Wednesday, January 6, 2016

ছোট গল্প ‘মুন্নী’ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী /২২.১১.২০১৫



   ছোট গল্প ‘মুন্নী’
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী /২২.১১.২০১৫  
 
মাসিমা মুন্নীর বিয়ের জন্য পাকা দেখা । পরশু ওকে দেখতে আসবে ওর ভাবি শ্বশুর আর বর । আমি দু দিন কাজে আসতে পারবোনা কিন্তু ।
 
... মুন্নীর বিয়ে সেকিরে ওরতো মোটে ১৪ বছর বয়েস । এই সবে স্কুল ফাইনাল দিল । এরমধ্যেই ওকে বিয়ে দিয়ে দিবি । ভালোই-ত পড়ছিল মেয়েটা । আমি তোকে বলে রেখেছি পাস করলে ঘড়ি কিনে দেব আর কলেজে ভর্তি করতে যা খরচ হয় দেব । তবুও তোর ওই টুকু মেয়েটার বিয়ে না দিয়ে তর সইছেনা । বলিহারি জাই বাপু তোদের ।
 
কি করবো যা দিনকাল পড়েছে ঘরে সমত্ত মেয়ে রাখা বিপদ 
। ওর বাবা কাজে চলে জায় ফেরে রাতে। আমি ফিরি বেলা তিনটের পর । ঘরে সমত্ত মেয়ে । পাড়ার ছেলেগুলো ভালো নয় । মেয়েটা ডাগর হয়েছে তাই ওদের ছুঁক ছুঁকুনির শেষ নেই । খালি ঘরের সামনে ঘুর ঘুর করে । মেয়েটাকে যে সামলে রাখব তার উপায় নেইকো । কি করি বলেন ? 
তা বলে ১৪ বছরের মেয়ের বিয়ে দিবি ! তোকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে জানিস । তুই আসার সময় ওকে নিয়ে আসতে পারিস । আমার ঘরে না হয় থাকবে পড়াশুনো করবে । আমারও একটা কথা বলার লোক থাকবে সঙ্গে । আমার ঘরে আমি যা খাই না হয় তাই খাবে । ওকে এই বয়েসে বিয়ে দি-সনা মা । আমার কথা শোন । পড়াশুনো করা । তুই কি চাস ও তোর মতন পরের বাড়ি বাসুন মেজে জীবন টা কাটাক ।
 
আমার চাওয়া পাওয়ার কি এসে যায় মা । সব ই অদৃষ্ট । মুন্নীর বাবা জামাই দেখে এসেছে । একটা পাস সেও করেছে । বাবার দোকান সামলায় । ভালো ছেলে । এই ছেলে হাত ছাড়া হলে পরে হাত কামড়াবো ।
 
ছেলের বয়েস কত ?
 
তা শুনলাম ২৮ হবে। একটা চোখ ট্যারা । তা হোক ব্যাটা ছেলের আবার খুঁৎ ধরে নাকি ?
 
কি বলিস রে!” গিন্নী গালে হাত দিয়ে বলেন ।
 
পাসের ঘর থেকে সব কথা কানে আসছিল । আমি আর থাকতে পারলামনা ।
 
বললাম,“মঞ্জু এদিকে আয় । এইনে দড়ি আর এই নে কলশী ... তোদের বাড়ির সামনে কুয়োতে তোর মেয়েকে গলায় দড়ি বেঁধে কলশি সমেত ডুবিয়ে দে ...চুকে গেল ল্যাঠা । লজ্জা করেনা তোদের বাচ্চা মেয়েকে জবরদস্তী বিয়ে দিতে । মেয়েদের বয়েস ১৮ না হলে বিয়ে দেওয়া আইন বিরুদ্ধ কাজ। সাজা হবে তোদের দুজনের ওই ট্যারা বর আর ওর বাবা মায়ের । পুলিশে আমি নিজে খবর দেব । দেশটা উচ্ছন্নে গেল এই মূর্খদের জন্য । পশ্চিম বংগ কি বিহার ইউ.পি.র অধম হল । এখন ও বাল্য বিবাহ উচ্ছেদ হোলনা? ”
 
মঞ্জু আমার গলার আওয়াজে ঠক ঠক করে কাঁপে । বুঝেছে আমি খুব রেগে গিয়েছি ।
আ...আমি কি করি বলেন .. কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমি কি চাই কচি মেয়েটারে বিয়ে দিতে । তার বাবা সব ঠিক  করেছেন । আমার কি দোষ । আমিতো গতর খাটিয়ে খাই দুমুঠো । আমারে কেন বকছেন মেসো?
 
