Saturday, June 17, 2017

মাসি ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১৫.০৬.২০১৭ / সকাল ৮.৫১


 
   মাসি 
 ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১৫.০৬.২০১৭ / সকাল ৮.৫১ 
শনিবার বিকেলে আমার পরিবারের সঙ্গে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাই । সেই রকম ই এক শনিবারের বিকেলে আমার ছেলের গাড়ীতে বেরুলাম ‘মনি স্কয়ার’ শপিং মল। একটা কথা মাথায় নাড়া দেয় ‘মল’ ! আরে ‘মল’ মানে ত বাংলায় ‘বিষ্ঠা’ ! সোজা বাংলায় “বিষ্ঠার দোকান” !! তবে ওখানে অত যাওয়ার কি প্রয়োজন বল ? আমার কথা কে শোনে ? বুড়ো হলে এই এক সমস্যা। বৌ , ছেলে , বৌমা , নাতনী সব যে যার তালে থাকে । আমার কথা শোনার ওদের সময়ের অভাব। ওরা রকমারি জিনিষ কেনে , আমার কিন্তু ওইসবে মন থাকে না। পার্থিব জগত থেকে একটু সরে মানুষের মনে ঝুঁকতে চেষ্টা করি। রাস্তায় কত গল্পের প্লট পাই । সেরকম ই একটার কথা বলি। 
গাড়িতে যেতে যেতে রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধাকে দেখি কিছু খেলনা নিয়ে বসে আছেন । বিক্রি করতে। আমি ছেলেকে বলি একটু বাঁ দিকে সাইড কর , আমি নামবো । 
ছেলে ঃ সেকি ? বলে আঁতকে ওঠে ! 
 আমি ঃ রাখনা গাড়ীটা সাইড করে ।
বাবা তুমি জানো কোলকাতার রাস্তায় গাড়ী পারকিং এর কত অসুবিধা । এখানে কি করে রাখি বলত ! তোমার মাথায় আবার ...........
রাখ । আমি যা বলছি শোন । আমি নামবো এখানে । 
 সেকি ? কিন্তু এখান থেকে মনি স্কয়ার অনেকটা পথ। কি করে যাবে ? 
সে আমি চলে যাবো । তোকে ভাবতে হবেনা। 
গিন্নী পেছন থেকে বলেন “মাথায় গল্পের পোকা কামড়েছে” । কাউকে দেখেছে এখন তার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। যত সব। আর পারিনা। অবসরের পর মানুষ ঠাকুর দেবতা করে , আশ্রমে যায় । তোর বাবার ও সবের পাট নেই । গল্পের ভূত মাথায় ঢুকেছে । যা পারছে তাই লিখছে। 
শুভ চল ওর কথা শুনিস না । এখান থেকে ট্যাক্সি পাবে না। পায়ের ব্যথা হাঁটতেও পারবে না । কি করে যাবে শুনি ? 
এই সময় সামনে ট্র্যাফিক সিগনাল টা লাল হতেই গাড়ি থামল । আমি বললাম তোরা চিন্তা করিসনা আমি বাড়ি চলে যাবো । 
ছেলে বলল এরকম জানলে আমি তোমায় নিয়ে আসতাম না । 
আর কে কার কথা শোনে । আমি এখন ঘোরে । পেছনে হাঁটা দিলাম ফুট ধরে । খানিকটা যেতেই বৃদ্ধাকে দেখতে পাই। 
বৃদ্ধার কাছে গিয়ে বলি , “ও মাসি কি বিক্রি করছ শুনি ?” 
 মাসি বলেন “ কেন বাপ তুমি কি কিনবে?” 
হ্যাঁগো । তুমি জাননা আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব বলে ছুটে এসেছি ওইখান থেকে । বলে আঙ্গুল দেখিয়ে ট্র্যাফিক সিগনালের দিকে হাত দেখাই। ওখানে আমাদের গাড়িটা এখন আছে । 
মাসি তুমি এই বয়েসে এত কষ্ট করছ কেন ? তোমার কি কেউ নেই। 
সব আছে বাপ , যে যার সে তার । এখন আমি বুড়ি হয়েছি আমাকে কে খাওয়াবে বল ? তাই ফুটের ধারে এই খেলনা বিক্রি করছি । তুমি নেবে ?
হ্যাঁ । ওই বাঁশীটা দাও , একটা ছোটা ভীম দাও , আরেকটা বেলুন। 
মাসি সব দিয়ে বলল ,“কার জন্যে গো ! নাতি নাকি?” 
 হ্যাঁ নাতনী । ওর ছোটা ভীম খুব ভালো লাগে । আমি দিলে খুশি হবে। 
আমার ও নাতি আছে। সে এখন কলেজে পড়ে । মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে । খাবার দিয়ে যায় আর কিছু টাকা। না করতে পারিনা । নাতিটা বড্ড ভালো ছেলে । ওর মা’টা দজ্জাল । এক্কেবারে বজ্জাৎ । 
কেন ? টাকা বার করতে করতে বলি । 
আর বলনি-কো । আসা থেকে আমার ছেলেটার কানে কি মন্তর ফুঁকল জানিনা .......... 
 পেছনে শুভ আমার ছেলের গলা পেলাম । বাবা হল ! 
হ্যাঁ হ্যাঁ । মাসি তোমার কত হল । ১৯০ টাকা । 
আমি দুটো একশ টাকার নোট দিয়ে বলি বাকিটা রেখে দাও । আমি তোমার ছেলের মত । 
না বাপ আমি ভিক্ষা নি না। ভিক্ষা খুব অসম্মানের কথা। ওতে মানুষের মনুষ্যত্ব থাকেনা। দাঁড়াও দিচ্ছি তোমায় বাকি টাকা বলে একটা দশ টাকার কয়েন দিল। 
 আমি ত তোমায় ভিক্ষা দিচ্ছিনা মাসি । আমি তোমার ছেলের মতন । 
ছেলের মতন , ছেলে ত নয় । আমি ছেলের কাছ থেকেও টাকা নি না বাপ। তুমি দুঃখ করনা বাপ। এই যে তুমি এতগুলো জিনিষ কিনলে এই যথেষ্ট । 
 আমি আশ্চর্য হই এই বৃদ্ধাকে দেখে । ৮৫ ঊর্ধ্ব বয়েস হবে কিন্তু আত্ম সম্মান জ্ঞান আছে। অথচ আমাদের দেশে বিজয় মাল্য ১৫,০০০ কোটি টাকা দেশের প্রায় সমস্ত ব্যাঙ্ক থেকে লুট করে নিয়ে উধাও । দিব্বি বুক ফুলিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলা দেখতে গিয়েছে । লজ্জা ত নেই অপরাধ বোধ ও নেই। এরাই অমানুষ ভিখিরি । আর এই বৃদ্ধা ? এনারা বোকা মানুষ । এনার কখন কোন ভুল কাজ করতে পারেন না। তাই এরা বোকা মানুষ । এদের মধ্যে পাপ পুণ্য , ভালো মন্দ বিচার করার জ্ঞান ভগবান দিয়েছেন সৎ বুদ্ধি কিন্তু টাকা দেন নি। মনুষ্যত্ব টাই সবচেয়ে বড়। মানুষের মতন মানুষ হলে তার পুণ্য তোলা থাকে। একদিন না একদিন ঈশ্বর শুনবেন ই । শ্রী কৃষ্ণ সুদামার কথাই দেখুন। 
মনটা ভারাক্রান্ত হল। আমার মা বেঁচে থাকলে ওই বয়েসের ই হতেন । তাই আমি মায়ের টানে গিয়েছিলাম মাসির কাছে। মাসির ভেতর আমার মা'কে খুঁজছিলাম । 
ফিরে গেলাম গাড়িতে । এখন অনেক কথা শুনতে হবে । আরও কিছুক্ষণ মাসির কাছে থাকার ইচ্ছা ছিল । কিন্তু আমার ছেলে শুভ নিয়ে এল প্রায় জোর করে।
L

