Sunday, November 18, 2012

মার ছোটবেলা কেটেছে বরাহনগরের আলমবাজারে। পুজোর মাস দুয়েক আগে কোনও একটা সপ্তাহান্তে বাবা আমাদের কলকাতায় নিয়ে যেতেন পুজোর বাজার করতে। সে ছিল আমাদের সব চাইতে বড় উত্তেজনার দিন

বিকেলের চায়ের জন্য ঢোকা হত অনাদি কেবিনে। সঙ্গে অবশ্যই অনাদির স্পেশাল মোগলাই পরোটা। এই একটা দিন বাবা বাইরের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমাদের লাগাম ছেড়ে দিতেন। আর তখন কলকাতা এত পরিচ্ছন্ন ছিল যে বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ভয় কম ছিল। এখন বাইরে খেতে গেলেই ভাবি ভাল জায়গায় যেতে হবে, এসি থাকতে হবে, ভাজাভুজি মোটেই নাহেলথ রুল মেনে খেতে হবে। খোলা জিনিস খাওয়া চলবে না ইত্যাদি।

এক বার বাবা আমাদের চাইনিজ রেস্তোরাঁ কারকো-য় নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন কলকাতায় চিনে খাবারের চল সবে হচ্ছে। http://www.anandabazar.com/e_kolkata/2012/october/amar_sohor5-2.pngচাংওয়া, জিমিস কিচেন, পিপিং আর কারকোএই কটি রেস্তোরাঁতেই সাবেকি চিনে খাবার মিলত। আর চাইনিজ খাবারে ইন্ডিয়ানত্বের ছোঁয়াও ছিল অল্প, তাই আমাদের বরং অসুবিধেই হত। কেবল গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন ছাড়া আর কোনও পদই ভাল লাগত না। বাবা বলতেন, চাইনিজ খাবারের অভ্যেস করতেসহজ পাচ্য, তেল মশলাও কম। আর সস্ ভিত্তিক রান্না, তাই মুখ বদলানোর পক্ষে আদর্শ। কিন্তু আমরা তিন জন সে কথা মানতাম না। শুধুই গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রনের দিকে হাত বাড়াতাম।

আমাদের স্কুল ছুটি পড়ে যেত পঞ্চমীর দিন। আর খুলত ভাইফোঁটার পর। পুজোর কদিন বইপত্র শিকেয় তোলা থাকত।

পুজোর প্রতি দিন সকালে বাবা নিয়ম করে চালাতেন গ্রামাফোন চেঞ্জার। আর একে একে সানাই, শরদ, সেতার, নতুন গানের এলপি রেকর্ডকলের গান বাজত। বছরের এই সময়টা নিয়ম করে বাবা সেই শব্দ যন্ত্রটির http://www.anandabazar.com/e_kolkata/2012/october/amar_sohor5-3.pngপরিচর্যা করতেন পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই। আজও সেই পুরনো আধুনিক গানগুলো রেডিওতে শুনলে মনটা যেন কেঁদে ওঠে। শিউলির গন্ধ, পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শিশির ভেজা শরত্কাল ছুট্টে এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ে। এক বার কেনা হয়েছিল হেমন্ত, মান্না, আরতি, প্রতিমা, শ্যামল, সন্ধ্যা, অনুপ ঘোষালের সাতটা ছোট ৪৫ আরপিএম-এর রেকর্ড, এইচএমভি থেকে বেরিয়েছিল। আর সবচেয়ে মজা হল দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সাতটা ছোট রেকর্ড এক সঙ্গে ওই চেঞ্জারে বসিয়ে সেট করে ঘুমিয়ে পড়লে নিজের থেকেই একটা একটা করে বাজতে থাকবে। খুব মজা হতনতুন গান যা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজছে তা আবার আমাদের বাড়িতেও বাজছে। অনুপ ঘোষালের বিয়ে করবই না’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব’, মান্না দের ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ”, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গহন রাতি ঘনায়’— এই গানগুলো আমাকে তখন ছুঁয়ে গিয়েছিল, তাই বোধ http://www.anandabazar.com/e_kolkata/2012/october/amar_sohor5-4.pngহয় আজও মনের কোটরে পড়ে রয়েছে। সে বার এই গানগুলোই কিন্তু বেরিয়েছিল পুজোর গান হিসেবে, সালটা বোধ হয় ১৯৭৩ কি ১৯৭৪ হবে, ঠিক মনে নেই। এখনকার ছোটরা দেখি পুজোর সময়েও কম্পিউটার গেম খেলছে নয়তো টিভি খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার্টুন দেখছে। তাদের ঠেলেঠুলে প্যান্ডেলে পাঠাতে হয় আরতি দেখতে আর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খেয়ে আসার জন্য।
সপ্তমীর দিন সকাল থেকেই সব প্যান্ডেলে পড়ে যেত নবপত্রিকার স্নান করানোর ধুম। আলমবাজার গঙ্গার ঘাট খুব কাছে বলে সকাল থেকেই শোনা যেত ঢাকের আওয়াজ। প্রত্যেক বার মা বলতেন নবপত্রিকার পুজো মানে আসলে মা দুর্গার পুজোই। অত বড় মৃন্ময়ী মূর্তি তো আর গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করানো যায় না, তাই নব পত্রিকা বা কলাবউকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ভাই কেবল বলত, ওটা তো গণেশের পাশে থাকে তাই গণেশের বৌ। মা দুর্গা কেমন করে গাছ হবে? মা তখন আবার ব্যাখ্যা করে দিতেন যে নরকমের উদ্ভিদ, যেমন, বেল, ডালিম, কচু, মান কচু, হরিদ্রা, অশোক, ধান, কদলী, আর জয়ন্তী গাছের চারাকে শ্বেত অপরাজিতা গাছ দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা বানানো হয়। শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার প্রতীক রূপে চার দিন ধরে মা পূজিত হন। সপ্তমীর দিন বিশেষ আমিষ পদ রান্না হতমাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সে দিন বিকেলে আড়িয়াদহে আর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর দেখতে যেতাম রিকশা ভাড়া করে। বিরাট বিরাট পুজো হয় ওই দুটি অঞ্চলে। মাঝে মাঝে হল্টদেওয়া হত মামারবাড়িতে আর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে। জল যোগ এবং বিয়োগ করে ঠাকুর দেখার পর্ব চলত। অষ্টমীর দিন ভোর থেকেই চলত অঞ্জলির প্রস্তুতি। একে একে স্নান সেরে সবচেয়ে ভাল আর দামি জামাটি পরে অঞ্জলি দিতে যেতাম। বিয়ের আগে পর্যন্ত এ ভাবেই কাটত ষষ্ঠী, সপ্তমী আর অষ্টমী।

