Saturday, July 9, 2016

বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর

     

   বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর 
বর্ধমান রাজপরিবারের অন্তঃপুরনারীদের মধ্যে সকলের আগে যাঁর নাম তাঁরা সকলে এখনও গর্বের সঙ্গে মনে রাখেন , তিনি হলেন বর্ধমান রাজ কৃষ্ণরাম রায়ের কন্য সত্যবতী। মহারাজকুমার শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতে, এর আগের বিশেষ কোন রাজকন্যা বা রাজমহিষীদের নাম সেভাবে জানাও যায় না। হয়তো তাঁর বীরত্ব, তেজস্বীতার জন্যই মহারাজকুমারী সত্যবতীর নামটি রাজপরিবারে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। চিতুয়া বরদার শোভা সিংহের বর্ধমান আক্রমণ ঐতিহাসিক তথ্য। শোভা সিংহের বর্ধমান রাজপুরীতে মৃত্যুও ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্ধমান নৃপতি কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতীর মর্য্যাদা স্খালনের চেষ্টা করলে সত্যবতী ছুরিকাঘাতে শোভা সিংহকে হত্যা করেন। কাহিনি এইরকমই শোনা যায়। তাঁর অসীম সাহস, আত্মমর্যাদাবোধ এবং শোভা সিংহ কে সমূলে বিনাশ করার জন্য বর্ধমান রাজপরিবার এই সাহসিনীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। যদিও, সেযুগে সঠিক কি ঘটনাটি ঘটেছিল, আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই, তবু বংশানুক্রমে চলে আসা বীরগাথাটি এখনও তাঁদের গর্ব ও আত্মসম্মানের বিষয় বলে তিনিও মনে করেন।
সত্যবতীর পর যে রাজপুরনারীর নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন রাণী ব্রজকিশোরী, রাজা কীর্তিচাঁদের মহিষী। রাণী ব্রজকিশোরীর নাম দান-ধ্যান, পুষ্করিণী খনন, দেবালয় প্রতিষ্ঠা এসব কাজের সঙ্গেই বেশি যুক্ত এবং রাজকার্য পরিচালনায় তাঁর তেমন কোন ভূমিকা দেখা যায় না, তবু সে যুগের একজন নারী, তিনি রাণী হলেও রাজঅন্তঃপুরের ঘেরাটোপের মধ্যে পর্দানশীন হয়ে না থেকে এতরকম কাজ করতে পেরেছিলেন, সেটি একটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে। বর্ধমান রাজপরিবারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র বা সবচেয়ে উজ্জ্বল নারী চরিত্র বলতে মহারাণী বিষেনকুমারী বা বিষ্ণুকুমারীর নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতে, মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর মত মহিলা রাজপরিবারে না থাকলে বর্ধমান জমিদারির অনেকখানিই ব্রিটিশদের হাতে বাজেয়াপ্ত হত।
মহারাণী বিষ্ণুকুমারী ছিলেন মহারাজ তেজচাঁদের মাতা। প্রথম যৌবনে তেজচাঁদ ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, রাজকার্যে অমনোযোগী। তাঁর অমনোযোগিতার কারণে জমিদারি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। কিন্তু সেইসময় মহারাণী বিষ্ণুকুমারী তাঁর জমিদারী রক্ষার জন্য সচেষ্ট হন এবং মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর পরামর্শে মহারাজ তেজচাঁদ ও বিষ্ণুকুমারী উভয়ে জমিদারি রক্ষার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেন। যার ফলে ইংরাজ সরকার তাঁদের প্রতি বিরূপ হলেও তাঁদের কোনভাবেই দমন করতে পারেনি। শেষমেশ ইংরাজ সরকার তাঁদের কয়েকবার গৃহবন্দী বা নজরবন্দী করে রাখলেও ইংরাজদের অধীনস্থ হতে হয়নি এবং ইংরাজ সরকার কোনমতেই কিছু আদায় করতে পারেনি। কখনও মাতা পুত্রের নামে, কখন পুত্র মাতার নামে ক্রমাগতঃ একের পর এক মামলা চালিয়ে যাবার জন্য, এবং ইংরাজ সরকার পূর্বতন মামলার নিষ্পত্তি ব্যতিরেকে পরবর্তী মামলার রায় দান না করতে পারার জন্য একের পর এক পুনঃ পুনঃ মামলা চলার ফলে বারে বারেই ব্রিটিশ সরকারকে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছে, কিন্তু রাজপরিবারের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। যার জন্য পরবর্তী কালে মহতাবচাঁদ তাঁর জমিদারির অনেকখানি পেয়েছিলেন সুরক্ষিত অবস্থায়। এবং তার পরপরই বর্ধমান জমিদারিতে পত্তনিদার প্রথা চালু হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার বর্ধমান রাজের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু সুবিধা করতে পারেনি। ফলে জমিদারিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখ থেকে রাজমাতা বিষ্ণুকুমারীর বুদ্ধিবলেই রক্ষা পায়।
পূর্ববর্তী মহারাজ ত্রিলোকচাঁদ ছিলেন অত্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী। কিন্তু পরবর্তী মহারাজা মহতাবচাঁদ বুঝেছিলেন যে ব্রিটিশরাজ সেইসময় পুরোপুরি এদেশে রাজত্ব কায়েম করেছে। তখন ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে শত্রুতা করার চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ধরে রাখতে পারলে বা দেখালে আর যাই হোক জমিদারির দিক দিয়ে তা লাভবান হবে। তাই তাঁর আমল থেকেই বর্ধমানের জমিদারিতে ব্রিটিশ বিরোধী হাওয়ার বদলে কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তার সুফলও মেলে অচিরেই। ইংরাজদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখার জন্য তাঁর আমলেই তিনি প্রথম ‘His Highness Maharajadhiraj’ উপাধি পান। যদিও এই জমিদারি এবং তার আয়ের জন্য মহারাজা মহতাবচাঁদ ও তাঁর পরিবার অনেকখানি মহারাণী বিষেণকুমারীর বা বিষ্ণুকুমারীর কাছে ঋণী। তিনি না হলে এবং তেজচাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে সেই সময় কৌশলে জমিদারি রক্ষার উপায় অবলম্বন না করলে এই বিশাল জমিদারির অনেকখানিই শেষ হয়ে যেত। তাই বর্ধমান রাজপরিবারে তিনি একজন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য নারী বলা যেতেই পারে। বর্ধমানের অনেক দেবালয়, পুষ্করিণী রাণী বিষ্ণুকুমারীর সময়ে স্থাপিত।
