Monday, May 8, 2017

অমলেন্দু চন্দ ৯:০৮ AM | রবীন্দ্রনাথের গান


      
৯:০৮ AM | 
রবীন্দ্রনাথের গান

বাঙালীর কাছে রবীন্দ্রনাথের গানের এক চিরায়ত আকর্ষণ রয়েছে। অনেক পাশ্চাত্য সঙ্গীতবিদ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছেন। সময়ের সাথে সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ফিরে ফিরে দেখার নতুন করে ছুঁতে চাওয়ার  অদম্য স্পৃহার দেখা মিলছে।  গানের তন্নিষ্ঠ বিশ্লেষন করার অধিকারী আমি নই, তবু তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক দিক গুলো বাদ দিয়েও সব ক্ষেত্রেই গানের একটা রুপ ফুটে ওঠে আমাদের কাছে  আর এই রুপ মাধুর্যের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত অতুলনীয়। কি আছে সেই রুপে? খুব সীমিত শব্দে সেই রুপের আভাষ ধরার চেষ্টা বাতুলতা তবুও তাঁর গানের অন্তঃস্থল ছোঁয়ার  একটা প্রচেষ্টা করায় দোষ দেখি না, কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের শব্দ সুর আর কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অভাবিত বিস্ময়ের জগৎ ।

রবীন্দ্রনাথ মুহম্মদমনসুর উদ্দিনের বাউল গান সংকলনের প্রথম খণ্ডের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, সেটা ১৯২৭ টাতাশ হবে, যখন মনসুর উদ্দিনের বয়েস খুব বেশী হলে তেইশ বছর, এর পরে বহুকাল ধরে মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন এগারো খণ্ডে এই লোকশিল্প সংগ্রহ সংকলিত করেন -
মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন বাউল-সঙ্গীত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এ সম্বন্ধে পূর্বেই তার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে আলাপ হয়েছিল, আমিও তাকে অন্তরের সঙ্গে উৎসাহ দিয়েছি। আমার লেখা যারা পড়েছেন, তারা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল-দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ রাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউলসুরের মিল ঘটেছেতিনি এইখানে তাঁর শিলাইদহে জমিদারী দেখা শোনা করার সময়ের কথা বলেছেন, সময়টা ১৮৯০ থেকে ১৯০১ এর মধ্যে, এর পরেও তিনি শিলাইদহ, পাতিসর  গিয়েছেন, কিন্তু শিলাইদহ পর্ব বলতে মুলত ওই সময়টাকেই বোঝায়।

বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সময়ের প্রসঙ্গে তাঁর লেখালেখিতে বলছেন- আমরা যখন শিলাইদহে ছিলুম তখন রোজ রোজ আমাদের বোটে সেখানকার গ্রাম্য গাইয়েদের আমদানি হত । একজন বোষ্ণম- সে কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গান গাইত, আর একজন নেড়ে এবং বাচ্চা- তার গান নানারকম । তার নাম সুনা-উল্লা।  প্রতিদিনের পালার জন্য বরাদ্দ থাকত দু আনা

গান একটি প্রয়োগশিল্প, এই প্রয়োগশিল্পের উৎকর্ষ শুধুমাত্র ভাষার ওপরে নির্ভরশীল নয়। এসব বাউল গানের জাদুকরী অন্তর্নিহিত ভাবের আকুতির প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন সেই মুখবন্ধেঃ
 অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটি শুনলুম, তার গেয়ে ওঠা স্বরে, সহজ ভাষায়যাকে সকলের চেয়ে জানবার তাকেই সকলের চেয়ে না জানবার বেদনাঅন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু, তারই কান্নার সুরতার কণ্ঠে বেজে উঠেছে ......ভাষার সরলতায়, ভাবেরগভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না, তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্য রচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোক-সাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে

বাউল গানের আরাধ্য সাধন ও তত্ত্বজ্ঞান যা মুলে মনে করে  সবার ওপরে মানুষ সত্য সেই মর্মকথার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেনঃ
আমাদের দেশে যারা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তারা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্যদেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্য আর বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি...আজকের এই সময়ে  মানুষে মানুষে সম্পর্কের সম্বন্ধের পারম্পর্য অনেক বদলে গেছে, সাম্প্রদায়িকতা ভীষণ ভাবে যখন আমাদের আতঙ্কিত করে তখন মনে না করে উপায় থাকে না যে একটা মৌল সত্যির সুর বেজেছে তাঁর এই সব কথায় যার ভেতর একটা আবহমান রয়েছে।

সুনা উল্লাহ্‌ র গাওয়া গান গুলিকে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে বলেন্দ্রনাথ নথীবদ্ধ করেন, সেই সব গানের মধ্যে গগণ হরকরার গাওয়া দু তিনটি গানের কথা রয়েছে।গগণ দাস, লালনের শিষ্যধারার একজন, সেই গগণের গাওয়া গানের কথা ও সুরেররবীন্দ্রনাথের হয়ে উঠলেন এক ভীষণ ভক্ত। এই সময়ে তিনি ঠাকুর পরিবারের জমিদারির বেতন ভোগী কর্মচারী, যুবক রবীন্দ্রনাথ বয়েস তিরিশের কোঠায় - দেবেন্দ্রনাথ তখনও  জমিদারির সর্বস্বত্ত্ব তাঁর হাতে কোবালা করে তুলে দেননি। বাউল গানের সুর তাল লয়ের  প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অনেক বছর পরে বলেছেন যে বাউল সুরের বৈশিষ্টই হইল সে একঘরে, ওস্তাদের রাগ রাগিণী যতই চোখ রাঙাক সে কিসের কেয়ার করে। এই সুরগুলিকে কোথাও রাগকৌলিন্যের জাতের কোঠায় ফেলা যায় না, তবু এদের জাতের পরিচয় সম্বন্ধে ভুল হয় না, স্পষ্টই বোঝা যায় যে এ আমাদের দেশেরই সুর...তিনি আরও বলেন “...ঔপনিষদীয় অন্তরতর য়দয়মাত্মা র বাণী যখন এদের মুখে মনের মানুষ শব্দে বেজে উঠল তখন বড়ই বিস্ময় জেগেছিলএই মনের মানুষই রবি কবির জীবনদেবতা

