সমীরদার বিয়ে
ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী ১২.০৭.২০১৩ / বেলা ১১.৩০
পেন্টু আমার ছোটবেলার বন্ধু । আমি , পেন্টু ,খোকন তিনজনেই এক স্কুলে পড়তাম । সকালে স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে ১ টা বাজতো । স্নান সেরে খাওয়ার পর হোম ওয়ার্ক থাকলে সেরে ফেলতাম । মা , সারা বাডির কাজ সেরে একটু বিশ্রাম নিতেন দুপুরে । ঠিক সেই ফাঁকে আমি জাল আলমারিতে রাখা নারকেলের নাড়ু সব ফাঁক করে দিতাম । মায়ের হাতের নারকেলের নাডুর স্বাদ এখন ভুলিনি। পেন্টুদের বাড়ী আমাদের বাডীর উল্টো দিকে । ওদের বিশাল বাগান বাড়ী ছিল। বাগানে রকমারি তরি তরকারি , হাঁস , গরু ,ছিল। একটা মস্ত পুকুর ছিল সেই পুকুর পাড়ে আমরা গিয়ে গল্প করতাম। হাঁস গুলো দেখতে খুব ভালো লাগতো বিশেষ করে রাজ হাঁস । আমাদের বাডীর কাছেই একটা খেলার মাঠ ছিল । আমরা সেখানে হয় ডাঙগুলি নয় চোর পুলিশ খেলতাম ।
বিশ্বকর্মা পূজোর আগে আমাদের ঘুডির সুতোর মাঞ্জা দেওয়ার রেওয়াজ থাকতো । তাই পেন্টুদের বডী থেকে য়ানতাম হামান দিস্তা , ভাঙ্গা কাঁচ , হাঁসের ডিম । হামান দিস্তাতে কাঁচ গুঁড় করে সেটা হাঁসের ডিম ফাটিয়ে সেই কুসুমের সঙ্গে মিশিয়ে একটা মন্ড তৈরি হত । মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সমস্ত চৌহদ্দি জুডে গাছের গুঁড়িতে পাক খাইয়ে সুতো জড়ানো হত । এরপর মাঞ্জা দেওয়া হত হাতে সেই মন্ড নিয়ে । সারা দুপুর আমাদের চলতো এই কাজ । আর কিছু হাঁসের ডিম আস্ত সিদ্ধ করে খাওয়ার জন্য । তিনটে ইট আড়া আড়ি ভাবে রেখে আরেকটা ইট রাখা হত যাতে উল্টো ইউ আকৃতি হয় । এরপর শুকনো বাঁশে কাগজ দিয়ে আগুন ধরানো হত । ইটের উনুনে সিলভারের একটা বাটিতে চারটে , ছটা ডিম সিদ্ধ হত । ডিম সিদ্ধ নুন লংকা দিয়ে খেয়ে লেগে পডতাম ঘুঁডির সুতোর মাঞ্জা দিতে । সেই আনন্দের দিন গুল ভুলতে পারিনা
পেন্টুর জাঠতুতো দাদা, সমীরদা’ তখন সদ্য মার্চেন্ট অফিসে চাকরিতে ঢুকেছেন । সমিরদাকে সকালে বাডীর ছাদে দেখা যেত কাগজ নিয়ে পডতে । আসলে কাগজ পডা নয় মিনুদির সঙ্গে চোখে চোখ মিলিয়ে একটু ভাসা ভাসা প্রেম আরকি । মিনুদির বাডী একটা বাডীর তফাতে তাই ওনাকেও সকালে হয় বই হাতে নয় কাপড় মেলতে দেখা যেত । আমাদের খেলার মাঠের কাছেই একটা ইটখোলা ছিল। সেই ইটখোলাতে সমীরদা রবিবার কিম্বা কোন ছুটির দিনে বিকেলে আসতেন । কেন আসতেন আমরা বুঝতাম না । হাতে একটা সিগারেট , পরনে পায়জামা পাঞ্জাবী আর পায়ে স্লিপার । তখন সদ্য হাওয়াই স্লিপার উঠেছে । সমীরদা সামনের বাডীর ‘মিনুদির’ সঙ্গে যে চুপি চুপি প্রেম করতেন তা আমরা বুঝতাম না তখন। মিনুদি আসতেন ইটখোলাতে সমিরদাকে দেখা করতে পরে জেনেছি ।
