ওরাও বাঁচতে চায়
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী , ২৩.০৯.২০১৩ ,
সোমবার , রাত ১০.৫৯
(একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে )
অতীত আমার স্মৃতির সাইয়েরি
সম্পর্ক হয়েছে কালি
রং হারিয়েছি পৃথিবী থেকে ,
জীবনটা মরু বালি ,
চাঁদনীতে আজ জ্বলছি আমি ,
হয়েছি চোখের বালি ।
ব্যথিত হৃদয়ে গাইছি আমি
নেই কোন ক্ষোভ চলেছি আমি
স্মৃতি তে সাজান ফুলের কবিতা ,
হারিয়েছি আজ মায়ের মমতা ।
(আমি একটু বদলেছি কিন্তু মূল কবিতাটা বদলাইনি)
ওপরের কবিতাটা এক রিক্সা-বালার লেখা
কবিতা । নাম কৈলাস চন্দ্র পাত্র । বাডি
যাজপুর জেলার কোরেই থানা অন্তর্গত রগডিতে । আমি সেই কৈলাস পাত্র , শুনবেন আমার কথা
? হ্যাঁ শুনতেই হবে কারন আমি স্কুলে পডার সুযোগ
পাইনি । এক অস্পৃশ্য পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা আমার মহাপাপ । তাই আমাকে জীবন যুধ্যে অবতীর্ণ হতে হয় ছোটবেলা
থেকে । বাবা মারা
জান এক অজানা ব্যাধিতে । ডাক্তার খানাতে ভর্তি করার পরের দিন মারা জান ।ঘরে দু ভাই
এক বোন আর আমি । মায়ের মাথায় বাজ পডে কারন বাবার সঞ্চয় বলতে কিছু ই ছিলনা । দিন আনতেন দিন খেতেন। রাজমিস্ত্রি র
কাজ করতেন আমার বাবা । বাবা মারা যাওয়ার পর মা কিছু সরকারি বাবুদের বাডিতে বাসুন
মাজা কাপোড কাচা ইত্যাদি কাজ করতেন । সরকারি বাবু বলতে ব্লকের বি ডি ও , জি পি ও , এস ই ও । ওই তিন চার ঘরে কাজ করে যা পেতেন
তাতেই বোনের বিয়ে দেন ১৪ বছর বয়েসে । হ্যাঁ জানি ওটা আইন বহির্ভূত কিন্তু কি করবেন এক অসহায় বিধবা নারী । শেয়াল
কুকুরের তো অভাব নেই দুনিয়াতে । হায়নার মোত ছিঁডে খেত যে নাহলে আমার বোনকে । সে-টাকি ভাল হত ? তাই
আইনের কথা মাথায় না রেখে আমরা ছোট বোনকে তুলে দিলাম ১০ বছরের বড বর পাত্রর হাতে।
আমাদের জাতিতে ভালো বর পাত্র পাওয়া প্রায় অসম্ভব ।
আমার বোনের বিয়ে হয় এক পানের দোকানির
সঙ্গে । ১০ হাজার টাকা পণ দিয়ে । সঙ্গে টিভি, খাট
, সোনার গয়না । যা আমার মা’র ছিল সব দিয়ে দিতে বলেছি আমি । মা’ র
সখ ছিল বড বৌ কে সোনার চুডি দিয়ে মুখ দেখবেন । হায় রে আমার পোডা কপাল , মায়ের, বৌমার শখ দেখলে আমার হাঁসি পায় ।
আমি গ্রামের স্কুলেতে পডতাম ক্লাস সেভেন
এ । ব্যাশ চুকে গেল পডা ; বাবা মারা যাওয়ার পর ! মায়ের একার পক্ষে এতোগুল মুখে আহার জোগান সম্ভব হলনা । আমাকে
কাজে নামতে হল । আমি যাজপুরের এক হোটেলে কাজ
করতে যেতাম । সকাল ৭ টায় বেরিয়ে ফিরতাম রাত
১০ টার পর । সারাদিন হাড ভাঙ্গা খাটুনির
পর পেটে পেতাম দুট দানা । ডাল ভাত আর কিছু উচ্ছিষ্ট তরকারি। সপ্তাহে
৭০ টাকা ।মানে মাসে ২৮০ টাকা
।
কি বলছেন
? লেবার অফিসার ধরেনা কেন হোটেলের মালিক কে ?
কি হবে ? গুঁজে
দেবে একটা ১০০ টাকার নোট আর এক প্লেট ভালো খাসীর মাংস সঙ্গে বাসমতী চালের ভাত । যাওয়ার
সময় একটা ছোট বোতল । কেল্লা ফতে
! কোন ব্যাটা কমপ্লেন করবে? কার ঘাডে দুটো মাথা
?
