নারীমুক্তিতে রবীন্দ্রনাথ ও ১৯৩৬
'পুরুষের আছে বীর্য আর মেয়েদের আছে মাধুর্য' আর 'মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্রেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টির আলো কল্পনাবৃত্তি' কিংবা যদি বলি নারীর পক্ষে কবি বৈজ্ঞানিক প্রধানমন্ত্রী হওয়া অস্বাভাবিক কেননা নারী সহজাতভাবেই পায়নি মানুষের সেই গুন,যা দরকার ওইসব সামাজিক মানবিক সাফল্যের জন্যে। এইটুকু পড়ে লেখাটি যে কোন পাঠকের কাছে প্রলাপ মনে হবে নয়ত মনে হবে সময়ধারণাহীন একটি লেখা ।কিন্তু এখানে পড়াটা না থামিয়ে যখন এগিয়ে এসে পড়বেন কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন! চোখ কি স্থির হয়ে এলো? (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি,রবীন্দ্র রচনাবলী খন্ড ১৯,পৃঃ ৩৭৯,৩৮৫)প্রেম মাধুর্য নারীকে গৃহে আটকে রাখে,তা মধুর ও আলোকিত করে ঘরকে,আর পুরুষের বীর্য ও প্রতিভা উপভোগ ও আলোকিত করে বিশ্ব ও সভ্যতাকে। নারীর ব্যর্থতার মূলে তার জরায়ু । রবীন্দ্রনাথ বলেন,'বস্তুত জীবনপালনের কাজটাই ব্যক্তিগত। সেটা নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের কোঠায় পড়ে না, সেই কারণে তার আনন্দ বৃহৎ তত্ত্বের আনন্দ নয়, এমন কি মেয়েদের নৈপুণ্য যদিও বহন করেছে রস, কিন্তু সৃষ্টির কাজে আজও যথেষ্ট সার্থক হয়নি' (‘নারী’ কালান্তর) রবীন্দ্রনাথ,তার সময়ের অধিকাংশ মহাপুরুষের মতোই,নারীমুক্তির বিরোধী ছিলেন। যে নারীরা পুরুষাধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্তির কথা বলে,তারা বিকারগ্রস্ত বলে বিশ্বাস করেন তিনি।প্রাকৃতিক স্বাভাবিক নারী কল্যানী হয়ে থাকবে গৃহে,প্রেম হবে তাদের জীবনের একমাত্র মূলধন,শুধু বিকৃত নারীরাই প্রতিষ্ঠা পেতে চায় বাইরে।
প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয় জোড়াসাকোঁর ঠাকুর পরিবার উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় প্রবর্ত্তনমূলক যে সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্ত্তন দেখা দিয়েছিলো সেগুলির বেশীরভাগ বীজ বপনের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। নারী মুক্তির বিষয়টিও এর ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্রনাথের দাদাঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪২এ বিলাত থেকে ফিরে নারী শিক্ষা এবং তাদের লক্ষ্য করে সমাজ সংস্কারের স্বপক্ষে বার বার তার কন্ঠ মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ চারিত্রিক দিক থেকে কিছুটা রক্ষণশীল হলেও নারী শিক্ষার জন্য বেথুন বিদ্যালয় স্থাপনে সমর্থন করেছিলেন এবং তার কন্যা এবং পরিবারের অপর নারী সদস্যদের বিবিধ শিক্ষা এবং সামাজিক কাজে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী কে আধুনিক নারীর হাব ভাব সৃজনে রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপিত করেছিলেন। পোশাকেও তিনি আধুনিক তাছাড়া নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন এবং স্বামী ছাড়াই তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রথমবার ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। তবে রবীন্দ্রনাথ কেন পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিদের দলে ছিলেন!