Saturday, June 10, 2017

ভেতরের পোশাক অরুণ দে




ভেতরের পোশাক

অরুণ দে
  • লক্ষণ-এর দোকানে আজ বেশ ভিড়। দাঁড়িয়েই আছি। অন্যদিন লক্ষণ বা কর্মচারীরা কেউ আমাকে দেখতে পেলেই বলে ওঠে, ‘কী দেব, মাস্টারমশাই?’
    আমি চুয়াত্তর। সেজন্য বোধহয় আমার প্রতি তাদের এমন সহানুভূতি।
    অস্বস্তি হয়। কয়েকবার বলেওছি, ‘দেখো, তোমরা সকলের সামনে আমায় অসহায় করে দিও না। আমি এখনও সোজা হাঁটি, তাকাই সোজাসুজি।’
    এমন কথায় ওরা নরম হাসে। এখন কাউন্টারের সামনের দিকে আমি। আশপাশের কম-বেশি পরিচিত মানুষজন। চোখের ইশারায় কয়েকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় হল।

    আমাদের পিছনে একটা স্কুটার থামার শব্দ। ঘাড় ঘোরাল সবাই। কৌতূহলী হয়ে আমিও তাকালাম।
    সাদা স্কুটি। বছর চব্বিশ-পঁচিশের এক যৌবনশ্রী। পরনে হাঁটু পর্যন্ত লালচে কেপ্রি, ওপরে হাতকাটা হালকা দুধ-সাদা টপ। বুকের ওপর কালচে এক নিগ্রোর আবছা মুখ। টান-টান টাইট পোশাক। চোখে রোদ-চশমা। ডান হাতের কব্‌জিতে রিস্টলেট। লুকনো মোবাইল থেকে দু’কানে গোঁজা দুটো মাইক্রোফোন। শরীরী আবেদন উপচে পড়ছে তার চাল-চলন আর পোশাক-আশাকে।
    নিমেষে চোখ সরিয়ে নিলাম। শরীরের ভেতর কেমন যেন গা-গুলনো ভাব।
    পাশের খদ্দেরটি চলে যেতেই সে ঢুকে দাঁড়াল আমার গা ঘেঁষে। তার পছন্দের পারফিউম একেবারে ভাল লাগছে না আমার। বিশ্রী অস্বস্তি হচ্ছে। এদিক-ওদিক এলোমেলো চেয়ে দেখলাম, প্রায় সকলেরই চোখ তার পোশাক আর উদ্ধত শরীরে।
    লক্ষণ কাউন্টারের বাইরে এল। আমার পায়ের সামনে থাকা ছোট পেটিটা তুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকল।
    পেটিটা সরে যেতেই মেয়েটি আরও স্মার্ট হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে আমার পায়ে তার পা ঠেকল।
    তাচ্ছিল্যভাবে, চোখে রাগ নিয়ে তাকালাম।
    কিন্তু এ কী! নিমেষে মেয়েটি কোমর পর্যন্ত শরীর ভেঙে মাথা নুইয়ে দু’হাত দিয়ে আমার দু’পায়ের পাতা ছুঁল। প্রণাম করে দাঁড়িয়ে উঠে, লজ্জিত মুখ নিয়ে বিনীত স্বরে বলল, ‘আমি দেখতে পাইনি জেঠু।’
    তার ভেতরের পোশাক দেখে আমি হতচকিত! হতবাক!
    মাথায় হাতের স্নেহ-স্পর্শ দিয়ে বললাম, ‘বড় হও। ভাল হও।’
    অঙ্কন: প্রীতম দাশ

