সংস্কৃত
অতনু বর্মণ
ফরফর করে কেউ ইংরাজি বললে আমবাঙালি যেমন তার দিকে সমীহ করে তাকায়, একদা সংস্কৃত ভাষাটির ছিল সেই দাপট। অং বং চং বলা পণ্ডিতের কদর ছিল সর্বত্র। অধুনা ভাষাটি সংস্মৃত হলে কী হয়, অন্নপ্রাশন থেকে পিণ্ডদান পর্যন্ত এই ভাষার উপস্থিতি এখনও অটুট। ঠাকুরমশাই যা বলেন, অর্থ না বুঝেই তা আওড়ে যাওয়া বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছে। ফি-বছর মহালয়ায় বাঙালি রেডিওতে ব্যাটারি লাগায়, কেউ কেউ রেডিওটাই কিনে আনে বাড়িতে। তারপর সারা বছর সেটায় পিঁপড়ে ডিম পাড়ে, মাকড়সা জাল বোনে এবং মহালয়ার আগের দিন তাকে চেক-আপে নিয়ে যাওয়া হয়। দোকানদার বলে, ‘এ আর চলবে না, একটা নতুন নিয়ে নিন, কতই বা দাম’! পুজোয় নতুন জামা, নতুন জুতোর মতোই বহু বাড়িতে নতুন রেডিও কেনা হয় ‘যা দেবী সর্বভূতেষু’ শুনবে বলে।
অর্থ না বুঝলে কী হয়, অর্থ বানিয়ে নিতে বাঙালির ধারেকাছে আসবে না কেউ। সেই কবে শিব্রাম চকরবরতি মশাই ‘কাকস্য পরিবেদনা’-র স্বকৃত অর্থ করেছিলেন- ‘কাকে বেদানা খাচ্ছে’, সেই রীতি আজও বহমান। দেশগাঁয়ে বড়-বাইরেকে বলা হয় বাহ্যে যাওয়া। আমাদের শ্যামাদাস বহুদিন জানত যে, ‘বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া’ মানে বাহ্য করার পূর্বে অনুষ্ঠিত লঘু ক্রিয়াগুলির কথা বলা হচ্ছে। জানি না ‘এহ বাহ্য’ বলতে সে কী বুঝতো!
ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে শোনা একটা গল্প মনে পড়ে গেল। গাঁয়ের মাতব্বর পালমশাইয়ের ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা, যদিও তার তিনকুলে কেউ সরস্বতীর স্পর্শলাভ করেনি। এহেন পালমশাই গেছেন বদ্যিবাড়ি। কবিরাজ পালমশাইয়ের নাড়ি ধরেই চোখ বন্ধ করে বলে গেলেন-‘ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ম মহাদ্যুতিম, ধ্বন্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্রণতস্মি দিবাকরম’। কবিরাজ যে সূর্যপ্রণামের মন্ত্র জপলেন, সে বোঝা তো পালের সাধ্য নয়। পাল ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কী বলছেন কোবরেজমশাই, কিছুই তো বুঝতে লারলম, টুকচি বুঝাইন দ্যান’। কবিরাজ তখন বুঝিয়ে বললেন, ‘ওঁ জবাকুসুম মানে তোর চোখ জবাফুলের মতো লাল হয়েছে। সঙ্কাশং মানে সঙ্গে কাশিও আছে শুধু নয়, কাশ্যপেয়ম মহাদ্যুতিম অর্থাৎ খুব ঘন ঘন কাশি হচ্ছে। ধ্বন্তারিং সর্বপাপঘ্ন অর্থাৎ আমি সব রোগের ধন্বন্তরি। প্রণতস্মি দিবাকরম মানে প্রণামীটা আগে দে বাবা’!
আমাদের অল্পবিস্তর সকলেরই ধারণা যে, সংস্কৃত মানেই অনুস্বারের বাড়বাড়ন্ত। অং বং চং সহ হিং টিং ছট প্রভৃতি নানান কিসিমের বাকবিন্যাসে আমরা এক একজন সংস্কৃত পণ্ডিত। রঙচঙ মেখে হংকং ঘুরে আসা থেকে ক্রিংক্রিং সাইকেল, ঢং-ঢং ঘন্টা, এমনকি কাবলিওলার হিং অথবা সিনেমায় কিং কং- সবই আমার সংস্কৃত মনে হয়।
এই সূত্রে আবার ঠাকুমার ঝুলি এবং আবার একটি গপ্পো। পদ্মলোচন পিতৃমাতৃহীন। খুড়ো আর খুড়িমার নয়নের মণি। নিরক্ষর খুড়ো আদরের পদ্মলোচনকে ভর্তি করেছিলেন পণ্ডিতের টোলে। এদিকে পদ্মলোচনের মোটেও বিদ্যায় রুচি নেই। তার ধারণা, ‘বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ’। কোনওক্রমে বছর ঘুরতেই টোলফেরত ভাইপো বাড়ি ফিরছে শুনেই খুড়ো সেঁধিয়েছেন খাটের তলায়। পণ্ডিত ভাইপোর সঙ্গে নিরক্ষর খুড়ো কথা বলবে কী করে! এদিকে গুণধর ভাইপো ঘরে ঢুকেই বলল, ‘খুড়িং খুড়িং, খুড়োং কোথাং’? সরলা খুড়িমা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলেন, ‘অনুস্বার লাগালে যদি সংস্কৃত হয়/তবে কেন খুড়ো তোমার খাটের তলায় রয়’।
এগুলো গল্পই। যদিও গল্প হলেও মেসেজটি পরিষ্কার। সংস্কৃত ভাষাটির অনুসারী দুই প্রকার। প্রথম পক্ষ হল তারা, যারা সংস্কৃত বোঝে না। আর দ্বিতীয় পক্ষ হল তারা, যারা একটু বেশি বোঝে। যারা বোঝে না, তাদের নিয়ে গন্ডগোল কম। তারা অনুস্বার লাগিয়ে মজা করে আর যারা বেশি বোঝে তাদেরকে নিয়েই মুশকিল। এরা সবকিছুকে সংস্কৃতের গর্ভজাত করে প্রমাণ করতে না পারলে শান্ত হয় না। একইরকম এক বেশি বোঝা সংস্কৃত পণ্ডিতের দাবি যে, দার্জিলিং শব্দটির উৎস নাকি ‘দুর্জয় লিঙ্গ’ শব্দ থেকে। কে যে কোথা থেকে এসেছে- দেবা ন জানন্তি। বৈদিক ভাষাকে সংস্কার করার ফলে যা দাঁড়াল, তারই নাম ছিল সংস্কৃত। কালে কালে যাকে আমরা বহিষ্কার করেছি এবং ভাষাটি এখন বহিষ্কৃত। ভাষাটির পোশাকি নাম দেবভাষা। দেবদেবীর ভাষা নিয়ে মানুষের কী বা কাজ! অন্তঃসারশূন্য বাঙালি তাই সংস্কৃতকে বরণ করেছে একটিমাত্র বর্ণে- ‘অনুস্বার’। বর্ণকে কোমল করে যদি বরণ হয়, তাহলে কি মর্ণ থেকে আগত- চন্দরা কহিল- ‘মরণ’।