরেছিলেন তা ভাবা যায় না । শোনা যায় এই ব্যাপারে তাঁর ঠিক অগ্রজ ‘নতুন দাদা’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এঁর মনে যে উদারতা ও ত্যাগ দেখা গিয়েছিল, তা মনকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় ।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এক সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গানবাজনা কবিতা সাহিত্য নাটক প্রভৃতির চর্চা নিয়ে যে বিরাট সাংস্কৃতিক আখড়া বানিয়েছিলেন, সেখানে একদিন তাঁর প্রিয় বন্ধু ও তখনকার সময়ের প্রখ্যাত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী মহাশয়কে নিয়ে এসেছিলেন । বিহারীলাল চক্রবর্তীর লেখা কবিতা গুলি তার স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর খুব পছন্দ হয়েছিল । তা বুঝতে পেরে বিহারীলাল বাবু নুতন নুতন কবিতা লিখে প্রায় কাদম্বরী দেবীকেই আগে দেখাতেন । এই ভাবে ক্রমশ কাদম্বরী দেবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, ঠাকুরবাড়িতে আসা যাওয়া ঘন ঘন বেরে যেতে লাগল তাঁর । কাদম্বরী দেবীর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ ও তাঁর অনুরাগ আদায় করতে প্রায় প্রতিদিন একটি করে প্রেমের কবিতা লিখে নিবেদন করতে লাগলেন । যা সকলের গোচরেই ঘটতে লাগলো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এতে ক্ষুণ্ণ হওয়া তো দূরের কথা বরং কাদম্বরীদেবীকে, বিহারীলাল বাবুর প্রতিভার সমাদর করতে প্রায় দিন ভাল মন্দ রেঁধে খাওয়ানর পরামর্শ দিতেন । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, তাঁর প্রিয় নুতনবৌঠানের প্রতি বিহারীলাল এর প্রেমজ আকর্ষণ একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি । সেই কথা একদিন নিজের স্ত্রী মৃণালিণী দেবীকে অকপটে স্বীকার করে বলেছিলেন, “জান তো ছোট বউ, আমি নুতনবউঠানকে এতটাই ভালবাসতাম যে বিহারীলাল বাবুর থেকেও ভাল কবিতা লেখার তারনায় দিন রাত লিখতে শুরু করেছিলাম । যখন তখন নুতন বৌঠানের ঘরে গিয়ে, তাকে জোর করে পাসে বসিয়ে রেখে বা বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার কবিতা শোনাতাম । তখন নুতনবউঠান বলতেন, ‘যাই বল বাপু, বিহারীলাল বাবুর মত লিখতে তোমার অনেক দেরি আছে’ ... শুনে আমার ভীষণ রাগ হত, একবার ম্যাকবেথ নাটকের “হেকটি” নামক ডাইনি চরিত্রটির মত বউঠানের নামে কবিতা লিখি । পরে বুঝেছিলাম নুতনবউঠান আমাকে এতটাই ভালবাসত যে, আমাকে খেপিয়ে দিয়ে আমার থেকে অতুলনীয় কিছু লেখা বার করে নিতে সাহায্য করাই ওঁর উদ্দেশ্য ছিল” । নিজের স্ত্রীর মনে, কাদম্বরী দেবীর প্রতি তাঁর দুর্নিবার প্রেম ও ভালবাসা, কটটা আঘাত করতে পারে তা না ভেবেই এমন অনেক স্বীকারুক্তি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ।
অথচ পরবর্তি কালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্ত্রী কাদম্বরী দেবী, তার প্রিয় দেওরটির প্রেমে পরেছে, তখন ওঁদের দুজনের জন্য ‘অলিকবাবু’ নামে একটি নাটক লিখে...নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নায়ক নায়িকা হিসাবে ওঁদের অভিনয় করালেন । নিজের স্ত্রীর মুখ দিয়ে সংলাপ বলালেন... “ আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্র সূর্য কে সাক্ষী করে মুক্ত কণ্ঠে বলব তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলব সহস্র বার বলব, আমিই তোমার স্ত্রী” । এই গল্পও নির্দ্বিধায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে অকপটে বলেছিলেন... !!!!