বিয়ের পর প্রথম বছর কেটেছিল দক্ষিণ কলকাতার পুজো দেখে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের বাসে চেপে দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো। আধুনিক থিমের দুর্গাপুজোর চেয়ে অনেক মন কাড়ে এই পুজোগুলি। সে বার সপ্তমীর দিন ধর্মতলা থেকে বাসে চড়ে দেখেছিলাম বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো, জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির পুজো, শোভা বাজারের রাজবাড়ির পুজো, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত লাটুবাবু-ছাতুবাবুদের পুজো। ডাকের সাজের প্রতিমা, চণ্ডীমণ্ডপে সুদৃশ্য চালচিত্রে বিশাল আয়োজন, বাড়ির মহিলাদের সাবেকি গয়না ও বেনারসি শাড়ি পরে মায়ের পুজো গোছানোসব কিছুতেই ঐতিহ্যের ছাপ।


...আরও সুন্দরী হয়ে ওঠে শারদোত্সবে
ত্রিভুবনজিৎ মুখোপাধ্যায়
(কলকাতা)
জ থেকে বহু বছর আগের কথা। তখন কলকাতা বলতে টালা থেকে টালিগঞ্জ বোঝাত। আমরা তখন বেলঘরিয়াতে থাকতাম, ভাড়া ঘরে। ১৯৫৯ সালের কথা। তখন স্টিম ইঞ্জিন চলত। নতুন পুজোর জামা বলতে স্কুল ড্রেসতাই পেয়েই খুশি। ষষ্ঠীর দিন মা কপালে চন্দনের টিপ দিয়ে আশীর্বাদ করতেন, “দীর্ঘজীবী হও।সপ্তমী থেকে পাড়ার পুজো দেখে আর ভোগ খেয়ে প্রতিমা দর্শন। তার পর পায়ে হেঁটে বেলঘরিয়া, মোহিনী মিল, পুকপাড়া, নিমতার পুজো।
http://www.anandabazar.com/e_kolkata/2012/october/amar_sohor4-1.jpg
পরের দিন অর্থাত্ অষ্টমীর দিন, হাঁটতে হাঁটতে রথতলা-সিঁথি ঘুরে পায়ের ব্যথা নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম। মা হয়তো পুজোর খরচের জন্য ১ আনা দিতেন তাতে রাস্তায় হয় চানাচুর নয় ঝুরিভাজা। সঙ্গে একটা বেলুন। মাইকে শ্যামল মিত্রর গান, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা...সেই গানের কলির অর্থ বুঝতাম না, তাও গাইতাম। আবার কখনও মিন্টু দাশগুপ্তের প্যারডি, ‘আমি তো পকেট কাটিনি কেন মোরে দাও শুধু প্যাদানিলতা মঙ্গেশকরের না যেও না রজনী এখনও বাকি, বলে রাত জাগা পাখিসলিল চৌধুরীর সাড়া জাগানো গান। কি বাচ্চা কি বুড়োসকলের মুখে ওই এক গান। গান শুনলেই মন ভরে যেত।

