আমার হিয়ার মাঝে
ত্রিভুবন জিৎ
মুখার্জী
কদিন ধরেই বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে ঘন মেঘ। মাঝে
মাঝেই বৃষ্টি ঝম ঝমিয়ে পড়ছে। আজ ঈপ্সিতা
কমলেশ এর এক বিশেষ দিন। আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী। কমলেশ অফিস থেকে ফেরার পথে একটা
ফুলের তোড়া আর তার প্রাণের অধিক ঈপ্সিতার জন্য বিষ্ণুপুর সিল্কের শাড়ি নিয়ে কোনমতে
নৈহাটি লোকালে উঠে পড়ে। বেলঘরিয়া ষ্টেশন আসতেই নেমে পড়ে। গাড়ি প্ল্যাটফর্মে নামতেই
এক রাশ লোক ঝড়ের বেগে নেমে পড়ে।
কমলেশ হাতের ব্যাগটা শক্ত হাতে চেপে ধরে কারণ তাতে
ঈপ্সিতার জন্য শাড়িটা যত্ন করে রাখা। ফুলের তোড়াটা কি করবে ভাবতে যাচ্ছিল হটাত
পেছন থেকে কে ঠ্যালা দেয়।
কমলেশ চিৎকার করে ওঠে। কি অসভ্য লোক রে বাবা। মানুষকে
এরকম ভাবে কেউ ঠ্যালা দেয় !
- লোকাল ট্রেনে কি
প্রথম উঠছেন দাদা? পেছন থেকে
বিদ্রূপের কণ্ঠস্বর শুনে ওর মাথা গরম হয়ে যায়.
- না আমি রোজকার যাত্রী।
তবে এত বাজে অসভ্য লোক দেখতে অভ্যস্ত নই।
- কাকে অসভ্য বলছেন ? ভিড় ঠেলে মানুষ
কোন মতে এগুচ্ছে তার মধ্যে আপনি ফুলের তোড়া নিয়ে ঢুকে মানুষকে অসভ্য বলছেন ! আপনি
নিজেকে কি ভাবেন বলুন ত ! অতো ফুলের সখ থাকলে ট্যাক্সিতে চড়ে ফুলের তোড়া নিয়ে
আসলেই পারতেন ।
- আমি কিসে যাবো
কিসে না যাবো সেটা কি আপনি ঠিক করবেন ? এই বলে কমলেশ
নেমে পড়ে। না সে হাতিবাগান থেকে ফুলের তোড়াটা না কিনলেই পারত। বেলঘরিয়া স্টেশন এর
কাছে কোন ফ্লোরিষ্টের দোকান থেকে কিনে নিয়ে গেলে
কি হত না ! ভুলটা তার ই হয়েছে।
কথাগুলো মনে মনে ভাবতে ভাবতে কখন বাড়ি এসে গিয়েছে খেয়াল করেনি।
ঘরে ঢুকেই ঈপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে বিবাহ বার্ষিকীর
অনেক অনেক ভালোবাসা। আমি সত্যি
তোমাকে পেয়ে ধন্য।
- ঈপ্সিতা নিজেকে
কমলেশের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে , তাড়া তাড়ি ফ্রেশ
হয়ে নাও । আমি তোমার খাবার বাড়ছি। চল হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা খাও। আমিও তোমার জন্য
বসে আছি কখন আসবে বলে !
- ট্রেনের ঘটনাটা
বলল না কমলেশ। ফুল ঈপ্সিতা খুব ভালো বাসে তাই বাছাই করা কাট ফ্লাওয়ার এর তোড়াটা
কিনেছিল। সেটা যে ট্রেনের যাত্রীদের পদপিষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেটা
বলা হয়নি। তাছাড়া সত্যি বলতে পকেটে আর টাকা ছিলনা নতুন ফুলের তোড়া কেনার। তাই শুধু
বিষ্ণুপুর সিল্কের শাড়িটাই ঈপ্সিতাকে বিবাহ বার্ষিকীর উপহার হিসেবে প্রদান করে
কিছুটা ধাতস্থ হল। কেমন হয়েছে
শাড়িটা পরে দেখত !
- এখন নয়। তুমি এত
দাম দিয়ে শাড়ি কিনলে কেন গো?
- আহা আমার সোহাগি ! কি করে না কিনি। বছরে এই দিনটার
জন্য বসে থাকো। কি উপহার আমি দিলাম
তা নিয়ে একটু কটু মন্তব্য করবে । তবে এবারে তোমার জন্য ফুল আনা হলনা। মনটা খারাপ ।
- তাতে কি হয়েছে , এত দামি শাড়িত
এনেছ। এই যথেষ্ট ।
- বলছ ! তবে আমার
পাওনাটা দাও।
- যাহ !
এখানে বলে রাখি কমলেশ ঈপ্সিতার পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে
কিন্তু ঈপ্সিতা সন্তান দিতে পারেনি কমলেশ কে । এই নিয়ে কমলেশের মনে কোন কষ্ট নেই
কিন্তু ঈপ্সিতার মনে
কষ্ট আছে। সে নিজেকে অপরাধী মনে করে । অনেক ডাক্তার দেখান হয়েছে কারুর কোন দোষ
ত্রুটি নেই বিভিন্ন টেস্ট এর ফলাফল যা বলছে। কমলেশ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না । এইতো বেশ
আছি । কোন বন্ধন নেই। এই ভাবেই কেটে যাক না দিন গুলো।
ঈপ্সিতার মা মাসি নানা টোটকা করেন ফল কিছুই হয় না।
ঈপ্সিতার একটি সন্তান থাকলে তার সময় কেটে যেত। সারাদিন টুক টাক কাজ নিয়ে থাকে। গান
করে, ছবি আঁকে , সেলাই করে। ঘরের
সমস্ত কাজ গুছিয়ে করে। সারা ঘর ঝক ঝক করে। রান্নাও ভালো করে।
আজ কমলেশের জন্য ইলিশ পাতুরী, কসা মাংস, ফ্রাএড রাইস, পনির টিক্কা, চাটনি, পায়েস, সংগে কমলেশ কাল
যে মিষ্টি এনে রেখেছিল ফ্রিজে সেগুলো আছে। সব সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়
ইপ্সিতা। কমলেশ হাত মুখ
ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। ট্রেনের কোন
কথাই বলেনা,তবে ফুলের তোড়াটা ট্রেনে পড়ে যাত্রীদের পদপিষ্ট হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেই কথা বলে হাঁফ ছাড়ে।
ঈপ্সিতা কথাটা শুনে বিব্রত হয়।
- তোমার কিছু হয়নি
ত !
