Saturday, June 10, 2017

অন্তিম ধৃতিমান গঙ্গোপাধ্যায়


Image may contain: one or more people


অন্তিম
ধৃতিমান গঙ্গোপাধ্যায়
And all night long we have not stirred
And yet God has not said a word!
লাইনদুটো দেখেই খুব চেনা মনে হয়েছিল স্মিতার...
সন্ধে থেকে প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টি, চারদিক ভেসে যাচ্ছে। লোডশেডিং হতে কতক্ষণ! তাই অন্যদিনের থেকে একটু আগেই দরজা বন্ধ করতে নেমেছিল অমিত। সবে ছিটকিনিতে হাত দিতে যাবে, ওপার থেকে নিঃশ্বাস ফেলার একটা চাপা আওয়াজ পেয়ে থমকে গেল হাত। এই ছন্দ, এ শ্বাস তার চেনা...কিন্তু...
এ কী! কবিতা, তুমি? এমন বৃষ্টিতে?
কোনও কথা না বলে ঢুকে এল কবিতা। তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরল অমিতকে। শরীরটা কাঁপছিল। এই রূপ খুব একটা চেনা নয় অমিতের...
কবিতাকে ভালবেসেছিল অমিত। গ্রীষ্মের দুপুরে ভিক্ষে করে আনা এক কৌটো চালের মতো ভালবেসেছিল। নিঃশ্বাস ছাড়া আর নেওয়ার মাঝের মুহূর্তটুকুর মতো ভালবেসেছিল। টুয়েলভে পড়ার সময়, পরি যবে চলে গেল, তখন থেকেই... কবিতার হাতে হাত দিয়ে ঘোরা, মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েও গঙ্গার তীরে, ময়দানে ওকে নিয়ে বসে থাকা... কী না করেছে অমিত। কবিতার চাহিদাও ছিল প্রচুর। যেমন খেয়াল হবে, ঠিক তেমনটি। খেয়াল হল, চুমুতে ভরিয়ে দিল অমিতকে... কখনও সপ্তাহের পর সপ্তাহ কথাই বলল না মোটে। রাতভর জেগে সাধ্যসাধনা করতে হত অমিতকে, মান ভাঙাতে হত। সবসময় যে তাতে কাজ হত, তা-ও না। রাগ হত, খুব। দোলাচলে ঝুলতে-ঝুলতে বিরক্তি আসত। মায়ের কথায় একবার ঠিকই করে ফেলেছিল বিয়ে করে নেবে। কবিতা রাজি নয় তো আর কেউই সই। সেকথা কবিতাকে বলতেই এমন চোখ লাল করে তাকাল...
বরং মাকেই ছেড়ে আসতে হয়েছিল। নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে একা থাকার সেই শুরু। কী করবে? কবিতা চোখে আকুতি এনে বলেছিল, “যদি কখনও রাতবিরেতে তোমার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে, অমিত? যদি আদর করতে ইচ্ছে করে? তোমার মা থাকলে...”
এতদিনে সময় হল কবিতা?
ততক্ষণে ওর বিছানায় বসেছে কবিতা। আলো নেভানোর আদেশ দিয়েছে। একা ঘরের কোনা থেকে ঠান্ডাটা বেরিয়ে দিয়েছে ছুট। আলো নিভিয়ে বিছানার কাছে এল অমিত।
“কবি...”
অমিতের ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করিয়ে দিয়েছিল কবিতা। শরীর থেকে একের পর এক অন্ধকার সরিয়ে মোলায়েম চাঁদের মতো উন্মুক্ত হয়ে বুকে আঁকড়ে ধরেছিল অমিতকে। দাঁতে, নখে ফালাফালা করে, উন্মত্ত আদরে ডুবিয়ে দিচ্ছিল... শ্বাস নেওয়ার সুযোগও পাচ্ছিল না অমিত। ওর মধ্যেই কোনওরকমে বলেছিল, “এই প্রথমবার কবিতা...”
“আমি আর আসব না অমিত। এই শেষ। আমায় এই শেষবারের মতো নাও। তোমার সব নিয়ে যাব আমি...”
কবিতার ভিতরেই থমকে গিয়েছিল অমিত। ঠান্ডা একটা অসহায় রাগে গলা টিপে ধরেছিল কবিতার। তারপর... তারপর... বিছানায় পড়ে থাকা প্রিয় পেনটা সোজা ঢুকিয়ে দিয়েছিল ওর গলায়, বুকে... নগ্ন সুন্দর দেহটাকে বিজবিজে করে কেটেছিল। বহুদিনের সঙ্গী কলমটাকেও প্রবল রাগে ভেঙে ফেলে দিয়েছিল। তারপর প্রচণ্ড আদরে আবার আঁকড়ে ধরেছিল কবিতাকে... কী ঠান্ডা শরীরটা! ঠান্ডা লাগছে কবিতা? আলো জ্বেলে দিই?
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল অমিত। কবিতা চোখ খুলল না। নিশ্চিন্ত হয়ে, কবিতার ওড়নাটা গলায় তিনবার পাক দিয়ে ফ্যানে ঝুলে পড়ল অমিত। ওতে তখনও কবিতার লম্বা চুলের দু’-এক কুচি...
কবি অমিত রায় আত্মহত্যা করেছেন। ওই যা হয়... সকালবেলা কাজের মেয়েটি ডেকে সাড়া পায়নি, লোক জড়ো করেছে, তারপর...
জমে যাওয়া ভিড়ের মধ্যেই ছিল স্মিতা। অমিতের পড়শি মেয়েটি, ওর কবিতার ভক্ত ছিল একটা সময়। অমিত রায়ের কবিতায় আর সেই জোর নেই, এই কথা ভেবে দুঃখও পেয়ে থাকে। গোলমালের মধ্যেই, ঘরের ধারের ডাস্টবিনটার দিকে চোখ পড়ে যায় ওর। ছোট্ট একটা ছেঁড়া ডায়েরি, একটা ভাঙা পেন। কী ভেবে, সবার অলক্ষ্যে ডায়েরিটা তুলে নিয়ে ছুটে বাড়ি চলে আসে স্মিতা। পাতার পর পাতা কবিতা, অধিকাংশই খুব খারাপ। সেগুলি পেন দিয়ে যারপরনাই হিংস্রতায় কাটা হয়েছে। ছিঁড়ে গিয়েছে পাতাগুলি। কোনায়-কোনায় লেখা, “আর আসবে না! না! না!”
ডায়েরির শেষ পাতাটুকুই শুধু অক্ষত। তাতেই লেখা, গল্পের শুরুর ওই দুটো লাইন...
লাইনদুটো চিনে ফেলেছে স্মিতা, অনেকক্ষণ। রবার্ট ব্রাউনিং, ‘পরফিরিয়াজ় লভর’...
অঙ্কন: দীপঙ্কর ভৌমিক

No comments:

Post a Comment