দুর্গা প্রতিমা দর্শনকুমোরটুলির ঠাকুর, বাগবাজার সর্বজনীনের পুজো, শোভাবাজারের ঠাকুর,আহিরিটোলা, পরে ফিরে দেশবন্ধু পার্ক, শ্যামবাজারের পুজো।

নবমীর পুজোর সময় ঢাকের বাদ্যির তালে ধুনুচি নাচ। কোথাও কোথাও পাঁঠা বলি হত তখনও। নবমীর দিন পাড়ার পুজো বেশি উপভোগ্য ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে হুটোপাটি, নাগরদোলনা চড়া, ফুচকা খাওয়াখুব হইচই। আর দশমীতে দেবীর বিদায়ের পালা। বিজয়ার প্রণাম সারতে সারতে পুজোও শেষ। অপেক্ষা আবার আরও একটা বছরের।

ছোটবেলার স্কুল ছুটি, কৈশোরের রাতজাগা, যৌবনের সদ্য ভালবাসা... দুর্গাপুজোর সঙ্গে যেন সেই সব দিনগুলি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।
অনেক দিন পেরিয়ে গেলেও তার স্মৃতি এখনও ঠোঁটের কোণায় এঁকে দেয় হাল্কা হাসি। পুজোর শহর, সেই কলকাতা নিয়ে আপনাদেরই কলমে...
http://www.anandabazar.com/e_kolkata/images/amar-shohor-logo.gif
http://www.anandabazar.com/e_kolkata/2012/october/notice-durga-logo.gif


লেখক পরিচিতি
সরকারি চাকরি থেকে প্রায় দেড় বছর হল অবসর নিয়েছেন। বদলির চাকরির ফলে পুরো ওড়িশাই ছিল পায়ের তলায়। ঘোরাঘুরির বহর এমনই যে তাঁকে ভবঘুরেও বলা যেতে পারে। কালাহান্ডিকোরাপুটমালকানগিরিজাজপুরপুরী— শেষে বারো বছর ভুবনেশ্বরে কাটানোর পর ওড়িশা-বাস শেষ হয়েছে। এখন স্বামী-স্ত্রীতে কলকাতায় ছেলের কাছেই থাকেন।

ফেলে আসা ছেলেবেলার পুজোর সাক্ষী
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
(খড়্গপুর)
http://www.anandabazar.com/e_kolkata/2012/october/amar_sohor5-5.jpg
আর এক বার আমরা একটা গাড়ি নিয়ে বেলুড় মঠে কুমারী পুজো দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয়। তবে আজকাল ধর্মের নামে যে হুজুগের স্রোতে আপামর বাঙালি মেতে উঠেছে তা বেলুড় মঠের ভিড় দেখলেও বোঝা যায়।

পুজো এখন ফ্যাশানেবল হয়ে উঠেছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আলোর রোশনাইয়ের সঙ্গে অনুরণিত হয় এক দিকে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র আর ডিজিট্যাল এলসিডি স্ক্রিনে রংচঙে বিজ্ঞাপন। আর সেই সঙ্গে থরে থরে সাজানো ফাস্টফুডের গরমাগরম হাতছানি। এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন স্পনসর্ডপুজোকোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন।

লেখক পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রিতে এমএসসি। কলকাতার বাসিন্দা তবে অধ্যাপক স্বামীর কর্মসূত্রে বর্তমানে খড়্গপুরে বাস। এক ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। সাহিত্যচর্চায় ভীষণই ঝোঁক। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে, দেশ পত্রিকায়। এ ছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত একাধিকবার। গদ্যচর্চার পাশাপাশি কবিতার সঙ্গে নীরবে ওঠাবসা চলতেই থাকে। সঙ্গীতচর্চা, বেড়ানো এবং রান্নাঅবসর যাপনের আরও তিনটি ঠেক।

লেখক পরিচিতি
সরকারি চাকরি থেকে প্রায় দেড় বছর হল অবসর নিয়েছেন। বদলির চাকরির ফলে পুরো ওড়িশাই ছিল পায়ের তলায়। ঘোরাঘুরির বহর এমনই যে তাঁকে ভবঘুরেও বলা যেতে পারে। কালাহান্ডি, কোরাপুট, মালকানগিরি, জাজপুর, পুরীশেষে বারো বছর ভুবনেশ্বরে কাটানোর পর ওড়িশা-বাস শেষ হয়েছে। এখন স্বামী-স্ত্রীতে কলকাতায় ছেলের কাছেই থাকেন।

No comments:

Post a Comment