শিলাইদহে থাকার এই সময়ে বেশ কয়েক বছর রবি ঠাকুরের গোঁসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টুমী ও আরও অনেক লালনের ভাব ধারার শিষ্য র সাথে ও তাদের সুর ও গানের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচিতি হয়, যা বলেন্দ্রনাথ নথীবদ্ধ করতেন কাকাবাবুর নির্দেশনায়। বোষ্টুমীর সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার গল্প তাঁর নিজের ভাষায় পরে বলছি। বাউল সুরের চিন্ময়তায় তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন রাগ রাগিণীর কাঠামোর বাইরের মানুষের অন্তরের সুর।সেই অন্তরের আচমন আহ্বানের সুর বেজে ওঠে যেখানে তিনি লিখেছেন
বেসুর বাজে রে / আর কথা নয়/ কেবল তোরই আপন মাঝে রে...”– চূড়ান্ত আত্মনিবেদনের ভাব তাঁর গানে বেজে ওঠে যখন তিনি লেখেন আমার জীবনে তব সেবা তাই বেদনার উপহারে” – তাঁর ব্যাথা তাঁর যন্ত্রনা সে তো সেই আমির অন্তস্থ আমি কেই খুঁজে চলেছে, যে খোঁজের স্বরুপের উদ্ভাস এই সব লাইন।

অ্যান ইণ্ডিয়ান ফোক রিলিজিওন প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন (এগুলি তিনি ইংরেজিতে তাঁর নিজস্ব কিছু প্রবন্ধকে সংকলিত করেন তাঁর ইংল্যান্ড আমেরিকার বন্ধু এবং আগ্রহী কবি লেখক সমাজবেত্তা সুধীজনদের জন্য অরিজিন্যাল বাংলা লেখাগুলি আগের হলেও এই লেখাগুলি তিনি ইংরেজি ১৯১২ সনের আশে পাশে ট্রান্সলেট করেন বোধহয় যখন গিতাঞ্জলী ইংরেজি তে প্রকাশিত হচ্ছে ইয়েটস এর তত্ত্বাবধানে এর এক বছর পরেই তিনি নোবেল পান) সেই ক্ষেপি বোষ্টুমীর সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্প -
“ One day in a small village in Bengal an ascetic woman from the neighbourhood came to see me.  She had the name ‘Sarva-khepi’ given to her by the village people. ..She fixed her star-like eyes on my face and startled me with the question ‘when are you coming to meet me under the trees?’ ….. In the same village I came in touch with some Baul Singers....Time came when I had the occasion to meet with some members of the same body and talk to them about spiritual matters. The first Baul song, which I chanced to hear with any attention, profoundly stirred my mind.”

তিনি এইখানে কোথায় পাবো তারে  র কথা বলছেন। তিনি বলছেন 
 “The man of my heart – to the Baul, is like a Divine instrument perfectly tuned… The name of the Poet who wrote this poem was Gagan. He was almost illiterate, and the ideas he received from his from his Baul teacher found no distraction from the self-consciousness of the modern age…”

গগণ হরকরা  আনুমানিক রবি কবির থেকে বছর পনেরো ষোলর বড় ছিলেন। রবি ঠাকুর তাঁর গানকে আত্মস্থ করে তাঁর গভীর এ অবগাহন সেরে একটি নতুন গীতরুপ দিয়েছেন ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গগণ তখন সম্ভবত সদ্য সদ্য এ দুনিয়া ছেড়ে  গেছেন বা তাঁর জীবনের শেষ ভাগে দাঁড়িয়ে আছেন। ১৯০৫-১১ র বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রবি কবি ওই গানটা বাঁধলেন, আর আনুমানিক ১৯১০ সালে গগণ হরকরা গত হন। এর কয়েক বছর পরে ১৯১৫ সনে র প্রবাসী পত্র র বিশেষ সংখ্যায় গগণ হরকরার গানের মুল রুপ টি তাঁর মনের ভাবনা সহ প্রকাশিত হয়।রবি ঠাকুরের বোনঝি সরলা দেবী সম্ভবত এর আগে ভারতী তে একটি প্রবন্ধ লেখেন লালন ফকির  ও গগণ হরকরা নাম দিয়ে বিশেষ করে গগণ হরকরার দুটি গান তাতে ছাপা হয়  কোথায় পাব তারে  আর আশার মায়ায় ভুলে রবে

