Wednesday, August 19, 2020

স্বয়ংসিদ্ধা ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী 20.08.2020




 

স্বয়ংসিদ্ধা

ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী 08.03.2021

 

অভিজিৎ ও সুদেষ্ণা দেবীর কোলে যখন স্বয়ংসিদ্ধা এলো ওদের সকলের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল এক সুদেষ্ণা দেবী ছাড়া l

এখানে বলে রাখি অভিজিৎ ব্যানার্জী হাই স্কুলের অংকের শিক্ষক এবং সুদেষ্ণা দেবী বিজ্ঞানের শিক্ষিকা l দুজনেই একই স্কুলে পড়াতেন l অভিজিৎ বাবু অঙ্ক নিয়ে কোলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন এবং গোল্ড মেডেল পান l ডক্টরেট করতে পারেন নি নানান কারনে তাই সুদেষ্ণা দেবীর সঙ্গে বি. এড পাস করেন এবং এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন l সুদেষ্ণা দেবী বোটানি অনার্স নিয়ে ইউনিভার্সিটি তে দ্বিতীয় হন l দুজনেই প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছাত্রী ছিলেন l সুদেষ্ণা দেবী বি এড করেন l অভিজিৎ বাবু ইচ্ছে করলেই সহকারী প্রফেসার এর অফার পেতেন কিন্তু সুদেষ্ণা দেবীকে জীবন সাথী করার পর ঐ স্কুল সার্ভিস দিয়ে মাষ্টার হন l

সংসার দেখার জন্য এবং সুদেষ্ণা দেবী মা হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণ সময় মেয়েকে মানুষ করার পেছনে সময় দেন l কিন্তু তাঁর মেয়ে বাপের মতন উজ্বল শ্যাম বর্ণের তাই তার বিয়ে নিয়ে তিনি খুব চিন্তায় ছিলেন l মেয়েকে একদম নার্সারি থেকে 12 ক্লাস অবধি উনি পড়া দেখেছেন l অভিজিৎ বাবু মেয়েকে ফিজিক্স এবং অঙ্ক পড়াতেন l মেয়ে স্বয়ংসিদ্ধা শিশু শ্রেণী থেকে প্রথম হোত l ক্রমে মেয়ে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এবং এম বি এ করে l

মেয়ে চাকরি করার পর স্টেটসে যায় l সেখানে দু বছর কাটিয়ে দেশে ফেরে l খুব কম সময়ে উচ্চ পদে যায় এবং মোটা মাইনে পায় l তবুও ওর মায়ের চিন্তা মেয়ের বিয়ে নিয়ে l সব ভালো মেয়ের কিন্তু বড্ড জেদি l বিয়ের ব্যাপারে বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে l তার কোন ছেলেকে পছন্দ হয়না l স্বভিমানী অহংকারী মেয়েদের বিবাহ নিয়ে মা বাবার চিন্তার শেষ থাকেনা l মা বলেন তুই তোর লাইফ পার্টনার নিজেই ঠিক কর l সেটিও হবার নয় l কোন ছেলের কাছে মাথা নত করবেনা l স্বয়ংসিদ্ধার যুক্তি মেয়েদের ব্যক্তি স্বাধীনতা এখন পর্যন্ত কোন পুরুষ স্বীকার করতে পারেনা l কোন না কোন বিষয়ে পুরুষ নারীর মধ্যে এই বিভেদ আছে l এটা যে পুরুষের কাছে দেখবে সে তাকে কিছুতেই নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে না l এইতো বেশ আছে সে l তাকে কেন তার মা বিয়ের জন্য উৎপীড়ন করছে ! ভেবে উঠতে পারেনা l যাই হোক পাত্রপক্ষ এলে হয় সে মোটা ময়দার বস্তা নয় ঠ্যাংরা কাঠি আলুর দম l কারুর নাম প্যাঁকাঠি তো কাউকে আলুভাতে আবার কাউকে ডিব্বা বলে l মা বিরক্ত হন কিন্তু মেয়েকে কখনোই বুঝতে দেন না তাঁর মেয়ের কি খামতি আছে বলে l

নারীর আর্থিক স্বাধীনতা,স্বাবলম্বিতা, আত্মনির্ভরশীলতা এই সবগুলোকেই আমি সম্পূর্ণ সমর্থন করি এবং সম্মান দি কিন্তু কর্মজীবী মহিলারা কি তাঁর সংসারের প্রতি পুত্র কন্যার এবং স্বামীর প্রতি সঠিক ভাবে সময় দিতে পারেন?

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ছোট্ট শিশুটিকে আয়ার কাছে কিম্বা বুড়ো বাবা মার কাছে রেখে স্বচ্ছন্দে অফিসে চলে গেলেন তার মা l কিন্তু শিশুটির প্রয়োজন তার মা'কে l সে কি পায় তার মা 'কে? বোধহয় হয় না l

আমি চাই তুমি গৃহকত্রী হও গৃহিণী নয় l তুমি এমন সংসার গড়বে যেখানে স্বয়ং মা লক্ষ্মী বিরাজমান হবেন l স্নেহের বন্ধনে তুমি তোমার সন্তানকে যত্নর সহকারে তোমার নিজের তত্বাবধানে মানুষ করবে l সে মা 'কে পাবে গৃহ পরিচারিকাকে নয় l তোমার জ্ঞান তোমার বুদ্ধি মত্তা র পরিচয় তোমার সন্তানের মধ্যে প্রস্ফুটিত হবে এটাকি তুমি চাওনা? আমার মনে হয় প্রত্যেক নারী সন্তানকে শিশু অবস্থা থেকে তার আদর্শে মানুষ করুক যাতে সে সমাজে মাথা উঁচু করে বলতে পারে, আমার মা আমার জন্মদাত্রী সেই আমাকে পরিপূর্ণ করেছেন তাঁর শিক্ষা এবং বুদ্ধিতে l এটাকি কম প্রাপ্তি l নারীর পূর্ণতা আমার মনে হয় এতেই বিকশিত হবে l সমাজে সু নাগরিক তৈরির জন্য নারীর ভূমিকা সর্বশ্রেষ্ঠ l তুমি কি অস্বীকার কর?

