Sunday, February 22, 2015

একুশের চেতনা : কাঁটাতারের এপারে / শ্রী শুভ্র /



 

একুশের চেতনা কাঁটাতারের এপারে

আমরা জানি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা বাংলা! ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী,বাংলায় ৯ই ফাল্গুন যেখানে মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে প্রাণ দিয়ে ভাষা শহীদ হয়েছিলেন পাঁচ বাঙালি! বিশ্বে নিজ মাতৃভাষার জন্য শহীদ হওয়ার ঘটনা সম্ভবত সেই প্রথম! ভাষার জন্য এরপর ১৯৬১ সালে শিলচরে প্রাণ দেন ১১ জন তরতাজা বাঙালি! বাহান্নর সেই ভাষা আন্দোলনের সুদূর প্রসারী ফলে একাত্তরে পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশ! তাই সেখানে আজ আ মরি বাংলা ভাষা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় ভাষারূপে প্রতিষ্ঠিতএবং আবিশ্ব স্বীকৃত।

কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমানা ঘেরা কাঁটাতারের এপারে বাংলাভাষার স্বীকৃতি রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে তো নয়বাংলা এখানে একটি প্রাদেশিক ভাষা মাত্র। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মতোই বাংলার স্বীকৃতি তাই আঞ্চলিক ভাষারূপেই। সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনাও। সত্যিই তো বিশাল ভারতবর্ষের এক প্রান্তে  পড়ে থাকা খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ত্রিপুরার ভাষারআঞ্চলিক ভাষারূপেই তো স্বীকৃতি পাওয়ার কথা। হয়েওছে তাই। ঠিক যেমন তামিল তেলেগু মালায়লাম কর্ণাটকি ভাষা কিংবা অসমীয়া উড়িয়া গুজরাটী পাঞ্জাবি মারাঠী ভাষা! রাষ্ট্রভাষা আর আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে হয়তো কোন বিরোধ নাইকিন্তু দেখতে হবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাদেশে বাংলাভাষার যে গুরূত্ব,  এই বঙ্গে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে বাংলার গুরুত্ব তার তুলনায় কতটুকু। কিংবা ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলার প্রকৃত অবস্থা ঠিক কিরূপ!

এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবেবর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালিদের সংখ্যাধিক্যের কথাটিও। বিগত দশকগুলিতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী বিহার ও নবগঠিত ঝাড়খণ্ডের অধিবাসীরা সহ উত্তরপ্রদেশ গুজরাট রাজস্থান পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্যের মানুষজন ব্যাপক ভাবে এই বঙ্গে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেছেন। সে তো তারা করতেই পারেন। আর এই প্রবণতা তো ঠিক একেবারেই নতুন কোন ঘটনা নয়বৃটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল এই প্রবণতা। আর ভারতবর্ষের নাগরিক মাত্রেই সারা দেশের যে কোনো প্রান্তেই পাকাপাকি ভাবে যে কেউ বসবাস করতেই পারেন। সকল ভারতবসীরই সেটি সাংবিধানিক অধিকারও বটে।  প্রশ্ন সেখানে নয়। দেখতে হবে এই প্রবনতা প্রতিটি রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির উপর কি প্রভাব ফেলছে ও কি ভাবেএবং তাতে সেই সেই আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নতি  না অবনতি- কোনটা ঘটছে।

আমরা জানি স্বাধীনতার পর বিশেষত দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি তাদের স্ব স্ব রাজ্যে অতি সম্মানের স্থান ‌অর্জন করতে পেরেছে! যাঁদেরই দক্ষিণ ভারতে কিছুদিনের জন্যে বসবাসের অভিজ্ঞতা ঘটেছেতারাই জানেন সেখানে প্রতিটি রাজ্যেসেই সেই রাজ্যের ভূমিপুত্ররা তাঁদের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কতটা গর্ব অনুভব করেন।  এবং তাঁদের আপন ভাষা ও সংস্কৃতিকে কি ভাবে বুক দিয়ে আগলিয়ে রাখেন ও সারা দেশে নিজ ভাষা সংস্কৃতির প্রসারে তাঁরা কতটা আবেগ প্রবণ। শুধু তাই নয়প্রতিটি রাজ্যে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার পরিসরেও সেই সেই আঞ্চলিক ভাষাগুলির গুরুত্ত কী অপরিসীম। পরাধীন মানসিকতার নাগপাশ কাটিয়ে উঠে তারা নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রচলন ও প্রসারে কতটা আপোষহীন ভাবে যত্নবানসেটা কিছুদিন তাদের মাঝে বসবাস করলেই বোঝা সম্ভব কিন্তু! এমনটাই তো হওয়ার কথা। আবিশ্ব ইংরাজীর দাপট ও উত্তর ভারতের হিন্দিবলয়ের দাপটকে প্রতিহত করে কি ভাবে বিদেশী ভাষাকে সঙ্গে নিয়েও নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে সদর্থক ভাবে লালন করে সমগ্র অঞ্চলের স্বজাতির উন্নতি ঘটানো যায়সেই বিষয়ে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে আমাদের।