বর্ধমান রাজপরিবারে যতজন রাজা রাজত্ব করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই মহারাজা তেজচাঁদ এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। ভালো-খারাপ দুই অর্থেই তাঁর সুনাম ও বদনাম আছে বলা যায়। খামখেয়ালী, উচ্ছৃঙ্খল, বিলাসী, যৌবন মদমত্ত রাজা বলা যাতে পারে তাঁকে। আবার পরবর্তীকালে তিনিই প্রজাদের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। তাঁর সম্বন্ধে নানারকম গাল-গল্প প্রচলিত আছে। অনেকের মতে তিনি সাপে কামড়ানোর ঔষধ জানতেন। কিন্তু শ্রী প্রণয়চাঁদের মতে পারিবারিক ইতিহাসে এই বক্তব্যের সমর্থনের কোন হদিশ তিনি পাননি।
মহারাজ তেজচাঁদের ছিল ৮জন মহিষী। বর্ধমান রাজপরিবারে তাঁদের ভূমিকা কি ছিল এবং আদৌ কিছু ভূমিকা ছিল কিনা স্বাভাবিকভাবেই তা মনে হতে পারে । কথা প্রসঙ্গে জানা গেল তেজচাঁদের প্রথমা, দ্বিতীয়া এবং তৃতীয়া পত্নীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল একই দিনে। শুধু তাই নয়, তাঁর চতুর্থ বিবাহটিও সম্পন্ন হয় প্রথম তিনটি বিবাহের এক সপ্তাহের মধ্যেই। তেজচাঁদের বিবাহের ঘটনাও চমকপ্রদ। বর্ধমান রাজপরিবারেও এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সাধারণভাবে এই ঘটনা অস্বাভাবিক মনে হলেও বিবাহের ঘটনাটিও মহারাজ তেজচাঁদের চরিত্রের মতই খামখেয়ালীপনায় পরিপূর্ণ। বর্ধমান রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী বিবাহ হত পাত্র ও পাত্রীর করকোষ্ঠীর মিল দেখে। মহারাজা তেজচাঁদের এই তিন রাণীর সঙ্গে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হবার আগে আরো একজায়গায় করকোষ্ঠীর গণনা কার্য চলার সময়ই এই তিন বিবাহ একসঙ্গে হয়। কিন্তু ওদিকে করকোষ্ঠীর মিল হওয়ায় পাত্রীর পিতা বর্ধমান রওনা হয়ে জানতে পারেন যে ইতিমধ্যেই তার আগের দিন মহারাজার তিনজন কন্যার সঙ্গে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়েছে। রাগে এবং দুঃখে সেই পাত্রীর পিতা মহারাজার নামে আদালতে মামলা করেন। সুতরাং বাধ্য হয়ে একসপ্তাহের মধ্যেই সেই নারীটিকেও চতুর্থ পত্নী হিসাবে গ্রহণ করেন। পরে পঞ্চম পত্নী হিসাবে পাণি গ্রহণ করেন পরাণচাঁদ কাপুরের ভগিনী কমলকুমারীকে। কমলকুমারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি পঞ্চমবার বিবাহ করেন। কিন্তু মহারাজের এই পাঁচপত্নীর একজনেরও সন্তানাদি না থাকায় আবার বিবাহ করেন ষষ্ঠ বার, নানকী দেবীকে। একমাত্র নানকী দেবীর গর্ভেই জন্ম নেন তাঁর একমাত্র সন্তান প্রতাপচাঁদ। পরবর্তী কালে এই প্রতাপচাঁদকে ঘিরেই বর্ধমান রাজপরিবারে ঘটে নানান সমস্যা, নানান গল্প গাথা, নানান মামলা, মোকদ্দমা ইত্যাদি।
অনেকের মতে প্রতাপচাঁদের গৃহত্যাগের পিছনে আছে রাণী কমলকুমারীর ষড়যন্ত্র। কমলকুমারী ছিলেন প্রখর বুদ্ধিশালিনী। মহারাজ তেজচাঁদের প্রিয় মহিষী হ’বার সুবাদে রাজপরিবারের অনেক ঘটনার পিছনেই ছিল তাঁর মস্তিষ্ক। অনেকের মতে রাণী কমলকুমারী এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পরানচাঁদ কাপুরের ছিল অর্থলিপ্সা ও উচ্চাভিলাষ। দুয়ের ষড়যন্ত্রে প্রতাপচাঁদ রাণী কমলকুমারীর ফাঁদে পা দেন কিন্তু পিতার মহিষী মাতৃসমা রাণী কমলকুমারীর আচরণে লজ্জ্বিত ও দুঃখিত প্রতাপচাদ বর্ধমান রাজপরিবার ও বর্ধমান ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ফিরে এলে শুরু হয় জাল প্রতাপচাঁদের মামলা। কিন্তু সে অন্য ইতিহাস। রাজপুরনারীদের জীবনবৃত্তান্ত বা রাজঅন্তঃপুরবাসিনীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। যদিও, মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ জাল প্রতাপচাঁদের ঘটনা বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে প্রতাপচাঁদের সপক্ষে কোন রকম রেকর্ডই পাওয়া যায় না।
সেকালে জাল প্রতাপচাঁদের মামলা ঘিরে বর্ধমান এবং সারা বাংলা যথেষ্ট আলোড়িত হয়। রবীন্দ্র পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও এই মামলার একজন সাক্ষী হিসাবে আদালতে উপস্থিত হয়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। অনেকের মতে, দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কম্পানীর একজন কর্মকর্তা, বর্ধমান রাজপরিবারের আইনী পরামর্শদাদা ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কোম্পানী। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বর্ধমান রাজপরিবারের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ঘটনা যাই হোক না কেন, শ্রী প্রণয়চাঁদও বিশ্বাস করেন যে প্রতাপচাঁদ মারাই গিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রতাপচাঁদ ছিলেন সুরাসক্ত। নিজের দুই স্ত্রী প্যারীকুমারী এবং আনন্দকুমারী ছাড়াও তাঁর ‘বিলাতী খামুন’ নামে এক বিদেশিনী রক্ষিতা ছিল, যে মহিলা আবার ছিলেন সেই সময়ের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টারের বান্ধবী। অর্থাৎ প্রতাপচাঁদ মদ এবং নারীতে আসক্ত ছিলেন। অতিরিক্ত সুরাপানে তাঁর মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক ছিল। প্রতাপচাঁদের দুই মহিষীর অনুরোধে রাজপরিবারের তহবিল থেকে প্রতাপের মৃত্যুর পর(রাজপরিবারের মতে প্রতাপের মৃত্যুই ঘটেছিল) কালনায় প্রতাপের নামে একটি অসাধারণ টেরাকোটা কারুকার্য মন্ডিত মন্দির নির্মিত হয় যা প্রতাপেশ্বর শিব মন্দির নামে খ্যাত এবং এই মন্দিরটি প্রতাপের নাম এখনও বহন করে চলে......
(ক্রমশঃ)
প্রতাপেশ্বর শিব মন্দির, কালনা, বর্ধমান
   বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর (৩য় পর্ব)
নানকী দেবী ও পুত্র প্রতাপের মৃত্যুর পর(যদিও সেই মৃত্যু ঘিরে অনেক সন্দেহ, অনেক প্রচার ও অপপ্রচার) পরিণত বয়সে মহারাজা আবার সন্তানের আশায় বিবাহ করেন উজ্জ্বলকুমারীকে। তাঁর একটি সন্তানও হয় কিন্তু সেই সন্তানের মৃত্যু হয় এবং পরে মহারাজার মহিষী উজ্জ্বলকুমারীরও মৃত্যু হয়। ইনি ছিলেন মহারাজ তেজচাঁদের সপ্তম মহিষী। মহারাজ তেজচাঁদের পঞ্চম মহিষী কমলকুমারী ব্যতীত অন্যান্য মহিষীদের নাম বা পরিচয় রাজপরিবারের ইতিহাসে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। উজ্জ্বলকুমারীর মৃত্যুর পর মহারাজা তেজচাঁদ দত্তক নেন কমলকুমারীর ভ্রাতা পরানচাঁদ কাপুরের পুত্র চুনিলালকে। দত্তক নেবার পরে যাঁর নাম হয় মহতাব চাঁদ। এরপরেও মহারাজ বৃদ্ধ বয়সে আবার বিবাহ করেন রাণী বসন্তকুমারীকে। বালিকা বসন্তকুমারীকে বৃদ্ধ বয়সে বিবাহ মনে প্রশ্ন জাগায়। কিন্তু তেজচাঁদের অষ্টম মহিষীর পরিচয় জানার আগে জানা প্রয়োজন রাণী কমলকুমারীকে।
বিষেণকুমারীর পর বর্ধমান রাজপরিবারে যে নারীর নাম উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন মহারাজা তেজচাঁদের পঞ্চম পত্নী মহারাণী কমলকুমারী। রাণী কমলকুমারীর মহারাণী বিষেণকুমারীর মত রাজকার্য্য, রাজ্য পরিচালনার দক্ষতা তাঁর ছিল না, কিন্তু রাজপুরনারীদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী, প্রখর বুদ্ধিশালিনী এবং সুচতুরা মহিলা ছিলেন এই নারী। ছল, কপটও তাঁর কম ছিল না। পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রতাপচাঁদের গৃহত্যাগের পিছনে এই নারীর হাত আছে বলে অনেকের অনুমান। সুরায় আসক্ত প্রতাপের সঙ্গে প্রতাপের স্ত্রীর ছদ্মবেশে মিলিত হ’লে মাতৃগমনের পাপবোধে প্রতাপ গৃহত্যাগ করেন এইরকম একটি জনশ্রুতি আছে। কমলকুমারীর ছলনায় প্রতাপ পরাজিত হন। মহারাজার প্রিয় পত্নী হবার সুবাদে কমলকুমারী যে কিছু সুযোগ কাজে লাগাতেন, সেকথা বলাই বাহুল্য। একরকম তাঁর চতুরতার জন্যই পরাণচাঁদ কাপুরের ভগিনী কমলকুমারী নিজ ভ্রাতার পুত্র (পরানচাঁদের পুত্র) চুনিলালকে রাজার দত্তক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। কিন্তু প্রতাপচাঁদের মৃত্যুর পর( এখানে বলা ভালো যে মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদও প্রতাপচাঁদের মৃত্যুকেই সমর্থন করেন এবং জাল প্রতাপচাঁদকে স্বীকার করেন না, সম্ভবতঃ বর্ধমান রাজপরিবারের কেউই তা স্বীকার করেন না) পরাণচাঁদ কাপুরের পুত্র চুনিলাল ওরফে মহতাব চাঁদকে দত্তক নেবার পরেও পরিণত বয়সে পরানচাঁদ কাপুরের কনিষ্ঠা কন্যা বসন্তকুমারীকে মহারাজ তেজচাঁদ আবার বিবাহ মনে ঔৎসুক্য জাগায়।
বসন্তকুমারীর বয়স তখন ছিল মাত্র এগারো বৎসর। শ্রী প্রণয়চাঁদের মতে এই বিবাহ ছিল কেবলমাত্র মহারাজা জনিত খেয়াল। আবার এই বিবাহ রাণী কমলকুমারীর অতিশয় চতুরতার ফল হতে পারে। পরানচাঁদ ছিলেন বর্ধমান রাজকার্যে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। কমলকুমারী ছিলেন তাঁর ভগিনী। দুজনেই ছিলেন অর্থলোলুপ, অতিশয় চতুর। একই পরিবারের দুই কন্যা(পিসি কমলকুমারী এবং ভাইঝি বসন্তকুমারী)এবং এক পুত্র(মহতাব চাঁদ) রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত হলে রাজ-ঐশ্বর্য্যের যে অনেকখানি কাপুর পরিবারের করায়ত্ত হবে, তা পরানচাঁদ কাপুরের অজানা ছিল না। সুচতুরা কমলকুমারী ভ্রাতার সঙ্গে সহমত ছিলেন। পরানচাঁদের কনিষ্ঠা কন্যা বসন্তকুমারীর সঙ্গে মহারাজার বিবাহ হ’লে রাজ্য-রাজত্বের প্রায় সমস্ত কিছুর উপরেই কায়েম হবে দেওয়ান পরানচাঁদের একরকম একছত্র অধিকার। ভগিনী, কন্যা আবার পুত্রের পরবর্তীকালে মহারাজা হ’বার আকাঙ্খায় (কারণ পরবর্তী সময়ে মহারাজ তেজচাঁদ যাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন তিনিই হন মহারাজাধিরাজ মহতাবচাঁদ) এই ধরণের একটি কাজ করা তাঁদের উভয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল। মহারাজা তেজচাঁদ এই বিবাহ করেন দত্তক পুত্র গ্রহণ করার পর, সুতরাং পুনরায় পুত্র আশায় যে তিনি এই বিবাহ করেননি তা বোঝাই যায়। তাছাড়া মহারাজ তেজচাঁদ তখন বৃদ্ধ, তাঁর বয়স তখন ছিল ৬৭ বৎসর। সুতরাং এই বিবাহ পরানচাঁদ কাপুর ও কমলকুমারীর ষড়যন্ত্র, মহারাজার উপর চাপসৃষ্টি এবং রাজপরিবারে প্রাধান্য স্থাপন এমন একটি সম্ভাবনার কথা ভাবা যেতেই পারে। এছাড়া এই বিবাহের অন্য কোন অর্থ হতে পারে না কারণ বসন্তকুমারী রাণী কমলকুমারীর মত পূর্ণযোবনা এবং সুন্দরী ছিলেন না যে, মহারাজ তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করতে পারেন। তাছাড়া বিবাহের সময় বসন্তকুমারী ছিলেন এগারো বৎসরের প্রায় বালিকা মাত্র। পাঁচ বৎসর পরেই মহারাজার জীবনাবসান হয়। রাণী বসন্তকুমারীর বয়স তখন মাত্র ষোল।

মহারাজ তেজচাঁদের জীবনাবসানের সময় তাঁর অষ্টম মহিষী রাণী বসন্তকুমারীর বয়স ছিল মাত্র ষোল বৎসর। কিন্তু মহারাজ তেজচাঁদের মৃত্যুর পর এই অল্পবয়স্কা রাণীর জীবন কাটে অত্যন্ত কষ্ট ও মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে। তাঁকে প্রায় একবৎসর ঘরবন্দী করে রাখা হয়। যুক্তি ছিল, অল্পবয়স্কা নারীর নানান প্রলোভনে চরিত্র নষ্ট হতে পারে এবং কুসংসর্গে পড়তে পারেন। রাণীর রাজপরিবারের অপর পুরুষমানুষের প্রতি প্রণয়াসক্তিও জন্মাতে পারে। তাই ঘরবন্দী করে রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, প্রধানতঃ এই যুক্তি ছিল রাণী কমলকুমারী এবং পরানচাঁদ কাপুরের। কারণ রানী বসন্তকুমারীকে বিষয় আশয় থেকে বাইরে রাখলে তাঁদের লাভই ছিল সকলের চেয়ে বেশি। রাণী বসন্তকুমারী নিজ অধিকারের জন্য মামলা করেন এবং এই মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য নিতে হত কার এন্ড ট্যাগোর কোম্পানীর ব্যারিষ্টার তখনকার বিখ্যাত ডিরোজিও সাহেবের শিষ্য ইয়ং বেঙ্গলের দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের। একটা কথা হয়ত বলা যেতে পারে কার এন্ড ট্যাগোর কোম্পানী ছিল বর্ধমান মহারাজাদের আইনী পরামর্শদাতা। এই কার এন্ড ট্যাগোর কোম্পানীর একজন ছিলেন আমাদের অতি পরিচিত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরমহাশয়ও। জাল প্রতাপচাঁদের মামলার সময় বর্ধমান রাজপরিবারের পক্ষে ইনি ছিলেন একজন প্রধান সাক্ষী ও সহায়। সে প্রসঙ্গ আগেই আলোচিত হয়েছে।
দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ছিলেন রাণী বসন্তকুমারীর পক্ষের উকিল। এই সময়েই দুজনের মধ্যে প্রণয় জন্মায় এবং রাণী বসন্তকুমারী এক দুঃসাহসিক যাত্রা করেন দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে যা বর্ধমান রাজপরিবার তো বটেই, সে যুগের পক্ষেও এক অতি দুঃসাহসের পরিচয়। দুজনে পলায়নের পর রাজার লোকলস্কর দিয়ে তাঁদের ধরে আনলেও আবার দুজনে পলায়নে সক্ষম হন এবং তাঁরা কোর্টে সিভিল আইন অনুযায়ী বিবাহ করেন। বিবাহের পর তাঁরা অযোধ্যার নবাবের অন্তর্গত লক্ষ্মনৌ শহরে বাকি জীবন কাটান এবং তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মে। রাণী বসন্তকুমারীকে নিয়েও অনেক গবেষক, লেখক নানা আলোচনা ও চিন্তাভাবনা তাঁদের লেখনীতে প্রকাশ করেছেন। এখানে তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে বলা যেতে পারে তিনি একজন অসমসাহসী মহিলা। রাণী বসন্তকুমারী যে তাঁর নিজের ইচ্ছামত জীবনকে বেছে নিতে পেরেছিলেন, একজন রাজ অন্তঃপুরবাসিনী হয়েও এতে তাঁর অসম সাহসিকতার পরিচয় মেলে, যদিও সেই জীবনকে বেছে নেবার পথ ছিল অত্যন্ত দুরূহ এবং কঠিন। তবু, একথা বলা যেতে পারে যে বর্ধমান রাজপরিবারে বসন্তকুমারী অবশ্যই এক অন্যরকম চরিত্র।
শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতেও রাণী বসন্তকুমারী যা করেছিলেন তা সঠিক কাজ। অল্পবয়স্কা এক মহিলা যিনি রাণীর জীবন কাটাতে অভ্যস্ত, তাঁর বন্দী জীবন কাটানোর চেয়ে নিজের খুশিমত জীবন কাটানো অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে তাঁর। সকল মানুষেরই অধিকার আছে তার নিজের জীবনকে বেছে নেবার। মাত্র এগারো বৎসরের বালিকার পক্ষে বৃদ্ধ রাজাকে স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া এবং সেই স্বামীর অবর্তমানে বন্দী জীবন কাটানো এক নারীর পক্ষে যে কি ভয়ানক সেটা যে কোন মানুষই চিন্তা করলে বুঝতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তৎকালীন রাজপরিবারের মান-মর্যাদা এবং সামাজিক বাধা কাটিয়ে সে যুগে এই নারী যে একজন প্রেমিকের হাত ধরে গৃহত্যাগের মত(তাও আবার রাজপরিবারের বধূ এবং বিধবা মহারাণী) সাহস দেখাতে পেরেছিলেন, এজন্য তাকে বাহবা দেওয়া উচিত। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাণী বসন্তকুমারী বর্ধমান রাজ অন্তঃপুরবাসিনী রমণীগণের মধ্যে অবশ্যই এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র। যদিও রাণী বসন্তকুমারী বর্ধমান রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ফলে বর্ধমান রাজপরিবারও তাঁদের পারিবারিক ক্রিয়াকরণ ইত্যাদি থেকে রাণী বসন্তকুমারী এবং তাঁর পরবর্তী পরিবার-পরিজনদের নাম রাজবাড়ির বংশলতিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন এবং এককথায় বলতে গেলে বর্ধমান রাজপরিবারে তাঁদের আর কোন স্থান নেই।