এবার আসি আর্থিক আত্মনির্ভরশীলতা l হ্যাঁ বিষয়টা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হওয়া দরকার বিয়ের আগে l আমি তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেব তোমার ইচ্ছানুসারে খরচ করার কারণ রোজগারটা আমার একার নয় আমাদের l

আমি আমার জন্য কেবল জীবন সাথী নয় আমি চাই একজন সম্পূর্ণ নারী যে আমার সংসারকে মন্দির করে তুলবে l

রুপমের কথাগুলো স্বয়ংসিদ্ধা মন দিয়ে শুনছিল l তার মনে একটাই দ্বন্দ্ব চাকরি ছাড়া টা কি ঠিক সিদ্ধান্ত হবে? চাকরি ছাড়লে এই বয়েসে আর চাকরি পাবেনা l যদিও পায় এখন যা পাচ্ছে সেই পরিমাণ নাও পেতে পারে l তার যা জমানো টাকা আছে সেটা এখন কোটি ছোঁয় নি l 30% আয়কর দিয়ে যা থাকে তা এ যুগে অনেক টাকা l আগে গাড়ির লোন বাড়ির লোন সব শোধ হওয়ার পর খুব একটা বেশি পরিমাণ টাকা থাকতো না l এ ছাড়া তার নিজের মেডি ক্লেম আছে , লাইফ ইনস্যুরেন্স এর নমিনি তার মা বাবা l তার মা বাবা ছাড়া অন্য কাউকে সে সেই টাকার ভাগীদার হতে দেবেনা l তার জন্য তার মা স্কুলের চাকরি ছেড়েছিলেন কিন্তু সে দেখেছে তার মায়ের ব্যক্তি স্বাধীনতা তাতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে l যদিও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল কিন্তু সেটা সীমিত কারণ প্রয়োজনের অধিক খরচা করা মায়ের অভ্যাসের বাইরে l সে দেখেছে তার মা নিজের জন্য শাড়ি না কিনে মেয়ের জন্য ভালো ড্রেস কিনে দিয়েছেন যাতে মেয়ে এতটুকু না ভাবে তার মা তার প্রতি যত্নশীল নন বলে l স্কুল কলেজের সমস্ত খরচা এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য যথেষ্ট স্বার্থ ত্যাগ মা বাবা দুজনেরই ছিল l আজ সে যা হয়েছে তার জন্য তার মা বাবা উভয়ের কাছে কৃতজ্ঞ l এখানে প্রশ্ন উঠছে সংসারে ত্যাগ কি শুধু নারী করবে পুরুষ না l এটা তো সে মানতে পারে না l দুজনের সমান স্বার্থ ত্যাগ থাকা প্রয়োজন l

তার বাবা একটি সরকারি স্কুলের হেড স্যার হয়ে রিটায়ার করেন l বাবা তার উচ্চ শিক্ষার জন্য যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করতেন l মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মা বাধা দেন l মেয়ে ডাক্তার হোক কেন জানিনা মা চাইতেন না l তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে l পরে ভালো ইন্সটিটিউট থেকে এম বি এ করে ফিনান্স এ l মার্কেটিং লাইন টা স্বয়ংসিদ্ধার পছন্দ ছিলোনা তাই ফিনান্সসিয়াল ম্যানেজমেন্ট এ এম বি এ করে l খুব কম বয়েসেই ভালো অফার পায় l অন সাইটে যায় আমেরিকা l সে সর্বদাই একরোখা এবং একটু জেদি টাইপের মেয়ে l সেইজন্য কোন পুরুষ বন্ধু টিকতনা তার জীবনে l মা চাইছিলেন তার মেয়ে নিজের পছন্দের জীবন সঙ্গী খুঁজে নেবে l কিন্তু সেরকম কিছুই হত না l রাতে ভিডিও কল করতেন কিন্তু সে ঐ সপ্তাহে একবার l মায়ের বিবাহ সংক্রান্ত কিম্বা পছন্দের ছেলে সংক্রান্ত কোন প্রশ্নের উত্তর দিত না l একটাই কথা সে বিয়ে করবে না l

প্রত্যেক বাঙ্গালী মা চান তার সন্তান সন্ততিরা ভালো লাইফ পার্টনার বা জীবন সঙ্গী বেছে নিন এবং সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর সংসার করুক l

রূপম শুরু করে আমি যদি কোন ভুল রাস্তায় যাই আমাকে ঠিক রাস্তায় আনা তোমার দায়িত্ব l

- চমকে ওঠে স্বয়ংসিদ্ধা l ভুল রাস্তা? মানে পরকীয়া না নেশা করেন আপনি l

- আমাকে দেখে কি মনে হয় ঐ কোন একটা আমি করতে পারি?

- মানুষকে দেখে স্বয়ং নারায়ণ ও চিনতে পারবেনা তার আসল রূপ কি!

- নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি l আমি সিগারেট ও খাইনা মদিরা সেবন ও নয় l নারী আমার জীবনে আসেনি বললে ভুল হবে তবে কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি এবং সেগুলি ঐ বান্ধবীর পর্যায়ে থেকে গিয়েছে l প্রত্যেকেই আত্ম কেন্দ্রিক, গর্বী, অহং এ ভরা l তাদের মধ্যে রূপ আছে ঠিক কিন্তু মানবিকতার অভাব l সামান্য চাকরি করে ধরা কে সরা মনে করা মহিলাদের আমি ঠিক পছন্দ করিনা l অনেকেই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে কিন্তু চাকরি ছাড়তে রাজি হয়নি l তাই আমি কাউকেই পাত্তা দি নি l

হোটেলের বয় খাবারগুলো সাজিয়ে দেয় l স্বয়ংসিদ্ধা খাবার খেতে গর রাজি হয় l তার একটাই যুক্তি হোটেলের খাবার তার পছন্দ নয় l যদিও সে রাঁধতে জানেনা, মা শেখান নি নয় মা ওকে রাঁধতে দেন নি কখনো l সে ম্যাগী আর কফি বানাতে পারে l

- স্টেটস এ থাকার সময় কি করতেন?

- ঐ বান্ধবীদের সঙ্গে থাকতাম তারাই প্রায় মাইক্রোতে কি সব করতো l সব সিদ্ধ আর হেলদি ডায়েট l অপছন্দ ছিলোনা তার একটাই কারণ আমি কুকিং জানিনা l

- একদম করেন নি?

- না l

- চিন্তায় ফেললেন l

- কেন আপনি কি ভেবেছিলেন আমি আপনার ঘরে গিয়ে রান্না করে সকলকে খাওয়াবো বলে !

- না তা নয় l

-তবে তবে কি?

- যা বাবা এতো ভারি মুশকিল l আমি সেরকম কিছু মনে করিনি l In fact আমাদের ঘরে রান্নার মহিলা আছেন l তিনি সব রান্নাই করেন তবে ঐ সব নিরামিষ রান্না l কারণ বিধবা ভদ্র মহিলা l খুব বাতিক গ্রস্ত মহিলা l আমার ইচ্ছে হলে অন লাইনে এনে খাই তাও আমার রুমে l ডাইনিং টেবিলে মানা l

- ভালোইতো নিরামিষ খাবেন l পারবেন না?