শেখার আছে হিন্দী বলয়ের রাজ্যগুলির থেকেও। তারাও স্বধীনতা উত্তর বিগত দশকগুলিতে নিজেদের মাতৃভাষাকে জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে বহুল পরিমাণেই প্রাসঙ্গিক করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যার সুফল পড়েছে তাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও। কিন্তু আমাদের এই বঙ্গের চিত্রটি ঠিক কিরকমআসুন বরং একবার ভালো করে দেখে নেওয়া যাক সেটা।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ শব্দটি স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বিশেষ একটি জায়গা করে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের আন্তর্জাতিক সীমানা দিয়ে নিরন্তর অনুপ্রবশ ঘটে চলেছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে। রাজ্য রাজনীতিতে সেই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অসরোষও নতুন কোনো ঘটনা নয়। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দুটুকরো হওয়া বাংলার এক পাড় থেকে আন্তর্জাতিক সীমানা পেড়োলেই অনুপ্রবেশ। অনুপ্রবেশ বিদেশী নাগরিক হিসেবে সেই একই বাঙালিরযার ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদেরই ভাষা ও সংস্কৃতি! রাজনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যা ভয়ানক অপরাধ! কিন্তু এরই পাশাপাশি স্বাধীন ভারতবর্ষের নানা রাজ্যের নানান ভাষাভাষী নাগরিক,যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের থেকে একেবারেই পৃথক ও ভিন্ন ;তারা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন জায়গা জমি কিনে স্থায়ী ভাবে বসবাস করলেও সেটা কোনোভাবেই অনুপ্রবেশ নয় । তারা আমাদের স্বজাতি না হলেওকারণ তারও আমাদের মতো একই ভারতবর্ষের নাগরিক!

আর সেই অবাঙালি ভারতীয় নাগরিকরা সাংবিধানিক ভাবেই নিরন্তর এই বাংলায় স্থায়ী ভাবে প্রবেশ করছেন প্রতিদিন- ঝাঁকে ঝাঁকে। প্রশ্ন সেখানেও নয়। তারা তো অন্যায় কিছু করছেন না! পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকারের সীমাতেই তারা এরাজ্যে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করছেন। প্রশ্ন অন্যখানে। প্রশ্ন হল এই অবস্থার প্রেক্ষিতে এই রাজ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ঠিক কিরকম প্রভাব পড়ছে। সেই প্রভাবে আমাদের ভাষা সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থাটি ঠিক কিরকমএরাজ্যে ভীড় করা অবাঙালিদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দীবলয় ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের অধিবাসী। স্বভাবতঃই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ প্রাপ্ত হিন্দী তাদের মাতৃভাষা হওয়াতে তারা এই রাজ্যে এসেও সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করতে পারছেন অতি সহজেই। কর্ম জগতে পেশার ক্ষেত্রে সরকারী ভাষা হিন্দী ও ইংরেজী হওয়াতেতারা তাদের মাতৃভাষা হিন্দীতে যত সহজে জীবন জীবিকায় অংশগ্রহন করতে পারেনআমাদের বাঙালিদের অনেক পরিশ্রম করেই ঐ দুইটি ভাষার কোন একটিতেবা ক্ষেত্র বিশেষে দুটিতেই আগে পারদর্শী হয়ে উঠতে হয়যা যথেষ্ঠ সময় ও অধ্যাবষয় সাপেক্ষ সন্দেহ নাই। যে কাজ সকলের পক্ষে সহজ নাও হতে পারে। আর সেই সুযোগেই অবাঙালিরা ব্যাপক ভাবে যত সহজে কর্ম জগতে প্রবেশ করতে পারেন ও সাফল্য অর্জন করতে পারেন বাঙালিরা আজ আর তা পারে না বলেইপশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যার মধ্যে বাঙালি ও অবাঙালির অনুপাতটি ভয়াবহভাবেই ভারসাম্যহীন। বিষয়টি পরিস্কার বোঝা যেতে পারে যদি আমরা রাজ্যবাসীর মোট বাঙালির মধ্যে কতজন বেকার এবং মোট অবাঙালির মধ্যে কতজন বেকারসেই অনুপাতটি সঠিক ভাবে খুঁজে বের করি। পরিতাপের কথাএই ভাবে ভাবলেই সকলের অভিধানে সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় কেউই আজ অব্দি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি মনযোগ দেননি। স্বভাবতঃই দেবেনও না। কিন্তু বাস্তব অতি কঠিন সত্যকেই প্রতিফলিত করেআমরা সেই সত্যের দিক থেকে মনযোগ সরিয়ে রাখলেও।