- না আমার আবার কি
হবে?
ঈপ্সিতা কমলেশকে খুব যত্ন করে খেতে দেয়। কমলেশ পরিতৃপ্ত নয়নে ঈপ্সিতাকে দেখে ভাবে
সত্যি তার বৌ ভাগ্যটা ভালো। আসলে পুরুষ মানুষের মন জয় করতে হলে ভালো রান্না র প্রয়োজন। ঈপ্সিতা সে বিষয়
পটু।
সারাদিনের খাটুনিতে কমলেশ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঈপ্সিতা তার মাথায় বিলি কেটে বলে এতই ঘুম!
- হ্যাঁ। খুব ঘুম
পাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নাসিকা গর্জন।
বেল্কনিতে ঈপ্সিতা বসে একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইল.
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।…….
হটাত ওর পিঠে কার হাতের স্পর্শ পেল।
পেছন ফিরে তাকাতেই ‘কমলেশ’ দেখে বলে.... ও তুমি !
কমলেশ ঈপ্সিতার গানে মুগ্ধ। হাত তালি দিয়ে ইপ্সিতাকে
সুন্দর গান পরিবেশনের জন্য ধন্যবাদ জানায় ।
-কোই আগে ত কখন আমার গানের সুখ্যাতি করনি ।
-আগে ত কখন লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার গান শুনিনি।
-তাই বুঝি ! কপট রাগে ইপ্সিতাকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছিল আজ।
কমলেশ দু চোখ ভরে তার প্রিয়া কে দেখছিল মুগ্ধ হয়ে ।
মেঘলা আকাশে চাঁদ স্পষ্ট ছিলনা তাও তার বারান্দার চাঁদ তার কাছে সবচেয়ে সুন্দর ।
কমলেশ একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ।
---২---
কমলেশ ঈপ্সিতার দিনগুলো ভালোই কাটছিল । এরমধ্যে
ঈপ্সিতার পীড়াপীড়িতে কমলেশ এক কন্যা সন্তানকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । ঘটনাটা
এইরকম । ঈপ্সিতার বাড়ির পরিচারিকা (লক্ষ্মী)র তৃতীয় কন্যা সন্তান হওয়াতে তার মাতাল
স্বামী নাকি সেই শিশু কন্যা সন্তানটিকে
বাড়ির দোতালার ছাদ থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় লক্ষ্মী তার
মাতাল স্বামীর হাত থেকে তার কন্যাটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঈপ্সিতার বাড়ি দৌড়ে চলে আসে। ঈপ্সিতার পায়ে পড়ে সকল ঘটনার
বৃত্তান্ত দেয়। ঈপ্সিতা সব শুনে তৎক্ষণাৎ থানাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু
লক্ষ্মীর অনুরোধে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যায়। সেইসময় ঈপ্সিতা লক্ষ্মীকে দিয়ে সর্ত করিয়ে নেয় যে, সে কন্যা সন্তানটিকে লালন পালন করবে কিন্তু লক্ষ্মী
যেন তার এই মেয়েটিকে পরে দাবি না করে। আইনত দত্তক নিলে সেই ব্যবস্থাই থাকে যাতে
পালিত পিতা মাতার কোন আইনগত সমস্যা পরে না হয়। যেমন বলা সেইরকম কাজ । লক্ষ্মীর
স্বামী , লক্ষ্মী এবং ঈপ্সিতা , কমলেশ সকলে
কোর্টে কন্যা সন্তানটিকে দত্তক নেয় । কোর্ট কমলেশ ঈপ্সিতার হাতে কন্যাটিকে প্রদান
করে নানা আইনি কাগজ পত্র সই সবুদের পর । এখন আর কোন সমস্যা নেই । ঈপ্সিতা কন্যাটি
পেয়ে খুব খুশি । তার মা হওয়ার সাধ লক্ষ্মীর মেয়ে পূর্ণ করে । সে এখন মা । তাকে আর
কারুর কথা শুনতে হবে না।
লক্ষ্মী ওই বাড়িতেই সারা দিন কাজ করে। তার মেয়েটির
মাতৃ স্নেহের অভাব হয়না । যেন দেবকী , যশোদা দুই মাতার সান্নিধ্যে মেয়েটি ক্রমে বড়
হতে লাগে। খুব আহ্লাদী তাই তার নাম ‘আহ্লাদী’ দেয় ঈপ্সিতা। লক্ষ্মীও খুশি ওই নামে । আহ্লাদীর ছয়
মাসে অন্নপ্রাশন হয় ঘটা করে। সত্য নারায়ণ পুজো হোম ইত্যাদি হয়। আত্মীয় স্বজন সকলেই
আসে । কিন্তু ঈপ্সিতার মা এই পরের মেয়ের তাও পরিচারিকার মেয়ের ঘটা করে অন্নপ্রাশন
একদম ই পছন্দ করেন না। ঈপ্সিতা ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দেয়।
কমলেশ , ঈপ্সিতার খুশীতেই
খুশী তাই সে এসব বিষয় মাথা ঘামায় না।
আহ্লাদীর তিন বছর বয়েসে স্কুলে ভর্তি হয় । স্কুলের
ড্রেসে তাকে বেশ ফুট ফুটে দেখায়। লক্ষ্মীর চক্ষে আনন্দাশ্রু । সে পরিতৃপ্ত নয়নে
আহ্লাদীকে দেখে দুহাত ভরে আশীর্বাদ করে। আহ্লাদী, লক্ষ্মীর চেয়ে
ঈপ্সিতাকে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু লক্মী যে মা, সে তার জননী তার স্নেহ উপচে পড়ে আহ্লাদীর ওপর। স্কুলে
নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা সব লক্ষ্মী করে। তার টিফিন বাক্স গোছান , জামা কাপড় কাচা , ইস্ত্রী করা
ইত্যাদি সব কাজ । সে জানে এখানে তার কন্যাটি সযত্নে আছে এবং থাকবে ।
আহ্লাদীর চার বছর পূর্ণ হয়ে গেল এর মধ্যে। পাঁচে পা
দেওয়াতে তার ঘটা করে জন্মদিন পালন করা হল। লক্ষ্মী সব দেখে শান্তির নিঃশ্বাস নেয় ।
মনে মনে ভাবে সে নিশ্চিন্ত তার মেয়ের ব্যাপারে । ভালো ঘরে মেয়েটি মানুষ হচ্ছে
পড়াশুনো করছে এর চেয়ে আর কি বেশি চায় । ভগবান ওকে সুস্থ সবল রাখুক সেটাই তার এক
মাত্র ভগবানের কাছে প্রার্থনা ।এদিকে ইপ্সিতা আহ্লাদীকে এত বেশি ভালবেসে ফেলে যে
আহ্লাদীর কাছে লক্ষ্মীর উপস্থিতি বেশি সহ্য করতে পারেনা। যতই হোক পালিতা মাতা আপন
মাতা ত নয় ! লক্ষ্মী জেনেও
না জানার ভান করে । ও ভালো করে জানে ওর সামান্য ভুলের জন্য হয়ত ভবিষ্যতে ওকেই তার
মাশুল দিতে হবে। ও তাই সর্বদা সতর্ক থাকে ইপ্সিতা কে তোয়াজ করে ওর মন রেখে কথা বলে,ঘরের সমস্ত কাজ কর্ম করে, আহ্লাদীর স্কুল ড্রেস ঝক ঝকে পরিষ্কার করে কাচে যদিও
ওয়াশিং মেশিন আছে তবুও লক্ষ্মী নিজের হাতেই সমস্ত কাচে আয়রন করে , আহ্লাদীকে
স্কুলের বাস স্টপে নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে।
ইপ্সিতাই আহ্লাদীকে স্কুলের সমস্ত পড়া পড়ায় । কেমন
সুন্দর টক টক করে রাইমস বলতে শিখেছে আহ্লাদী । স্কুলের পড়া খুব মনোযোগ দিয়ে করে আর
ছবি আঁকে । আহ্লাদীর ছবি আঁকা তার মা ইপ্সিতা শিখিয়েছে । আহ্লাদী এখন ভালোই ছবি
আঁকে । এইতো স্বাধীনতা দিবসে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় আহ্লাদী প্রথম পুরষ্কার পায়
জাতীয় পতাকা আঁকার জন্য। সকলে খুব প্রশংসা করে আহ্লাদীকে আর লক্ষ্মীর গর্বে আর
আনন্দে দুচোখ থেকে আনন্দাশ্রু বয়ে যায়। সেই ত তার জন্মদাত্রী মা কিন্তু নেপথ্যে
আছে তার মেয়ে কিছুই জানেনা জানার উপায় ও নেই । লক্ষ্মী তার মনের দুঃখ মনেই রাখে
আবার এই বলে মনকে সান্ত্বনা দেয় , “কাঁদিস কেন !
আহ্লাদীকে কে তুই এই ভাবে
মানুষ করতে পারতিস ? পারতিস না ত ! তবে তোর দুঃখ কিসের ? কিন্তু মন মানতে
চায়না। ”
লক্ষ্মীর কিছু কিছু আচরণ ইপ্সিতার চোখে পড়ে । ও বোঝে
লক্ষ্মী ক্রমশ তার মেয়ের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে । সে ভয় পায় যদি মেয়েটাকে চুরি করে
নিয়ে পালায় ! হায়রে পোড়া কপাল এই দ্বন্দ্বে ছেড়ে-দিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর তাদের দুই মা’কে আর মুখ টিপে হাসছেন । ইপ্সিতা নিজের
সন্দেহে নিজেই লজ্জা পায়। ছিঃ ! একি ভাবছে সে ! সে না শিক্ষিতা । একজন অশিক্ষিতার
মতন সন্দেহ করতে তার লজ্জা করেনা।
এই টানা পড়া দুজনের মনেই চলতে থাকে।
--৩—
বেশ কিছুদিন
এইভাবে চলতে থাকে । এরমধ্যে আহ্লাদী বড় হচ্ছে। ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কমলেশ
ইপ্সিতা দুজনে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে এসেছে তাকে। এখন তার স্ট্যান্ডার্ড ওয়ান ।
সারাদিন লক্ষ্মীর কেটে যায় মেয়ের কাজ করে এবং ইপ্সিতার ঘরের কাজ করে। লক্ষ্মী মনের
আনন্দে সব কাজ করে। তার মেয়ে বড় ঘরে মানুষ হচ্ছে এটা তার কাছে এক স্বপ্ন। তাকে ত
তার মা বাবা ঘাড় ধরে এক জল্লাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন । অবশ্য মা বাবার দোষ নেই
সব তার অদৃষ্টের দোষ।
এরমধ্যে লক্ষ্মীর স্বামীর কিছু ধার দেনার জন্য টাকার
প্রয়োজন হয় । বারে বারে লক্ষ্মীকে বলে ইপ্সিতার কাছ থেকে টাকাটা আনতে কিন্তু
লক্ষ্মী কিছুতেই রাজি হয়না। বলে তোমার মেয়েকে ওরা ভালো ভাবে মানুষ করছে আবার তোমার
মদ গাঁজা খাওয়ার টাকা দেবে কখনই নয়। কিসের জন্য তোমার অত টাকার প্রয়োজন শুনি !