মা , বি
ডি ও সাহেবকে অনেক বলেছিলেন আমাকে একটা চাকরী দেওয়ার জন্য ।
হেঁসে খুন বি ডি ওর স্ত্রী । বলেছিলেন
মহিলা, “কি বলছিস চাকরী” ! তুই কি দিবা
স্বপ্ন দেখছিস কৈলাসের মা ? ও সব চাকরী ফাক্রী তোদের জন্য নয়রে
। তোরা না থাকলে আমাদের ঘরে কে কাজ করবে বলতো
? ছেলেকে বল রিক্সা চালাতে । বুঝলি
।
মা চোখ মুছে ফিরে আসেন । আমায়
কিছু বলেন না ।
আমাদের পরিবারে টানা টানি পডে কারন বোনের
বিয়ে তে মহাজনের কাছ থেকে সুধে টাকা ধার নিয়ে ছিলাম আমরা মা’ ব্যাটা
। প্রত্যেক মাসে ৩০০ টাকা সুধ বাবদ দিয়ে হাতে যা থাকতো নাম মাত্র টাকা।
একদিন হোটেলের কাজ করতে করতে আমার খুব খিদে
পায় । আমি থাকতে না পেরে একটা প্লেটে ভাত আর ডাল নিয়ে খেতে সুরু করি । সে
দিন আমাদের ওখানে পার্টির মিটিং ছিল। অনেক বক্তা এসেছিলেন । খুব
গরমা গরম বক্তৃতা চলছিল। হবু এম এল এ অমূল্য বাবু মাইকে বলেন আমাদের রাজ্যতে কেউ খালি পেটে শোবে না । বি
পি এল কার্ড ধারিদের ১টাকা কিলো চাল মাসে ২৫ কিলো দেওয়া হবে । মেয়েদের
স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল দেওয়া হবে । গর্ভবতী মহিলাদের জননী সুরক্ষা
যোজনায় ৫০০ টাকা পাবে । পরে আবার পুষ্টিকর
খাদ্যর জন্য টাকা দেওয়া হবে। আপনারা এসবের সুযোগ নিন আর
আমাদের চিহ্নে ভোট দিন জাতে আমরা আপনাদের আরও সেবা করতে পারি ৫ বছর। হাথ
তালিতে কান ফেটে জায় ।
আমি সব শুনছিলাম হঠাৎ পিঠে এক কিল আর লাথি
চড এর বর্ষণ আরম্ভ হল । কিছু বলার আগেই মালিক চিৎকার
শুরু করলেন , শালা নিমক হারাম । বেরিয়ে
যা । এখুনি বের ।
আমি অনুনয় করে বলি,
মালিক সকাল থেকে কাজ করছি । পেটে
দানা নেই । খিধে পেয়েছিল । আমার
মাইনে থেকে কেটে নেবেন ।
তুই বের এখুনি । অনেক
কাজের লোক পাবো ।
অগত্যা মিটিংয়ে চলে জাই । সেখানে
আমাদের সরপঞ্চ ছিলেন । ওনাকে বলি সব কথা । উনি
বলেন মিটিং শেষ হলে শুনবো তোর কথা । তোকে না বলেছিলাম আজ এখানে
থাকতে । এখানেই ত খেতে পেতিস সঙ্গে ২৫ টাকা । তোরা
পার্টির কথা না বুঝলে আমরা কি করি বল তোদের জন্য ! বিপদে
পডলে তোরা আসিস অন্য সময় টিকি দেখা জায় না।
আমি বলে রাখি ওই হোটেল থেকে এসে আমি
প্রতিদিন রাতে লন্ঠনের আলোতে বই পড়তাম । কবিতা
লিখতাম । আমার
কবিতা লেখার প্রবণতা জীবনের সব জ্বলন্ত ঘটনা নিয়ে । তাতে
অবসাদ , দুঃখ , বেদনা ভরা কিছু কাহিনী
যা জীবনের সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্ত কে লিপি বধ্য করা । কিছু
মুখোস ধারি রাজনৈতিক ব্যক্তি র আসল রূপের কথা।তাদের আসল রুপটা তুলে ধরতে
। আমার লেখা কবিতা ক্রমশ
উডিশ্যার বিখ্যাত খবরের কাগোজ ‘সমাজে’
প্রকাশ পায় । রবিবাসরীয় তে । আমার
আনন্দের সীমা থাকেনা সেদিন। মা’কে বলি , মা আমার লেখা বেরিয়েছে সমাজে । তিন টাকা
দিয়ে আমি প্রতি রবিবারের ‘সমাজ’ কাগজ কিনি