বাস্তব এইটিই যে কি সরকারী কি বেসরকারীদুই ক্ষেত্রেই কর্ম জগতে প্রবেশ ও উন্নতির ক্ষেত্রে হিন্দী ও ইংরাজীর গুরুত্ব অপরিসীম। ঠিক যেখানে আ মরি বাংলা ভাষার কোনো রকমের প্রাসঙ্গিকতাই স্বাধীনতার সাতদশকেও গড়ে ওঠে নি। সকল রকম গুরুত্বপূর্ণ সরকারী চাকুরীর পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র হিন্দী ও ইংরেজীতে হওয়ায় হিন্দীভাষী রাজ্যবাসী তাদের মাতৃভাষায় যত সহজে উৎরে যেতে পারেএরাজ্যের বঙ্গসন্তানের পক্ষে কাজটি তত সহজে হয় না। সেই উৎরানোর কাজটি সম্পন্ন করতে গিয়ে তাদেরকে অনেকটা সময় ও পরিশ্রম করেই মোটামুটি ভালোভাবে বিদেশীভাষা ইংরেজীতে দখল অর্জন করতে হয়। যে কাজটি আপামর বাঙালির সন্তানের পক্ষে মোটেই সহজ সাধ্য নয়। ফলে দিনে দিনে সাধারণ মেধার বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রে পেশাগত ভাবে সাধারণ মেধার অবাঙালিদের থেকে পিছিয়ে পড়ছেই। আমরা অধিকাংশ বাঙালিরাই এই বাস্তব সত্যকে প্রতিরোধ করা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করি বা সাচ্ছন্দ বোধ করি। বরং এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই আমরা আমাদের সন্তানদেরকে বেশী করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্ত্তি করতে রাত জেগে লাইনে দাঁড়াই। আমরা জানি ইংলিশে চৌখস না হলে জীবনে উন্নতি নাই। শুধু তাই নয়ইংরেজীর সাথে হিন্দীতেও যে ছেলেমেয়েদের চোস্ত হওয়ার দরকারআমাদের সেদিকেও খেয়াল থাকে এইযুগে। আর এর অবশ্যম্ভাবী পরিণামেই মাতৃভাষা বাংলাকে আমরাই আরও বেশী করে কোণঠাসা করছি দিনে দিনে অবহেলার চূরান্ত চর্চায়!

এই প্রসঙ্গেই স্মরণে রাখা দরকারবাংলাদেশে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মূল প্রেক্ষিতটা। সেই সময় বাংলা ভাষার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগেই কিন্তু এই আন্দোলনের ব্যাপকতা গড়ে উঠেছিল না। সেই আন্দোলন গড়ে ওঠার মূল কারণ ছিলতৎকালীন পাকিস্তানী প্রশাসনের, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দ্দুকে ঘোষণা করা। যে ঘোষণার নেপথ্যে ছিল পাকিস্তানী প্রশাসনের গভীরতর ষড়যন্ত্রমূলক দূরভিসন্ধি। সেদিনের বাংলাদেশের যুবসমাজ বুঝতে পেরেছিল রাষ্ট্রভাষা উর্দ্দু হলে সমস্ত সরকারী বেসরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে উর্দ্দু না জানলে কর্মজগতে প্রবেশ ও উন্নতি করা যাবে না। বরং পাকিস্তানের ছেলেমেয়েরাই মাতৃভাষা উর্দ্দুর সুযোগ নিয়ে একতরফা ভাবে অধিকাংশ কর্মস্থলে অভিষিক্ত হবে। বাঙালি পর্যবসিত হবে মূলত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে। তাই সেদিন বাংলাদেশের যুবসমাজ বাংলার ইতিহাসে সেই  প্রথমমাতৃভাষার মূল গুরুত্বটি অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারা বুঝেছিল জীবন জীবিকায় মাতৃভাষার স্থান না থাকলে সার্বিক ভাবে সমগ্র জাতির উন্নয়ন অসম্ভব। তাই প্রথমত পেটের তাগিদেই যে উর্দ্দুর বিরোধীতা শুরু হয়েছিলঅচিরেই তা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বৃহত্তর আন্দোলন হয়ে দেখা দিল। এইখানেই বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

