মা মহামায়া নিজের ত্রিনয়নটা সামলে সুমলে রাখে । সরবক্ষন লক করা থাকে । কারণ যদি কোনও কারণে রাগের মাত্রাটা বেড়ে যায় তো ত্রিনয়ন লিক করে আগুন ঠিকরোতে পারে । সেজন্য শুধু লককরাই নয়, একটা ভালভ-এর ব্যবস্থা করেছে । শরীরের হরমোনাল সিস্টেমের ফিড ব্যাক কনট্রোলের মত ব্যবস্থা । শরীরের রাগ একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছলে তবেই ত্রিনয়নের ভালভ খুলবে । আবার রাগ মাত্রার নীচে নামলেই সে ডিসচার্জ বন্ধ করে দেবে ।
আসলে সবকিছুর মত এখন ভগবানও ডিজিটাল হয়ে গেছেন কিনা । টাকা আনার মত ছোটখাট বিষয় এই ডলারের যুগে অচল । তাই আনালগ (পড়ুন অ্যানালগ) সিস্টেম বাতিল হয়েছে । তা, যা বলছিলাম । বাবা সাতসকালে ধ্যানে বসেছেন ।হাতের তেলোয় একটা চ্যাপ্টা মোবাইল। যেটা নিয়ে এখন মর্তবাসী সর্বদা ধ্যানে মগ্ন সেটা এখন স্বর্গে দেবতাদের হাতে হাতে । কি করবে - ডিজিটাল স্বর্গ যে ।
ধুতুরার সরবতের গ্লাসটা এনে রাখার সময়ই চোখে পড়ল মহামায়ার । একি - এখন ধ্যানে বসার সময় নয় ? মেডিটেশনের কত উপকার তা কি মহেশ্বর জানে না ? আর ঠিক তখনই রাগটা তার মাথায় চড়ে বসল । কিন্তু এখানে তার ত্রিনয়ন লিক করার সম্ভাবনা নেই। মহাদেবের ত্রিনয়নের জোর একটু বেশি (স্বর্গটাও বোধহয় পিতৃতান্ত্রিক )। এখানেও সেই ফিড ব্যাক কনট্রোল । তাছাড়া একটা অ্যাটমিক পাওয়ার কি আর একটাকে ঘাঁটায় নাকি ? আরে রাম কহো । বড়জোর পায়ে পা লাগিয়ে গায়ে একটু তাপ দেওয়ার চেষ্টা এই যা । আর ওই পরমপুরুষের সাজেশন মেনে একটু আধটু ফোঁস ফাস করা । সেটা তো করতেই হবে নাকি ? নাহলে টেকা যাবে দুনিয়ায় ?
যা বলছিলুম। বাবার হাতে মোবাইল । নারদের নতুন আনা মোবাইল । বাবা বিষ্ণুর দেয়া । দেয়ার সময়ই বিষ্ণু নীরব হাসি হেসেছিলেন । নারদ এর গভীরে লুকিয়ে থাকা অর্থটা অনুধাবন করে মনে মনে হেসেছিল । লাগ ভেলকি লাগ । কৈলাসে এবার কলহ লাগল বলে । নারদ নিজের মনে শুধুবলল, নারদ ! নারদ !!
মোবাইলে বাটন নয় টাচ স্ক্রিন । আহা পরশের কি পুলক আর চমক ! একটু কষ্ট নেই, নেই এতটুকু ঝামেলা । একটা আঙ্গুলের মধুর পরশ মুহূর্তে খুলে দিতে পারে চরম এক সুখের জগত ।
মহাদেব বসে প্র্যাকটিস করছেন । একটা সুন্দরীর বুকের ওপরে আঙ্গুলের মৃদু পরশে খুলে গেল একটা নাচের সীন । হাতের সরবত হাতেই রইল । মহামায়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে যাচ্ছেন ।আর ভোলানাথ তো ধ্যান করছেন – মোবাইল হাতে ডিজিটাল ধ্যান । মহামায়ার মনে হল এটা একটা বলিউডই সিনেমা । তারপর মনে হল টলিউডিও হতেপারে । আবার হলী হুডিও হতে পারে । আজকাল হুডখোলা আর কার না ?