Monday, April 14, 2014

**শুভ নববর্ষ** ১৪২১


বছর শেষের ঝরা পাতা বলল উড়ে এসে,
একটি বছর পেরিয়ে গেল হাওয়ার সাথে ভেসে;
নতুন বছর আসছে তাকে যতন করে রেখো,
স্বপ্ন গুলো সত্যি করে ভীষণ ভালো থেকো।
**শুভ নববর্ষ** ১৪২১ 

স্কুল পরিদর্শন / ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী / ১৫.০৪.২০১৪ / ১লা বৈশাখ ১৪২১ / সকাল ৮ টা ।

স্কুল পরিদর্শন 


ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী / ১৫.০৪.২০১৪ / ১লা  বৈশাখ  ১৪২১ /  সকাল ৮ টা ।

 মাষ্টার মশাই কলার টেনে দু গালে দুটো শক্ত চাঁটি মারলেন ছেলেটির গালে । গাল লাল হয়ে গেল । তারপর বেত্রাঘাত সপাং সপাং । ছেলেটি ছট পট করতে করতে বলে,“সার মারবেন না আমি পরের বারে ভালো করে উত্তর দেব। আমার মা নেই আমাকে ঘরের কাজ করতে হয় । তার মধ্যে পডার সময় পাই না ।” 
মাষ্টার মশাই বলেন মাতৃভাষায় ফেল । ছি ছি মাতৃভাষার অপমান । ওরে তোদের চোদ্দ পুরুষে কেউ পডাশুন করেছে যে তুই করবি? যা রিক্সা টান ! কাজে দেবে । এই বলে আবার বেত্রাঘত ।  সঙ্গে চাঁটি লাথি .. মানে রাগের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন মহাশয় । ক্লাসের অন্য ছেলে মেয়েদের মুখে রা নেই । নীরবে সহ্য করে তারা এই অকথ্য অত্যাচার । প্রতিবাদ করার শক্তি কারুর মধ্যে আছে বলে মনে হয় না । সাহিত্যের মাষ্টার খুব কড়া মেজাজের এবং রাগি । রাগলে ওনার জ্ঞান থাকেনা । মেরে মেরে ছেলেটির ফর্শা চেহারা লাল হয়ে জায় । কান গাল লাল টক টক করছে ।
ছেলেটি আর পারছেনা এই অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে । সাহিত্যে সে , তার মতন লিখেছে তবে সার কেন তাকে পশুর মত মারছেন ? সে ত বলছে সারকে পরের বারে পরীক্ষায় ভালো লিখে দেখাবে ।
শিক্ষকের নির্দেশ -  বাইরে হাঁটু গেড়ে কান ধরে বসতে । তখন ছেলেটি প্রায় আধমরা  হয়ে গিয়েছে মার খেয়ে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।দু চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত অশ্রু ধারা মুখে লালা আর মারের চোটে শার্ট ছিঁড়ে কুটি কুটি । কলারটাও ছিঁড়ে গিয়েছে বেচারার । কান্নাও থামছেনা । শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জ্বালা যন্ত্রণায় বিবশ করে ফেলেছে । হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কেঁদে ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট ছেলেটির । তবুও সারের দয়া হলনা ! 
ঠিক সেই সময় বাইরে জীপের শব্দ । পেছনে একটা সাদা রং এর  এম্বাস্যাডার কার তাতে লেখা স্কুল এন্ড মাস এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট   
স্কুলে কমিশনার , স্কুল এন্ড মাস এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট , স্বয়ং ।   মহাশয়ার বিনা প্রোগ্রামে সারপ্রাইজ ভিজিট সঙ্গে জেলা শিক্ষা অধিকারী   এবং স্কুল এস আই ।