আর আমাদের এই পাড়েপাকিস্তান প্রশাসন ঐ পাড়ে যে ভুলটি করেছিলভারতবর্ষের প্রশাসন সেই ভুলটি কোনোদিনও করেনি। তারা বুঝতে পেরেছিলেন হিন্দীকে জবরদোস্তি রাষ্ট্রভাষা ঘেষণা করে সারা ভারতের উপর চাপিয়ে দিতে গেলে দেশ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে। বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদেশী ভাষা ইংরেজীর পাশাপাশি হিন্দীকে রেখে দিনে দিনে সুকৌশলে হিন্দীকে নানান ভাবে পোষকতা দিয়ে জনপ্রিয় করে তুলতে পারলেই একদিন কালক্রমে হিন্দীই রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর গত সাতদশকে ঠিক সেইটিই হয়েছে। এই বিষয়ে প্রথমাবধি বোম্বাইমার্কা হিন্দী বায়োস্কোপের জনপ্রিয়তা তাদের পরিকল্পনার পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। পরবর্তীতে টিভির পর্দায় হিন্দী সিরিয়াল যে কাজটিকে আজ ব্যপক ভাবে সফল করে তুলেছে। আর এই ভাবেই হিন্দীবলয়ের বাইরেও ভারতবাসীকে হিন্দীনুখি করে তুলতে সক্ষম হয়েছে ভারতীয় প্রশাসন। তাই এই বঙ্গে হিন্দী আজ আর বিদেশী ভাষা নয়। অধিকাংশ বাঙালিরই মুখেরও ভাষা হয়ে উঠছে দ্রুত।

ফলত, রাজ্যের শহর ও গ্রাম সর্বত্রই হিন্দীবলয়ের মানুষের সাথে পাশাপাশি বসবাস করে একদিকে যেমন হিন্দীর প্রতি বাঙালি মাত্রেই একটি স্বাভাবিক আবেগ গড়ে উঠেছেঠিক তেমনই সিনেমা টিভির দৌলতে হিন্দী আজ এই রাজ্যের বাঙালির কাছে অন্যতম জনপ্রিয় ভাষা। আর কর্ম জগতে প্রবেশের জন্যে হিন্দীর প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধির সাথে সথেই একই সঙ্গে সর্বত্র বাংলাভাষার কদর কমে চলেছে অতি দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে। স্বভাবতঃই এই যে সার্বিক পরিস্থিতিএরই প্রক্ষিতে আজ আপামর বাঙালি তার মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আদৌ আর ভাবিত নয়। সে জানে কর্মজীবনে জীবিকার ক্ষেত্রে বাংলাভাষা পুরোপুরি অপ্রসঙ্গিক ও অচল। বরং ইংরেজীতে সরগর হওয়ার সামাজিক সুবিধে অনেক। কিংবা বিকল্প হিসেবে হাতের কাছে অতি পরিচিত হিন্দী তো রয়েইছে! তাই এই রাজ্যের বাঙালির কাছে বাংলাভাষা ও একুশের চেতনা আজ শুধু অপ্রসঙ্গিকই নয়সম্পূর্ণ অচল আবেগ মাত্র!
বুস্তুত দীর্ঘকাল ধরেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের উদাসীনতা ও সমাজের প্রাগ্রসর শ্রেণীর এই ভাষাটি সম্বন্ধে  উন্নাসিকতা বাংলা ভাষার প্রসার ও প্রচলনে ধারাবাহিক ভাবেই বাধার সৃষ্টি করে এসেছে। এখন দেখা যাক বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে এই উদাসীনতা ও উন্নসিকতার সুদীর্ঘকালের প্রভাবটি কিভাবে ক্রিয়াশীল। সার্বিক ভাবে একদিকে ইংরেজী ভাষার প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও অন্যদিকে হিন্দীকে ভারতের প্রধান ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানআমাদের বাঙালিদের মধ্যে নিজেদের বাংলা ভাষা সম্বন্ধে একটি হীনমন্যতা গড়ে তুলেছে। যার সরাসরি প্রভাবে আমরা যার যত বেশি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীসেই নিক্তিতে নিজেদের শিক্ষিত প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ অপ্রয়জনীয় ভাবে হলেও নিজেদের স্বজাতির মধ্যেও পরস্পরে ইংরাজীতে বাক্যলাপে অধিকতর স্বচ্ছন্দ বোধ করে থাকি। সারা পৃথিবীতে এই মানসিকতার দৃষ্টান্তে আমরা বাঙালিরা সত্যিই অনন্য! অন্যদিকে এরাজ্য বসবাসকারী বিপুল পরিমাণ হিন্দীভাষী ও হিন্দী জানা অবাঙালিদের সাথে আমরা স্বতঃপ্রোণদিত হয়েই হিন্দীতেই যোগাযোগ রাখতে ভালোবাসিকারণ ভারতীয় নাগরিক হিসাবে আমরা নিজেদেরকে আগে ভারতীয় তারপর দৈবাত বাঙালি বলে মনে করি বলে আমরা হিন্দীকেই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দেখি। অনেকেই বলবেন তাতে কি হয়েছে। সারা ভারতের একটি সাধারণ ভাষা থাকলে তো ভালোই। ঠিক কথা। কিন্তু সেই জায়গায় হিন্দীকে তুলে ধরতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করে বলি দেওয়ার কথা সারা ভারতে একমাত্র বাঙালি ছারা আর কেউই কিন্তু ভাবে না। ভাববেও না কোনদিন। অনন্য বাঙালি আর অনন্য তার মানসিকতা। ভূভারতে যার তুলনা নেই।