অন্তিম ধৃতিমান গঙ্গোপাধ্যায়


Image may contain: one or more people


অন্তিম
ধৃতিমান গঙ্গোপাধ্যায়
And all night long we have not stirred
And yet God has not said a word!
লাইনদুটো দেখেই খুব চেনা মনে হয়েছিল স্মিতার...
সন্ধে থেকে প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টি, চারদিক ভেসে যাচ্ছে। লোডশেডিং হতে কতক্ষণ! তাই অন্যদিনের থেকে একটু আগেই দরজা বন্ধ করতে নেমেছিল অমিত। সবে ছিটকিনিতে হাত দিতে যাবে, ওপার থেকে নিঃশ্বাস ফেলার একটা চাপা আওয়াজ পেয়ে থমকে গেল হাত। এই ছন্দ, এ শ্বাস তার চেনা...কিন্তু...
এ কী! কবিতা, তুমি? এমন বৃষ্টিতে?
কোনও কথা না বলে ঢুকে এল কবিতা। তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরল অমিতকে। শরীরটা কাঁপছিল। এই রূপ খুব একটা চেনা নয় অমিতের...
কবিতাকে ভালবেসেছিল অমিত। গ্রীষ্মের দুপুরে ভিক্ষে করে আনা এক কৌটো চালের মতো ভালবেসেছিল। নিঃশ্বাস ছাড়া আর নেওয়ার মাঝের মুহূর্তটুকুর মতো ভালবেসেছিল। টুয়েলভে পড়ার সময়, পরি যবে চলে গেল, তখন থেকেই... কবিতার হাতে হাত দিয়ে ঘোরা, মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েও গঙ্গার তীরে, ময়দানে ওকে নিয়ে বসে থাকা... কী না করেছে অমিত। কবিতার চাহিদাও ছিল প্রচুর। যেমন খেয়াল হবে, ঠিক তেমনটি। খেয়াল হল, চুমুতে ভরিয়ে দিল অমিতকে... কখনও সপ্তাহের পর সপ্তাহ কথাই বলল না মোটে। রাতভর জেগে সাধ্যসাধনা করতে হত অমিতকে, মান ভাঙাতে হত। সবসময় যে তাতে কাজ হত, তা-ও না। রাগ হত, খুব। দোলাচলে ঝুলতে-ঝুলতে বিরক্তি আসত। মায়ের কথায় একবার ঠিকই করে ফেলেছিল বিয়ে করে নেবে। কবিতা রাজি নয় তো আর কেউই সই। সেকথা কবিতাকে বলতেই এমন চোখ লাল করে তাকাল...
বরং মাকেই ছেড়ে আসতে হয়েছিল। নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে একা থাকার সেই শুরু। কী করবে? কবিতা চোখে আকুতি এনে বলেছিল, “যদি কখনও রাতবিরেতে তোমার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে, অমিত? যদি আদর করতে ইচ্ছে করে? তোমার মা থাকলে...”
এতদিনে সময় হল কবিতা?
ততক্ষণে ওর বিছানায় বসেছে কবিতা। আলো নেভানোর আদেশ দিয়েছে। একা ঘরের কোনা থেকে ঠান্ডাটা বেরিয়ে দিয়েছে ছুট। আলো নিভিয়ে বিছানার কাছে এল অমিত।
“কবি...”
অমিতের ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করিয়ে দিয়েছিল কবিতা। শরীর থেকে একের পর এক অন্ধকার সরিয়ে মোলায়েম চাঁদের মতো উন্মুক্ত হয়ে বুকে আঁকড়ে ধরেছিল অমিতকে। দাঁতে, নখে ফালাফালা করে, উন্মত্ত আদরে ডুবিয়ে দিচ্ছিল... শ্বাস নেওয়ার সুযোগও পাচ্ছিল না অমিত। ওর মধ্যেই কোনওরকমে বলেছিল, “এই প্রথমবার কবিতা...”
“আমি আর আসব না অমিত। এই শেষ। আমায় এই শেষবারের মতো নাও। তোমার সব নিয়ে যাব আমি...”
কবিতার ভিতরেই থমকে গিয়েছিল অমিত। ঠান্ডা একটা অসহায় রাগে গলা টিপে ধরেছিল কবিতার। তারপর... তারপর... বিছানায় পড়ে থাকা প্রিয় পেনটা সোজা ঢুকিয়ে দিয়েছিল ওর গলায়, বুকে... নগ্ন সুন্দর দেহটাকে বিজবিজে করে কেটেছিল। বহুদিনের সঙ্গী কলমটাকেও প্রবল রাগে ভেঙে ফেলে দিয়েছিল। তারপর প্রচণ্ড আদরে আবার আঁকড়ে ধরেছিল কবিতাকে... কী ঠান্ডা শরীরটা! ঠান্ডা লাগছে কবিতা? আলো জ্বেলে দিই?
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল অমিত। কবিতা চোখ খুলল না। নিশ্চিন্ত হয়ে, কবিতার ওড়নাটা গলায় তিনবার পাক দিয়ে ফ্যানে ঝুলে পড়ল অমিত। ওতে তখনও কবিতার লম্বা চুলের দু’-এক কুচি...
কবি অমিত রায় আত্মহত্যা করেছেন। ওই যা হয়... সকালবেলা কাজের মেয়েটি ডেকে সাড়া পায়নি, লোক জড়ো করেছে, তারপর...
জমে যাওয়া ভিড়ের মধ্যেই ছিল স্মিতা। অমিতের পড়শি মেয়েটি, ওর কবিতার ভক্ত ছিল একটা সময়। অমিত রায়ের কবিতায় আর সেই জোর নেই, এই কথা ভেবে দুঃখও পেয়ে থাকে। গোলমালের মধ্যেই, ঘরের ধারের ডাস্টবিনটার দিকে চোখ পড়ে যায় ওর। ছোট্ট একটা ছেঁড়া ডায়েরি, একটা ভাঙা পেন। কী ভেবে, সবার অলক্ষ্যে ডায়েরিটা তুলে নিয়ে ছুটে বাড়ি চলে আসে স্মিতা। পাতার পর পাতা কবিতা, অধিকাংশই খুব খারাপ। সেগুলি পেন দিয়ে যারপরনাই হিংস্রতায় কাটা হয়েছে। ছিঁড়ে গিয়েছে পাতাগুলি। কোনায়-কোনায় লেখা, “আর আসবে না! না! না!”
ডায়েরির শেষ পাতাটুকুই শুধু অক্ষত। তাতেই লেখা, গল্পের শুরুর ওই দুটো লাইন...
লাইনদুটো চিনে ফেলেছে স্মিতা, অনেকক্ষণ। রবার্ট ব্রাউনিং, ‘পরফিরিয়াজ় লভর’...
অঙ্কন: দীপঙ্কর ভৌমিক