- আপনি বললে খাবো তবে ঐ সপ্তাহে একদিন চিকেন কিম্বা মটন বিরিয়ানি না হলে কি চলে বলুন?

- উইক এন্ডে না হয় বাইরে ঘুরতে গিয়ে খাবো l সেটাইতো ভালো l উনি যখন চান না ঘরে মাছ মাংস কি লাভ সেগুলো করে ওনাকে ব্যস্ত করা?

- আমার মা ও তাই বলেন l

- আমার মা লোকনাথ বাবার ভক্ত l উনি পিঁয়াজ রসুন ও খান না l

- সে কি?

- আর বলছেন কেন l আমি তাই....

- আপনি চাইছেন আপনার বৌ রান্না করে মাছ,মাংস মুরগী খাওয়াবে !

- কি মুশকিল l তা কেন হবে?

- বাড়িতে যা রান্না হবে তাই খেতে হবে l আপনি বলেছেন আমি বাড়ির কত্রী গৃহিনী নয় l ঠিকতো ! না পরে পাল্টি খাবেন?

- হ্যাঁ তাই হবে l আপনি বিয়েতে রাজি l

- ভেবে দেখবো l কিছু বলতে পারছিনা l

- ঠিক আছে l ঐ শ্রী নগরের ফ্লাইট আর হোটেল রিজার্ভেশন গুলো তাহলে সেরে ফেলি l হনিমুন এ কাশ্মীর যেতে আপনার আপত্তি নেইতো!

- আমি সুইজারল্যান্ড দেখিনি তাই ওখানেই যাবো গেলে l

- বেশতো পাসপোর্ট ভিসা!

- সব আছে তবে না কাশ্মীর আমাদের দেশের ভূস্বর্গে সেটাই দেখতে যাবো l বিদেশে অনেক ঘুরেছি l

- তারমানে আপনি বিয়েতে রাজি!

- একটু মুচকি হেঁসে স্বয়ংসিদ্ধা মাথা নাড়িয়ে বলে এতো উতলা হওয়ার কি আছে l একটুতো ভাবতে হবে যাচাই করতে হবে l শুধু ছেলেরাই মেয়েদের বিষয় খোঁজ নেবে মেয়েরা কি সেটা করতে পারেনা?

- অবশ্যই খোঁজ নিন l

- আপনি কি করে ভাবলেন সে কথা?

- এইতো আপনি বললেন l

- বিবাহ বন্ধন বিশ্বাসের বন্ধন l সেখানে সন্দেহের কোন স্থান নেই l

- আমি দেখেই ভেবেছিলাম আপনি আমার সঠিক লাইফ পার্টনার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন l

দুজনে দুজনের দিকে অপলক নয়নে তাকাল l তবে কি শুভ দৃষ্টি হয়ে গেলো স্বয়ংসিদ্ধার রূপমের সঙ্গে l আপনারা কি ভাবছেন....?

চিত্র ঋণ ঃ- গুগুল

 

ঝড় লেখিকা বনশ্রী মিত্র


 

ঝড়

facebook sharing button
twitter sharing button
বনশ্রী মিত্র

ঝড় আসছে, সামান তুলে নে রে পাতুয়া! আজ আর মেলা হবে না। ফলের টুকরি গোছাতে-গোছাতে আকবর আলি পাতুয়াকে তাড়া লাগান। কিন্তু আজ তো যাত্রা পালা আছে চাচা, মহুয়ার নাচ আছে। অনেক লোক হবে। তুমি দেখবে না?

আরে ওসব আজ আর হবে না রে পাতুয়া—খবরে বলেছে, জোর বারিশ আসছে, ঝড় বইবে ইদিকে, সাইক্লোন। তুই জলদি সামান তুলে বাড়ি যা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। দোকানিরা মেলায় সবে দোকান সাজাতে শুরু করেছে। রহিম মোল্লার ঘাগরার দোকান। লাল মসলিনের ওপর নীল-হলুদ সুতোয় ফুল, প্রজাপতি। কমলার ওপর সবুজ-হলুদের পাখি আরও নানা রঙের ছোট মেয়েদের ঘাগরা। পুঁতির মালা, কানের দুল সাজাচ্ছে মানিক তার দোকানে। টিয়া পাখির খাঁচায় ছোলা দিচ্ছে সোনাই। মেলা শুরু হলেই লোক জড়ো হবে। তখন সোনাইয়ের টিয়া কার্ড তুলে-তুলে ভাগ্য বাতলে দেবে সবার। বাঁশিওয়ালা ফুঁ দিচ্ছে তার বাঁশিতে। গোলাপি, সাদা বেলুন নিয়ে হাজির বেলুনওয়ালা। করিমের দোকানে লোহার কড়াইতে জিলিপি ভাজার তেল গরম হচ্ছে। এমন সময় আকবর আলির কথায় সব যেন থমকে যায়— তবে আজ আর বিক্রি-বাটা হবে না! মেলার এই কটা দিনই তো একটু বেশি রোজগার হয় ওদের। সংসারে দুটো পয়সা বেশি আসে। ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করে। বছরের বাকি দিনগুলো তো সেই আবার দিন আনা, দিন খাওয়া। কেউ ধান জমিতে লাঙল দেয়, কেউ বা মিস্তিরির কাজ করে।

মাইকে ঘোষণা হল— সাইক্লোন আসছে। দোকান তুলে নাও।

তাঁবুর বাইরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে মহুয়া কাঁদছে। তার পরনে নীল চোলি আর ঘাগরা মুখে চড়া রঙ মহুয়ার বুড়ো বাপ তখন যাত্রার ম্যানেজারের কাছে হাতজোড় করে পয়সা ভিক্ষা চাইছে—“এত দূর থেকে এলাম বাবু, কয়েকটা টাকা দেন, বাড়িতে বড় অভাব।”

ম্যানেজার খেঁকিয়ে ওঠে— “পয়সা কিসের? একটাও টিকিট বেচতে পারলাম না আর উনি পয়সার স্বপ্ন দেখছেন! যদি আবার মেলা বসে, মেয়েকে নিয়ে এসো, যাত্রায় নাচবে, পয়সাও পাবে।”

মহুয়ার কানে তার বাবা আর ম্যানেজারের কথা ভেসে আসে। এক সপ্তাহ ধরে মায়ের জ্বর ডাক্তারবাবু শহরে নিয়ে যেতে বলেছে। ছোট বোন টিয়াকে মায়ের কাছে রেখে সে আর তার বাবা পাশের গ্রাম থেকে অনেক পথ হেঁটে এসেছে। সারাদিন কিছু পেটে পড়েনি তার। খিদেয় পেট ব্যথা করছে।

পাতুয়া মাটির পুতুলগুলো টুকরিতে গুছিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়। আকাশ কালো করে আছে। হাওয়া বইছে।

— “আমার খুব খিদে পেয়েছে বাবা।”

মহুয়ার কথায় বুড়ো কানু হালদার ফুঁসে ওঠে— “হারামজাদি! এক পয়সা রোজগার হল না! তোর খিদে পেয়েছে? এমন ভাঙা কপাল নিয়ে জন্মেছিস যে, রোজগারের দিনেই ঝড় নিয়ে এলি! চুপ করে এইখানে বসে থাক, আমি আর-একবার ম্যানেজার বাবুর সাথে কথা বলে আসি।”

পাশ দিয়ে যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ায় পাতুয়া— “আমার কাছে বাতাসা আছে। খাবে?”

কোনও জবাব না দিয়ে পাতুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মহুয়া।

“তুমি বুঝি ওই যাত্রাদলের?”

“হ্যাঁ, নাচ করতে এসেছিলাম দলে।” বাতাসায় কামড় দিয়ে মহুয়ার মুখ জুড়িয়ে যায়।

“তুমিই মহুয়া?”ছিপছিপে চেহারার সদ্য-কিশোরী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে শরীরে রক্তস্রোত বয়ে যায় পাতুয়ার।

“হ্যাঁ, আমিই পোস্টারে নাম দেখেছ বুঝি!” ফিক করে হেসে ওঠে মহুয়া।

“কিন্তু ঝড়ের জন্য তো আজ আর হবে না কিছু। তা তোমার টুকরিতে কী আছে গো?”

“রাম, সীতা, হনুমান! তোমার চাই?”

“পাখি আছে, পাখি?” বড় বড় চোখ করে তাকায় মহুয়া

—“আজ তুই এখানেই থাকবি। আমি আবার কাল আসব। ম্যানেজারবাবু আছেন।” কানু হালদার পকেটে একশো টাকার নোটে হাত বোলায়।

মহুয়া চিৎকার করে ওঠে— “না! না! আমায় এখানে রেখে যেও না নিয়ে চলো, তোমার পায়ে পড়ি বাবা

ম্যানেজারের মুখে তখন লোলুপ হাসি

আশ্রয়ের খোঁজে সবাই এদিক-ওদিক দৌড়চ্ছে। পাতুয়ার শরীর কাঁপতে থাকে কিশোরী মহুয়া তাকিয়ে থাকে পাতুয়ার দিকে। গ্রামের ওপর তখন তীব্র গতিতে ঝড় আছড়ে পড়ছে।

 


    Monday, August 17, 2020

    এঞ্জেল ১৭ তম পর্ব লেখক ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী



                           এঞ্জেল

                       ###১৭ম পর্ব###   

     এয়ারপোর্ট থেকে ওনারা সকলে মনিকাদের বাড়িতে ওঠেন l মনিকার মায়ের অতিথিদের প্রতি আদর যত্নর শেষ নেই l সব রান্না নিজে হাতে করে রেখেছেন কুটুম বাড়ি বলে কথা l ওনার আজ অনেকদিন পর মুখে হাঁসি দেখে মনিকাও খুব খুশি l ওর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল ওর মা বুঝেছেন l তাই বোধহয় এতো আয়োজন করেছেন আত্মীয়দের জন্য l মায়ের পক্ষে ধ্রুবর মতন বাঙালি পাত্র জোগাড় করা অসম্ভব ছিল l এ যেন মেঘ না চাইতেই জল l

    জগদীশ বাবু কিন্তু কিন্তু করে প্রথমে চা জলখাবার খেলেন l মনটা সায় দিচ্ছিল না ওনার l ছেলের   জন্য জাত ধর্ম সব গেলো l এখান থেকে গিয়ে পৈতে পাল্টাতে হবে । এখানে কি পৈতে পাওয়া যাবে? জিজ্ঞাসা করলেন জগদীশ বাবু মনিকার মাকে l

    - কেন বলুন তো?

    - অনেকদিন পৈতে বদলানো হয়নি তাই বলছিলাম l

    - খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে হয়তো l

      কেন কি খুব দরকার l

    - হ্যাঁ ধ্রুবর বিয়ের আগে নাহ্নিমুখ শ্রাদ্ধ করতে হবে পূর্ব পুরুষদের জন্য তাই পৈতের প্রয়োজন l

    - ও হ্যাঁ তা তো বটেই ! ভুলে গিয়েছিলাম l আসলে আমিও তো চক্রবর্তী বাড়ির মেয়ে নেহাত দারিদ্রের কষা ঘাতে এই বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম l একরকম পেটের দায়ে বলতে পারেন l কাকা কাকিমা না থাকলে আমার কি হোতো বলা মুস্কিল l আমার কথা থাক, আপনাদের জন্য দুপুরে রুই মাছের ঝোল , ফ্রায়েড রাইস , খাসির কসা  মাংস , চিংড়ীর মালাইকারী , আলু পটলের দোর্মা , আমের চাটনি আর শুক্ত বানিয়েছি l ধ্রুবর জন্য আলু পোস্ত বিউলির ডাল l ও ওটাই এখানে খেতে পছন্দ করে l মাছতো খেতেই চায়না l 

    - না মা, বাড়িতে ওর মা কাঁটা বেছেদিলে মাছ খায় l মায়ের নন্দ দুলাল তো তাই l তাও মা খাইয়ে দিলে খায় বলে মুখ টিপে হাঁসে l

    - এটা কিন্তু খুব বাড়া বাড়ি হয়ে যাচ্ছে l আমার মা কে আমি দু বছর পর পেয়েছি l মা তাই নিজেই খাইয়ে দিলেন l এতে নন্দ দুলালের কি আছে?

