অজিতেশের সন্ধানে... | ||||
| ||||
বিশ্বের খ্যাতনামা নাট্যকারদের নাটক এই বঙ্গে বসে দেখছেন বাঙালি দর্শক। দেখে হাসছেন, কাঁদছেন, রেগে যাচ্ছেন, কখনও বা ভয়ে শিউরে উঠছেন। বিষয় বৈচিত্রে বা ভাবনাগত নতুনত্বে চমকে উঠছেন। বিভিন্ন চরিত্রকে ঘরের মানুষ বলে মেনে নিচ্ছেন। তর্ক জুড়ছেন নিজেদের মধ্যে। অর্ধশতাব্দীরও আগে বঙ্গ থিয়েটারকে বিশ্ব থিয়েটারের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন যিনি তাঁর নাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব কৌশলে আমৃত্যু তিনি সেই কাজটাই করে গিয়েছেন। ছ’ফুটের উপর লম্বা। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য চাহনি। প্রাণখোলা হাসি। দাপিয়ে অভিনয় করছেন মঞ্চে, গান গাইছেন, নাচছেন। প্রযোজনা নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন কলকাতা থেকে সারা বাংলা। বাংলার বাইরে। নেপথ্যে চলছে নাটক লেখা, নাটক নির্মাণ, নির্দেশনা, সংগঠন সামলানো, স্কুলে পড়ানো। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে এমন শিল্পমুখী প্রতিভা বাঙালি দেখেছে কি না সন্দেহ। শুধু কি বাংলা থিয়েটার! রেডিও নাটক, সিনেমা, যাত্রা, কবিতা লেখা, সবেতেই নিমজ্জিত ছিলেন বাংলা মঞ্চের এই ‘শের আফগান’। | ||||
জন্ম, ছেলেবেলা ও পড়াশোনা | ||||
অধুনা পুরুলিয়া তখন মানভূম। ১৯৩৩-এর ৩০ সেপ্টেম্বর সেখানকার রোপো গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মালেন অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কয়েক বছর পরে কলকাতায় পা রেখে যে নাম পরিবর্তিত হবে অজিতেশে। নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত মজা করে বললেন, “সে সময় বাংলা রঙ্গমঞ্চে বেশ কয়েক জন অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করছেন। আমার মনে হয়, অজিত বুঝতে পেরেছিল, ওর খুব নাম হবে। ভবিষ্যতে যাতে দর্শক বাকি অজিতদের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলে তাই ও অজিতেশ হয়েছিল।” | ||||
![]() ‘তিন পয়সার পালা’য় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কেয়া চক্রবর্তী। | ||||
ভুবনমোহন ও লক্ষ্মীরানির বড় ছেলে অজিত। বাবা কোলিয়ারিতে কাজ করেন। আসানসোল শিল্পাঞ্চলের রামনগরে। একটু বড় হতেই অজিত দেখলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেটা ১৯৪২, তখন তার বয়স বছর নয়েক। জাপানি বোমার ভয়ে ভুবনমোহন তাঁকে পুরুলিয়ার ঝালদায় এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে অজিত তিনটি বিষয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন— ফুটবল, রাজনীতি এবং থিয়েটার। প্রথমটির ঘোর অল্প দিনের মধ্যেই কেটে যায়। দ্বিতীয়টিতে প্রভাবিত করে গাঁধীজির লেখা। কিন্তু পরের দিকে কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকেছিলেন। বেশ কিছু কাল সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন। তবে থিয়েটারের মগ্নতা আমৃত্যু কাটাতে পারেননি অজিত। ঝালদা থেকে বছরখানেকের মধ্যেই ফিরে এলেন রামনগর। কুলটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর ভুবনমোহন বদলি হয়ে গেলেন ঝরিয়ার কাছে চাসনালায়। সেখানেই নাট্যগুরুর দেখা পেলেন অজিত। নাম প্রবোধবিকাশ চৌধুরী। তাঁর সঙ্গেই পাথরডি রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে ‘টিপু সুলতান’-এ জীবনের প্রথম অভিনয় করেন অজিত। হস্টেলে থেকে চলতে থাকে পড়াশোনা এবং নাটক। স্কুল শেষে অজিত ভর্তি হলেন আসানসোলের বিবি কলেজে। সেখান থেকে আইএ পাশ করে কলকাতা এলেন ১৯৫৩ সালে। ভর্তি হলেন মণীন্দ্র কলেজে। | ||||
গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে নান্দীকার | ||||
ইংরেজির স্নাতক অজিত শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিলেন। পাশাপাশি তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠের ইংরেজির শিক্ষক, পার্টি কর্মী, তথা গণনাট্য সঙ্ঘ পাতিপুকুর শাখার শিল্পী অজিতকে তখন সবাই এক ডাকে চেনে। দমদম আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর দায়িত্ব পড়ে গণনাট্য সঙ্ঘের চারটি শাখাকে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা তৈরি করার। মঞ্চস্থ হল ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’। তার পর ধারাবাহিক ভাবে সঙ্ঘের কাজ করেছেন তিনি, মূলত থিয়েটারকে আঁকড়ে। প্রথম দিকে তারই শাখা হিসেবে কাজ করত ‘নান্দীকার’। কিন্তু সঙ্ঘের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব আর বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে। তাই গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে সরে এসে ১৯৬০-এর ২৯ জুন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে, দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত এবং অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় স্বতন্ত্র সত্তায় আত্মপ্রকাশ করল ‘নান্দীকার’। এর পর প্রায় ১৭ বছর এই সংগঠনের সঙ্গে থিয়েটারকে নিয়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলেন অজিতেশ। | ||||
| ||||
এই দলের প্রথম নাটক ইবসেনের ‘ঘোস্টস’। বাংলায় ‘বিদেহী’। একটি মাত্র অভিনয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় এই নাটকের শো। ’৬০-’৬১-তে পর পর কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করে নান্দীকার। মৌলিক এবং বিদেশি নাটক নির্ভর ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’, ‘সেতুবন্ধন’, ‘চার অধ্যায়’, ‘প্রস্তাব’ করার পর ১৯৬১ সালের ১২ নভেম্বর অভিনীত হল ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। এই নাটক বাংলা থিয়েটারে নান্দীকার-এর নাম দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। মূল নাটক লুইজি পিরানদেল্লো-র ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর’। বঙ্গীয়করণ করেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। এর পর অজিতেশের নির্দেশনায় একের পর এক মঞ্চসফল প্রযোজনা করেছে নান্দীকার। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘যখন একা’, ‘নানা রঙের দিন’, ‘তিন পয়সার পালা’, ‘শের আফগান’, ‘ভাল মানুষ’— তালিকায় নাম বাড়তেই থাকে। নির্দেশনার পাশাপাশি নাটকের গান তৈরি করা, সে গানের সুর দেওয়া, বিদেশি নাটকের আত্তীকরণ, মৌলিক নাটক লেখা— সবই চলতে থাকে অজিতেশের। নান্দীকার তখন বাংলা নাট্যমঞ্চের হীরকখনি। | ||||
