Thursday, December 14, 2017

আকাঙ্ক্ষা ,পারোমিতা দুই বোন । দুজনের বয়েসের ব্যবধান মাত্র এক বছর। দুই বোনই এক ইংলিশ মিডিয়াম কোএড্ স্কুলে পড়ে । স্কুল
বাস আসে সকাল ৭.৩০ টার সময় । শীতে কুঁকড়ে দুজনে বিছানা থেকে ওঠে সকাল ৬.৩০ টার সময়। সটান বাথরুমে ঢুকে নিত্যকর্ম সেরে বেরুনোর
সময় ৭.০০ টা বেজে পাঁচ কি দশ মিনিট । তার পর খাওয়া সেরে বাসের জন্য অপেক্ষা । আরম্ভ হয় সারা দিনের জমে থাকা কিছু গল্প আর
বয় ফ্রেন্ডদের নিয়ে কিছু ছুঁক ছুঁকুনির কথা পারোমিতার । যাকে বলে চুলবুলি লেড়কি হিন্দিতে । উপায় নেই যুগের টানে এরকমটা হবেই । মানুষের কিছু জেনে-টিক আর একুয়ার্ড ক্যারেক্টার থাকে । কোন কোন সময় একুয়ার্ড ক্যারেক্টারটা বেশি মাত্রায় প্রকাশিত হয় । সেগুল ভাল হতে পারে আবার খারাপ ও হতে পারে । যদি খারাপের দিকে যায় তবে সর্বনাশ। সামাজিক দিক থেকে ভয়ঙ্কর ও হতে পারে। যা বাবা মা ভাই বোনের মাথা ব্যথার
কারন হয়। ধরাজাগ সেইরকম ই ক্যারেক্টারের মেয়ে পারোমিতা ।
আকাঙ্ক্ষা একটু আলাদা ও পড়াশুনোর গল্প বেশি করে বন্ধুদের সঙ্গে। কিছু প্রব্লেমের কথা যা হয়তো সল্ভ হচ্ছেনা বা অন্য কিছু । ও পড়াশুনোতে ভাল । ক্লাসে বরা বর ফার্স্ট হয় পারোমিতা ঠিক তার উল্টো। টিভি প্রোগ্রাম , সারুখ্ সলমন হৃত্তিক ইরফান  আর বাংলার দেব ছাড়া  ভাবতেই পারেনা ।ও বলে মাস ক্লাস বাঙ্ক করে সিনেমা যাওয়া র এক্সাইটমেন্ট ই আলাদা । । টিচারকে এফ বি তে জন্মদিনে গিফট পাঠানো । লিটিল হনি বলে বয় ফ্রেন্ড কে চুমু খাওয়া । এসবে থৃল আছে বল । কথা-গুল বলে দম নেয় ।ওর দিদি এসব শুনেও শোনেনা ।এরমধ্যে আকাঙ্ক্ষা সি বি এস সি র ১০ম শ্রেনিতে ৯৮.৮% নাম্বার রেখে পাস করেছে । কলেজে সাইন্স নিয়ে পড়ছে ।সেদিন আকাঙ্ক্ষা খবরের কাগজে খবরটা পড়ে  আতঙ্কিত হয় কারন ও
প্রত্যেক দিন বাসে কলেজ যায় ফেরে প্রায় রাত ৭ টার পর । খবরটা এইরকম ঃ-:-“সকাল দশটায় ওদের কলেজের কাছা কাছি এক এলাকায় চলন্ত বাসের ভিতরেই এক তরুণীর হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল জনা চারেক মদ্যপ যুবক ।উপায় না দেখে চলন্ত বাস থেকেই লাফ দিয়ে নেমে ছুটতে ছুটতে কলেজে পৌঁছলেন ওই তরুণী। জনা কয়েক সহপাঠীকে কোনও মতে ঘটনাটা জানিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারালেন তিনি।রক্তাক্ত অবস্থায় হাঁসপাতালে ভর্তি করা হয় কলেজের ছেলেদের প্রচেষ্টায় ।
এই শহরের বুকে দিনের বেলায় আরও এক বার এই ঘটনা , শহরের রাস্তায় মহিলাদের নিরাপত্তার অভাবটাকেই ফের বেআবরু করে দিল। দিল্লির
বাসে তরুণীকে গণ-ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল , সে প্রতিবাদে গলা মিলিয়েছে আমাদের শহরেও । কিন্তু তার পাশাপাশি এই শহরের বাস এবং রাস্তাই বা আলাদা কিসের , এ প্রশ্নটাও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে”। ঘটনাটা  অনেক দিন আগের কথা ।
কাকে বলবে ? বোন তো পাত্তা দেয়না। বলে তোর বয় ফ্রেন্ড থাকলে ওই তোকে প্রটেক্ট করবে । দিদি তুই ভারি আন-স্মার্ট আর ভীতু । মা’কে
বললে বলবেন আর পাঁচটা মেয়েদের মতন তুমি হতে চেষ্টা কর । এসব কথা মনের ভেতর রেখে গুমরচ্ছিল আকাঙ্ক্ষা । ও কি সত্যি আর পাঁচটা মেয়ের মতন নয় ? তবে ওর পড়াশুনো কি বৃথা ! মনের মধ্যে তোল্পাড করে সব প্রশ্ন । আয়নার সামনে নিজেকে দেখে । ভরা যৌবনে মেয়েদের যা
সৌন্দর্যের বিকাশ হওয়া উচিৎ  ওর ক্ষেত্রে তা ব্যাতিক্রম । অসব  কিছু্র ই  পরি-প্রকাশ পায়নি।খুব সাধা মাটা মেয়ে । সাজতে জানেনা বললেই চলে । এতো সাধারণ মেয়ে আজকাল খুব একটা চোখে পড়েনা।
পরোমিতা ঠিক উল্টো। প্রসাধনের সামগ্রী কেনার চেয়ে গিফট বেশি পায়। বয়ফ্রেন্ডের অভাব নেই । পারমিতা কে দেখতে সুন্দর এবং চোখ
ধাঁদানো চেহার । কস্মেটিক্স এর বাহারে ভুরু ভুরু গন্ধ । ছেলেদের মন ভোলানো চেহারা । এখন থেকেই ডেঁপো । পডাশুনোয় অষ্টরম্ভা ।কোনমতে পাস করে । টুকলি করতে ওস্তাদ্ বোধহয় । কিন্তু বুদ্ধি প্রখর । ছেলেদের মাথায় টুপি পরাতে ওস্তাদ ।
আগেই বলেছি আকাংক্ষা ক্লাসে ফার্স্ট হয় । রিপোর্ট কার্ডে সই করার সময় বাপি আকাংক্ষা কে খুব উৎসাহ দিয়ে বলেন ১২ ক্লাসে সাইন্সে র‍্যাঙ্ক
রাখতেই হবে । এখন থেকে আই. আই . টির এন্ট্রান্সের জন্য তৈরি হও। তোমাকে খড়গপুর আই আই টি তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবো । ভাল রেসাল্ট
করলে জি. আর . ই দিয়ে আমেরিকা পাঠাবো। বি .টেক্ এর পর হয় গেট্ দাও নয় ক্যাট্ দাও । যদি এগুলো না দাও তবে ভাল রেসাল্ট করলে জি.
আর . ই টা দেবে । এখন থেকে তৈরি হও আমেরিকা কিম্বা ব্রিটেন যাওয়ার জন্য ।
পারোমিতা ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে যায় । বাপী জানেন ওর রেসাল্টের ব্যাপার ।বাপী বলেন , মেয়েদের পড়াশুন যে কত প্রয়োজন তা এখন থেকে না বুঝলে পরে আর সময় থাকবেনা মা । পড়াশুনোতে মন দাও । মেয়েদের রূপ যৌবন গুন তিনটে দিয়ে বিচার করার সময় রূপ যৌবন দুটোই কিন্তু বয়স আধিক্যে ফুরিয়ে যায় মা;থাকে শুধু গুনটা । ওটাই শেষ জীবনের ভরসা । তোমার বন্ধুদের জিজ্ঞাসা কর ; ওরা কি ক্লাসে লাস্ট্ বেঞ্চে বসা মেয়েকে ভাল বলবে !বাপীর টাকা মধু দাদার ভাঁড় নয় যে অফুরন্ত থাকবে । চিরদিন তো আমি আর তোমার মা থাকবেন না । যাও মাকে দিয়ে সই করাও । ওঁচা মেয়েদের আমি পছন্দ করিনা । তোমার ত সব বায়না শুনি তবুও তোমার এতো অধঃপতন কেন? লজ্জা করেনা ? দিদিকে দেখে সেখ ।
বাপীর কথা শুনে ওর চোখে জল আসে । চোখে জল নিয়ে বলে পরের বার ভাল করব ।গড প্রমিস্ বাপি । এবারের মত সই করে দাও !
থাক আর গড্ কে টেনোনা ! তিনি তোমাকে অহোরাত্র দেখছেন। তাঁর ,তোমার মত উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়েকে দয়া করার সময় নেই। গড খুব ব্যাস্ত মা ।
তোমার প্রাইভেট ট্যুটার এর প্রয়োজন হলে রাখ । কিন্তু রেসাল্ট ভাল হওয়া চাই।
মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আঁচল ঠিক করতে করতে বলেন , “রাম রাম , প্রাইভেট টিউটর ? রক্ষে কর ! আরেক ফ্যাসাদ বাঁধাবে । ও যা পড়ছে পড়ুক । না পড়লে হেঁসেল ঠেলবে !” আমার সময় কোথায় ওকে দেখার ?”এটাত ঠিক কথা নয় । তুমি না দেখলে কে দেখবে ?”  বাপী বলেন।
কেন ওর দিদির কাছে বসে পড়তে পারেনা ?
দেখ সুমি (মায়ের নাম সুমিতা , বাপী ‘সুমি’ বলেই ডাকেন) তোমার মেয়েদের  প্রতি দায়িত্ব বোধ না থাকলে ওরা কি করবে ভবিষ্যতে? মা’র নজর
মেয়েদের দিকে বেশি থাকা উচিৎ । নাহলে পরে পস্তাবে । আমার ত ওদের দেখা সম্ভব নয় । কেন? আমার একার দায়িত্ব কেন? তোমার মেয়ে নয় ওরা ? তোমার কোন দায়িত্ব নেই !‘দায়িত্ব’ শব্দটা খুব জোরদিয়ে বিদ্রূপের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন সুমিতা দেবী ।
আহ্ ! আমি কি তাই বলছি ! বোঝ না কেন? আর সেরকম বুঝলে চাকরি ছেড়েদাও । তুমি ত সখের জন্য চাকরি কর ! ওটার কি কিছু প্রয়োজন আছে? যদি মেয়েরা মানুষ না হইয় তবে ওই চাকরি থাকার চেয়ে না থাকা ভাল !
কি ? আমি সেক্রিফাইস্ করবো আর উনি প্রাইভেট সেক্রেটারি কে নিয়ে টুরে যাবেন ; আজ মুম্বাই কাল দিল্লী পরশু সিঙ্গাপুর । অফিস ছাড়া বাড়ির হাল কি হচ্ছে বুঝেছ কখন ! বাহ ! সুন্দর !! চমৎকার সল্যুশন । পারবোনা চাকরি ছাড়তে !! ও মেয়ের এমনিতেই বারোটা বেজে গিয়েছে । আমি কি করব ?
দ্যাখো যা জাননা সে বিষয় নিয়ে কথা বোলনা। আমার চাকরিটা খাটুনির আর দায়িত্ব সম্পন্ন কাজ । তুমি ভাল করে জান সেটা । ওটা ঊল বোনার
চাকরি নয় যে মেয়েরা পাস করলো কি না করলো মাস গেলে জমা খাতায় মাইনে ঢুকে যাবে গুঁতো মেরে । চাকরি ? আর চাকরি দেখিওনা !! মেয়েদের সামনে স্বামির সঙ্গে কি করে কথা বলতে হয় সেটাই তো শিখলে না? যত্তো সব । বাবা গাড়ীর চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন গজ্ গজ্ করতে করতে ।
মা বাপির কথা কাটা কাটির মধ্যে পারোমিতা মা’কে দিয়ে টুক করে সই করিয়ে নেয় । মা অজান্তে সই করে দেন । কিছুটা নিশ্চিন্ত এবারের মতন।
এবার পড়াশুন টা করতে হবে মন দিয়ে। মোবাইলে কল আসে সুমিতের । সুইচ  অফ করে দেয় । না আর সুমিতের সঙ্গে যাবেনা সে । শেষে কিনা
হেঁসেল ঠেলতে হবে ! ম্যা গো !! মাথাটা টন টন করছে । দিদিকে দেখ ? খুব খুশী , আমাকে বাপী বকেছেন বলে । ভালো পড়ে বলে খুব অহংকার দিদির।
ঈশ্বর প্রেমিক প্রেমিকাকে একি ছাঁচে বানান না । কিছু তার তম্য থাকে ।আদর্শ শব্দটি অভিধান থেকে মুছে গিয়েছে আজকাল। সিটি সেন্টারে ওরকম অনেক যুগল ই ঘুরে বেড়ান । আমি একটা ঘটনার কথা বলি । সেদিন রাজার হাট্ দিয়ে ফিরছিলাম আমার কারে । তখন বাজে রাত ১১ টা । হঠাৎ আমাদের কারটাকে দুটো বাইক্ সম্ভবতঃ হিরো মোটর্সের লেটেস্ট মডেল নামটা বলতে পাচ্ছিনা , যাইহোগ বাইকে দুই প্রেমি জুগল যাচ্ছেন । পিলিওনে যে মেয়েটি ছিলো সে বোসে নয় ফুট রেস্টে দাঁড়িয়ে । বিদ্যুৎ গতিতে বাইক্ দুটি আমাদের ক্রস করে বেরিয়ে যায় । যদি এতোটুকু অসাবধান
হয় মৃত্যু সুনিস্চিৎ । এটা কি স্টান্ট্ না কি আমি বুঝলাম না । এদের মা বাবা এদের কি শিক্ষা দিয়েছে? অবিশ্যি মা বাবা কে দোস দিয়ে কাজ নেই
ওনারা কি জানেন? আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম ও বোলল , সাহাব  আপ নেয়া হ্যায় । এ তো হামেশা দেখনেকো মিল্তা হ্যায় । মনে মনে ভাব
লাম আমরা কতো গ্রাম্য, এরা কতো সভ্য । এই যদি সভ্যতা হয় তবে হে ঈশ্বর আমাকে গেঁয়ো করেই রাখো! সে দিন থেকে আমি আর কাউকে
কিছু জিজ্ঞাসা করিনা । কান মুলছি নাক মুলছি আর না ।নিজের মেয়েদের কথা ভাবছি ! পারোমিতার  কি হবে ? ওর কি ভবিষ্যৎ ? আমার সময় নেই
এনার্জি ও নেই । সুমি তার স্কুল আর বান্ধবীদের নিয়ে ব্যাস্ত । পার্টীর জন্য আজ ধারনা তো কাল বন্ধ ।ছারখার হয়ে গেল এই দেশটা এসবের জন্য ।
সর্ব শিক্ষা অভিজানের লেকচার দেয় সুমি আর নিজের মেয়ে গোল্লায় যাচ্ছে ।
কি মারে বাবা । কিছু বলার উপায় নেই আমার । মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে । দেখেও কিছু বলার উপায় নেই ।আমি নিরুপায়। কোম্পানির সার্ভিস ।
একটু এদিক ওদিক হলে সর্বনাশ । কাকে বোঝাব ? কথাটা উল্লেখ করলাম এইজন্য যে হামেশা নাকি এরকম হয় । আমরা ত দেখতে অভ্যস্ত নই তাই বোধ হয় আমার দৃষ্টিকটু লাগলো । মানুষ সহজ ভাবে নিচ্ছে। আমি বোধহয় গেঁয়ো হয়ে গেলাম বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে। আমার বন্ধুরা বলে তুই এইসব নিয়ে ভাবিস না। ও সব মডার্ন ছেলে মেয়ে। মনে মনে ভাবি আমার ত দুটো মেয়ে আছে ! তাদের মধ্যে ছোটটাই মাথা ব্যাথার কারন হচ্ছে । ওকে নিয়ে আমার চিন্তা ।
আমিত দেখছি আকাংক্ষার মতন মেয়েরাই বিপদে পড়ে  কারন ওরা নিজেদের নিরাপত্তার দিকে নজর দেয়না। পড়াশুনোতে এত ব্যস্ত থাকে
যে ওদের অন্য দিকে মন যায় না তার সুযোগ নেয় অসামাজিক ব্যাক্তি। তাই বলি জুডো ক্যারাটে টা মেয়েদের যানা নিতান্ত জরুরি । ওদের বন্ধু
হাতে গোনা হয় আর ছেলে বন্ধু থাকলেও তারা পাত্তা পায় না এদের কাছে। কিন্তু পারোমিতা ! তার বন্ধু শয়ে শয়ে । বাপী লেটেস্ট এপেলের আই ফোন্ সিঙ্গাপুর থেকে কিনে এনেছেন একটা মা আরেকটা পারোমিতার জন্যে ।বাপি কি জানেন মেয়ের কীর্তি ! মেয়েদের হাতে মোবাইল দেওয়া কি উচিৎ ?
বলেন রেসাল্ট ভাল হওয়া চাই কিন্তু । আইফোন দিতে আপত্তি নেই। আকাঙ্খ্যার ওসবে কোন আগ্রহ দেখি না।
‘কচু’ রেসাল্ট না ছাই । মা বলেন । ওই মেয়ে গোল্লায় গেছে ।
হয়াটস এপ এ  এ ছবি পাঠান , মেসেজ বক্স এ জোক , লাভ এস .এম .এস সব ভর্তি । কে দেখবে? দেখার সময় কার আছে ? বাপি সকাল থেকে
বেরিয়ে যান ফেরেন রাতে। মা স্কুল টিচার অন্যকে জ্ঞান বিতরণে ব্যস্তনিজের মেয়েকে দেখার সময় নেই ? সোসিয়াল সার্ভিস করে ক্লান্ত । নারী জাগরন , নারী শিক্ষা এইসব নিয়ে ব্যাস্ত ।
স্কুলথেকে এসে এতোই ক্লান্ত যে মেয়ে কি পড়লো কি খেলো দেখার সময় নেই । টিভি, সিনেমার ম্যাগাজিন,তারপর খাওয়া ,ঘুম । ঘরে রান্না বান্না করতে হয়্না কারন রাঁধুনী আছেন ।২৪ ঘণ্টার কাজের লোক আছেন। মঞ্জু মাসি ।
ঘরে গার্জেন বলতে ঠাকুমা তাঁর তো বয়েস ৭৯+ অতএব তিনি কি করবেন? ঠাকুরপুজো তেই তাঁর সময় কাটে । ছেলে,বৌ,নাত্নীদের জন্য সব পুজো । ওনার ঘরে কেউ যায়না । কখনো কখনো বাবা জান আর মঞ্জু মাসী খাবার দিতে যায় । পারোমিতা কে একদম দেখতে পারেন না ঠাকুমা । বলেন শুভ( শুভজিত বাবার নাম) গোল্লায় যাচ্ছে তোর মেয়ে । মেয়ের ডানা গজিয়েছে । এখন থেকে দ্যাখ নাহলে ওই মেয়ে ভোগাবে তোকে । আমি বলে রাখলাম শুভ ।
আমি কতোক্ষণ থাকি মা ? আপনি বলুন ? আমার সময় কোথায় ?তবুও তোর শাসন প্রয়োজন । ওকে মোবাইল কেন দিলি ? ওই অলক্ষুণে মোবাইল ই ওর উচ্ছৃঙ্খলতার  কারন । আমাকে ত হুটা হুট্ করে দেয় ।আপনি শাসন করুন মা । আমি কতক্ষণ ই বা থাকি ? একটু শান্তি না হলে আমার কি ভাল লাগে ? ওইসব শুনতে ভাল লাগে না। সমত্ত মেয়েদের মা শাসন করবেন না !  বাবা কি পারে? না মানায় ! আপনি বলুন! শুভ এক নিশ্বাসে কথাগুল বলে হাঁফ্ ছাডলো ।সব ই অদৃষ্ট বাবা । হ্যাঁরে মঙ্গল বার দিন একটু সময় করে দক্ষিণেশ্বর নিয়ে চল না বাবা। কতদিন মায়ের মুখটা দেখিনি। আহা মা সদয় হলে তোর কোন দুঃখ থাকবেনা।মঙ্গলবার ! আচ্ছা দেখছি ! টেবলেট পিসিটা তে কি দেখে বললো, মা একদম ভোরে আপনাকে নিয়ে যাব ।
আমিত সেই ভোর ৪ টেতে উঠি তুই উঠতে পারবিত ?
হ্যাঁ মা পারবো ।
আজ কিছু অঘটন হল রাস্তায় । কাউকে বলা যাবেনা। বাপীকে কিছুই বলা যায়না এ বিষয় । মা’ ! তিনি তো ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। ঠাকুমা ! তিনি ই বা কি করবেন? তবে কাকে বলবে সে ? বোন ! ও শুনলে হাঁসবে । মজা পাবে ।বাড়িতে ফিরে একটা ডাইরিতে আজকের ঘটনা সম্পর্কে লিখে রাখল।
বাপীর কথাগুল মনে রেখে খুব মন দিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি করতে লাগলো । ম্যাথ্, ফিজিক্স্, কেমিস্ট্রি সব বিষয় গুল ভাল করে রিভিশন দিয়ে রাখলো। গত দশ বছরের সমস্ত প্রশ্ন র উত্তর শেষ করে ফেলেছে। খাতা ভর্তি অঙ্ক আর ফিসিক্স্ এর প্রব্লেম সলভ্ করে রেখেছে ।ইংলিস্ টা আরেকটু রিভিসন করতে হবে । এইরকম ভাবছিল …।মা বললেন হ্যাঁরে পারু কোই ? ৭ টা বেজে গেল মেয়টা কোথায় যায়?তোর সঙ্গে আসেনি?এতোগুল প্রশ্নের উত্তর কি দেবে ভেবে পেলনা । আমি জানিনা …
জানিসনা মানে ?
বারে আমি স্কুল সেরে বাড়ি ফিরে এলাম । এমনিতেই আমাদের এক্সট্রা ক্লাস হচ্ছে । আমি কি করে জানবো ওর কথা ?তুমি তোমাকে ছাড়া  আর কি কর মা ! বাপের আহ্লাদি মেয়ে ! বোনটা কোথায় গেল খোঁজ নিবিনা একটু ! জানি তুমি দিগ্গজ্ মেয়ে , তা বলে বোনটার কোন খোঁজ খবর নেবে না?
সরি মা ভুল হয়ে গিয়েছে । আমাকে ভুল বুঝ না।সুমিতা মোবাইলে নম্বর ডায়াল করতে লাগলেন … এই অর্পিতা শোন ভাই তোর বর কে একটু বলনারে … আমার ছোট মেয়ে পারোমিতা যে তোর ছেলের বার্থ ডে পার্টি তে নেচেছিল মনে আছে … হ্যাঁ !… ও এখন পর্য্যন্ত
আসেনিরে । কি করি বল তো?… ইনি দিল্লী গেছেন ফিরবেন কালকে ।এলেই ত আমার ওপর হম্বি তম্বি করবেন। আমার হয়েছে যত জ্বালা…।
দাঁড়া চিন্তা করিসনা …। আমি একটু পরে তোকে খবর দিচ্ছি।রাত ৯ টার সময় পুলিসের জিপ্ এল । এটাকি সুভজিৎ ব্যানার্জীর বাড়ি  ?
ভয়ে তটস্থ সব্বাই । হ্যাঁ …। কি হয়েছে ?
দেখুন চিনতে পারেন কিনা ?
আমার বুক টা দুরু দুরু করতে লাগলো । মা গিয়ে যা দ্যাখেন । হতভম্ব হয়ে যান । পুলিসের জীপের পেছনে দুটি ছেলে মেয়ে । তার মধ্যে একটি চেনা
। সে আমাদের পরমযা

