Wednesday, July 14, 2021

আগন্তুক ছোট গল্প ©ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

 

  আগন্তুক ছোট গল্প

©ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী 

 

আরাম কেদারায় বসে সকালের রোদ পোয়াচ্ছি হটাত কলিং বেলটা বেজে উঠলো l এই সাত সকালে কে এলো? মঞ্জু আমার কাজের মাসিকে বললাম দোর খুলে দেখত কে এলো l

 

মেসো এক সন্ন্যাসী এসেছেন বলছেন উনি আপনার সঙ্গে এক কলেজে পড়তেন l অগত্যা উঠে পড়ি l আমার সঙ্গে কলেজে পড়তেন তিনি সন্ন্যাসী! কেমন আশ্চর্য লাগলো শুনতে l সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখি খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু নামটা ঠিক মনে করতে পারছিনা l

 

- ত্রিভুবন , আমি অর্ণব,অর্ণব চক্রবর্তী তোর সঙ্গে পড়তাম l ভুলে গেলি l তবে এখন আমার নাম স্বামী চিন্ময়ানন্দ l রামকৃষ্ণ মিশন ,কন্যাকুমারী আমার ঠিকানা l ভেতরে আসতে বলবিনা l

 

- আমি অপ্রস্তুতে পড়েযাই l জিভ কেটে বলি ক্ষমা করিস ভাই হঠাত চিনতে পারিনি l আমায় ভুল বুঝিসনা l ভেতরে আয় l তোকে এখন কেউ দেখলে চিনতে পারবেনা l কারণ তুই অনেকটা বদলে গিয়েছিস ভাই l

 

- হ্যাঁ তা হবে l তোরা সংসার ধর্মে এত ব্যাস্ত থাকিস সবাইকে মনেরাখা কঠিন ব্যাপার । একটা কথা মনে রাখিস সন্ন্যাসীরা কখনো রাগ , অভিমান, ঈর্ষা এসব করেনা l যে করে সে সন্যাসী নয় l- আমরা দুজনে আমার বৈঠক খানায় বসলাম l

 অনেক দিন আগের কথা ,আমাদের ক্লাসে নিবেদিতা নামে একটি মেয়ে পড়তো l ও সব মেয়েদের থেকে আলাদা  ছিল l দেখতে সত্যি যাকে বলে সুন্দরী কিন্তু খুব অহংকারী মেয়ে ছিল l কারুর সঙ্গে কথা বলতো না একমাত্র অর্ণব ছাড়া l অর্ণব পড়াশুনোয় ভালো ছিল l

 

এরমধ্যে গিন্নি চলে এলেন l আমি ওদের পরিচয় পর্ব টা সেরে নিলাম । দুজনে নমস্কার বিনিময় করলেন l গিন্নি বললেন আপনি চা খাবেন স্বামীজি l

- হ্যাঁ হলে মন্দ হয়না l

- এবার জানতে পারিকি তুই কি করে আমার ঠিকানা জানলি l আমায় ফোন করতে পারতিস আমি নিজে গিয়ে তোকে নিয়ে আসতাম l

- তবে আর ইংরেজরা সারপ্রাইস শব্দটা ভারতীয়দের মধ্যে গেঁথে দিয়েছে কেন l হঠাত দেখার মজাই আলাদা l কি বল? প্রথমেই বলেছি আমাদের ব্যাচ মেটদের নিয়ে যে ডায়রিটা ছাপানো হয়েছে ওতে সকলের ঠিকানা, ফ্যামিলি ফটো ইত্যাদি সব আছে l

- হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক l

- এবার তোর কথা বল l তুই কেন সন্ন্যাস নিলি?

এটার উত্তর দিতে গেলে আমার সম্পূর্ণ ইতিহাস বলতে হয় l তুই জানিস আমি পড়াশুনোয় বরা বর ই ভালো ছিলাম l স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করি l সেই সময় আমার সঙ্গে নিবেদিতাও ছিল আমার ক্লাসমেট l মনেপড়ে নিবেদিতা রে !

 - বাহ ভুলেগেলি !

