Tuesday, November 20, 2012

এই শহর

কালী কলকত্তেওয়ালি

অনির্বাণ চৌধুরী
কলকাতা, ১৩ নভেম্বর, ২০১২

kolkata's popular kali temples
সিদ্ধেশ্বরী চতুর্ভুজা; খড়্গ-মুণ্ড-অভয়-বরদ মুদ্রাধারিণী।ছবি- ফাইল চিত্র
বাঙালি কালীকে এত পছন্দ করে কেন? কালীর গায়ের রঙ মহাঘোর যামিনীর মতো; এদিকে কালো মেয়ে তো বাঙালি মরে গেলেও ঘরে আনতে চায় না! একমাথা এলোমেলো চুলে সে মেয়ে শ্মশানে-মশানে ঘোরে; এমন ধিঙ্গি স্বভাবও বাঙালি গেরস্তর দু’ চক্ষের বিষ। তার ওপর আবার মদ-মাংস-রক্ত না হলে যে দেবীর মন ওঠে না, যৌনাত্মক আরও কত কী ক্রিয়াকাণ্ড থাকে তন্ত্রবিহিত পূজায়- সে সবও তো শান্ত স্বভাবের বাঙালি বরাবর উচ্ছৃঙ্খলতা বলেই ধরে এসেছে। তাহলে? এত শহর থাকতে বেছে বেছে ভারতে কলকাতাই কেন একচেটিয়া কালী-উপাসনায় অন্য সব শহরের তুলনায় এক-পা এগিয়ে রইল?
কথায় আছে, কালী কলকত্তেওয়ালি! দেবী যেমন শিবের বুকে এক-পা এগিয়ে রাখেন, অনেকটা সেই আদর্শেই কলকাতাও বিখ্যাত হয়েছে কালীপূজার উত্তরাধিকারে। সূত্রটি এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। বঙ্গে তন্ত্রমতে শক্তিপূজা একসময় সাধারণ মানুষের মনে ত্রাসের সঞ্চার করত বটে, তন্ত্রাচারের নামে শাসকের যথেচ্ছ সুন্দরী অসহায় নারীভোগ বিরাগেরও কারণ ছিল- তবু কালী জনপ্রিয় হল। জনপ্রিয় করলেন দুই শক্তিসাধক- রামপ্রসাদ সেন আর কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।
বাঙালি আসলে বুদ্ধির কদর করে; কদর করে শিল্পসুষমার। আর এই দুই সাধককবি শক্ত করে ধরেছিলেন এই দুর্বলতার জায়গাটাকেই। দেশে যখন বিধর্মী শাসক হিন্দু ধর্মকর্ম লাটে তুলে দিতে বসেছে, তখনই শিকড়ে ফেরার টানে কালীকে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন তাঁরা। শোণিতলিপ্তা মহাশক্তিকে অবশ্য নয়! খড়্গধারিণী যে নারী ‘ঝলসিয়ে দিশি দিশি’ ঘুরে বেড়ায়, তাকে তো বাঙালির মনে ধরবে না। তাই দেবী সাধকের কল্পনায় কন্যা হলেন; বন্যা নয়- শান্ত হলেন। সেই রূপে শক্তি থাকলেও প্রখরতা নেই; মাধুর্য আছে। সেই রূপে সংহার নেই; সৃষ্টি আছে। আর আছে সুনিশ্চিত ত্রাণের আশ্বাস। আর কী চাই? তারপরেই শ্মশানবাসিনী মন্দিরে ঠাঁই পেলেন; বহুল পূজার হাত ধরে তৈরিও হতে থাকলো একের পর এক মন্দির। সেই মন্দিরের সংখ্যা স্বাভাবিক নিয়মেই বাঙালির প্রিয় শহর কলকাতায় বেশি থাকতে বাধ্য। সেই কারণেই কালী যেমন কলকত্তেওয়ালি; কলকাতাও তেমনই কালীক্ষেত্র।