Wednesday, November 29, 2017

ইন্দ্রজাল ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী ২৯.১১.২০১৭



 
 ইন্দ্রজাল
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী


যখন এক অজানা চোখের সঙ্গে আরেকটি চোখের মিলন হলে বেড়ে যায় হৃদ স্পন্দন মন বলে, “হ্যাঁ এই সেই ছবি যাকে কল্পনায় বারে বারে আঁকি কিন্তু তবুও অস্পষ্ট থেকেযায় আবার পরক্ষণে তাকে সামনে দেখে মণ আকুল হয় তাকে পাওয়ার জন্যতবে কি সেটাই প্রেমের নিদর্শন নাকি  অবাস্তব এক কল্পনা মাত্র ! কিন্তু তাকেই যে আপনার করার জন্য মন হয় ব্যাকুল যে কিনা সহজে ধরা দেয় না ।  কিশোর মনের এক চঞ্চলতা আচ্ছন্ন করে তবুও ছোটে আলেয়ার পেছনে সেই কল্পনার প্রতিচ্ছবিকে ছুঁতে । সব অসাধ্য কে সাধ্য করার অদম্য ইচ্ছা ! কিন্তু সত্যি কি তাতে সে সফল হবে না হতে পারবে ? ................. এই গল্পটা সেইরকম এক নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের গল্প । 
 অয়ন কলেজের সামনে লাইব্রেরীর দিকে যেতে যেতে এক স্বপ্নের ইন্দ্রজালে বশীভূত হওয়ার মত নানা রঙিন স্বপ্নে বিভোর । স্বভাবতই দেবযানী র প্রতি এক অজানা আকর্ষণে লাইব্রেরীর দিকে নিজের অজান্তেই চলে এসেছে … 
হ্যাঁ দেবযানী নতুন এসেছে এই কলেজে ।  সাইন্স ব্লকে তাকে প্রথম দ্যাখাতেই অয়নের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে তার অপরূপ চোখ ধাঁধানো রূপে । ওর রূপের এক আকর্ষণ আছে যা অন্য মেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । লম্বা ছিপ ছিপে , টানা টান চোখ , মেদ হীন চেহারা অথচ লাবণ্যে ভরা। দেবযানীর সুন্দর মুখশ্রী সত্যি যে কোন পুরুষ কে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। অয়ন সত্যি এই প্রথম বার  কারু প্রেমে পড়লভেবে কূল কিনারা পায়না তার এই পরিবর্তনের জন্য  রবিঠাকুরের লেখা গান আপনা হতে গুন গুন করে গাইতে ইচ্ছে হবে দেবযানী কে দেখলে ঃ    একি  লাবণ্যে পূর্ণ  প্রাণ, প্রাণেশ হে, আনন্দবসন্তসমাগমে ॥ বিকশিত প্রীতি-কুসুম হে পুলকিত চিতকাননে ॥ জীবনলতা অবনতা তব চরণে। হরষগীত উচ্ছ্বসিত হে কিরণ-মগন গগনে।কবির সৃষ্টি বোধ হয় এইরকম ই কোন অপরূপার জন্য ।
অয়ন কলেজের ক্রিকেট টিমের  ক্যাপ্টেন।   
 অয়ন খেলা ধুলোয় ভালো বিশেষ করে ক্রিকেট তার স্বপ্ন ।  ইউনিভার্সিটি রিপ্রেজেন্ট করেছে এই বছরটপ স্কোরার হিসেবে তার নাম আছে এই কলেজে । তার লম্বাটে গড়ন এবং পুরুষালী ব্যক্তিত্ব অনেক মেয়ের হৃদয়ের স্পন্দন বাড়ায় । খেলার মাঠে ব্যাট হাতে নামলে অনেক ছেলে মেয়েকেই দেখা যায় করতালি দিতে এবং সঙ্গে আপ আপ অয়ন”  চিৎকার। অয়ন খেলার সময় বোলারের হাতের বলটা অর্জুনের লক্ষ ভেদের সেই মাছের চোখের মতদেখে পারফেক্ট টাইমে ব্যাট ঘোরায় । বল কানেক্ট হলেই হয় চৌকা নয় ছক্কা । হাত তালিতে গ্যালারি ফেটে পড়ে । অয়ন বিচলিত না হয়ে ফের পরের বল ফেস করে।
 কিন্তু দেবযানীকে দেখার পর থেকে ওকে বেশ অন্যমনস্ক  দেখায় । বন্ধুরা অয়নের পরিবর্তন  লক্ষ্য করে কিন্তু কিছুই বলেনা। সামনে ইন্টার কলেজ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি । এই কলেজের অয়ন ই  ভরসা । উইকেটে অয়ন টিকলেই রান গড় গড় করে বেড়ে চলে স্কোর বোর্ডে । অয়নের পার্টনার অমিতসেকেন্ড ডাউনে এলে ওদের জুড়ি বাজি মাত  করে। পনেরো দিন বাদ টুর্নামেন্ট । এই খেলা দেখতে খোদ মুখ্যমন্ত্রী আসবেন । কলেজের সুনাম বজায় রাখা অনেকটা অয়নের-অমিতের জুড়ীর ওপর নির্ভর করে । এই সময় ওকে অনেক  প্র্যাকটিস করতে হবে । কলেজের কোচ প্রত্যেক দিন নেট প্র্যাকটিস করাচ্ছেন । ফিজিক্যাল ফিটনেসের টিপস দিচ্ছেন আর ফিল্ডিং করাচ্ছেন। সব ছেলেদের মধ্যে আশা উদ্দীপনা এবারে তারা চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে কলেজে আসবেই।   কলেজের প্রিন্সিপাল ডঃ কমলেশ ভট্টাচার্য কলেজের সকল ক্রিকেটার দের এক টি পার্টিতে  আমন্ত্রণ করেন । ওই পার্টিতে দেবযানী , পুষ্প গুচ্ছ দিয়ে প্রত্যেক প্লেয়ার কে স্বাদর অভ্যর্থনা করে। অয়নের কাছে দেবযানী এলে দুজনে দুজনের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে। অয়নের , দেবযানী কে দেখে এক অজানা আকর্ষণে ওর চোখটা স্থির হয়ে যায় ওর মুখের দিকে  তাকিয়ে।
এটাই বোধহয় ওদের প্রথম শুভ দৃষ্টি”.... এটা অয়নের ভাবনা, দেবযানীর কিনা জানিনা!  
কলেজের লাইব্রেরীর দিকে নিজের অজান্তেই চলে এসেছে অয়ন। দেবযানী প্রত্যেক দিন আসে তাই ও চলে আসে এই সময় । লাইব্রেরী কার্ড টা এনেছ কিনা দেখেনিল অয়ন । হ্যাঁ সঙ্গে আছে তবে কোনদিন বই নেয়নি । কলেজ লাইব্রেরীতে ওকে দেখে কিছু ছেলে মেয়ে একে অপরের দিকে দ্যাখে কিন্তু নীরবতার জন্য মুখে কিছু প্রকাশ করে না। সকলের ই কৌতূহল অয়নের আগমের উদ্দেশ্য নিয়ে ।
অয়ন খুব স্থির পদক্ষেপে দেবযানীর দিকে এগোয় । ওর পাসে বসে বলে হায়কেমন আছ।
একটু ইতস্তত ভাবে দেবযানী অয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে তুমি ! এখানে!!
কেন আমায় কি আসতে নেই ! 
না তা নয় । তবে ..... !!
তবে কি ?
দেবযানী লক্ষ্য করল সকলের চোখ ওদের দিকে । খুব অপ্রস্তুত মনে হল নিজেকে।
অয়ন পরিস্থিতি বুঝে একটাই কথা বলে বাইরে লনে অপেক্ষা করছি । আশা করি না বলবে না।এই বলে উঠে পড়ে ।
খুব অপ্রস্তুতে পড়ে দেবযানী । সকলে কি ভাবছে কি জানি ! মনে মনে ভাবে সত্যি ই ছেলেটা হ্যান্ড-সাম কিন্তু তার মানে এই নয় সোজা লাইব্রেরীতে এসে আমার পাসে বসে পড়বে! এটা খুব খারাপ মনে হল । বন্ধুরা টিটকিরি না আরম্ভ করে ওকে নিয়ে। ওকে দ্যাখা করে করে বলবে ও  যেন আর এরকম না করে। কিছু বই আর নিজের নোট নিয়ে উঠে পড়ে । অয়নের কথাটা মনে  করে কলেজের লন এ এগুচ্ছিল হটাত অয়ন সামনে এসে একটা গোলাপ দিয়ে ওকে প্রপোজ করে বসে।