তেজচাঁদের পর বর্ধমান রাজপরিবারের রাজা হন দেওয়ান পরানচাঁদ কাপুরের পুত্র চুনিলাল, যাঁকে মহারাজ তেজচাঁদ দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী কালে যাঁর নাম হয় মহতাবচাঁদ। ইনি ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন না, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। বলতে গেলে একরকম তাঁর আমল থেকেই ব্রিটিশ ভক্তি শুরু হয় এবং পরিবারেও ব্রিটিশ নিয়ম-কানুন লাগু হয়। মহতাবচাঁদের দুই বিবাহ। প্রথমা পত্নী নয়নকুমারী। তাঁর মৃতুর পর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন নারায়ণকুমারীকে। রাজপরিবারে নারায়ণকুমারীর বেশি কিছু অবদানের কথা শোনা যায় না। কিন্তু মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদের মতে নারায়ণকুমারী ছিলেন একজন জবরদস্ত মহিলা। রাজকার্য বা অন্যান্য ব্যাপারে নারায়ণকুমারীর বিশেষ কোন অবদান না থাকলেও তিনি মহারাজের সবরকম কাজের সহায়ক ছিলেন এবং অনুমোদন করতেন, বাধা দিতেন না। নারায়ণকুমারী এবং মহতাব চাঁদেরও কোন সন্তানাদি না থাকায় মহারাণীর ভ্রাতা বংশেগোপাল নন্দের পুত্রকে দত্তক নেওয়া হয়। তাঁর নাম হয় আফতাব চাঁদ। পরে আফতাব চাঁদেরও সন্তান না থাকায় দত্তক পুত্র গ্রহণের সময় আফতাব চাঁদের মহিষী বেনোদেবীর সঙ্গে নারায়ণ কুমারীর মকদ্দমা বাধে, কিন্তু নারায়ণকুমারী মিতাক্ষরা আইন অনুসারে পরাজিত হন। সেই সময় দত্তক পুত্র নেবারও একটা নিয়ম ছিল। যাকে বিবাহ করা যায় না সেই রকম কোন সম্পর্কের কারো সন্তানকে দত্তক নেওয়া যেত না। তাই শেষ পর্য্যন্ত বেনোদেবীর মতানুসারেই বনবিহারী কাপুরের পুত্র বিজনবিহারী কাপুরকে দত্তক পুত্র গ্রহণ করা হয়, যাঁর পরবর্তী নাম হয় বিজয়চাঁদ মহতাব।
বিজয়চাঁদই প্রথম ‘মহতাব’ উপাধি কে পদবী হিসাবে গ্রহণ করেন। নারায়ণ কুমারী মামলায় হেরে গেলেও বেশ কিছু বিষয় সম্পত্তির অধিকারিণী হন। শ্রী প্রণয়চাঁদের মতে, নারায়ণকুমারী ছিলেন তন্ন্ত্রসাধিকা। রাজবাড়ির ভিতরে এইরকম মড়ার মাথা, খুলি এইসব নিয়ে তন্ত্রসাধনা রাজ পরিবারের অন্যান্য লোকজন সুনজরে না দেখার জন্য আফতাব চাঁদ রাজমাতা মহারাণী নারায়ণ কুমারীর জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেই মন্দিরটি রাজবাড়ির কাছাকাছি অবস্থিত ভুবনেশ্বরী কালিমন্দির, বর্ধমানের বুকে যা আজও ‘সোনার কালিবাড়ী’ নামে খ্যাত এবং নারায়ণ কুমারী সেইখানেই তাঁর জপতপ, সাধনা নিয়েই বাকী জীবন কাটান। নারায়ণ কুমারীর কথা চিন্তা করলে একটা কথা অতি বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবা যেতে পারে যে সেই কালেও একজন মহিলা (যদিও তিনি রাণী) স্বাধীনভাবে একা তন্ত্রসাধনার মত কঠিন পথকে বেছে নিতে পেরেছিলেন, রাজপরিবারের লোকেরা তা অনুমোদন করেছিলেন এবং তাঁর থাকা ও সাধনার জন্য অন্যত্র মন্দির ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেদিক থেকে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা অবশ্যই। তবে তেজচাঁদের আমল থেকেই সাধক কমলাকান্তের তন্ত্রসাধনার সঙ্গে রাজপরিবার পরিচিত ছিলেন। যার কিছু আধ্যাত্মিক প্রভাব পড়েছিল প্রতাপচাঁদ এবং পরবর্তী কালে মহারাজ বিজয়চাঁদের উপরেও, যদিও তা তন্ত্রসাধনা ছিল না।
বর্ধমান রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সেইযুগের একজন মহিলা, যিনি রাজরাণী, রাজমাতা আবার তিনিই যে তন্ত্রসাধিকা---একথা ভেবে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কতরকমের যে বিস্ময় লুকিয়েছিল এই অন্তঃপুরে, ভাবলেও অবাক হতে হয়! সাধারণভাবে যে সকল অন্তঃপুরবাসিনীরা ছিলেন ঘেরাটোপের মধ্যে, বাইরে বেরোতে পারতেন না, ছিলেন পর্দানশীন তাঁরাও কিন্তু সকলের অলক্ষ্যে রচনা করে গেছেন নিজ নিজ ইতিবৃত্ত। তাই কখনও পাই রাণী ব্রজকিশোরীর মত দান-ধ্যান রতা রাণী, কখনও পাই রাণী বিষ্ণুকুমারীর মত জমিদারি রক্ষাকর্ত্রী, আবার কখনো পাই নারায়ণকুমারীর মত তন্ত্রসাধিকা, ছিলেন বসন্তকুমারীর মত দুঃসাহসিকা। কিন্তু বর্ধমান রাজঅন্তঃপুরে ছিলেন আরো অনেকে। তাঁদের কথাও জানা যাক......
( সাদা-কালো ছবিটি ইয়ং বেঙ্গলের সভ্য, ডিরোজিও শিষ্য দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের, যিনি পরে মহারাজা তেজচাঁদের অষ্টম মহিষী বিধবা বসন্তকুমারীকে বিবাহ করেন।
অন্য ছবিটি মহারাজিধিরাজ মহতাব চাঁদের যিনি প্রথম His Highness Maharajadhiraj উপাধি পান। )
  বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর (৪র্থ পর্ব)
মহতাবচাঁদ ছিলেন ব্রিটিশভক্ত। ব্রিটিশভক্তি থেকেই তাঁর মহারাজাধিরাজ উপাধি লাভ। তাঁর সময় থেকেই বর্ধমান রাজপরিবারের অন্দরমহলেও চালু হয় ব্রিটিশ নিয়মশৃঙ্খল্লা, শিক্ষাদীক্ষা, নানান আদব-কায়দা ইত্যাদি। সেই সময় থেকেই রাজপরিবারের অন্দরমহলে সন্তানদের শিক্ষা দেবার জন্য একজন করে Nanny রাখার রেওয়াজ হয়। রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী রাজপরিবারে রাজকুমার বা রাজকুমারী জন্মগ্রহণ করলে এক একজন শিশুর প্রতি ছয় জন করে সাহায্যিকা বা সাহায্যকারিণী রাখার রেওয়াজ ছিল । এই সময় থেকেই এই ছয়জন সাহায্যকারিণীর উপরে আরো একজন করে ইংরেজ nanny রাখা শুরু হয়। এরা সাহায্যকারিণীদের শিক্ষা দিতেন কিভাবে বাচ্চাদের মানুষ করতে হবে, রাজপরিবারের নানান আদব-কায়দা শেখাতে সাহায্য করতেন। রাজপরিবারের নিয়মকানুন ছিল খুব কড়া। খাবার সময় ছিল এক নিয়ম, সারাদিনের জন্য ছিল আর এক নিয়ম, কে কিভাবে হাঁটাচলা করবে তাও শিখতে হত রাজকুমার-রাজকুমারীদের।
দুপুরের খাওয়া হত ভারতীয় তথা বাঙ্গালীদের মত মাটিতে আসন পেতে। রাত্রে হত ইংরাজি কায়দায় ডিনার, তখন খাওয়া হত চেয়ার-টেবিলে। একসঙ্গে খেতে বসতেন রাজা, রাণী, রাজকুমার, রাজকুমারীরা এবং অন্যান্য বয়োজ্যোষ্ঠরা। রাজা এবং রাণীর খাওয়া হয়ে গেলে উঠে দাঁড়াতে হত সকলকেই। একটা কথা বলে রাখা ভাল, এসব আচরণই শিখতে হত সেই বিদেশিনী nanny র কাছে এবং তা যে ইংরাজি আদব-কায়দা, সে কথা বলাই বাহুল্য। খাওয়া হয়ে গেলে অন্যত্র এসে সকলে মিলে বসতে হত মিনিট পনেরো। সামান্য কিছু কথাবার্তা, তারপর রাজা-রাণী ছেলেমেয়েদের অর্থাৎ রাজকুমার-রাজকুমারীদের একটি করে ‘চুমো’ দিতেন, তাঁরা শুতে চলে যেতেন nanny র সঙ্গে নিজের নিজের জায়গায়। সারাদিনে পিতা-মাতার কাছ থেকে এই একটিমাত্র চুমো খাওয়া ছাড়া আর কোনরকম সম্পর্ক শিশুদের ছিল না। কঠিন জীবন যাপন করতে হত। কোনোরকম emotion প্রকাশ করার উপায় ছিল না, করলে কঠিন শাস্তি পেতে হত। ভবিষ্যতের রাজা ও রাণীদের মনে পাছে কোনরকম দুর্বলতা মনের মধ্যে জন্মায়, তাই আচার, আচরণ, ব্যবহারে কোনরকম দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হত না। শিশুবয়স থেকেই তাঁদের এই শিক্ষা দেওয়া হত।
রাণীদেরও তাঁর নিজের সন্তানকে কাছে ডাকা, খেলা করা, কাছে থাকা এসবের নিয়ম ছিল না। এমন কি সন্তানদের অসুখ করলেও আগে রাজার অনুমতি, তারপর ডাক্তারের জন্য ফরমান বা আদেশপত্রে সাক্ষর এবং শেষে ডাক্তার ডাকার অনুমতি মিললে তবেই সন্তানের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হত। রাজকুমার-রাজকুমারীদের সারাজীবন কেটে যেত রাজবাড়ির চার-দেওয়ালের ভিতরেই। সেখানেও ছিল পদে পদে নিয়মের প্রহরা। যাতায়াতের পথে বড় এবং ছোট রাজকুমারদের নিয়ম মেনে চলতে হত, সেখানে কোনমতেই ছোট রাজকুমার বড় রাজকুমারের আগে পথ চলতে পারতেন না। এই নিয়মের জন্য এখনও ছোটো মহারাজকুমার বড় মহারাজকুমারদের আগে যেতে পারেন না, রাজপরিবারের নিয়ম তাঁকে মেনে চলতে হয় কিংবা বলা ভাল, সেই শিশু বয়স থেকে শেখা নিয়ম এখনও মেনে চলেন তাঁরা। আরো একটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করার, তা হল ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে মহতাবচাঁদের সময় থেকেই বহুবিবাহ প্রথা রাজপরিবারে বন্ধ হয়ে যায়। মহারাজা মহতাব চাঁদ নিজেও দ্বিতীয় বিবাহ করেন প্রথমা পত্নী মারা যাবার পর। তার পর থেকে সকলেই একপত্নী গ্রহণ করেছেন। রাজপরিবারের মহিলা বিশেষতঃ রাজবধূদের আরো একটি শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিল। তখন বর্ধমান রাজপরিবারে বধূ হয়ে যাঁরা আসতেন এত অল্প বয়সে তাঁরা এখানে আসতেন যে তাঁদের একরকম এখানেই মানুষ হতে হত। কিন্তু রাজপরিবারে তাঁরা একবার এলে আর নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারতেন না। কিন্তু অত বালিকা বয়সে তাঁরা আসতেন বলে তাঁদের বাবা, মা এবং পরিবারের অন্যান্য লোকদেরও সেখান থেকে বর্ধমানে নিয়ে আসা হত। কোন উপলক্ষ্যে নিজের মা, বাবার সঙ্গে দেখা হলেও রাণীরা পিত্রালয়ে ফিরে যেতে পারতেন না।
একটি কথা অনিবার্য ভাবেই মনে হয়, যাঁরা এখানে আসতেন অতি অল্প বয়সে রাণীর মর্যাদা নিয়ে, তাঁরা হয়ত আর তেমন ভাবে পিত্রালয়ে যাবার প্রয়োজনও বোধ করতেন না। কারণ, অতি অল্প বয়স থেকে এই রাজপরিবাবের ঐশ্বর্য্যের মধ্যে থেকে সেখানে ফিরে যাবার প্রয়োজন হত না, গেলেও মানিয়ে নিতে পারতেন না। কিন্তু পিতা-মাতারাও কি তাঁদের কন্যাদের অভাব বোধ করতেন না? কন্যারাও কি বিবাহকেই শৃঙ্খলিত জীবন এর মুক্তি বলে মনে করতেন? কারণ বেশির ভাগ নারীই তো আসতেন রাজা-রাজড়ার পরিবার থেকে, হয়তো এই শৃঙ্খলিত জীবন তাঁদেরও কাটাতে হত শিশু বয়সে। তাই তাঁরা বিবাহকেই মুক্তি বলে মনে করতেন। এসব কথা সবই অনুমান, নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না। আরো একটি কথা জানানো দরকার, তা হল এই যে, বর্ধমান রাজপরিবার দীর্ঘদিন এদেশে বসবাস করার জন্য একরকম বাঙ্গালীই হয়ে গিয়েছিলেন বলা যায়। কাজেই সুদূর পঞ্জাব বা অন্যত্র থেকে আগত এই সব রমণীরা যারা রাজপরিবারে বধু হয়ে আসতেন, একেবারে প্রথম থেকেই চলত তাঁর বাংলা শেখা ও বাঙ্গালীর আচরণ, আদব-কায়দা কে জানা। বর্ধমান রাজপরিবারের একেবারে নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন, যেমন বিবাহ, চূড়াকরণ, নামকরণ বা কোন পূজা-পাঠ ইত্যাদি ছাড়া বাকি সব কিছুতেই ছিল বাঙ্গালীয়ানা। রাজকুমার, রাজকুমারী বা রাণীদের তা শেখা আবশ্যক ছিল।
মহারাজ আফতাব চাঁদের পর বর্ধমানের রাজপরিবারে সিংহাসনে বসেন মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব। ‘মহতাব’ শব্দটি হল চন্দ্র কথার ফারসী রূপ। আবার চন্দ্র কথাটি হল সংষ্কৃত শব্দ। যেহেতু তিনি মহারাজা এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই তাঁর প্রজা, সেকারণেই এইরকম একটি উপাধিকেই তিনি পদবী হিসাবে গ্রহণ করেন। মহারাজা বিজয়চাঁদের পত্নীর নাম ছিল রাধারাণী দেবী। বিজয়চাঁদের বিবাহ হয় দিল্লীতে, কিন্তু বিবাহের পর রাধারাণী দেবীর পুরো পরিবার চলে আসেন বর্ধমানে। রাজপরিবারে যে করকোষ্ঠীর মিল দেখে বিবাহ হত সেকথা আগেই বলেছি। সেইমতই রাধারাণী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয় মহারাজা বিজয়চাঁদেরও। রাধারাণী দেবী ছিলেন দরিদ্র পরিবারের কন্য। রাজরাজড়ার পরিবারের আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন তাঁর জানা ছিল না, তিনি কোনদিন তা পছন্দও করেন নি। মহারাজকুমারের মতে এই অসম বিবাহের জন্য মহারাজা বিজয়চাঁদ এবং মহারাণী রাধারাণী দেবীর বনিবনা হয়নি কোনওদিনও। রাজা-রাণীদের জীবনে অতুল ঐশ্বর্য্য-বিলাসিতার মাঝেও যে সাধারণ নরনারীর জীবনের মত তাঁদের জীবনেও নেমে এসেছিল দুর্ভাগ্যের ছায়া, তার প্রকৃত ইতিহাস আমরা জানি কতজন!