    - ও বাবা এত কে খাবে ? এতো এলাহি কাণ্ড । না মা আমার ছেলে এমনিতেই আমার হাতে খেতে ভালোবাসে.. সুনীতি দেবী বলেন l

    - যা সব রান্না হয়েছে সব ই ধ্রুবর বাবার প্রিয় মনে মনে ভাবেন । ঐ পৈতে টা আজ পাবো ত ! ওটার বিশেষ প্রয়োজন কিন্তু । 

    - হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই l আমি দেখি আমার মালীকে বলে l ঐ সব খবর রাখে l ও তো  আমাদের ই ওদিক কার লোক l আমার অনেক বিশ্বাসী l ও নিশ্চয়ই খুঁজে আনতে পারবে l

    - এক ডজন পৈতে লাগবে l

    - ঠিক আছে l মনিকার মা বলেন l

    দুপুরের খাওয়া ভালোই হোল সকলের l এবার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন l সবাই সোফায় গিয়ে বসে

    ধ্রুবর ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে l ও তাই চলে যায় l মনিকা হসপিটালে চলে যায় l ধ্রুবর বাবা সোফাতেই ঢুলিয়ে পড়েন l একটু পরেই নাসিকা গর্জন ।

    -আশ্চর্য লোক বাপু ! খেল ত ওমনি নাক ডাকা সুরু হল  । স্থান কাল পাত্র কিছুই বোঝে না … সুনীতি দেবী বলে ওঠেন ।

    -আসলে অনেকটা পথ এসেছেন ত তাই শরীরের ধকল গিয়েছে …

    - না না উনি খেয়েই ঘুমান আর পড়লেই নাক ডাকেন ।

    -ওটা এই বয়েসে হয় । ওনারও হত । উনিত অসময়ে চলে গেলেন আজ থাকলে খুব খুশি হতেন। বলে একটু উদাস হয়ে পড়েন ।

    - হার্টের অসুখ ছিল । দ্বিতীয় স্ট্রোকেই মারা জান ।

    - ও ! তখন মনিকা কত বড় ?

    -ও তখন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সাইন্স পড়ছিল । পড়াশুনোয় ভালোই ছিল । ওনার ইচ্ছে ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে বলে ।  কিন্তু কি যে হল ! মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে নার্সিং স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়। ও বাপের ধারা পেয়েছিলো । যা মনে ভাববে তাই করবে । আমার কথা শুনলো না । সেই নার্সিং পড়ে হাঁসপাতালের চাকরি করল । ধ্রুবর ই ফ্যাক্টরির হাঁসপাতাল । ওখানেই ওদের আলাপ পরিচয় ।

    মনিকার মা আজও ছুটি নিয়েছেন তাই বেয়ানের সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত l দুই বেয়ান মনের কথা বলে নান গল্পে মত্ত । যেন অনেক দিন পরে দুই বোনের দেখা ।

    বিয়ের জোগাড় প্যান্ডেল সাজানো, পুরোহিত ঠিক করা, বন্ধু বান্ধবদের বলা অনেক কাজ l উনি বলেন এই জ্যৈষ্ঠ মাসেই বিয়ে দেব l বিয়ের দিন ঠিক করতে হবে পাঁজি দেখে ।

    - হ্যাঁ তাই ভালো l দেরি করে লাভ নেই l

    বিপাশার বৌ ভাত

    ওদিকে বিপাশার বৌভাত এর জন্য সেরকম কোন প্রস্তুতি দেখলেন না কোনের বাড়ির কেউ l কমলেশ বাবু মৃণালিনী দেবী গিয়েছিলেন সঙ্গে বম্বের কাকা কাকিমা , বেনারসের কাকা কাকিমা l বিপাশার সঙ্গে বম্বে থেকে আসা ওর খুড়তুতো বোন বান্টি ছিল সঙ্গে । কোন সাজ শয্যা নেই । সাধারণ ভাবে সাজানো ফুল দিয়ে । লোক জন নিমন্ত্রিত কেউ সেরকম নেই বললেই হয় । জনা ৫০ লোক । পাড়ার কেউ আসেনি কিম্বা এনারা ডাকেন নি । ডঃ অভিজিৎ ব্যানার্জীর ঠাকুমা নাতবৌকে পেয়ে খুব খুশি । তিনি বিপাশার গলায় একটা গিনির মালা পরিয়ে দিলেন তাতে ২৫ টা গিনি সোনা ছিল । বিপাশা , ঠাকুমা কে প্রণাম সেরে বলে ওই হার তাঁর কাছে রেখে দিতে কারন এতো দামি হার সে কোথায় রাখবে? ঠাকুমা আরও একটা বাক্স এনে তার হাতে দেন বলেন বাপের বাড়ি থেকে যে আলমারি টা দিয়েছেন তাতেই সব গুছিয়ে রেখে দেবে । চল আমি  সব গুছিয়ে দেব ।

    ডঃ অভিজিৎ ব্যানার্জী সেজে গুজে এলেন । সঙ্গে এক মহিলা । অভিজিৎ কে ওনার  ঠাকুমা  কনের পাসে বসতে বলেন । ফটোগ্রাফার , ঠাকুমা , অভিজিৎ এবং বিপাশার ফটো  তোলে । পরে অভিজিৎ এর বাবা , মা এবং বিপাশার বাবা মা র সঙ্গে আবার একটা ফটো ঠাকুমা তোলেন। বিপাশা কে খুব ই বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল । বান্টি ব্যাপার দেখে আশ্চর্য হচ্ছিল । ওদের ওখানে বিয়েতে হই হুল্লোড় গান বাজনা কতো কি হয় । এই নিস্তব্ধ বিবাহ বাসরে ও হাঁপিয়ে উঠছিল । যেন নিষ্প্রাণ এক বিবাহ বাসর ! 

    সবাই চলে যাওয়ার পর অভিজিৎ এর সঙ্গে যে মহিলা এসেছিলেন উনি চুপি চুপি কি সব কথা বলছিলেন । একটা কথাই বিপাশার কানে আসে … অভি এই গাঁইয়া মেয়েটাকে তুমি কি দেখে বিয়ে করলে ?  

    -কি করবো ! আমার ঠাকুমা নাছোড়বান্দা বিয়ে করতেই হবে তাও পালটা ঘরে । আমাদের কলেজের মেডিসিন বিভাগের ডঃ কমলেশ চক্রবর্তীর মেয়ে বিপাশা র সঙ্গে সম্বন্ধ এলো । বাবা রাজি হয়ে গেলেন … ডঃ অভিজিৎ ব্যানার্জী বলেন।

    -উনি বললেন ওমনি তুমি রাজি হয়ে গেলে । এখন আমার কি হবে ?