সারপ্রাইজ টেস্ট ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী



 
সারপ্রাইজ টেস্ট
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী
আজ স্কুলের সব চেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে এসেছে সে।
সারপ্রাইজ টেস্ট।
জীবনের যত ধৈর্য, সাহস, শক্তি আছে, সবকিছু মিলিত করে একেবারে অন্যরকম এক পরীক্ষা। সারা ক্লাসঘর শান্ত, নিশ্চুপ। মুহূর্তরা কেবল ধরা দিচ্ছে দেওয়াল-ঘড়ির ভীরু পদক্ষেপে। নিষ্পাপ চোখ দুটো আলতো করে খুলে কিছুটা দম নিতে চাইল কিন্তু পারল না। একটা ভুলের ফল হতে পারে পরীক্ষায় হেরে যাওয়া। শুধু আম্মুর কথাগুলো মনে করতে লাগল ও, “কখনও চেষ্টা না করে হার মানবে না। যত কঠিন পরীক্ষা আসুক জীবনে, মনকে শান্ত রেখে নিজের কাজ করে যাবে।” আজ সকালেও যাদের সঙ্গে প্রার্থনা লাইনে দাঁড়িয়ে খুনসুটি করছিল সেই রোশন– সাকিব– শ্রুতি কারও কোনও সাড়া নেই চারপাশে। কেবলমাত্র দুই একটি পায়ের শব্দ বেঞ্চগুলোর চারপাশে, সেই সঙ্গে অতন্দ্র প্রহরা।
না, একটি পায়ের আওয়াজও ওদের প্রিয় শিক্ষিকা সাবিনা কিংবা রাগী স্যার বশিরের নয়, কারণ ও নিজের চোখে দেখেছে কিছু মুহূর্ত আগেই দু’জনই ওই দুষ্টু লোকগুলোর বন্দুকের সামনে প্রাণ দিয়েছে ওদের বাঁচাতে। ও জানে ওর চারপাশের চেনা মুখগুলো রক্তাক্ত-ভূলুণ্ঠিত। শুধু মাঝে মাঝে অল্প কিছু গোঙানি আর সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের তীব্র আক্রোশ। আবার সব শান্ত।
গলার কাছে কান্না দলা হয়ে আছে। আর্তনাদ চেপে সে অপেক্ষা করতে থাকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মুহূর্তটার।
না, ওকে হারাতে পারেনি। বন্দুকের নল, রক্তাক্ত স্মৃতি কোনও কিছুই পারেনি ওকে আটকে রাখতে। ও বুঝেছে সন্ত্রাসবাদের কোনও ধর্ম হয় না, বুঝেছে ভয় দেখিয়ে শিক্ষার আলো নেভানো যায় না। আজ ও আবার স্কুলে এসেছে। কারণ অনেক অনেক লেখাপড়া করে সাবিনা আন্টি কিংবা বশির স্যারের মতো হতেই হবে ওকে। জীবনের সব পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে প্রস্তুত আজ ও। মৃত্যু আর ভয়, দুটোকেই আজ হারিয়ে দিয়েছে ইকবাল।
অঙ্কন: দীপঙ্কর ভৌমিক

Friday, June 9, 2017

ডাউন বনগাঁ লোকাল ঐন্দ্রিল ভৌমিক


 