এ কথা শোনার পর মণ্টা (লক্ষ্মীর স্বামী) তেলে বেগুনে
জ্বলে ওঠে। বলে কি বললি আমার মুখের ওপর চোপা । লক্ষ্মীকে মার ধর করে । বলে টাকা না
আনলে আমার ঘরে ঢ়ুকবিনা । ওখানেই থাক।
- লক্ষ্মী বলে তবে
তাই হবে কে তোমাকে গায়ে গতরে খেটে পুষবে ? সারা জীবন শুষে
খেয়েছ। আমার কথা কোনোদিন ভেবে দেখেছ আমি কি খাই কেমন ভাবে তোমার সংসার চালাই?
পরে নানান ধমক চমকে লক্ষ্মী ভয়
পায় এবং ইপ্সিতাকে ১০,০০০ টাকা চেয়ে বসে ।
ইপ্সিতা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে এত টাকা তার কিসের
জন্য প্রয়োজন ।
লক্ষ্মী বলে তার বর ধার করেছে কোথায় কি ব্যবসার জন্য
তাই জন্য চাইছে ।
- কিসের ব্যবসা ?
- জানিনা-গো দিদি
আমি মুখু সুক্ষু মানুষ ওই ব্যবসার কথা কি করে জানবো বল ! তা ছাড়া আমি ত তোমার
কাছেই সারা দিন থাকি না কি বল । থাকি ত !
- তা ঠিক তবুও তোর
জানা উচিৎ । এতোগুলো টাকা নিয়ে ও হয় মদ গিলবে নয় বাজে যায়গায় যাবে ।
- বরের গুণকীর্তনের কথা আর কি বলবে ? বলে ঠিক আছে আমি বলে দেব ওকে অন্য জায়গায় চাইবে।
- না না তা নয় তবে
একটা সন্দেহ ত হয় বল।
- কি করি বল দিদি
সব ই আমার অদৃষ্ট । তোমরা আমার মেয়েকে দত্তক নিয়ে ভালো ভাবে মানুষ করছ তা কি ওই
জল্লাদ টা জানে ? সে তার নিজের সুখ আর ফুর্তি তে ব্যস্ত । আমি গতর
খাটিয়ে নিজে খাবো আবার ওকে খাওয়াবো । একটা যায়গায় কি কাজ করত সেখানেও কি গণ্ডগোল
করেছে। ইউনিয়নের লিডার হয়েছে । ব্যাস কাজটা গেল চলে। এখন বলে ব্যবসা করবো । আমি কি
করি বলতে পারো দিদি বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। না দিদি তুমি টাকা দিও না।
একবার দিলে ও পেয়ে বসবে । এমনিতেই ত আমাকে জ্বালাচ্ছে। আমার মেয়েটা এখানে ভালো
ভাবে মানুষ হচ্ছে ওর কু নজর লেগেছে এবার আমার মেয়েটার ওপর ।
- ঠিক আছে ঠিক আছে
তুই যা আহ্লাদীর স্কুল থেকে আসার সময় হয়ে গেল যা গিয়ে নিয়ে আয়।
- যাই গো দিদি বলে চোখ পুঁছতে পুঁছতে লক্ষ্মী চলে
যায়।
--- ৪ ---
মণটা তার বন্ধুদের সাথে সুরা পানে মসগুল। বন্ধুদের
বলে বুঝলি , বৌটা আমার এ.টি.এম মেশিন। পড়াশুনো করেনি কিন্তু বেশ রোজগার করছে। আমার ছোট
মেয়েটাকে বড়লোকের ঘরে মানুষ করাচ্ছে। সে এখন ইংরেজি শিখেছে। টক টক করে অনেক
ইংরেজিতে কবিতা আওড়াচ্ছে । আমার বৌ ত ওর আয়া রে। মেয়ের ‘আয়া মা’ । শুনেছিস কোনদিন নিজের মেয়ের আয়া হয় কোন মা। বলে হেঁসে
কুটিপাটি খায়। বৌকে বলেছি ১০,০০০ টাকা আনতে নাহলে ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
পিন্টু , মনটা র সাগরেদ
বলে সেকিরে বৌদি চলেগেলে খাবি কি? তোর ত রোজগার
পাতি কিছু নেই ।
- সেই জন্যই ত
বলেছি টাকা আন তবেই ঘরে থাকবি ।
- কিন্তু বৌদি যদি
সত্যি চলে গিয়ে ওদের বাড়িতে থাকে তখন তুই কি করবি ?
- দূর আমার আরও
দুটো মেয়ে আছে না । তারা ত স্কুলে পড়ে । তাদের ছেড়ে ও যাবে না । আমি জানি । ও ঠিক
টাকা আনবে । দেখিস এই বলে গ্লাসের বাকিটুকু গলাধঃকরণ করে।
- বলছিস গুরু। একটু
চরণামৃত দে মাইরি । গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। বৌদি তাহলে বড়ই ফাঁদে পড়েছে বল।
- হ্যাঁ । আমার
বুদ্ধির কাছে ও পাত্তা পাবে ? কিসসু করতে পারবেনা দেখে নিস। আনবে না ওর ঘাড় আনবে। আজ বাড়িতে আশুগ
দাঁড়া । ওর এক দিন কি আমার এক দিন।
- চল গুরু রাত অনেক
হল চল যাই।
- দূর মোটে সোয়া
আটটা বাজে। তুই দেখছি এই টুকুতেই চোখে সর্ষে ফুল দেখছিস। তবে হ্যাঁ ওর আসার সময় হয়ে
গেল।
স্কুল থেকে আসার পর আহ্লাদী ইপ্সিতার কাছেই থাকে।
ঘরেই ওর বেশি সময় কাটে। বাইরে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে ছাড়ে না ইপ্সিতা । সকলের নানা
প্রশ্নে মেয়েটার মনে যদি কিছু তার কু প্রভাব পড়ে তাই ইপ্সিতা ওকে বাড়িতে ডল হাউস , বার্বি ডল
ইত্যাদি কিনে দিয়েছে যাতে ও বাড়িতে থাকতে চায়।
লক্ষ্মী, বাড়ির সমস্ত
রান্না বানা সেরে আহ্লাদীকে নিয়ে ঘরে এনে ওকে খাইয়ে দাইয়ে ইপ্সিতার ঘরে ছেড়ে আসে। ইপ্সিতা দিদি কিছু খাবার দিয়ে ছিল
লক্ষ্মীর দুই মেয়ের জন্য। সবসময় ইপ্সিতা বলে ওই মেয়ে দুটোর কি হবে কে জানে ?