    -কেন যেমন ছিল সেইরকম ই থাকবে । আমার অন্য কিছু করার উপায় ছিলোনা । ঠাকুমার হাতে সমস্ত ঘর বাড়ি বিষয় সম্পত্তি । বাবা বলেন ওনার কথা না শুনলে বিষয় সম্পত্তি সব হাত ছাড়া হয়ে যাবে । আর তোমার কথা যে না বলেছি তা নয় । বলেন বদ্দি বাড়ির মেয়ে এই ঘরে ঢুকতে পারবেনা । স যেই হোকনা কেন ।

    বিপাশা সবই বুঝতে পারলো । মুখে কিছু বললোনা । ঠাকুমা তাহলে এই বাড়ির সর্বে সর্বা । আচ্ছা কথাটা জানা রইলো । সে ও কিছুটা আন্দাজ করছিলো । কারন ঠাকুমা ওনার সব গহনা আমাকে দিতে চান কিন্তু আভির মা মানে তার শাশুড়ি ওটা দেখে খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন । বাকি ওই মহিলা কে সেটা জানার প্রয়োজন ………

    ©ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

     

                   ###১৮ তম পর্ব###   

     

    দিনের বেলার হেভি লাঞ্চ খেয়ে জগদীশ বাবুর আর রাতে খেতে ইচ্ছে হলনা । একে বিদেশ ভুঁই তায় স্লাটার হাউসের পাশদিয়ে গেলে গরু কেটে টাঙ্গানো আছে দেখে ওনার গা বমি বমি করে । মনে মনে ভাবেন যবন দের দেশ এখানে বেশি বাইরে না বেরুনোই শ্রেয় । ছেলের জন্য এই দৃশ্য দেখতে হল । এরা গরু শুয়োর সব খায় । এখানে ব্রাহ্মণ এলে তার পইতে দিনে চোদ্দ বার পালটাতে হবে । কথাটা মনেই থাক ধ্রুবর মাকেও বলবেন না । তাহলে কুরুক্ষেত্র হবে । মনিকার মা মালীকে দিয়ে কথা মতন ১২ টা পৈতে আনিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন । মালীর হাতে ৫  টাকা দিয়ে বলেন পৈতে বিনা পয়সায় ধারণ করতে নেই । কোন ফল হয়না তাতে ।  

    মালী মনিকার মায়ের দিকে তাকাল । উনি সম্মতি দিলেন টাকাটা নেওয়ার জন্য ।

    ধ্রুব ফ্যাক্টরি থেকে সেই সন্ধ্যের পর ফিরল । তখন ৭ টা বাজে । মনিকা ওই প্রায় একই সময় ফিরল ।

    ওরা আসার পর বিকেলের চা খেয়ে ধ্রুবর কোয়ার্টারে রওনা দিলেন সকলে । মনিকা সঙ্গে গেল  কারন আসবাব পত্র সব  ঠিক আছে কিনা দেখতে । তা ছাড়া ঘরটা আরেকবার গুছিয়ে দিয়ে আসবে । রাস্তায় কিছু ফুল কিনে নিয়ে গেল ফ্লাওয়ার ভেশ এ রাখার জন্য । মনিকা ফুলের খুব ভক্ত । রজনীগন্ধা , গোলাপ , আর কিছু অরকিডস । রুম ফ্রেশনার বাড়িতেই আছে ।

     

    বাড়ি পৌঁছেই সমস্ত কাজ নিজে হাতে সুরু করলো ।পুরো ঘর ঝাঁট দেওয়া , ঘর পোঁছা , সমস্ত ঘর গুছন , বিছানা পরিপাটি করে রাখা , ফ্লাওয়ার ভেসে ফুল রাখা । ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে রাখা , ফুলদানিতে ফুল রাখা , রান্না ঘরের বাসুন পত্র মেজে রাখা । তবে রান্না ঘরে এসে দেখল  একটা বিরাট ভুল হয়ে গিয়েছে , ধ্রুব রান্নার জন্য কোন বাসুন পত্র কেনেনি । ওটা মনিকা ভুলে গিয়েছিল । প্রায় দৌড়ে যায় কাছের মার্কেট থেকে কিছু আজকের মতন বাসুন পত্র  কিনে আনে । ধ্রুবর মা মনিকাকে লক্ষ করছিলেন মেয়েটা সুধু দেখতে সুন্দর , চাকরি করা মেয়ে নয় সে দুর্দান্ত গৃহিণী হবে । প্রত্যেকটা কাজ নিখুঁত ভাবে খুব কম সময়ের মধ্যে করে দেখাল তাও হাঁসপাতাল ফিরে বাড়িতে স্নান সেরে । এটা কম পাওয়া নয় । তিনি ও ফেরা মাত্র ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন মা তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী মা আমার । আমি তোমাকে আর তোমার কাজের ধরন দেখছিলাম । সত্যি  আমার ছেলে ঠিক মেয়েকেই বেছে ছে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে । আমি অত্যন্ত খুশি মা । তুমি এবার রেস্ট নাও ।

    -  না মা এখানে আপনারা নতুন তা ছাড়া বাবা রাতে কি খাবেন আমায় বলুন সেই অনুযায়ী আমি রান্না করে বাড়ি যাবো ।

    -  তোমাকে আর কিছু করতে হবে না । এবারে আমি সব করে নেব । তোমায় কিচ্ছুটি চিন্তা করতে হবে না মা । তুমি এইবার বাড়ি যাও । কাল তোমার মাকে পাঠিও ওনার সঙ্গে কিছু কথা আছে ।

    -  আচ্ছা । এই বলে মনিকা ধ্রুবর সঙ্গে কিছু কথা বলে নিজের বাড়ি চলে যায় ।

     

    ওকে কি করে বোঝাই যে ধ্রুবর বাবা , বারে বারে পৈতে বদলাচ্ছেন । এই প্রথম কলকাতার  বাইরে এলেন তাও গোয়া । এখানে খৃষ্টানদের বাড়িতে খেতে হল । তাই এসেই পৈতে বদলালেন  । সন্ধ্যাহ্নিক করলেন । মাথায় গঙ্গা জল ছিটিয়ে বলেন ঠাকুর এ কি বিপদে আমায় ফেললে ? আমার জাত ধর্ম সব গেল এখানে ।

    -ধ্রুবর মা স্বামীকে বোঝান দেখো আমি ও ঠাকুর পুজো করি । কিন্তু ঠাকুর স্বয়ং যখন আমাদের পরীক্ষা করছেন ছেলের বৌ কে দিয়ে তখন ব্যাপারটা আমাদের মেনে নিতেই হবে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তার সুখের জন্য । মনিকা  হয়তো জন্ম সূত্রে খৃষ্টান কিন্তু ওর মাত বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ কন্যা । শুনলে ভদ্র মহিলার সব কথা । তিনি এখন ও ঘরে ভবতারিণীর ফটো রেখে দীপ জ্বালান কিন্তু কি করবেন পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করেছিল তাই তিনি খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সংসার করেন কিন্তু মনে প্রাণে তিনি এখন ও বাঙ্গালি এটা ত অস্বীকার করা যায়না ।