রবীন্দ্রনাথের গানে উপনিষদের প্রভাব এক ঐশী উপস্থিতির মত। তাঁর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাউল অঙ্গের সুষমা।বাউল গানের দেহতত্ত্ববাদ ঔপনিষদীয় আত্ম-মুক্তির ভাবময় সংরচনায় উদ্ভাসিত যার সাথে সূফীবাদের অলৌকিকত্বের দ্রবণ তাঁর গানকে দিয়েছে সহজিয়া অনন্য রুপময়তা। তাই তো রবি কবির গানে বিরাজমান সত্ত্বাটি সেই এক এবং অদ্বীতীয়র উপলব্ধি।

আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণ সখা বন্ধু হে আমার...  গানটি হয়ত নদীর বুকে বোটে বসেই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে লিখেছিলেন। কিন্তু গানটি শুধু নেহাতই কোনও বর্ষার গান না হয়ে হয়ে ওঠে এক আধ্যাত্মিক প্রেম ও পুজার রুপ।প্রকৃতি আর তাঁর গানের ভেতরের ভাবের প্রসঙ্গে তিনি ছিন্নপত্রাবলীর একটি চিঠিতে লিখছেন – “যতবার পদ্মার ওপরে বর্ষা হয় ততবারই মনে করি মেঘমল্লারে একটা নতুন বর্ষার গান রচনা করি, কথা তো ওই একই, মেঘ করেছে, বৃষ্টি পরছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে  কিন্তু তাঁর ভেতরকার নিত্যনতুন আবেগ, অনাদি অনন্ত বিরহ-বেদনা যা কেবল গানের সুরেই প্রকাশ প্য... চিঠিটি তিনি ১৮৯৫ সালে লিখেছিলেন, যখন তাঁর শিলাইদহ পর্ব চলছে।
চরিত্রের যে গীতধর্মিতা তাঁর সৃজনী প্রতিভা কে মনময় করে তুলেছিল সেই মনোধর্ম তাঁর গানেগানে গেয়েছে। এই প্রকৃতিপ্রেমের অনন্য প্রকাশ  আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো / আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করেই চাও গো...

অক্সফোর্ডের ম্যানচেস্টার কলেজে ১৯৩০ সালে ডব্লিউ এইচ ড্রুমণ্ড এর আমন্ত্রনে রবীন্দ্রনাথ কত গুলো লেকচার দেন যা পরে বইয়ের আকারে ম্যাক্মিলান বার করে “The Religion of man”– তাঁর মধ্যে তিনি বলেছেন
“The religion of man had been growing in my mind as a religious experience and not merely as a philosophical subject”তাঁর গানের গভীর বোধ তাঁর জীবন  চর্যার মধ্যে দিয়েই এসে আসন পেতেছে।লালন ভাবতেন দেহের নির্মাতা দেহের মধ্যেই বাস করেন। এই মৌলিক অবলম্বন আর গভীর বোধেই বাংলার গানের হাজার বছরের নির্মিতি যা এক অনন্যতায় ভাস্বর রবীন্দ্রসঙ্গীতে।এই অনুপমের সন্ধানই তাঁর গানের কথায় বেজে ওঠে  ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারেলালনের দেহের নির্মাতা দেহের মধ্যেই বাস করেন তত্ত্বের  অপরুপ প্রকাশ ঘটে রবি কবির গানে আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তায় হেরি তাই সকল খানে

পনেরো জন ভাই বোনের একজন আমাদের রবিকবি। জীবনের বহু অবমাননা অসহ্য দুঃখ চরম আঘাত কে সুরে ঢেলেছেন যা একই সঙ্গে মর্মবিদারী বিষণ্ণতা আবার নিঃসীম প্রশান্তির রুপকল্প হয়ে গেছেঃ
আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে এ গানটি তিনি লেখেন ১৯০৩ সালে  সে বছরই দ্বিতীয় কন্যা রানী মারা গেছে, তাঁর আগের বছর স্ত্রী মৃণালিনী।
একটা গোটা জীবনদর্শন গভীরতম জীবনবোধের রস রঙ রুপ বর্ণ নিয়ে উপস্থিত সেখানে। কবি বিহারীলালের ছেলে শরৎকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন আর এক প্রিয়তম আত্মজার। বেলার চূড়ান্ত শরীর খারাপের মুহুর্তে কবি যখন বিহারীলালের শ্রীরামপুরের বাসায় যেতেন মেয়েকে দেখতে কথিত যে তখন শরৎকুমার তাকে চূড়ান্ত অপমান করতেন কারন বোধহয় শরৎকুমারের ধারণা ছিল ঠাকুরবাড়িতে শরৎকুমারের অবমাননার মুলে ছিলেন রবিঠাকুর।
জানকীনাথ বসুকে লিখিত চিঠিতে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর গান সম্বন্ধে, সে প্রায়বেলার মৃত্যুর (১৯১৮)বেশ কিছু বছর  পরে  সেখানেও সেই ব্যথা বেজেছে এরকম করেঃ
তোমাদের কাছে আমার মিনতি তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমি আমার গান বলে চিনতে পারি, আজকাল আমি অনেক সময়েই আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় যেন আমি লিখেছি বটে কিন্তু সুর টা আমার নয়। মেয়েকে অপাত্রে দান করলে যেমন সব কিছুই সহ্য করতে হয়, এও যেন সেরকম...। আমাদের শাস্ত্রে বলে দুহিতা কৃপণঃ পরং ... গানও যেন তেমনি, কথায় কথায় ওর কপাল ভাঙে...