নান্দীকার থেকে নান্দীমুখ | ||||
১৯৭৭-এ ‘সাংগঠনিক কারণ’-এ নিজেরই তৈরি করা দল নান্দীকার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অজিতেশ। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি গঠন করলেন নতুন সংস্থা, ‘নান্দীমুখ’। প্রথম দিকে নান্দীকারে করা তাঁর পুরনো নাটকগুলিই মঞ্চস্থ করত নান্দীমুখ। ‘নানা রঙের দিন’, ‘শের আফগান’, ‘তামাকু সেবনের অপকারিতা’, ‘প্রস্তাব’ ইত্যাদি নাটক দিয়েই পথ চলতে থাকে অজিতেশের নতুন দল। | ||||
![]() ‘পাপপুণ্য’ | ||||
এর পর লিও তলস্তয়ের ‘পাওয়ার অফ ডার্কনেস’ অবলম্বনে নান্দীমুখ মঞ্চস্থ করে ‘পাপপুণ্য’। নান্দীকারে এ নাটকের একটি পাঠ-অভিনয় হয়েছিল। তার পরই দল ছাড়েন অজিতেশ। তাই ‘পাপপুণ্য’ মঞ্চে উপস্থাপিত হয় ১৯৭৮ সালে, তলস্তয়ের জন্মের সার্ধশতবর্ষে। এ নাটকে নিতাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করলেন অজিতেশ এবং আদুরির চরিত্রে সন্ধ্যা দে। এর পর হ্যারল্ড পিন্টারের ‘দ্য বার্থ ডে পার্টি’ অবলম্বনে অজিতেশ মঞ্চস্থ করলেন ‘৩৩তম জন্মদিন’। বাংলা নাটকের ইতিহাসে এই দু’টি নাটক জায়গা করে নিয়েছে তার যোগ্যতার কারণেই। কিন্তু সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পাওয়া অজিতেশের অকালমৃত্যু এই দলকে স্তিমিত করে দেয়। | ||||
নাট্যকার অজিতেশ | ||||
বিদেশে বসে লেখা, সে দেশের পটভূমিতে লেখা বিভিন্ন নাটক অজিতেশের ছোঁয়ায় হয়ে উঠত ঘরের নাটক। এই বাংলার নাটক। ভিন্ন দেশ-কাল-পরিবেশ-পরিস্থিতি-পাত্রপাত্রী যেন হয়ে উঠত একান্ত ভাবেই এ দেশের। বা বলা ভাল, এই বঙ্গের। ব্রেখট, ইবসেন, চেখভ, পিরানদেল্লো, ওয়েস্কার, পিন্টার— বিশ্ব নাট্যমানচিত্রের এই সব স্থপতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অজিতেশের হাত ধরে। এঁদের নাটকের অনুবাদ নয়, বঙ্গীয়করণ করে তিনি উপস্থাপন করতেন মঞ্চে। | ||||
![]() ‘তিন পয়সার পালা’য় অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ এবং কেয়া | ||||
“তার আগে তোরা ক’জন জামা-ফামা গায়ে দে মাইরি। তোর তো জন্ম ইস্তক দেখে আসছি, এই এক লাল শালু গায়ে দিচ্ছিস। তোর গায়ের গন্ধে কাবলি কাঁদবে শালা। সিপাহী বিদ্দোহের পর এটা আর কাচিসনি নাকি বে! দ্যাখ দি-নি কোমরে গামছা বেঁধে ডাঁরিয়ে আচে। তুই বরযাত্তীর না শ্মশান যাত্তীররে? ডাঁইরে ডাঁইরে হাসচে, যেন বাপ মরেচে!” ব্রেট্রোল্ট ব্রেখট-এর ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’ যখন মঞ্চে উপস্থাপন করলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন এই ভাবেই তার সংলাপ রচনা করেছিলেন। যার ফলে দর্শকদের কোনও ভাবেই মনে হয়নি তাঁরা কোনও বিদেশি নাটকের মঞ্চায়ন দেখছেন। বরং মনে হয়েছে, এই ‘তিন পয়সার পালা’য় বাংলারই কোনও এক চরিত্র মহীন তাঁদের সামনে কথা বলছে। বাঙালিয়ানার মোড়কে বিদেশি নাটক এ ভাবেই দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করতেন অজিতেশ। কিন্তু বর্তমান সময়ে কি বিদেশি নাটককে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয় বাংলা মঞ্চে? নাট্যকার এবং নির্দেশক ব্রাত্য বসু বললেন, “বিদেশি নাটকের স্থানীকরণের বিষয়টা ওই সময়ের দাবি ছিল। দরকারও ছিল। সে