রথযাত্রা
রথযাত্রা শুধু বঙ্গ বা
ওড়িশাবাসীর নয়, এ উত্সব এখন সব্বার, গোটা বিশ্বের। পুরীতে জগন্নাথের রথ, মায়াপুরে ইসকনের রথ,
শ্রীরামপুরে
মাহেশের রথ, হুগলিতে রাজবলহাটের রথ, বেলঘরিয়ায় রথতলার রথ,
আড়িয়াদহের
রথ, আদ্যাপীঠের রথ— এ সব বিখ্যাত রথ তো আছেই, তা বাদেও রথ এখন সর্বত্র। দিল্লিতে,জামশেদপুরে,চেন্নাইতে,বেঙ্গালুরুতে,আহেমেদাবাদে,সুরতে,
এবং বিদেশে যথা
আমেরিকাতে কার্লিফরনিয়া,লন্ডনে,ঢাকা
বাংলা দেশ,সিঙ্গাপুরে রথ যাত্রা মহা সমারোহে পালিত হয়।পশ্চিম বঙ্গে পাড়ায় পাড়ায়, মন্দিরে,
রাস্তায়, এমনকী অলিতে-গলিতে রথ টানা হয়। বাচ্চারা কত দিন ধরে পরিকল্পনা করে
নিজের ছোট্ট কাঠের রথটিকে সাজিয়ে তোলে এই সময়ে। রথ সাজানোর যেন এক প্রতিযোগিতা
লেগে যায় তাদের!বিপুল উৎসাহ-উদ্দিপনার মধ্য
দিয়ে বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উল্টো রথযাত্রা উৎসব
পালিত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ : পৌর এলাকার কালীবাড়ি মন্দিরসহ জেলার অন্যান্য মন্দির প্রাঙ্গণে রথযাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হয়। শেরপুর : গোপাল জিউর মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে উল্টোরথ টানা হয়। কালির বাজার ভবতারা কালি মন্দির প্রাঙ্গণে মেলা বসে। ভোলা : মদনহোন ও লক্ষ্মীগোবিন্দ জিউর মন্দিরের রথ শহর প্রদক্ষিণের পর মন্দিরেই ফিরে যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ : হরেকৃষ্ণ সংঘ, উত্তরবঙ্গ বৈষ্ণব সংঘ ও শিবতলা পূজা উদযাপন কমিটি পৃথক উল্টো রথাযাত্রার আয়োজন করে। ধামরাই (ঢাকা) : ধামরাইয়ে ১০ জুলাই প্রথম রথ টানের মধ্যদিয়ে মাসব্যাপী রথমেলা শুরু হয়। বৃহস্পতিবার উল্টো রথ টানের মধ্যদিয়ে মেলার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার যবনিকা ঘটে। রথের দিন বৃষ্টি যেন হতেই হবে। আর হবে নাই বা কেন! বর্ষাকালে বৃষ্টি হওয়াই তো স্বাভাবিক! তবুও সবাই জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা করে, এ দিন বৃষ্টি যেন না হয়। রথের সাত দিন আগে থেকেই শুরু হয় উত্সব, জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা দিয়ে। মূল অনুষ্ঠান হয় দু’দিন— সোজারথ এবং উল্টোরথ। তবে রথের অন্য একটি বড় আকর্ষণ কিন্তু রথের মেলা। রথটানাকে কেন্দ্র করে কাছাকাছির কোনও মাঠে বা পথের উপরেই যে মেলা বসে তার আনন্দ রথটানা থেকে কিছু কম নয়। কোথাও সোজারথ আর উল্টোরথ এই দু’দিন মেলা বসে, কোথাও আবার টানা সাতদিন চলে মেলা। মেলায় কত্ত কিছু— মাটির পুতুল, খেলনা, হরেকমাল, ঘুগনি, আলুকাবলি, ফুচকা, গরম জিলিপি, চিনি বা গুড়ের