আমি গলা নামিয়ে বলি, “যা তোর বরকে বোঝা । এ সব বিয়েতে না মেতে মেয়েকে ১২ ক্লাসে ভর্তি কর। তোর মাসি ভর্তির জন্য যা লাগে সব টাকা দেবে । খাতা ,বই , টাকা যা লাগে সব দেব আমরা । ওকে পড়া মা । আমার কথা শোন” 
  
মঞ্জু চলে যায় । মঞ্জু যাওয়ার পর গিন্নী খেঁপে গিয়ে বলেন তোমার এর মধ্যে নাক গলানোর কি ছিল এখন যদি ও না আসে কি হবেআমি ত খেটে খেটে মরবো । তোমার আর কি!
আমি বলি ,“তুমি চিন্তা করনা ও ঠিক আসবে”। 
 
মঞ্জু গিয়ে বরকে সব বলে ।
 
বর শুনে বলে ওনাদের আর কি টাকার গদিতে বসে আছেন । ঘরের কাজ তুই করে দিচ্ছিস । গতর ত আমাদের যাচ্ছে ওনারা মাস গেলে দুটো ৫০০ টাকার নোট ছুঁড়ে দিচ্ছেন । ব্যাস নিশ্চিন্ত । আমরা গ্রীষ্ম বর্ষা শীত সব সহ্য করে ভোর বেলায় ছুটি ওনাদের বাড়ি কাজে । ওনারা ঘুমের ঘোরে দরজা খোলেন ব্যাস । তারপর তুই তো ওনাদের ঘরের কাজটা করিস ... না কি আসলে মুন্নীর পড়ার খরচ দিয়ে ওনারা তোকে পুরো পুরি ওদের ঘরে বেঁধে রাখতে চান যাতে তুই অন্য কোথাও না গিয়ে ওনাদের ঘরের কাজ ই করিস।ওনারা বিনা স্বার্থে কিছু করেন না জেনে রাখিস 
 
ও মা সে কি কথা ওনারা ওরকম লোক নন। মাসি মেসো আমাদের বাড়ির জন্য চিন্তা করেন । তোমার বাবা মারা যাওয়াতে ওনারা টাকা দেন নিতোমার চোখের অসুখে টাকা দেন নিমেসো নিজে টাকা দিয়ে বলেছিলেন এই টাকা তোকে দিতে হবে না মঞ্জু। হ্যাঁ আমি ওনাদের বাড়িতে কাজ করি আমার পেটের দায়ে আমার বাড়ির জন্য । আমার ঘর চলবে কি করেএকা তোমার রোজগারে কি ঘর চলবে ওরকম কথা বলে ওনাদের সঙ্গে বেইমানী করতে পারবো না ।
 
মুন্নীর বিয়ে হলে তুই ঘরে থাকিস আর তোকে যেতে হবে না পরের দুওরে বাসুন মাজতে ।
 
শোন কথা ! বরং মুন্নী বাড়িতে থাকার সময় আমার এই ঘরে থাকার কথা । আমি থাকলে কি ওই বকাটে ছেলেগুলোর সাহস হত আমার ঘরে উঁকি মারার। মেয়েটার স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়েছে একটু যে ঘরে থাকবে তার উপায় নেই । আমার বাপু ভয় করে। তুমি কিছু অন্য উপায় কর । না মেয়েটাকে বিয়ে দিও না । থাক না আর দু চার বছর পরে না হয় দিও । ও কি করবে এই কাঁচা বয়েসে ?
 
এখন বিয়ে না দিলে পরে তোর মেয়ের ল্যাজ মোটা হয়ে যাবে । দুটো পাস করলেই নাক উঁচু করবে । আমি কোথা থেকে ওর বিয়ে দেব তখন আমার কাছে টাকা নেই । এখন মালিক রাজি হয়েছেন ১০০০০ টাকা আগাম দেবেন বলে । ধার দেনা করে আরও ১০০০০ যোগাড় করবো । মুন্নীর নামে পোষ্ট অফিসে ২০০০০ আছে । তোর সোনার গয়নাগুলো ........
 
মঞ্জু কথা থামিয়ে উঁহু ওটি হবে না । আমি টাকা জোগাড় করে দেব যা দেওয়ার । আমার সময় অসময়ে কে দেবে টাকাভালো মন্দ হলে সব সময় কি মেসো মাসি দেখবেন ?বিয়ে শাদিতে নেই নেই করে ১ লক্ষ টাকা কিছুই না । গ্রামের লোকজন আছেন । শাড়ি গয়না লোক লৌকিকতা তত্ত্ব তালাস কত কি খরচ । মেয়ের বিয়ে কি চাট্টি খানি কথা?”
 
তাহলে তুই বরং ওকে তোর বোনের বাড়ি টাকি’ তে পাঠিয়ে দে । ওদের ওখানে অনেক জমি জমা আছে । চাষ বাস আছে । কোন অভাব নেই । ওখানে না হয় কিছু দিন থাকুক । আমি এর মধ্যে জামাইয়ের বাড়ি থেকে কিছু সময় নিয়ে নি । তবে ওরা গর রাজি হলে কি করবো ?
 