আমাদের এই মানসিকতার হাত ধরেই সারা রাজ্যে দিনে দিনে বাংলা ভাষায় পঠন পাঠনের রেওয়াজ কমে আসছে। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেনতুন নতুন যত স্কুল চালু হচ্ছেতার অধিকাংশই কিন্তু হয় ইংরাজী মাধ্যম নয় হিন্দী! বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির উৎকর্ষতাও ক্রমহ্রাসমানভালো মেধার ছাত্র ও উপযুক্ত শিক্ষক উভয়েরই প্রবণতা ইংরাজী মাধ্যম স্কুল গুলির সাথে যুক্ত হওয়া! আর এই প্রবণতার সুদূরপ্রসারী ফল কিন্তু মারাত্মক! রাজ্য রাজধানী কলিকাতা সহ শিলিগুরি দূর্গাপুর আসানসোল শিল্পাঞ্চলের শহর ও শহরতলিগুলিতে এমন বহু হিন্দী মাধ্যম স্কুল রয়েছে যেখানে পঠন পাঠনের বিষয়ের মধ্যে বাংলার কোনোই স্থান নেই। ফলত এই স্কুলগুলি থেকে শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা এই রাজ্যের বাসিন্দা হয়েও রাজ্যের ভাষাটির সাথে পরিচিত হচ্ছে না! আমাদের জানা নেই ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলিতেও এইরকম অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানা প্রচলিত আছে কিনা! থাকলেও সেখানে সেই বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলে চালানো হয় কিনা!

আর ঠিক এইটিই এই বাংলায় নিরন্তর ঘটে চলেছেযা কিছু অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেওয়া। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গ আজকে ভারতেরই যেন একটি ক্ষুদ্র সংস্করন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু:খের বিষয়অনেক বাঙালিই তাতে শ্লাঘা বোধ করেণ। তারা ভেবে দেখেন না,এই ভাবে একটি রাজ্যে তার ভাষা ও কৃষ্টি প্রতিনিয়ত সঙ্কুচিত হতে থাকলেসেদিন আসতে আর বেশি দেরি নাইযেদিন বাঙালি তার রাজ্যেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। সে বড়ো সুখের সময় হবে না বঙ্গবাসীর জীবনে। আর এই প্রবণতার লক্ষ্মণ ইতিমধ্যেই অল্পস্বল্প ধরা পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন পদে অবাঙালিদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধির পথে। এরই সুত্র ধরে রাজ্যরাজনীতিতে তারাই অদূর ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করলেও আশ্চর্য্যের কিছু নাই। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি উদাসীনতা ও উন্নাসিকতার হাত ধরে ইংরাজী ভাষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং হিন্দীভাষা হিন্দুস্তানী সংস্কৃতি আয়ত্ব করার প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার এই বিস্তৃত পরিসরে ২১শে ফেব্রুয়ারী কিংবা একুশের চেতনা নেহাৎই পড়শী রাষ্ট্রের একটি ঐতিহাসিক বিষয় মাত্র। যার সাথে এই বাংলার বাঙালির মন ও মননের কোনো আত্মীয়তা কোনোদিনই গড়ে ওঠেনিআর ওঠার কথাও নয়। কারণ ভারতীয় বাঙালি আগে ভারতীয় ও নেহাৎই দৈবাৎ বাঙালি! কোনো ভাবেই প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট

Saturday, February 21, 2015

গোপালপুর , উড়িষ্যা / ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী /



     

পথে প্রান্তরেঃ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

Posted in 


পথে প্রান্তরে


গোপালপুর, উড়িষ্যা 
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী 



‘সমুদ্র’ বাঙ্গালীর এক প্রধান আকর্ষণ । শুধু বাঙ্গালী কেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটক আমাদের দেশের সমুদ্রের টানে দেশ বিদেশ থেকে আসেন । ভারতবর্ষের পর্যটন মানচিত্রে গোপালপুর সমুদ্র সৈকতের ততটা প্রাধান্য নেই বললেই চলে । সমুদ্র বলতে প্রথমেই ছাপোষা সাধারণ বাঙ্গালীর মাথায় নাড়া চাড়া দেয় হয় ‘পুরী’ নয় ‘দীঘা’ । “গোপালপুরের” সমুদ্র সৈকতের চিত্রপট পুরী দীঘার চেয়ে অনেকটা আলাদা । খুব সুন্দর অথচ শান্ত এই গোপালপুরের সমুদ্র সৈকত । যে দেখেছে তাকে বার বার ঐ সমুদ্রের সৌন্দর্য টেনে আনে এবং আনবে। তাই বোধ হয় এবারে রাস পূর্ণিমার দিন (৬ নভেম্বর ২০১৪) গোপালপুরে প্রচুর বাঙ্গালী টুরিস্ট দেখলাম । 