কালীঘাটের কালীবাড়ি
কলকাতায় কালীমন্দিরের কমতি যে নেই- তা আর ফলাও করে না বললেও চলে! এ শহরের অলিতে-গলিতে দু’ পা করে গেলেই চোখে পড়বে ছোট-বড় নানান কৌলীন্যের কালীবাড়ি। অবশ্য সবার সমান খ্যাতি যে নেই- তাও বলাই বাহুল্য। এবার যদি কলকাতার পুরনো পেটেন্ট কালীবাড়ির তালিকা তৈরি করতে হয়, তাহলে সবার প্রথমে ঠাঁই দিতে হয় কাকে? ওই কালীঘাটের কালীকেই। বয়সের জন্য, খ্যাতির জন্য, এমনকি অপখ্যাতির জন্যও!
কেননা, কালীঘাট কলকাতার শক্তিপূজার ইতিহাসে শুধুই একটা মন্দির নয়! এখনকার মন্দিরটার বয়স হোক না মাত্র দুশো বচ্ছর; স্থানমাহাত্ম্যেই সে মাত করে দিয়েছে সব্বাইকে। এখানেই যে প্রস্তরীভূত হয়েছে সতীর ডান পায়ের কড়ে আঙুল- কালীঘাট তাই একান্নটি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম। এর খ্যাতির সবচেয়ে পুরনো নমুনা তাই মন্দির সংলগ্ন চত্বর থেকে উদ্ধার হওয়া গুপ্তরাজা প্রথম কুমারগুপ্তর মুদ্রা; অপেক্ষাকৃত নবীন কবি বিজয়গুপ্তর ‘মনসাভাসান’ আর মুকুন্দরামের ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’-তেও এর জয়জয়কার! এই মন্দিরসংলগ্ন গঙ্গার হাত ধরেই কলকাতার বাণিজ্য শুরু; একসময়ে বণিকদের প্রথম কলকাতায় পা ফেলার জায়গাও এই কালীঘাট।
ইতিহাস বলছে, এত মাহাত্ম্য থাকা সত্ত্বেও কালীঘাটে কিন্তু কোনও জাঁকালো মন্দির ছিল না। থাকবেই বা কী করে? গভীর বনের মধ্যে, খরস্রোতা নদীর পাড়ে মুখ লুকিয়ে ছিল সতীদেহর টুকরো আশ্রয়কারী কালীক্ষেত্র; পূজা দিতে হলে যেতে-আসতে হত বনপথে বাঘের মুখ বাঁচিয়ে। এসব উৎপাত আস্তে আস্তে লোকসমাগমে তফাত গেলে প্রথম মন্দির তৈরি করে দেন রাজা মানসিংহ; মতান্তরে রাজা বসন্তরায়- সেই ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে। তা, অত দিনের পুরনো স্থাপত্য- সে আবার থাকে নাকি? তাই ঝড়ে-জলে সেই মন্দিরের বেহাল দশা হলে আজকের মন্দিরটি তৈরি করে দেন কলকাতার সাবর্ণ-পরিবার। সেই মতো কাজ শেষ হলে জোড়বাংলা রীতির মন্দিরটি মুখ দেখায় ১৮০৯ সালে। এরও কিছু পরে ১৮৩৫ সাল নাগাদ তৈরি হয় নাটমন্দির; সৌজন্যে বিখ্যাত জমিদার কাশীনাথ রায়। পরে পরে যোগ হয় মন্দিরসংলগ্ন বিখ্যাত ষষ্ঠীতলা; ১৮৮০ সালে গোবিন্দদাস মণ্ডলের উদ্যোগে। এই ষষ্ঠীতলার সেবার অধিকার কেবল নারীদেরই- এমনটাও কলকাতার আর কোনও কালীবাড়িতে নেই। হাড়কাঠতলা, কাককুন্ড- মন্দির তৈরির শুরু থেকেই ছিল; এখনও স্বমহিমাতে যথাস্থানেই আছে।
তবে কালীঘাটের আসল খ্যাতি যে দেবীর জন্য, সে কিন্তু বঙ্গ-উপাস্যা শ্যামার মতো আদপেই নয়। কালীঘাটের কালীমূর্তি ভাস্কর্যের জন্যই আলাদা করে চোখ টেনে নেয়। বিরাট বড় টানা-টানা তিনটি চোখ, রক্তমাখা কপাল আর হাতকয়েক লৌল জিহ্বায় কালিকা বিরাজ করেন এই মন্দিরে। চতুর্ভুজা দেবীর এক হাতে অজ্ঞানতা-তমসা ছেদনকারী খড়্গ; অন্য হাতে অহংরূপী অসুরের ছিন্ন মুণ্ড- প্রবাদ মানলে অসুররাজ শুম্ভর মুণ্ড! বাকি দুই হাতে অভয়মুদ্রা ও বরদমুদ্রা। শক্তিপীঠের নিয়ম মেনে দেবীমন্দিরের অদূরেই নকুলেশ্বর শিবের আবাস। নকুলেশ্বর দর্শন না করলে প্রথামাফিক দেবীও প্রসন্ন হন না।

দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী
কালীঘাটের কালী অনেক দিনই একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়েছিলেন কলকাতার বুকে; খাঁড়া ঘুরিয়ে সে মন্দিরের কালী-সেবাইতরাও! প্রতিদ্বন্দ্বী এল ঠিক ১৮৫৫ সালে! শুরুটা অবশ্য হয়েছিল তারও বছর আটেক আগেই।
জানবাজারের দুঁদে রানি রাসমণি, যিনি কথায় কথায় ঘোল খাইয়ে রাখতেন ইংরেজ শাসককে, সেই তাঁর একদা মনে হল- দিনরাত একগলা ডুবে আছেন বিষয়-আশয়ে; ধর্মকর্ম তো কিছুই হচ্ছে না! হবেই বা কী করে- স্বামী তো তাঁর ঘাড়ে সব দেখভালের ভার চাপিয়ে মনের সুখে স্বর্গে বিরাজমান! সেসব নিয়েই ব্যতিব্যস্ত রানি আর তাঁর জামাই মথুরবাবু- তবে ঢের হয়েছে! এবার তীর্থে না গেলেই নয়। সেই মতো ১৮৪৫ সাল নাগাদ সেজে উঠল রানির বজরা; গঙ্গাপথে রানি চললেন কাশীদর্শনে। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের কাছাকাছি এক রাত্রে নদীর বুকে স্বপ্নাদেশ পেলেন তিনি। জগজ্জননী সাফ সাফ বাতলে দিলেন তাঁকে যে, কোথ্থাও যাওয়ার দরকার-টরকার নেই। এই দক্ষিণেশ্বরসংলগ্ন জমিনই কাশীতুল্য; এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেই রানির পুণ্যলাভ নিশ্চিত। ব্যস আর কী, রানির যাওয়া হল না। এবং জানবাজারের বাড়িতে পা দিয়েই তিনি কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন মন্দির প্রতিষ্ঠায়। জন হেস্টি নামে এক সাহেবের বাগানবাড়ি কিনে আর এক মুসলমান কবরখানাও কিনে সেই জমিতে শুরু হল মন্দিরবাড়ি তৈরি!
মুসলমান কবরখানায় হিন্দুর মন্দির? এও কি সম্ভব? সম্ভব হল, কেননা ওই জায়গাটুকুর আকৃতি ছিল কচ্ছপের পিঠের মতো; তন্ত্রমতে কালী-উপাসনার জন্য যা একেবারে আদর্শ। তাছাড়া এসব ভেদাভেদ মেনে মানুষই চলে; জগতের ঈশ্বরী এত কিছুর ধার ধারেন না। তাই দীর্ঘ আট বছরের শ্রমে, ৯০০, ০০০ টাকা ব্যয়ে তৈরি হল দক্ষিণমুখী, তেতলা নবরত্ন মন্দির। সঙ্গে আটচালা রীতিতে দ্বাদশ শিবের বারোটি আলাদা আলাদা মন্দিরও। আর তৈরি হল রাধাগোবিন্দ জীউর মন্দিরও। নবীন ভাস্করের হাতে তৈরি হল মায়াময়ী কৃষ্ণপাথরের প্রতিমাও।
আর সেই সঙ্গে ফ্যাসাদটি এল ঠিক সব উদ্যোগ শেষে মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়েই। চালকলাভোজী বামুনেরা টিকি নেড়ে, পৈতে ঘুরিয়ে বিধান দিল- এ মন্দির শুদ্ধ নয়। মুসলমানের জমি বলে? উঁহু! রানি যে ব্রাহ্মণ নন; তিনি অপেক্ষাকৃত নিচু কৈবর্ত শ্রেণীর নারী। তাই তিনি দেবীকে মন্দির উৎসর্গ করতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, কোনও সৎ ব্রাহ্মণকে মন্দিরটি লিখে দিলে তখন আর ফ্যাকড়া থাকবে না। সেই মতো খুঁজেপেতে রানি মন্দির লিখে দিলেন প্রধান পুরোহিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর নামে; তাঁর সঙ্গেই মন্দিরে এল ছোট ভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায়ও। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে সাড়ম্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠিতও হল; আর বাকিটুকু আজ ইতিহাস।
এহেন দক্ষিণেশ্বরে চতুর্ভুজা খড়্গ-মুণ্ড-অভয়-বরদ মুদ্রাশোভিতা দেবী পূজা পান ভবতারিণী নামে; মতান্তরে জগদীশ্বরী! রানির মন্দির বলেই বোধহয় এখানে দেবী সোনার সিংহাসন আলো করে থাকেন; পুরনো রূপোর সিংহাসনটিও ভক্তদর্শনের জন্য মুখ করে থাকে নাটমন্দির পার হয়ে গর্ভগৃহের দিকে। আর কলকাতার কালীর মধ্যে এই ভবতারিণীই সম্ভবত সবচেয়ে বিলাসিনীও। বেনারসী শাড়ি ছাড়া তিনি আর কিছুই পরেন না; সেই সঙ্গে সোনার গয়না তো আছেই।

ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী
রাসমণির কালীবাড়ি বাদ দিলে কলকাতার আরেকটি কালীবাড়িকেও কালীঘাটের জোর প্রতিদ্বন্দ্বী বলাই যায়। সেটা উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। বয়সের বিচারেও ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিনীর চেয়ে কিছু এগিয়ে। অতিভক্তির আতিশয্যে অনেকেই দাবি করে থাকেন যে, এ মন্দিরের জন্ম সেই ১৭০৩ সালে! তবে ধর্মস্থানে মিথ্যের ঠাঁই নেই। তাই মন্দিরই বুক বাজিয়ে তার জন্মের সঠিক সময়টি জানান দেয় ভক্তদের। আর এ কাজে সাক্ষী দেয় মন্দিরচত্বরের একটি পাষাণফলক; সেখানে স্পষ্ট খোদাই করে লেখা- মন্দির তৈরি হয়েছে ১১১০ বঙ্গাব্দে। এবার বঙ্গাব্দটিকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ফেলে দিলেই যে সালটা বেরোয়, সেটা আদপেই ১৭০৩ নয়; বরং ১৮০৩! ওই সালেই এই মন্দির তৈরি করেন শঙ্কর ঘোষ। যাই হোক, তাতেও মন্দিরের প্রাচীনত্ব আর খ্যাতি তো কমে না।
তবে ঠনঠনিয়ার কালী যে জনপ্রিয়তায় আগের দুই কালীবাড়ির চেয়ে পিছিয়ে, তার প্রধান কারণ হতে পারে কমতি জৌলুস। এ মন্দিরবাড়ি নেহাতই সাদামাটা। এমনকি দেবীমূর্তিও ধাতুর তো নয়ই; এমনকি পাথরেরও নয়। ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীর কায়া তৈরি হয় মাটি দিয়ে; ফি বছর যদিও নতুন করে তৈরি হয় সেই বিগ্রহ! দেবীর অঙ্গেও সোনার নয়; রূপোর গয়নাই বেশি করে চোখে পড়ে। আগের দুই কালীমূর্তির মতো সিদ্ধেশ্বরীও চতুর্ভুজা; খড়্গ-মুণ্ড-অভয়-বরদ মুদ্রাধারিণী। এত কিছু অনাড়ম্বরের মধ্যেও অবিশ্যি শনি-মঙ্গলবারে ভক্তদের ভিড় দেখলে চোখ কপালে তুলতে হয়!