মিনুদি খুব সুন্দরী ছিলেন । যেমন রং সেইরকম মুখের গড়ন । টিয়া পাখির মতন টানা নাক আর টানা টানা চোখ । সে , না দেখলে বোঝানো যায়না । প্রত্যেক দিন ভোর বেলায় মিনুদি তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ করতেন । পাড়ার ফাংশনে মিনুদির গান অবশ্যই থাকবে । সমিরদা নাটকেতে হিরোর রোল করতেন । অনেক ড্যান্স ড্রামা হত রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ ,’চিত্রাঙ্গদা’ ইত্যাদি । মিনুদি সব ড্যান্স ড্রামা নিজে নির্দেশনা দিতেন । পাডার মেয়েদের দিয়েই সুন্দর ভাবে পরিবেশন করতেন । সত্যি দেখার মতন। নাটক মানেই সমীরদা । রাত জেগে রিহার্সাল দেওয়া, স্ক্রিপ্ট লেখা সব সমীরদা । তাই বোধহয় সমীরদা মিনুদির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। খুব স্বাভাবিক ।
হঠাৎ পেন্টু বলল , সমিরদার বিয়ে । সমীরদার বাবা জোর করে সমীরদার বিয়ে ঠিক করেছেন এক অল্প বয়সের মেট্রিক পাস মেয়ের সাথে । সমীরদা কিন্তু ওনার মাকে মিনুদির কথা বলেছিলেন । জ্যাঠাইমা সব জানেন কিন্তু জেঠুর রাগের কাছে কেউ তিষ্টতে পারে না। এই ছিল তখনকার কালের সমস্যা । সমীরদারা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ‘লাহিড়ী’ আর মিনুদিরা বদ্যি ‘সেনগুপ্ত’ ! অগত্যা সমীরদা বাডী ছাডা হলেন । অন্য জায়গায় বাসা ভাডা নিলেন। মিনুদিকে আর রেওয়াজ করতে শোনা গেলনা ।
দুটি হৃদয়ের মিলন কি তাহলে অসম্ভব ! সেটাইতো প্রশ্ন !! কি হল তবে ?
এর মধ্যে জ্যাঠাইমার জন্ডিস হল। সমীরদা মাতৃভক্ত ছেলে । মায়ের অসুখে কিছুতেই দূরে থাকতে পারলেন না । ফিরে এলেন বাডীতে । জেঠু , ডাক্তার বদ্যি সব করলেন । অনেকদিন জ্যাঠাইমা ভুগলেন শয্যাশায়ী হয়ে। ক্রমে ছেলেকে-দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন মাথায় হাত রেখে সে যেন তার মা’কে ছেডে কোথাও না যায় । সমিরদা ফ্যাসাদে পডলেন । ‘ফান্দে পডে বগা কান্দেরে’ এ কিছুটা সেই রকম ই অবস্থা । সমীরদা ঠিক করেছিলেন মিনুদিকে বিয়ে করে আলাদা থাকবেন । ভগবান বাধ সাধলেন । জ্যাঠাইমা সমীরদা কে বলেন বাবার পছন্দের মেয়ে কে বিয়ে করতে । সমীরদা গর রাজি । কিছুতেই রাজি করান গেলনা । সরদার মা বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আমরা জ্যাঠাইমাকে দেখতে যেতাম । আর পেন্টু আসত না খেলতে । সামনে বিশ্বকর্মা পুজো । ওই দিন ঘুড়ি ওডাতেই হবে ।
জেঠু এরমধ্যে মেয়ের বাবাকে আশীর্বাদের আয়োজন করার মনস্থ করেন । সমীরদার মা অনেক অনুনয় বিনয় করে ছেলেকে বোঝাতে চেষ্টা করেন । বাবা, কেন তুই বুঝছিস না”
সমীরদা, “কিসের সমাজ মা! ,আমি ওই সমাজ মানিনা যেখানে ভালোবাসার কোন দাম নেই ?”