- হ্যাঁ হ্যাঁ মনেপড়েছে । খুব অহংকারী মেয়েটা ছিল ।

- না ও আমার সঙ্গে সর্বদা ভালো ব্যাবহার করত । শোন , আমরা এক ক্লাসে পড়তাম বেনারসে l আমি হোস্টেলে থাকতাম ও ওর মাসির বাড়িতে থেকে ক্লাস করতো l এরমধ্যে সত্যি প্রেম বলে এক বস্তুর ব্যাপারটা উপলব্ধি করি l কিন্তু কেউ প্রকাশ করিনা । দুজনে বেনারসের গঙ্গার বুকে মণিকর্ণিকা ঘাট, হরিশ্চন্দ্র ঘাট ইত্যাদি নৌকা বিহার করি l আমি বোঝাতাম দেখ এই মণিকর্ণিকা ঘাটে কোনদিন চিতা নেভেনা । মানুষ জন্মানর পর মৃত্যু নিশ্চিত বলে জানে কিন্তু সেটা জেনেও নানা অপকর্ম করে । শেষটা তো দেখছ ওই আগুনে দগ্ধ হয়ে যাবে নশ্বর দেহ খানি । কি হবে এই অহংকার , টাকা ,পয়সা , প্রতিপত্তির ? কেউ ভাবেনা , সে এই দেহ ত্যাগ করলে কোন কিছু সঙ্গে নিয়ে যাবেনা তবুও মানুষের স্বভাব বদলায়না ।

- ও বলে তুমি ওই রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছ । সংসারে যখন জন্ম নিয়েছ সংসার ধর্ম পালন কর । তোমার সব কথা দর্শন শাস্ত্রের কিছু নিতি বাক্যের মতন ।

- ওটা তোমার ভুল ধারনা নিবেদিতা । আমিও মানুষ রক্ত মাংসের মানুষ । আমার মধ্যেও প্রেম, প্রীতি ,ভালোবাসা , দয়া , মায়া , ক্ষমা সব আছে কিন্তু সেটা ঈশ্বরের স্বত্বাকে উপলব্ধি করে তার প্রতি ভক্তিভাব রেখে জীবন তরী বাইতে হবে । নিজের কর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে এক শৃঙ্খলিত জীবন শৈলী নিজেকে বেছে নিতে হবে তবেই তুমি জীবনে এগুবে ।

 

- তুমি থাকো তোমার শৃঙ্খলিত জীবন শৈলী নিয়ে । তুমি আমাকে কখন বুঝলেনা ।

- আমি বুঝি সব বুঝি ।

- ছাই বোঝ ! আমি তোমার কাছে আছি অথচ তোমার কোন অনুভূতি নেই । তুমি আমাকে মড়া পোড়ানো দেখানোর জন্য এখানে আনলে ?

- তুমি আমাকে আঘাত করলে নিবেদিতা । আমি সত্যি সেরকম কিছু ভেবে তোমাকে আনিনি এখানে । আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি কিন্তু ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি সেটা দৈহিক নয় বরং মনের দিক থেকে ভালোবাসা । আমিতো তোমাকে আমার আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে বলিনি।ওটা সম্পূর্ণ আমার চিন্তাধারা ।

- ঠিক আছে এবার চল । সন্ধ্যে হয়ে আসছে । তোমার দ্বারা ওই বই পড়া আর লেকচার দেওয়া ছাড়া কিছু হবেনা । নিবেদিতা বলে মাস্টার্স ডিগ্রির পর তুমি কি করবে?

- আমি চট করে উত্তর দি পড়াশুনোর কোন শেষ নেই তাই পি. এচ. ডি অবশ্যই করবো যদি সুযোগ পাইত l তুমি ?

- আমি জানতাম তুমি ওই উত্তরটা দেবে বলে । না , আর আমার দ্বারা পড়াশুনো বোধহয় হবেনা l আমি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে l আমি সন্ন্যাসিনী হয়ে তোমার ছায়া সঙ্গী হতে চাইনা ।

- ও l আমি কিন্তু তোমাকে আমার ছায়া সঙ্গী হতে কোনদিন বলবোনা । তবে এইজন্য পড়া ছেড়ে দেবে ! এটা একটা যুক্তি হল ! আমি ওর দিকে তাকাই l

-উপায় নেই আমি মেয়ে l আমাকে, বাবা মার দিকটাও তো দেখতে হবে ।

- অবশ্যই দেখবে তবে নিজের কেরিয়ার পড়াশুনো তার জন্য জলাঞ্জলি দিতে পারনা l অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত l আসলে আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে পি.এচ.ডি. কর ।