এবারে গোপালপুর যাওয়ার প্রোগ্রামটা করি আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর পরামর্শে । ৫ নভেম্বরে, ২০১৪, বুধবার আমরা সকলে মিলে রওনা 'দি গোপালপুর ভায়া চিলকা । আমার গাড়ী নিয়েই যাই । ড্রাইভার আমার বন্ধু স্বয়ং । আমাদের ৪-৫ দিনের প্রোগ্রাম তাই ড্রাইভার নিতে আমার বন্ধু বারণ করেন। 

ভুবনেশ্বর থেকে ৫ নম্বর জাতীয় রাজপথ ধরে প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এক ছোট্ট শহর ‘বালুগাঁ’ পৌঁছে গেলাম । এই বালুগাঁ চিলকার কাঁকড়া ও চিংড়ীর জন্য প্রসিদ্ধ । এখান থেকে দেশ বিদেশে চিংড়ী ও কাঁকড়া রপ্তানি হয়। বালুগাঁ থেকে বরকুল মাত্র ৩ কিলোমিটার । বরকুল , চিলকা হ্রদের সংলগ্ন একটি ছোট্ট যায়গা । ওখানে উড়িষ্যা সরকারের পর্যটন বিভাগের সুন্দর কটেজ , পান্থনিবাস আছে । বরকুল থেকে প্রায় পর্যটক মটর বোটে চিলকা হ্রদের ওপর বোটিং করে কালিজাই মন্দির, ‘নলবন’ বিদেশী পক্ষী আশ্রয়স্থল , তা ছাড়া চিলকা হ্রদের মধ্যে অবস্থিত অনেক ছোট বড় যায়গা যেমন পারিকুদ , নুয়াপড়া , কৃষ্ণ প্রসাদ , তিতিপ, মালুদ ইত্যাদি । আবার যারা সাতপড়া থেকে যান চিলকা তে,  তারা ডলফিন দেখতে যান  চিলকার মোহানা সমুদ্র সন্নিকটে । সরকারি মোটর বোট নেওয়াই ভালো, কারণ  ওতে রিস্ক কম থাকে । 

চিলকার কথা আগেই লিখেছি তাই আর না বাড়িয়ে সোজা গোপালপুরের কথায় যাই । বরকুল থেকে গোপালপুর ছক ৭০ কিলোমিটার। ওখান-থেকে SH 30 ধরে আরও ১০ কিলোমিটার ভঞ্জবিহার ইউনিভার্সিটি , (গঞ্জাম) বহরমপুরের রাস্তা ধরে যেতে হয় । আরেকটা রাস্তা আছে সেটা বহরমপুর(উড়িষ্যা) থেকে গোপালপুর । ওটা প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তা । গোপালপুর পৌঁছে গেলাম বিকেল ৪ টে নাগাদ । আগে থেকেই হোটেল বুক করা ছিল, তাই গোপালপুর পৌঁছেই হোটেলে চেক ইন করে যে যার রুমে ঢ়ুকে পড়ি। আমরা সব্বাই ফ্রেশ হয়ে চলে যাই সি বিচে । 

গোপালপুর একটা ছোট্ট শহর। বঙ্গোপসাগরের ধারে এই শহর উড়িষ্যার দক্ষিণে গঞ্জাম জেলার অতি পুরাতন কিছু স্মৃতি নিয়ে অবস্থিত। 

২০১১-র  জনগণনা অনুযাই এখানকার লোক সংখ্যা ৬৬৬৩ । এখানে প্রায় সকলে জেলে সম্প্রদায়ের। তেলুগু আর উড়িয়া এখানকার প্রধান অধিবাসী । আছেন কিছু সাহেব তাঁরা ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় থেকে আছেন । এনাদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে । দু চারটে ঘর অবশিষ্ট আছে । প্রায় সকলে গোয়া নয়, কোলকাতাতে চলে গিয়েছেন। ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে এখানে একটা ছোট বন্দর ছিল । কাছেই একটা লাইট হাউস আছে । বার্মা এবং রেঙ্গুন থেকে চাল আমদানি করা হত এই পথে । তখন এখানে অনেক বাঙ্গালী ব্যবসায়ীরা প্রধানত চালের ব্যবসা করতেন । এখন কিছু বাঙ্গালী গঞ্জাম, বহরমপুরে আছেন তবে তাঁদের সংখ্যা নগণ্য । এখান থেকে উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলার বহরমপুর শহর মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । অন্ধ্র রাজ্যের সীমান্তবর্তী  অঞ্চল, তাই মূলত তেলুগু এবং উড়িয়া প্রচলিত ভাষা । 