দেবযানী অয়নের এই ব্যাবহারে ক্ষুব্ধ হয় । গোলাপ টা ছুঁড়ে ফেলে বলে , “কি মনে কর নিজেকে ?” আমি এসব একদম পছন্দ করিনা। তুমি হয়ত ভাল ক্রিকেট খেল কিন্তু তার মানে এই নয় যে তোমার প্রেমে আমি পাগল হব।  আমাকে আর কখন বিরক্ত করবেনা। এই বলে দেবযানী গট গট করে সেখান থেকে চলে যায় অয়নের উত্তরের অপেক্ষা না করে। 
এইরকম অপ্রস্তুতে পড়তে হবে অয়ন কে ও ঘুণাক্ষরেও বোঝেনি । ওর নিজের কনফিডেন্স লেভেল টা অনেক বেশি তাই হটাত এই অপ্রত্যাশিত আচরণে চকিত হয়ে যায়।  কোন উত্তর দেওয়ার আগেই দেবযানী চলে যায়।  অয়ন ফ্যাল ফ্যাল করে দেবযানীর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এটা কি হচ্ছে তার ! সে না প্লেয়ার । প্লেয়ারদের শরীর চর্চা , জগিং , জিম এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা । নারী সংগ অবাঞ্ছনীয় ।  যদিও ভালো প্লেয়ারদের গার্ল ফ্রেন্ডের অভাব থাকে না। কিন্তু দেবযানী অন্য ধাতের মেয়ে। ওর প্রতি আকর্ষণ টা কেন যে হল ভেবে কুল কিনারা পায়না অয়ন। ওর ভাবনা তে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে অমিতের ডাকে।
কিরে কি ভাবছিস? চল ফিল্ডে যাই ।
নারে আজ বাড়ি যাব । এই বলে ওখান থেকে চলে যাচ্ছিল। 
কি হল গুরু ? কেস টা কি বলত ?
কিছু না ! কি আর হবে ?
কিছু ত আছে। আমি জানি সেই জন্যই এলাম ।
অয়ন অপ্রস্তুতে পড়ে .....  মানে ?
মানে আবার কি ! অয়ন - দেবযানীর প্রেমের উপাখ্যান এর শুভারম্ভ । চিন্তা করিস না । সব ঠিক হয়ে যাবে । আমার ওপর ছেড়ে দে । কিন্তু এখন চল গুরু প্র্যাকটিস করি । এটাই তোর আমার পরীক্ষা । এখানে কোন গোলমাল হলে প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ....!
অগত্যা অয়ন বাধ্য ছেলের মতন ফিল্ডে যায় নেট প্র্যাকটিস করতে । অমিত বোলিং করে । অফ স্পিন বল । কখন আউট সুইঙ্গার কখন ইন সুইঙ্গার । স্পিন ভালোই করতে পারে অমিত । প্রথম বলটাই অয়ন মিস করে । 
এ কি হচ্ছে ? মেয়েটা ত আচ্ছা মাথা খেল তার পার্টনারের । কাছে এসে বলে গুরু এ কি হচ্ছে? এ্যাঁ ।
না আমি আজ খেলতে পারবোনা ।
এদিকে আর মাত্র ১৫ দিন বাকি টুর্নামেন্টের । কি হবে ? মানসিক প্রস্তুতি না থাকলে খেলা সম্ভব নয় সে যত বড় প্লেয়ার ই হোক না কেন !
অয়ন আজ খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল । অমিত বেশ বুঝতে পাচ্ছিল সেটা । কিছু একটা বুদ্ধি বার করতে হবে .... পার্টনার বলে কথা ! ও এখন কলেজের ভবিষ্যৎ । ফিল্ডে ও না থাকলে রান রেট বাড়বে না জেতার ও চান্স কম । ও থাকলে খেলোয়াড়দের মনে জৌলুশ থাকে । সেটা অন্য কেউ দিতে পারবে না। না না .. এ রিস্ক কিছুতেই নিতে পারে না অমিত।  
 ভাবনাতে পূর্ণচ্ছেদ পড়লো , অয়নের ডাকে। আমি আজ যাচ্ছিরে । আমার শরীর ভালো নেই । মাথাটা যন্ত্রণা করছে । বাড়ি যাই । এই বলে অমিতকে বাই বলে চলে যায় ফিল্ড থেকে।
অমিত অন্য প্লেয়ারদের সাথে খেলা নিয়ে আলোচনা করে। আজকের ঘটনার সাক্ষী এক মাত্র অমিত।  কিন্তু এ বিষয় কাউকে কিছু বলে না।
৭ দিন পর:-
ক্রিকেটার অয়নের প্রেমের প্রস্তাব কে ছক্কা মেরে বাউন্ডারি পার করে দিয়েছিল দেবযানী। কিন্তু  নাছোড়বান্দা জিদ-খোর অয়ন হাল ছাড়ে নি । সেদিনের অপমান কে শার্ট থেকে ধুলো ঝাড়ার মতন ঝেড়ে ফেলে  বন্ধুদের দিয়ে সুপারিশ করিয়েও যখন কাজ হল না, নিজেই দেবযানীকে  দিল আবার বন্ধুত্বের প্রস্তাব ফ্রেন্ডশিপ ডে”  তে । দেবযানীর কাছে প্রেম ট্রেমের  চেয়ে ফ্রেন্ডশিপ টা  অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হল। কিন্তু সে কি জানত, বন্ধুত্বের ইন্দ্রজালে আটকা পড়বে অয়নের  বাকি জীবনের গল্পর সঙ্গে  ! হ্যাঁ কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবে অয়নের বন্ধুত্বের ডাকে সাড়া দেয় দেবযানী । নিছক বন্ধুত্বের খাতিরে কলজের ক্যাপ্টেন এর প্রিয়তমা না হোক বন্ধু হতে আপত্তি ছিলোনা তার। তাই খেলা দেখার ছলে বন্ধুর ক্রিকেট পারদর্শিতা কে অগ্রাহ্য করতে পারলনা
সেই থেকে সুরু ............. 
এখন অয়ন কে আর পায় কে ! হাতে চাঁদ পেয়ে অয়ন বেশ খুশি খুশি মেজাজে অমিত কে বলে আজ আমি পার্টি দেব । চল সবাই বন্ধুরা মিলে যাই ক্যানটিনে । স্মিতা , রোজি , দেবযানী , মৌসুমি , অনুষ্কা , প্রিয়াঙ্কা , অম্লান , প্রিতম , দেবজিৎ, অমিত, অয়ন । মোট এগারোজনের পার্টি । সকলেই ঠিক সময় এল দেবযানী একটু দেরিতে পৌঁছল । দেবযানী কে দেখে অয়নের ধড়ে প্রাণ এল । কিন্তু মুখে কিছু না বলে দেবযানীর  দিকে মেনু কার্ড টা এগিয়ে দিয়ে বলে আজ তোমার অনারে আমি এই পার্টি দিচ্ছি । তোমাকেই মেনু ঠিক করতে হবে ।
ও মা সেকি ! আমি এসবের কিছু বুঝি না ।
তবুও তুমি ..... অয়ন বলে ।
 আরে দিয়েই ফেল না কিন্তু কিন্তু করছিস কেন ? প্রিয়াঙ্কা র কথায় সকলে সায় দিয়ে বলে হ্যাঁ হ্যাঁ , অয়ন যখন এত করে বলছে ........
ঠিক আছে । মেনু কার্ড দেখে বলে
starter : chicken tangri kabab . Main menu :  Chicken Malai Kabab , Gobi Manchurian , Vegetable Biryani , rayta , butter nun  .  Dessert Mango pudding , strawberry kulfi   .
সকলে হাত তালি দিয়ে বলে বাবা তুই ত কামাল করেছিস ।
 “কে বলে তুই কিছু জানিস না ?”  প্রিয়াঙ্কা বলে । 
 দেবযানী ঃ   মানে ?
 প্রিয়াঙ্কা ঃ মানে তুই সুন্দর মেনু চয়েস করেছিস । আমরা সকলে এনজয়  করব । কি বল অয়ন ?
 হ্যাঁ নিশ্চয় নিশ্চয় বলে অয়ন দেবযানীর দিকে তাকায় .....
দেবযানী বোঝে ওকে এইসব বলে ওর মন পাওয়ার চেষ্টা চলেছে। অয়নের হুক সর্টে দেবযানী কুপোকাত হওয়ার মেয়ে নয় । দেখা জাগ কোথাকার জল কোথায় জায়তবে ওরা সংখ্যায় বেশি এবং অয়নের নিকট বন্ধু তাই চুপ থাকাই শ্রেয় ।
আজ খুব ফুর্তি সকলের মনে । কেন জানিনা আজ দেবযানী ও খোস মেজাজে আছে। সারাদিন পড়াশুনো করতে তারও ভালো লাগে না । মাঝে মাঝে একটু ব্যতিক্রম হলে ক্ষতি কি ? এই বলে নিজেকে বোঝায় ।
দেবযানী: বেশ কাটল দিনটা । লাঞ্চ এর জন্য অশেষ ধন্যবাদ । পাওনা রইল টুর্নামেন্ট জিতলে । 
অয়ন: তোমাকেও ধন্যবাদ তুমি আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে কষ্ট করে এসেছ । তোমার জন্য আরও বেশি সুন্দর কাটল আমাদের সকলের দিনটা । হ্যাঁ টুর্নামেন্ট আমাকে জিততেই হবে। এটা কলেজের তথা আমাদের সকলের সম্মানের ব্যাপার । বড়দের আশীর্বাদ আর তোমাদের শুভেচ্ছা  থাকলে আমরা নিশ্চয় ট্রফি আনবো । 
হ্যাঁ সেতো নিশ্চয় । তোমার প্র্যাকটিস টার গুরুত্ব বেশি । সেটা কি হচ্ছে ? ট্রফি তোমাকে আনতেই হবে । এটা কলেজের এবং আমাদের সকলের সম্মানের ব্যাপার । কথাটা খেয়াল রেখ কিন্তু।
তুমি প্রার্থনা কর ভগবানের কাছে ।
তা করব বই কি ! চলি । সকলের দিকে হাত নাড়িয়ে বাই বলে উঠে পড়ে দেবযানী ।
বা..ই..ইইই সকলে এক স্বরে বলে ।    
সকলে একে একে যে যার গন্তব্য স্থলে চলে যায়। অয়ন দেবযানীর কথাগুলো মনে করে , “তোমার প্র্যাকটিস টার গুরুত্ব বেশি । সেটা কি হচ্ছে ? ট্রফি তোমাকে আনতেই হবে। এটা কলেজের এবং আমাদের সকলের সম্মানের ব্যাপার । কথাটা খেয়াল রেখ কিন্তু।
অয়ন ভোরে উঠেই মাঠে দৌড়োয়। নিজের ফিজিক্যাল ফিটনেস টা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন । সকাল ৮ টা অবধি নানা exercise    
1.Bench press. ...
2.Squats. ...
3.Chin-ups, overhand grip. ...
4.Deadlift/stiff leg deadlift. ...
5.Lunge (static or walking) with torso twist ...
6.Rotator cuff .
7.Internal and external rotations.

তার পর নেট প্র্যাকটিস , ফিল্ডিং ইত্যাদি। বিকেল চারটের থেকে আবার খেলা। অয়ন এবং তাদের টিম সারা দিন ফিল্ডে কাটায়। কলেজের ছেলে মেয়েরা উৎসাহ দেয় সকলকে । পরিশ্রমের ফল কখন বৃথা যায় না ।
ফাইনাল টুর্ণামেন্ট ঃ
আজ ফাইনাল ইন্টার কলেজ টুর্নামেন্ট । ফাইনালে দুটি কলেজটিম এ তে অয়নদের কলেজ টিম বি তে বর্ধমান কলেজ ।
খেলাটা মূলত টিম এ vs টিম বি  ।
টস জিতে  টিম ‘এ’ , টিম ‘বি’ কে ব্যাটিং এ আমন্ত্রণ করে । দর্শক মহলে জোর হাত তালি ।
প্রথম বল টিম ‘এ’  র  প্রিতম করে , আউট সুইঙ্গার ছিল । ব্যাটস ম্যান কানেক্ট করতে পারে নি। উইকেট কিপারের হাতে । এপিল এল বি ডবলু র। প্রত্যাখ্যান করেন আম্পায়ার ।
পরের বল প্রিতমের হাতে । দুর্দান্ত পেস ছিল বলটায় । ব্যাটসম্যান ব্যাট ঘোরান ।  মিড অফে ফিল্ডার ছোটে । ততক্ষনে বল বাউন্ডারি পার হয়ে যায়। ৪ রান সংগ্রহ করেন ব্যাটসম্যান । স্কোর বোর্ডে 04 দেখায় ।  স্কোর ঘুরতে ঘুরতে দু অঙ্কয় পৌঁছোয় বিনা উইকেটে ১২ রান । এর মধ্যে চার ওভার শেষ । প্রিতম ২-০-৮-০ , দেবজিৎ স্পিনার হিসেবে ভালো । মিডিয়াম পেস বোলার ২-১-৪-০ ।  এরপর অম্লান আসে বল হাতেমিডিয়াম পেস বোলার কিন্তু মাঝে মাঝে ইয়োর্কার দেয় । বল কোন দিকে টার্ন নেবে ব্যাটসম্যান বুঝে উঠতে পারেনা । অয়ন , অম্লানের কানে কিছু বলে। অম্লান ফিল্ডিং সাজায় । সিলি পএন্ট(১) , সর্ট লেগ(১) , সিলি মিড অফ(১) ,  মিড অফ(১) ,  মিড অন(১) , স্লিপে দুজন (২)  , উইকেট কিপার নিজে অয়ন ©  , ডিপ স্কয়ার লেগ (1)  , ডিপ এক্সট্রা কভার (1)
অম্লানের বল সম্ভবত ইয়র্কর ছিল , ব্যাটিং ক্রিসে ব্যাটসম্যান পায়ের কাছে পিচ খায়।  ব্যাটসম্যান ব্যাট  ঘোরাতেই মিড উইকেট পড়ে যায়। দর্শক মহলে জোর কর তালি । আম্পায়ারের নিশানা তর্জনী ওপরে করে আউটের ইংগিত বিনা দ্বিধায়। প্রথম উইকেট টিম বির   ১২ রানে । স্কোর  ১২ রান এক উইকেটের বিনিময়ে । দর্শক মহল উল্লাসে ফেটে পড়ে। অম্লানের প্রথম বলেই চরম সফলতা । পরের বল ফুল টস । ব্যাটসম্যান এর  লং অন এ ড্রাইভ করতে চেষ্টা কিন্তু বৃথা চেষ্টাতেই পরিণত । আবার উইকেট পড়ে যায় । টিম বির   প্লেয়ারদের  ওপর খুব  প্রেশার । বোঝাই যাচ্ছে। দর্শক মহল থেকে জোর কর তালি অম্লান হ্যাট ট্রিক , অম্লান হ্যাট ট্রিক !  উই ওয়ান্ট হ্যাট ট্রিক।টিম বির ১২ রান দু উইকেটের বিনিময়ে । থার্ড বল আবার   ইয়র্কর । সেকেণ্ড ডাউনে ওদের ক্যাপ্টেন চরম বিপর্জয়ের মুখে ১ রান করেন । স্কোর ১৩/২ ।
  দেবযানী বন্ধুদের সঙ্গে তাদের কলেজের টিম র খেলা দেখছিল । সকলের সঙ্গে ও খেলা দেখছিল । সম্ভবত উপভোগ ও করছিল । কিছুক্ষণের মধ্যে ২০ ওভার শেষ হয় । ২০ ওভারের শেষে টিম বির স্কোর দাঁড়ায় ৯৮ অল আউট । কিছুক্ষণ টাইম ব্রেক মানে লাঞ্চ । সব  খেলোয়াড় রা প্যাভিলিয়নে ফিরে যায় । তাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা ডাইনিং হলে করা হয়ে ছিল। হোষ্ট হিসেবে টিম কলেজ সব আয়োজন করে।
লাঞ্চের পর অয়ন কে ব্যাট হাতে ফিল্ডে যেতে দেখে দেবযানীর কৌতূহল বেড়ে যায়। এই তার প্রথম কোন খেলোয়াড়ের স্বচক্ষে ক্রিকেট খেলা দেখার সুযোগ । এবারে অয়ন আর অমিত ওপনার হিসেবে যায় । দুজনেই তুখোড় ব্যাটসম্যান । অনেক প্র্যাকটিস করেছে । ক্রিকেট ওদের জান । সকলে কপালে করজোড়ে ঠাকুর কে প্রণাম করতে দ্যাখা গেল। দেবযানীর কৌতূহল অয়ন কে নিয়ে । ও মনে মনে ঠাকুর কে ডাকল প্রকাশ্যে নয়।
সচরাচর যা ফিল্ডিং সাজান হয় তাই । ফারাক দুটোর যায়গায় তিনটে স্লিপ । একি টেস্ট খেলা নাকি ? দেখা-জাগ কি হয়। উৎকণ্ঠা ভরা দর্শক .... প্রথম বল ... অয়ন ফেস করছে । সঠিক টাইমিং এ অয়ন ব্যাট ঘোরাতেই বল বাউন্ডারির বাইরে । প্রথমেই ৪ রান। পপিং ক্রিসে ব্যাটটা ঠুকে পরের বলের জন্য অপেক্ষা । সেকেন্ড বল বাউন্সার ছিল । অয়নের হেলমেটের ওপর দিয়ে চলে যায়। রানার অমিত আম্পায়ারকে কিছু বলতে দেখা যায়। আম্পায়ার বোলারকে হুঁশিয়ার দেন। ফার্স্ট ওভারেই বাউন্সার ! যাই হোক তৃতীয় বলে আবার ছক্কা । অয়নের স্ট্রোকটা পারফেক্ট টাইমিং এবং বেশ পাওয়ার-ফুল ছিল। বোলারের মনের বল এই রকম করে ভাঙ্গতে হয়। কলেজের কোচ এই ট্রেনিং দিয়েছিলেন। অয়নের স্ট্রোক গুলো কেতাবি চালে মারা । একেই বলে এক্সিবিশন  স্ট্রোক । এরপরের বলে সিঙ্গিলস ছিল। এবার অমিত ফেস করবে। দুই পার্টনার জমিয়ে দিয়েছে মাঠ । দর্শকের উত্তেজনার শেষ নেই । অমিত বল ফেস করে মিড অফের দিকে ব্যাট ঘোরায় । বল গড়িয়ে সোজা বাউণ্ডারি পার করে চার রান। প্রথম ওভারে ১৫ ফর নো লস। টিম বির দুটো  উইকেট পড়ে গিয়েছিল মানে ১৩/২ তার জবাবে টিম র ১৫ রান বিনা উইকেটে ।  
টিম ৩ উইকেটে ১০০ রান করে। অয়নের দ্রুত ৫০ টিম কে জেতানোর সাহায্য করে। অয়ন অপরাজিত ৫০ অমিত ৪০ করে আউট হয়ে যায় বাকি দশ রান অম্লান আর প্রিতমের যোগ করে। টিম ৭ উইকেটে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি যেতে।
সারা মাঠে কলেজের ছেলে মেয়েরা অয়ন, অমিত , অম্লান ও প্রিতম কে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানায় । খুশির ফোয়ারা বয়ে যায় Champagne এর বোতল খোলা মানা , তা নাহলে ছেলেরা সেটাও খুলে সেলিব্রেট করত ।
অয়ন কেবল একজনকেই মনে মনে খুঁজছিল সে আর কেউনা দেবযানী । কোথায় সে ? সে কি আসেনি ! তার প্রেরণা আজ সফল করেছে এই ট্রফি জিততে । সেকি যানে ?
ট্রফি নিয়ে পুরো টিম লাফালাফি করে সারা ফিল্ড চক্কর দেয়। ম্যান অফ দি ম্যাচ অয়নকে দেওয়া হয় দ্রুত রানের জন্য। টিম এবং টিম বির সব প্লেয়ারদের সঙ্গে করমর্দন । সবাই সেলিব্রেট করতে ব্যস্ত। অয়ন বড় ক্লান্ত । আজ সে ভগবানকে প্রাণ ভরে ডাকবে । এই সফলতার জন্য তাঁর আশীর্বাদ , দেবযানীর প্রেরণা এবং কলেজের সকলের প্রার্থণা ই দায়ী । কিন্তু একজন  কে কেন দেখল না ! সেটাই প্রশ্ন করে নিজেকে।  
ক্লান্ত অয়ন প্যাভিলিয়ন থেকে ফিরে যায় ড্রেসিং রুমের দিকে। সামনে দেবযানীকে দেখে আশ্চর্য হয়েযায়।
তুমি ? কোথায় ছিলে ? আমি কত খুঁজেছি তোমায় ! In fact……….
আমি তোমার পুরো খেলা দেখেছি । Congratulation. তুমি সত্যি চ্যাম্পিয়ন। “I admire you” এই বলে জড়িয়ে ধরেঅয়নের মুখ থেকে একটাই কথা স্বতস্ফুর্ত উচ্চারিত হয় , “I love you”
দুজনে দুজনের দিকে গভীর ভালোবাসায় তাকায় যেন হারান নিধি খুঁজে পেয়েছে দুজনে । এটাই কি তবে প্রেম নাকি সরল বন্ধুতা মাত্র ? প্রশ্ন আপনাদের কাছে রাখলাম  ??????? 
  