রবীন্দ্রনাথ পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ। তিনি রুশো রাসকিন সহ আরো অনেককে দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। নারী বিষয়ক তার লেখা প্রচুর কিন্তু তার লেখাগুলো ধাঁধায় ভরা,অনেক সময় কথা বলার জন্যেই কথা বলা। ঘুরিয়েপেঁচিয়ে অনেক সুন্দর কথা তিনি বলেছেন, যা প্রথমে মুগ্ধ করে কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে কিংবা পড়লে ধরা পড়ে যায় যে নারীকে তিনি দেখেছেন অসম্পূর্ন মানুষ রূপে। রবীন্দ্রনাথের নারীধারণা বিবর্তনের আলোচনায় পরে আসছি, তার আগে চলুন গভীর মনযোগে তার দুটি কবিতা পড়ি কেননা এই কবিতা দুটোতে প্রকাশ পায় পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষের চোখে নারীধারনার সম্পূর্ণ রূপ নারীর বাস্তবতা ও অবাস্তবতা । ‘সোনারতরী’ কাব্যের সোনার ভাধন একটি কবিতা আছে যা তিনি লিখেছিলেন ১২৯৯এ কবিতার নাম সোনার বাঁধনঃ
“বন্দি হয়ে আছো তুমি সুমধুর স্নেহে
অয়ি গৃহলক্ষ্মীঁ,এই করুণ ক্রন্দন
এই দুঃখদৈন্যে ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কন দুটি বহিতেছে দেহে
শুভচিহ্ন,নিখিলের নয়নক্রন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিনাঙ্ক কঠিন
সংসার সংগ্রামে,সদা বন্ধনবিহীন......
রবীন্দ্রনাথ যখন গৃহিনীর দিকে দেখছেন, দেখছেন রোমান্টিক দৃষ্টিতে যদিও তিনি নিজের ঘরেও অমন কোন দেবী দর্শন পাননি । তবে তিনি চান বাস্তবে নারী হবে কেবল গৃহিনী ।রোমান্টিক চোখে নারীর আরেক রূপ ১৩০২এ লেখা ‘মানসী’ কবিতায় তা যেন স্পষ্টতা পেলঃ
“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী......”
এই কবিতাটি সম্পূর্ন পড়া শেষ করে চমত্কৃত হবে যে কোন পাঠক কিংবা পাঠিকা । কিন্তু ভেবে দেখুন তো এই কবিতায় পুরুষ নারীর দ্বিতীয় বিধাতার ইংগিত দেয় কিনা যে অনেক শক্তিশালী প্রথম বিধাতার থেকে। যদি প্রশ্নের বুদবুদ মনের কোণে জাগে তবে কি স্পষ্ট মনে হয়না প্রথম বিধাতা সৃষ্টি করেছে আর দ্বিতীয়টি সৃষ্টির নামে বন্দী করেছে নারীকে ! আরো লক্ষণীয় কবিতাটিতে সক্রিয় পুরুষ স্রষ্টা, স্থপতি,ভাস্কর,কবি, শিল্পী । আর নারী নিষ্ক্রিয় কেবল পুরুষ বিধাতার তৈরী মূর্তি আর ভোগপন্য । কবিতাটি সুক্ষতায় অস্বীকার করে নারীর বাস্তব অস্তিত্বকে যেমন অনেকটা তারচেয়েও বড় এখানে নারী সব কিছুতেই অর্ধেক আর দ্বান্দিক মতে নারী যদি পুরুষের চোখে অর্ধেক হয়ে থাকেন তবে নারীর চোখেও পুরুষ অর্ধেক কল্পনা হওয়ার কথা এবং তারচেয়েও বড় প্রশ্ন কিংবা মজাই বলবো রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এখানে অর্ধেক যুক্তিবিদ্যায় ।
রুশো ও রাসকিনের নারীবিষয়ক লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন তিনি। বোঝা যায়, নারী সম্পর্কে তাঁর অনেক উক্তিই রুশো রাসকিনের প্রতিধ্বনি। মিল’এর সাথেও পরিচিত ছিলেন । যদিও মিলএর সাথে তার মিল ছিলো না, তার মিল ছিলো টেনিসনের সাথে, এবং প্রিন্সেস এর নারীবিষয়ক ধারণা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদায়। ছক ভাঙা নারীকে ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করার সফল উদাহরণ ‘চিত্রাঙ্গদা’(১২৯৯)। চিত্রাঙ্গদা ভিক্টোরীয় যুগের ঘরে বাইরে বা পৃথক এলাকা কিংবা সহচারীতত্ত্বের এক নিরীক্ষা, যাতে প্রমান করা হয়েছে যে নারী স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার অযোগ্য । সে হতে পারে বড়োজোর পুরুষের সহচরী।
১২৯৮এ রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তি সম্পর্কে স্বেচ্ছায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নারীমুক্তিবাদী কৃষ্ণভবানী দাসের সাথে । এখানে জেনে রাখা প্রয়োজন প্রগতিশীল পরিবারের সন্তান হয়েও নারী সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরী ও বদ্ধমূল করে নিয়েছিলেন বিশ একুশ বছর বয়সে । যা তিনি লালন করেছেন তার আশি বছর পর্যন্ত। তিনি নারীর দুটি বিপরীত ধ্রুবরূপে বিশ্বাস করেছেন প্রিয়া ও জননী, উর্বশী ও কল্যানী বা পতিতা ও গৃহীনী। প্রথম রূপটি স্বপ্ন দেখেছেন তিনি কবিতার জন্যে, দ্বিতীয় রূপটি তিনি চেয়েছেন বাস্তবে। তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাসে এই রূপ দুটি ফিরেফিরে এসেছে । উদাহরণ দাবী করে যদি মন , উর্বশী(১৩০২,চিত্রা), বলকার(১৩২১) , কল্যানী(১৩০৭,ক্ষণিকা) পড়ুন। চিত্রাঙ্গদার ছকের মিল দেখা যায় অতি জনপ্রিয় শেষের কবিতার (১৩৩৬) লাবণ্যের মধ্যে । তাকেও রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদার মতই ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করেছেন। সাতাত্তর বছর বয়সে এসে রবীন্দ্রনাথ যখন নারী(১৯৩৭,সানাই) নামের কবিতা লেখেন এর অর্থ দাঁড়ায় আদিতে ছিলো পুরুষ, নারী তখন ছিলো না। নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো পুরুষের স্বাতন্ত্র্যস্পৃহা নিয়ন্ত্রণের জন্যে, নারী দেখা দিয়েছিলো আনন্দরূপে। কে সৃষ্টি করেছিলো নারীকে ?তবে ধরে নেয়া যায় নাকি সেই সৃষ্টিকর্তা পুরুষ ?
১৯৩৬ এর অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ নিখিলবঙ্গ মহিলা কর্মী সন্মিলনে আমন্ত্রিত হয়ে পড়েন 'নারী' (কালান্তর,ররঃ২৪,৩৭৭-৩৮৩) প্রবন্ধটি। প্রবন্ধটি লিখেছিলেন তিনি নারীদের আমন্ত্রণে, যে নারীরা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তারা ছিলেন মুক্ত এবং মুক্তিপিপাসু লালিত বিশ্বাস অপ্রকৃতিস্থ । এই প্রবন্ধেই রবীবাবুর বিবর্তনের দুটি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া যায় এবং এই আমন্ত্রণ ইতিহাসের পাতায় রবীন্দ্রনাথ কে নতুন পরিচয় দিয়েছে। আমার মতে তাই ১৯৩৬ রবীন্দ্রনাথের জন্য নোবলপ্রাপ্তি বছরের চেয়েও ঐতিহাসিক ও মূল্যবান কেননা এই আমন্ত্রণ না জানালে তার তিরোধান ঘটতো নারীমুক্তিবিরোধী পুরুষতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত রূপে। আমন্ত্রিত হয়ে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, কাটিয়ে ওঠেন নিজের আযৌবন প্রগতিবিরোধিতা, স্বীকার করে নেন নারীমুক্তিকে । আর তাই জোরালো ভাবেই বলা যায় নারীরাই সৃষ্টি করেন এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে যখন তার বয়স পঁচাত্তর। যে নারীমুক্তি এতদিন তার কাছে ছিলো অপ্রকৃতিস্থ একদল নারীর আস্ফালন, তা এখন তার কাছে হয়ে ওঠে অনিবার্যঃ
এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গন্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা ভাঙার যুগ এসে পড়েছে।....বাহিরের সঙ্গে সংঘাতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে,নতুন নতুন প্রয়োজনের সঙ্গে আচার বিচারের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে” (কালান্তর) । যে গৃহ একসময় ছিলো তার চোখে নারীর অনিবার্য এলাকা, তা হয়ে ওঠে অতীতের ব্যাপারঃ“কালের প্রভাবে মেয়েদের জীবনের ক্ষেত্র এই যে স্বতই প্রসারিত হয়ে চলছে,এই যে মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়ছে,এতে করে আত্মরক্ষা এবং আত্মসন্মানের জন্যে তাদের বিশেষ করে বুদ্ধির চর্চা,বিদ্যার চর্চা,একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠল”(কালান্তর)

রবীন্দ্রনাথ নতুন কল্প আশার যে কথা লিখেছেন যাতে পুরোপুরি অংশ নেবে নারীরা তবু সুখকর হচ্ছে যে পঁচাত্তর বছর বয়সে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ এবং আরো সুখকর এই যে ১৯৩৬ এ নারীরাই তাঁকে রূপান্তরিত করেছিলো আর ইতিহাসকে নতশিরে লিখতে হয়নি নারীমুক্তি বিরোধী রবীন্দ্রনাথের নাম ।