ডাউন বনগাঁ লোকাল

ঐন্দ্রিল ভৌমিক
  • মানুষের মন বড় বিচিত্র। বাইরে থেকে দেখে তা বুঝবার উপায় নেই। এই যেমন আমি। ভিড়ে ঠাসা ডাউন বনগাঁ লোকালে জানলার পাশের সিটে আরাম করে বসে আছি। কোলের উপর একটা ছোট ব্যাগ। চোখ দুটো বোজা। যে কেউ দেখলেই ভাববে অফিসের নিত্য যাত্রী। কেউ সুদুর কল্পনাতেও ভাবতে পারবে না, আমার মনের মধ্যে এখন কী চিন্তা ঘুরছে।
    আমি একটা খুন করতে চাই। আমার সবচেয়ে প্রিয় নারীটিকে আমি খুন করতে চাই। একটা সন্দেহ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিছুতেই তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছি না। রাতের ঘুম উবে গেছে। সারাক্ষণ অস্থিরতা। অবশেষে আমি সিদ্ধান্তে এসেছি যে করেই হোক তাকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে। কিন্তু এমন ভাবে, যাতে কেউ আমাকে সন্দেহ না করে। একেবারে নিখুঁত হত্যা। কোনও সূত্র না রেখে। 
    সেটাই সমস্যা। ভেবে চলেছি গত দুই তিন দিন ধরে। বাড়ির বাইরে যাইনি। একটি নিখুঁত অথচ নৃশংস খুনের ব্লু প্রিন্ট আমাকে তৈরি করতে চাই, কিন্তু এখনও কোনও পরিকল্পনাই মনে ধরেনি।
    আজ তাই বেরিয়ে পড়েছি, ভিড়ভাট্টায় ঘুরে যদি হঠাৎ কোনও প্ল্যান ঝলসে ওঠে!
    গেটের কাছে চরম হইহট্টগোল। ট্রেন হাবরায় ঢুকেছে। প্লাটফর্ম ভিড়ে থিক থিক। সকলেই ট্রেনে উঠবার জন্য মরিয়া। যেন এটাই পৃথিবীর শেষ ট্রেন।  
    আমার পাশের সিটে একটি মেয়ে বসে আছে। মুখ ওড়নায় ঢাকা। এই গরমেও। শুধু চোখ আর নাক দেখা যাচ্ছে। বয়সটাও তাই ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না, শরীরের গঠন বলছে তিরিশের নিচেই। আমার এই মানসিক পরিস্থিতিতেও একটি মেয়ের প্রতি আগ্রহ হচ্ছে বুঝতে পেরে নিশ্চিন্ত হলাম। যাক তাহলে আমি এখনও স্বাভাবিক আছি। 
    আমার উল্টোদিকের কমবয়েসি ছেলেটি একমনে মোবাইলে কিছু ছবি দেখছে। সেদিকে তাকালাম। ছবিতে একটি মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ছেলেটি। নিশ্চয় প্রেমিকা। ছেলেটি ছবিটা বড় করল। তার নিজের মুখ এখন স্ক্রিন জুড়ে। প্রেমিকা বাদ পড়ে গেছে। ছেলেটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের ছবি দেখছে। তার মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠছে। মানুষ যে আসলে নিজেকেই সবচেয়ে ভালবাসে, তা আমার চাইতে ভাল কে জানে! নিজেকে ভাল রাখার জন্য সে প্রেম করতে পারে, আবার নিজের প্রেমিকাকে খুনও করতে পারে।
    দুটি সিটের মাঝের গলিতে দুটি বাচ্চা কোলে নিয়ে এক দম্পতি। বাচ্চা দুটি সম্ভবত যমজ। বাচ্চা কোলে নিয়ে দুর্বল শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। ভদ্রতার খাতিরে আমার সিট ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে ঘামতে ঘামতে হত্যাকাণ্ডের মতো একটা গভীর ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনা সম্ভব নয়। চোখ বুজে জানলা দিয়ে আসা হাওয়া খেতে খেতে আমি ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা করতে চাইলাম।
    একসময় চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বুঝতে পারলাম পাশের মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। আর বাচ্চা কোলে বউটি সেখানে বসেছে। ব্যাস, এবার বাচ্চাটি আমার জামার হাতা ধরে টানবে, মাথা দিয়ে গুঁতো দেবে, ব্যাগের হ্যান্ডেল ধরার জন্য ছটফট করবে। এই অবস্থায় নিখুঁত খুনের পরিকল্পনা করা অসম্ভব।
    অগত্যা আমিও উঠে দাঁড়ালাম। বউটির স্বামীকে বললাম, ‘আপনি বসুন।’ সে বিনা বাক্যব্যয়ে দ্বিতীয় বাচ্চাটিকে নিয়ে আমার সিটে বসে পড়ল। 
    বসে থেকেও ঘুম আসেনি, কিন্তু এবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজ্যের ঘুম আমাকে চেপে ধরল। এই ক’দিন প্রতিহিংসার চিন্তায় ঠিকঠাক ঘুমাতে পারিনি।
    পাশের মেয়েটি আমাকে যেন কিছু বলল। বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘কিছু বলছেন?’
    ‘আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো? ’
    এরকম প্রশ্নে আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। প্রথমেই মনে হল মেয়েটি আমার চিন্তাভাবনা জেনে যায়নি তো! কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আমি একটু বিলম্বে উত্তর দিলাম, ‘আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। তাছাড়া আপনার মুখ ওড়নায় ঢাকা।’
    মেয়েটি বলল, ‘আমার দিকে ভাল করে তাকান, তাহলেই বুঝবেন।’
    মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম। দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। ওড়নার ফাঁক দিয়ে মুখের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির মুখের বাঁ-পাশ জুড়ে পোড়া দাগ। 
    আমি গলাটা যতটা সম্ভব করুণ করে বললাম, ‘কী করে পুড়ল?’
    ‘পোড়া, তবে আগুনে পোড়া নয়। অ্যাসিড বার্ন। একজন পুরুষ, যে আমাকে ভালোবাসে বলে দাবি করত তার মহৎ কীর্তি।’
    আমি কৌতূহলী হলাম। আমিও এরকম কিছু একটা করতে চাই। বললাম, ‘আপনি কি ইয়ে... মানে... তাকে ভালবাসতেন না?’
    ‘আমি তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম। ভালবাসা মন্দবাসা এসবের চাইতেও তখন বড় চিন্তা ছিল পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। আমার পরে আরও দু’জন বোন। বাবা অটোরিকশা চালান। টিউশানি করে পড়াশুনো চালাতাম। ভালবাসা বাসির মতো সময় আমার ছিল না। তাছাড়া আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল ছেলেটির আদৌ ভালবাসার ক্ষমতা আছে কিনা।’
    কিছুক্ষণ দু’জনে চুপচাপ। তারপর মেয়েটি বলল, ‘তবে সে ছেলে আমার অনেক উপকার করে গেছে। আগে আমি পুরুষদের ভয় পেতাম। এখন পুরুষরা আমাকে ভয় পায়।’
    মেয়েটির কথা শুনতে শুনতে হৃদয়পুর চলে এল। মেয়েটি বলল, ‘আমি এগোই। মধ্যমগ্রামে নামব। এখানে এক বালিকা বিদ্যালয়ে আমি ইংরাজির শিক্ষিকা। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু ক্লাসে মুখ ঢেকে পড়াই না।’
    একটু থেমে বলল, ‘আমি প্রথমেই আপনাকে দেখে চিনেছি। আপনি বিখ্যাত লেখক শ্যামল সমাজপতি। আমি আপনার লেখার ভক্ত। পারবেন আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে?’
    আমার পরবর্তী প্রতিহিংসা ও অপরাধমূলক গল্পটির প্লটকে ছিন্নভিন্ন করে মেয়েটি মধ্যমগ্রামে নেমে গেল।
    অঙ্কন: মহেশ্বর মণ্ডল