মুন্নীকে ওর মেসো টাকি’ থেকে এসে নিয়েযায় ওঁদের বাড়িতে । মুন্নীর ওখানে মাসতুতো ভাই শোভনের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায় । শোভন টাকি সরকারী মহাবিদ্যালয়ে পড়ে বি.এস.সি কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে। শোভন মুন্নীকে সাইন্স নিয়ে ওদের ই কলেজে ভর্তি হতে বলে। মুন্নীর রেজাল্ট ভালই ছিল মাধ্যমিকের । শোভন বলে কোন অসুবিধে হবে না সাইন্স পড়তে। তা ছাড়া ও আছে ওকে গাইড করতে। মুন্নী জেন আকাশের চাঁদ পেল এখানে এসে । এত আপন করে ফেলেছিল ওরা মুন্নীকে যে মুন্নী বুঝতেই পারলনা ও বাড়ি ছেড়ে আছে বলে। স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট মার্ক শিট সব সঙ্গে নিয়ে এসেছিল । এমন সুন্দর দাদাকে পেয়ে ও সত্যি কৃতজ্ঞতা জানাল সকলকে । চোখ ছল ছল করে মাসীকে বলে , “তোমরা না থাকলে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিত আমার চেয়ে অনেক বয়েসে বড় এক লোকের সঙ্গে । সারা জীবনের জন্য পড়াশোনা শিকেয় তুলে এক লাঞ্ছিত জীবন অতিবাহিত করতে হত ঘর সংসারের জন্য। আমি আমার মাকে দেখেছি । মা কি সাংঘাতিক পরিশ্রম করে আমার পড়ার জন্য। আমি তোমাদের ঋণ কি করে শোধ করবো ? ”
 
মাসী বলেন .. থামত । এই টুকু মেয়ের কথা দেখ ! ওরে আমরা কি তোর কেউনা । হলাম ই বা তোর মাসী .. তবে সর্বনাশী নই বলে বুকে টেনে নেন মুন্নীকে । তুই আমাদের মেয়ে । এখানেই থাকবি । পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়াবি । আমি জানতাম তোর বাবার মতলব । মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাবার জন্য এই কচি বয়েসে কেউ বিয়ে দেয় ! কি যে মতি গতি জানিনা বাপু।
মুন্নী ওর দাদার সঙ্গে টাকি সহরের কাছে ইছামতী নদীর ধারে যায় । ওখানে সুন্দর বসার জায়গা আছে। ওপারে বাংলা দেশ । শোভন মুন্নীকে বোঝায় এই ইছামতী নদী ভারত বাংলা দেশের সীমা রূপে পরিগণিত হয়। ইছামতী তিন ভাগে বিভক্ত ১. পদ্মা নদীর শাখা নদী মাথাভাঙা থেকে এই ইছামতী নদী ২০৮ কিলোমিটার বয়ে হাসনাবাদের কাছে কালিন্দী নদীতে মিলিত হয়। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার মুন্সি-গঞ্জের কাছে পদ্মা নদীর দক্ষিণ দিক থেকে বেরিয়ে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার মজি-দিয়া তে আবার দুভাগে বিভক্ত হয় ইছামতী এবং চুরনি নদী রূপে । ২. ভারতে ১৯.৫ কিলোমিটার অতিক্রম করে ইছামতী আবার বাংলাদেশের মুবারক-পুরের কাছে মোড় নিয়ে বাংলা দেশে প্রবেশ করে। প্রায় ৩৫.৫ কিলোমিটার বাংলা দেশে প্রবাহিত হয়ে আবার ৩. পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার দত্ত-ফুলিয়াতে এসে পড়ে । এই নদীর প্রাধান্য অনেক কারন এটাই ভারত বাংলা দেশের সীমা নির্ধারণ করে। ইচ্ছানুসারে নদীর মোড় তাই বোধ হয় ইছামতী নাম করন । অবশ্য এটা আমার মনে হয়।
মুন্নী খুব পরিতৃপ্ত নয়নে তার দাদার দিকে তাকিয়ে বলে ,“তুমি আমাকে কত কিছু বোঝাচ্ছ দাদা । প্রত্যেকটা কথা সুন্দর ভাবে বোঝাচ্ছ । এরকম ভাবে আমাকে কেউ বলে দেওয়ার ছিলনা । আমার সৌভাগ্য আমি তোমার মত দাদা পেয়েছি। এখানে না এলে আমার কি হত দাদা?”
... দূর বোকা মেয়ে । সব সময় মনে রাখবি ওপরে ভগবান আছেন । মানুষের সুখ দুঃখ তিনি ই নির্ণয় করেন । তাঁর প্রতি ভক্তি ভাব রেখে সব কাজ করলে তোর চলা পথ সরল হবে । কোন দুঃখ দুর্দশা থাকবে না । তুই ভালো ভাবে পড়া শুনো কর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
... তুমি ত আছো আমাকে ঠিক রাস্তা দেখাতে । আমার চিন্তা কি? 
মুন্নী একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে , “চল দাদা সন্ধ্যা হয়ে এল ঘরে ফিরে যাই।
... হ্যাঁ চল । 
..........XXX……..

No comments:

Post a Comment