এতক্ষন তবু রাগ আর দুঃখ চেপে সব সইছিল । কিন্তু আর তো সয় না । ত্রিনয়ন এলারম বাজাতে শুরুকরেছে । আরে একি ! বাবা কিনা সাত সকালে ফেসবুক খুলে বসেছে ? নিজের প্রোফাইল । মহামায়ার সামনে । ফ্রেন্ড লিস্ট খুলতেই দেখা গেল । আরে একি ! উর্বশী, রম্ভা এরকম কত সুন্দরী সেই লিস্টে । কিন্তু সব ডিজিটাল – তাই ঘাগরা কাচুলি-ওড়নার বদলে সব বিকিনি পরে ফেলেছে । হায় হায় এবার কি হবে ? স্বর্গটাকেও কিনা বুক করে ফেলল ফেসবুক ? হরি হে মাধব – বাথটবে কি গা ধোব ?
কোটী কোটী ফেসবুক-সুন্দরীর লিস্ট কুটিকুটি করে ফেলতে ইচ্ছে হল মহামায়ার । কিন্তু এ যে সব ডিজিটাল – মানে মায়া । মহামায়ার থেকেও বড় মায়া । রাগে মোবাইলটা ভেঙ্গে ফেললেও কি আর সুন্দরীরা যাবে ? এই সুন্দরীদের ধ্যান করবে রোজ মহাদেব ? হায় হায় বিষ্ণুদেব তোমার মনে মনে এই ছিল ?
- কি, কি করছ তুমি ? রাগে কাঁপতে কাঁপতে মহামায়ার প্রশ্ন, এই তোমার ধ্যান ? এসব কি হচ্ছে ? আবার ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছ ?
মহাদেব মুখ তুললেন । গলার স্বর ভারি শান্ত । না হয়ে উপায় কি ? ভাঙ্গের সরবতটা যে এখনও বউ হাতছাড়া করে নি । একটু না তেলালে যে ও ফিরিয়ে নিয়ে যাবে । বললে, প্রিয়ে, তুমি হলে জগতের সেরা সুন্দরীদের সেরা । তুমি হলে মিস হেভেন । তুমি যখন রেগে যাও তখন মনে হয় একশটা সুন্দর লাল গোলাপ গন্ধ বিকিরণ করতে করতে এগিয়ে আসছে ।
মহামায়া একটু নরম হয়ে পড়ছে নাকি ? তার ত্রিনয়নের চার্জ কি কমে যাচ্ছে ? দনুজ দলনী দুর্গা কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন ? ভাবছেন ত্রিনয়নের চার্জ আরটা আনতে যাবেন কিনা।
- হেপ্রিয়ে । মহাদেব আবার শুরু করেছেন, তুমিই আমার ধ্যান । আমি কি করে অন্য সুন্দরীদের–
-- চুপ কর। এসব ডায়ালগ গল্প উপন্যাসে অন্তত কয়েক কোটী বার লেখা হয়েছে । ভেবেছ এই সব বস্তাপচা ডায়ালগে ভুলব আমি ? আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না । ফেসবুকের একাউন্ট তুমি এক্ষুনি ডি -একটিভেট করবে কি না বল ?
- আহা এটাতো বিষ্ণুর দেয়া । দেখ না বিষ্ণুই আমার প্রথম ফ্রেন্ড ।
- সে কি বিষ্ণু তোমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড ? আমি নই ?
মহাদেব বললেন, ডার্লিং তোমাকেই তো আমি করতুম কিন্তু তুমি যে ফেসবুক পছন্দ করই না । তাই –
মহামায়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কে বললে ? আমাকে ফ্রেন্ড করবে না তাই বল ।
মহামায়ার হাত একটু বোধ হয় ঢিলে হয়ে আসছিল । শিব উঠে সরবতটা সে হাত থেকে নিয়েই ঘোঁট ঘোঁট করেখেয়ে ফেললেন সবটা । তারপর হেসে বললেন, ফ্রেন্ড যে করব তোমারও একটা একাউন্ট থাকা চাই তো ?