রঘু ডাকাতের চিত্তেশ্বরী
উপরের এই তিনটে কালীবাড়ির ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখলেই একটা মিল বেবাক চোখে পড়ে- এই সবকটা মন্দিরই উচ্চবর্ণের হিন্দুর হাতে প্রতিষ্ঠিত। আর ঠিক এই জায়গা থেকে কলকাতার কালীবাড়ি ভাগ হয়ে যায় দুটো দলে- পয়লা, সমাজপোষ্য গেরস্থ কালীবাড়ি; আর দোসরা, কুখ্যাত কালীবাড়ি! দ্বিতীয় দলটায় কালীবাড়ির হোতারা পেশায় ডাকাত; নেশায় কালী-উপাসক। অবাক হওয়ার কিছুই নেই- কালী তো আদতে শক্তিদেবী। এখন গায়ের জোরে লুঠতরাজে যারা বেঁচে থাকার ভাতকাপড় জোটায়, তারা কালীপুজো করবে না তো কে করবে? তাছাড়া অনেকে যে বলে, কালী মূলে অন্ত্যজ; সেজন্যই কালো এবং রক্তলোভী- সেটাও এই ডাকাতদের কালীপুজোর রীতিকে সমর্থন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-তেও তো দস্যু রত্নাকর ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে নরবলির জন্য এক বালিকাকে ধরে এনেছিল!
‘বাল্মীকি প্রতিভা’ হোক না কবির কল্পনা; ডাকাতে কালীবাড়ি এবং সেখানে নরবলি কলকাতা স্বচক্ষে দেখেছে বহুবার। চিৎপুরের বুকে রঘু ডাকাতের কালীবাড়ি এর এক জলজ্যান্ত সাক্ষী! এই কালীকে রঘু নাকি খুঁজে পেয়েছিল এক পুকুরের তলা থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে। সেদিক থেকে দেখলে বয়সের বিচারে এই কালী সবার আগে থাকার হকদার হতেই পারে। বিপ্রদাস পিপলাই-এর ‘মনসামঙ্গল’-এও রঘু ডাকাতের কালীবাড়ির উল্লেখ আছে- ‘চিতপুরে পূজে রাজা সর্বমঙ্গলা’! এখন জনপ্রিয়তায় বড় হয়ে এগিয়ে থাকতে যে পারেনি, সেটা ওই ডাকাত-অধ্যুষিত পুজোর কারণে!
বলাই বাহুল্য, রঘুর হাতে দেবী পূজা পেতেন ‘সর্বমঙ্গলা’ নামে। নামে অভিনব হলেও মূর্তি প্রথানুগ- খড়্গ-মুণ্ডধারিণী ও অভয়া বরদা! ডাকাতের দেবী হলেও এবং তাঁর প্রসাদে বহু পরিবারের রঘু সর্বনাশ করলেও কালী কিন্তু সত্যই সর্বমঙ্গলা। রঘু লুঠপাট করত গরিবকে সুখে রাখার জন্য- নিজস্ব স্বার্থ তার প্রায় ছিল না বললেই হয়। সেই জন্যই তৎকালের পূর্ববঙ্গের রামশরণ সিমলাই নামে এক বণিক যখন বাণিজ্যপথে বজরা থামিয়ে এই দেবীর পুজো দেয়- তখন রঘু তার গায়ে আঁচড়টিও না কেটে তাকে ফিরে যেতে দিয়েছিল। সম্ভবত উচ্চবর্ণের স্বীকৃতিই রঘুকে দুর্বল করে ফেলে। ইংরেজদের হাতে ধরা দেওয়ার সময়ে হয়ত তাই মন্দির এবং সব দেবোত্তর সম্পত্তি রঘু লিখে দিয়ে যায় সিমলাইকেই।

মনোহরপুকুরের ছানা কালী
কালীক্ষেত্রে কালী-উপাসকের যেমন কমতি নেই; তেমনই কমতি নেই ডাকাতেরও। রঘু ডাকাত রীতিমতো ত্রাস হলেও সে তো ঘাঁটি গেড়েছিল কলকাতার উত্তরে। দক্ষিণটা কিন্তু তা বলে মুক্তাঞ্চল ছিল না- সেটা শাসন করত মনোহর ডাকাত। মনো ডাকাতেরও স্বাভাবিক নিয়মেই নিজস্ব কালী ছিল। মন্দিরে সগৌরবে বিরাজও করতেন দেবী। সে বাড়ি যেমন আজ প্রায় ধূলিসাৎ, তেমনই ভয়টয় উড়ে গিয়ে লোকমুখে ইদানিং দেবীর প্রসিদ্ধি ‘ছানা কালী’ নামে! ছানাভোজী দেবী বলে নয়- ডাকাতে কালী আবার নিরামিশাষী হয় নাকি? আদতে এই দেবীমূর্তি মাত্র হাতপ্রমাণ- সেই মাপের অনুষঙ্গেই এই আদর-নাম। আর এই মাপের জন্যই সামনাসামনি না গেলে দেবীদর্শনের উপায়ও নেই; প্রায় সময়ই দেবী আড়াল থাকেন পুষ্পভারে!

