ঝড়
বনশ্রী মিত্র
ঝড় আসছে, সামান তুলে নে রে পাতুয়া! আজ আর মেলা হবে না। ফলের টুকরি গোছাতে-গোছাতে আকবর আলি পাতুয়াকে তাড়া লাগান। কিন্তু আজ তো যাত্রা পালা আছে চাচা, মহুয়ার নাচ আছে। অনেক লোক হবে। তুমি দেখবে না?
আরে ওসব আজ আর হবে না রে পাতুয়া—খবরে বলেছে, জোর বারিশ আসছে, ঝড় বইবে ইদিকে, সাইক্লোন। তুই জলদি সামান তুলে বাড়ি যা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। দোকানিরা মেলায় সবে দোকান সাজাতে শুরু করেছে। রহিম মোল্লার ঘাগরার দোকান। লাল মসলিনের ওপর নীল-হলুদ সুতোয় ফুল, প্রজাপতি। কমলার ওপর সবুজ-হলুদের পাখি। আরও নানা রঙের ছোট মেয়েদের ঘাগরা। পুঁতির মালা, কানের দুল সাজাচ্ছে মানিক তার দোকানে। টিয়া পাখির খাঁচায় ছোলা দিচ্ছে সোনাই। মেলা শুরু হলেই লোক জড়ো হবে। তখন সোনাইয়ের টিয়া কার্ড তুলে-তুলে ভাগ্য বাতলে দেবে সবার। বাঁশিওয়ালা ফুঁ দিচ্ছে তার বাঁশিতে। গোলাপি, সাদা বেলুন নিয়ে হাজির বেলুনওয়ালা। করিমের দোকানে লোহার কড়াইতে জিলিপি ভাজার তেল গরম হচ্ছে। এমন সময় আকবর আলির কথায় সব যেন থমকে যায়— তবে আজ আর বিক্রি-বাটা হবে না! মেলার এই কটা দিনই তো একটু বেশি রোজগার হয় ওদের। সংসারে দুটো পয়সা বেশি আসে। ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করে। বছরের বাকি দিনগুলো তো সেই আবার দিন আনা, দিন খাওয়া। কেউ ধান জমিতে লাঙল দেয়, কেউ বা মিস্তিরির কাজ করে।
মাইকে ঘোষণা হল— সাইক্লোন আসছে। দোকান তুলে নাও।
তাঁবুর বাইরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে মহুয়া কাঁদছে। তার পরনে নীল চোলি আর ঘাগরা। মুখে চড়া রঙ। মহুয়ার বুড়ো বাপ তখন যাত্রার ম্যানেজারের কাছে হাতজোড় করে পয়সা ভিক্ষা চাইছে—“এত দূর থেকে এলাম বাবু, কয়েকটা টাকা দেন, বাড়িতে বড় অভাব।”
ম্যানেজার খেঁকিয়ে ওঠে— “পয়সা কিসের? একটাও টিকিট বেচতে পারলাম না আর উনি পয়সার স্বপ্ন দেখছেন! যদি আবার মেলা বসে, মেয়েকে নিয়ে এসো, যাত্রায় নাচবে, পয়সাও পাবে।”
মহুয়ার কানে তার বাবা আর ম্যানেজারের কথা ভেসে আসে। এক সপ্তাহ ধরে মায়ের জ্বর। ডাক্তারবাবু শহরে নিয়ে যেতে বলেছে। ছোট বোন টিয়াকে মায়ের কাছে রেখে সে আর তার বাবা পাশের গ্রাম থেকে অনেক পথ হেঁটে এসেছে। সারাদিন কিছু পেটে পড়েনি তার। খিদেয় পেট ব্যথা করছে।
পাতুয়া মাটির পুতুলগুলো টুকরিতে গুছিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়। আকাশ কালো করে আছে। হাওয়া বইছে।
— “আমার খুব খিদে পেয়েছে বাবা।”
মহুয়ার কথায় বুড়ো কানু হালদার ফুঁসে ওঠে— “হারামজাদি! এক পয়সা রোজগার হল না! তোর খিদে পেয়েছে? এমন ভাঙা কপাল নিয়ে জন্মেছিস যে, রোজগারের দিনেই ঝড় নিয়ে এলি! চুপ করে এইখানে বসে থাক, আমি আর-একবার ম্যানেজার বাবুর সাথে কথা বলে আসি।”
পাশ দিয়ে যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ায় পাতুয়া— “আমার কাছে বাতাসা আছে। খাবে?”
কোনও জবাব না দিয়ে পাতুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মহুয়া।
“তুমি বুঝি ওই যাত্রাদলের?”
“হ্যাঁ, নাচ করতে এসেছিলাম দলে।” বাতাসায় কামড় দিয়ে মহুয়ার মুখ জুড়িয়ে যায়।
“তুমিই মহুয়া?”ছিপছিপে চেহারার সদ্য-কিশোরী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে শরীরে রক্তস্রোত বয়ে যায় পাতুয়ার।
“হ্যাঁ, আমিই। পোস্টারে নাম দেখেছ বুঝি!” ফিক করে হেসে ওঠে মহুয়া।
“কিন্তু ঝড়ের জন্য তো আজ আর হবে না কিছু। তা তোমার টুকরিতে কী আছে গো?”
“রাম, সীতা, হনুমান! তোমার চাই?”
“পাখি আছে, পাখি?” বড় বড় চোখ করে তাকায় মহুয়া।
—“আজ তুই এখানেই থাকবি। আমি আবার কাল আসব। ম্যানেজারবাবু আছেন।” কানু হালদার পকেটে একশো টাকার নোটে হাত বোলায়।
মহুয়া চিৎকার করে ওঠে— “না! না! আমায় এখানে রেখে যেও না। নিয়ে চলো, তোমার পায়ে পড়ি বাবা।”
ম্যানেজারের মুখে তখন লোলুপ হাসি।
আশ্রয়ের খোঁজে সবাই এদিক-ওদিক দৌড়চ্ছে। পাতুয়ার শরীর কাঁপতে থাকে। কিশোরী মহুয়া তাকিয়ে থাকে পাতুয়ার দিকে। গ্রামের ওপর তখন তীব্র গতিতে ঝড় আছড়ে পড়ছে।
No comments:
Post a Comment