- খুলে দাওনা বাপু ।
কলহটা হয়ত মিটেই যাচ্ছিল কিন্তু নারদ অলক্ষ থেকে একটু হাসল । নিঃশব্দে বলল, নারায়ন নারায়ন !
মহামায়ার চোখ পড়ে গেল মহাদেবের জটার দিকে । আরে এটা এমন ফুলে উঠেছে কেন ? কি লুকিয়ে রেখেছে এখানে ভোলানাথ ? কিছু বলা যায় না কোনও সুন্দরীকে হয়ত –
- ওখানে কি? তোমার জটার মধ্যে । কি একটা উঁকি পাড়ছে মনে হচ্ছে ?
মুহূর্তে যেন শিব দুর্গার যৌথ তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল । মহাদেব কিছুতেই জটায় হাত দিতে দেবে নাআর জটায় হাত না দিয়ে দুর্গাও ছাড়বে না ।
- আরে আরে করছ কি ? অনর্থ হয়ে যাবে যে । জগত ভেসে যাবে যে ।
- যায় যাক। বলে টেনে জটা খুললেন মহামায়া । পাকের পর পাক খুলতে লাগল জটার । আর স্রোতের পর স্রোত বয়ে যেতে লাগল গঙ্গার । ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভগীরথের শাঁখের আওয়াজ ।
না জটার ঘোরপ্যাঁচ আর আটকে রাখতে পারল না গঙ্গাকে । বেরিয়ে এসে মহামায়াকে প্রনাম করে বলল,মা কি বলে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না । ওঃ আমার কি গা চুলকচ্ছিল যেকি বলব মা । জটাটা একটু সাবান সোডা দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে পার না মা ?
আবার প্রনাম করল ভগীরথও । বলল, মা সগর রাজার ষাট হাজার ছেলেকে বাচাতে হবে মা । মা গঙ্গাকে চাই । আপনি মুক্ত করে দিয়ে কি ভাল যে করলেন ।
মহামায়া যে কি করবেন তা বুঝতে পারছেন না । সত্যি তো ঝগড়ার ফল তবে মাঝে মাঝে ভালও হতে পারে ? শিব এবার ধ্যানে বসলেন । সত্যিকার ধ্যানে ।
সবজান্তা বিষ্ণু ওদিকে হাসছেন । নারদ বলতে যাচ্ছিল, নারদ নারদ ! মুখে আসার আগেই পালটেনিয়ে বলল, নারায়ন নারায়ন !
[ প্রথম ভাগ ]
কেসবুক (কৈলাস সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইট ) KSBOOK(KAILASH SOCIALI NETWORKING SITE)
- অরুণ চট্টোপাধ্যায়
মর্তে প্রতি বছর একবার করে আসতে আসতে মর্তের একেবারে প্রেমে পড়ে গেছেন মা মহামায়া । অনেক দিন ধরে লক্ষ করে দেখেছেন মর্তবাসীরা আজকাল খুব কম ঘুমোচ্ছে কিম্বা অনেক বেলায় উঠছে ।
কৌতূহল হল । কিন্তু কি করা যায় । মর্তবাসীরা কখন ঘুমোবে বা কখন জাগবে এ তো তাদের মৌলিক অধিকার । তিনি তো তাদের এই fundamental right ছিনিয়ে নিতে পারেন না ।
কিন্তু প্রশ্ন হল তার ধ্যান ছেড়ে দিয়ে মানুষ এখন কার ধ্যান করছে ? কৈলাসে ফিরে বাবা মহাদেবকে প্রশ্নটা করতেই তিনি একবার নিজের সিদ্ধির গেলাসটার দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে drug addiction.