লক্ষ্মীর প্রায় দিন ই বাড়ি ফিরতে সাড়ে আটটা নটা হয়ে যায়।
- লক্ষ্মী বলে যা
অদৃষ্টে আছে তাই হবে দিদি। আমি যথা সাধ্য চেষ্টা করছি যাতে ওরা মানুষ হয়। ওরা
যতদূর পড়ছে পড়ুক । তুমি ত আছো দিদি। আমাকে একটু সাহায্য করবেনা ওদের পড়া শুনোর
জন্য । কি গো করবে ত ! বলে ইপ্সিতার মুখের দিকে তাকায় ।
- নিশ্চয়ই করব ।
কেন করবোনা। আমি চাই ওরা পড়ে মানুষ হোক । দিদি নাম্বার ওয়ানে দেখছিসনা কত তোদের মতন মেয়ে
স্বরোজগারক্ষম হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসার চালাচ্ছে আবার রোজগার ও করছে। সরকার
তোদের জন্য রোজগারের পথ অনেক খুলে রেখেছেন। তুই এক কাজ করবি তোর দুই মেয়েকে কিছু
হাতের কাজ শেখা। দাঁড়া আমাদের ওয়ার্ডের কর্পোরেটারের সঙ্গে কথা বলে দেখব আমি।
- কোথা থেকে টাকা
পাবো দিদি ? ওরা সকলে টাকা নাহলে কিছু করেনা গো দিদি । গরিবের
দুঃখ কেউ শোনেনা।
- কে বলল কেউ
শোনেনা। তুই গিয়েছিস ওদের কাছে?
- তবে আমার একটা
কিছু বেশি রোজগারের ব্যবস্থা করনা গো দিদি । আমি রাত জেগে কাজ করতে রাজি । তোমার
সব কাজ সেরে আমি যাবো । আমার মেয়ে দুটোকে মানুষ করতে হবে গো দিদি। ওরা বড় দুঃখী ।
এরকম বাপের মেয়ে হওয়া পূর্ব জন্মের পাপ ।
- যত বাজে কথা বলিস
। পূর্ব জন্ম কি রে ? তুই দেখেছিস পূর্ব জন্ম ! ও সব বাজে কথা । দাঁড়া
ভগবান সহায় হলে সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে। ভালোকথা তুই সেলাই জানিস ?
- না তবে শিখে নেব
। তুমি দেখ আমার জন্য কোন শিক্ষানুষ্ঠান আমি ঠিক সেখানে গিয়ে শিখে নেব।
- ঠিক আছে আমি কথা
বলে দেখব ।
ইপ্সিতার সঙ্গে ওদের কাউন্সিলার আর কর্পোরেটের ভালোই
চেনা শোনা আছে । ওনারা এই বিষয় কিছু সুরাহা করতে পারবেন বলে মনে হয়। কর্পোরেটারের
কাছথেকে ‘কণ্যাশ্রী ’ যোজনায় সম্পৃক্ত অধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে লক্ষ্মীর
দুই মেয়ের পড়ার জন্য কিছু আর্থিক সুরাহা করতে পারলে ওর অনেকটা উপকার হয় ।
কর্পোরেটারের অনুমোদনে ওরা দুজনেই কন্যা-শ্রীর সরকারী সাহায্য আবেদন করে । রাজ্যে গরিব
জনসাধারণের জন্য সরকার অনেক যোজনা করছেন । তার মধ্যে কণ্যাশ্রী একটা।
এমনিতেই লক্ষ্মীর মেয়ে দুটোই ভালো পড়াশুনো করে। আসলে
গরিবের ঘরের মেয়েরা আজকাল ভালো পড়ে
কারণ ওরা ছোট বেলা থেকেই আর্থিক অনাটনে ভোগে দুবেলা দুমুঠো খাবার পায়না সেটাই ওদের
স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে।
লক্ষ্মী ঘরে ফেরার পর তুমুল কাণ্ড বাঁধে । মণ্টা বারে বারে এক কথা জিজ্ঞাসা করে
লক্ষ্মী টাকা চাইলো না চাইলো না। লক্ষ্মী কোন কথার জবাব না দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে ।
ও জানে মন্টা এই সময় নেশা করে এসেছে কিছু বললে তুমুল কাণ্ড লাগাবে।
এইসময় মণটা ক্ষুব্ধ হোয়ে বলে টাকা না আনলে ঘর-থেকে
বেরিয়ে যা । লক্ষ্মী মেয়ে দুটোর হাত ধরে বেরুতে যাচ্ছিল মণ্টা বাধা দিয়ে বলে তুই
একা যা ওদের কেন নিচ্ছিস?