।
মা বলেন লেখা নিয়ে কি হবে পেটের ভাত জুটবে তোর ? একটা রিক্সা কেন । বী ডি ও বলেছেন লোন করিয়ে দেবেন ।
উদ্যেশ্য টা মোটেই মহৎ নয় । বি ডি ওর মেয়েকে কলেজে নিয়ে জেতে হবে নিয়ে আস্তে হবে বিনে পয়সায় । লোন শোধ
না হওয়া অভধি । তবুও রাজি হলাম কারন নিজের স্বাধিন রোজগারে চলবো । কেউ লাথি মারার
লোক থাকবেনা।
আমি বি পি এল কার্ডের
জন্য সরপঞ্চ কে বলি । উনি বলেন তোর মা ,
বি ডি ও র বাডিতে কাজ করে এটুকু করাতে পারে না ! আমায় বলছিস কেন ? অগত্যা
মা কে বলি । মা বহু কষ্টে কার্ড পেয়ে জান । এবার আমাদের দুঃখ ঘুঁচবে বোধ হয় ।
ভগবান কে আমি বিশ্বাস করি না যেদিন আমার
বাবা মারা যান বিনা চিকিৎসাতে । কিন্তু আমার মা করেন । তাই বোধ হয় একটু সদয় হলেন
ভগবান ।
কিন্তু আমার মা’ ? তাকেও তো হারাতে হল
এক অশুভ দিনে । মাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তার খানায় । ডাক্তার বললেন তোমার মায়ের
ক্যানসার হয়েছে । পেটেতে । আমার মাথায় বজ্রাঘাৎ হল যেন। মা বললেন কিছু হবে না আমি
ঠিক হয়ে জাবো । কটকে নিয়ে গেলাম ক্যানসার হাঁসপাতালে । আমাদের এম এল এ মহাশয় একটা
বেড ঠিক করে দিলেন । আমি ‘সমাজে’ আমার মার
জন্য আবেদন করেছিলাম কিছু সাহাজ্যের জন্য । সেই সুবাদে হয়তো বেড টা পেলাম । কিন্তু
মা’কে বাঁচাতে পারলাম না ।
আরম্ভ হল আমার জীবন যুধ্য । আমি একা ।
আমার বোন ছোট ভাই কে নিয়ে রাখে তার কাছে।
আমি লিখতে লাগলাম একটার পর একটা কবিতা
।
আমাকে কবিতা পাঠ উৎসবে ডাকা হল। আমার কবিতা পডে শোনালাম । হাততালি পেলাম আর কিছু বাহবা । মঞ্চে ঘোষণা হল “রিক্সা
বালা কৈলাস চন্দ্র পাত্র” র লেখা কবিতা । মন্ত্র
মুগধ হয়ে শুনছিল সবাই । সেটাই আমার প্রেরণা । সেটাই আমার পুরস্কার । আমি
রিক্সা চালিয়ে কম পডাশুন করে যদি আমার লেখা কে পৌঁছে দিতে পারি লোকেদের কাছে সেটাই
আমার সব পাওয়া ।
একদিন শুনলাম আমার সেই
হোটেল বালা যার কাছে আমি কাজ করতাম সে মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে । দুঃখ হল আবার
মনে হল বোধ হয় ভগবান আছেন ।
এখন আমি স্বাধীন এক রিকশাওয়ালা যার দুখের সাথি
একটা রেডিও আর কাগজ কলম । মা সরস্বতী
বিদ্যে বুদ্ধি যা দিয়েছেন তাই দিয়ে লডতে হবে অন্যায়ের বিরুধ্যে । আমার তো কোন বাঁধন নেই । আমি
একা আর আমার কলম সাথী । সংসার করার কোন ইচ্ছে নেই । সেই ঘ্যানর
ঘ্যানর , সেই দুঃখ দারিদ্র্য র কষাঘাতে
ছেলে মেয়েকে মানুষ করা , তাদের ইচ্ছা পূর্ণ করা এ যুগে আমার দ্বারা সম্ভব নয় । আমি
আর আমার কবিতা । আমার কবিতা পাঠোৎসবের আমন্ত্রণে মঞ্চের ওপর উঠে কবিতা পাঠ সে এক অদ্ভুত
শিহরন , অদ্ভুত অনুভূতি । আমি তাতেই খুশি । তাই বেছে নিলাম এক রিকশাওয়ালার জীবন যত
দিন থাকবো এই শহরে লিখে যাব আমার কবিতা ।
No comments:
Post a Comment