ফিরিঙ্গি কালী
তো, এসব কালীবাড়ি নিয়ে, ‘মায়ের পায়ে জবা হয়ে’ কলকাতা দিব্যি ছিল। বাঙালিরাও হইহই করে পুজো দিয়ে, বিপদ কাটুক বা না কাটুক- নিজেদের ধন্য মনে করত। এবার সাহেবরা সেদিকেও নজর দিল। মনোভাব যেন অনেকটা এরকম- বাঙালি একাই পুজো করতে জানে নাকি? আর সেটাই ঠিক উঠে-পড়ে প্রমাণ করে দিল এক ফিরিঙ্গি- অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি!
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি তো আদতে কবিয়াল, তাই শাক্ত পদাবলীর দিকে তার একটা ন্যাক ছিলই। তার ওপর আবার বিয়েও করেছিল এক বঙ্গললনাকে। সব মিলিয়ে দেবীপদে মোক্ষই তার কাম্য হয়ে ওঠে; যীশুর পুজোয় উৎসাহ তার ছিল না বললেই হয়। সেই অনুরাগের জায়গা থেকেই ধুমধাম করে দুর্গাপুজো করত ফিরিঙ্গি; নিজের টাকা দিয়ে তৈরি করেছিল এক কালীমন্দিরও। আজকের বউবাজারে সেই মন্দিরই ‘ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি’ নামে মুখে মুখে চাউর! এই মন্দিরও অবশ্য জনপ্রিয়তায় কিছু পিছিয়ে; কারণ ওই জৌলুসের অভাব। দেবীমূর্তিও প্রথামাফিক; তবে নির্মাণসৌকর্য চোখ টানে। আর প্রবাদকে সত্যি বলে মেনে নিলে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির এই কালী তন্ত্রমতে সিদ্ধিলাভের জন্য প্রসিদ্ধ ‘পঞ্চমুণ্ডি’-র আসনের উপর স্থিতা।
অবশ্য এই কালীবাড়ি কেন ‘ফিরিঙ্গি’ তকমার হকদার- তা নিয়ে মতান্তরও আছে। সেই মতান্তরের যুক্তি বলে, পুরনো কলকাতায় শ্রীমন্ত ডোম তৈরি করেছিল এই মন্দির। নামে ডোম হলেও সে আদতে ছিল কালী-উপাসক; পাশাপাশি খুচরো রোগ- বিশেষ করে জলবসন্তের প্রতিকারে সে ছিল অব্যর্থ! ডোম বলে উঁচু জাতের হিন্দু তার ওষুধ না খেলেও সাহেবসুবোদের এসব ছুঁৎমার্গ কোনও কালেই নেই; আত্মরক্ষাই তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। কাজে কাজেই অনেক গোরাই শ্রীমন্তর ওষুধ খেত এবং কৃতজ্ঞতাবশে ধুমধাম করে মন্দিরে পুজো দিতেও ভুলত না। শ্রীমন্ত তো মাতৃউপাসক; তার টাকার কীসের দরকার? কিন্তু মন্দিরটিকে তো রক্ষা করতে হবে; তাই সাহেবদের দানধ্যানে সে বিমুখ ছিল না।

বাদবাকি কালী
এই মূল মন্দিরগুলো বাদ দিলেও কালীক্ষেত্র কলকাতায় কালীবাড়ির কমতি নেই। সুতরাং, জায়গার অভাবে এবং প্রসিদ্ধির বিচারে লেখা অবশ্য শেষ হবে এখানেই। সে দিক থেকে কলকাতার পুরনো কালীবাড়ির ভিড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে আছে জোড়াসাঁকো কালীবাড়ি; তারই একটু উল্টো দিক করে রয়েছে পুঁটে কালীবাড়ি। এই পুঁটে কালীবাড়িও আবার শরিকি বিবাদে দু’টুকরো হয়ে বড় তরফ-ছোট তরফে ভেঙে গিয়েছে। বড় তরফ রয়ে গিয়েছে গণেশ টকিজ-জোড়াসাঁকো সংলগ্ন পুরনো চত্বরেই; অন্যদিকে গিরিশ পার্কের এক গলিতে ঠাঁই নিয়েছে ছোট তরফ। প্রতিমা অবশ্য দুই মন্দিরেই একইরকম- চতুর্ভুজা এবং খড়্গ-মুণ্ড-অভয়-বরদ শোভিতা। তফাতের মধ্যে ছোট তরফের মন্দিরে মাঝে থাকেন কালী; আর দুই পাশে ষোড়শী আর বগলা। যে কোনও অমাবস্যাতেই বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে পূজা এই মন্দিরে এখনও হামেহাল বর্তমান; এমনকি স্থান সঙ্কুলানের অভাব সত্ত্বেও বলিদানও!
এভাবেই কালী ক্রমশ পাকা জায়গা করে নিয়েছেন কলকাতার বুকে। দুর্গাপুজোর মতো জাঁকজমকে না হলেও এক সুদীর্ঘকাল ধরে শ্মশানবাসিনী কালীকে মন্দিরে মন্দিরে শান্ত রূপে বশে রাখতে চেয়েছে ভক্তরাও। শিরায় শিরায় রক্তধারার মতোই কালীও তাই বাস করেন বাঙালির মননে। অবশ্য শুধুই বাঙালি বললে সত্যের অপলাপ হয়। ট্যাংরাসংলগ্ন চিনে-পাড়াতেও তো কালী উপাসনা হয়; দেবী সেখানে ‘চিনে কালী’। ভোগও পান সে কারণে চিনে মতেই- নুডলস্ এবং চপস্যুই দিয়ে! মন্দিরে পাথর হয়ে থাকলেও ‘কৃষ্ণকলি’ বা ‘সমাপ্তি’-র মৃণ্ময়ী হয়ে, অথবা ‘দেবী’-র দয়াময়ী বধূমাতা হয়ে বারে বারে কালী তাই ফিরে আসেন বঙ্গজীবনে।



Sunday, November 18, 2012

সুবর্ন বসু।

সমস্যাটা শুরু হল গত শনিবার থেকে। কোথাও কিছু নেই, ঝকঝকে সকাল। বেলা সাড়ে বারোটা মতো হবে। এলআইসি-র প্রিমিয়াম জমা দিয়ে ফিরছিলাম। বেশি দূর নয়। বাড়ি থেকে মিনিট চার-পাঁচের হাঁটা পথ। একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। হঠাৎ খুব কাছে কেউ যেন খিলখিল করে হেসে উঠল। চমকে উঠলাম। মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম। চোখ তুলে দেখি আশপাশে কেউ নেই। শুধু ফুটপাথের বাইরের কিনারা ঘেঁষে যে ল্যাম্পপোস্টটা ছিল, তার গায়ে হাসি মিলিয়ে যাওয়ার রেশ স্পষ্ট। এইটুকু পড়েই যদি আমার মস্তিষ্কর সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে, আমি একটুও প্রতিবাদ করব না। পাতা উল্টে (বা স্ক্রল করে) অন্য কিছু পড়তে শুরু করার জন্য আপনি ওয়েলকাম। কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের হাসিটা নিয়ে আমার একটুও সন্দেহ নেই। হ্যাঁ মহামান্য পাঠক। ল্যাম্পপোস্টটাই হেসেছিল এবং তার সেই উচ্চকিত খিলখিল এখন আমার কানে লেগে আছে। সেই ছিল ঘটনার শুরু।