দাবিটা অজিতেশবাবু চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। কিন্তু এই বিশ্বায়ন পরবর্তী যুগে আমাদের থিয়েটারকে আর বিদেশি নাটকের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। আমরা আমাদের থিয়েটারের টেক্সট নিজেরাই তৈরি করি। দেশীয় জল-হাওয়া থেকেই উঠে আসে আমাদের চরিত্র ও সংলাপ।” তিনি জানান, সময় পাল্টে গেলেও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই নাটকগুলি কিন্তু বাংলা থিয়েটারের সম্পদ। এবং যত দিন বাঙালি থিয়েটার নিয়ে ভাববে তত দিন অজিতেশ থাকবেন। | ||||
অভিনেতা ও নির্দেশক অজিতেশ | ||||
অভিনয় শিল্পের সব ক’টি মাধ্যমেই কাজ করেছেন অজিতেশ। মঞ্চ নাটকে তো তিনি অবিসংবাদিত অভিনেতা ছিলেনই, বাংলা চলচ্চিত্র এবং যাত্রাশিল্পও সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর অভিনয়ে। থিয়েটারে তাঁর অভিনয় যাঁরা দেখেছেন তাঁদের স্মৃতিতে এখনও যথেষ্ট উজ্জ্বল অজিতেশ। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, সংলাপ, হাসি, গান, বাচনভঙ্গি— সবই মনে আছে তাঁদের।
ষাটের দশক থেকে তিনি সিনেমাতেও অভিনয় করা শুরু করেন। সব মিলিয়ে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এর মধ্যে কয়েকটি হিন্দি ছবিও আছে। তপন সিংহ, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দীনেন গুপ্ত, অরুন্ধতী দেবী, মৃণাল সেন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, তরুণ মজুমদার ছাড়াও আরও অনেক পরিচালকের নির্দেশনায় তিনি সিনেমায় অভিনয় করেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘গণদেবতা’র চলচ্চিত্রায়ণ করেন তরুণ মজুমদার। সেই ছবিতে অজিতেশের অভিনয় অবিস্মরণীয়। বৃহৎ বাঙালির কাছে অজিতেশ যে সিনেমার অভিনেতা ছিলেন এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অন্তত এই প্রজন্মের কাছে তো বটেই। যাত্রার ক্ষেত্রেও একই রকম সফল অজিতেশ। এবং জনপ্রিয়। গ্রামবাংলার মানুষ যাত্রাশিল্পী অজিতেশের অভিনয়ে বুঁদ হয়ে ছিল। থিয়েটারের বৃত্তের বাইরে একটা বড় সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছতেই অজিতেশের যাত্রায় যোগ দেওয়া। তিনি বলেছিলেন, “যাত্রা অনেক বেশি লোককে দেখানো যায়। জিনিসটা অনেক ছড়ানো। অনেক কথাও বলা যায়।” কিন্তু বছর তিনেক অভিনয় করার পর তিনি যাত্রা ছেড়ে দেন। অভিনয় শিল্পের আরও একটা মাধ্যম রেডিওতে প্রচুর কাজ করেছেন অজিতেশ। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা এখনও সতেজ বাচিকশিল্পী এবং আকাশবাণী ও দূরদর্শনের প্রাক্তন কর্তা জগন্নাথ বসুর মনে। তাঁর প্রযোজনায় বহু নাটকে অভিনয় করেছেন অজিতেশ। “প্রথাগত অভিনয়ের বাইরে চরিত্র নিয়ে ভেবে সংলাপ উচ্চারণ করতেন অজিতেশবাবু। আঞ্চলিক ভাষার অভিনয়ে ওঁর কাছাকাছি কেউ ছিলেন না। ‘গিরিশ ঘোষ’ প্রযোজনায় তাঁর ‘ঠাকুর’ বলে কান্নায় ফেটে পড়ার অভিনয় আমার সারা জীবন মনে থাকবে। অভিনয়ের এমন ব্যাপ্তি আমাকে আজও অবাক করে।” জানালেন জগন্নাথবাবু। অজিতেশের নির্দেশনায় কাজ করা শিল্পীরা আজও তাঁর গুণমুগ্ধ। যে পদ্ধতিতে শিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিতেন, তা আজও তাঁদের কাছে বিস্ময়! অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কখনও শিখিয়ে দিতেন না। কিন্তু সময় দিয়ে নির্মাণ করতেন এক একটি নাট্য মুহূর্ত। মায়া ঘোষ থেকে সন্ধ্যা দে কিংবা বিভাস চক্রবর্তী থেকে পবিত্র সরকার— সকলে এক বাক্যে জানালেন এ কথা। | ||||