অথচ সেই একই গুরুদেব পঙ্কজ মল্লিককে খোদ খোদার ওপরে খোদকারী করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন নাকি সীমিত মাত্রায় বলে শোনা যায়। জানকী নাথ কে লেখা চিঠির বছর চারেক পরেই তিনি গত হন। তাঁর নিজের গানের গায়ন সম্বন্ধে প্রফুল্লকুমার মহলানবিশ কে লেখা একটি চিঠিতে লিখেছিলেন – “বুলাবাবু তোমার কাছে আমার সানুনয় অনুরোধ এদেরকে একটু দরদ দিয়ে একটু রস দিয়ে গাইতে শিখিও, এইটা আমার গানের বৈশিষ্ট, তাঁর ওপরে যদি তোমরা স্টীম রোলার চালিয়ে দাও আমার গান যে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে

কথিত যে রবি ঠাকুর অল্পবয়েসে বিষ্ণু চক্রবর্তী নামে তৎকালীন রাগ সংগীতের এক বিশেষজ্ঞের কাছে মার্গ সংগীত সাধনা তালিম নেন। এ ছাড়া তিনি সংগীতজ্ঞ শ্রীকণ্ঠ সিংহের থেকে গান সম্বন্ধে অনেক কিছুই আয়ত্ত করেন। তিনি শ্রীকণ্ঠ সিংহের সম্বন্ধে বলেন যে উনি তো গানেই থাকেন, গান তিনি দিতেন আর আমি কখন তুলে নিতুম নিজেই জানতুম নাতবে রবীন্দ্রনাথের সংগীত চেতনার প্রসঙ্গে কিছু বলতে হলে তাঁর জ্যোতি দাদার কথা না বললে সব কিছু অপূর্ণ থেকে যায়। তাঁর ভাষায় পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নতুন নতুন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাঁহার অঙ্গুলি নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুরবর্ষণ হইতে থাকিত। ... তাঁহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত থাকিতাম

পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাবের গৌরচন্দ্রিকা রবীন্দ্রনাথের জীবনে এভাবেই হয়েছিল। এ ছাড়া প্রাদেশিক গান সুর ও তাকে প্রভাবিত করেছে। তিনি গ্রহণ করেছেন অ্যাসিমিলেট করেছেন সে সব, তাঁর অনন্য সব গানে  যেমন আনন্দলোকে মঙ্গলালোকেবা এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে মহীশুরের ঘরানায়, কর্ণাটকী সুরের ছায়ায় লেখা বড় আশা করে” , আবার মাদ্রাজী সুরে বাজে করুণ সুরেএমনকি ঠুমরী যা কিনা নিতান্তই দরবারী সংগীত ধর্মী শিল্প তাঁকে বাঙালীর করে তুলেছেন খেলার সাথী বিদায়দ্বার খোলো, দাও বিদায়

বহুর প্রতি এই টান আর সেই সবের সৌন্দর্য আর বৈচিত্র কে গ্রহণ করার সামর্থ্য তেই রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পদময়। বাবার সাথে অনেক ঘুরে বেরয়েছেন রবি, আর সেই সব সময়ে দেখেছেন যে তিনি তাঁর কিশোর কণ্ঠে যখনই ঔপনিষদীয় মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে গান ধরেছেন বাবা জোড় হাত করে চোখ বুজে মগ্ন হচ্ছেন  বোধহয় সেই সুত্রেই রবি ঠাকুরের কাছে গান এবং ধ্যান মধ্যে এক ধরনের সম্পর্কের সুত্রপাত।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম বৈশিষ্ট হল তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে তাঁকে আজও আবিষ্কার আর পুনরাবিষ্কার করা যায়।কথিত যে মধ্যরাতে বাতসের শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে নাকি লিখেছিলেন বাদলের বায়ে প্রদীপ নিভায়ে জেগে বসে আছি আঁধারে...

কাছ থেকে এই মানুষটাকে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্যের প্রযত্নেই হয়ত শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বাউল বইতে লিখেছেন “...প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের বহু গানেই বার বার তিনি এক গভীর বেদনায় আপ্লুত হয়েছেন। অনুভব করেছেন কোনও এক প্রিয়ার অনুপস্থিতি। এই প্রিয়াই কি তাঁর জীবন দেবতা বা তাঁর মনের মানুষ...

 রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছিলেন বাংলার নিজস্ব প্রাণের গানের ওপরে  বাউল বৈষ্ণব কীর্তন তাঁর ছন্দ আর ভাবের স্বাতন্ত্র  কীর্তনাঙ্গের গান তাঁর ঝুলিতে হয়ে ওঠে ওহে জীবনবল্লভ ওহে সাধনদুর্লভ বা মাঝে মাঝে তব দেখা যেন পাই বা সেই বিখ্যাত প্রেমের গান ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখ...

তাঁর গানের কাব্যাংশে তিনি অনেক বেশী স্বতন্ত্র ছিলেন যা অনন্যতায় স্বকীয়। কবি জানতেন একদিন চলে যেতে হয়, জীবনের তিন চতুর্থাংশের বেশী সময়ের শ্রম আর সাধনার ফসল তিনি রেখে গেছেন তাঁর গানে গানে।এই গান ভালবেশে গানের  দীক্ষায় আমরা কত সহজে গেয়ে উঠি তাঁর গান। এ ভালবাসার আত্মজ অনুভুতি কে কোনও কাল অপহরণ করতে পারবে না।
এই নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত চিরচৈতণ্যের ভালবাসায় আমরা ভেসেই আছি।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার 
রবিজীবনকথা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
ছিন্নপত্র  রবীন্দ্রনাথ
স্মৃতিসম্পুট,রবীন্দ্রস্মৃতি  ইন্দিরা দেবী
জীবনস্মৃতি  রবীন্দ্রনাথ
The compete woks of Rabndanah Tagoe (web vesion)
e-banglalibrary.com

ও অন্যান্য ওয়েব থেকে সংগৃহীত তথ্য

Wednesday, May 3, 2017

কেয়া চক্রবর্তী মৃত্যু - হত্যা ? দুর্ঘটনা ? আত্মহত্যা ?