আমি কলেজ স্ট্রিটে একটা মাঝারি গোছের পাঠ্যবই প্রকাশনী সংস্থায় প্রুফ দেখি। দ্বিতীয়বার সেই খিলখিল শুনতে পেয়েছিলাম, আমি যেখানে কাজ করি, সেই ঘরটায়। দেওয়ালে ঝোলানো একটা ক্যালেন্ডার থেকে। ক্যালেন্ডারে একটা সিনারি ছিল। লন্ডনের বিগ বেন। দেওয়ালের পিছনে মালিকের ঘর। তিনি তখন অনুপস্থিত ছিলেন। হাসি শোনার পর আমি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিবশেই উঠে গিয়ে মালিকের ঘরটা দেখে এসেছিলাম। তালা বন্ধ। অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি তখন পুরী গিয়েছিলেন। মোট কথা, দ্বিতীয়বারের সেই খিলখিল হাসি শুনেছিলাম ক্যালেন্ডার থেকেই, কারণ ক্যালেন্ডারের দেওয়ালের পিছনে তখন কেউ ছিল না। এরপর ঘটনার ফ্রিকোয়েন্সি বাড়তে থাকে, পাঠকগণ। টেবিলের চাপা দেওয়া গেলাস, দেওয়াল ঘড়ি, রাস্তার ধারে কেতরে থাকা চালকবিহীন টানা রিকশা, ডাস্টবিন এবং এবং আরও অনেকে ... অনেকেনা বলে অনেক কিছুবলাই কি ঠিক হত। আসলে যারা এরকম স্পষ্ট উচ্চকিত শব্দে খিলখিল করে হাসতে পারে, তাদের জন্য অপ্রাণিবাচক অভিধা ব্যবহার করতে মন সায় দিচ্ছে না। অপছন্দ হলে, মহামান্য পাঠক, অধমকে ক্ষমা করবেন।
 যেদিন এই খিলখলে হাসিটাকে আমি নির্ভুলভাবে আইডেন্টিফাই করতে পারলাম, সেই দিনটা ছিল রবিবার। এক ফোটোগ্রাফি পাগল বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নিজের ভাবনাচিন্তার কথাই শেয়ার করছিলাম। আসলে ফোটোগ্রাফিটাকে আমার ঠিক ক্রিয়েটিভিটি বলতে ইচ্ছে করে না। যন্ত্রসর্বস্ব কোনও কাজই কি ক্রিয়েটিভ হতে পারে? ফোটোশপে কি মোনালিসা আঁকা যায়? যিনি লেখেন, যিনি আঁকেন, তাঁদের প্রয়োজনমাফিক একটু কাগজ, কলম, রং তুলি হলেই চলে। সামান্য আয়োজন। তা ব্যবহার করে তাঁরা লক্ষ-কোটি টাকার বা ক্ষেত্রবিশেষে অমূল্য সৃজনশীল কাজ করেন। কিন্তু যে কাজের উৎকর্ষের অন্যতম শর্তই হল দেড়-দুলাখি ক্যামেরা, তা কি ক্রিয়েটিভ হতে পারে? তা তো একটা যন্ত্রনির্ভর অনুশীলন এবং অভ্যেসের বহিঃপ্রকাশ, আর কিছুই না। এইটুকুই বলছিলামকিন্তু বন্ধু তা মানতে রাজি নয়। অনেকক্ষণ গা জোয়ারির শেষে আমাকে বলল, ‘না হয় বইপাড়ায় একটু যোগসাজস আছে, প্রকাশক, সম্পাদকদের ধরে-করে না হয় দু-চারখানা রদ্দি গল্পই ছাপিয়েছ, তা বলে কি তোমায় সব কিছুই জানতে হবে। যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো নাবইপাড়ায় যোগাযোগটা কাজের সূত্রেই আছে। যোগাযোগআর যোগসাজসএক কথা নয়। দুটোর তফাৎ বন্ধুকে বোঝানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কথা শেষ করেই বন্ধুটি রেগে-মেগে উঠে পাশের ঘরে চলে গেল। তার দারুণ দামি ক্যামেরাটা টেবিলের উপর আকার দিকে তাক করা ছিল। কাকতালীয়ভাবেই ছিল। বন্ধু চলে যেতেই ক্যামেরাটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। স্পষ্ট দেখলাম লেন্স ক্যাপ না-পরানো ক্যামেরাটার পাতলা মহার্ঘ্য লেন্সের ময়ূরকণ্ঠী রংয়ে হাসির রেশ! জনশূন্য ঘরে এত কাছে আচমকা ওরকমভাবে হাসির আওয়াজ হলে আমি চমকে চেয়ার থেকে পড়েও যেতে পারতাম। নেহাত গত মাসখানেকে ওরকম আচমকা হাসি শোনা আমার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তাই তেমন কিছু হল না। তবে এবার যেটা হল, সেটা অন্যরকম। আগে হয়নি। বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল, হাসিটা অনুষ্কার। মানে, আর একটু খুলে বললে দাঁড়ায়, অনুষ্কা ঠিক ওরকমভাবেই হাসত। হুবহু! অবিকল।

এতদিন ভাবনা হয়নি। এবার হল। শুধু ভাবনা নয়, ভয়ও। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আশ্চর্য ঘটনা দেখুন পাঠকগণ! এতদিন হাসি শুনছি, পাত্তা দিইনি। কিছু মনে হয়নি। যেই চিনতে পারলাম যে, হাসিটা অনুষ্কার, তখনই কেমন একটা ভয় এসে বাসা বাঁধল বুকে। এতদিন পর অনুষ্কার হাসি কেন শুনতে হবে এভাবে! প্রায় আট বছর আগের সেই দিনটা মনে পড়ে গেল স্পষ্টভাবে...

কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই প্রেমে পড়েছিলাম অনুষ্কার। ওরকম ভাল, সোজাসাপটা, হাসিখুশি মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। বছরখানেক চলেছিল প্রেমটা। কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি থেকেই আমার কাছে অনুষ্কা কেমন একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছিল। ভাল লাগতে শুরু করেছিল সোহিনী বলে অন্য আর একটা মেয়েকে। আসলে অনুষ্কা মেয়েটা বড্ড সাদাসিধে, সিম্পল। সোহিনীর মধ্যে একটা মাল্টি-লেয়ার, রহস্য-রহস্য টাইপ ব্যাপার আছে, ওর আউটফিটও বেশ আধুনিক, বেশ ইয়ে-ইয়ে আর কী। আসলে আমাদের কলেজ জীবনে সেক্সিশব্দটা আজকের মতো সহজ-উচ্চার্য ছিল না, তো তাই একটু দ্বিধা রয়ে গেছে শব্দটা নিয়ে। এখনও। সে যা-ই হোক, সোজা কথায়, সোহিনীকে দেখার পর থেকে আমার অনুষ্কাকে কেমন যেন ঘরেলু, পানসে আর বহেনজি টাইপ মনে হতে শুরু করল। খুব ধৈর্যের সঙ্গে সোহিনীকে খেলিয়ে ছিপে তুললাম এবং অনুভব করলাম অনুষ্কাকে আর ঝুলিয়ে রেখে লাভ নেই। একদিন অনুষ্কাকে ডেকে বলেছিলাম সব কথা। বলেছিলাম, ওকে নয়, সোহিনীকে ভালবাসি। বলেছিলাম, ব্রেক আপ চাই। আর মনে মনে তৈরি ছিলাম প্রচণ্ড সিনক্রিয়েট, চেঁচামেচি এবং কান্নাকাটির জন্য। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না পাঠকগণ, অনুষ্কার মতো মেয়ে, আমার বাধ্য, অনুগত, আমি-অন্ত-প্রাণ সেই প্রেমিকা সেইসব প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াগুলোর কোনওটাই দেখাল না। আমার চোখের দিকে চেয়ে একটুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর খিলখিল করে হেসে উঠেছিল, তারপর একটাও কথা না বলে ধীরে ধীরে চলে গেছিল আমার সামনে থেকে। সেই অপ্রত্যাশিত খিলখিল হাসিটা আমি কোনওদিন। অনুষ্কাকে যতদূর চিনেছিলাম, ওর গভীর কষ্ট পাওয়ার কথা ছিল। তবে সে-সব পেটি ব্যাপার খেয়াল করার মতো মানসিকতা তখন আমার ছিলনা ।

আজ আমার ফোটোগ্রাফি-পাগল বন্ধুর বাড়িতে ক্যামেরার হাসি শুনে আমার মনে পড়ে গেল অনুষ্কার কথা। শিরশিরে ভয় আর তীব্র একটা অস্বস্তি নিয়ে বন্ধুকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম আমি। মেয়েদের খুব সিরিয়াসলি নিইনি কখনও। সোহিনীর সঙ্গে মাসতিনেক ঘোরার পর, সোহিনী ওর বাড়ি থেকে দেখে-দেওয়া এক ঘ্যামা এনআরআই পাত্র আঁকড়ে আমাকে টা-টা করে দিয়েছিল। তখনও কিন্তু অনুষ্কার জন্য মন খারাপ হয়নি। মোটামুটি গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর নানা জায়গায় চেষ্টাচরিত্র করার পর এক বন্ধুর এই পাবলিশিং হাউসটায় কাজ পেয়েছি। সায়েন্স ছিল, তাই সায়েন্সের টিচারদের পাঠানো ম্যাটার কম্পোজ বা এডিট করার কাজটা ঠিকমতো সামলে নিতে পারি। তিনতলা পৈতৃক বাড়ি। আমরা তিনতলায় থাকি। বাড়ির একতলা ও দোতলায় দুঘর ভাড়াটে আছে। একরকম চলে যায়। বছরদুয়েক বিয়ে হয়েছে। ঘরোয়া স্ত্রী। আমাকে ভালই রেখেছে। সেদিকে অভিযোগ নেই। তবে পাঠকগণ, আপনাদের কাছে স্বীকার করতে বাধা নেই, এক দূর সম্পর্কের শালীর সঙ্গেও আমার সম্পর্ক আছে। বউ জানে না। প্ল্যান আছে, একটু টাকাপয়সা জমিয়ে নিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনব। শালীকে নিয়ে সেই ফ্ল্যাটে ওঠার ইচ্ছে আছে। বউ প্রবলেম করলে, আউট অব কোর্ট সেপারেশন ব্যবস্থা করতে হবে। শান্তিপূর্ণ ডিভোর্সের আইনকানুন এবং খোরপোষের নিয়মকানুন নিয়ে একটা চটি বই কিনেছি। অবসর সময়ে পড়ি। দিনকাল খারাপ। কখন কী ঝামেলা হয়, কে জানে। একটু পড়াশোনা করে রাখা ভাল। আমার সাদাসিধে ভালমানুষ স্ত্রী সন্দেহ পর্যন্ত করে না। আমি জানি। শিয়োর।