কিন্তু মেয়ে দুটো মায়ের সংগে যেতে চাইলো । তারা সাফ
তাদের বাবাকে জানিয়ে দেয় তাদের মা যেখানে যাবে তারা তার সংগে সেখানেই থাকবে। লক্ষ্মী জানে ওর সঙ্গে বচসা করে লাভনেই ।
তারচেয়ে আজকের দিনটা দিদির কাছে থেকে ওর মায়ের কাছে চলে-যাবে। চৌকাঠ পেরুনোর সময়
লক্ষ্মীকে মণ্টা জোরে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। টাল সামলাতে না পেরে লক্ষ্মী উঠনে পড়ে
যায় এবং কপাল ফেটে রক্ত ঝরে। লক্ষ্মী জোরে চিৎকার করে বলে মেরে ফেলল তোমরা কেউ বাঁচাও এই জল্লাদের হাত
থেকে আমাকে।
এরমধ্যে পাড়ার লোকজন এসে পৌঁছোয় । মণ্টাকে সকলে গালি গালাজ করে। মণ্টা
চুপসে যাওয়ার বস্তু নয় । সে ফুঁসে ওঠে আমার বাড়িতে তোরা কে রে ?
মেয়েগুলো তার স্বরে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ করে ।
তারা যথেষ্ট নির্যাতন চোখের সামনে দেখছে । পাড়ার ছেলেদের বলে বাবা প্রায় ই মাকে
মারধোর করে ঘরে অশান্তি করে । আমরা আর এখানে থাকব না। মামার বাড়ি চলে যাব।
মণ্টা চেঁচিয়ে উঠে বলে , কি বললি ? কি বললি ? মামার বাড়ি ! হা
হা হা ওরে তোদের মামার বাড়ি থাকলে ত যাবি ।
- তাহলে অন্য কোথাও
চলে যাবো কিন্তু তোমার মতন বাবার কাছে থাকবনা । আমরা জ্ঞান হওয়া থেকে দেখছি তুমি
মাকে অকারণে মার। মা মুখ বুঝে সহ্য করে আমাদের মুখ দেখে।
- ওরে তোদের ত খুব
মুখের চোপা হয়েছে দেখছি। দাঁড়া .....
- না না মেয়েদের
গায়ে হাত দেবে না মণ্টা দা । ভালো হবেনা। পাড়ার ছেলেরা এক সংগে চিৎকার করে ওঠে।
- কি করবি তোরা ?
- দেখতে চাও কি করব
।
- পেছনে এক
কনস্টেবল সাদা পোশাকে ছিল । সে বলে চলুন আপনি থানায় । ওখানেই এর সমাধান হবে।
- থানায় ! .. থানায়
কেন যাবো ? আমি কি চোর না ডাকাত ?
- তারচেয়ে বেশি
সাংঘাতিক আপনি । চলুন।
- কিন্তু আপনি কে?
- আমি কে সেটা
থানায় গেলেই জানতে পারবেন । বাড়ির স্ত্রী কে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন সেটাই কি যথেষ্ট নয় আপনাকে থানায়
নেওয়ার জন্য। আবার মুখে মুখে তর্ক করছেন !
- ওরে সব্বাই মিলে ধরত
। পালায় না যেন । কনস্টেবল চেঁচিয়ে ওঠে।
- লক্ষ্মী সঙ্গে
সঙ্গে চলে এসে বাধা দেয় । দারোগা বাবু এবারের মতন মাফ করুন ওকে। ও রাগের চোটে
এমনটি করে ফেলেছে। আর করবেনা ভবিষ্যতে ।
- আপনি কি করে
বলছেন ও আর করবেনা বলে ? যে বাবা নিজের পরিবারকে হেনস্তা করে তাদের ভরণ পোষণ
এর দায়িত্ব না নিয়ে স্ত্রীকে টাকা আনতে বলে তার মনিবের কাছ থেকে এবং না আনতে পারলে
মার ধর করে , সে যে ভবিষ্যতে এমনটি করবে না সেটা হলফ করে কি করে
বলতে পারছেন। না ওনাকে থানায় যেতেই হবে। এই বলে মণ্টা কে কনস্টেবল ধরে নিয়ে জান।
লক্ষ্মী মহা ফ্যাসাদে পড়লো । স্বামীকে কি করে বাঁচাবে
কিছু কূল কিনারা পেলনা।
এই হচ্ছে ভারতীয় নারী। অত্যাচার সহ্য করেও স্বামীর
হয়ে তাকে রক্ষ্যা করে তার বিপদে ।
মন্টাকে পুলিস নিয়ে গেল থানায়।
থানায় ওসি মন্টাকে জিজ্ঞাসা বাদের পর চার্জ শিট তৈরি
করার বাহানা করেন। বলেন তুই তোর বৌকে প্রায় মারধোর করিস। আইনত ওটা জামিন অযোগ্য ধারা ৪৯৮-এ এ কোর্ট চালান করলে কি হবে জানিস? শ্রী ঘরে কমসে কম ৪-৫ বছর কাটাতে হবে।
লক্ষ্মী থানার ওসি কে বলল সার ওকে এইবারের মতন ছেড়ে
দেন । ও আর করবেনা ।
- ওটা তুই বলছিস। ও
কি বলেছে? না না ওকে শ্রী ঘরেই পাঠাব।
মন্টা সটান ওসির পায়ের তলায় পড়ে বলে চাকরি যাওয়াতে
মণটা ভালো নেই দারোগা বাবু । কাঁহাতক বৌয়ের গজ গজানি শুনবো । মনমেজাজ ভালো ছিলনা।
ভুল করে ফেলেছি আর হবেনা।
- না না তোদের মতন
ষাঁড় দের আমি চিনিরে । বয়েস ত কম হলনা । তোদের পেটে একটু পড়লেই স্বর্গ দেখিস
নিজেকে ইন্দ্র ভাবিস। তোর বৌ না লিখলে হবেনা।
লক্ষ্মী বলে বাবু ওকে ছেড়ে দিন। ভুল করে ফেলেছে।
- তবে তোরা দুজনে
কাগজে সই করে দে। পাড়ার একটা মাতব্বর ছেলে ওসির কানে কানে কি বলে।
ওসি মাথা নাড়িয়
বলেন না না।
- তাহলে ঠিক আছে সার । (ছেলেটি বোঝে ও সব ভয় দেখানোর জন্য
ওসি বলছেন)
মন্টা সই করার সময় বলে সার সাদা কাগজে ..... !