Sunday, June 4, 2017

নজরুল - রোমান্টিক বিদ্রোহী শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

নজরুল - রোমান্টিক বিদ্রোহী 
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় 
 



আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়ায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা ফকির আহমেদ ছিলেন মসজিদের ইমাম। সেই সূত্রে মাদ্রাসায় পড়াশুনো। বাল্যে পিতৃবিয়োগের পর নিজেও ‘মুয়াজিন’ পদে নিযুক্ত হন। মাদ্রাসায় পড়াশুনোর পর শিখেছিলেন আরবির পাশাপাশি হিন্দী এবং সংস্কৃতও। আসানসোলের ‘ওয়াহিদ’ বেকারিতেও কিছুদিন কাজ করেন। ছোটবেলা থেকেই কাকা ফজল করিমের ভ্রাম্যমান নাটক দল যাকে ইংরিজিতে Leto বলা হয়ে থাকে, তাতে যোগ দিয়ে অভিনয়ের পাশাপাশি গান, কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন একাধিক নাটিকা যেমন ‘শকুনি বধ’, ‘চাষার শং’, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের শং’, ‘আকবর বাদশা’, ‘কবি কালিদাস’, ‘বিদ্যায়ন হুতুম’, ‘রাজপুত্রের শং’ ইত্যাদি। তবে তাঁর সত্যিকারের গদ্য ও পদ্যস্ফূর্তি British Indian Army-তে যোগদানের পর 49th Bengal Regiment-এর অধীনে করাচি ক্যান্টনমেন্টে থাকা কালে। ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ বই, ‘মুক্তি’ কবিতাটি সেই সময়কার -১৯১৯ সালের। নজরুলের সেনায় যোগদানের পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাশার বদলে সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চারের তাগিদ কাজ করেছিল। কারণ পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন হয়ে কারাবরণও করতে দেখা গেছে, তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমণে’ কবিতাটি নিষিদ্ধও ঘোষিত হয়েছিল। একাধিক জ্বালাময়ী গান আর কবিতা বলতে গেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্লোগানের তুল্য ছিল। তবে তাঁর সেনাবাহিণীতে যোগদানের ঘটনাটি ঘটেছিল কোনও পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ করে ম্যাট্রিকুলেশনের প্রিটেস্ট না দিয়ে। 