  কেয়া চক্রবর্তী মৃত্যু - হত্যা ? দুর্ঘটনা ? আত্মহত্যা ? 
   


অঞ্জন দত্ত 
১৩ মার্চ রবিবার সকাল দশটায় পোর্ট পুলিশের লঞ্চ সাঁকরাইল থেকে এক ঘণ্টার উজানে হীরাপুরের কাছে কেয়া চক্রবর্তীর মৃতদেহ উদ্ধার করে, জানাচ্ছে পরদিন ১৪ মার্চের ‘আনন্দবাজার’। ‘কেয়ার মৃতদেহে তিন চারটি ক্ষত দেখা দেয়। তাঁর হাত দুটি ভাঙ্গা। মুখে আঘাতের চিহ্ন। তাঁর হাত ভাঙলোই বা কি করে?… গঙ্গার জলের তোড়ে, স্টিমারের প্রপেলারের ঘায়ে? না ধস্তাধস্তির চোটে…?’ লিখছে এক হপ্তা পর ২০ মার্চের ‘যুগান্তর’।
আসল কেয়া নিজের জীবনখানায় ছিলেন কেমন?
নীললোহিতের একটা উপন্যাস আছে ‘তোমার তুলনা তুমি’। উপন্যাসের ওই নামখানা কেয়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু কেয়ার তুলনা বোধ হয় কেয়া কেবল নিজেই। একদিকে স্কটিশ চার্চ কলেজের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে নিরন্ন গ্রুপ থিয়েটারে হোল-টাইমার হতে চাইছেন। অন্যদিকে সশস্ত্র নকশালদের হাত থেকে অসহায় তরুণকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন নির্দ্বিধায়, ধস্তাধস্তিতে খুলে যাচ্ছে পরনের শাড়ি। একদিকে নিজের বিয়ের গয়না আর মায়ের জমানো গয়না বেচে দাঁড় করাতে চাইছেন অজিতেশ-রুদ্রপ্রসাদের ‘নান্দীকার’। অন্যদিকে নিজের খরচ চালাতে জুতোর কোম্পানিতে (‘বাটা’) বসে বিজ্ঞাপনের কপি লিখছেন নীরবে।আর দুর্দম সাহসে মা’কে নিয়ে একাই বেড়াতে যাচ্ছেন নাগাল্যান্ড-মণিপুর। এবং মায়ের বুকে পেস-মেকার বসানোর খরচ টানতে শেষটা সিনেমায় নামছেন।
কার্যত দেশের শেষ প্রান্ত নাগাল্যান্ড-মণিপুরে বেড়াতে যাওয়ার নামে আজও অ্যাভারেজ বাঙালি চারবার ভাবে, কোন নামী ভ্রমণ সংস্থা ওসব রাজ্যে বেড়ানোর ট্যুর অ্যারেঞ্জ করে না। আর কেয়া ব্যাপারটা সেরে ফেলছেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেই !
আইএ পাশ করার পর হঠাৎ ঠিক করলেন রাতের কলকাতা দেখতে বেরোবেন। তাই-ই করলেন। দেওয়াল পত্রিকায় বন্ধুরা যখন কাঁচা হাতে মকশো করে, তখন তিনি লেখেন নিখুঁত সনেট। হইহই পড়ে যায় তা নিয়ে।যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, তখন কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর নিবন্ধের বিষয় হয় ‘রবীন্দ্রমানসে মৃত্যু’। তিনি লেখেন, ‘অন্ধকারের ঝরনা থেকে আমাদের জীবন শুরু। অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মধ্যেই মৃত্যুর আক্রমণ। মানুষ কিন্তু কোনও দিনই মেনে নিতে পারেননি মৃত্যুর এই আক্রমণ।’’
অধ্যাপনার চাকরি পেলেন। নিজেরই কলেজে। কৃতজ্ঞতা জানাবেন মাস্টারমশাইকে। সটান চলে গেলেন স্টাফ রুমে। ‘গুরু’ তরুণ সান্যালের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এলো চুল তাঁর পায়ে বিছিয়ে দু’পায়ে চিমটি কেটে বললেন, ‘‘গুরুদক্ষিণা।’’
কালে কালে অভিনয়ের নেশা ওঁকে বুঁদ করে ফেলল। পড়ুয়া থাকার সময়ই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে উনিশ বছর বয়েসে নান্দীকার-এর ‘চার অধ্যায়’-এর এলা হলেন। শুধু যে অভিনয় তা নয়, দলের প্রত্যেকের সুখদুঃখ, টাকাপয়সা, সেটসেটিং, পোশাকআশাক, বিজ্ঞাপন লেখা, টিকিট ছাপানো, এর পরে কী নাটক হবে, কেমন করে হবে, সবেতেই তিনি। এমনকী আলাপ-আলোচনায় তর্কযুদ্ধেও। সে’ও ভারী সিরিয়াস ঢঙে। একবারের কথা যেমন। নান্দীকার-এর ঘরে তমুল তর্ক সে দিন। অজিতেশ বনাম কেয়া। সন্ধে পেরিয়ে রাত....পরদিন দেখা গেল কেয়া আসছেন রিকশা চেপে। সঙ্গে অসংখ্য বই। তার পাতায় পাতায় কাগজের ‘ফ্ল্যাপ’ লাগানো। এ দিনও তর্ক শুরু হতে একের পর এক বই খুলে নমুনা, উদ্ধৃতি দিতে থাকলেন। একটা সময়ের পর হার মেনে নেন কেয়ার ‘অজিতদা’।
অভিনয়টা যখন করতেন তাতে যে কতটা সম্পৃক্ত হতেন, দেখা যেতে পারে সাহিত্যিক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষের বয়ান থেকে।— ‘‘আন্তিগোনে দেখবার স্মৃতিটা আমার সাঙ্ঘাতিক। সাধারণত কেয়া-রুদ্র (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) যখন আমাকে নেমন্তন্ন করত তখন একটু আগেই আমি যেতাম। ব্যাপারটা হত অদ্ভুত। কেয়া তখন শিশু হয়ে যেত। অপেক্ষা করত যে ও স্টেজে ঢোকবার আগেই যাতে আমার সঙ্গে দেখা হয়। ... ওই দিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ... ঢোকার মুখেই রুদ্রর সঙ্গে দেখা। রুদ্র আমাকে একেবারে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল সাজঘরে। আমি কেয়াকে খুঁজে পাইনি। এ রকম আমার একদম হয় না। তারপর আমি দেখলাম, কেয়া আর নেই। আন্তিগোনে বসে আছে। পুরোপুরি। কেয়া আমার হাতটা চেপে ধরল।’’
তাঁর ‘তিন পয়সার পালা’ দেখে গৌরকিশোর সোজাসুজি বলে দেন, "কেয়ার মতো অভিনেত্রী বাংলায় আসেনি।’’
মায়ের ‘পেসমেকার’ বসানোর দিন শো করতে পারেন কেউ? তা’ও আবার একটা নয়, দু-দুটো! পৌনে তিনটে নাগাদ হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকলেন। দুটো শো করে কাউন্টারের সামনের সিঁড়িতে বসে পরের দিনের বিজ্ঞাপনের ‘ম্যাটার’ তৈরি করলেন। তার পর আবার ছুটলেন হাসপাতাল।
বিয়েতে শুভদৃষ্টি হচ্ছে। তখনও নাটক। এমনিতে পুরোহিত ইত্যাদি ছিল না। বোধ হয় লঘুচ্ছলে ওই আচারটুকুই হচ্ছিল। ‘‘সেই সময় অজিতেশবাবু এলেন। সম্ভবত তখন ‘তিন পয়সার পালা’ চলছে। ...কেয়া চেঁচাতে লাগল... ‘পরের শো কবে? কী? কোথায়?’ কোনও ক্রমে দু’জনকে থামানো গিয়েছিল,’’ স্মরণ বন্ধু ইন্দিরা দে-র।
বেতারে তখন একটা পরীক্ষামূলক সাহিত্য-অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। রিডিং ড্রামা। একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী একটি নাটক একাই পড়ে যাবেন। সংলাপের মাঝে দৃশ্য-নির্দেশও পড়তে হবে নির্লিপ্ত গলায়। নাটক ঠিক হল কবি কৃষ্ণ ধরের ‘বনজ্যোৎস্না’। চারটি চরিত্র। দু’জন পুরুষ। দু’জন নারী। কেয়াকে ধরলেন প্রযোজক। উনি তখন ঘোরতর শয্যাশায়ী। তাতে কী, শুনেই বললেন, ‘‘বাহ্, বেশ নতুন রকমের তো। আমি করব।’’তাঁর অসুখের কথা ভেবে স্ক্রিপ্ট পাঠানোর কথা উঠল বাড়িতে। তারও দরকার পড়ল না। আধ ঘণ্টার মধ্যে ট্যাক্সি করে হাজির হয়ে গেলেন ‘আকাশবাণী’। সে দিনের মতো আলোচনা সেরে পরদিন দিব্যি রেকর্ডও করলেন।
একটি সাক্ষাৎকারে কেয়াকে বলতে দেখা যায়, ‘‘যদি মহিলা প্রকৃত অর্থেই সাধিকা হন, তা হলেই কিন্তু তাঁকে সামাজিকভাবে নিন্দিত হতে হবে। তাঁর স্বামী হয়তো, যে গান শুনে এক কালে তাঁকে ভালবেসেছিলেন, সেই গানের চর্চায় বেশি মন দেবার অপরাধে, পাশের বাড়ির বৌটিকে দেখে আহ্লাদিত হবেন— ভাববেন— আহা বৌটি কেমন সুন্দর, সংসার করে, রাঁধাবাড়া করে, সেজেগুজে থাকে। আর যে-মা অসুস্থ ছেলেকে ছেড়ে শো করতে গেল, তাকে তো ডাইনি মনে করা হবে।’’ স্পষ্ট ভাষায় কেয়া বলে দেন, বিছানা, রান্নাঘর, আঁতুড়ঘরের বাইরের জীবনে যেতে স্ত্রীদের ভূমিকা স্বামীরা কতটা মানতে রাজি, তার ওপরেই নির্ভর করে ঘরনির চৌকাঠ পেরনো !
মঞ্চটা তাঁর মন্দির হলেও কলেজে পড়াতে যে কোনও খামতি ছিল, তা কিন্তু নয়। বরং তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা ‘ইনোভেশন’ কাজ করত। ভাবনার ঋজুতা, জিতে নেওয়ার জেদ, আগলে রাখার মন চোখে পড়ত।বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রী, যারা ইংরিজি বলতে গিয়ে থমকায়, কলেজ বসার আগে তাদের লাইব্রেরিতে আলাদা ক্লাস নিতেন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে ‘ওথেলো’, ‘হ্যামলেট’-এর রেকর্ড আনিয়ে শোনাতেন। উচ্চারণ শুধরে দিতেন।