- চুপ যা বলছি তাই
কর । বেশি কথা বললে .....!
- হ্যাঁ সার করছি
এই বলে লক্ষ্মী আর মন্টা দুজনেই কাগজে সই করে দেয়।
দুজনে ফিরে আসে ঘরে।
মন্টা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে মুখ দেখেই লক্ষ্মী টের
পেয়েছে। মনে মনে ভাবে ঠিক হয়েছে। এইরকম ওষুধের প্রয়োজন ছিল। তারপর ভাবে আহারে আমার
জন্য লোকটার এত অসম্মান হল।
-----৫------
পরেরদিন লক্ষ্মী ইপ্সিতার কাছে বলে দিদি আমার স্বামী
কিছু সরকারি সাহায্য পেতে পারে ? ও একটা মটর সাইকেল সারানোর গ্যারেজ করতে চায়।
- জানিনা । আমাকে
ওর বিষয় কিছু বলিস না । তুই যা এখন এখান থেকে।
লক্ষ্মী আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায় নিজের কাজে। ১০,০০০ টাকা তে ত
গ্যারেজ হবে না। আরও টাকা লাগবে। তবে
ওর কানের দুটো সোনার দুল কি বিক্রি করে দেবে !
পরর দিন লক্ষ্মীকে ওর কানের দুল না থাকা অবস্থায় দেখে ইপ্সিতা চমকে ওঠে ।
- কিরে তোর কানের দুল দুটো কোথায় গেল?
- ও কিছুনা ঘরে
রেখে এসেছি।
- ঘরে রেখে এসেছিস
মানে ! তোর বর ত ওগুলো বেচে দেবে ।
- না দিদি কালকের
পর থেকে ওর মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে। আমায় বারে বারে বলছে আমায় মাফ কর লক্ষ্মী আমি তোর
ওপর খুব অনাচার অত্যাচার করেছি।
- ওরে ওরা কুমীরের
জাত বুঝলি । মটকা মেরে পড়ে থাকবে সময় বুঝে ঠ্যাং ধরে জলে নামিয়ে গিলে খাবে। ওদের
বিশ্বাস করিস না । আর তুই ই বা কি করবি ? তোদের মতন হাজার
হাজার মহিলা এই দেশে এই রকম অত্যাচারিতা হয়ে ঘরের এক কোনে পড়ে থাকে । গায়ে গতরে
খেটে ঘরের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েও তাদের নিস্তার নেই । ভারতবর্ষে হিন্দু নারীদের এটাই
মহানতা । কিন্তু একে আমি প্রশ্রয় ছাড়া কি বলব বল।
- না দিদি এখন আর
ওরকম করবেনা । পুলিশের ভয় ধরে গিয়েছে। তা ছাড়া ওই কাগজে সই করিয়ে রেখেছেন না
দারোগা বাবু।
- বলিস কিরে ? কি লেখা ? শুনি।
- আমি কি করে বলব
বল আমি কি লেখা পড়া জানি।
- তা বটে । তবে
চিন্তার বিষয়।
- দিদি ওকে একটা
কাজে লাগিয়ে দাওনা । ও গাড়ি চালাতেও পারে ওর লাইসেন্স ও আছে ।
- দাঁড়া কমলেশ আসুক
ওকে বলে দেখি কি করা যেতে পারে।
- দেখনা দিদি তোমার
উপকারে ও যদি কিছু কাজ পায় ।
- আমি কিছু নির্ভর
প্রতিশ্রুতি দিতে পারছিনা।
রাতে কমলেশকে গত কালের সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণী
দিয়ে ইপ্সিতা বলে ওই লক্ষ্মীর স্বামী মন্টার কিছু কাজের সুবিধে হতে পারে কিনা । ও
নাকি ড্রাইভিং জানে। লাইসেন্স ও আছে।
- আগে বলনিত। দেখি
আমাদের অফিসের গাড়ির ড্রাইভারের প্রয়োজন। আমি ত ড্রাইভার নেই বলে ট্র্যাভেলস থেকে
গাড়ি নিয়ে টুরে যাই। অনেক সময় ডিউটির অসুবিধে হয়। তবে হেড অফিস থেকে পারমিশন না পেলে হবে না। ওই টেম্পোরারি ড্রাইভার ।
- তাই দাওনা । কিছু
সুরহা হবে।
- হ্যাঁ তা হবে ।
- কাল ওকে ডেকে
পাঠাও । সকাল বেলায় আসে যেন। আমি বেরুবার আগে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
- ঠিক আছে লক্ষ্মী
আসুক ওই নিয়ে আসবে। কিছু যদি কাজের সুরাহা হয় ও আর লক্ষ্মীকে হয়রান করবেনা।
- ওই শ্রেণীর লোকেরা
কাজ যেনেও কিছু না করে পায়ের ওপর পা দিয়ে বৌ কে খাটিয়ে খেতে ভালোবাসে। যখন বিপাকে
পড়ে তখন বাবাজীবন রা কাজে মন দেয়। এদের মানসিকতা বড় বিচিত্র বুঝলে ইপ্সিতা ।
- তা হবে আমার ওই
বিষয় জ্ঞান কম।
-
সকালে লক্ষ্মী এলে ইপ্সিতা বলে ওর স্বামী মন্টাকে
ডেকে আনতে । লক্ষ্মী বলে ও সকাল সকাল কোথায় কাজের সন্ধান পেয়ে চলে গিয়েছে। জানিনা
কখন আসবে।
- শোন কথা ! এই
বললি ওর কাজের প্রয়োজন বলে।
- আমি কি করে জানব
বল ?
- হুম ম । কমলেশ
চলে যায় টিফিন নিয়ে ।
লক্ষ্মী বিকেলে ইপ্সিতাকে খবর দেয় মন্টা এক মালিকের ট্যাক্সি চালাচ্ছে ‘গতিধারা’ না কি নাম বলল ?