 কিন্তু সমস্যা বাড়ল সেই রবিবার দিন থেকে, ফোটোগ্রাফার-বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরনোর পর। সেই খিলখিলে হাসি ক্রমশই সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে। দুপুরে বইয়ের প্রুফ দেখতে দেখতে একটু মিঠে ঝিমুনি আমার অনেকদিনের অভ্যেস। সেটাও মাথায় উঠল। একটু চোখ লেগে এলেও কে যেন হেসে ওঠে। ঠিক কানের পাশে। চমকে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ি। কোনও কোন‍ওদিন মাথার যন্ত্রণা শুরু হয় তীব্রভাবে। যখন বাড়ি ফিরি তখন বেশ জ্বর-জ্বর লাগে, চোখ লাল হয়ে থাকে। একদিন স্ত্রীও জিজ্ঞেস করল, ‘কী গো। খুব কাজের চাপ যাচ্ছে বুঝি? শরীর ঠিক আছে তো’? জোর করে একটু হেসে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলাম। গত কয়েকদিন হল রাত্তিরেও শুরু হয়েছে এই কাণ্ড। যতবার ঘুম আসে, হাসির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। কখনও দূর থেকে, কখনও খুব কাছ থেকে। যেন ঘরের মধ্যেই হেসে উঠল কেউ। বেশ কয়েকদিন সহ্য করলাম। কানে বালিশ চেপে ধরে ঘুমনো শুরু করলাম। প্রথম প্রথম বালিশ সরে যেত, হাসির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত। তারপর একরকম অভ্যেস করে নিলাম। কিন্তু সেই অভ্যেসও আর স্থায়ী হল না। হাসিটা কেমন যেন আমার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমায় কি পাগল ভাবছেন, পাঠকগণ? বিশ্বাস করুন, এরকমই হল। একদিন আর থাকতে পারলাম না। ঘুমন্ত স্ত্রীকে ঠেলে তুললাম। উদ্ভ্রান্তর মতো বললাম, ‘শুনতে পাচ্ছ? একটা হাসির আওয়াজ? শুনতে পাচ্ছ’?

ঘুমচোখে ভারী অবাক হল আমার স্ত্রী। বলল, ‘হাসি! কই না তো। কে হাসছে? কোথায় হাসছে’?
 অধৈর্য হয়ে দুহাতে ধরে ওকে ঝাঁপিয়ে বললাম, ‘কালা হয়ে গেলে না কি? আমার কান ফেটে যাচ্ছে... ঘুমোতে পারছি না। আর তুমি বলছ কোথায় হাসি’! নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম, কী বলছি, কেন বলছি তার কিছুই আর মাথায় রইল না, উন্মাদের মতো বলে চললাম, ‘অপদার্থ কোথাকার। দাঁড়াও না। ডিভোর্স দিয়ে দূর দূর করে যেদিন তাড়িয়ে দেব, সেদিন বুঝবে কত ধানে কত চাল। ননসেন্স একটা। আমি ঘুমোতে পারছি না, আর উনি নাক ডাকাচ্ছেন। গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়াতে হয়...অনেক দিনের তীব্র মানসিক ক্লান্তি যেন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উঠে এল আমার মধ্য থেকে। কত কী যে বলে চললাম... নিজেরই খেয়াল রইল না।

তবে সেন্স ছিল। একটু হলেও ছিল। যা মুখে আসে বলে যেতে-যেতে লক্ষ্য করলাম, আমার স্ত্রী বেশ মন দিয়ে আমার বিষোদ্গার শুনছে এবং ক্রমশ ওর মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে। ওর চিরকালীন শান্ত, সরল, ঠাণ্ডা, তরঙ্গহীন অভিব্যক্তির জায়গায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে একটা চাপা কৌতুক। মজা পাচ্ছে নাকি ও। স্পর্ধাটা একবার বুঝে দেখুন পাঠকগণ। রাগে আমার পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যাচ্ছে, আর ও মজা পাচ্ছে।

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘হাসছ কেন? আমি শালা জোকার নাকি? মাঝরাত্তিরে ভাঁড়ামি করছি তোমার সঙ্গে’?

হাসির কথাই তো বলছিলে...আমার স্ত্রীর মুখে তখন হাসি চাপার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সে বলল, ‘কী একটা হাসি শুনতে পাচ্ছ বলছিলে, সে তো একটা হাসির কথাই বটে...বলেই আর হাসি চেপে রাখতে না পেরে খিলখিল করে হেসে উঠল ও। আর... সঙ্গে সঙ্গে... 
আমার হাড় হিম হয়ে গেল। মেরুদণ্ডে প্রবহমান স্পষ্ট এক হিমস্রোতে অনুভব করলাম আমি। 
পাঠকগণ! বললে বিশ্বাস করবেন না, একেবারে সেই হাসি। হুবহু। অবিকল। পিছোতে পিছোতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল আমার। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে মাটিতে বসে পড়লাম আমি। ও হেসেই চলেছে, মাথার ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার... সারা শরীরে জ্বলন্ত আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ওর হাসি... ক্রমশ দ্রুততর হচ্ছে আমার হৃৎস্পন্দন... বিশ্বচরাচরের সমস্ত শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে ওই হাসির আওয়াজে... শুনতে পাচ্ছেন না? পাঠকগণ, শুনতে পাচ্ছেন না আপনারা? সত্যিই শুনতে পাচ্ছেন না?

সুবর্ন বসু।