   

Thursday, September 7, 2017

টকিং বার্বি ডল ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী ০৭.০৯.২০১৭




 ছোট্ট মেয়েটা নাম তার ‘দীপান্বিতা’ । আমার নাতনীর বয়সী হবে।আমাদের আবাসনেই থাকে আমার বাড়ির পাসে । তার ৫ম জন্মদিন ১লা জানুয়ারি তে। আমাকে দু মাস আগেই বলে রেখেছে “দাদু , আমার জন্মদিন ১লা জানুয়ারিতে । তুমি কিন্তু আমাকে গিফট দেবে । আমি মা বাবাকে বলে তোমার পছন্দর খাবার আনাবো।”
আমি বলি নিশ্চয়ই মা। তুই তো আমার আহ্লাদী ঠাকুমা । তোকে গিফট না দিলে কাকে দেব বল !
হুম মনে থাকে যেন ।
ঠিক আছে মনে থাকবে দেখিস। তবে আমি যদি তার আগে মরে যাই ।
বালাই শাঠ ও কথা বলছ কেন । তুমি না থাকলে আমায় গল্প কে শোনাবে? পাকা বুড়ির মত বলে।
তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায় বেঁচে থাকতে হবে !
তা কেন । তুমি শুনিও না কিন্তু তুমি থাক নাহলে আমিও তোমার সঙ্গে চলে যাব আকাশে।
দূর বোকা মেয়ে । তবে ওই পক্ষী রাজ ঘোড়া চড়ে তোর অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার যে মেলবোর্ন থেকে আসবে সে কাকে নিয়ে যাবে তার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া য়।
খুব রেগে যায় । তুমি খুব বাজে । ও আমার বন্ধু । আমাকে না রাগালে তোমার বুঝি ভাত হজম হয়না?
আমি হাঁসি । খুব মজা পাই ওকে রাগাতে আবার ও নাহলেও চলে না । ওই ত আমার প্রকৃত বন্ধু।
অস্ট্রেলিয়ান রাজকুমার এর সিক্রেট হচ্ছে …. ওর ই স্কুলের এক ছেলে তার জন্ম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে । সে নাকি ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড । তাই এই রসিকতা। ওই বলেছিল সে কথা । ছেলেটি দেখতে ভারি সুন্দর কিন্তু ও আসলে মহারাষ্ট্রিয়ান । নাম অমিত আকোল্কার ।
এই অমিতকে নিয়ে দীপান্বিতার যত গল্প । ও কি টিফিন আনে , স্কুলে টিচার ওকে কি বলে। কেমন ড্রইং করে ইত্যাদি।
আমি চুপ করে শুনি । মাঝে মাঝে ‘হুঁ’ বলি । তারপর বলি তোর বেষ্ট ফ্রেণ্ড দের ডাক-বিনা ?
ডাকব তো । চকলেট দেব, গিফট দেব । আরও কত কি ।
আজকাল বাবা মায়েরা , ছেলে মেয়েদের জন্মদিন ইউরোপিয়ান স্টাইলে ওদের ধারায় করে । আমাদের আমলে বাবা মা নতুন ড্রেস পরিয়ে মন্দিরে পূজো দিতেন । সেদিন একটা বিশেষ দিন বলে গণ্য হত । বাড়িতে পায়েস নিশ্চই হত । সেটা মুখে দিয়েই মা বাবা আশীর্বাদ করতেন । গড় হয়ে প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদই সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল। সে রীতি প্রায় নেই । এখন কেবল কেক কাটা আর গিফট নেওয়া পরে গিফট দেওয়া । বেলুন দিয়ে সাজানো, লাইটের ডেকোরেশন ইত্যাদি।
……… দিপুরা (আমি ওকে এই নামি ডাকি) বেশ কদিন হল কোথায় গিয়েছে । আমি কোন খবর পাইনা ওদের। মনে মনে খুঁজি । আহা মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছে । ওর টক টক কথা , চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচ আমার মন কেড়ে নিয়েছে। ওর মা বাবা কেও দেখিনা কদিন। মনে মনে ভাবি হয়ত স্কুলের পড়াশুনোর চাপ। তারপর নাচের ক্লাস ,গানের ক্লাস , ড্রইং ক্লাস , ক্যারাটের ক্লাস …… । সত্যি আজকাল মা বাবারা নিজেদের ছেলে মেয়ের ওপর এতো প্রেশার দেয় যে তাদের নিজের মতন বাঁচার অধিকারটুকু যেন ছিনিয়ে নেয় । সব এক একটা রোবটে পরিণত হচ্ছে আর সেই রোবটের রিমোট টা আছে মায়ের হাতে । যেমন বোতাম টিপবে ঠিক সেই রকম চলবে । খাও খাবে … নাচো নাচবে … গান কর গান করবে …!!!!! এ কি ?
আমার মনে আছে কিন্তু দিপুর কথা । ওর বার্থ ডে গিফটের ফরমাস“টকিং বার্বি ডল” সেটা নিয়েই যাই ১লা জানুয়ারির দিন সন্ধ্যায় । কিন্তু একি ফ্ল্যাট টা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন ? কেউ কি নেই ! লোকজন ত থাকার কথা । মিউজিক ,লাইট সব কোথায় ? তা ছাড়া কোন লোক জন নেই । তবে কি ওর বার্থ ডে পার্টি হবেনা ! কিন্তু কেন? এই ভেবে মনটা এক অজানা আশংকায় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপলাম। দরজা খুলে দিলেন ওর বাবা । আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । উনি বললেন , “দিপুর ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে । ওরা মুম্বাই গিয়েছিল ওকে দেখাতে আশা ক্যানসার হসপিটাল এন্ড চিলড্রেন হসপিটাল এবং টাটা ক্যানসার হসপিটাল , মুম্বাইতে। কেমো দেওয়া হয়েছে। ওকে দেখলে চিনতে পারবেন না।”
আমি আর দুঃখ রাখতে পারলামনা। ও যে আমাকে বলেছিল “আমার সঙ্গে আকাশে চলে যাবে । তবে কি ও জানতো ওর রোগের কথা ! ওর সেদিনের কথাগুলো আমার ভিডিও রেকর্ডিং এর মত চোখের সামনে ভেশে উঠলো ; বালাই শাট ও কথা বলছ কেন । তুমি না থাকলে আমায় গল্প কে শোনাবে? তবে তোকে গল্প শোনাবার জন্য আমায় বেঁচে থাকতে হবে !” আমার চোখ ভারাক্রান্ত হল। আমি কেঁদে ফেললাম হাউ হাউ করে । ভগবান কেন এই কচি শিশুদের এই ভয়ংকর রোগ দেন ! কেন ? আর কিছুই আমার মাথায় এলোনা তখন কিছু না বলে দিপুর বাবার হাতে বার্বি টকিং ডলটা দিয়ে বলি এটা ওকে দিয়ে দেবেন । এটাই ও চেয়েছিল। মানা করবেন না । ওই আমার প্রাণের বন্ধু । এই বলে দ্রুত পায়ে ওখান থেকে ফিরে আসি আমার নিজের ফ্ল্যটে । সারাদিন আমি ঠাকুর ঘরে গিয়ে ওর আরোগ্যের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি । আমি কি করতে পারি এ ছাড়া !

Tuesday, August 1, 2017

'রুদ্রাক্ষ' ছোট গল্প / ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী । /


  
Published in http://www.annyodesh.in 
রুদ্রাক্ষ
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী । 
ছোট্ট গ্রাম, নাম তার হরিনারায়াণপুর । চাষ আবাদ করে চলে গ্রামবাসীরা । অর্থনৈতিক সাচ্ছিলতা নেই বললেই হয় । কৃষি প্রধান গ্রাম । সকলেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠিন পরিশ্রম করে সংসার চালায় । যে বছর ভাল বৃষ্টি হয় ফসল ভাল , নাহলে কপালে হাত । ফি বছর বন্যা তে গ্রাম প্লাবিত হয় আর ফসল হানি হয় । গ্রামে কুঁড়ে ঘরই বেসি । যারা গ্রাম ছেডে সহরে চলে গিয়েছে তারা প্রায় গ্রামের মুখ দেখেনা বললেই চলে ।দুর্গা পুজর সময় আসে , কদিন থেকে চলেযায় । এমনি এক গ্রামের বাসিন্দা কুঞ্জ বিহারি প্রধান । তার এক মাত্র ছেলের নাম রুদ্রাক্ষ প্রধান । শিব রাত্রীর দিন রুদ্রাক্ষ র জন্ম তাই নাম রুদ্রাক্ষছেলেটা ধীর স্থীর মিষ্ট স্বাভাবের ।
কুঞ্জ আর তার স্ত্রী , লক্ষ্মী দুঃখে কষ্টে দিন কাটাত । রুদ্রাক্ষ গ্রামের স্কুল এ ক্লাস থ্রী তে পড়ত । ভালই পড়াশুন করত । মাস্টার মশাই রুদ্রাক্ষ কে খুব স্নেহ করতেন । মা বাবার চোখের মণি যেমন গুনে তেমন কাজে । পড়াশুন থেকে আরম্ভ করে খেত খামারের কাজ সব করত রুদ্রাক্ষ বাবার সঙ্গে ।
একদিন গ্রামেতে লোকের ভিড় । অনেক গাড়ি তার সঙ্গে কিছু নেতা , গ্রামের মোড়ল নিশিকান্ত চৌধুরী । বাবুদের দেখে গ্রামের ছেলে ছোকরা, বুড়ো বুড়ি সকলেই একজোট হল। নিশিকান্ত বাবু বললেন, এই গ্রামের সুদিন এল । আপনাদের আর দুঃখ কষ্ট থাকবে না । আপনারা এবার গাড়ি ঘোঁড়া চড়ে বাবুদের মত থাকবেন । এখানে বাঁধ হবে । সরকার আপনাদের জন্য এখানে বাঁধ করলে কৃষির উন্নতি সাধন এর সঙ্গে অর্থনৈতিক সাচ্ছলতা আসবে । আপনাদের ছেলে মেয়ে পড়াশুন করে অনেক বড় হবে। বিস্থাপিত ৭২৬ পরিবারের জন্য সরকার আলাদা বসতি নির্মাণ করবেন । আজ তাই আপনাদের কাছে আমাদের অঞ্চলের মাননীয় বিধায়ক, শ্রী ভগবান চৌধুরী মহাশয় উপস্থিত থেকে এই প্রকল্পের বিষয় বিস্তারিত সূচনা দেবেন। সভাতে, করতালীর বদলে বিরোধিতা আরম্ভ হল। স্কুলের এক শিক্ষক শ্রী পঞ্চানন প্রধান বিরধিতার সুর আরম্ভ করে বললেন ,সরকার আগে বিস্থাপিতদের জন্য নতুন বসতি,রাস্তা,স্কুল,ডাক্তারখানা,পানীয় জলের ব্যাবস্থা এবং বিদ্যুৎ সংযোগ করুন তারপর আমরা এই বিষয়ে সম্মতি জানাবো । নিশিকান্ত চৌধুরী খেঁপে লাল। গর্জে উঠলেন আপনার মাস্টারিটা বিধায়াক মহাশয় এক্ষুনি ঘুঞ্চিয়ে দেবেন, আপনার সাহস ত কম নয়! শিক্ষক মহাশয় বিনম্রতার সঙ্গে বললেন আপনারা এই গরীব গ্রামবাসী দের জমি নিয়ে নেবেন আর তার বিনিময়ে যা যা ঘোষণা করছেন তার বিধায়ক মাহাশয় হাত থামিয়ে নিশিকান্ত কে বসতে বললেন । তার পর শুরু করলেন আমি এখানে কারুর পেটের দানা ছিনিয়ে নিতে আসিনি বরং কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে এসেছি । আপনারা ধৈর্য্য ধরে শুনুন সমস্ত বিষয়টা তারপর আপনাদের কথা শুনব। এই যোজনার জন্য সরকার ৪৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন এবং এর সুবাদে সমুদায় ৯৯৫০ হেক্টার জমিতে সেচের সুবিধে হবে
আপনাদের পরিবারের কেউ একজন সরকারি চাকরী পাবেন। সাতটি পুনর্বসতি কলোনি তে সকল বিস্থাপিতদের থইথান করা হবে ।
এর মধ্যে কিছু লোক চেঁচা মিচি শুরু করে দেয় । নিশিকান্ত সরকারী দালাল আমরা এ ভিটে মাটি ছাড়বনা। আমাদের বাপ দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে কোথাও যাবনা । ছেলেদের চিৎকারের সঙ্গে অন্যরাও সুর মেলাল । বিধায়ক মহাশয় যত বোঝালেও কেউ রাজি হলনা কি চিৎকার থামল না । অগত্যা সরকারি বাবুদের নিয়ে সবাই ফিরে গেলেন । তার পরের দিন পুলিশ এসে পঞ্চানন বাবুকে ধরে নিয়ে যায়
প্রথমে পঞ্চানন বাবু ওয়ারেন্ট দেখতে চান কিন্তু পুলিশ কিছু না দেখিয়েই ধরে নিয়ে যায় তাঁকে । সবাই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থেকে যে জার ঘরে চলে যায় । রুদ্রাক্ষ সব দেখে নির্বাক হয়ে যায় । বয়স অল্প হলেও তার মনে প্রতিবাদের বহ্নিশিখা জ্বলতে থাকে সে বোঝে যা হচ্ছে সেটা অন্যায় । পেছন থেকে পুলিশ এর জীপ কে লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে । তারপর বাড়িতে দৌড়ে চলে যায়। বাবাকে বলাতে, বাবা গুম হয়ে বসে থাকেন, মা কিছু বললে বিরক্ত হন । আকাশ পানে চেয়ে কিছু বিড় বিড় করেন।
********
এর পরের ঘটনা গ্রামেতে ক্যাম্প বসে । তাহসিলদার, আর আই,আমিন চেন নিয়ে মাপ জোপ আরম্ভ করে দেয় । পল্লিসভা হয় তাতে কিছু লোক নিশিকান্ত বাবুর গুণ্ডাদের ভয়ে টুঁ শব্দটি করেনা। হঠাৎ বাবা বাড়িথেকে একটা কাটারি নিয়ে নিশিকান্তর দিকে দৌড়ন রাগে গজরাতে গজরাতে ; বলেন তোর চোদ্দ পুরুষের বাপের জমিদারী যে আমাদের জমি নিতে এসেছিস । সবাই রে রে করে বাবাকে আটকান । তহসিলদার বোঝান তোমরা ক্ষতি পুরন পাবে । অনেক টাকা পাবে । এখানে সই কর । বাবা কাগজটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন । রাগে বলেন বাবু আপনারা আমাদের অন্ন র থালা ছিনিয়ে নিয়ে টাকা দেখাচ্ছেন । টাকা আমরা চাইনা । নিশিকান্ত গর্জে উঠে বলল এই কুঞ্জ তোর গায়ে মেলা চর্বি হয়েছে না ? দেখাচ্ছি তোকে মজা। গ্রামের উন্নতি চাসনা তো গ্রাম ছেডে চলেযা ।
পরের দিন পুলিশ এসে কুঞ্জকেও নিয়ে গেল কোন ওয়ারেন্ট না থাকা সত্তেও । দেশের আইন ব্যাবাস্থা র প্রতি কুঞ্জর ঘৃণা ধরেগেল । পুলিশের দারোগা বাবু বললেন তোর এত সাহস তুই লোক প্রতিনিধির কথা না শুনে কাটারী নিয়ে মারতে গিয়েছিলিশ ; সেটা কি তুই অস্বিকার করবি
সাক্ষী প্রমান তোর বাড়ির লোক ই দেবে । ওয়ারেন্ট এর কি প্রয়োজন ? কুঞ্জর নিজের জন্যে চিন্তা হয়না । তার বৌ ছেলের যদি কোন ক্ষতি হয় তারচেয়ে তার মৃত্যু ভাল । কুঞ্জ হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো । হাজতে নিশিকান্ত আর ভগবান চৌধুরী , বিধায়ক এসে কুঞ্জ কে বললেন , “দেখ কুঞ্জ আমরা তোকে ইচ্ছে করলেই জেল হাজতে পাঠাতে পারি কিন্তু তাতে কি লাভ তোর বৌ ছেলে না খেয়ে মারা যাবে । তুই কি তাই চাস ?” কুঞ্জ হাউ হাউ করে কেঁদে বলে না বাবু ওরকমটি করবেন না ! আমি আপনারা যা চাইবেন তাই করবনিশিকান্তর ক্রুর হাঁসি কুঞ্জ র চোখে পড়ল । কাথায় আছে ….হাতি কাদায় পড়লে ব্যাং এও লাথি মারে । কুঞ্জ র অবস্থা কিছুটা তাই । দারোগা বাবু বললেন , বাবুদের অশেষ দয়া তা নাহলে তোর নামে ৪ টে দফা লাগিয়ে তোকে জেলে ভরতাম বুঝলি । কালকেই কোর্ট এ হাজির করা হত ৷ ভগবান বুঝলি সাক্ষাৎ ভগবান , যেমন নাম সেইরকম কাজ । আমাদের বিধায়ক মহাশয় তোকে ছাড়াতে নিজে এসেছেন । তুই কিনা কাটারি নিয়ে গিয়েছিলিশ মারতে । ধর্ম নেইরে এ যুগে ধর্ম নেই । যার ভাল করবি সেই তোকে বাঁশ দেবে । আঃ কি হচ্ছে ? আমি যে জন্য এসেছি সেটা করুন । কুঞ্জ র বেল এর কাগজ নিয়ে এসেছি । ওকে ছেড়ে দেন । হ্যাঁ সার । এক্ষুনি ছেড়ে দিচ্ছি ।
এই সময় বাইরে লক্ষ্মীর গলার আওয়াজ এল ! লক্ষ্মী গজরাতে গজরাতে ভেতরে ঢুকল , আ মরণ মিনসে ! আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে যায় !! আমার বর ছাড়া কি কেউ ছিলনা এ গেরামে মুখপোড়ারা ? হাজতে ভরতে তোদের হাত কাঁপ-লোনা ? কাল থেকে মানুষটা ভাতে মুখ দেয়নি-গো ! রোগা কাঠি হয়ে গেছে গা । মরণ হয় না তোদের ? গরীবের ভাতের থালা ছিনিয়ে নিলে ভগবান তোদের কি শাস্তি দেবে খেয়াল রাখিস ! হাতে কুড়ি কুষ্ঠ হবে যে !! আমি যদি
কোন পাপ না কোরে থাকি এর জবাব দিও হে ঠাকুর ! তুমি ভরসা !! এই বলে হাত জোড় করে আকাশ পানে ঠাকুর নমস্কার করে ।
দেখছিস কুঞ্জ তোর বউ এর চোপা?” দারগা বাবু বলে উঠলেন । স্যার এর একটা বিহিৎ করুন । মেয়েমানুষের চোপা ? এই ! কে তোকে থানাতে আসতে বলেছে ? যা এখান থেকে নাহলে তোকেও লক আপে ভর্তি করে দেব । সাধে কি আর বলে মেয়ে মানুষ ? মুখের কথা দেখ ? যেন খই ফুটছে । উঁহহ
আবার গালা গালি দিচ্ছে । সাহস্ !!
লক্ষ্মী বলে , “কেন যাব ? কেন যাব শুনি ?? কি দোষ ওনার শুনি ? গরীবের কি কেউ নেই গা ? দেশে কি আইন নেই ? আমরা কার কি ক্ষতি করলাম এ্যাঁ ?”
দারগা বাবু বলেন , “তুই কি জজ্ না ম্যাজিস্ট্রেট ? তুই কি বিচার করবি কার অন্যায় আর কার ন্যায়”! তোর সাহস ত কম নয় । থানায় এসে থানা বাবুকেই ধমকাচ্ছিস ?
আহ্ কি হচ্ছে ?” বিধায়ক মহাশয় বিরক্তির সঙ্গে বললেন । দেখুন আমরা কুঞ্জ কে ছাড়াতে এসেছি আপনি ঘরে যান । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
যাচ্ছি যাচ্ছি , কে আর থানা তে আসে বাবু আমার সোয়ামি আছেন তাই এলুমকো । আমার সোয়ামিকে ছেড়ে দেবেন ত বাবু ?
হ্যাঁ হ্যাঁ ভগবান বাবু বলেন ।
এতক্ষন নিশিকান্ত চুপ ছিল । লক্ষ্মী যাওয়াতে বললেন স্যার দেখলেন ত ? এরা লাথীর ভাষা বোঝে ভাল কথা বললে আপনার মান ইজ্জৎ সব যাবে ।
কুঞ্জ মনে মনে ভাবছিল ওই শালাকে গিয়ে গালে একটা জোরে ঠাপ্পড় কোসিয়ে দেয় । কিন্তু নিরুপায় । হাজৎ বাস ! ছীঃ ! আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর । গা ঘিন ঘিন করছে । নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে । কিন্তু মাস্টার মশাই ? উনি ত কোন দোষ করেন নি ! তবে কেন ওকে ছাড়া হচ্ছেনা? এরা কিছু একটা অভিসন্ধ্যি করছে না ত ??
তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কুঞ্জ । এবার ঘরে যেতে পার । এই কে আছিস্ লক আপ টা খুলে দে । যত পাজির পা ঝাড়া সব । দারগা গর গর করলেন ।
কুঞ্জ বাড়ি ফিরল তার পরদিন মাষ্টার মোসাই ফিরে এলেন । মাষ্টার মোসাইএর এখানে কেউ থাকেন না । উনি একাই এই গ্রামে প্রায় বছর দশেক আছেন ।তিনি নিজে ছাত্রদের শিখিয়েছেন অন্যায়কে সহ্য করা এবং অন্যায় করা দুটোই এক অপরাধ । অন্যায়কে প্রতিবাদ কর হিঁসা দিয়ে নয় যুক্তি দিয়ে । কুঞ্জ যেটা করল সেটা ভূল । সে ভূলের মাসুল তাকে দিতে হল।
*********
হাজৎ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কুঞ্জ ঘরে ফিরে যায় । দু দিন হল ক্ষেত খামারের কাজ না হওয়াতে ফসলের ক্ষতি হতে পারে । আজকাল যা পোকার উৎপাত কোন কিটনাশক ই কাজ করে না । গ্রামের কৃষি গ্রাম সেভক যে কিটনাশক এর চিরকুট টা লিখে দিয়েছিলেন সেটা কিনে এনেছিল কিন্তু স্প্রে করা হয়ে ওঠেনি । আজকে দেখা যাক ফসলের অবস্থা বুঝে স্প্রে করবে ।
কুঞ্জ মাঠে যাচ্ছিল ফসলের অবস্থা দেখতে । রাস্তায় নিশিকান্তর সঙ্গে দেখা। কিরে কুঞ্জ তোর রাগটা কমেছে না আগের মতনবলে কুঞ্জ মুচকি মুচকি হাঁসতে লাগলো

কুঞ্জ উত্তর না দিয়ে পাস কাটিয়ে চলে গেল। ছেলেটার জন্য কুঞ্জ মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে তারওপর লক্ষ্মী মাথার দিব্বি দিয়েছে। নাহলে ওই নিশিকনতর দফা গয়া করে দিত ।
রাস্তায় যেতে যেতে রুদ্রর জন্য ভাবে । ওকে এই গ্রাম থেকে সহরে পাঠিয়ে দেবে ওর কাকার কাছে । বলাবাহুল্য ভাইকে অনেক কষ্টে ডাক্তারি পড়াতে পেরেছে ।এখন সে মস্ত ডাক্তার রুদ্র পড়াসোনাতে ভালো তাই ওর সম্ভাবনা বেশি ডাক্তার হবার। ভাইএর ডাক্তারি পড়ার খরচ সামলাতে না পেরে কুঞ্জ জমি বন্ধক রাখে নিধিরাম বেনের কাছে । আজ সাত বছর হল সুধ গুনছে । ফসল যা আমদানি হয় তাতে সংসার টেনে টুনে চলেযায়। কোনদিন ছোট ভাইকে ওর অভাবের কথা জানায় নি । সেও কোনদিন দাদা বৌদি কি ভাবে আছেন খোঁজ নেয়নি । কিন্তু কুঞ্জর কোন অভিযোগ নেই তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে । সে সকলকে গর্ব করে বলে তার ভাই সহরের মস্ত ডাক্তার ! এই সব চিন্তার সঙ্গে গোল ঘাঁট বেঁধে যায় । জমি তে গিয়ে যা কুঞ্জ দেখল সেটা ওকে আরো আঘাত করলো । ওর জমি মাপ জোপ হচ্ছে দেখে কুঞ্জ হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো আমিন কে।
আমিন : নিধিরাম তার নামে জমি করিয়ে নিয়েছে ,এখন রেকর্ড তার নামে তুই আপত্তি করিসনি কেন সেটিলমেন্টে এ ? ”
কুঞ্জ ঃ আমার কাছে কি কোন নোটিস এসেছে যে আমি আপত্তি করব ?
আমিনঃ নোটিস তো তোর নামে পাঠান হয়েছে তুই পাসনি ত আমরা কি করব?
কুঞ্জ ; মানে ? আমার জমি আমার বাপ দাদার আমলের ; নিধিরাম এর নামে কি করে হয় ?
আমিনঃ হয় হয় ! তুই কি আইন জানিস ? তোর ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেশ কর সব ঠিক করে বুঝে যাবি । ও বোধ হয় সই করে দিয়েছে ।
কুঞ্জর মাথায় বজ্রাঘাত হল যেন ! কুঞ্জ বিশ্বাস করতে পারলোনা ? আমিন কে বললো তুই ই যত নাটের গুরু । আমার ভাইয়ের নামে মিথ্যে বলে পার পেয়ে যাবি ! আজই সত্যা সত্য ধরা পড়বে ।
**********
গ্রাম থেকে কিছু দূরে একটা টেলিফোন বুথ আছে সেখানে কুঞ্জ সাইকেলে যায় টেলিফোন করতে । তখ মোবাইলের যুগ ছিলনা । রাত প্রায় দসটা কুঞ্জ নম্বর মিলিয়ে ডায়াল করল । অনেকক্ষন রিং হওয়ার পর ওপার থেকে নিতাইএর কন্ঠ স্বর ভেশে এল হ্যালো!
কুঞ্জ উৎসাহের সঙ্গে বললো হ্যাঁরে নিতাই তুই ভাল আছিস ? বৌমা কেমন আছে ? সবাই ভালো ত !
হ্যাঁ ! কেন ?
না , মানে , আমি বলছিলাম কি তুই আমাদের জমির কোন কাগজে কি সই করেছিলি ?
আমাদের মানে ? হ্যাঁ ! আমার ভাগটা আমি বেচে দিয়েছি
কেন ওটা কি একা তোমার নাকি ? “হ্যাঁ ! আমার ভাগটা আমি বেচে দিয়েছি।….. আমার ভাগ আমি বেচে দিয়েছি ।কথাগুলো কুঞ্জর কানে বারে বারে বাজতে লাগলো ।
ওপার থেকে নিতাই বলল,“কাল অপারেসন আছে ঘুমতে দাও। রাত দুপুরে বিরক্ত করতে এলে!কুঞ্জ আর নিজেকে সামলাতে পারলনা । হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো । ফোন তার হাত থেকে পড়ে গেল । বাড়িতে ফিরে এলো । গুম হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষন তারপর যে কিটনাশক টা কিনে এনেছিল পোকা মারার জন্য সেটা সকলের অজান্তে খেয়ে দিল রাত্তিরে ।
কি হল ? কি হল ? লক্ষ্মী, কুঞ্জকে বমি করতে দেখে ঘাবড়ে যায় । কি হল ? মাগো আমার সর্বনাশ হল গো । দৌড়ে যায় পাশের বাড়িতে সুভ্র কে খবর দিতে । বলে মাস্টার মোশাই কে খবর দিতে ডাক্তার কে ডাকার জন্য ।
এ গ্রামে ডাক্তার নেই আছে এক কম্পাউন্ডার, সেই সব রোগি দ্যাখে আর অসুধ দেয় । কম্পাউন্ডার এসে দেখেন কুঞ্জর মুখ থেকে গ্যাঁজা বেরুচ্ছে । দেখে সন্দেহ হয়। এটাতো সুইসাইড কেস ।
রুদ্রাখ সব দেখছিল শুনছিল কিছুই মুখ থেকে শব্দ না করে গুম হয়ে বসে ছিল । হঠাৎ বাবা যে কাটারি টা নিয়ে নিশিকান্ত কে তাড়া করেছিল সেটা নিয়ে দৌড়তে লাগলো । সবাই কে মেরে ফেলব । আমার বাবাকে আমায় ফিরিয়ে দাও নাহলে সকলকে মেরে ফেলব । আমার বাবাকে আমায় ফিরিয়ে দাও নাহলে সকলকে মেরে ফেলব । রুদ্রাক্ষ আর পরের দিন ফেরেনি কোথায় গেল কেউ জানেনা । এরকম হাজার হাজার রুদ্রাক্ষ র জন্ম হচ্ছে এ দেশে এরকম হাজার হাজার কুঞ্জ দারিদ্রের কশাঘাতে মৄত্যু কে স্বাগত করতে বাধ্য হচ্ছে । থেকে যাচ্ছে কিছু নিশিকান্ত,নিতাই,নিধিরাম,পুলিশ দারোগা র মতন স্বার্থপর রক্ত শোষা মানুষ রুপি পশু । পরের দিন কাগজে বড় বড় করে বেরুলো হরিনারায়ণপুরে চাষির মৃত্যু
এন জি ও, পত্রকার , টিভি চ্যানেল এর রিপোর্টার , বিরোধী নেতাদের স্রোত ছুটল । কেউ কি রুদ্রাক্ষর খোঁজ নীল ? কেন কুঞ্জ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হল ? কি হবে লক্ষ্মী র সিঁদুরের ? কেউ কি তার সোয়ামি কে ফেরাতে পারবে গা ? এ সব প্রশ্ন আপনাদের কাছে রাখলাম ।
গোধূলি লগ্নে সূর্য অস্তগামী । রক্তিম বর্ণে আকাশ লাল । সেই লাল আকাশের মধ্যে দূর থেকে দেখা-গেল একটি ছোট্ট ছেলে হাতে কাটারী নিয়ে কারুর কোলে আসছে। কাছে আস্তে বোঝা গেল রুদ্রাক্ষ মাস্টার মশাইয়ের কোলে তাদের ঘরে ফিরছে । লক্ষ্মী দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারলো তার ছেলে আসছে। দু চোখে কান্নায় তার জল শুকিয়ে গিয়েছে কিন্তু রুদ্রাক্ষ কে দেখে ছুটতে লাগল লক্ষ্মী তার এক মাত্র সন্তানকে কাছে পাওয়ার জন্য । কান্নায় আবার ভেঙে পড়লো লক্ষ্মী । রুদ্রাক্ষ মায়ের চোখের জল পুঁছে দেয় ছোট্ট হাতে । তারপর বলে , “মা কেঁদনা আমি আছি ত ।
মাস্টার মশাই রুদ্রাক্ষ র মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যান । সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে । চারিদিকে শঙ্খ ধ্বনিতে মনে হয় যেন স্বয়ং মা লক্ষ্মী সকলের ঘরে ফিরে এলেন । রুদ্রাক্ষ র চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছিল। মনে হচ্ছিল সংসারের সব পাপকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে ওই ছোট্ট ছেলেটির চোখের জ্যোতি যা থেকে অগ্নি বর্ষণ হচ্ছিল। স্বয়ং মহাদেব বোধ হয় মর্তে অবতারণ করলেন । এবার সব পাপীর শাস্তি হবে ।
4

Tuesday, July 25, 2017

অণুগল্প নদীর এপার ওপার ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী ২৬.০৭.২০১৭














ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী  ২৬.০৭.২০১৭



ছোট্ট একটি গ্রাম । নাম ইতি-পুর । গ্রামটির ধার দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট্ট একটি নদী । নাম ‘দয়া’ নদী । যারা “ধউলি শান্তি স্তূপ” দেখেছেন তারা নিশ্চয় এই দয়া নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে গিয়েছেন । দয়া নদীর ইতিহাস মর্ম স্পর্শী কারন এখানেই কলিঙ্গ যুদ্ধ হয় । হাজার হাজার কলিঙ্গ সেনার রক্তে ভাসে দয়া নদী । দয়া নদীর বর্ণ লাল হয় । সম্রাট অশোক এখানেই চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হন । বৌদ্ধ ভিক্ষু উপ গুপ্ত তাঁকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করেন । তাই জাপান থেকে এসে বুদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এখানে শান্তি স্তূপ বানান । বিশিষ্ট প্রস্তর শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়ক এই শান্তি স্তূপ বানান । এর পর থেকে এই শান্তি স্তূপ প্রধান আকর্ষণ হয় পর্যটকদের এবং পুরী ভুবনেশ্বর এলেই লোকে ধউলি শান্তি স্তূপ অবশ্যই দেখে যান । তবে আমি বলছি ইতিপুরের কথা । এই গ্রামটি দয়া নদীর ধারে অবস্থিত । নাম থেকেই সহজে অনুমেয় এটা শেষ গ্রাম তাই নাম ‘ইতি-পুর’ । এই গ্রামে অনেক দিন আগে এক দম্পতী বাস করতেন নদীর ধারে ঘর বানিয়ে । স্বামী কাজে যেতেন কিন্তু স্ত্রী সারাক্ষণ ঘরে মন মরা হয়ে বসে থাকতেন। ঘরে স্বামী ফিরলে বলতেন , “নদীর ওপার টা কত সুন্দর তুমি ওপারে কেন ঘর বানালে না । ওপারের রং কি সুন্দর সোনার মতন বালি , নীল রঙ্গের পাহাড় , আর সবুজ রঙ্গের গাছ পালা । মেঘ ঢাকা পাহাড় আর তাতে বিদ্যুতের ঝলকানি সব মিলিয়ে ছবির মতন লাগে । এপারটা দেখ কিছুই আকর্ষণ নেই যেন খাঁ খাঁ লাগে । আমার ভালো লাগে না । তুমি ওপারে ঘর কর । আমি ওপারে থাকবো । ”
স্বামী আশ্চর্য হয়ে বলতেন ঠিক আছে একদিন ওপারে নিয়ে যাবো তোমাকে । তারপর বলবে কোথায় ঘর করলে ভালো হবে । এক রবিবার স্বামী স্ত্রী তে ওপারে গেলেন । স্ত্রী ওখানে পৌঁছে বললেন এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি ? এতো আমার সেই নদীর ওপার নয়। এখানে পাহাড় গর্তে ভরা । মরা গাছের ডালে ন্যাড়া পাহাড় অতি কদাকার লাগছে । এটা সে জায়গা নয় ।
স্বামী বোঝান স্ত্রীকে , তুমি ভুল করছ । এটাই সেই জায়গা , যা তুমি ওপার হতে দেখতে । এখন দেখ আমাদের ওপার কেমন দেখাচ্ছে ? কি সুন্দর দেখেছ ! সবুজ গাছ পালা , ধানের ক্ষেত , সরু বাঁকা নদী বয়ে গিয়েছে । সব মিলিয়ে চিত্রকরের হাতে তূলির টানে আঁকা চিত্রপট । দেখ আমি কত সুন্দর জায়গায় তোমাকে রেখেছি অথচ তুমি আমার তৈরি ঘরকে হতাদর করছ । এখন বল কোথায় তুমি থাকবে? এখানে না ওখানে ? এইখানেই ভগবানের সৃষ্টি দুটো চিত্রপট দেখলে !
ভগবান আমাদের দুটি জিনিষ দিয়েছেন ১. তৃষ্ণা ২. তৃপ্তি । তুমি , তৃষ্ণার বশবর্তী হয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে তুলনা করে মনে তৃপ্তি পাচ্ছিলেনা তাই অতৃপ্ত তোমার আকাঙ্ক্ষা । যা আছে তাতে তুমি তৃপ্ত হলে তোমার আকাঙ্ক্ষা হবেনা কিন্তু অতৃপ্ত হলে আকাঙ্ক্ষা বাড়বে । সেখানে তুমি যত যাই পাওনা কেন সর্বদা একে তাকে দুষবে , মনে কষ্ট পাবে । কিন্তু তোমার তৃষ্ণার সমাপ্তিতে তুমি পরম আরাধ্য পরম পিতা ভগবানের সন্নিকটে আত্ম তৃপ্তি পাবে। তাই আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত রাখ ।
স্বামীর কথায় স্ত্রী হতবাক । স্ত্রী তাঁর ভুল বোঝেন ।

Monday, July 10, 2017

আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি:- (প্রথম পর্ব) ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী ১ম,২য়,৩য়,৪র্থ .৫ম ..পর্ব



     উপক্রমণিকা
আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি ঃ- 
আমি অতীত কে পাশ বালিশের মতন আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছিনা আবার বর্তমান কে অস্বীকার করতে পারছিনা কারন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উত্তর-দায়িত্ব রাখতে হবে আমার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ । আমাকে রেখে যেতে হবে এমন কিছু নিদর্শন যা আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের স্মৃতি-থেকে আমাকে বিচ্যুত না করে । তাদের শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ প্রাপ্তি হোক তারা মানুষের মত মানুষ হোক এই আশা । মানুষকে ঘৃণা করা সোজা কিন্তু ভালোবাসা কঠিন । যদি তোমার বাক্যের মিষ্টতায় কারুর মনে প্রেম , প্রীতি , ভালোবাসার উদ্রেক হয় তবে কুণ্ঠা কিসের ! বিলিয়ে যাও সেই মিষ্টতা , ভালোবাসা । দেখবে তোমার মিত্র সংখ্যা বাড়বে আর শত্রু নিজেকে আয়নায় দেখে ধিক্কার দেবে নিজের অপকর্মের জন্য । দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার । এ আর নতুন কি ? ত মহাভারত , রামায়ণ সব মহাকাব্যেই সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখিত । বিধির বিধান কে কেউ টলাতে পারবে না । আজ যে টাকার প্রাচুর্যে উল্লাসিত , কাল হয়ত সে ফকীর ! কথায় বলে লক্ষ্মী চঞ্চলা । তাঁকে কাছে পেয়ে যে বা যারা গর্বে হিতা হিত জ্ঞান হারায় এবং বড়দের অসম্মান করে তাদের ভবিষ্যৎ খুব একটা সুখের হয়না। আজকাল সংসারে এইরকম অমানুষের অভাব নেই। মিথ্যা কথা বলে অপরের ন্যায্য দাবিথেকে বঞ্চিত করে বড়লোক হয়ত সাময়িক ভাবে হওয়া যায় কিন্তু কে বলবে কার ভবিষ্যৎ কি হবে ? কার কি ভবিতব্য হবে কেউ বলতে পারে না । কোন গ্রহ রত্ন কখনই কারুর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারে না ! যারা বলেন সেগুলো আজগুবি কথা। আমি মানি না। মানবো না। আমার মা বাবা দুজনেই অনেক কষ্ট স্বিকার করে অনেক দুর্গম অঞ্চলে থেকে আমাদের মানুষ করেছেন। আমারা বলি আমারা মানুষ হয়েছি কিন্তু কে কতটা হয়েছে সেটাই যাচাই করা প্রয়োজন । সে যাচাই অন্য কেউ করবেনা নিজেকেই করতে হবে। আয়নার সামনে নিজের প্রতিবিম্ব বলবে কে কতটা মানুষ আর কে কতটা আমানুষ। আমি চেষ্টা করছি কোণ কটু মন্তব্য না করে কিম্বা অভিযোগ আলোচনা না করে বাবা মা আমাদের প্রতি যা যা কর্তব্য এবং ত্যাগ করেগিয়েছেন নিজেরা না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন , নিজেরা সব সুখ দুঃখ ভুলে কেবল আমাদের কথাই ভেবেছেন । তাই তাঁদের ই স্বরন করে আমার যতটুকু মনে পড়ছে তা লিপিবদ্ধ করে রাখা। সেটাই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি । এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ।

আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি:- 
(প্রথম পর্ব)
 
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী 
১৯৬২ সাল যায়গাটার নাম মালকানগিরি , কোরাপুট জেলা , উড়িষ্যা । বাবা দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্টের জোনাল এগ্রিকালচার অফিসার ছিলেন । সিনিয়র ক্লাস ওয়ান অফিসার এ প্রোমোশন পেয়ে কেন্দ্র সরকারের অধীনে ডেপুটেসনে ছিলেন।
এমনিতেই বাবা মাঝে মাঝে জয়পুর যেতেন অফিসের কাজে মিটিং এ্যাটেন্ড করতে টুরে । তখন দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টের চিফ এডমিনিস্ট্রেটর *শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন , আই.সি.এস কিছুদিন ছিলেন। বাবা ওনার খুব প্রিয় অফিসার ছিলেন ।
 
(*শ্রী যুক্ত সুকুমার সেন আবার তৎকালীন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী শ্রদ্ধেয় ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের খুব পছন্দের আই.সি.এস. অফিসার ছিলেন। দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টের শুভারম্ভ শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন কে বিশেষ ভাবে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান হয়েছিল কারন পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলা দেশ) থেকে যে সকল শরণার্থী ভারতের ভূমিতে সর্ব হারা হয়ে এসেছিলেন তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য উড়িষ্যার কোরাপুট জেলার মালকানগিরি , উমোরকোর্ট এবং মধ্য প্রদেশ (এখন ছত্তিশ গড়) এর পার্লকোর্ট সঠিক যায়গা যেখানে বিস্তীর্ণ বনানী সাফ করে প্লটিং করে বিস্থাপিত শরণার্থী দের পুনর্বাসন করা হয় । তাঁদের জন্য বাসগৃহ সমেত চাষ বাসের জমি সরকার থেকে দেওয়া হয়। বাবা যেহেতু দেরাদুন থেকে মৃত্তিকা সংরক্ষণের পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা-ধারি এবং নাগপুর এগ্রিকালচার কলেজের গোল্ড মেডালিষ্ট ছিলেন বি.এস.সি এগ্রিকালচারে ১৯৩৩ সালের ; তাই ওনাকে দণ্ডকারণ্য ডেপুটেসনে পাঠান হয় সএল সার্ভে এক্সপার্ট হিসেবে । খুব গুরু দায়িত্বের কাজ ছিল ।)
 
মালকানগিরি তে তখন লন্ঠন ই এক মাত্র সম্বল। ছোট বেলায় বাঘ , হরিণ ,শিকার দেখেছি। তখন শিকার করা ফ্যাশন ছিল এবং আইনের দিক থেকে কোন বাধা ছিলনা । একবার বাবার সঙ্গে জয়পুর , কোরাপুট থেকে মালকানগিরি আসার সময় রাস্তায় গোবিন্দপল্লী ব্লকের কাছে দুটো পাহাড় কেটে মাঝখানে রাস্তা ছিল সেই রাস্তায় একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার পাহাড়ের এক পাস থেকে আরেক পাসে লাফ মারল । ঠিক আমাদের জিপের ওপর । ড্রাইভার একটুও না ঘাবড়ে সোজা স্টিয়ারিং হাতে পুরো ঘটনাটা সামাল দিল । পূরণ উইলিস জিপ লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ ছিল। আজ সেই কথা মনে পড়ে গেল। এরকম অনেক ঘটনা আছে ।
 
আরেকটা ঘটনার কথা বলি । তখন গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে বাবার কাছে যাই । আমি অনেক দুর্গম যায়গা বাবার সঙ্গে টুরে গিয়েছি । এক আদিবাসীদের গ্রাম চিত্রকুন্ডার কাছে (এখন চিত্রকুন্ডা সহর হয়ে গিয়েছে) সেখানে তাঁবু ফেলে রাত কাটাতে হল বাবার সঙ্গে । সঙ্গে ভঞ্জ শিকারি সব সময় বাবার সাথে সাথে থাকে । ভঞ্জ শিকারি পারলাখেমুণ্ডী গজপতি রাজার শিকারি ছিলেন তাই উনি শিকারি হিসেবে দারুণ সাহসী এবং বুদ্ধিমান । উনি বাবার খুব প্রিয় ছিলেন
ওনার দোনলা বন্ধুক একটা রাইফেল আরেকটা গান ।সেদিন রাতে বাইরে আগুন জ্বালিয়ে কিছু আদিবাসী পাহারা দিল কারন বাঘের উপদ্রব । ভঞ্জ শিকারি রাতে জেগে রইলেন । রাতে বাবা দুবার ওঠেন বাইরে যাওয়ার জন্য। ভঞ্জ শিকারি সেটা জানেন তাই তার সাহেবের বডি গার্ড হিসেবে বাবার পেছনেই ছিলেন তিনি। হটাত ভঞ্জ শিকারি লক্ষ্য করেন দুটো জ্বলন্ত চোখ বেশ খানিকটা দূরে । শিকারিরা বাঘের চোখ দেখলে বুঝতে পারেন । কাল বিলম্ব না করে ভঞ্জ শিকারি দু চোখের মধ্যে খানে লক্ষ্য করে রাইফেলের ট্রিগার টেপে । বাঘটি প্রচণ্ড শব্দ করে লাফ মারে । ভঞ্জ শিকারি আবার গুলি ছোঁড়ে এবার আর কোন শব্দ নেই । বাবা হতভম্ব হয়ে ভঞ্জ কে ডাকেন , তখন ভঞ্জ শিকারি বাবাকে প্রায় চ্যাঁ দোলা করে টেন্টে নিয়ে যায়। আদিবাসী লোক গুলি আগুনের মশাল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ফেলে বাবাকে । পরে যানা যায় সকাল হতে এক বিরাট রয়েল বেঙ্গল টাইগার মরে পড়ে আছে । কপালে দুচোখের মাঝে একটা গুলি আরেকটা পেটে । আদিবাসীরা গান করে নিয়ে এলো বাঘটিকে । ওদের অনেক গরু ছাগল খেয়েছিল বাঘটা । বাঘটা খুব উৎপাত করছিলো তাই তাদের আনন্দের সীমা নেই। আমরা বাড়ী ফিরি জীপের ট্রেলারে বাঘ সমেত । রাস্তায় লোকে অতবড় বাঘ দেখে আশ্চর্য হচ্ছিল আবার অবাক ও হচ্ছিল। বাবা ভঞ্জ শিকারিকে পুরস্কার স্বরূপ ৫০ টাকা দেন (১৯৬২ সালে ৫০ টাকা অনেক) সেই বাঘের ছাল মান্দ্রাজ(চেন্নাই) পাঠান হল ট্যানিং এর জন্য । ক্রমশ .............



আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতিঃ- 
(দ্বিতীয় পর্ব)
 
ত্রিভুবান জিৎ মুখার্জী
 
বাঘের ছালটা ট্যানিং এর জন্য মান্দ্রাজে(চেন্নাই) যে ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন তাঁর নাম মিঃ নাইয়ার । কেরলী ভদ্রলোক । উনি বাবার স্টেনো ছিলেন। দুঃখের কথা ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন ঠিক ই কিন্তু ফিরিয়ে আনলেন না । ফিরে এসে বাবাকে বললেন , ফরেস্টের অফিসার নাকি সিজ করেছিলো বাঘের ছালটা অন্ধ্র থেকেই ট্রেনের কোম্পার্ট্মেন্টে । ওনাকে ফাইন দিতে হয়েছে সেই জন্য । যদিও কথাটা বিশ্বাস যোগ্য নয় কিন্তু বাবা ওই বিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না। ভঞ্জ শিকারি ভদ্রলোককে অনেক কটু কথা বলতে লাগলেন । খুব রাগ করেন নায়ার বাবুর ওপর । নায়ার বাবু কোন উত্তর দেন না । ভঞ্জ শিকারি বলেন,“আপনি কেন না জেনে অত দামি বাঘের ছালটা নিয়ে গেলেন?” এর পর ওই ভদ্রলোক চাকরি ছেড়ে চলে যান । কেউ ওনাকে ফেয়ার ওয়েল দিলনা ।
 
বাবা নায়ার বাবুকে বাড়িতে ডেকে খাওয়ালেন বটে কিন্তু যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিলেন যে কাজটা ভদ্রলোক ঠিক করলেন না। বাঘের ছালটার গল্প গল্পতেই থেকে-গেল ওটা থাকলে বাবার স্মৃতি এবং সবচেয়ে বড় কথা ভঞ্জ শিকারির এত বড় শিকারের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে থাকতো ।
 
যাইহোক এর পরে ভঞ্জ শিকারি যতগুলো বাঘ ভালুক শিকার করেছে সে সব গুলোর ছাল নিজেই নিয়ে গিয়েছে ।
 
একদিন আমরা সকলে মানে মা বাবা এবং আমি একটা কাছেই একটা ডেয়ারি ফার্মে গেলাম বেড়াতে। সেদিন রবিবার ছিল । আমাদের জীপের ড্রাইভার পাঞ্জাবী ভদ্রলোক ছিলেন নাম গুরুমুখ সিং । আমরা ওনাকে সিং সাহেব বলতাম। খুব আমুদে লোক উনি। আমাকে পাঞ্জাবীদের জোক শোনাতেন । সর্দার কা বারা বজ গয়া ওনার কাছ থেকেই শোনা । আমি একদিন বলি সিং সাহেব আপনি পাঞ্জাবী হয়ে পাঞ্জাবী জোক শোনান কেন ? উনি বলেন তোমরা আনন্দ পাবে বলে । তা ছাড়া ইয়ে ত জোক হ্যায় , সচ থোড়ি ।
 
সিং জী শুরু করেনঃ- এক দিন এক সর্দারের ছেলে ভূগোল ক্লাসে বিষুব রেখার বিষয় পড়ে । উত্তর গোলার্ধ দক্ষিণ গোলার্ধ র বিষয় পড়ে । ওর খুব ইচ্ছে হয় বিষুব রেখা দেখতে । বাবাকে বলে পিতাজী হম বিষুব রেখা ইয়ানি ইকুয়েটার দেখনা চাহতে ।
 
পিতাজী বলেন বেটা ইকুয়টার দেখ নাহি সকতে ও ত এক কাল্পনিক রেখা হ্যায় ।
 
বেটা বোলা নাহি হম খুদ দেখ লেঙ্গে বলে বাবার বাইনোকুলার নিয়ে আসে ।
 
বাবার মাথায় এক বুদ্ধি এলো ছেলেকে বলে চল ম্যায় হিঁ দিখা দেতা হুঁ তুঝে এই বলে ছেলে যখন বাইনোকুলার আকাশের দিকে দেখে ওর বাবা বাইনোকুলারের কাঁচের সামনে নিজের দাড়ি থেকে একটা চুল ছিঁড়ে কাঁচের সামনে ধরেন।
 
ছেলেকে বলেন বেটা ক্যা দেখা তুনে ?
 
