অনু গল্প “টকিং বার্বি ডল”
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ১৯.১২.২০১৫ /
ছোট্ট মেয়েটা নাম তার 'দীপান্বিতা' । আমার নাতনীর বয়সী হবে।আমাদের আবাসনেই থাকে আমার বাড়ির পাসে । তার
৫ম জন্মদিন ১লা জানুয়ারি তে। আমাকে দু মাস আগেই বলে রেখেছে ,“দাদু , আমার জন্মদিন ১লা জানুয়ারিতে । তুমি কিন্তু আমাকে গিফট
দেবে । আমি মা বাবাকে বলে তোমার পছন্দর খাবার আনাবো।”
আমি বলি নিশ্চয়ই মা। তুই তো আমার আহ্লাদী
ঠাকুমা । তোকে গিফট না দিলে কাকে দেব বল !
হুম মনে থাকে জেন ।
ঠিক আছে মনে থাকবে দেখিস। তবে আমি
যদি তার আগে মরে যাই ।
বালাই শাঠ ও কথা বলছ কেন । তুমি না থাকলে আমায় গল্প কে শোনাবে? পাকা বুড়ীর মত বলে।
তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায়
বেঁচে থাকতে হবে !
তা কেন । তুমি
শুনিও না কিন্তু তুমি থাক নাহলে আমিও তোমার সঙ্গে চলে যাব আকাশে।
দূর বোকা মেয়ে । তবে ওই পক্ষী রাজ
ঘোড়া চড়ে তোর অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার যে মেলবোর্ন থেকে আসবে সে কাকে নিয়ে যাবে তার
সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া য়।
খুব রেগে যায় । তুমি খুব বাজে । ও
আমার বন্ধু । আমাকে না রাগালে তোমার বুঝি ভাত হজম হয়না?
আমি হাঁসি । খুব মজা পাই ওকে
রাগাতে আবার ও নাহলেও চলে না । ওই ত আমার প্রকৃত বন্ধু।
অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার এর সিক্রেট হচ্ছে .... ওর ই স্কুলের এক ছেলে
তার জন্ম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে । সে নাকি ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড । তাই এই রসিকতা। ওই বলেছিল
সে কথা । ছেলেটি দেখতে ভারি সুন্দর কিন্তু ও আসলে মহারাষ্ট্রিয়ান । নাম অমিত
আকোল্কার ।
এই অমিতকে নিয়ে দীপান্বিতার যত
গল্প । ও কি টিফিন আনে , স্কুলে টিচার
ওকে কি বলে। কেমন ড্রইং করে ইত্যাদি।
আমি চুপ করে শুনি । মাঝে মাঝে ‘হুঁ’ বলি । তারপর বলি
তোর বেষ্ট ফ্রেণ্ড দের ডাক-বিনা ?
ডাকবোত । চকলেট দেব গিফট দেব । আরও
কত কি ।
আজকাল বাবা মায়েরা , ছেলে মেয়েদের জন্মদিন ইউরোপিয়ান স্টাইলে ওদের ধারায় করে
। আমাদের আমলে বাবা মা নতুন ড্রেস পরিয়ে মন্দিরে পূজো দিতেন । সেদিন একটা বিশেষ
দিন বলে গণ্য হত । বাড়িতে পায়েস নিশ্চই হত । সেটা মুখে দিয়েই মা বাবা আশীর্বাদ করতেন
। গড় হয়ে প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদ ই সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল। সে রীতি প্রায় নেই । এখন কেবল কেক
কাটা আর গিফট নেওয়া পরে গিফট দেওয়া । বেলুন দিয়ে সাজান , লাইটের ডেকোরেশন ইত্যাদি।
......... দিপুরা (আমি ওকে এই নামি
ডাকি) বেশ কদিন হল কোথায় গিয়েছে। আমি কোন খবর পাইনা ওদের। মনে মনে খুঁজি । আহা
মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছে । ওর টক টক কথা , চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচ আমার মন কেড়ে নিয়েছে। ওর মা বাবা কেও দেখিনা কদিন। মনে
মনে ভাবি হয়ত স্কুলের পড়াশুনোর চাপ। তারপর নাচের ক্লাস , গানের ক্লাস , ড্রইং ক্লাস , ক্যারাটের ক্লাস ...... । সত্যি আজকাল মা বাবারা নিজেদের
ছেলে মেয়ের ওপর এতো প্রেশার দেয় যে তাদের নিজের মতন বাঁচার অধিকারটুকু যেন ছিনিয়ে
নেয় । সব এক একটা রোবটে পরিণত হচ্ছে আর সেই রোবটের রিমোট টা আছে মায়ের হাতে । যেমন
বোতাম টিপবে ঠিক সেই রকম চলবে । খাও খাবে ... নাচো নাচবে ... গান কর গান করবে
...!!!!! এ কি ?
আমার মনে আছে
কিন্তু দিপু’র কথা । ওর বার্থ ডে
গিফটের ফরমাস “টকিং
বার্বি ডল” সেটা নিয়েই যাই ১লা জানুয়ারির দিন সন্ধ্যায় । কিন্তু একি
ফ্ল্যাট টা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন ? কেউ কি নেই ! লোকজন ত থাকার কথা । মিউজিক ,লাইট সব কোথায় ? তা ছাড়া কোন লোক জন নেই । তবে কি ওর বার্থ ডে পার্টি হবেনা ! কিন্তু কেন? এই ভেবে মনটা এক অজানা আশংকায় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে
ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপলাম। দরজা খুলে দিলেন ওর বাবা । আমাকে দেখে কান্নায়
ভেঙ্গে পড়লেন । উনি বললেন , “দিপুর ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে । ওরা
মুম্বাই গিয়েছিল ওকে দেখাতে আশা ক্যানসার হসপিটাল এন্ড চিলড্রেন হসপিটাল এবং টাটা
ক্যানসার হসপিটাল , মুম্বাইতে। কেমো দেওয়া হয়েছে। ওকে দেখলে চিনতে পারবেন
না।”
আমি আর দুঃখ রাখতে পারলামনা। ও যে
আমাকে বলেছিল “আমার সঙ্গে আকাশে
চলে যাবে । তবে কি ও জানতো ওর রোগের কথা ! ওর
সেদিনের কথাগুলো আমার ভিডিও রেকর্ডিং এর মত চোখের সামনে ভেশে উঠলো ; বালাই শাঠ ও কথা বলছ কেন । তুমি না থাকলে আমায় গল্প কে শোনাবে? তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায় বেঁচে থাকতে হবে
!” আমার চোখ
ভারাক্রান্ত হল। আমি কেঁদে
ফেললাম হাউ হাউ করে । ভগবান কেন এই কচি শিশুদের এই ভয়ংকর রোগ দেন ! কেন ? আর কিছুই আমার মাথায় এলোনা তখন । কিছু না বলে দিপুর বাবার হাতে
বার্বি টকিং ডলটা দিয়ে বলি এটা ওকে দিয়ে দেবেন । এটাই ও চেয়েছিল। মানা করবেন না । ওই আমার
প্রাণের বন্ধু । এই বলে দ্রুত পায়ে ওখান থেকে ফিরে আসি আমার নিজের ফ্ল্যটে ।
সারাদিন আমি ঠাকুর ঘরে গিয়ে ওর আরোগ্যের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি । আমি কি
করতে পারি এ ছড়া ।
No comments:
Post a Comment