অথচ মজার কথা করাচিতে গিয়ে যত না যুদ্ধ করেছেন তার চেয়ে বেশি সাহিত্য বিশেষ করে কাব্যচর্চা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্রের পাশাপাশি জনৈক পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে পার্সি শিখে কবি হাফিজ রুমি আর ওমর খৈয়ামের কাব্যরস পান করেছেন আকণ্ঠ্য। নজরুলেরই অনুবাদ করা ওমর খৈয়ামের কবিতার একটি সংকলন আমার কাছে আছে। খৈয়াম সাহেব কতটা সুরারসিক ছিলেন সেই পরিচয় পাওয়া ছাড়া ওগুলোর গুণমান নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু পার্সি ঘরানার আদলে বাংলা রোমান্টিক গানে গজল শৈলীর প্রবর্তনা কাজি নজরুলেরই অমর কীর্তি। বাংলা, হিন্দী, উর্দু, সংস্কৃত, আরবি ও পার্সি ভাষাচর্চার পাশাপাশি নিজের অনুরাগের জায়গা থেকে যে হিন্দুস্তানী ধ্রূপদী সঙ্গীত শিখেছিলেন, সেই শিক্ষারই সার্থক প্রতিফলন তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গানে, আমাদের সুপরিচিত নজরুলগীতিতে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো গুরুগম্ভীর ভাবে নয়, হয়তো কিঞ্চিত চটুল ভঙ্গীতেই প্রকাশিত প্রেমের আবেগ। কিন্তু সেগুলোর সাঙ্গীতিক অবস্থান ও মূল্য সাতসুরের নীরিখে বাংলা গানে একেবারে স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তের ভক্তিগীতির পরিবেশনার মধ্যে কোথাও যেন স্বভাব-গাম্ভীর্যে একটা সাযুজ্য দেখি, যেন গান যে ফেলনা নয়, খুব পবিত্র কিছু সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার সচেতন চেষ্টা; কিন্তু নজরুলের শ্যামসঙ্গীতও তাঁর নিজস্ব স্বতন্ত্র্য ঘরাণার সাক্ষ্য দেয়। এটা আমার নিজের অভিমত যদিও আমি সঙ্গীতবোদ্ধা নই। কবিতা ও গানে এই সাতন্ত্র্য হয়ত কিছুটা অতিরিক্ত আবরি, পার্সি শব্দ ব্যবহারের জন্যও। জানি না ইংরেজ সেনাধিকারিকরা সঙ্গীত রসিক ছিলেন কিনা, তবে সক্রিয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও কাজি কিন্তু কর্পোরাল থেকে হাবিলদার পদে উত্তির্ণ হন, নিজের ব্যাটালিয়নের-এর কোয়ার্টার মাস্টার হিসাবেও দায়িত্ব পান। বয়স তখন কতটুকু? কুড়ির প্রথম কোটায়। সেনা বাহিনী ত্যাগের পরও সঙ্গীত ও কাব্যই তাঁর ধ্যান জ্ঞান হয়ে থাকে। ভাগ্যক্রমে চাকরিও পান His Master’s Voice Gramophone কোম্পানিতে পদ রচয়িতা, সুরকার তথা মিউজিক ডায়রেক্টর হিসাবে। বেশ কিছুদিন Indian Broadcasting Company-র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, আকাশবাণী নামটা বোধহয় তখনও আসেনি। 

বাংলা সাহিত্যের প্রখর সূর্য এবং বহু নক্ষত্রখচিত আকাশেও একটা আলাদা পরিচয় কাজি নজরুল ইসলাম। আমরা কবিতায় তীব্র বিদ্রোহ, শ্লেষ, প্রতিবাদ একজন অতি অল্প বয়সে প্রয়াত কবির রচনাতেও দেখেছি –সুকান্ত ভট্টাচার্য। কিন্তু বিদ্রোহী কবি বলতে নজরুল ইসলাম। কবিতাগুলো প্রকরণে হয়তো খুব আধুনিক নয়। কিছুটা সুকান্তের মতো সুকুমার আবেগে সিক্ত বা বলা যায় ক্ষোভে বাষ্পীভূত। কিন্তু নজরুলের চিন্তা ভাবনা শুধু যুগত্তীর্ণ নয়, এখনকার সময়ের চেয়েও এগিয়ে। 

১৯৩০-৩১ নাগাদ ভারতের অনেক মুসলমান মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর নেতৃত্বে তুরস্কের খিলাফত রক্ষার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তা দেখে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনে ভারতীয় মুসলিমদের অংশগ্রহণ টানতে অসহযোগের সঙ্গে খিলাফত আন্দোলনকে জুড়ে দিতে চান। আমরা পাঠ্যপুস্তকে এই ব্যাপারটা জাতির জনকের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা হিসেবে পড়েছি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম খলিফাদের সাম্ততান্ত্রিক স্বার্থ ও ধর্মীয় শাসন রক্ষার জন্য লড়াই করার বদলে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশার নেতৃত্বে নতুন তুর্কি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন,যারা তুরস্কের জগদ্দল ধর্মান্ধ সালতানাৎকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৯২১ সালের শেষ দিকে নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘কামাল পাশা’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। ভারতবর্ষে তোষণনীতির যে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য আজও বাহিত হচ্ছে, পরাধীন ভারতেই সেই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নজরুল ভারতীয় খিলাফত আন্দোলনের অসারত্ব এবং সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্পর্কে নিজের স্বচ্ছ ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন। মোস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বের প্রতি নজরুলের গভীর শ্রদ্ধা ছিল, যিনি তুরস্ককে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের সমাজ থেকে সামন্তবাদ অপসারণ এবং নারীদের আধুনিকতার পথে উত্তরণ দেখে নজরুল বিমোহিত হয়েছিলেন। যাঁর বাবা মসজিদের ইমাম এবং বাল্যে পিতৃবিয়োগের পর নিজেরও মসজিদে ‘মুয়েজিন’ পদে নিযুক্তি তাঁর মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, উদারতা এবং লিঙ্গসাম্যের ভাবনা কীভাবে বিকশিত হয়েছিল সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। 

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে কাজি সাহেবের ছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'সম্পাদনা করতেন ভারতীয় রাজনীতিতে ‘কাকাবাবু’ নামে পরিচিত মুজাফফর আহমেদ। এই পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে নজরুল ও মুজাফফর আহমেদের প্রথম পরিচয়। ১৯১৮ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলামান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশের জন্য প্রথম লেখা পাঠান নজরুল। এর পর থেকে দুজনের মধ্যে পত্রালাপ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯২০ সালে।