বেটা বোলা জি ইকুএটার দেখা ম্যায়নে ।
অঊর কুছ ? হাঁ জি উসকা উপর এক উট ভি চল রাহি হ্যায় ।
 
সিং জি বলেন কিছু বুঝলে?
আমি বলি সে কি করে সম্ভব ?
 
সে ত না কিন্তু উট টা কি যানো ।
না
 
আরে ওটা ছেলের বাবার দাড়িতে যে উকুন ছিল ওটা চলছিল। বাইনোকুলারে ওই উকুনটা বড় দেখাচ্ছিল তাই ও উট বলে ভাবল ।
আমি হো হো করে হাঁসি । সিংজী ক্যা বাত
বহুত আচ্ছা জী । 
এরমধ্যে বাবা মা এসে-গেলেন একটা জার্সি গরু কিনে। নীলকণ্ঠ আমাদের পিওন অই গরু নিয়ে পেছনে ট্রাকে বাড়ি নিয়ে আসবে ।
 
আমার মা খুব সু গৃহিণী ছিলেন। আমাদের কোয়ার্টারের পেছনে নিজে হাতে বাগান করেছিলেন। বাগানে রকমারি শাক সবজি এবং কিছু ফলের গাছ ছিল
আমরা বাজার থেকে শুধু আলু পেঁয়াজ কিনতাম অন্য কিছু কিনতাম না। এবারে গরু এসে-গেল মানে গরুর দুধ ও কেনা হবে না। ঘরে ৬২ টা মুর্গী ছিল । কাজেই ডিম আর মুর্গীর মাংস ঘরেই পেতাম সকলে। 
নীলকণ্ঠ কাঠ কেটে রাখত । সেই কাঠের জালের রান্না হত। বাবার খাওয়ার অনেক তরিবাত ছিল
কাঠ কয়লার আঁচে মাংস রান্না হত খুব ধিক ধিকে আঁচে । বাবার ফেভেরাইট বাটি চচ্চড়ি সেটা আলু পোস্তর সঙ্গে মাশরুম দিয়ে ধিক ধিকে আঁচে বসবে ওপরে কাঁচা সর্ষের তেল আর কাঁচা লংকা চিরে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এক জাম বাটি পাঁঠার মাংস বাবার প্রিয় ছিল। ভাত খুব ই কম খেতেন। রাতে দুখানি রুটি আর এক বাটি দুধ খেতাম আমরা সকলে । 
মা না-থাকলে মিশ্র পিওনরান্না করতো । মিশ্র খুব তেল মসলা দিয়ে রান্না করতো । তাই জগদলপুর থেকে বাবা মঙ্গল রামবলে এক মধ্য প্রদেশের গয়লা বাবুর্চি আনেন। ও মুর্গা মসল্লা টা ক্লাস রান্না করতো । আমাদের বাড়িতেই দিশি মুর্গী থাকতো । মঙ্গল , বাবাকে সকালে কি কি রান্না হবে জিজ্ঞাসা করে নিজেই মুর্গি কাটতে চলে যেত । এখানে বলে রাখি তখন মালকানগিরিতে আনাজ খুব একটা পাওয়া যেত না। আমি মঙ্গলের কাছে মুর্গি কাটা শিখি । মঙ্গলের কোন ছুরির প্রয়োজন হত না । হাতেই সব সেরে ফেলত । তখন প্রেশার কুকার ওঠেনি । তাই কাঠ কয়লার আঁচেই খুব সুন্দর মাংস রান্না হত। এখন গ্যাসেও সেইরকম রান্না পাই না।
 
মিশ্রকে , বাবা *এপয়েন্টমেন্ট ( *তখন সরকারী গেজেটেড অফিসাররা থার্ড গ্রেড অবধি এপয়েন্টমেন্ট দিতে পারতেন) দিয়েছিলেন ও পুরীর লোক বলে। বাবা অনেক কে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন যারা পরে প্রোমোশন পেয়ে উঁচু পোষ্টে রিটায়ার করেছেন।
 
মিশ্রর বাড়ি জানকাদেইপুর । ওটা একটা ছোট্ট রেল ষ্টেশন মালতিপাটপুরের আগে চন্দনপুরের কিছু দুরে। মঙ্গল আসার পর মিশ্র সকালে মঙ্গল রাতের ডিনার বানাত । আপনারা হয়ত মনে করবেন এগুল বানান , কিন্তু না তখন সিনিয়র ক্লাস ওয়ান অফিসারদের জন্য চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বরাদ্দ ছিল বাড়ির কাজের জন্য। মিশ্রকে মা রাতে আস্তে বারুণ করেছিলেন কারন ও সন্ধ্যে হলেই নেশাগ্রস্ত থাকতো । মা নেশাখোরকে একদম পছন্দ করতেন না। সেদিকে মঙ্গল রামের ওরকম কোন দোষ ছলনা । তা সত্ত্বেও মা বাবার জন্য রকমারি রান্না করতেন। বাবা খাওয়ার সময় থালার পাসে ছোট ছোট অনেক বাটিতে নানা ধরনের রান্না থাকত ।
 
আমার বাবা খুব আমুদে লক ছিলেন । নিজে যেমন খেতে ভালোবাসতেন পরকেও সেইরকম খাওয়াতেন। আমাদের বাড়িতে কেউ এলে এলাহি রান্না হত।
 
এরমধ্যে জামাই ষষ্ঠী এসেগেল। তখন আমাদের দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে ,
 
ক্রমশ ঃ-

আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতিঃ- 
(তৃতীয় পর্ব)
 
ত্রিভুবান জিৎ মুখার্জী
জ্যৈষ্ঠ মাসের রৌদ্র তাপ । মালকানগিরি তে তখন প্রায় ৪০ ডিগ্রী উত্তাপ। ফাল্গুন মাস থেকেই গরমে অতিষ্ঠ সকলে। জলের কষ্ট কারন একমাত্র জলাশয় নাম বালি-সাগরএক প্রকাণ্ড সাগর স্বরূপ পুষ্করিণী যার ওপর সমস্ত মালকানগিরি র অধিবাসী নির্ভরশীল । এই বালি-সাগরের বিষয় কিছু না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে লেখাটা। নাম থেকেই সহজে অনুমেয় সেই রামায়ণের বালিরাজা এখানেই তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। বালি-মেলা চিত্র-কুণ্ডার বিষয় আসবো পরে । বালি-সাগরের জল পরিচ্ছন্ন । জলেতে কর্পূরের বাস ছিল । পুষ্করিণীর ওপর থেকেই তলার বালির শয্যা দেখা-যেত । বালিতে অভ্র (Mica) ছিল তাই সূর্যর কিরণে বালি-সাগরের জল স্ফটিকের মতন স্বচ্ছ ছিল। বালি-সাগরের জলাশয়ের অপর শ্বেত পদ্ম অনেকটা যায়গা জুড়ে ছিল। বালি-সাগরে ধার দিয়ে আমাদের স্কুলের রাস্তা ছিল। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে অই শ্বেত পদ্মের শোভা দেখে মুগ্ধ হতাম । অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম প্রকৃতির সৌন্দর্য । উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ ওই শ্বেত পদ্মর শোভা দেখলে ডেফডিলসছেড়ে লোটাসলিখতেন । আমি ত কবি নই তাই বিশেষ বর্ণনা দিতে পারলামনা। কবি সম্রাট উপেন্দ্র ভঞ্জ (১৬৭০ সালে জন্ম ১৭৪০ এ দেহ ত্যাগ ) প্রাচীন উৎকলের পুরাতন রাজ শাসিত উড়িষ্যার ঘুমুসুরের কুলাড় তে জন্ম । উনি রাজ পরিবারের হয়েও কবিতা লিখতেন রাজ কর্ম ছেড়ে । অসংখ্য কাব্য সৃষ্টি করেছিলেন। ওনার লেখা কাব্যগ্রন্থ কোটি লাবণ্য সুন্দরীথেকে উধৃত দুলাইন অনুবাদ করতে চেষ্টা করলাম। ওই পদ্ম ফুলের শোভায় এই কবিতার সৃষ্টি তাই দু লাইন ....... 
দেখরে নলিনী নলিনীতে শোভিত
 
ভ্রমেতে ভ্রমর ভ্রমে চকিত
 
আমার মনে আছে লক্ষ্মী পূজো এবং সরস্বতী পূজোর সময় ওই বালি সাগর থেকেই আমরা শ্বেত পদ্ম আনতাম । সারা গ্রীষ্মকাল নীলকণ্ঠ ওই বালি-সাগর থেকে টিনের ভারে জল এনে আমাদের বড় মাটির হাঁড়ী ভর্তি করে জল রাখতো । তখন ফিলটার ছিলনা তাই মা জল ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে খাওয়াতেন । কত খাটতে হত তখনকার মায়েদের ! আমাদের ঘরের কুয়োর জলেই আমরা স্নান সারতাম।
১৯৬৩ সাল । জামাই ষষ্ঠী মানেই এলাহি কাণ্ড । জামাই বলে কথা। দুজনেই এলেন । আমাদের প্রথম ভাগ্নি , বানী র তখন বোধ হয় এক বছর বয়েস হবে। সকলে বলে আমার ঠাকুমা নাকি বানী হয়ে ফিরে এসেছেন আমাদের কাছে। হবে হয়ত । তবে হ্যাঁ বানী খুব চার্মিং ছিল ছোট বেলায় । দেখতে যেমন ডল পুতুলের মতন সেইরকম টক টক কথা বলত । মাকে বলত , “ দিদুন - চটি ছাতা ভুঁ।মানে ওকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। সারাক্ষণ মায়ের কোলে ঘুরে বেড়াত । বাবা আদর করে বলতেন বানী মালকানগিরিকি রাণীদিনগুলো ভালোই কাটত । প্রসঙ্গে আসি ঃ মালকানগিরি সত্যি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অত্যন্ত মনোরম ছিল। চারিদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত এক ভূখণ্ড । আসল নাম মাল্যবন্তগিরি । এর পৌরাণিক দিক আছে। রাম এবং সীতা দেবী সঙ্গে ভ্রাতা লক্ষণ এই দণ্ডকারণ্য তে আসেন বনবাসে । এখানেই তমসার ধারে কুটীরে রাম সীতা বনবাসে ছিলেন। বালিমেলা এখানথেকে ১২ কিমি হবে ওই খানেই সপ্ত তাল ভেদ করে রাম , বালিকে হত্যা করে সুগ্রীবকে রাজা করেন । তমসা নদী এবং বালি সাগর এখন আর নেই। আমরা থাকার সময় ছিল দুটোই । প্রকাণ্ড বালি সাগরে পদ্ম ফুটে থাকত আর জল কাঁচের মত স্বচ্ছ ছিল। নীলকণ্ঠ ওই বালি সাগর থেকে জল নিয়ে আসত । বাড়িতে পাতকুয়ো ছিল সেটার জল খাওয়া হত না। তাই খাওয়ার জল বালি সাগর থেকেই আসত । সেই জল ফুটিয়ে ছেঁকে মা কলশিতে রাখতেন। তখন না ছিল ফিল্টার না ছিল একুয়াগার্ড । তাই আমাদের ওই জল ই ভরসা ছিল । 
বাবা , সিং জীকে জীপ নিয়ে কাছেই তমসা নদী দেখিয়ে আনতে বলেন জামাই বাবাজীকে। সেখানে জামাই বাবাজী গেলেন । একটু সন্ধ্যা হয়ে আসছিল সঙ্গে ভঞ্জ শিকারি ছিল। দূরে অন্ধকারে দুটো চোখ দেখে জামাই বাবু ভাবলেন নিশ্চই বাঘ। ভঞ্জ বলে এখন মোষেদের ফেরার সময় ওটা বাঘ নয় মোষ। কে কার কথা শোনে ! সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে পগার পা। বাড়িতে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন জামাই রাজা । ভঞ্জ বলে সার , মোষের চোখ দেখে বাঘ বলে ফিরে আসেন। বাবা বোঝেন কিন্তু বলেন ঠিক আছে তোমরা যাও । আসলে সহরের মানুষ জঙ্গলে বেড়াল দেখলেও ভাবে ছোট বাঘ ওই আরকি !
 
ভঞ্জ শিকারি আমাদের নিয়ে যেত জঙ্গলে বুনো মুর্গি শিকার করতে। ও বলত বোনের মুর্গি শিকারের সময় কখন পেটে তাক করবেনা। তাহলে পুরো মুর্গি নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ও মাথায় তাক করত । যদিও খুব কষ্টকর ব্যাপার কিন্তু তাই হত এবং দেখতাম মাথা বাদ পুরো মুর্গি আস্ত থাকত । বাবা বুনো মুর্গির মাংস খেতে খুব ভালো বাসতেন। ভঞ্জ একটা মুর্গির জন্য ৫০ টাকা বকশিস পেত। এখন ভাবি ওটা কিছুই নয় ওর পরিশ্রমের বদলে । কিন্তু ও তাতেই খুশী হত।
 
বেশ কাটছিল দিনগুলো । এরমধ্যে হটাত দণ্ডকারণ্যর চিফ এডমিনিষ্ট্রেটার জনসন সাহেব (অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ) আই.সি.এস অফিসার টুরে আসেন বাবার অফিস ইন্সপেকশন এ । লম্বা ফর্ষা , ব্রাউন হেয়ার , মাথায় ফেল্ট ক্যাপ । বেশ ভারিক্কি চেহারা। উনি কালো রংয়ের এক ক্যাডিল্যাক কারে লাল বাতি লাগিয়ে আসেন। বাবার ওই "বাঘের মুখে পড়ার" কথা এবং অন্য কিছু কাজের জন্য আসেন । বাবা যে টুরে টেন্টে থাকতেন তা উনি শোনেন এবং যানেন। এক রাত উনি হল্ট করেন দণ্ডকারণ্যর আই.বি তে । মা এরমধ্যে নানা ভোজনের আয়োজন করেন । পোলাও , মাংস , মুর্গি , নানা তরকারি, সালাড , পায়েস ইত্যাদি। লাঞ্চ খাওয়ার সময় আমাদের ঘরের পরিবেশ অন্যরকম হয়ে যায়। বাবা ময়ুরভঞ্জে পোষ্টেড ছিলেন তাই সেখান থেকে ময়ুরভঞ্জের রাজার কিছু জিনিষ যেগুলো আর রাজা ব্যাবহার করেন না সেগুলো কিনে এনে ছিলেন। আসলে আমার বাবা ভীষণ সৌখিন মানুষ ছিলেন। ওই জিনিস গুলির মধ্যে একটা ফুল ডিনার সেট । টি সেট , পিওর গোল্ড প্লেটেড চামচ, ছুরি , কাঁটা চামচ ও কিনেছিলেন । ওগুলো রুপোর ওপর সোনার প্লেটিং করা। সেগুলো ওই জনসন সাহেব আসাতে কাজে লাগে লাঞ্চে এবং ডিনারে।
 
ক্রমশ ঃ-

আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি:- 
(চতুর্থ পর্ব)
 