- সম্ভব নয় । আমি বেনারস অবধি এসেছিলাম তোমার মতন এক মেধাবী পুরুষের সান্নিধ্য পাবো বলে । কিন্তু এখানে এসে দেখলাম তুমি পড়া আর ওই রামকৃষ্ণ মিশন ছাড়া কিছুই জাননা । পৃথিবীতে এসেছ তার বৈচিত্র্য অনুভব কর । জীবনকে উপভোগ কর । এটাই সংসার ধর্ম ।

যে বয়েসের যা ধর্ম তাই পালন কর । ছাত্রাবস্থায় ব্রহ্মচর্য পালন করেছ তার ফল পেয়েছ । এখন ভালো কোন চাকরি তুমি অনায়াসে পাবে । তবে ঠিক আছে পি.এচ.ডি তোমার স্বপ্ন সেটা পূরণ কর কোন বাধা নেই কিন্তু তা বলে সন্ন্যাস ! সনাতন ধর্ম কি বলে ১) ব্রহ্মচর্য , ২)গার্হস্থ্য , ৩)বানপ্রস্থ , ৪) সন্ন্যাস । তাই সংসার ধর্ম পালন না করে এক লাফে সন্ন্যাস নেওয়া মানে ভগবানের সৃষ্টির বিরুদ্ধে যাওয়া নয়কি ? ওই স্বামীজিরা তোমার মগজ ধোলাই করেছেন ।এবার চল ।

 

- আমার দীক্ষা হয়নি তবে স্বামীজি বলেছেন নিজের যোগ্যতার জন্য তোমাকে আরও পড়াশুনো করতে হবে l রামকৃষ্ণর পথ অনুসরণ করতে চাও তার জন্য নিজেকে যোগ্য প্রমাণ কর l নিজেকে বিকশিত কর l জ্ঞানের শেষ নেই l জ্ঞানী তাকেই বলে যে সংসারের সমস্ত মোহ মায়া ত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে নিজেকে উৎসর্গ করে, জ্ঞান বিতরণে নিজেকে প্রস্তুত করে l জ্ঞান আহরণের যেমন শেষ নেই জ্ঞান বিতরণের ঠিক সেইরকম শেষ নেই l

- আমি ডক্টরেট এর জন্য সিলেক্ট হয়েছি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে l আমার ফেলোশিপ মঞ্জুর হয়েগেল l যা টাকা পেতাম আমার পড়াশুনোর খরচ,খাওয়া দাওয়ার, হোস্টেলের খরচ সব ঐ টাকায় হয়েযেত l

- তোর নিবেদিতার কি হল?

- আমার নিবেদিতা ? ও কখনই আমার ছিলোনা । ও চেয়েছিল আমাকে পথভ্রষ্ট করে ওর অনুগামী করে ওর গোলাম করে রাখা । সেটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়

- সেকিরে ওর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখিসনি?

- না আমার লক্ষ অন্য ছিল l উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে গেলে ওসব দিকে মন না দেওয়াই ভালো l আমার গুরুজী তাই বলেন l ঠিক বললাম?

- ঠিক বলেছেন আমার গিন্নি বলেন। হাতে চায়ের কাপ আর জল খাবারের ডিস নিয়ে গিন্নি আমাদের পরিবেশন করেন l নিন অনেকক্ষণ কথা বলছেন একটু গলা ভিজিয়ে নিন l

একসঙ্গে সকলে বসে চা জলখাবার খেলাম l

গিন্নি রান্নাঘরে চলে যান আজকের রান্না করতে l আজ অর্ণব আমাদের বাড়িতেই মধ্যহ্ন ভোজন করবে ।

অর্ণব বলা শুরু করে l আমি Ph. D থিসিস জমা দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী নি l সব সময় শ্রী রামকৃষ্ণর আশীর্বাদ পেয়েছি তাই মনে মনে স্থির করি এইবার দীক্ষা নিয়ে নিজের জীবন পরম পুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসর আশ্রমেই কাটাবো l

 

   ©ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

  ১৫.০৭.২০২১ সকাল ১০.১৭ 

  শব্দ সংখ্যা ১১৯৪ 





 

No comments:

Post a Comment