হঠাৎ পরিবেশটা এমন হবে কেউ আশা করেন নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় দৌড়ে গেলেন স্বাদরে আমন্ত্রণ জানাতে । কিন্তু কমিশনার মহোদয়ার চোখ সেই ছাত্রটির ওপর পড়লো । ওই ছেলেটি তখন ও কাৎরাচ্ছে যন্ত্রণায় ।  উনি  কোন কিছু না বলেই ছেলেটিকে  উঠতে বললেন  । তারপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পরম স্নেহ ভরা নয়নে বললেন, “কি হয়েছে বাবা ? তোমার নাম কি ? তুমি কেন কাঁদছ ? তোমায় কে মেরেছে ? ...ইত্যাদি ইত্যাদি ।
ছেলেটি থর থর করে কাঁপতে লাগলো তারপর বলল আমার নাম পদ্মলোচন দাস ।  আমি  সাহিত্যতে ২৪ নম্বর পেয়েছি তাই সার আমায় মেরেছেন । আমি ভালো লিখেছিলাম । আমার মা নেই তাই বাবা ঘরের কাজ করতে বলেন । আমি গরীব । আমদের দু বেলা খাওয়ার জোটে না । স্কুলে মিড ডে মিল খেতে আসি । তা নাহলে তাও জুটতোনা । কথাগুলো হাঁপাতে হাঁপাতে এক নাগাড়ে বলে গেল ছেলেটি । 
এটা ত মারা নয় এটা রীতিমত বধ করা ! তা কে সেই ব্যক্তি তোমায় বধ করেছে ? এই বলে ছেলেটিকে নিজের কোলে তুলে পিঠে হাত বুলতে লাগলেন । সারা গায়ে চোট দেখে শিউরে ওঠেনমুখে ,“আহারে কে সেই পাষণ্ড !  এরকম ভাবে কেউ ছাত্রদের মারে? ” আর  তোমরা  ছেলে মেয়েরা তোমরা কেন মানা করনি সারকে?
ক্লাসের সব ছেলে মেয়ে এক সঙ্গে বলল আমাদের সাহিত্য সার ওকে মেরেছেন আমরা মানা করলে আমাদেরও মারতেন সার ।
তাই-বুঝি ! কমিশনার মহোদয়া , প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে সেই সাহিত্যের শিক্ষক কে হাজির করতে বলেন ।
প্রধান শিক্ষক বলে মাদাম আজ এক বছরের ওপর এই স্কুলে সাহিত্যর শিক্ষক নেই । আমাদের স্কুলের ক্লার্ক শ্যামল বাবুকে ওই বিষয় পড়াতে বলি ।
ডি. আই মহাশয় সাফাই দেন , উনি বারে বারে এই বিষয় চিঠি লিখেছেন কিন্তু সুফল হয় নি।
কমিশনার আড় চোখে দুজনের উত্তর শোনেন তার পর ছেলেটির পরীক্ষার খাতা আনতে বলেন । 
ছেলেটি ভয়ে কেঁদে ফেলে । সে ভাবে আবার বোধ হয় মার দেবেন ।
কমিশনার ছেলেটিকে পরম স্নেহে বলেন ,“কাঁদিস না বাবা আমি তোর মা । কাঁদে কেউ বোকা ছেলে আমি মারবনা ভয় পাচ্ছিস কেন ? ” আচ্ছা বাবা তোর নাম পদ্মলোচন তাই না ?
হ্যাঁ ।
বলতো বাবা তোর নামের মানে কি ?
পদ্ম মানে পদ্ম ফুল .. লোচন মানে চোখ , যার চোখ পদ্মের মতন তিনি শ্রী রাম
বাঃ ।  কে বলেছে তুই সাহিত্যে কাঁচা ! এই বলে মাথায় হাত দেন ।
ছেলেটির লেখা খাতা এল । এই সময় সাহিত্যের শিক্ষক হাত জোড় করে বলেন আমরা নিজেদের ভাষা ভুল লিখছি । আমাদের মাতৃভাষাকে অপমান করছি । এটা কি বরদাস্ত করা জায় ?
প্রধান শিক্ষক মহাশয় চুপ করতে বলেন ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে ।
কমিশনার মহাশয়া খাতা দেখে বলেন বাঃ ছেলেটি-ত বেশ লিখেছে । ওকে এই প্রশ্নের উত্তরে  ১০ এ ৭ দেওয়া উচিৎ । আপনি কি আপনার মাইনের টাকা থেকে নম্বর দিচ্ছিলেন না জীবনে ৩০ এর বেশি নম্বর পান নি পরীক্ষায় কি শ্যামল বাবু ? কোনটা ঠিক ? ছেলেটি যা  লিখেছে আমি হলে ওকে ৫০ দিতাম ১০০ থেকে । আপনি মাধ্যমিক টুকে পাস করেছিলেন না লিখে আপনি ১০ এ ২ , ১০ এ ৩ এরকম করে ২৪ নম্বর দিয়েছেন । আচ্ছা বলুন তো এক+এক সন্ধি হলে কি হয় ? সন্তানের স্ত্রী লিঙ্গ কি ?
দুটোরই উত্তর ভুল হল। কোনটার ই উত্তর সঠিক পেলেন না । দেখলেন ত এবার বলুন সাহিত্য কার বেশি জানা জরুরি । নিজেকে আগে প্রস্তুত করুন তারপর বাচ্চা ছেলের গায়ে হাত দেবেন। এত আস্পর্ধা ! কচি ছেলে মেয়ের গায় হাত !! ঘরে বৌকে মারেন নিশ্চয় !!! কি শ্যামল বাবু ?  
কমিশনার মহোদয়া ওইখানেই ডিক্টেসন দিয়ে শ্যামল সারকে সাসপেন্ড করার জন্য ডি.আই কে নির্দেশ দিলেন। প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে ১০০ কিলোমিটার দুরে এক স্কুলে বদলির আদেশ দিলেন । শ্যামল সারকে ডি. আই অফিসে হেড কোয়ার্টার ফিক্স করলেন । সাহিত্যের শিক্ষক ওই স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন । সব শিক্ষক শিক্ষিকা র উদ্যশ্যে বলেন কোন ছেলে মেয়ের গায়ে হাত দেবেন না । ওদের ভালো করে বুঝিয়ে পড়াবেন । এমনিতেই স্কুলের উপস্থাপন কম হচ্ছে এর পর আরও কমে জাবে । গরীবের ছেলে মেয়ে এখানে বিদ্যার্জন করতে আসে মার খেতে নয় ।  আপনাদের সরকার মাইনে দিচ্ছে পড়ান জন্য ।  এটা সকলকে ওয়ার্নিং । মনে থাকে জেন।
যাওয়ার সময় ছেলেটির হাতে ১০০ টাকা দিয়ে বললেন একটা নতুন জামা কিনে পরবি বাবা । ছেলেটি এবার খুশিতে কমিশনার মহোদয়ার পা জড়িয়ে ধরল । চোখ থেকে তার অবিরাম অশ্রু  ধারা বয়ে কালো দাগ হয়ে গিয়েছে । কিন্তু তার সব কষ্ট এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। সে জেন তার মাকে পেয়ে-গেল । অনেকক্ষণ কাঁদছিল এবার মুখে হাঁসি দেখে কমিশনার খুশী হলেন। এক টিচার ভদ্রলোককে দায়িত্ব দিলেন ওই ছেলেটির নতুন জামা কেনার , কারন উনি জানেন ছেলেটি ঘরে টাকা নিলে ওর কাছথেকে হয়তো ওর বাবা ছাড়িয়ে মদ খেয়ে নেবে ওই টাকায় ।
সকলে আনন্দে  তালি দিয়ে মহাশয়াকে সম্বোধন করল , “আপনি আমাদের মা , সাক্ষাৎ মা।”  
কমিশনার মহোদয়া সকলকে  বসতে বলে শিক্ষক দের উদ্দেশ্যে বলেন ছাত্রদের মারলে তারা ভয়  পাবে আর তাতে স্কুলের উপস্থাপন কমে জাবে । সে-টাকি ভালো ! ওদের ভালোবেসে পড়াতে হবে ।  কেন পারছেনা সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে । সেই অনুযায়ী ওদের বারে বারে বোঝাতে হবে । শিক্ষকের ধৈর্য এবং স্নেহ দুটোর প্রয়োজন । মেরে কাউকে ভালো মানুষ করা যায়না । এটা মনে রাখবেন। শিক্ষক সর্বদা নমস্য কিন্তু সেই শিক্ষক কে তার কর্তব্য করতে হবে কারন তারা মানুষ তৈরির শিল্পী।
মা মরা ছেলে পদ্মলোচন দাস আজ প্রথম এক ভিন্ন মার স্নেহ পেল । তার আনন্দাশ্রু তে দুচোখ ভরে উঠলো । সে ঘরে ফিরে ভালো করে সাহিত্য পডে দেখিয়ে দেবে সকলকে সে কিছু কম নয় । কমিশনারের দেওয়া শার্ট পরে পরীক্ষা দেবে । এবারে সে ফার্স্ট হবে ।
ত্রিভুবনজিৎ  মুখার্জী / ১৩.০৪.২০১৪ / রবিবার রাত ১১.০৯ ।
   