    -তোমার যুক্তি তোমার কাছে । আমাকে আমার মতন থাকতে দাও । আমি তোমার হাতের রান্না  ছাড়া কোনদিন কোথায় কিছু খাইনি নি কি খাবোনা । আমায় বাধ্য করনা ।

    -ঠিক আছে তাই হবে । কাল মনিকার মাকে আসতে বলেছি আমাদের বাড়িতে । ওনার সামনে আবার কিছু বে ফাঁস কথা বলে বসনা যেন । কাল ধ্রুবর বিয়ের দিন স্থির করব । সঙ্গে পুরোহিত  আনতে বলেছি । এখানে বাঙ্গালি পুরোহিত পাওয়া যায় । তাই উনি পুরোহিত  নিয়েই আসবেন আমাদের সঙ্গে শুভ বিবাহর  দিন ঠিক করতে ।

    -তোমরা যা বলার বল আমাকে টেনো না  এর মধ্যে । আমি আমার যা করনিয় করবো ।


    ধ্রুব মনিকার শুভ বিবাহর দিন স্থির 

     

     ধ্রুব , মনিকা কাজে চলে যাওয়ার পর মনিকার মা সকাল সকাল চলে আসেন ধ্রুবর কোয়ার্টারে  । সঙ্গে পুরোহিত  আর পঞ্জিকা ।পঞ্জিকা দেখে পুরোহিত মশাই বলেন আগামী সামনের ২৮ শে মে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৪ তারিখে শুভ বিবাহ লগ্ন সন্ধ্যা ০৬.১৩ গতে রাত ০২.১৫ মধ্যে বৃশ্চিক ধনু লগ্নে। বিবাহ স্থান শান্তা দুর্গা মন্দির উত্তর গোয়া তে অনুষ্ঠিত হইবে । তদনুসারে প্রস্তুতি পর্ব লইতে হইবে । বিবাহ অনুষ্ঠানের সমস্ত দায়িত্ব তাঁর ।

     বৈদিক মতে আচার গুলির মধ্যে অবশ্য পালনীয় প্রথাগুলি হল কুশণ্ডিকা , লাজ হোম (লাজ বা খৈ দিয়ে যজ্ঞানুষ্ঠান ) , সপ্তপদী গমন , পাণিগ্রহণ (কন্যার পাণি অর্থাৎ হস্ত গ্রহণ)  , ধৃতি-হোম ( ধারণ করা অর্থাৎ কন্যাকে ধরে রাখার যজ্ঞ )  ও চতুর্থী হোম । এ ছাড়া পালিত হয় অরুন্ধতী নক্ষত্র এবং ধ্রুব নক্ষত্র দর্শন । এই প্রথাগুলি বিধিবদ্ধ এবং শাস্ত্রীয় প্রথা ও বিবাহের মূল অঙ্গ ।  বেদি , মণ্ডপ , কুশণ্ডিকা , হোম ইত্যাদির জন্য তিনি অর্থাৎ পুরোহিত মহাশয় দায়িত্ব নিচ্ছেন । এই সব মনিকার মা সুন্দর ভাবে গুছিয়ে স্থির করেছেন । নিজের বিবাহ অনুষ্ঠান হয়নি সেই সাধ নিজের মেয়ের বেলায় পূর্ণ করতে চান । তাই কোন খুঁত রাখতে চান না বিবাহ অনুষ্ঠানে ।  

    দিন স্থিরের জন্য সম্মতি নিতে এসেছেন ধ্রুবর বাবা এবং মায়ের কাছ থেকে ।

    ধ্রুবর বাবা পুরোহিত মহাশয়ের কথা শুনে ভাবলেন এই যবনের দেশে এইসব পালন হয় । তিনি আশ্চর্য হলেন এবং পূর্ণ সমর্থন দিলেন । প্রথা এবং রীতি নিতি শুনে খুব ভালো বললেন তাঁর ।  

    শান্তা দুর্গা মন্দির পাঞ্জিম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে উত্তর গোয়ার কাভালাম গ্রামের এক পর্বত পাদ দেশে অবস্থিত । এই মন্দির প্রায় ৪০০ বছরের পূরণ । শান্তা দেবী এখানকার গৌড় সরস্বতী ব্রাহ্মণ দের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । প্রায় বিবাহ কার্য এই মন্দিরে সম্পূর্ণ হয় । 

     

    তাহলে আমি কার্ড ছাপাতে দিয়ে দি ..মনিকার মা জিজ্ঞাসা করেন ।

    -  হ্যাঁ নিশ্চই । বলেন ত পাটিপত্র তে সই করে দেব .. ধ্রুবর বাবা বলেন । খুব ভাল এখানকার পুরোহিত ।

    -  হ্যাঁ উনি এখানে অনেক বছর আছেন । হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানে ওনাকেই ডাকে সবাই । আমিও ওনাকে ডেকে পাঠালাম । আমার এবং আপনাদের এই একটাই কাজ ছেলে মেয়ে কে তাদের পছন্দর পার্টনারের সঙ্গে হৃদয়ের মিল করিয়ে দেওয়া এই বিবাহ পদ্ধতি অনুসরণ করে  ।

    -  আজ আসি । সেকি কিছু মুখে না দিয়েই যাবেন ?

    -  না দিদি আরেকদিন হবে এখন । এখন ত যাওয়া আসা থাকবেই । আপনারা বিশ্রাম নিন । আমি আসি তাহলে …….

     

                             xxxxxxxxxxxxxx

     

    ওদিকে বিপাশার বৌভাতের এইরকম করুণ অবস্থা দেখে মৃণালিনী দেবী স্বামীর ওপর খাপ্পা । এতো ছোট লোকের বাড়ি তুমি আমার মেয়েটার হাত পা বেঁধে ছুঁড়ে দিলে । আমার মেয়ের কিছু হলে আমি আত্মহত্যা করব বলে রাখলাম আর সুইসাইড নোটে তুমি এই মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে লিখে দিয়ে যাবো । অনেক সহ্য করেছি । তোমার অর্থ লোভ আর মানুষকে হেও চোখে দেখা এইবার ঘুঁচবে । এতোদিন পতি পরম গুরু ভেবে কিছু বলিনি । এবারে আর না । মা দুর্গা তাঁর সন্তানকে বাঁচাতে মা কালির রূপ ধারণ করেছিলেন । আম সেই রূপ ধারণ করে তোমার মুখোশ খুলে দেব । সব থানাতে জানাবো । তোমার জন্য আমার মেয়েটার জীবন ছার খার হয়ে গেল । আমি বুঝতে পারছি সে কি জ্বালায় জ্বলবে । আমরা এতো দিন মা মেয়ে তোমার সমস্ত অত্যাচার সহ্য করেছি এবার আর না। তুমি তোমার সমস্ত অধিকার ইচ্ছা আমাদের মা মেয়ের ওপর চাপিয়ে এখন আমার মেয়েটার জীবন শেষ করতে বসেছ । কি খারাপ ছিল ধ্রুব । সে গরিব সেটাই তার অপরাধ ! মেয়েটাকে এম.এ. পড়তে দিলে না । তাকে মূর্খ গেঁয়ো বলে বৌ ভাতের দিন শুনতে হচ্ছে । কেন ? কেন ? হে ভগবান এ কি পাপের ফল আমায় দিলে ।

    -শান্ত হও বিপাশার মা ।শান্ত হও । ওরকম কিচ্ছু হবেনা । ও আমার ছাত্র ।

    - কিসের ছাত্র ? লম্পট চরিত্র হীন ছেলে । সঙ্গে একটা মহিলা এনেছে । ও ডাক্তার ? আমি বুঝিনা ।  ওই মহিলাটির সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক  শুনি ? আমাকে বোঝাতে এসো না । আমি তোমাদের সবকটাকে জেলের ঘানি টানবো । আমার মেয়ের কিছু হলে বাপ , জামাই কাউকে ছাড়বনা । দেশে আইন কানুন নেই ভেবেছ ।

    -শান্ত হও ।

    -খবরদার আমাকে আর আটকে রাখতে পারবে না । এইবার আমার স্বরূপ দেখবে । ভালোয় ভালোয় আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনো । তা নাহলে তাণ্ডব নৃত্য দেখবে । মহাদেব নয় আমি কালীর রূপ ধরে শেষ করেদেব তোমাদের সব কটা শয়তান কে । সাবধান ……… 

     

    ©ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী 

     


    Tuesday, August 11, 2020

    ভুতের সাথে কিছুক্ষণ লেখক ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী.



    ভুতের সাথে কিছুক্ষণ

    ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী.


    আরে চ্যাটার্জী বাবু কোথায় যাচ্ছেন সন্ধ্যে বেলায়? আপনি জানেন না বোধ হয় আজ ভূত চতুর্দশী l আজকে ভূতদের স্পেশাল দিন l. আজ ওরা স্বেচ্ছায় যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে l যা খুশি তাই করতে পারে l কেউ বাধা দেওয়ার নেই l তা আপনি কি ভূতের নৃত্য দেখতে চান?  
    -আপনি কে মশাই?  এত সব প্রশ্ন করার?  
    -এই দ্যাখো চটছেন কেন? 
    - একটু রসিকতা করলাম l মনে কিছু করবেন না l তা চলুন না একটু পুকুর পাড়ে নিরিবিলি যায়গায় যাই l বুঝতেই ত পারছেন. একা একা এখানে একটু বসে ছিলাম l আপনাকে দেখে একটু খেজুরে পিরিত করতে ইচ্ছে হল ! 
    - সেটা আবার কি?  
    - বলছি বলছি আগে চলুন ত আয়েশ করে একটু পুকুর পাড়ে বসা যাগ l ওদিকটায় যাবেন না l ওই পোড় বাড়িটার সামনে একটা বেল গাছে ব্রহ্ম দৈত্য আছে l 
    -কে কে আপনি?  আপনাকে ত দেখিনি এদিকে ! 
    -দেখবেন কি করে আমি ত এখানে বেশি দিন থাকি না.মাঝে মাঝে আসি আবার চলে যাই l 
    -আপনি কি করে জানলেন ব্রহ্ম দৈত্য আছে বলে?  আর ব্রহ্ম দৈত্য কি কেউ কোন দিন দেখেছেন?  না শুনেছেন?  
    -জানি জানি আমার কথা শুনলে আপনিও বিশ্বাস করবেন মশাই , চলুন ওই পুকুর পাড়টায় বসি.আপনাকে পুরো কাহিনী টা শোনাবো l 
    -আপনাকে চিনি না জানিনা কখন দেখিনি  আমাকে কেন ডাকছেন কাহিনী শোনানোর জন্য?  আমি ই বা যাব কেন?  বলুন ত?  
    -আসবেন আসবেন আস্তেই হবে.ওই কাহিনীর টান এমন,  কেউ না এসে পারে না ! 
    -আপনি আমার নাম জানলেন কি করে বলুন ত?  
    -জানতে হয় l ওটাই আমাদের নিয়ম ! 
    -তাই বুঝি? 
     -হ্যাঁ তাই l 
    -ভদ্রলোক একটু বেশি কথা বলছেন না ! মনে মনে ভাবি l 
    -ও আপনি ভাবছেন আপনাকে কেন ডাকছি?  চিন্তা করবেন না. আমি চোর ডাকাত নই l আপনার মতন এক সাধারণ মানুষ l আমার ও স্ত্রী পুত্র পরিবার ছিল l এখন অবশ্য আমি একা. তাই লোক দেখলেই তাকে আপন করার সূত্র খুঁজি l 
    -সূত্র খোঁজেন মানে ! 
    -এই দেখ সব কথা ওরকম টেড়া বেঁকা করে দেখলে চলে.মানুষকে বিশ্বাস করতে হয় l 
    -আমার সংসারে আমি আর আমার স্ত্রী l আমাদের এক পুত্র সন্তান l সে ত থাকে সুদূর আমেরিকায় তাই আমি আর আমার বেটার হাফ থাকি l  দিনের মধ্যে দু একটা কথা ছাড়া কথা বলার লোকের অভাব l ওই খেতে দেওয়ার সময় আর ওষুধ খাওয়ানোর সময় ছাড়া আমাদের মধ্যে  বড় একটা কথা বার্তা হয়না l এর মধ্যে আমার একটা স্ট্রোক হয়ে গেল. মরে যেতাম তবে বেঁচে গেলাম l   ডাক্তার বাবু এঞ্জিওগ্রাফি করে বাঁচালেন l এ যাত্রায় যোম নিতে পারলোনা. তবে চিত্রগুপ্তর খাতা দেখে জম বলেন তোর মৃত্যু অনিবার্য l 
    ঠিক তাই হল l পরের স্ট্রোকে খতম l এখন দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছি l লোকের সংগে কথা বলছি l ও চ্যাটার্জী বাবু আপনার কি হল?  
    আর চ্যটার্জি বাবু !!!!  ভূত  ভূত বলে ওইখানেই জ্ঞান হারালেন l 
    কি মুস্কিল ! আমি কি ভূত নাকি?