![]() রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত নির্দেশিত ‘ফুটবল’ নাটকের প্রথম অভিনয়ে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় | ||||
অন্য অজিতেশ | ||||
“অজিতেশের যেটা মজা, আপনার সঙ্গে কথা যখন বলবেন, তখন আপনিই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোক তাঁর কাছে। এবং অসাধারণ হাস্যরসিক ছিলেন।” বলছিলেন পবিত্র সরকার। কথিত আছে, সকালবেলা কোনও তরুণ হয়তো অজিতেশের কাছে দেখা করতে এলেন। তাঁর সঙ্গে সারাদিনের গল্প শেষে ওই তরুণের বোধ হবে তার জীবনে আসলে একটাই কাজ, সেটা হল থিয়েটার করা। এমন মায়াময় কথা বলতেন। একই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করলেন নাট্যনির্দেশক আশিস চট্টোপাধ্যায়, “আমাদের দলের একটা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে তাঁকে নেমন্তন্ন করতে গিয়েছি বেলেঘাটার বাড়িতে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও অপরিচিত এই নাট্যকর্মীকে অনেকটা সময় দিয়ে শুধু থিয়েটারের গল্পই করে গেলেন।” সে কারণেই বোধহয় ব্রাত্যকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, যদি কোনও ভাবে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়, নাট্যকার হিসেবে, অভিনেতা হিসেবে এবং সংগঠক হিসেবে তিনটি প্রশ্ন করতে হলে কী কী করবেন? একটুও না ভেবে তিনি উত্তর দেন, “কোনও প্রশ্ন নয়। শুধুই গল্প করব। থিয়েটার নিয়ে গল্প।” খেতে খুব ভালবাসতেন। এমনও শোনা যায়, মহলাকক্ষে আনা শিঙাড়ার অর্ধেকের বেশি তিনিই খেয়ে ফেলতেন। জগন্নাথ বসু তো বলেই ফেললেন, “অমন খাদ্যরসিক মানুষ আমি আর দেখিনি। এক বার রেকর্ডিং শেষে আমি আর অজিতেশবাবু গিয়েছি আকাশবাণীর ক্যান্টিনে। তখন ওখানে সিমাইয়ের পায়েস পাওয়া যেত। তিনি ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কয় বাটি পায়েস আছে?’ উত্তর এল, ‘১৯ বাটি।’ তিনি বললেন, ‘দিয়ে দিন।’ টেবিলে ১৯ বাটি পায়েস এল। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রায় সব ক’টি বাটিই শেষ করে ফেললেন তিনি। আমি বোধহয় ২ বাটি খেয়েছিলাম তত ক্ষণে!” | ||||
শেষের সে দিন | ||||
১৯৮৩-র ১৩ অক্টোবর মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাংলা অভিনয় জগতের প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী। সেটা ছিল সপ্তমীর রাত। ওই সন্ধেতেই দক্ষিণ কলকাতার ‘সুজাতা সদন’-এ ‘সেই অরণ্যে’ নামের একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। নাটক শেষে বাড়ি ফিরে একটু রাত করেই খেয়েছিলেন খাবার। তার পর হঠাৎ বুকে ব্যথা। ডাক্তার ডেকে আনার আগেই সব শেষ। সে বছরের অষ্টমীর দিন নিমতলা শ্মশানে পুড়ে শেষ হয়ে যায় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নটের দেহ। | ||||
Saturday, March 1, 2014
অজিতেশের সন্ধানে... উজ্জ্বল চক্রবর্তী
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment