Tuesday, December 31, 2013

=নেতাজীর স্মৃতির খোঁজে= -সৈকত চক্রবর্তী



=নেতাজীর স্মৃতির খোঁজে=
-লেখক ডঃ সৈকত চক্রবর্তী

(প্রথম পর্ব)

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের মৃ্ত্যু আজও আমাদের কাছে রহস্যের মোড়কে আবৃত।
ছোটবেলা থেকেই জানতাম,নেতাজীর চিতাভস্ম রক্ষিত আছে "রেনকোজি"নামক
জাপানের এক বৌদ্ধমন্দিরে। অধিকাংশ দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর মতো আমিও নেতাজীর একজন পরম ভক্ত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান আমরা
কোন দিনই ভুলতে পরবো না। গভীর দেশপ্রেম,অনমনীয় সংকল্প আর কঠোর
আত্মত্যাগের প্রতীক নেতাজী যেভাবে দেশের ভিতরে ও পরবর্তীকালে দেশের বাইরে
গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব দিয়ে বন্দিনী ভারতমাতার শৃংখলমোচনের জন্য
প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন,সেই রোমহর্ষক কাহিনী
স্মরণ করলে আজও আমরা অবাক হয়ে যাই,পরম শ্রদ্ধায় আপনা থেকেই মাথা নুয়ে
আসে সেই মহানায়কের পায়ে।
নেতাজীর জীবনকাহিনী সব সময়েই আমাকে অনুপ্রাণিত করে,জীবনের পথে
চলার দিশা দেখায়। এই মহান বিপ্লবী দেশপ্রেমিককে আমাদের দেশ আজও তাঁর
প্রাপ্য মর্য্যাদা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। দেশকে স্বাধীন করার সংকল্প নিয়ে দেশের
বাইরে থেকে তিনি যে সংগ্রাম করে ইংগ্রেজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে তাদের শক্তির ভিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং অবশেষে তাদের এ দেশ থেকে পালাতে
বাধ্য করেছিলেন,তাঁর শৌর্যের সেই অবিস্মরণীয় কাহিনী পড়তে পড়তে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-সুবিধার প্রতি চির-উদাসীন
নেতাজী কিন্তু তাঁর সংগ্রামী সহকর্মীদের সম্পর্কে সব সময়েই সচেতন থাকতেন, তাঁদের সুখ দুঃখের শরিক হয়ে সত্যিকারের অভিভাবকের আসন নিতেন। তাই তো
আজাদ হিন্দ বাহিনীর ৬০,০০০ সংগ্রামী ভারতবাসী এই বিপ্লবী নায়ককে তঁদের
হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন এবং তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য
করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নেতাজীর উদাত্ত আহ্বান-
"তোমরা আমায় রক্ত দাও,আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো"অথবা "দিল্লী চলো,
চলো দিল্লী"বাহিনীর সবার রক্তে আগুন ধরিয়েছিল সেদিন,তাঁরা ও সম্মোহিত হয়েই
কদম কদম বাড়ায়ে গিয়েছিলেন,দেশকে মুক্ত করার কঠিন সংগ্রামে। শিবাজীর শৌর্য্য স্বামীজীর ত্যাগের মিশ্রনে তৈরী নেতাজীর কর্মবহুল জীবন নিয়ে ভাবতে
গেলে মনটা আজ কেমন উদাস হয়ে যায়। .........



=নেতাজীর স্মৃতির খোঁজে
-সৈকত চক্রবর্তী

পূর্ব প্রকাশিতের পর
------------------- 
(২য় পর্ব)
--------
"......... কোনদিন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমার জাপানে আসা হবে। জাপান সরকারের আমন্ত্রণে হঠাৎ জাপানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ যেদিন পেলাম সবকিছুর মাঝে জাপানে রেনকোজি মন্দির দর্শণ করার কথাই সর্বাগ্রে ভেবেছিলাম।
জাপানে এসে তাই নেতাজীর বিতর্কিত চিতাভস্ম রাখার যে স্থান,সেই রেনকোজি
মন্দির দর্শণ করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ করে একদিন টোকিও
যাওয়ার ডাক পেলাম,একটা সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য-আমার পি এইচ ডির
গাইড প্রোফেসার কাজোও সাক্কার সঙ্গী হয়ে।
সেদিন ১২ই অক্টোবর,২০০৭ইং। আমার কর্মস্থান Tsu City থেকে
বেরিয়ে গেলাম সকাল ৮ টায়,চেপে বসলাম বুলেট ট্রেনে। ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার
বেগে চলে বুলেট আমাদের পৌঁছে দিল টোকিওতে,১ঘণ্টা ২০ মিনিটে-৩৮০ কিলোমিটার দূরত্বে। জাপানের সর্বোচ্চ গতিবেগসম্পন্ন বুলেট ট্রেনের কথা দেশে থাকতে অনেক শুনেছিলাম,এবার ঐ ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতায় কেমন যেন একটা
রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। ঐ দিন সেমিনার সারার পর প্রোফেসারের অনুমতি নিয়ে
আমি থেকে গেলাম একটা হোটেলে,আমার স্বপ্নের রেনকোজি মন্দির পরিদর্শন
করবো বলে।
পরদিন,১৩ই অক্টোবর। সকালেই হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম সোজা
রেনকোজির উদ্দেশে। মন্দিরটি জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের পশ্চিমে অবস্থিত।
টোকিও ছবির মতো সুন্দর শহর,সাজানো গোছানো,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন-কিন্তু শহর
হিসাবে খুব একটা বড় নয়। তাই লক্ষ লোকের দৈনন্দিন যাতায়াতের সুবিধার জন্য তৈরী হয় টোকিও সেন্ট্রাল রেলষ্টেশন,যেখানে মাটির নীচে সমস্ত শহর জুড়ে বিভিন্ন
স্তরে মাকরসার জালের মতো ছড়িয়ে আছে সাব-ওয়ে লাইন। বিভিন্ন
সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার মেট্রো সার্ভিস বিভিন্ন স্তরের সাবওয়েতে তাদের মেট্রো রেল চালিয়ে যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতের বন্দোবস্ত করে থাকে। সাব ওয়েতে
সরকারী সংস্থার রেলকে বলা হয় "টোকিও মেট্রো"। .........
-চ ল বে
---------------------------------------



=নেতাজীর স্মৃতির খোঁজে=
-সৈকত চক্রবর্তী
(তৃতীয় পর্ব)
পূর্ব প্রকাশিতের পর
--------- 
"..........ফিরে আসি পূর্বপ্রসঙ্গে,রেনকোজি যাত্রায়। টোকিও শহর ছেড়ে প্রথমে এলাম টোকিও সেন্ট্রাল ষ্টেশনে,দূরত্ব ২০ কিলোমিটার।
সেখানে গিয়ে মাটির নীচে সাব-ওয়ে মেট্রো সার্ভিসে দেখলাম বিভিন্ন গন্তব্যে
চলা মেট্রো রেলের তালিকা। রেনকোজি যেতে হলে আমাকে উঠতে হবে
"টোকিও মেট্রো সার্ভিসে"।                                                                                                                             মেট্রো ট্রেনের নাম"টোকিও সেন্ট্রাল -সিনজুকু-
হিগাসি কোয়েনজি"।                                                                                                                                          আমাকে যেতে হবে শেষ ষ্টেশন "হিগাসি কোয়েনজি"।
ট্রেন মিলিয়ে বসে পড়লাম,আর নামলাম এসে হিগাসি কোয়েনজি ষ্টেশনে।
সময় লাগলো ১৮ মিনিট। ষ্টেশন থেকে একটু এগিয়ে গেলেই একটা পার্ক,
আর সেই পার্কের পিছনেই মন্দিরে যখন পৌঁছলাম,তখন
বেলা প্রায় ১০ টা।
ছোট্ট এই বৌদ্ধমন্দিরটি জনবহুল শহরের মাঝে,জাপানীদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। ১৫৯৪ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ধনসম্পত্তি ও সুখের প্রতীক এই
মন্দির সাধারণ জাপানী নাগরিকদের কাছে এতটা পরিচিত না হলেও অধিকাংশ
ভারতবাসী,বিশেষ করে প্রতিটি বাঙ্গালী এই নামের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই
পরিচিত। বর্তমান প্রধান পুরোহিতের পিতা মোচিযুকি ছিলেন তৎকালীন মন্দিরের
প্রধান। ১৮ ই আগস্ট,১৯৪৫ ইং তাঁর অনুমতি নিয়েই মন্দিরে রাখা হয়েছিল
একপাত্র চিতাভস্ম আর কিছু সামগ্রী,যা বলা হয়ে থাকে নেতাজীর।
নেতাজী জাপানে"চন্দ্র বোস"নামে খুবই পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে
জাপান যখন পুরো সামরিক শক্তি নিয়ে ইংরেজদের ও আমেরিকানদের মোকাবিলায়
ব্যস্ত,তখন বিপ্লবী রাসবিহারী বোসের হাতে গড়া আজাদ হিন্দ ফৌজ ও তার নায়ক
নেতাজী সুভাষ জাপানীদের কাছে খুবই প্রিয়। সেই নেতা চন্দ্র বোসের স্মৃতিরক্ষার্থে
এবং অন্তেষ্ঠির কাজে সাহায্যের অর্থে তৎকালীন প্রধান পুরোহিত মোচিযুকি রাজী
হন এবং অনুমতি দেন চিতাভস্ম এবং তার সঙ্গে আরো কিছু সামগ্রী রেনকোজি
মন্দিরে রাখার। শোনা যায়,ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জানা ছিল না এই চিতাভস্ম
আসলে কার।
এই সময় জাপানের পরিস্থিতিও অনেকটা বদলে যায়।পর পর দু'টি পরমাণু
বোমার আক্রমন,আমেরিকার কাছে জাপানের পরাজয়,আত্মসমর্পণ-অনেক কিছুই
ঘটে কয়েক মাসের মধ্যে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও সুরক্ষিত রয়ে যায় রেনকোজি মন্দির এবং মন্দিরের একটা ছোট্ট কৌটায় রক্ষিত তথাকথিত নেতাজীর চিতাভস্ম
তৎসহ কিছু সামগ্রী।.........."

=নেতাজীর স্মৃতির খোঁজে=
-সৈকত চক্রবর্তী

(চতুর্থ পর্ব)

পূর্ব প্রকাশিতের পর
----------------
"............প্রতি বছর ১৮ই আগষ্ট দিনটিকে রেনকোজি
মন্দিরের পুরোহিতেরা পালন করে থাকেন নেতাজীর মৃত্যুবার্ষিকী হিসাবে।
জাপানে আমার মতো নেতাজীর ভক্ত যাঁরা রয়েছেন,তাঁরাও যোগদান করেন এই অনুষ্ঠানে। চিতাভস্ম আনার পর থেকে(১৮ই আগষ্ট,১৯৪৫ইং)
তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী জহরলাল নেহেরু(অক্টোবর ১৯৫৭ইং)এবং এক বছর পর রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ,প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী(১৯৬৯ইং),
অটল বিহারী বাজপেয়ী(৯ই ডিসেম্বর,২০০১ইং)-আরো অনেকেই এই
মন্দির দর্শণ করে গেছেন। সবাই শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন ঠিকই,কিন্তু নেতাজীর মতো একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর মৃত্যুরহস্য উন্মোচনে কেহই
তেমন আন্তরিকতা দেখান নি। শিলান্যাস করে বক্তব্য খোদাই করার মধ্যেই
তাঁদের আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিল।
রেনকোজি মন্দির প্রাঙ্গনে পাথরে খোদাই করা নেতাজীর আবক্ষ প্রতিমূর্তিটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমার ডানদিকে কাঠের ছোট্ট একটা
টেবিলে একটি "ভিজিটারস্ বুক"আর বামদিকে মূল মন্দির ও মন্দিরের
একটি কোঠা,যেখানে রক্ষিত আছে নেতাজীর তথাকথিত চিতাভস্ম। রুদ্ধদ্বার
সেই কোঠাটির দিকে তাকিয়ে মনটা আমার বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিচিত্র
এক অনুভূতিতে চোখের দৃষ্টি আমার ঝাপসা হয়ে উঠে। জানি না এই চিতাভস্ম কার,আদৌ এটা কোন চিতাভস্ম কি না। তবুও সারা পূথিবীর কাছে প্রচার হয়ে গেছে এখানে,এই মন্দিরে,নেতাজীর চিতাভস্ম
রক্ষিত ছিল। ..............."


(1)নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে নেতাজীর ছবি


Friday, December 6, 2013

সমীরদার বিয়ে ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী ১২.০৭.২০১৩ / বেলা ১১.৩০



সমীরদার বিয়ে

ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী  ১২.০৭.২০১৩  / বেলা  ১১.৩০

পেন্টু আমার ছোটবেলার বন্ধু । আমি , পেন্টু ,খোকন তিনজনেই এক স্কুলে পড়তাম । সকালে স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে ১ টা বাজতো । স্নান সেরে খাওয়ার পর হোম ওয়ার্ক থাকলে সেরে ফেলতাম । মা , সারা বাডির কাজ সেরে একটু বিশ্রাম নিতেন দুপুরে । ঠিক সেই ফাঁকে আমি জাল আলমারিতে রাখা নারকেলের নাড়ু সব ফাঁক করে দিতাম । মায়ের হাতের নারকেলের নাডুর স্বাদ এখন ভুলিনি। পেন্টুদের বাড়ী আমাদের বাডীর উল্টো দিকে । ওদের বিশাল বাগান বাড়ী ছিল। বাগানে রকমারি তরি তরকারি , হাঁস , গরু ,ছিল। একটা মস্ত পুকুর ছিল সেই পুকুর পাড়ে আমরা গিয়ে গল্প করতাম। হাঁস গুলো দেখতে খুব ভালো লাগতো বিশেষ করে রাজ হাঁস । আমাদের বাডীর কাছেই একটা খেলার মাঠ ছিল । আমরা সেখানে হয় ডাঙগুলি নয় চোর পুলিশ খেলতাম ।

 বিশ্বকর্মা পূজোর আগে আমাদের ঘুডির সুতোর মাঞ্জা দেওয়ার রেওয়াজ থাকতো । তাই পেন্টুদের বডী থেকে য়ানতাম হামান দিস্তা , ভাঙ্গা কাঁচ , হাঁসের ডিম । হামান দিস্তাতে কাঁচ গুঁড় করে সেটা হাঁসের ডিম ফাটিয়ে সেই কুসুমের সঙ্গে মিশিয়ে একটা মন্ড তৈরি হত । মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সমস্ত  চৌহদ্দি  জুডে গাছের গুঁড়িতে পাক খাইয়ে সুতো জড়ানো হত । এরপর মাঞ্জা দেওয়া হত হাতে সেই মন্ড  নিয়ে । সারা দুপুর আমাদের চলতো এই কাজ । আর কিছু হাঁসের ডিম আস্ত সিদ্ধ করে খাওয়ার জন্য ।  তিনটে ইট আড়া আড়ি ভাবে রেখে আরেকটা   ইট রাখা হত যাতে উল্টো ইউ  আকৃতি হয় । এরপর শুকনো বাঁশে কাগজ দিয়ে আগুন ধরানো হত । ইটের  উনুনে সিলভারের একটা বাটিতে চারটে , ছটা ডিম সিদ্ধ হত । ডিম সিদ্ধ নুন লংকা দিয়ে খেয়ে লেগে পডতাম ঘুঁডির সুতোর মাঞ্জা দিতে । সেই আনন্দের দিন গুল ভুলতে পারিনা

পেন্টুর জাঠতুতো  দাদা, সমীরদা’ তখন সদ্য মার্চেন্ট অফিসে চাকরিতে ঢুকেছেন । সমিরদাকে সকালে বাডীর ছাদে দেখা যেত কাগজ নিয়ে পডতে । আসলে কাগজ পডা নয় মিনুদির সঙ্গে চোখে চোখ মিলিয়ে একটু ভাসা ভাসা প্রেম আরকি । মিনুদির বাডী একটা বাডীর তফাতে তাই ওনাকেও সকালে হয় বই হাতে নয় কাপড় মেলতে দেখা যেত ।   আমাদের খেলার মাঠের কাছেই একটা ইটখোলা  ছিল। সেই ইটখোলাতে সমীরদা রবিবার কিম্বা কোন ছুটির দিনে বিকেলে আসতেন । কেন আসতেন আমরা বুঝতাম না । হাতে একটা সিগারেট , পরনে পায়জামা পাঞ্জাবী আর পায়ে স্লিপার । তখন সদ্য হাওয়াই স্লিপার উঠেছে । সমীরদা সামনের বাডীর ‘মিনুদির’   সঙ্গে যে চুপি চুপি প্রেম করতেন তা আমরা বুঝতাম না তখন। মিনুদি আসতেন ইটখোলাতে সমিরদাকে দেখা করতে পরে জেনেছি ।

        মিনুদি  খুব সুন্দরী ছিলেন । যেমন রং সেইরকম মুখের গড়ন । টিয়া পাখির মতন টানা নাক আর টানা টানা চোখ ।  সে , না দেখলে বোঝানো যায়না । প্রত্যেক দিন ভোর বেলায়   মিনুদি তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ করতেন । পাড়ার ফাংশনে  মিনুদির গান অবশ্যই থাকবে । সমিরদা নাটকেতে হিরোর রোল করতেন । অনেক ড্যান্স ড্রামা হত রবীন্দ্রনাথের  ‘তাসের দেশ’ ,’চিত্রাঙ্গদা’ ইত্যাদি । মিনুদি সব ড্যান্স ড্রামা নিজে নির্দেশনা দিতেন । পাডার মেয়েদের দিয়েই সুন্দর ভাবে পরিবেশন করতেন । সত্যি দেখার মতন। নাটক মানেই সমীরদা । রাত জেগে রিহার্সাল দেওয়া, স্ক্রিপ্ট লেখা সব সমীরদা । তাই বোধহয় সমীরদা মিনুদির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। খুব স্বাভাবিক ।

হঠাৎ পেন্টু বলল , সমিরদার বিয়ে । সমীরদার বাবা জোর করে সমীরদার বিয়ে ঠিক করেছেন এক অল্প বয়সের মেট্রিক পাস মেয়ের সাথে । সমীরদা কিন্তু ওনার মাকে মিনুদির কথা বলেছিলেন । জ্যাঠাইমা সব জানেন কিন্তু জেঠুর রাগের কাছে কেউ তিষ্টতে পারে না। এই ছিল তখনকার কালের  সমস্যা । সমীরদারা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ‘লাহিড়ী’ আর মিনুদিরা বদ্যি ‘সেনগুপ্ত’ !  অগত্যা সমীরদা বাডী ছাডা হলেন । অন্য জায়গায় বাসা ভাডা নিলেন। মিনুদিকে  আর রেওয়াজ করতে শোনা গেলনা ।

দুটি হৃদয়ের মিলন কি তাহলে অসম্ভব ! সেটাইতো প্রশ্ন !!   কি হল তবে ?
এর মধ্যে জ্যাঠাইমার জন্ডিস হল। সমীরদা মাতৃভক্ত ছেলে । মায়ের অসুখে কিছুতেই দূরে থাকতে পারলেন না । ফিরে এলেন বাডীতে । জেঠু ,  ডাক্তার বদ্যি সব করলেন । অনেকদিন জ্যাঠাইমা ভুগলেন শয্যাশায়ী হয়ে। ক্রমে ছেলেকে-দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন মাথায় হাত রেখে সে যেন তার মা’কে ছেডে কোথাও না যায় । সমিরদা ফ্যাসাদে পডলেন । ‘ফান্দে পডে বগা কান্দেরে’ এ কিছুটা  সেই রকম ই  অবস্থা । সমীরদা ঠিক করেছিলেন মিনুদিকে বিয়ে করে আলাদা থাকবেন । ভগবান বাধ সাধলেন । জ্যাঠাইমা সমীরদা কে বলেন বাবার পছন্দের মেয়ে কে বিয়ে করতে । সমীরদা গর রাজি । কিছুতেই রাজি করান গেলনা । সরদার মা বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আমরা জ্যাঠাইমাকে দেখতে যেতাম । আর পেন্টু আসত না খেলতে । সামনে বিশ্বকর্মা পুজো । ওই দিন ঘুড়ি ওডাতেই হবে ।