বিজয়চাঁদ কিশোর অবস্থা থেকেই আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন ছিলেন। ‘বিজয়ানন্দ বিহার স্থলে’ তিনি প্রায়ই ধ্যানে রত থাকতেন। এমন কি একটানা সাতদিন ধরেও তিনি ধ্যানে রত থাকতেন এমন কথাও জানা যায়। সেই সময় রাজকার্য, রাজ্যশাসন কিছুই প্রায় সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। আধ্যাত্মিক ভাবের ঘোরেই তিনি ডুবে থাকতেন। পত্নী রাধারাণী দেবীর সঙ্গে এই নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়, ক্রমে, মহারাজা বিজয়চাঁদ লর্ড কার্জনের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর মদত,পরামর্শ ও সাহায্যে ধীরে ধীরে আবার রাজ্য পরিচালনা ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। কিন্তু মহারাণী রাধারাণী যে আধ্যাত্মিক চেতনার ঘোরে থাকার জন্য মহারাজার সঙ্গে বিরোধ বাধে, নিজে ধীরে ধীরে সেই জগতে ডুবে যান। আগেই বলেছি, মহতাব চাঁদের আমল থেকেই বহুবিবাহ প্রথা বন্ধ হয়ে যায় এবং রাজারা এক পত্নীতেই সন্তুষ্ট থাকনে। কিন্তু রাধারাণী দেবীর সংগে মহারাজা বিজয়চাঁদের কোনদিনই সদ্ভাব বা বনিবনা হয় নি। এমনকি রাজকুমার, রাজকুমারীগণের ইংরাজি শিক্ষা ও পঠন-পাঠনের জন্য বিদেশ গমনও রাধারাণী দেবী মেনে নিতে পারেননি। রাজবাড়িতে একত্রে টেবিলে বসে ইংরাজি কায়দায় মাছ, মাংস, মদ ইত্যাদি গ্রহণেও তীব্র আপত্তি জানান। প্রথম যৌবনে মহারাজার আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য যে মহারাণী এত প্রতিবাদ করেন সেই জীবন থেকে মহারাজা বিজয়চাঁদ লর্ড কার্জনের প্রভাবে একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়ালেও রাধারাণী দেবীর আর কোন পরিবর্তন হয় না। বরঞ্চ তিনি রাজবাড়ির মায়া-মোহ ত্যাগ করে চিরজীবনের মত সন্ন্যাসিনী হয়ে যান ও রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে বারাণসী ধামে চলে যান তাঁর গুরুর আশ্রমে। রাজ ঐশ্বর্য্য, রাজকীয় বিত্ত, বৈভব, রাজ রাণীর জীবন এক কথায় ঠেলে ফেলে দিয়ে তিনি আজীবন সন্ন্যাসিনীর জীবন যাপন করেন।
সেদিক দিয়ে বর্ধমান রাজপরিবারে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা বলা যায়। এই জীবনের প্রতি তাঁর বিরাগ, বিতৃষ্ণা তিনি প্রকাশ করেছেন কবিতায়, যা তিনি রচনা করেছিলেন রাজঐশ্বর্য্য ছেড়ে চলে যাবার সময়। রাজমহিষী রাধারাণীর জীবনের এও এক আশ্চর্য্য সুকুমার মনোবৃত্তি যা হল তাঁর কবি প্রতিভা, যা প্রকাশিত হয়েছে দেবতার কাছে কবিতার বয়ানে। এটাই ছিল তাঁর শেষ আকুল প্রার্থনা। এই কবিতা এখনও লিখিত আছে মহারাজা কীর্তি চাঁদ কর্তৃক স্থাপিত নবরত্ন মন্দির বর্ধমানের দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দিরের নাটমন্দিরের দেওয়ালে। আজও দেবীর ভক্তকুল মন্দিরে এলে দেখতে পান এক নারীর বেদনা, হাহাকার ও রাজঐশ্বর্য্যের প্রতি বিপুল অনীহা কবিতাগুলির ছত্রে ছত্রে,যা খোদাই করা আছে নাটমন্দিরের গাত্রে। মহারাণী রাধারাণী লিখিত তিনটি কবিতা---
(১)--কবিতা-১
তোমারে,ডাকি মা , তাই।
এ তিনি ভুবনে,জননী আমার,আপন কেহই নাই।।
ত্রিলোকতারিণী,তুমিনারায়ণী,তুমিত সহায় সার।
তোমার মহিমা,অনন্ত অসীম,শুনিয়াছি বারে বার।।
তাইসচন্দনে,জোড়া বিল্বদলে,পরশি জাহ্নবী জল।
তোমার চরণে সঁপিনু জীবন তুলনা করিয়া ছল।।
ধর্ম,অর্থ,কাম,মোক্ষ নাহি চাই তোমার চরণ তলে।
জনমে জনমে, তনয়া হইয়া, বসিব জজনী বলে...।
মা, বলে ডাকি গো, নিকটে থাকিও,দেখিব মা তব মুখ।
জননী বলিয়া করতালি দিয়া ভুলিবে রাধিকা দুখ।।
অসয়ায় তনয়া
কবিতা—২
করুণা রুপিনী, শোন।
এবারে মরিলে এ রাজ মহলে,মোরে না আনিও পুনঃ।।
যেখানে, মা হয় সাধুর পীড়ন,অসাধু জিনিয়া যায়।
ভক্তের মহিমা উড়িয়া যায় মা,বঞ্চনা আদর পায়।।
গুণের সম্মান, হয় অবসান,ধনের সম্মান বাড়ে।
দেবতা হয় মা ভুতের অধীন,ভয়িয়া বেড়ায় ঘাড়ে।।
প্রভুত থাকে মা, পাষন্ডের হাতে,বিনাশে ধর্মের প্রাণ।
সাধুর লাঞ্ছনা, উঠিতে বসিতে দুর্জনের বাড়ে মান।।
সতীর না থাকে, অন্নের সংস্থান,অসতী কাঞ্চন পরে
কপটতা হয়, সভ্যতা যথা, কলঙ্ক প্রেমের ঘরে।।
এ মহলে মোরে আর না আনিও, এ মিনতি তব পায়।
রাধিকার দিন যেভাবে যাইল,বলিয়া বোঝান দায়।
নিরুপায় তনয়া
কবিতা—৩
মা, মা, মা, বলে ডাকিলে, জননী।
এই, ফল তার, ফলিল সঙ্করী।।
এই অপমান, নহে আমার তারিণী।
এই অপযশ, তব রবে জগভরি।।
রক্ষ, রক্ষ, সতী রক্ষ মা আমারে।
এই শত্রু কর হতে, ওগো কৃপা করে।।
তোরই, নামের জোরেতে জননী।
ত্যাজিয়া যাইব এই রাজধানী।।
ফিরিয়া হেথায় আসিব না আর।
এই প্রতিজ্ঞা মোর, পুর নারায়ণী।।
তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।
তব, কাতরা তনয়া
অদ্য ২৯ বৎসর পর বঙ্গদেশ ছাড়িয়া চলিলাম। ইতি সন ১৩৩৭ সাল ১৩ই আশ্বিন মঙ্গলবার
বন্দেমাতরম্‌ ।
১)মহারাজা বিজয়চাঁদ (বিবাহের সময়)
২)মহারাণী রাধারাণি দেবী (বিবাহের সময়)
৩)মহারাণী রাধারাণী দেবী(পরিণত বয়সে)
৪)সর্বঙ্গলা দেবীর মন্দির, বর্ধমান
ছবিগুলি নেট থেকে প্রাপ্ত...

No comments:

Post a Comment