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
জনসন সাহেব , বাবার সঙ্গে বাবা যেখানে সএল সার্ভে পার্টি আছে তাদের সঙ্গে তাদের কাজের তদারকি এবং কি কি কাজ হচ্ছে তার প্রগতির সঙ্গে সেগুলি খুঁটিয়ে দেখতে গেলেন। এখানে বলে রাখি বাবাকে দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্টে ডেপুটেশনে পাঠান হয়েছিল ; তখনকার পূর্ব পাকিস্তান(অধুনা বাংলা দেশের) শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সঠিক চাষোপযোগি জমি সরকারি ভাবে বিতরণের আগে সএল সার্ভে করার জন্য । প্রত্যেক শরণার্থীকে দু একর করে জমি দেওয়া হবে সরকারের তরফ থেকে । তারা সেই জমিকে বাসোপযোগী করে চাষ করে নিজেদের পরিবার ভরন পোষণ করবে। এক একটি নতুন গ্রাম সৃষ্টি হবে পুরো মালকানগিরি সাবডিভিশন জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় যার নাম্বার থাকবে এম.ভি.নম্বর..... । এম.ভি.মানে মালকানগিরি ভিলেজ। কতবড় গুরু দায়িত্বের কাজ সহজেই অনুমেয়। এখানে আরো বলে রাখি জনসন সাহেবের আগে সুকুমার রায় আই.সি.এস কে তখনকার পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী স্বনাম ধন্য ডঃ বিধান চন্দ্র রায় , দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্টের শুভারম্ভ করার জন্য বিশেষ তাৎপর্যের সঙ্গে পাঠান হয়। সুকুমার রায় বাবাকে খুব স্নেহ করতেন কারন বাবা কাজ পাগলা লোক ছিলেন এবং টেকনিক্যালি সাউন্ড এবং ইংরেজিতে খুব ভালো ছিলেন । ব্রিটিশ আমলে অফিসারেরা সাধারণত ইংরেজিটা ভালো যানতেন । তাই বাবা যেমন খেতে ভালোবাসতেন ঠিক সেইরকম প্রচণ্ড পরিশ্রম করে ফিল্ডে ফিল্ডে কাজের তদারকি করতেন ও অফিসিয়াল কাজের সময় অনর্গল স্টেনোকে ডিক্টেসন দিতে দেখেছি। এখনকার অফিসাররা ডিক্টেসন দিতে হোঁচট খান। অনেক সময় ভালো স্টেনোরাই ড্রাফট তৈরি করে আনেন । এসবের দিক থেকে বাবা সম্পূর্ণ আলাদা । তাই সুকুমার সেন বাবাকে ভালোবাসতেন ওনার কাজের প্রশংসা করে । সএল সার্ভে তে অনেক টেকনিকাল কাজ আছে । প্রোফাইল স্টাডি , সএল টেস্ট , ফার্টিলিটি স্ট্যাটাস ইত্যাদি। বাবা , দেরাদুনের সএল কঞ্জারভেসন ট্রেনিং ইন্সটিট্যুটে , পোষ্ট গ্রাজুয়েট কোর্স কমপ্লিট করেছিলেন। তাই সএল সার্ভের বিষয় ভালো বুঝতেন। এখানে আরো বলে রাখি , বাবা নাগপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের থেকে গোল্ড মেডেল পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ১৯৩৩ এ পাস করেন। সালটা ঠিক মনে করতে পারছিনা হয়ত এক বছর এদিক ওদিক হবে। 
সএল সার্ভের পর পুরো রেভিনিউ ভিলেজের রিপোর্ট , সএল ম্যাপ , সএল ফার্টিলিটি স্ট্যাটাস , বিভিন্ন সএল পিটের ম্যাক্রো এবং মাইক্রো প্রোফাইল তৈরি করে সেগুলো দিতে হয়। এরপর রেভিন্যু ডিপার্টমেন্ট থেকে জমি শরণার্থীদের ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়। এইসব কাজে একটু গাফিলতি হলেই সমস্ত দায়িত্ব বাবার ঘাড়ে পড়বে। তাই বাবাকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সমস্ত ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে কাজ তদারকি করতে হত। মাসের প্রথমেই স্টাফদের মাস মাহিনা ড্র করে সেগুলি আবার প্রত্যেক স্টাফ কে তাদের কাজের যায়গায় দিয়ে আসা। এক একটা ক্যাম্পে একজন জে.টি.এ বা জুনিয়ার টেকনিক্যাল এসিস্টেন্ট কিম্বা সিনিয়ার টেকনিক্যাল এসিস্টেন্ট এবং তাঁর আণ্ডারে সার্ভেয়ার , ড্রাফটসম্যান , ফিল্ড এসিস্টেন্ট , চেন ম্যান , ট্র্যাক্টর ড্রাইভার ইত্যাদি স্টাফেরা থাকত । ক্যাম্পে তাঁবু , রান্নার সরঞ্জাম , ফোল্ডিং খাট এবং একটি করে কুক থাকত । প্রত্যেক ক্যাম্পে একটা করে ফার্গুসন ট্র্যাকটার থাকত । ডিজেল সাপ্লাই এবং ট্র্যাকটার মেরামত ইত্যাদির জন্য একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট এগ্রিকালচার ইঞ্জিনিয়ার মালকানগিরিতে পোষ্টেড ছিলেন। ওনার আণ্ডারে ওয়ার্ক শপ ছিল । ওইখানে সব গাড়ি যেমন জীপ , ট্র্যাকটার মেরামতের জন্য আসত । ওই ওয়ার্কশপ , অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার বাবার আণ্ডারে ছিলেন । আরো দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সএল কঞ্জারভেসন অফিসার বাবাকে সহযোগিতা করতে পোষ্টেড ছিলেন । একজন হৃদানন্দ মাহান্তি আরেক জন চৌধুরী সাহেব।
 
প্রসঙ্গে আসি। জনসন সাহেব সমস্ত ফিল্ড এবং ক্যাম্পগুলি নিজে বাবার সঙ্গে ঘুরলেন দুদিন ধরে । পুঙ্খানু পুঙ্খ ভাবে ফিল্ড ভিজিট এবং কাজের অগ্রগতিতে খুব খুশী হয়ে বাবাকে যাওয়ার আগে খুব প্রশংসা করে গেলেন । Congratulation Mr Mukerjee , I am very much happy that you are doing excellent work with your team . I also congratulate your staff for their team work and full cooperation with you. Thank you all and do your job for a noble cause. এইটুকুই আমার কানে এল। বাবা উত্তর দিলেন
 Thank you for your kind visit to the entire project area . We are inspired and will definitely follow your instruction, Sir. On behalf of my staff I thank you for giving us such nice advice . Inspite of your busy schedule  of work you have taken much pain to visit all the project site and checked the work progress . It is a rare opportunity to get, Chief Administrator of Dandakaranya Project at Malkangiri with us . I request you to come again to give us moral encouragement to discharge our duty most efficiently and sincerely . মনে হল জনসন সাহেব বাবার কাজে খুশী হয়েছেন।
 জনসন সাহেব আমাকেও একটু আদর করে গেলেন কারন আমি কাছেই ছিলাম। আমি একটু বাবা ন্যাওটা ছিলাম তাই কাছে কাছেই থাকতাম এবং প্রায় সময় বাবার সঙ্গে টুরে যেতাম। সচর আচর ব্রিটিশ আই.সি.এস. অফিসারেরা বড় একটা কথা বলেন না। কিন্তু উনি বাবার কানে কানে কিছু গোপন কথা বলে গেলেন যাওয়ার আগে । বাবা কথাটা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে যান। কি এমন কথা যা প্রকাশ্যে বলা যায়না। আমার একটু ভয় হল। ভয়ের কিছু নেই ত । কি জানি ব্রিটিশ সাহেবদের কথা ই আলাদা । 
জনসন সাহেব কোরাপুটে ফিরে গিয়ে দিল্লীতে চিঠি পাঠান একটা করে ক্যারাভ্যান প্রত্যেক ডিভিশনে পাঠানোর জন্য । এখানে ফিল্ড অফিসারদের জীবন বিপন্ন হতে পারে বাঘের উৎপাতে।
 
উনি দিল্লী-থেকে বিশেষ অনুমোদন অর্থ মঞ্জুরি এনে মালকানগিরি , উমোরকোর্ট আর পার্লকোর্ট ডিভিশনে সেই বছর ই একটা করে ক্যারাভ্যান পাঠান ওই বাঘের উৎপাতের ঘটনার বিবরণী শুনে । বাবা জীবন বিপন্ন করে কাজ করতেন তাই ওই ক্যারাভেনতাঁর ই দান । পরে বাবা ওনার কাছ থেকে আউট স্ট্যান্ডিং সি সি আর পেয়ে ডেপুটি ডাইরেক্টরের পদ মর্যাদা পান ।


 


আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি:
(পঞ্চম পর্ব)
 
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
জনসন সাহেব নতুন ক্যারাভ্যান পাঠান কোরাপুটে ফিরে যাওয়ার পর । নতুন ক্যারাভ্যান ভাইজাগ থেকে বাই রোড পৌঁছয় । প্রায় দু সপ্তাহ পরে এসে মালকানগিরি পৌঁছয় । নতুন ক্যারাভ্যান টানার জন্য একটা পাওয়ার ওয়াগন ও এসে পৌঁছয় । বাবা এবার থেকে টুরে গেলে ওই ক্যারাভ্যানে যাবেন। ক্যারাভ্যান এর ভেতর সব ব্যবস্থা আছে। সুন্দর খাট বিছানা সমেত সাদা চাদর পাতা। একটা সোফা, ডাইনিং টেবিল চেয়ার । পড়ার জন্য আলাদা টেবিল , টেবিল ল্যাম্প সমেত। ছোট্ট রান্না ঘর । তাতে সব ইউটেন্সিল ছিল। তখনকার দিনের স্টিম কুকার। ধোঁয়া বেরুনোর জন্য চিমনি । কিন্তু বাবা ভেতরে রান্না করতে বারুণ করেন কারন নোংরা হয়েযাবে তাই। একটা ছোট বাথ রুম , টয়লেট তাতে কমোড  ফিট করা। ওপরে জলের ট্যাঙ্ক ফিট করা । বাইরে একটা লোক আরামে দু তিন দিন থাকতে পারবে । কোন অসুবিধে নেই। এবার সঙ্গে মঙ্গল সিং গেল মুর্গা মসাল্লাম রেঁধে বাবাকে দেবে। তাছাড়া বনের মুর্গি ত আছেই। ভঞ্জ শিকারি ও  অন্য সব্বাই জিপে গেল ।  বাবা , মাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন একটু ঘোরাও হবে মায়ের আর বাবা নিশ্চিন্তে কাজ করবেন। আমার যাওয়া  হলনা । 
আমি , ছোড়দি ,বানি  মালকানগিরিতেই কোয়ার্টারে থেকে-গেলাম । মিশ্র রান্না করে দিয়ে যেত দু বেলার জন্য। এখানে বলে রাখি আমি এক বছর ওই মালকানগিরিতে উড়িয়া স্কুলে পড়তাম। তখন ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলের চল ছিলনা । আদিবাসী ছেলে মেয়ে আর কিছু লোকাল অফিসিয়ালের ছেলে মেয়েরা পড়ত ওই স্কুলে । আমার তখন ক্লাস সেভেন। এখানে বৃত্তি পরীক্ষা ছিল। ছোটবেলায় বেলঘরিয়াতে বাংলা মিডিয়ামে পড়েছিলাম ক্লাস ফোর অবধি , বেলঘরিয়া বয়েজ স্কুলে। তারপর কটকে রেভেন্সা  কলিজিএট স্কুল যেখানে নেতাজী পড়েছিলেন । সেখানেকে মালকানগিরি । বুঝতেই পারছেন ভাষা পরিবর্তনের সঙ্গে স্থান পরিবর্তন কতটা অসুবিধে হয় একটা ছোট ছেলের । আমি আবার অনেক ছোট বয়েসেই স্কুলে ভর্তি হই। তখন আমার ১০ বছর বয়েস । এটা ১৯৬৩ সালের কথা।
স্কুল যাওয়ার পথে বালি সাগরের ধারে প্রকাণ্ড সেগুন গাছ সারি সারি ছিল। এক একটা সেগুন গাছ প্রায় ৩০ ৩৫  ফুট লম্বা আর গোলার্ধে ১০ ফুট । ভেবে দেখুন কি জঙ্গল সম্পদ ওই মালকানগিরিতে ছিল। এ ছাড়া কাছেই শাল বোন , তাতে পিয়া শাল, বন্ধন, শাল, সেগুন ও শিশু কাঠের গাছ অপর্যাপ্ত । ২০ বছর পর সেই মালকানগিরি যাই পূর্ব স্মৃতি র কিছু অংশ আছে কিনা দেখতে । হায়রে বিধাতা কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব মাফিয়াদের কবলে সাফ ।
বেশ কিছুদিন পর পৌষ পূর্ণিমা এল। ওই সময় আদিবাসীদের পর্ব। ওই পর্বে ওরা গান নাচ করে সলপ(এক রকমের দিশি মদ) খেয়ে পুরুষ, মহিলা সব্বাই আনন্দে উৎসব করে আর সারা রাত নাচে। আমাদের বাড়ীতে নীলকণ্ঠ ওদের গ্রামে আমাকে নিয়ে যাবে বলে বলে পরব দেখানোর জন্য। ওদের গ্রাম কাছেই ছিল। মা গর রাজি হলেন কিন্তু নীলকণ্ঠ বলে সে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ওদের নাচ দেখিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। আমি খুব বায়না ধরলাম ওই পর্ব দেখব বলে। ওদের নাচের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে । নীলকণ্ঠ ওদের গ্রামের নাচের গুরু অর্থাৎ নাচের মাষ্টার । ও নিজে গান লেখে আবার সুর দেয় । ওইটাই আমাকে ওই পর্বের জন্য আকর্ষিত করে । অনেক বার নীলকণ্ঠ বলেছিল বাবু আমি আপনাকে নিয়ে যাবো আমাদের নাচ  গ্রামের ধাংড়া ধাঙড়ীর নাচ দেখাতে ।

ওই আদিবাসীদের নাচের তালে নীলকণ্ঠ মাদল বাজাত আর গান করত । তখন আমাদের কাছে না ছিল টেপ রেকর্ডার না ছিল ভিডিও গ্রাফির জন্য ক্যামেরা। এখনকার দিন হলে স্মার্ট ফোনেই সমস্ত ভিডিও করে রাখা যেত । তাই নিজের স্মৃতি থেকে এই গানটা লিখেছি । ওরা প্রায় ওইরকম ই শব্দ ব্যাবহার করে গান গাইত ।



ঝুমরি
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী / ২৯.০৮.২০১২  / বেলা ৩ টে ।
ছেলেঃ-   ঝুমরি তোর  নাচের তালে মাদল বাজে আমার
           চেনা গানের সুরের তালে মাতাল হলাম আবার  
মেয়েঃ-  ঝুমরি তোর গানের সুরে পাগল হল আবার
           রসিক নাগোর মরদ আমার মাদল বাজা আবার
ছেলেঃ-  ঝুমরি তুই ফুলের তোডা খোঁপায় লাগা আবার

         ফুলের গন্ধে ভরবে আমার পরান টা যে আবার
মেয়েঃ-   শক্ত হাতে সামলে নে না সরম  কেন আবার

         ঝুমরি তোকে মনটা  দিল রসিক নাগর আমার
ছেলেঃ-   ঢোল বাজিয়ে রাত পোহাবে নাচবি আমার সাথে  
          ঝুমরি তুই আমার ছিলি থাকবি আমার সাথে
মেয়েঃ-   আমার জন্যে এনে রাখিস নতুন শাডী সিন্দুর
          ঘরের কোনে ঘুম পাডাবি কিনে রাখিস মাদুর
ছেলেঃ-     ঝুমরি তোর  নাচের তালে মাদল বাজে আমার
               চেনা গানের সুরের তালে মাতাল হলাম আবার  
                    
মেয়েঃ-    ঝুমরি তোর গানের সুরে পাগল হল আবার
         রসিক নাগোর মরদ আমার মাদল বাজা আবার
                   

                  ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জ্জী /২৯.০৮.২০১২/৩.০০ টে
                        
পরবের গান
( ঝর্না চ্যাটার্জ্জী র দ্বারা সম্পাদিত আদিবাসী দের ফর্মাটে)

ছেল্যা-- ঝুমরি, তুর নাচের সঙে বাইজছ্যে মাদল
        চিনা গান লাগছ্যে কানে হল্যম মাতাল

মেঁইয়া-- তুর গানট শুন্যে ঝুমরি পাগল হল্যেক
         রসিক নাগর মরদ আমার ফির বাজাল্যেক

ছেল্যা--ঝুমরি, তুই ফুলট আবার মাথায় দিল্যেক
         উয়ার গন্ধে মনট আবার ভর‍্যে গেল্যেক

মেঁইয়া--মরণ টানে ধর ক্যানে তুই হাত দু-টাকে
        ঝুমরি তুকে মনট দিছে, জানিস বটে !

ছেল্যা-- ঢোল বাজাব, আমার সঙে নাচবি রেতে
        ঝুমরি তু আমার ছিলি, আমার বটে...

মেঁইয়া-- শাড়ী সি*দুর রাখবি কিনে
        ঘরের ভিতর মাজুরটকে রাখবি আন্যে

ছল্যা-- ঝুমরি তুর নাচের সঙে মাদল বাজাই
        চল ক্যানে তুর সঙে আবার মহুয়া খাই

মেঁইয়া--ঝুমরি তুর গানট শুন্যে পাগল হল্যেক
         রসিক আমার মরদ বটে জান্ত্যে পাল্যেক...