আমি ছিলাম ... আমি আছি .... আমি থাকবো
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
দিলুদা । আমার নিজের পিসতুতো
দাদা। দুর্গ রেলওয়ে ষ্টেশনের ইয়ার্ড মাষ্টার ছিলেন। সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব একা
ঘাড়ে নিয়ে কখন যে তাঁর বয়েস হয়ে-গিয়েছিল বুঝতেই পারেন নি । ছোট ভাই বোনেদের পড়ান তাদের বিয়ে দেওয়া সব
দিলুদা এবং ছটুদা র ওপর ন্যস্ত করে ছোট পিসেমোসাই পিসিমা পুজো আচ্ছায় মন নিবেশ
করতেন। সবকটি ছেলে মেয়ে প্রতিষ্ঠিত । দিলুদা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। কালি পুজোর ছুটিতে মাঝে মধ্যে
আমাদের বাড়িতে আসতেন। বড় মামী (আমার মা) বলতে অজ্ঞান। মা দিলুদা কে খুব আদর যত্ন
করতেন। সে সব দিনের কথা ওই স্মৃতিতেই থেকে গেল...... ।
ভুত চতুর্দশীর দিন দিলুদা আমাদের নানান ভুতের
গল্প বলে স্তম্ভিত করে দিতেন। আমার চেয়ে ১৫ -১৬ বছরের বড় দিলুদা। আমরা কুঁচ কাঁচা ভাই
বোনেরা ওনার মুখে ভুতের গল্প শুনতে
যেমন কৌতূহল ছিল ঠিক সেইরকম ভয় ও পেতাম। তখন কার দিনে না
ছিল টিভি না ছিল স্মার্ট ফোন। ওই বড়দের মুখে গল্প শোনাই ছোটদের একটা মস্ত আমোদ
প্রমোদের উপায়।
একবার পুরীতে আমাদের বাড়িতে
দিলুদা এসেছিলেন কোন কাজে । কথায় কথায় বলেন আরে ভুত বলে কিছু জিনিষ নেই। ওটা তোদের
মনের ভুল। চল আমাকে কেউ যদি ভুত দেখাতে পারিস আমি তোদের সকলকে একটা সিনেমা দেখাবো।
এই বলে আমাদের এক Doris Day -
Que Sera, Sera 1956 এর গান শোনালেন ... When I was a little girl I asked
my mother ........ গান শোনাতে আরম্ভ করলেন। দিলুদার ইংরেজি উচ্চারণ
খুব সুন্দর ছিল । আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আর ভাবতাম কি করে দিলুদা এত কাজের মধ্যে
এত সুন্দর গান করেন !
পুরীতে ১৯৬৪-৬৫ সালের কথা বলছি , ভুত-কুঠি বলে একটা বিরাট লাল রঙ্গের প্রাসাদ ছিল
পুরী চার্চের পাসের রাস্তা দিয়ে যেতে হত সেখানে। কেউ থাকতো-না
সেখানে। একটা উঁচু ঢিবির মতন বিরাট ভূখণ্ডের ওপর প্রাসাদ । ওখানে কেউ গেলে হয় পাগল
হয়ে ফিরত নয় হার্ট ফেল করে মারা যেত । দিলুদাকে সেই কথা বলাতে তৎক্ষণাৎ বললেন চল
আমি যাবো ওখানে দেখি ব্যাটা কোন ভূত আছে ওখানে ! মা ,
কাকিমা দুজনে শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে পড়েন । মা , দিলুদাকে বলেন তোর কি মাথা খারাপ
হয়েছে? কিছু হলে আমরা কি জবাব দেব তোর মা বাবাকে ! বাচ্চা
ছেলেদের কথায় ওমনি সাহস দেখাতে যাচ্ছিস । খবরদার ওখানে যাওয়া চলবেনা । কাকিমার ও
ওই এক কথা। মাকে দিলুদা সত্যি খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। মায়ের কথা অবাদ্ধ হতেন না।
মা পারলে দিলকে( দিলুদা কে মা ওই নামে ডাকতেন)র কান মূলে দিতেন।
বড় মামি .. তবে আমার একটা সর্ত আছে।
কি বল ?
আজ তবে পেট ভরে মাংস ভাত খাব ।
এই কথা তবে তাই হবে দাঁড়া আমি
সকলের জন্য মাংস আনাই। কথাটা শুনে মা
নিশ্চিন্ত । বাজারের থলে হাতে বড়দা গেল মাংস আনতে । দিলুদার জন্য আমরাও বেশ মাংস
ভাত খাবো । গরীবের ঘরে তখন ওটাই বিলাসিতা ছিল।
খাওয়া দাওয়ার পর সিগারেট টানতে
দিলুদা লক্ষ্মী টকিসের সামনে মণিয়ার পানের দোকানে
চলে জান। ওখানে ওই লালকুঠির কথা জিজ্ঞাসা করাতে লোকে বলে ওখানে কেউ যায়না ।
ওটা ভুত-কুঠি । ওর অনেক ইতিহাস আছে। এখানে বলে রাখি পুরীতে অনেক বাঙ্গালীদের বড় বড়
বাড়ি ছিল এখন ও আছে। ওই ভুত-কুঠি সেরকম ই কোন বাঙালী জমিদারের বিরাট অট্টালিকা হবে
। তবে পরিত্যক্ত অবস্থায় এবং অবহেলিত অবস্থায় ওই ভুত-কুঠি এক জন-
মানব শূন্য অট্টালিকা যার ইতিহাস কেউ জানেনা ।
দিলুদার মাথায় ভুত চেপে বসল ।
এক জেদ মা’কে না জানিয়ে ওই ভুত-কুঠিতেই যাবেন । যেমন কথা তেমন কাজ । মেজ কাকার পাঁচ সেলের
টর্চ নিয়ে চললেন বাবু । কাউকে কিছু বলা নেই কওয়া নেই । আমাদের ও বলেননি পাছে আমরা
মা’কে বলে দি। বোঝ ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে।
মণিয়ার দোকান থেকে এক বাচ্চা
ছেলে আমাদের বাড়ি এসে বলে ,
বাবু বাবু
সেই বাঙ্গালী বাবু তোমাদের বাড়িতে যে এসেছে সে ভুত-কুঠিতে যাচ্ছে।
মা রেগে লাল। কোথায় গেল দিলকে ?
সকলে মিলে ছুটলাম ওই লাল কুঠি র
দিকে।
ও হরি কে কার কথা শোনে ? কোথায় দিলুদা
?
শেষে থানায় গিয়ে খবর দেওয়া হল ।
দুজন কনস্টেবল আমাদের সঙ্গে এলেন থানা বাবুর কথায়। মেজ কাকা পুরীর রেভিন্যু
ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন তাই ওরা শুনে সাহায্যের হাত বাড়ায়।
কনস্টেবল দুজন ভয়ে ভয়ে হাতে
টর্চ নিয়ে যায় দিলু বাবুকে খুঁজতে । ওরা যা দেখেছিল তাই বলছি । দিলুদা অজ্ঞান হয়ে
ঘরে পড়েছিলেন। টর্চ টার কাঁচ ভেঙ্গে গিয়েছিল । বাবুকে চ্যাং দোলা করে আনাহয় । চোখে
মুখে জলের ঝাপটা দেওয়াতে জ্ঞান ফেরার পর বলেন , “আমি ছিলাম ..আমি আছি ..আমি থাকব” তোরা চিন্তা
করিস না । আমরা সকলে ভাবলাম দিলুদা বোধ হয়
পাগল হয়ে গেল। কিন্তু না । উনি সেরকম কিছুই হন নি । সুধু বলেন হ্যাঁ যায়গাটা খুব সাংঘাতিক না গেলে বুঝতাম
না। তবে ভুত আছে কিনা জানিনা । ঘরে ঢুকে গা ছম ছম করছিল। আমি সহজে ভয় পাওয়ার লোক
নই। কিন্তু সত্যি আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম একটা ছায়া র মতন কিছু দেখে । আসলে কি জানিস
যার অস্তিত্ব নেই তাকে যদি কেউ প্রাধান্য দেয় সেটা মানুষের মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে
থাকে সে ভুত প্রেত যাই হোক না কেন।
হনুমান চালিশা পড়লে ও সবের ভয়
থাকে না।
হয়ত তাই হবে।
No comments:
Post a Comment