‘‘(কেয়াদি) ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ পড়াতেন জেনারেল ইংলিশ ক্লাসে। অনার্সে ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’। ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অভিনয় করাতেন। তাদের তর্কবিতর্কে টানতেন। এটাই ওঁর পড়ানো,’’ একটি লেখায় বলেছেন তাঁর ছাত্রী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়। কেউ কেউ আবার বলেন, এক-এক সময় মনে হত, ক্লাসের ডায়াসটা হয়ে উঠেছে নাটমঞ্চ।পড়ানোর আগে-পরে চলত নানা ধরনের গল্প। ঠিক গল্প নয়, শিল্পীর আত্মদানের কাহিনি। ‘‘লরেন্স অলিভিয়ার যখন ওথেলো অভিনয় করেন, তখন কী ভাবে হরমোন ইনজেকশন নিয়ে চেহারার বদল এনেছিলেন... ওঁর বলাতে গায়ে কাঁটা দিত,’’ স্মৃতি বোলানের।
১৯৭৭। ১৪ মার্চ। শহর জুড়ে সবার গন্তব্য সে দিন উত্তর কলকাতার ২০এ, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট। সন্ধে নামার একটু আগে শববাহী কাচের গাড়িতে ওই বাড়ির সামনে আনা হল অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তীকে। শ্যাওলা রঙা মুখটুকু তখন জেগে শুধু। সারা শরীর ফুলে মোড়া।
দু’দিন আগে ‘জীবন যে রকম’ ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে মাঝগঙ্গায় তলিয়ে যান তিনি। আগের দিনই সকালে সাঁকরাইলের ঘাটে ভেসে ওঠে তাঁর দেহ। রাস্তায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভিড় ঠেলে কোনওক্রমে আনা হল ওঁর মা লাবণ্যকে।
চরিত্রটি এক অন্ধ মায়ের। লঞ্চে করে মা-ছেলে যেতে যেতে জলে পড়ে যায় ছেলে। তাকে বাঁচাতে মা’ও ঝাঁপ দেয় মাঝদরিয়ায়। এই দৃশ্যেরই শ্যুটিং করতে গিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান বছর পঁয়ত্রিশের কেয়া।
মাত্র চৌত্রিশ বছরে জীবন নাট্যের ইতিরেখা টেনে যবনিকার অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী। ১৯৭৭ সালের ১২ মার্চ ৷
জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছিল কেয়া চক্রবর্তীর,মাত্র ৩৫ বছরে৷ সাঁকরাইল থেকে পাঁচ মাইল দূরে হীরাপুরে ভেসে এসেছিল তাঁর কাদামাখা, কচুরিপানা জড়ানো দেহ ৷
'জীবন যে রকম' ছবির শ্যুটিংকালে লঞ্চ থেকে কেয়ার পতন এবং মৃত্যু, কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যু নিয়ে চাপানউতোর চলে বহু দিন। মাঝগঙ্গায় শ্যুটিং করার অনুমতি ছিল তো? ডামি নয়, অভিনেত্রী স্বয়ং কেন ঝাঁপ দিলেন জলে? জাল পাতা ছিল? লাইফবোট? সাঁতার না-জানা কেয়া এই ঝুঁকি নিলেন কেন? তাঁকে কি জোর করা হয়? না কি তিনিই জোর করেন পরিচালককে? নিছক দুর্ঘটনা? না কি আত্মহত্যা? হত্যা নয় তো? কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল কি? নাকি পরিবার ,কেরিয়ার , দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে তিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন জলে? আর তারপর শাড়ি জড়িয়ে যায় লঞ্চের প্রপেলারে৷ লঞ্চ এগিয়ে যায়, যাওয়ার পথে মারণ আঘাত করে যায় তাঁর মুখে ,মাথায় ! ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতা পুলিশের তদন্তও চলে দীর্ঘদিন৷ একটা সময়ের পর ফাইল বন্ধ হয়ে যায়৷ প্রশ্নের উত্তর থেকে যায় অজানাই ৷
অরুণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন , 'কেয়ার অভ্যাস ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমানো৷ এমনকি রিহার্সালের মধ্যে দশ মিনিটের
ব্রেক থাকলেও ও ঘুমিয়ে পড়ত৷ গঙ্গা থেকে যখন ওকে পাওয়া গেল , তখন ওর মুখ সামান্য ফোলা ৷ আমার মনে হয়েছিল, ও ঘুমিয়ে আছে ৷ '
কিংবা কবিতা সিংহ যেভাবে দেখেছেন :'কেয়ার দেহ পচতে আরম্ভ করেছে৷ অনেকক্ষণ জলে ছিল , এখন রোদে ৷
আমি তার ঈষত্ নীলবর্ণ মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম৷ মুখের বাঁ পাশ সুন্দর৷
ডান পাশ ফুলে ঝুলে পড়েছে৷ সেখানে একটি গভীর দাগ ৷'
নান্দীকারে কেয়ার বন্ধু রাধারমণ তপাদারের মনে পড়েছিল : ' কেয়ার খুব খৈনির নেশা ছিল৷ আমি ছিলাম ওর সাপ্লায়ার৷ শ্যুটিং থাকলেই বলতো , 'রাধুদা , আজ শ্যুটিং আছে৷ বেশ অনেকটা বানিয়ে দিন৷'. . যখন কেয়ার বডি পাওয়া যায়, তার মুখের ভেতর তখনো ছিল অনেকটা না খাওয়া খৈনি ৷'
'মিসেস আর পি সেনগুপ্ত ' ৷ এই শিরোনামেই এক নাট্যপত্রিকায়
রম্যরচনা লিখেছিলেন কেয়া ৷ তাতে সংসারে তাঁর ফ্রাসটেশনের
দিকটা কিন্ত্ত খানিক ধরা পড়ে ৷ তিনি লিখেছেন , 'এই নিয়ে ৬ বার
উঠলাম- - মানে এই লিখতে বসে আধ ঘণ্টাটাকের মধ্যে৷ একবার গয়লা এল, সদর দরজা খুললাম ৷ স্বামী গেঞ্জি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, খুঁজে দিলাম .. . টেলিফোন এল দুটো' ৷ কিংবা , 'আজ সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা ছবি দেখতে যাব ভেবেছিলাম ৷ অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস- এ ৷ উনি মানা করেছেন. .৷' একসময়ে শুধুমাত্র নাচ নিয়ে থাকতেন যিনি, সেই ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়কে পাকাপাকি নাটকের
দিকে নিয়ে আসায় উত্সাহ দিয়েছিলেন কেয়াই ৷ ঊষা -র কথা থেকে জানা যাচ্ছে , 'আমি ওর যন্ত্রণাকে জানি .. . ছোটবেলাতে একটা পারিবারিক যন্ত্রণা , কলেজ জীবন এবং তার পরেও এক যন্ত্রণা , কি সে যন্ত্রণা , কেন ? কি? জানাতে পারবো না৷ লেখা যাবে না, একান্তই পার্সোনাল. ..৷ ' কেয়ার স্কটিশ চার্চ কলেজের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিবেকানন্দ রায়ের কথাতেও রয়েছে একই রকমের আভাষ৷ তাঁর কথায়: ' তিন বছর কেয়ার মনোজগতে যে আলোড়ন চলছিল. .. ছিল
দুই পুরুষের মাঝখানে তার দ্বিধা ৷ তাঁদের নামোল্লেখ থেকে বিরত থাকলাম ৷ সম্ভবত দু 'জনেই তার পাণিগ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন ৷ কোনও এক জনকে না বলা কেয়ার সাহসে কুলোত না. ..'
"সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন একটি পত্রিকায় লিখেছেন - অজিতেশের কথা ভাবলে আমার চোখে ভেসে ওঠে অন্য এক ছবি। কেয়ার শেষ যাত্রায় , আমাদের আগে আগে চলন্ত সব চেয়ে উঁচু , এলোমেলো চুলের মাথাটা।"
কেয়া শুধু বড় অভিনেত্রীই ছিলেন না ,দলের সবার প্রতি তাঁর একটা অদ্ভুত ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ ছিল ,দল বাঁচাতে নান্দীকার-এর দুঃসময়ে গয়না বন্ধক রেখেছিলেন , চাকরী ছেড়ে নিজেকে পুরোপুরি থিয়েটারে সমর্পন করেছিলেন , তাঁর নীতিবোধ এতই দৃঢ় ছিল যে, তিনি 'স্কটিশ চার্চ কলেজে'র শিক্ষকতা থেকে ১৯৭৪ সালে ইস্তফা দিলেন , কেননা তাঁর মনে হয়েছিলো নাটকের জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় তাঁর পক্ষে শিক্ষকতার কাজে যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না , চাকরী থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে উনি নান্দীকার-এর প্রচারের দায়িত্ব নিযেছিলেন।
অজিতেশকে গুরু বলে মেনে জীবনটাকে থিয়েটারে নিমজ্জিত করে দিয়েছিলেন , শো-এর আগে অজিতেশের পা ছুঁয়ে প্রনাম করে স্টেজে নামতেন , সব নাটকেই অজিতেশ কিংবা কেয়ার জুটির টানটান লড়াই ছিল উপভোগ করার মতো , শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের পর বাংলা নাটক পেয়েছিল এই দুরন্ত জুটিকে , নান্দীকারের ভেতরকার দ্বন্দ্ব যখন বেসামাল অবস্থায় এসে পৌঁছতো সেই অবস্থাকে সামাল দিতে 'কেয়া চক্রবর্তী'র অনন্য ভূমিকা ছিল , দলের মধ্যে ব্যক্তিগত সংঘাত যতই প্রকট হোক না কেন 'কেয়া চক্রবর্তী'র হস্তক্ষেপে সেই দ্বন্দ্বের নিরসন হতো।
‘চলচ্চিত্রের কিছু ক্রিমিনালের গাফিলতিতে বাংলা নাটকের কতবড় ক্ষতি হয়ে গেল সেটা কি চলচ্চিত্রের অভিনেতৃবৃন্দ কোনোদিন বুঝবেন? এ যেন নাট্যকর্মীদের বৃহত্তর আত্মহত্যার প্রতীক।’ – কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যুতে এভাবেই ঝলসে উঠেছিলেন উৎপল দত্ত।