এরপর ‘শের-এ বাংলা’ এ কে ফজলুল হক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘নবযুগ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রাজনীতিবিদ কমরেড মুজফ্‌ফর আহমেদ। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য এটি পত্রিকা হিসেবে বেরোতে শুরু করে। এই সময় মুজাফফর আহমেদের প্রভাবেই নজরুল ইসলাম কমিউনিস্ট চিন্তাধারার দিকে আকৃষ্ট হন। তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে সাম্যবাদের বাণী, শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনা ক্ষোভ, অধিকারের দাবি ও বৈপ্লবিক বার্তা।

এর পর নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু'ও ‘লাঙল'পত্রিকাতেও একসাথে কাজ করেন মুজাফ্‌ফর আহমেদ। কর্মজীবন পেরিয়ে ব্যক্তিজীবনেও তাঁদের গভীর সখ্য অটুট ছিল চিরকাল। নজরুল যখন দেওঘরে গিয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন তখন কলকাতায় ফিরতে পারেন মুজফ্‌ফরের জন্য। কুমিল্লায় বিয়ে করতে গিয়ে প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব খোয়ানোর পরেও তাঁকে কলকাতায় ফেরান সেই মুজফ্‌ফর। আবার মুজাফফর আহমদ যখন জেলে তখন তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সন্দ্বীপ ছুটে যান নজরুল। কলকাতায় তালতলা লেনে তাঁদের একত্রবাসের সময়ই লেখা হয় কাজীর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। মুজাফফর আহমদ তাঁর ব্যাক্তিগত স্মৃতী কথায় লিখেছেন, “আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সাপ্তাহে। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন প্রহরে তা আমি জানিনে। ওদিন রাত ১০ টার পর আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বললো সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে আমায় পড়ে শুনালো। বিদ্রোহী কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”

বাংলাদেশের জাতীয় কবির কবিতাতেই ফিরি। সংবেদনশীল মন সমাজের পিছিয়ে পড়া নিগৃহীত মানুষের হয়ে মুখর হবেন তাই তো স্বাভাবিক। সেই মুখরতা খুব কেতাবি নয়। নজরুলের বলার ভঙ্গীতে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নয়, পাওয়া যায় নিপীড়িত সাধারণের প্রতিনিধিকে। বিদগ্ধ মননশীলতার মার্জিত বচন নয়, ফুটে ওঠে প্রতিবাদী চিৎকার। কবির ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিঞা’। এই দুঃখ কবিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে আবার এই দুঃখকে যেন তিনি যত্ন সহকারে লালনও করেছিলেন। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হলেও নিজেকে সর্বহারাদের একজন ভেবেই সৃষ্টির অনুপ্রেরণা পেতেন। -‘হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান/ তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান,/ কণ্টক মুকুট শোভা দিয়াছ তাপস/ আসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস!/ উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার/ বীণা মোর শাপে তব হল হল তরবার/দুঃসহ দহনে তব হে দর্পী তাপস,/ অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস।/ অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!/ শীর্ণ করপুট ভরি সুন্দরের দান।/ যতবার নিতে যাই – হে বু্ভুক্ষু তুমি/ অগ্রে আসি কর পান! শূন্য মরূভূমি/ হেরি মম কল্পলোক! আমার নয়ন/ আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ! – কিন্তু এ তাঁর দুঃখ-বিলাসিতা নয়। দুঃখের এই বাস্তবতা তাঁকে গভীর ভাবেই ছুঁয়েছিল, যে কারণে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তাঁকে বিভিন্ন লেখায় সোচ্চার হতে দেখি। 

অথচ যখন তিনি গীত রচয়িতা তখন যেন গানের সুরে রাগ জ্বালা কোথায় উড়ে যেত। বেজায় মজলিশি আর রোমান্টিক মেজাজে রচিত তাঁর গানগুলি। ৪০০০ গানের মধ্যে প্রেমের গানের সংখ্যাধিক্য উল্লেখযোগ্য। কিন্তু রোমান্স বা রোমান্টিকতা কোনওটাই কেবল সুখানুভূতি লাভের দিবাস্বপ্ন নয়। একটি রোমান্টিক মনকে প্রথমে সংবেদনশীল হতেই হয়। আর সংবেদনশীল হৃদয় প্রতিবাদী হতে বাধ্য। একটি সত্যিকারের রোমান্টিক হৃদয় প্রকৃতির সৌন্দর্যে যতটা মোহিত হয়, প্রেমাস্পদকে কাছে পেতে যতটা ‌আগ্রহী হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াতেও ততটাই মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় ‘রণক্লান্ত’ বিদ্রোহীর প্রেমিক সত্তার বিকাশ, কিংবা আশৈশব কাব্য-সঙ্গীত রসপ্রেমী কবির বিদ্রোহী হয়ে ওঠার মধ্যে তাই কোনও বিরোধ নেই; বরং দুটো সত্তার সহাবস্থানই তাঁর অন্তরের স্বচ্ছতা ব্যক্ত করে। 

মাত্র ৪৩ বছর বয়সে দুরারোগ্য স্নায়ুরোগের কবলে বাক্‌ ও স্মৃতিশক্তি না হারালে আমরা আরও সমৃদ্ধ হতাম। শুধু সাহিত্যে নয়, এই দেশে এই উপনিবেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতিতেও। জাতির জনক যে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে মান্যতা দিয়ে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিলেন, কলম হাতে এই সৈনিক তার চেয়ে অনেক বেশি দূরদৃষ্টির পরিচয় দেন। আমাদের দুর্ভাগ্য সেই দূরদৃষ্টিকে সুদূর প্রসারী হতে দেয়নি।