বেড ~ পর্ব ১ ~ দেবাশিষ চক্রবর্তি
বেড
~ পর্ব ১ ~
তাপসদা কিন্তু এবার নিজেই বলেছিল ৷ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকে কানের কাছে বুডুর বুডুর করে চলেছে ৷ গতবার দশমীর দিন বেরোবার সময় বৃষ্টি নামল ৷ আর সময় পেলনা ! এদিকে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে ছিল ৷ এমনকি তেল পর্যন্ত ম্যানেজ করা সারা ৷ কাদার চোটে রাস্তায় হাঁটা যাচ্ছিলনা তো আবার বাইক চালানো !
এই বছর এক্কেবারে ইচ্ছে ছিলনা অষ্টমীতে বাইক চেপে বেরোনোর ৷ দুপুর বেলা পাড়ায় সাইকেল খেলা হবে ! উলুবেড়ে থেকে এসছে লোকটা, রাত্তির থেকে ডায়লগ মারছে ৷ কবে নাকি খেলা দেখাতে গিয়ে নতুন একটা সাইকেল প্রাইজ পেয়েছে ৷ হতে পারে তবে হাজার টাকার মালার গল্পটা ঢপ ৷
কেমন যেন লাগছিল প্রথম থেকেই ৷ পেটের মধ্যে বেআক্কেলের মতো ভুটভাট চোলছে ৷ রাত্তিরে প্যান্ডেল পাহারার সময় একটুও ঘুমোতে দেয়নি ৷ মাথার পিছনটা ভারী আর শরীরটা জ্বর জ্বর করছে ৷ মা আবার বলছিল সবায়ের সাথে বিকেলে ঠাকুর দেখতে বেরোতে ৷ তাপসদা তো বলেই বসলো একবার , না গেলেই হয় ! কি একটা ফোন এলো ব্যস ! সেই যে লাফাতে লাগলো এক্কেবারে স্টার্ট দিয়ে তবে শান্ত ৷
পেলকুটাও ছাড়লোনা ৷ ওদের ভোগ নাকি ফাটাফাটি খেতে ৷ পরশু ওদের পাঠানো সপ্তমী পুজোর প্রসাদ খেয়ে তাপসদা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল ৷ অষ্টমীর দিন ভোগ রান্নার ঠাকুর নাকি আলাদা ! প্যান্ডেলের সামনে সবাই মিলে আগেকার দিনের মতো বাবু হয়ে বসে খেতে হবে ! পাড়ার মেয়েরা লাল পাড় শাড়ি পড়ে পরিবেশন করবে ৷ সবটা মিলিয়ে বেশ একটা ফাটাফাটি ব্যাপার, সবটা শুনে দিল খুশ !
বেরোনোর মুখেই কোত্থেকে একটা ল্যাংড়া কুত্তা এসে ধাক্কা লাগিয়ে দিল ! গোঁত্তাটা লাগালো হাই রোডে উঠবার ঠিক আগের টার্নিংয়ে ৷ ছোট্ট মতো ছাই রঙের জন্তরটা আর একটু হলেই চাকায় জড়িয়ে প্রথমেই কেলেংকারীটা বাধিয়ে দিত ৷ সামনের চাকাটা একটু টলমল করে আবার ঠিক হয়ে গেল ৷ আশেপাশের লোকগুলো তাকানোর আগেই সব ঠিকঠাক ৷ ওখানেই কিছু হলে তাপসদা পাশের বেডে অন্ততঃ থাকতো ৷
পাড়ার প্যান্ডেলের সামনে, এখনো মনে আছে, তাপসদার বাবা দাঁড়িয়ে ছিল ৷ কার সঙ্গে যেন রাগ রাগ মুখে কথা বলছিল ৷ যতই বলুক এখন, স্পষ্ট মনে আছে, যেন দেখতেই পায়নি এমনভাবে ভিতরে ঢুকে গেল তাড়াহুড়ো করে ৷ কোনো কিচ্ছু বলেনি তাপসদাকে ৷ না , না বেরোনোর কথা অথবা না , না বাইক চাপার কথা ৷ উচিত ছিল প্রনাম করে বেরোনো ! কিন্তু তার জন্যে তো থাকতে হবে ৷
বরং হিমানিজেঠু বলল চটপট ফিরে এসে এখানের ভোগটাও খেতে ৷ ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো চাট্টি বেলপাতা হাতে নিয়ে ৷ কোনো রাগ নেই, বিরক্তি নেই, সোজা তাকিয়ে আছে তাপসদার দিকে ৷ কথা বলার পরে আবার দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কিসব বলল ৷ জেঠুর মুখ চোখে যে হাসিটা সবসময় থাকে সেটা লেগেছিল বাইকটা বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ৷ একটুও যে পাত্তা পেলনা সেটা কিছু মনেই হলনা !
সকাল থেকেই মেঘ শুরু হয়েছিল, কোথায় নাকি গভীর নিম্নচাপ হয়েছে ৷ টিভিতে বার বার বলছিল সাবধানে থাকবার কথা ৷ ওই সব দক্ষিনবঙ্গে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত জাতীয় ! গরমটা একটুও কাটেনি তখনো ! কবে যে বৃষ্টি নেমেছিল মনে নেই ৷ মাঝে একদিন একটু ঝড় ! তাতে কি আর পুজোর দিনগুলো ঠান্ডা হয় ! বরং গুমোট ভাবটা বেড়ে উঠে মেজাজটাকে খাটটা করে দেয় ৷
হাই রোডে স্পিড না নিলে গাড়ি চালানোই যাবেনা ৷ উঠেই কাঁটা সিক্সটির ঘরে ! আকাশ যেন থম মেরে ছিল এতক্ষণ, গরমটা বাইকের হাওয়ায় কেটে এবার বেশ চনমনে ভাব ৷ ঘামের গন্ধটা নাকে এসে আর ধাক্কা দিচ্ছেনা ! হুশ হুশ করে একটার পর একটা ওভারটেক করে এগিয়ে যেতে দারুন লাগছিল ! খিদেটা বেশ চনমনে হতেই আরো স্পিড বেড়ে গেল ৷ ভয় করছিল , কিন্তু কিছু করবার নেই !
পেলকু বার বার ফোন করছিল ৷ ওর পিসীর মেয়েরা আর থাকতে পারবেনা বলছে ৷ আমাদের কথা নাকি বারবার জিগ্গেস করছে ৷ লাস্ট বার বলল তাপসদার সাথে ছাড়া খেতে বসতে চাইছেনা ৷ এই সময়ই স্পিডটা বিচ্ছিরি বাড়ল ৷ পিছনে বসে থাকাটাকে মনে হচ্ছিল যেন অতিরিক্ত ৷ সেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের রিংটোনটা বেজে উঠতেই তাপসদা ছটফট করে উঠলো ৷ ছোটো জন ফোন করেছে বুঝতে পারলাম ৷
তারপর থেকে আর কিছু বুঝতে পারছিনা ! এমনকি মাথার মধ্যে থাকা অসহ্য যন্ত্রনাটা যে কিভাবে থামানো যাবে, সেটাও ! যে গাছটায় লেগেছিল সেটাও নাকি নয়ানজুলিতে উল্টে গেছে ৷ বাইকটা আস্ত নেই বোধ হয় ৷ কোমরের নিচ থেকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছেনা ৷ চার বছর পর এই প্রথম বার অরণি সংঘ কালিপুজোর দিন মাঠ থেকে মাথা নিচু করে ঘরে ফিরবে ! ক্র্যাচ নিয়েও যদি মাঠে যাওয়া যেত ! ........................................ ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment