Wednesday, October 29, 2014

অনুগল্প ইন্দ্রধনু ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী



      




অনুগল্প 



ইন্দ্রধনু 
ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী



পারুল সবে +২ সাইন্স এ এ্যাডমিসন নিয়েছে । প্রথম দিন কলেজে সিনিয়র মেয়েরা র‍্যাগিং আরম্ভ করাতে খুব অস্বস্তি লাগছিল। মেয়েরা আবার র‍্যাগিং করে ! খুব শ্রুতিকটূ, তবুও মানতে বাধ্য, উপায় নেই । খুব ভাল পড়াশুনোয় না হলেও পারুল ফেলে দেওয়ার মত মেয়ে নয় । ৯২ শতাংশ নম্বর পেয়েছে সি বি এস সি তে । 
সকালে প্রাক্টিকাল ক্লাসে যাওয়ার সময় ওদের পাডার ছেলে অনির্বাণের সঙ্গে দেখা । 
- এই অনির্বাণ দা শোন , বলে হাঁপাচ্ছিল পারুল । 
- কি বল ? 
- আমার সঙ্গে কলেজ অবধি যাবে ? 
- না যাওয়ার কি আছে ? আমিতো কলেজেই যাচ্ছি । 
- হ্যাঁ, জানি । তুমি কি সাইন্স নিয়েই পডছো অনির্বাণ দা ? 
- হ্যাঁ, পিওর সাইন্স । আমার ‘কম্প্যুটার’ ফোর্থ অপশনাল । 
- ও, তবে ত ভালোই, বল ! 
- কেন ? 
- আমিও ‘কম্প্যুটার’ ফোর্থ অপশনাল নিয়েছি । 
- হুঁ। ভালো করেছ। খাটুনি আছে। প্রোজেক্ট করতে হবে। পারবে তো ? একটু গুরু গম্ভীর ভাবে বলে। 
- পারতে হবে । না পারার কি আছে ! একটা কথা বলবো অনির্বাণ দা ! 
- বল । 
- আমার না ভয় করে সিনিয়রদের । 
- কিছু ভেবোনা আমি বলে দেব ওদের। ফাজিল ছেলে সব । 
- না না - শুধু ছেলেরা নয় মেয়েরাও আছে ওই মহৎ কাজে । কি করে সময় পায় ওরা ? আমার ভয় করে । তুমি যদি ওদের একটু বলে দিতে “তোমার বোন বলে”! 

অনির্বাণের ভুরু কুঁচকানো সহজেই অনুমেয় ! পারুলের চোখ এড়ালোনা । 
- ঠিক আছে । বলে দেব । 

এরমধ্যে কলেজ ক্যাম্পাস এসে যায় । পারুল দ্রুত বেগে এগোয় ক্লাসের দিকে ।
অনির্বাণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে পারুলের হাঁটার পথের দিকে । এটাই কি হয় সবার ! নিজেকে ছোট মনে হয় । ও হাঁটতে শুরু করে ক্লাসের দিকে !

ইন্দ্রধনুর সাত রঙ্গের কোন রংটা মনে লেগেছে বুঝতে পারে না অনির্বাণ । তবে কিছু একটা ঘটেছে । তাও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে । তবে রংটা টিকবে কিনা জানেনা !



Sunday, October 12, 2014

সার্কিট হাউস / ত্রিভুবন জিত মুখার্জী /


 
    

সার্কিট হাউস
ত্রিভুবন জিত  মুখার্জী

আজ থেকে বহু বছর আগের কথা । তা প্রায় ৪০ বছর তো হবেই। আমার বয়েস ৯ - ১০ হবে তখন আমরা কোরাপুট জেলার মাছকুন্ড’ বলে উডিশ্যার এক জায়গা তে কিছুদিন ছিলাম উডিশ্যার জয়পুর’ থেকে প্রায় ৪০ কি মি দক্ষিণে । টানা পাহাড়ের ওপর ঘাট রাস্তা তখন দিনে একটা বাস চলত । বাবার সঙ্গে আমরা জিপে যেতাম মাছকুন্ড । খুব ভয় করতো যখন  জিপটা পাহাড়ের গা ঘেঁসে চলত ।

অন্ধ্র প্রদেশের গোদাবরি নদীর এক শাখা নদী মাছকুন্ড নদী । এই নদী হঠাৎ দিগ পরিবর্তন করে জল প্রপাতে পরিনত হয় নাম ডুমডুমা জলপ্রপাত” চারিদিকে পাহাড ঘেরা এক মনরম জায়গা । শান্ত পরিবেশ । জলপ্রপাতের গুরু গম্ভির গর্জনে কম্পিত পরিবেশ ।

এখানে ১৯৫৫ সালে তৈরি হয় জলাপুট ড্যাম । জলা’ মানে জল পুটমানে ঘর অর্থাৎ জলের ভাণ্ডার । এইখানে তৈরি হয় মাছকুন্ড হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট আন্ধ্র এবং উডিশ্যার মিলিত উদ্যমে । ৩৪.২৭৩ টি এম সি জলকে জলপ্রপাত থেকে ১৫ কিমি টানেল দিয়ে ১২০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় ১৯৫৫ সালে। এখন অবশ্য এই প্রজেক্ট পুরন হয়ে গিয়েছে যার নব-কলেবরের প্রয়োজন । সেটা থাক ।  ১৯৫৮ র কথা, তখন ওই জায়গা  ছিল  গভীর জঙ্গলে ভরা, নির্জন  । সভ্যতার কোন চিহ্ন  ছিলোনা । কিছু আদিবাসী এবং কিছু সরকারি বাবু । কেউ তাদের পরিবারের সঙ্গে থাকতেন কেউ একা। কিছু তেলেগু উড়িয়া এবং আমরা একমাত্র বাঙ্গালী পরিবার । অবশ্য আমরা ছুটি কাটাতে যেতাম ওখানে কারণ আমার পিতৃদেব ওখানকার একজন অফিসার ছিলেন । আমাদের পড়াশুনোর জন্য তিনি একাকীত্ব বেছে নেন সে প্রসঙ্গে আসি । সেই ১৯৫৫ সালের আগে ওই জলাপুটে আসেন কিছু জার্মান ইঞ্জিনিয়ার । তাদের জন্য সার্কিট হাউস তৈরি হয়েছিল যাতে কোন অসুবিধে না হয় ।
আজ সেই সার্কিট হাউসের কথা বলি । জার্মান সাহেবরা ঘর দোর ছেডে এই বিদেশ ভুঁইতে এসে আমাদের দেশের ঘরে ঘরে আলো জ্বালাতে আসেন কিন্তু তারই মধ্যে ঘটে কিছু অঘটন ।

ওই নির্জন বনানীতে এক সুন্দরি তেলেগু মহিলা ছিলেন নাম
 জি.পূর্ণিমা । তিনি কোন এক কর্মচারীর কন্যা । যেমন দেখতে ঠিক সেরকম গান গাইতেন মহিলা । আর জার্মান সাহেবের নাম আলেকজান্ডার পল । সুধু পল সাহেব বলেই ওনাকে ডাকতেন সবাই। বয়েসটা অল্প । পল সাহেব যেমন সুন্দর দেখতে ছিলেন সেইরকম অমায়িক ব্যাবহার ছিল ওনার। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসতেন। খুব ভালো টেনিস খেলতেন এবং পিয়ানো বাজাতেন। প্রসঙ্গত পল সাহেব ওই পূর্ণিমাদের বাডী যেতেন গান শুনতে । অভিভূত হয়ে গান শুনতেন পল সাহেব আর সেই গান পিয়ানোতে বাজাতেন সার্কিট হাউসে । সেই সঙ্গীতের মূর্ছনায় দু জনের মধ্যে কোথায় কখন প্রেম সৃষ্টি হয় কেউ বুঝে উঠতে পারেনি কখন। এটাই মুল সুত্র । এর পর চলে চুপি চুপি দেখা আর প্রেমের আদান প্রদান । বোধ হয় ওই একটাই চিত্ত বিনোদনের উপায় । তখন ওখানে না ছিল বায়স্কোপ না ছিল এখনকার মতন টিভি ভিডিও,ক্রিকেট ফুট বল খেলা ইত্যাদি। তাই দুই হৃদয়ের মিলন ঘটে অজান্তে । ক্রমে পূর্ণিমা অন্তঃসত্ত্বা হন । এর মধ্যে পল সাহেব পূর্ণিমাকে প্রায় স্ত্রীর দরজা দেওয়ার জন্য প্রস্তাব রাখেন তার বাবার কাছে । কিন্তু সমাজের ভয়ে তার বাবা গর রাজি হন ফিরিঙ্গীর হাথে কন্যা সম্প্রদান করতে । রক্ষণশীল সমাজে তা গ্রহণিয় নয় । বিশেষ করে সে যুগে । পল সাহেব ব্যথিত হন । এর মধ্যে কিছু দিন কেটে যায় । ওদের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ । 

সে দিন ছিল পৌষ পূর্ণিমা । পূর্ণিমা চুপি চুপি সার্কিট হাউসে যায় কিন্তু দেখে পল সাহেব নেই । তাকে না জানিয়ে পল সাহেব চলে জান । সে কান্নায় ভেঙ্গে পডে । ওখানেই আত্মহত্যা করে গলায় দডি দিয়ে। সকালে সবাই দেখে হতচকিত হন। এ হেন জায়গায় এরকমটি কেউ আশা করে নি । পুলিশ আসে । ময়নাতদন্ত হয় । পল সাহেব এই ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে ফিরে জান ভিজয়নাগরম হয়ে মান্দ্রাজ । ওখানথেকে দেশে পাডি দেন। সেই সার্কিট হাউসে এর পর আর কোন সাহেব থাকেননি কারন পূর্ণিমা ঠিক পূর্ণিমার দিন রাতে বেরুত খোলা চুলে । ওই নির্জন পরিবেশে কার বাবা সার্কিট হাউসে থাকবে আজও পূর্ণিমার অতৃপ্ত আত্মা পল সাহেবের অপেক্ষায় । মৃদু সঙ্গীতের ঝংকার শোনা যায় আর শোনা যায় পুর্নিমার হাসি কান্নার শব্দ । পল সাহেব কি জানেন পূর্ণিমার কি হল ? আজ ও ওই সার্কিট হাউসে কেউ একলা থাকেনা ।

আর পুর্নিমার দিন বন্ধ থাকে সার্কিট হাউসের দরজা।