এখানকার সমুদ্র তট শান্ত এবং সুন্দর । ঝাউ বনের ধারে প্রশস্ত ৪ কিলোমিটার ঊর্ধ্ব সমুদ্র সৈকত প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি । মাঝে মাঝে স্তূপাকার বালুকা রাশি । গোপালপুরের সমুদ্র কিন্তু খুব গভীর এবং এখানকার আন্ডার কারেন্ট অনেক সময় মৃত্যুর কারণ  হতে পারে । তাই একে রিপ কারেন্ট বলা হয় । 

সমুদ্রের ধারে ধারে ছোট ছোট গ্রাম- বক্সিপালি , গোলাবন্ধ , কস্তুপেটা , হাতিপাদ , কির্তিপুর , মার্কন্ডি, ইত্যাদি প্রায় ১৫ কিলোমিটার লম্বায় । ঝাউ , কাজু বাদাম এবং নারকোল গাছে ভর্তি এলাকা । কাছেই ধবলেশ্বরের মন্দির । খুব জাগ্রত শিবের মন্দির । শিব রাত্রিতে খুব ভীড় হয় ভক্তদের ।

গোপালপুরের সবচেয়ে বড় ৫ তারকা হোটেল “মে ফেয়ার” । এই হোটেল আগে “পাম বিচ রিসোর্ট” নামে পরিচিত ছিল । এখন তার মালিকানা পরিবর্তন হওয়াতে শিল্প পতি এবং পূর্বতন কেন্দ্র মন্ত্রী শ্রী দিলিপ রায়ের “মে ফেয়ার” ব্যানারে পরিচালিত । ১৫০০০ টাকা এক দিনে শুধু থাকা আর কমপ্লিমেন্টারি ব্রেক ফাস্ট । ব্যাস !

গোপালপুরে দু রাত তিন দিন কাটিয়ে ফিরে আসি । ফেরার সময় গঞ্জামের বিখ্যাত শক্তি পীঠস্থান তারা তারিণী দর্শন করে ফিরি।



** পরের কোনো আলোচনায় তারা তারিণী র বিষয়ে  লিখবো ।







Friday, February 6, 2015

পাকাদেখা ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী ০৭.০২.২০১৫



    
পাকাদেখা

আমাদের এপার্টমেন্টের থার্ড ফ্লোরে থাকেন এক ভদ্রলোক । নাম প্রতাপ সিংহ রায় । বেশ কিছুদিন আমাদের এপার্টমেন্টে এসেছেন । চেনা সোনা বলতে সোসাইটি মিটিং আর ক্লাবে তাস খেলা । আমার সঙ্গে বাজারে দেখা । দেখেই বলেন ,“অনেকদিন হল একটা কথা মাথায় চাড়া দিচ্ছে। কি করি ভেবে পাচ্ছিনা ! আমার একটাই ছেলে । ইনফোসিস বেঙ্গালুরুতে সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার । বিয়ের বয়েস হয়নি তাও চিন্তা ! বিয়ে দেব কি, যা বিয়ের বাজার !! কি করি বলুন তো ! 
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে-গেলেন ভদ্রলোক।
অপ্রত্যাশিত কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম । আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের সেরকম হৃদ্যতা নেই । হঠাৎ ছেলের বিয়ের ব্যাপারে আমাকে কেন এ সব বলা বুঝলাম না । তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললাম, হ্যাঁ ছেলে মেয়েদের মানুষ করা তারপর যোগ্য পাত্র পাত্রী র সঙ্গে বিয়ে দেওয়া...। 