Friday, April 11, 2014

অনুগল্প 'ইতিপুর' ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী , ১১.০৪.২০১৪

অনুগল্প 'ইতিপুর' 
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী , ১১.০৪.২০১৪

ছোট্ট একটি গ্রাম । নাম ইতিপুর । গ্রামটির ধার দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট্ট একটি নদী । নাম ‘দয়া’ নদী । যারা “ধউলী শান্তি স্তূপ” দেখেছেন তারা নিশ্চয় এই দয়া নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে গিয়েছেন । এই দয়া নদীর ইতিহাস মর্ম স্পর্শী কারন এখানেই কলিঙ্গ যুধ্য হয় । হাজার হাজার কলিঙ্গ সেনার রক্তে ভাসে দয়া নদী । এই দয়া নদীর বর্ণ লাল হয় । সম্রাট অশোক এখানেই চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হন । বৌধ্য ভিক্ষু উপ গুপ্ত তাঁকে বৌধ্য ধর্মে দীক্ষিত করেন ।আমরা সকলেই ইতিহাসে পডেছি এই বিষয় । 
  তাই জাপান থেকে এসে বুধ্য ধর্মালম্বিরা এখানে শান্তি স্তূপ বানান । বিশিষ্ট প্রস্তর শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়ক এই শান্তি স্তূপ বানান । এর পর থেকে এই শান্তি স্তূপ প্রধান আকর্ষণ হয় পর্যটকদের এবং পুরী ভুবনেশ্বর এলেই লোকে ধউলী শান্তি স্তূপ অবশ্যই দেখে যান ।
 তবে আমি বলছি ইতিপুরের কথা । এই গ্রামটি দয়া নদীর ধারে অবস্থিত । নাম থেকেই সহজে অনুমেয় এটা শেষ গ্রাম তাই নাম ইতিপুর । এই গ্রামে অনেক দিন আগে এক দম্পতী বাস করতেন নদীর ধারে ঘর বানিয়ে । স্বামী কাজে জেতেন কিন্তু স্ত্রী সারাক্ষণ ঘরে মন মরা হয়ে বসে থাকতেন। ঘরে স্বামী ফিরলে বলতেন , “নদীর ওপার টা কত সুন্দর তুমি ওপারে কেন ঘর বানালে না । ওপারের রং কি সুন্দর সোনার মতন বালি , নীল রঙ্গের পাহাড় , আর সবুজ রঙ্গের গাছ পালা । মেঘ ঢাকা পাহাড় আর তাতে বিদ্যুতের ঝলকানি সব মিলিয়ে ছবির মতন লাগে । এপারটা দেখ কিছুই আকর্ষণ নেই যেন খাঁ খাঁ লাগে । আমার ভালো লাগে না । তুমি ওপারে ঘর কর । আমি ওপারে থাকবো । ”
স্বামী আশ্চর্য হয়ে বলতেন ঠিক আছে একদিন ওপারে নিয়ে যাবো তোমাকে । তারপর বলবে কোথায় ঘর করলে ভালো হবে । এক রবিবার স্বামী স্ত্রী তে ওপারে গেলেন । স্ত্রী ওখানে পৌঁছে বললেন এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি । এতো আমার সেই নদীর ওপার নয়। এখানে পাহাড় গর্তে ভরা । মরা গাছের ডালে ন্যাড়া পাহাড় অতি কদাকার লাগছে । এ সে জায়গা নয় । আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল ।
স্বামী বোঝান স্ত্রীকে ,  তুমি ভুল করছ । এটাই সেই জায়গা যা  তুমি ওপার হতে দেখতে । এখন দেখ আমাদের ওই পার কেমন দেখাচ্ছে ? কি সুন্দর দেখছ । সবুজ গাছ পালা , ধানের ক্ষেত , সরু বাঁকা নদী বয়ে গিয়েছে । সব মিলিয়ে চিত্রকরের হাতে তূলির টানে আঁকা চিত্রপট । দেখ আমি কত সুন্দর জায়গায় তোমাকে রেখেছি অথচ তুমি আমার তৈরি ঘরকে হতাদর করছ । এখন বল কোথায় থাকবে? এখানে না ওখানে ? এইখানেই ভগবানের সৃষ্টি দুটো চিত্রপট দেখলে । ভগবান আমাদের দুটি জিনিষ দিয়েছেন ১. তৃষ্ণা ২. তৃপ্তি । তুমি , তৃষ্ণার বশবর্তী হয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে তুলনা করে মনে তৃপ্তি পাচ্ছিলেনা তাই অতৃপ্ত তোমার আকাঙ্ক্ষা । যা আছে তাতে তুমি তৃপ্ত হলে তোমার আকাঙ্ক্ষা হবেনা কিন্তু অতৃপ্ত হলে আকাঙ্ক্ষা বাড়বে । সেখানে তুমি যত যাই পাওনা কেন সর্বদা একে তাকে দুষবে , মনে কষ্ট পাবে । কিন্তু তোমার তৃষ্ণার সমাপ্তিতে তুমি পরম আরাধ্য পরম পিতা ভগবানের সন্নিকটাবর্ত্তি হবে তাতে আত্ম তৃপ্তি পাবে। তাই আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত রাখ । 
স্বামীর কথায় স্ত্রী হতবাক । স্ত্রী তাঁর ভুল বোঝেন ।