বলেই আবার ধ্যান মগ্ন হলেন ।
মহামায়ার মনে তো কৌতূহলটা জারিই রয়ে গেল । তাই এবার আর কাউকে জিজ্ঞেস করা নয় । রাতের আঁধারে বেরোলেন সারপ্রাইস ভিজিটে । ভাবলেন প্রথম যে জানলায় আলো জ্বলবে তাকেই তিনি টারগেট করবেন ।
কিন্তু হায় । না না সব ঘরে হয় আলো নেভানো, নয় নাইট ল্যাম্প জ্বলছে । ভাবলেন তাহলে তাঁর অনুমান মিথ্যে । ফিরে গিয়ে ছেলে গনেশকে বললেন । গণেশ নিজে সিদ্ধি খান না । সিদ্ধি দ্যান অন্যকে । শুঁড় নেড়ে বললেন, না মা । তুমি জান না । ওরা সব জেগে আছে । ঘরে ঢুকে দেখ । তাহলেই বুঝতে পারবে ।
সেই মত পরের দিন চুপি চুপি আবার গেলেন । প্রথমেই পড়ে গেল একজন তরুণের ঘর । বিছানায় বসে নিজের lap এর top -এ laptop নিয়ে কি যেন নিয়ে মেতে আছে । মা স্বয়ং নিজের চেহারায় আবির্ভূত হলেন । হুঁশ নেই ছেলেটার । সে তখন এক তরুণীর ছবিতে আত্মস্থ । তারপর দেখলেন সে কি লিখল । একটু পরে আর একটা লেখা আবার নিজে থেকেই হয়ে গেল । আবার তরুণ উত্তর লিখল।
মা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে জানলেন এরা প্রেম করছে । এবং আরও জানলেন এরা কেউ কাউকে জানে না, চেনে না । এমন কি এরা যে সত্যি সত্যি এরা তাও এরা জানে না । এই না জানাটাই এদের মস্ত এক আনন্দ আর সাহস দিয়েছে । এরা ডেস্পারেট । পরস্পরের প্রতি এরা যে যা পারছে করে যাচ্ছে । যোগবলে মহামায়া জানলেন, এই খুপরিটার নাম হল মেসেজ বক্স । এর মধ্যে যে যাই কর মহামায়া তো দূরে থাক শিবের বাবাও টের পাবে না। আর শিবের বউ হয়ে তিনিই বা কি করে টের পান ?
মহামায়ার কৌতূহল হল । এরা কি করছে দেখি তো । যোগবলকে লাগালেন কাজে । চট করে ওপাশের মেয়েটা হয়ে গিয়ে বললেন, কি হচ্ছে বাচ্চু । অনেক রাত হয়েছে এবার শুতে যাও ।
এপাশ থেকে ছেলেটা লিখল, আর একটু ডার্লিং । সবে তো তোমার লিপের দিকে এগিয়েছি । লিপস্টিকটা তো ঘসে তুলি নি এখনও । এর পর আরও কত কি –
ছ্যা ছ্যা । তারপর ভাবলেন, এরা সব অল্প বয়েসই ছেলে মেয়ে তো হতেই পারে । টিন –এজার । টিন দিয়ে তো এদের ঘিরে রাখা যাবে না । গেলেন এক বিবাহিতর ঘরে । ওরে বাবা এ তো আরও সাংঘাতিক । ওই টিন – এজাররা তো জানে অল্প । কিন্তু এরা বেশি জানে আর তাই –
নির্ঘুম লোক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে গেল । দেশ থেকে চললেন দেশে । দেখলেন সারা পৃথিবী কেউ এখন আর ঘুমিয়ে নেই । তখন শুরু হল তাঁর তত্ত তল্লাশ । জানলেন এরা সব মেতে আছে যাতে তার নাম নাকি ফেসবুক । এটা এখন খুব সহজ –লভ্য । কম্পিউটার ল্যাপটপ এসবেরও কিছু দরকার নেই । মুঠোফোন নামে একটা যন্ত্রে আঙুলের মৃদু স্পর্শেই মুঠোয় চলে আসবে সারা দুনিয়া । কর লো দুনিয়া মুঠঠি মে / ভর লো লাইফ ছুট্টি সে ।
[ চলবে ]
No comments:
Post a Comment