আমার কথা শেষ না হতেই ঝাঁজিয়ে উঠলেন, “রাখুন ত যোগ্য পাত্রী ! যা দুনিয়ার অবস্থা,
 পাত্রী ই পাওয়া যায়না তা যোগ্য পাত্রী !!
ভাল মেয়ে, ভদ্র ঘরের মেয়ে , দেখতে শুনতে ভালো, ভাল চাকরী করে সেরকম মেয়ে পাচ্ছি কই? যোগ্য পাত্রী বলতে আর কি বোঝায় বুঝলাম না ! তবুও বলি, দেখুন এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা একটু কম । আপনি বরং বেঙ্গলী মেট্রিমনিতেআপনার ছেলের একটা বায়োডেটা দিয়ে প্রোফাইল খুলুন , ওরাই যোগাড় করে-দেবে পাত্রী । এই বলে পাশ কাটিয়ে যাই । 
পরের সপ্তাহে আবার দেখা । আমি দূর থেকে ভদ্রলোককে দেখে মাছ কেনার ভান করি । ওমা ! ঠিক আমার কাছে এসে হাজির !! 
মাছ ওয়ালাকে জিগ্যেস করছি ইলিশ কত করে ? 
মাছওয়ালা বালা বলে বারোশ টাকা কিলো  সে কি,এত দাম ? পদ্মার ইলিশ বাবু । খেলে আবার আসবেন । বাজি রাখছি । সত্যি পদ্মার কিনা জানিনা তবে কানকোর কাছটা লাল আছে । হয়তো তাই !
পাশে দেখি প্রতাপ বাবু হাজির। আমায় দেখে বলেন, “দিয়ে দিয়েছি’ !
 কি ?কি দিয়ে দিয়েছেন ? 
ঐযে আপনি বলেছিলেন, “বেঙ্গলী মেট্রিমনি” ! ওটার সঙ্গে আনন্দবাজারে "পাত্র পাত্রী" কলমের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছি । মনেহয় এবারে আমার চিন্তা গেল। 
ও তাই ! তা ভাল । 

রবিবার অফিস নেই খোশ মেজাজে কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছি, হটাত কলিং বেল বেজে ওঠে । দরজা খুলে দেখি স্বয়ং প্রতাপ বাবু ।
 গুড মর্নিং । কেমন আছেন দেখতে এলাম । বিরক্ত করছি না তো ? 
সুপ্রভাত । ওমা সেকি ?আসুন আসুন । আপনার পদ ধূলি আমার দ্বারে পড়লো আমার পরম সৌভাগ্য । আসুন আপনার দৌলতে আরেক কাপ চা খাওয়া যাবে । গিন্নীকে বলি চা বানাতে । চা আসে ।
 দুজনে চা খেতে খেতে প্রতাপ বাবু বলেন, আজকে প্রায় ১০০ টা ফোন কল পেয়েছি । আমার এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলে ভাল মনে হল । তাঁর মেয়ে দিল্লীতে পোষ্টেড । ভালো এক কোম্পানিতে ।
আপনার মতা মত নিতে এলাম । 
আমি ! আমি কি মতামত দেব বলুন ? আমি ওসব কিছুই বুঝিনা !! 
উহু তা বললে চলবে না । আপনার কথার দাম আছে মশাই । শুনুন ,মেয়েটি ভাল চাকরী করে , আমার ছেলের চেয়ে তিন বছরের ছোট । বাবা ভাল কোম্পানির ডাইরেক্টর, মা শিক্ষয়িত্রী । পাত্রী দেখতে যাব আগামী রবিবার আপনাকে যেতেই হবে আমার সঙ্গে । কথাগুলো গড় গড় করে বলে এক গ্লাস জল খেলেন ।
আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লাম ! আপনি কেন বুঝছেন না আমি ওসব কিছুই বুঝি না। বিয়ের ব্যাপারে আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে যান আমি যেতে পারবোনা । মাফ করবেন এই জোড়হস্তে বলছি আপনাকে । আমিও আপনাকে জোড় হস্তে অনুরোধ করি আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আপনাকে আমি কিছুতেই না নিয়ে ছাড়বনা । আমি আপনার দাদার মতন । আমার কেউ নেই বলেই আপনাকে অনুরোধ করছি । না বলবেন না প্লিজ । এটা আমার বিনীত অনুরোধ । 
আমি বলি, পরে ভেবে বলব । আজ কথা দিতে পারছিনা । ক্ষমা করবেন হাত জোড় করে বলি । ভদ্রলোক বলেন , ঠিক আছে যা ভাল বোঝেন । আজ তবে উঠি । বলে দরজার দিকে পা বাড়ান । আমি বুঝি ভদ্রলোক মনক্ষুন্ন হলেন তবে আমার করার কিছুই নেই। 


মাস খানেক পর প্রতাপ বাবু সপত্নীক আমাদের ফ্ল্যাটে আসেন । হাতে একটা সুন্দর বিয়ের কার্ড । হাত জোড় করে বলেন : আপনি আমাদের সঙ্গে গেলে ভালো হত । মনে-হল ওইখানেই আমার ছেলের বিয়ে দিলে ভাল হবে । কোন দাবি দাওয়া রাখিনি । রাখবোই বা কেন ! বৌমা ত আমার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী । পণ চেয়ে ছোট হব কেন বলুন ? "আমার বৌমা তো নিজেই এটিএম মেশিন, পণের কি হবে ?" বলে হ্যা হ্যা করে হাঁসেন । 
আমি ভদ্রলোকের মুখের পানে হাঁ করে তাকাই আর ভাবি ,"ভাগ্যিস ভদ্রলোকের সঙ্গে যাইনি" ।