মানি না মানি না !!
হঠাৎ ঘরে জেঠু ঢুকলেন । সব নিস্তব্ধ ।
জেঠিমার চোখে জল । তিনি দোটানার মধ্যে পড়েন আর মানসিক অশান্তিতে কাটান ।
“তাহলে তোমার কি এটাই সিধান্ত খোকা” , জেঠু গম্ভীর ভাবে বলেন।
“হ্যাঁ বাবা । এটা আমার জীবনের চরম সিদ্ধান্ত যা আমাকেই নিতে হবে । আমি চাইনা কোন মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করতে । আমি ওই অপরিপক্ব এক ম্যাট্রিক পাস মেয়েকে জীবন সঙ্গিনী করতে চাইনা। আমি আপনার সঙ্গে এ বিষয় তর্ক করতেও চাইনা । আপনি আমায় বুঝতে চেষ্টা করুন” ।
সমীরদা গড় গড় করে ডায়লগ বলার মতন বলে গেলেন।
সমীরদা গড় গড় করে ডায়লগ বলার মতন বলে গেলেন।
খোকা তুমি নাটক করে নাটকের সংলাপ আমায় শোনাচ্ছ ! বাচালতার সীমা আছে । সীমা টপকাচ্ছ তুমি । নিজেকে কি মনে কর তুমি ? ওই বদ্যি বাডীর মেয়ে তোমার মাথাটা খেয়েছে । ঠিক আছে তুমি জদি ওকেই বিয়ে করতে চাও তবে এ বাডীর দরজা তোমার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ ।
এ কথা শুনে সমীরদা একদম বিচলিত হলেন না । পা বাড়ালেন দরজার দিকে ......।
জেঠিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন ...... খোকা যাসনি ! খোকা যাসনি !! তোদের বাবা ছেলের বচসাতে আমি যমের দ্বারে জেতে বসেছি । তুই আমার মরা মুখ দেখবি খোকা । আর তোমাকেও দোহাই তুমি কেন ছেলেটার মনের কথা বুঝে উঠতে পারছোনা? কি চাও তোমরা ?
জেঠু চুপসে গেলেন এই কথায় । দাঁড়াও !! গর্জন করে ওঠেন !! খোকা দাঁড়াও !!!
সমীরদা ধীর স্থির ভাবে দাঁড়ালেন দরজার কাছে ।
জেঠু বলেন ,“ঠিক আছে তুমি ওদের বাডীতে খবর পাঠাও”
সমিরদা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন । সত্যি বাবা ? ঢিপ করে প্রণাম করেন বাবা মাকে । আমি খবর দিচ্ছি ।
বাডীতেই বৈঠকখানায় টেলিফোন ছিল । ফোনে খবর দেন মিনুদিকে ।
পরের দিন মিনুদিদের বাডী থেকে মিনুদির মা বাবা আসেন সঙ্গে আংটি মিষ্টির বাক্স আর জেঠিমার জন্য এক ঝুডী ফল , ডাব ইত্যাদি ।
জেঠিমা এখন অনেকটা সুস্থ বলে মনে হচ্ছে । এতদিন পর মুখে হাঁসি দেখে সবাই আশ্বস্ত ।
আজ চাকর বাকর ,পাডা পোডশি , ছেলে ছোকরা সব্বাই খুশি । সকলেই হার্দিক ভাবে এই যুগলকে বিবাহ বন্ধনে আবধ্য হতে দেখতে চান । আসলে জেঠু এ পাডার একজন গণ্য মান্য ব্যাক্তি । তাই বিয়ের ভোজ খুব ভাল হবে । আমরা সকলে বলি ,সমিরদা মিনুদির বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খাবো ।
খুব ধুম ধাম করে বিয়ে হল । আমি নিত বর হয়ে গেলাম সমিরদার সঙ্গে গাডীতে । দেখতে একটু লাল্টু ছিলাম তাই বোধহয় আমার ভাগ্যে নিত বর হওয়া জুটে গেল।
No comments:
Post a Comment