জেঠু এরমধ্যে মেয়ের বাবাকে আশীর্বাদের আয়োজন করার মনস্থ করেন ।                      সমীরদার মা  অনেক অনুনয় বিনয় করে ছেলেকে বোঝাতে চেষ্টা করেন । বাবা, কেন তুই বুঝছিস না”
 সমীরদা, “কিসের সমাজ মা! ,আমি ওই সমাজ মানিনা যেখানে ভালোবাসার কোন দাম নেই ?”
মানি না মানি না !!
হঠাৎ ঘরে জেঠু ঢুকলেন । সব নিস্তব্ধ ।

জেঠিমার চোখে জল । তিনি দোটানার মধ্যে পড়েন আর মানসিক অশান্তিতে কাটান ।
“তাহলে তোমার কি এটাই সিধান্ত খোকা” , জেঠু গম্ভীর ভাবে বলেন।
“হ্যাঁ বাবা । এটা আমার জীবনের চরম সিদ্ধান্ত যা আমাকেই নিতে হবে । আমি চাইনা কোন মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করতে । আমি ওই অপরিপক্ব এক ম্যাট্রিক পাস মেয়েকে জীবন সঙ্গিনী করতে চাইনা। আমি আপনার সঙ্গে এ বিষয় তর্ক করতেও চাইনা । আপনি আমায় বুঝতে চেষ্টা করুন” ।
 
    সমীরদা গড় গড় করে ডায়লগ বলার মতন বলে গেলেন।
 খোকা  তুমি নাটক করে নাটকের সংলাপ আমায় শোনাচ্ছ ! বাচালতার সীমা আছে । সীমা টপকাচ্ছ তুমি । নিজেকে কি মনে কর তুমি ? ওই বদ্যি বাডীর মেয়ে তোমার মাথাটা খেয়েছে । ঠিক আছে তুমি জদি ওকেই বিয়ে করতে চাও তবে এ বাডীর দরজা তোমার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ ।

এ কথা শুনে সমীরদা একদম বিচলিত হলেন না । পা বাড়ালেন দরজার দিকে ......।
জেঠিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে  ওঠেন ......  খোকা যাসনি ! খোকা যাসনি !! তোদের  বাবা ছেলের বচসাতে আমি যমের দ্বারে জেতে বসেছি । তুই আমার মরা মুখ দেখবি খোকা । আর  তোমাকেও দোহাই তুমি কেন ছেলেটার মনের কথা বুঝে উঠতে পারছোনা? কি চাও তোমরা ?
জেঠু চুপসে গেলেন এই কথায় । দাঁড়াও !! গর্জন করে ওঠেন !! খোকা দাঁড়াও !!!
সমীরদা ধীর স্থির ভাবে দাঁড়ালেন দরজার কাছে ।
জেঠু বলেন ,“ঠিক আছে  তুমি ওদের বাডীতে খবর পাঠাও”
সমিরদা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন । সত্যি বাবা ? ঢিপ করে প্রণাম করেন বাবা মাকে । আমি খবর দিচ্ছি ।

বাডীতেই  বৈঠকখানায় টেলিফোন ছিল । ফোনে খবর দেন মিনুদিকে ।
পরের দিন মিনুদিদের বাডী থেকে মিনুদির মা বাবা আসেন সঙ্গে আংটি মিষ্টির বাক্স আর জেঠিমার জন্য এক ঝুডী ফল , ডাব ইত্যাদি ।

জেঠিমা এখন অনেকটা সুস্থ বলে মনে হচ্ছে । এতদিন পর মুখে হাঁসি দেখে সবাই আশ্বস্ত ।
আজ চাকর বাকর ,পাডা পোডশি , ছেলে ছোকরা সব্বাই খুশি । সকলেই হার্দিক ভাবে এই যুগলকে বিবাহ বন্ধনে আবধ্য হতে দেখতে চান । আসলে জেঠু এ পাডার একজন গণ্য মান্য ব্যাক্তি ।  তাই বিয়ের ভোজ খুব ভাল হবে । আমরা সকলে বলি ,সমিরদা মিনুদির বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খাবো ।

খুব ধুম ধাম করে বিয়ে হল । আমি নিত বর হয়ে গেলাম সমিরদার সঙ্গে গাডীতে । দেখতে একটু লাল্টু ছিলাম  তাই বোধহয় আমার ভাগ্যে নিত বর হওয়া জুটে গেল।