গাঁটিয়া, নিমকি, চানাচুর, আইসক্রিম, প্রতিদিনের গৃহস্থালীর জিনিসপত্র, বেলুন, বাঁশি, সস্তার মনোহারী বস্তু, ফুল ও ফলের চারাগাছ— এ সব অতি পরিচিত ছবি। আর আছে নাগরদোলা, তার আকর্ষণও কিন্তু কম নয়। রথের মেলায় পাঁপড় ভাজা বা অন্য কোনও তেলেভাজা না খেলে দিনটাই যে বৃথা! তেলের গুণমান নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামানো চলবে না। মনে পড়ে, শহর ঘেঁষা মফস্সলে আমাদের ছোটবেলায় রথের আগের দিন বেলঘরিয়ার রথতলা থেকে বাবা একটা কাঠের ছোট রথ এনে দিতেন। সেটা নিয়ে আমার আনন্দের শেষ থাকত না। আর যদি সেটা দোতলা রথ হয় তা হলে তো কথাই নেই! সকালবেলা মা কাগজ কেটে ফুল তৈরি করে সেটাকে সাজিয়ে দিতেন। রথ সাজানো হয়ে গেলে উপরের খোপে বসাতাম জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রাকে এবং ঠিক তার নীচে ছোট্ট থালায় থাকত বাতাসা, গুজিয়া কিংবা নকুলদানা— ঠাকুরের প্রসাদ। রথের মেলা দেখার জন্য দাদু, ঠাকমা, বাবা, মা, পিসি সবাই টাকা দিতেন— কেউ এক’টাকা, কেউ দু টাকা! সব মিলিয়ে দশ টাকা হলে মহা আনন্দ। সেই নিয়ে রথের মেলা দেখতে যেতাম। বন্ধুদের সঙ্গে গেলে ছিল আলুকাবলি, আইসক্রিম খাওয়ার স্বাধীনতা। বড়রা সঙ্গে থাকলে অবশ্য তা হত না। এক বার বেলঘরিয়ার রথ দেখতে আমাদের বাড়ি এসেছিল আমার এক মাসতুতো দাদা শিবপুর থেকে সঙ্গে দাদু আর ফুদান আমার সমর্কে মাসি । তার সঙ্গে সদলবলে বন্ধুদের নিয়ে মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। দাদু আমাদের সবাইকে গরম গরম জিলিপি খাইয়েছিল। পয়সা জমানোর জন্য বাড়ি ফেরার সময় কিনে দিয়েছিল একটা বড় মাটির আম। সে আমটা পরের বছর রথ পর্যন্ত ছিল। রথের দিনে পাঁপড় ভাজা, জিলিপি বা ল্যাংচা বোঁদে খাওয়া। যখন আরও ছোট ছিলাম, মনে পড়ে ঠাকুমা আমায় কোলে করে মেলায় নিয়ে যেতেন। কিনে দিতেন মাটির পুতুল । বার কয়েক আবার বাবার সঙ্গেও বেলঘরিয়ায় রথের মেলায় গেছি। ওখান থেকে কেনা মাটির কৃষ্ণঠাকুর আজও আছে আমাদের বাড়িতে। কখনও রথের দিনে বাসে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে যানজটে আটকে গেছি, বিরক্ত হয়েছি। আবার যখন বাসে বসেই দেখেছি সিঁথির মোড়ে সাজানো রথের দড়ি টানা হচ্ছে, টবিন রোডের মেলায় শিশুরা বড়দের হাত ধরে বায়না করছে কিছু কিনে দেওয়ার জন্য, বেলঘরিয়ার মেলা থেকে মানুষ ফুল-ফলের চারা গাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে— তখন মনটা কেমন ভাল হয়ে গিয়েছে, শরীরের ক্লান্তি ভুলে আমিও মেতে উঠেছি উত্সবের আনন্দে। মনে পড়ে— ‘রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি, হাসেন অন্তর্জামী!’ |
|
|
No comments:
Post a Comment