- বাঃ সেত ভালো হল
রে । কোলকাতাতে গতিধারা ট্যাক্সি অনেক চলে। তবে ত ঠিক আছে। তুই চিন্তা করছিস কেন?
- আমি কি ওসবের
কিছু বুঝি দিদি।
- হ্যাঁ তা যা
বলেছিস। এবার বোধ হয় তোর সুদিন এলো লক্ষ্মী ।
- তাই যেন হয় গো।
ইপ্সিতা নিজের ঘরে চলে গিয়ে আহ্লাদীর পড়াশুনো দেখতে
যায়। আহ্লাদী মায়ের কাছে তার স্কুলের সমস্ত পড়াশুনো হোম ওয়ার্ক করে খেলতে বসে।
লক্ষ্মী যথাযথ ঘরের সমস্ত কাজ কর্ম করে। রাতের রান্না
সেরে ঘরে যায় । যাওয়ার আগে আহ্লাদীকে একটু আদর করে যায় । ওকে দেখে চোখ ভরে যায়
জলে। দুহাত ভরে আশীর্বাদ করে চোখ পুঁছে ।
- আহ্লাদী লক্ষ্মীর
হাবভাব দেখে আশ্চর্য হয় । ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে তুমি আমায় দেখে ওরকম কাঁদো কেন
গো লক্ষ্মী পিসী ।
- না না ওই রান্না
করতে গিয়ে একটু লংকা লেগেছিল ওই হাত চোখে দিয়েছি ব্যাস চোখ জ্বালা করছে আর জল বেরুচ্ছে।
- ও তাই বল। আমি
ভাবলাম আবার বুঝি কিছু হল ?
- ইপ্সিতা
আহ্লাদীকে নিজের কাছে ডাকে।
- যাচ্ছি গো যাচ্ছি , লক্ষ্মী পিসীর
সংগে একটু কথা বলছি । বাবা আমাকে না দেখলে মায়ের এক দণ্ড চলেনা । বুঝেছ লক্ষ্মী
পিসী ! বলে চোখ বড় বড় করে তাকায়।
- লক্ষ্মী আর ইপ্সিতা দুজনেই ওর পাকা পাকা কথা
শুনে হেঁসে কুটিপাটি খায়।
- যাইগো দিদি অনেক
বেলা হল ।
------ ৬ -----
ঘরে পৌঁছে শান্তির নিঃশ্বাস নেয়। আহ্লাদীর কথা মনেকরে
হেঁসেই চলে লক্ষ্মী । আজ অনেক দিন
পর লক্ষ্মী প্রাণ খুলে হাঁসে ।
এর মধ্যে মন্টা এসে পৌঁছয় গাড়ি নিয়ে । বলে চল সবাই
মিলে ঘুরে আসি ।
লক্ষ্মী অনেকদিন কলকাতা যায়নি । নিজের কাজ নিয়ে এতই
ব্যস্ত ঘোরার সময় হয়না। মনটার পরিবর্তন দেখে আশ্চর্য হয়। বলে সত্যি বেড়াতে নিয়ে
যাবে। এই রাতে কোথায় যাবে ?
- না যাওয়ার কি আছে
চল যাই । লক্ষ্মীকে জড়িয়ে ধরে বলে আজ ওই বিয়ের শাড়িটা বার কর দেখি । ওটা পরলে কেমন
লাগে তোমাকে।
- বাবা । কোথায়
যাবো আমি ! আদিখ্যেতা দেখে হাঁসি পায় আমার । কি হয়েছে বলত ?
- বেশ কিছু টাকা
রোজগার হয়েছে আজ। তোমাকে নিয়ে তাই ফুর্তি করতে যাবো চল। মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে দাও।
- না মেয়েদের না
নিয়ে যাবো না। ও বেচারার কোথাও যায়না। ওদের ও ত ইচ্ছে হয়।
- আজ আমার আর তোমার
ইচ্ছেই সব । জানোনা আজ কি ?
আজ আমাদের বিবাহ
বার্ষিকী ।
- ও মা তাই । দেখ
আমি ভুলেই গিয়েছি । তুমি মনে রেখেছ। আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে ?
- মনটা লক্ষ্মীকে
আজ নতুন ভাবে পেতে চায় । যাতে কোন খাদ থাকবেন তাদের ভালোবাসার । দুজনে দুজনকে
জড়িয়ে ধরে যেন কত দিন তারা বিরহের দিন কাটিয়েছে ।
অভাবের সংসারে
একটার পর একটা মেয়ে
জন্ম তার মনকে বিষিয়ে তুলেছিল কিন্তু সে ত জানেনা মেয়ে জন্মর জন্য নারীর কোন
ভূমিকা নেই। মেয়ে জন্মর জন্য পুরুষ ই দায়ী । এটা খুব ই সহজ কথা কিন্তু অধিকাংশ
পুরুষ এই সামান্য কথাটা জানেনে বলে অনেক সংসারে অশান্তির ঝড় বয়ে যায়।
লক্ষ্মী মনটাকে বলে ও ঘরে মেয়েরা আছে ছাড় আমাকে। ওরা বড় হচ্ছে কি শিখবে
আমাদের কাছথেকে ?
লক্ষ্মী পরিতৃপ্ত নয়নে তার স্বামীকে নতুন ভাবে পেয়ে ভগবানকে জোড় হস্তে
প্রণাম করে বলে হে ঠাকুর আমার সংসারে এই রকম শান্তি বজায় রাখ ঠাকুর। আমি এবার খুব
খুশি ঠাকুর ।
মনটা লক্ষ্মীকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগোয় । পেছনে তার দুই মেয়ে । বাবার
পরিবর্তনে তারাও খুশি। ইপ্সিতা মাসি শুনলে নিশ্চয় খুশী হবে।
( ৪২৮৬ শব্দ )